স্বামী পর্ব ৫

#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৫

রাত এখন পৌনে চারটা বাজে। সোহান বিছানার বালিশের ভেতরে মাথা রেখে পড়ে পড়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। কয়েক রাত না ঘুমানোর কারণে মাথাটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। বিছানা দিয়ে নেমে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমে ঢুকে সমস্ত শরীর সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে পরীষ্কার করে নিচ্ছি। ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছি। সমস্ত শরীর বিষের মতো ব্যথা হয়ে আছে। হাত পা নাড়াতে পারছি না। সমস্ত শরীরে নখের আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ড্রয়ারের উপরে নিউসিন মলমটা পেয়ে ক্ষত জায়গায় লাগিয়ে চুপ করে হাঁটুর ফাঁকে মাথা লুকিয়ে বসে আছি। শাওয়ার নেওয়ার পরে ওজু করে বেরিয়ে এসেছি। ফজরের আজান কানে বাজতেই ফ্লোরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করি। তারপর ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালের সূর্য্যের আলোর রশ্নি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়।
হঠাৎ মনে পড়ল গতকালকে তো বাবা আর কল দেয়নি। কিন্তু কী করে তাকে বলব বুঝতে পারছি না! যদি আবার রাগ করে। বলবে করেও বলা হয়নি আর।
সোহানের ঘুম ভাঙলে আমাকে ইশারায় ডাক দিয়ে বলল,
– যাও আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসো।

সোহানের কথা মতো কফি বানিয়ে এনে তার হাতে দিলাম। কফির মগে চুমুক দিয়ে আমাকে বলল,
– এত চিনি দিছ কেন..? এরপর থেকে আরও কমিয়ে দিবে।
– এক চামচ দিছি তো।
– আধা চামচ দিবে। এত চিনি আমি খাই না।
– ঠিকাছে নেক্সট টাইম চিনি কম দিব।
জান্নাত এদিকে এসে আমার কপালটা টিপে দাও তো..?
প্রচন্ড ব্যথা করছে।
– আমি শাওয়ার নিয়েছি আপনি আগে শাওয়ার নিয়ে পবিত্র হয়ে আসুন তারপর আমি মাথাটা টিপে দিচ্ছি।

বিছানা দিয়ে ধড়মড় করে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলগুলো এদিক করছে তো ওদিক। আলমারি খুলে কাপড় বের করে রেডী হচ্ছে সোহান।
– আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন..? এদিকে আসেন মাথাটা টিপে দেই।
– এখন আর মাথা টিপে দেওয়া লাগবে না। তোমার মাথা তুমি টিপো।
– আচ্ছা আপনি আমার সাথে খারাপ বিহেভ করছেন কেন..? আমি কী আপনার কোন ক্ষতি করেছি..?
– দেখো তোমার সাথে তর্কে যেতে চাই না।
আমি আর কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

সোহান বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে সাথী ডাক দিল। ভাইয়া কোথায় যাও..?
– কাজ আছে।
– নাস্তা করে তারপর যা।
– নাহ্। সময় নেই তোরা খেয়ে নিস।
সোহান কথাগুলো বলতে বলতে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাইক চালিয়ে গেইট খুলে বেরিয়ে যায়।

রাহিমা বেগম আসলে সাথী মাকে বলল,
– ভাইয়া শুধু ভাবীর সাথে রাগ দেখায়। নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে।
– বুঝলাম না ছেলেটা কী চাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না..? বিয়ের পরে এখন মাথাটা গরম থাকে সব সময়। নতুন বউকে কী বলে তার কোন ব্যালেন্স থাকে না। ভাবছি আমরা ভুল করলাম না তো জান্নাতের সাথে সোহানের বিয়েটা দিয়ে! জান্নাতের জীবনটা নষ্ট করলাম না তো..?

সকাল থেকে মনের মধ্যে কেমন কেমন জানি লাগছে! মায়ের শরীরটা তো খারাপ ছিল বাবাকে রাতে কল দিতে বলার পরেও একটু কল দিয়ে জানালো না যে মা কেমন আছেন..? খুব চিন্তা হচ্ছে মায়ের জন্য। হাজার হোক মা তো! বারবার শুধু আফসোস করছি।

রাহিমা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– আসব!
– জি মা আসুন। আমার রুমে আসতে গেলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার যখন ইচ্ছা চলে আসবেন।
কালকে সোহানের জন্মদিন। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পাড় করে ফেলেছে। জানিস প্রতি বছর জন্মদিনটাকে বড় করে আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার তো আর শুভ আসবে না যার কারণে ঘটা করেও আনন্দ করা যাবে না। শুভ অনেক অফসোস করছে। প্রতি বছর সোহানের জন্মদিনের আগে বেড়াতে এসে পুরো এক মাস থেকে তারপর যায়। সোহান মুখে কিছু না বললেও অন্তরে শুভকে খুব মিস করবে।
– মা একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
– হ্যাঁ বল।
– শুভ কোথায় থাকে..? তাছাড়া সাথীর বলা অনুযায়ী তো আপনার ছেলে দুইজন সোহান আর সজল। তবে শুভ কে..?
রাহিমা বেগম মুখ চেপে ধরে হাসল। তারপর বলল,
– আরে পাগলী মেয়ে আমার। শুভ হলো আমার বড় মেয়ে যে সিলেটে থাকে। অবশ্য নামটা ছেলে বলে তুই হয়তো চমকে গেছিস। শুভর পুরো নাম হলো, সুবেকা সাদেকিন (শুভ)।
এবার বুঝতে পারছিস..?
– জি মা।
– আচ্ছা শোন, আমি রান্না করতে যাচ্ছি তুই বিশ্রাম নে।

