গল্পের নাম : #শ্রাবনের_মেঘ
লেখিকা : ফারিয়া
পর্ব : ৫
শ্রাবন বলে উঠলো,
” কি হয়েছে মেঘা? ”
মেঘা উত্তর দিলো,
” কিছু হয়নি, আসলে আমার তারাভরা আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে। ছোট থেকেই ভালো লাগে, চাদের মায়াবী আলোয় নিজেকে খুব স্নিগ্ধ লাগে। ”
শ্রাবন আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর দুজনে ঘরে চলে গেলো। মেঘা সোফায় শুতে যাওয়ার সময় শ্রাবন বলে উঠলো,
” তুমি নিশ্চিতে বিছানায় ঘুমাতে পারো। তোমার বিনা অনুমতিতে আমি তোমায় ছোবো না। ”
মেঘা অন্যরকম অনুভূতির ছোয়া পেলো। ভাবলো, এই মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়। তাই সে আর কিছু না ভেবে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। তার প্রতি এতো বিশ্বাস দেখে শ্রাবনের নিজেরও বেশ ভালো লাগলো। সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। পরেরদিন সকালে মেঘা নামাজ পড়তে উঠে দেখলো শ্রাবন নিজেও নামাজ পড়তে উঠেছে। শ্রাবনের এই গুনটা মেঘার খুব ভালো লাগলো। আর একটু পর মেঘা নিচে নামতেই দেখে ইশা আহম্মেদ এবং শেফালী আহম্মেদ দুজনে সকালের নাস্তা তৈরি করছে। মেঘা ইতস্তত করে বললো,
” আসসালামু আলাইকুম, আন্টি আমি আপনাদের একটু সাহায্য করি? ”
মেঘা মাথা নিচু করে রইলো। শেফালী আহম্মেদ ধমকে বললো,
” না, ওতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। যেই মেয়ে আমাদের আপন ভাবতে পারে না, আমাদের সাহায্য করার কোনো অধিকার নেই তার। ”
মেঘা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। শেফালী আহম্মেদ আগের মতোই কঠোর স্বরে বললো,
” আমরা কি তোমার মা নই? কেনো আমাদের আন্টি বলে ডাকবে তুমি? যখন আমাদের আপন ভাববে, তখন আমাদের সাহায্য করবে। ”
মেঘা কান্না মিশ্রিত স্বরে বললো,
” আসলে আমি ভেবেছিলাম, উনার মতো যদি আমিও আপনাদের মা এবং মামনি বলি তাহলে হয়তো রাগ করবেন। সেই ভয়ে বলি নি। ”
শেফালী আহম্মেদ হেসে বললেন,
” ধুর বো/কা মেয়ে, আমাদের একটা মেয়েরই অভাব ছিলো। তোমায় পেয়ে সেই অভাব পূর্ণ হলো, আর তুমি আমাদের মা ডাকলে আমরা ধন্য হবো। যেনো মনে হবে দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষিত সেই জিনিসটি পেয়েছি। আর আমরা তো দা/জ্জা/ল শাশুড়ী নই, তুমি এখন থেকে আমাদের মেয়ে। আর এতো ছিচকাদুনে হলে হবে নাকি বলো? ”
মেঘা হুট করে জড়িয়ে ধরে বললো,
” মা এবং মামনি, এবার আমি তোমাদের একটু সাহায্য করতে পারি? ”
ইশা আহম্মেদ এতোক্ষন চুপ করে মেয়েটিকে দেখলো, কেনো জানি এই মেয়েকে দেখলে তার মনে হয় নাড়ীর একটি টান রয়েছে। মনে হয়, কতো বছরের চেনা! কিন্তু হিসাব মেলাতে পারে না। আড়ালে চোখের জল মুছে রান্নার কাজে মনোযোগ দিলো। অন্যদিকে মেঘা ভাবছে, তাকে দেখলেই কেনো মামনি এমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ওতো কিছু না ভেবে সবাই মিলে হাতে হাতে রান্নার কাজটি শেষ করলো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাই এলো, কিন্তু শ্রাবন এখনো এলো না। মাহিন সাহেব বলে উঠলো,
” মেঘা মা, তুমি গিয়ে শ্রাবনকে ডেকে আনো৷ ”
মেঘা ভ্রু কুচকে বললো,
” বাবা, শ্রাবন কে? ”
উপস্থিত সবাই মেঘার কথা শুনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মত্ত হলো। ওদের হাসি দেখে মেঘা বো/কা বনে গেলো। তখনই সিড়ি দিয়ে নেমে এলো শ্রাবন, ইফতি বলে উঠলো,
” আরে পিচ্চি ভাবি, তুমি জানোই না শ্রাবন কে? ”
মেঘা মাথা নাড়ালো। ইফতি আবারও বললো,
” তোমার জামাইয়ের নাম কি জানো? ”
মেঘা মেকি হাসি দিয়ে বললো,
” ইয়ে মানে না ”
সবাই আরেকদফা হেসে দিলো, এবার শ্রাবন নিজেও হেসেছে। ইফতি বলে উঠলো,
” ওইযে দাঁড়িয়ে আছে, মানে তোমার জামাইয়ের নাম হলো শ্রাবন আহম্মেদ। বিয়ের সময় নাম শুনো নি? আর যেহেতু শ্রাবন আর আমি একই বয়সী, তাই তোমায় পিচ্চি ভাবি বললাম। ডোন্ট মাইন্ড, তাছাড়া তুমি আমার ছোট বোনেরই মতো। ”
ইফতির মুখে তার ছোট বোন শুনে ইশা আহম্মেদ যেনো থমকে গেলো। মেঘা হেসে সমস্যা নেই জানালো। শ্রাবন এবার বসে বললো,
” উনি বিয়ের সময় শুনেই নি রে ইফতি, না জানি কই হারিয়েছিলো। ”
