হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -৩৫+৩৬

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৫

বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে আরাবীকে।জায়ান আরাবীকে আনতে চায়নি।মূলত আরাবীর ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানিতে অতিষ্ট হয়ে ওকে আনতে হয়েছে জায়ানের।কি করবে? মেয়েটা ওর দূর্বলতার কথা খুব ভালোভাবেই জানে।আর সেটাই কাছে লাগিয়েছে মেয়েটা।কান্নাকাটি করে বাসায় আসার বাহানা ধরেছে আরাবী।আর জায়ান আরাবীর কান্না সহ্য করতে পারে না।তাই বাধ্য হয়েই আরাবীকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছে ওর।সেই থেকে জায়ান রাগে বোম হয়ে আছে আরাবীর উপর।একটুও কথা বলছে না।আরাবী বার দুয়েক চেষ্টা করেছে জায়ানের সাথে কথা বলার।কিন্তু লোকটা শুনলে তো?আরাবী ঠোঁট উলটে তাকিয়ে রইলো।মহা মুশকিলে পরেছে আরাবী।লোকটা এইভাবে গোমড়ামুখো হয়ে আছে যা আরাবীর একটুও ভালো লাগে না।আরাবীর জন্যে রাতের খাবার এনে খাইয়ে দিচ্ছে জায়ান।ওর সব ধ্যাংজ্ঞান আপাততো আরাবীকে খাইয়ে দেওয়ার দিকে।আরাবীর দিকে ভালোভাবে তাকাচ্ছে না।আরাবী অপরাধী কণ্ঠে ডাকল,
-‘ শুনুন নাহ।’

জায়ান নিশ্চুপ।আরাবী বার দুয়েক ডাকলো।কিন্তু জায়ানের কোন হেলদোল নেই।আরাবীকে খাবার খাইয়ে দিয়ে উঠে চলে যেতে নিতেই আরাবী জায়ানের হাত টেনে ধরল।জায়ান থমথমে গলায় বলে,
-‘ কি হচ্ছে এসব?ছাড়ো কাজ আছে আমার।’

আরাবী কাঁদো গলায় বলে,
-‘ নাহ ছাড়বো না।কথা বলছেন না কেন আমায়? কি হয়েছে?’

জায়ান গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ যা চেয়েছো তাই পেয়েছো।এখন আর কি চাই? দেখি বলে ফেলো।’

আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।ধরা গলায় বলে,
-‘ আচ্ছা সরি তো। আর এমন করবো না।আমাকে কালকে আবার হাসপাতালে রেখে আসবেন।আমি আর কিছু বলব নাহ। এইবার তো রাগ করবেন নাহ।কথা বলুন।’

জায়ান তাও মুখ ঘুরিয়ে।আরাবী জায়ানের হাত ধরে টেনে জায়ানকে ওর আরো কাছে আনলো।তারপর টুপ করে জায়ানের গালে একটা চুমু এঁকে দিলো আরাবী।জায়ান স্থির হয়ে রইলো কতোক্ষন।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-‘ খুব ভালোভাবেই জানো আমাকে কিভাবে বশে আনতে হয়।’

আরাবী দাঁত কেলিয়ে হাসলো।জায়ান হতাশার নিশ্বাস ফেলল।এই মেয়েটার সাথে ও কোনমতেই রাগ করে থাকতে পারে না। একদম পারে না।ওই স্নিগ্ধ,কোমল,আদুরে মুখশ্রীটা দেখলেই তো জায়ানের হৃদয়টা ভালোলাগায় ছেঁয়ে যায়।সকল ক্লান্তিরা ছুটে পালিয়ে যায়।একরাশ মুগ্ধতা এসে ভড় করে ওর চোখে মুখে।জায়ান নরম গলায় বলে,
-‘ আমি তোমার সাথে রেগে থাকতে পারিনা জানো তুমি।আর সেটাই কাজে লাগাও তুমি।কেন এমন করো তুমি আরাবী?আর দুটো দিন হাসপাতালে এডমিট থাকলে কি হতো?নিজের ভালো তো পাগলও বোঝে।’