আমি রুমের ভেতরে পায়চারী করছি। নিজের কাছে মোবাইল না থাকার কারণে মায়ের খবরটা জানাতে পারলাম না। কষ্টে মনটা ছটফট করছে। বিছানায় আধা শোয়া অবস্থায় শুয়ে আছি তখনি সাথী রুমে ঢুকল।
– ভাবী তোমার কী শরীর খারাপ..?
– নাহ্।
– তবে বাড়ীর জন্য মন খারাপ লাগছে..?
– হুমম।
– কথা হয়েছে বাসায়.?
– গতকালকে কথা বলেছিলাম বাবার সাথে তখন শুনেছি মায়ের শরীরটা খারাপ। সন্ধ্যার পরে ডাক্তার দেখাবে বলেছিল কিন্তু এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি। আমার তো আর মোবাইল নেই যার কারণে এখন চিন্তা হচ্ছে।
– ওহ্ আচ্ছা এই কথা। তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি মোবাইল নিয়ে আসছি।
– ঠিকাছে।
সাথী রুমে গিয়ে নিজের মোবাইলটা নিয়ে এসে বলল,
– ভাবী নাম্বারটা বলো আমি কল দিয়ে তোমাকে দিচ্ছি।
আমি নাম্বারটা দিয়ে হাতের নখ কাটতে লাগলাম আঙুল দিয়ে। চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
বাসার নাম্বারটাতে কল দিয়ে বলে,
– নাও ভাবী কথা বলো।
মোবাইলটা কানের কাছে ধরে রিসিভ হতেই বললাম,
– বাবা, মা কেমন আছে..?
– এখন একটু ভালো। তুই কেমন আছিস..?
– আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু বাবা তুমি গতকালকে আমাকে কল দিয়ে জানাওনি কেন..? জানো সারারাত আমি কত চিন্তায় কাটিয়েছি। মায়ের কাছে দাও কথা বলব।
– অনেক ঝামেলার ভেতরে ছিলাম তাই তোকে কল দিতে পারিনি।
দিলারা নাও জান্নাতের সাথে কথা বলো।
– আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছ..?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। এহন আগের থেইক্কা ভালা। তোর শরীর ভালা তো..?
– হ্যাঁ মা।

কথা বলার সময় আয়নাতে লক্ষ্য করলাম সোহান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে মায়ের সাথে কথা বলতে থাকলাম। ভাইকে দেখে সাথী রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সোহান গুটিসুটি পায়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চুমু দেয়। সোহানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললাম, একটুপরে কথা বলছি। সোহান বুঝেও না বোঝার ভান করে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সোহানের আদরে থাকতে না পেরে মাকে বললাম, মা তুমি তাহলে বিশ্রাম নাও আমি পরে আবার কল দিব।
কল কেটে সোহানের দিকে ফিরতেই সোহান আমার ঠোঁটে তার ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। একটুপরে ছেড়ে দিয়ে বলল,
– কালকে সন্ধ্যার পরে বাহিরে ঘুরতে যাব রেডী থেকো।
– আচ্ছা।

রাতে ডিনার করে রুমে এসে দেখি সোহান ল্যাপটপের ভেতরে ডুবে আছে। আমি যে কখন রুমে এসে তার পাশে শুয়ে পড়েছি সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। আমি সোহানের দিকে তাকিয়ে দেখি ল্যাপটপ দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। বিষয়টা লক্ষ্য করেও কিছু না বলে চুপ করে চোখ বন্ধ করে রাখি। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে চোখ খুলে দেখি সে এখনো ল্যাপটপের ভেতরে ডুবে আছে। এবার আর চুপ না থেকে ল্যাপটপের দিকে তাকাতেই সোহানের হুশ আসে এবং সাথে সাথে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দেয়।
– কী ব্যাপার আপনি আমাকে দেখে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলেন কেন..? কী করছিলেন এতক্ষণ বসে..?
– কী আর করব..? অফিসের কাজ করছিলাম।
– অফিসের কাজ করলে চেহারার রঙ এলোমেলো হয়ে গেল কেন..? আপনি কী কিছু লুকাচ্ছেন..?
– জান্নাত তোমার কী মাথাটা গেছে নাকি..? কীসব উল্টা পাল্টা বলছ.? কী লুকাবো..? আসলে তুমি যে গ্রামের মেয়ে সেটা তোমার কাজ কর্মে বুঝা যায়। এসব নোংরা মনমানসিকতা ছেড়ে ভালো হও।
আমি আর সোহানকে কিছু না বলে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here