সবাই একসাথে খেতে লাগলো। মেঘা ভাবলো, বাহ মানুষটির নাম ‘ শ্রাবন ‘। প্রিয় ব্যক্তিত্বের একজনের সাথে পূর্ণ মিল রয়েছে। এই মানুষটিই কি উনি? ধুর, নিজের ভাবনায় নিজেই হাসলো মেঘা। মেঘাকে কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলো শ্রাবন, তারপর ওখান থেকে শপিংমলে গেলো। কয়েকটি ড্রেস কিনে দিয়ে বাসায় এসে পড়লো৷ বিকাল এবং সন্ধ্যায় সবাই মিলে মজায় কেটে গেলো। এর মাঝেই মেঘা তার মায়ের সাথে কথা বলেছে, শ্রাবনের ফোনে কল আসতেই উঠে গেলো। কিছুক্ষন পর মেঘাকে ডাকতেই মেঘা উঠে গেলো। মেঘার হাতে ফোনটি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” নাও কথা বলো ”
মেঘা ফোনটি কানে নিতেই, ওপাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ওপাশের ব্যক্তিটি বলে উঠলো,
” মেঘ রাজ্যের মেয়েটি বুঝি জামাই পেয়ে আমায় ভুলেই গিয়েছে? ভালো ভালো। কে জানি বলতো, ভাইয়া আমি যেখানেই থাকি তোমায় ভুলবো না। এখন তো সেই নমুনাই দেখছি ”
মেঘার ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বলে উঠলো,
” রাজ ভাই! ”
ওপাশ থেকে রাজ হেসে বললো,
” বাহ! চিনতে পেরেছিস তাহলে। আমি তো ভাবলাম ভুলেই গেছিস আমায় ”
মেঘা বলে উঠলো,
” নিজেকে আমি ভুলতে পারি, তোমাকে যাবে না ভোলা। বুঝলে রাজ ভাই? তোমায় ভুলি কি করে বলো তো? আমার তো ফোন নেই, কিভাবে ফোন দিবো তোমায়? আর তুমিই তো আমার ভাই, বেষ্ট ফ্রেন্ড সবই। আর তুমি আমার জামাইয়ের নাম্বার কিভাবে পেলে? ”
রাজ বুঝতে পারলো, মেঘা এখনো কিছু জানে না। তাই, কথা ঘুরিয়ে কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে দিলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকালে, মেঘা চুল আচড়ানোর সময় শাড়ির আঁচল মাথা থেকে নামিয়ে দিলো। আয়নায় তাকাতেই হঠাৎ শ্রাবনের চোখ পড়লো মেঘার গলার দিকে। ও যেনো আকাশ থেকে পড়লো, উঠে গিয়ে মেঘাকে এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
” তোমার গলার এই চেইন লকেট তুমি কোথায় পেয়েছো? ”
মেঘা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই দুদিনে কি আজই প্রথম দেখলো উনি? মেঘা বললো,
” এটা তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমার কাছে আছে। আপনি কি এর আগে এটা লক্ষ্য করেন নি? ”
শ্রাবন গভীরভাবে সেটা দেখতে লাগলো। হুট করে বলে উঠলো,
” কে তুমি? ”
মেঘা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। বলে কি এই মানুষ। মেঘা বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো,
” কে আবার? মেঘা আহম্মেদ। আপনার সাথে বিয়ের আগেই আমার নামে আহম্মেদ ছিলো। ভাব্বেন না বিয়ের পর এই নাম বলেছি। ”
শ্রাবন লকেটটা হাত দিয়ে দেখতেই দেখলো ” মেঘা আহম্মেদ ” নামটি জ্বলজ্বল করছে। সে মেঘার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেলো। আজ সবাই ছুটিতে আছে, বিয়ের সব প্লান করতে হবে তাই। এভাবে মেঘাকে টানতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলো। নিচে এসে তার হাত ছেড়ে দিলো। শান্ত বললো,
” শ্রাবন! এসব কেমন আচরণ? ওকে এভাবে টানছো কেনো? ”
শ্রাবন বলে উঠলো,
” সবাই যেহেতু এখানেই আছো, তাই এখনই বলি। মেঘার গলার এই লকেটটা দেখো তো। চিনতে পারো কিনা? ”
সবাই তাকালো, মেঘা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ইশা আহম্মেদ ছুটে এসে লকেকটা হাত দিয়ে ধরলো এবং বললো,
” এই মেয়ে! তুমি এই লকেট কোথায় পেয়েছো? এটা তো তোমার কাছে থাকার কথা নয়। কে তুমি? ”
মাহিন সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
” এই লকেটটা তো আমি দিয়েছিলাম, কিন্তু এটা তোমার কাছে কি করে এলো মেঘা মা? ”
মেঘা বললো,
” এটা তো ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে আছে। মা বলতে পারবে এটা কিভাবে আমার কাছে এলো। ”
শেফালী আহম্মেদ বললেন,
” শ্রাবন, মেঘার মাকে এখনই আনার ব্যবস্থা করো। ”
বিকেল নাগাদ মেঘার মাকে নিয়ে আসা হলো। উনি যা বললেন তাতে সবাই যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এটা কিভাবে হতে পারে? এতোদিন তাহলে ওরা ভুল জানতো? এটা সম্ভব হতেই পারে না, সব কথাগুলো শোনার পর আহম্মেদ পরিবার যেনো দুইয়ে দুইয়ে চার হিসাব মেলাতে সক্ষম হলো। তবে মেঘার মনে কালো মেঘ জমে গেলো
চলবে,
{