আরাবী মুখটা একটুখানি করে বলে,
-‘ আমার হাসপাতালে থাকতে ভালো লাগছিলো নাহ।আর তাছাড়া আমি জানি আমার কিছুই হবে না। আপনি হতে দিবেন নাহ্।আপনি আছেন না আমার সাথে।তাই কোন ভয় নেই আমার।’

আরাবী মুঁচকি হাসলো।জায়ান ধ্যানমগ্ন হয়ে সেই হাসিটুকু দেখলো।তার সকল চিন্তাদের ঝেরে ফেলে দিলো।আসলেই চিন্তা করে কি হবে? ও আছে তো ওর আরাবীর জন্যে।জায়ান নরম হাতে জড়িয়ে ধরলো আরাবীকে।আরাবী ছোট্টো বিড়ালছানার মতো গুটিয়ে রইলো জায়ানের বুকে।জায়ান পরম আদরে চুমু খেলো আরাবীর চুলের ভাঁজে।

———–
তারাহুরো পায়ে কোচিং-এ আসলো নূর।আজ বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে ওর।কোচিং-এর দরজার সামনে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
-‘ আসতে পারি স্যার।’

ফাহিম সবেই ক্লাসে প্রবেশ করেছে।নূরকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতে দেখে বলে,
-‘ ইয়াহ।এসো।’

নূর রুমে প্রবেশ করল। একটা সিটই খালি আছে।সেখানে গিয়েই বসে পরলো নূর।নূরের পাশে বসেছে একটি ছেলে।ছেলেটার নাম রিজন।রিজন নূরকে দেখে হাসল।নূরও বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দিলো।ছেলেটা পড়ালেখায় অনেক মেধাবি।তাই নোটস-এর বিষয়ে দু একবার কথা হয়ে নূরের সাথে।তাই ভদ্রতার খাতিরে অল্পস্বল্প কথা বলে নেয় নূর।রিজন জিজ্ঞেস করল,
-‘ লেট হলো যে।’
-‘ আর বলো না।রিকশা পাচ্ছিলাম নাহ একটাও।’
-‘ ওহ।’

কথা শেষ হতেই নূর আর রিজন পড়ায় মনোযোগ দিলো।ফাহিম তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে নূরের দিকে।পাশের ছেলেটার সাথে কিসের এতো কথা বলা আর হাসিহাসি করা।কই ওকে দেখলে তো কোনদিন হাসি দেয় না মেয়েটা।বরংচ ম্যারথন রেসের মতো দৌড় লাগায়।গম্ভীর হয়ে রইলো ফাহিম পুরোটা ক্লাসে।তেজ নিয়ে বেশিরভাগ পড়া জিজ্ঞেস করেছে নূরকে।নূর কিছু পারলো আর কিছু পারলো নাহ। যা পারেনি তার জন্যে ফাহিম ওকে বেশ কয়েকটা ধমকও দিয়েছে। মূলত আরাবী অসুস্থ থাকাতেই এতোদিন ঠিকঠাক পড়া হয়ে উঠেনি নূরের।ফাহিম সেটা জানে। আর জেনেশুনেই কিনা লোকটা ওর সাথে এই ব্যবহার করল।নূরের অভিমান হলো।অভিমানে অভিমানে জমে গিয়ে এখন পাহাড়সম হয়েছে।এই অভিমান কি আদৌ বুঝবে ফাহিম? ক্লাস শেষে ছুটির পর সবাই বের হয়ে গেলো।নূর দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্যে।নূর বুঝে পায় না। সব রিকশাওয়ালার কি ওর সাথে জাত শত্রুতা?নাহলে ওর দরকারের সময়টাতেই কেন একটা রিকশা পায় নাহ ও।এমন সময় ওর সামনে বাইক নিয়ে হাজির হলো ফাহিম।নূর ভ্রু-কুচকে তাকালো।ফাহিম সেদিকে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ সাখাওয়াত বাড়ির দিকেই যাচ্ছি।উঠে পরো।’

নাক ফোলালো নূর।এটা কেমন ধরনের কথা?এমন তিতকরলার মতো করে বলে কিনা উঠে পরো।এহ! বয়েই গেছে ওর এই বাইকে উঠতে।নূর হেটে হেটেই বাড়ি যাবে সিদ্ধান্ত নিলো।তাও এই লোকটার বাইকে উঠবে না।নূর রাগে হনহন করে সামনের দিকে হাটা দিলো।ওর রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।নূর বিরবির করল,
-‘ অস’ভ্য।চরম অস’ভ্য লোক।’

ফাহিম আবারও বাইক নিয়ে নূরের সামনে আসলো।নূর রাগি চোখে তাকালো ফাহিমের দিকে।ফাহিম গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-‘ তেজ দেখিয়ে লাভ নেই।বাইকে উঠতে বলেছি।রাস্তায় সিনক্রিয়েট করো নাহ।’

নূর আশেপাশে তাকালো।আসলেই অনেক লোক তাকিয়ে ওদের দিকে।বিষটা দৃষ্টিকটু ঠেকলো নূরের।তাই অভিমান থাকা সত্তেও ফাহিমের বাইকে চেপে বসলো।নূরের অগোচরে বাঁকা হাসলো ফাহিম।তারপর হেলমেট পরে বাইক স্টার্ট দিলো।
————
জায়ান হুটোপুটি করে তৈরি হচ্ছে।তা দেখে আরাবীর ভ্রু-কুচকে আসে।আরাবী বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসা।সেই অবস্থাতেই বলে,
-‘ কোথাও যাচ্ছেন?’
-‘ হু!’

আরাবী প্রশ্ন করে,
-‘ কিন্তু কোথায়?অফিসে যাবেন নাহ তা আমি জানি।কারন এই মাঝবেলা নিশ্চয়ই আপনার অফিস টাইম নাহ।’

জায়ান চুল জেল লাগাতে লাগাতে ভরাট কণ্ঠে বলে,
-‘ তোমায় আমি বিশ্রাম নিতে বলেছি।শুনেছো আমার কথা?’
-‘ আপনি শুনেছেন আমার কথা?’
-‘ তোমার কোন কথাটা শুনলাম নাহ?’
-‘ এইযে একটু আগেই শুনলেন নাহ। আমি কতোগুলো প্রশ্ন করলাম।উত্তর দিয়েছেন আপনি?’

জায়ান নিশব্দে হেঁসে দিলো।জায়ানকে হাসতে দেখে আরাবী মুখ ফুলালো।জায়ান একেবারে তৈরি হয়ে আরাবীর কাছে আসলো।আরাবীর গালে আদুরে স্পর্শ করে নরম গলায় বলে,
-‘ কি হয়েছে?এতো রেগে যাচ্ছো কেন?’

আরাবী মাথা নিচু করে বলে,
-‘ রাগবো না তো কি করব? আপনি আমায় ফেলে চলে যাচ্ছেন।এখন আমি রুমে একা একা কি করব?’

জায়ান হেসে বলে,
-‘ একটুর জন্যে যাচ্ছি। দরকার আছে নাহলে যেতাম নাহ।আর আমি এতোটাও নিষ্ঠুর না যে আমার বউটাকে একা ফেলে যাবো।নূর আছে আমি গেলেই ও আসবে।আর আলিফাকেও আসতে বলেছি।কতোদিন যাবত ভার্সিটি যাচ্ছো না। আলিফার থেকে কিছু পড়া বুঝে নিও। আর আমি আসার সময় নোটস নিয়ে আসবো নেহ স্যারদের থেকে।’

আরাবী মাথা দুলালো।তবুও কেমন যে ওর কৌতুহল কমছে না। হঠাৎ করে লোকটা এমন তারাহুরো করে যাচ্ছেই বা কোথায়?আরাবী ধীরে বলে,
-‘ কোথায় যাচ্ছেন বলুন নাহ।’

জায়ান একটুও বিরক্ত হলো না।বরংচ নম্র গলায় বলল,
-‘ আমার সুখের সুখ খুঁজতে যাচ্ছি।কাঠগোলাপের মাঝে আমার সুখ বাস করে।আর আমায় সুখি থাকতে হলে যে তাকেও সুখি থাকতে হবে।সেই কাঠগোলাপের গাছটার মূল শিকড় কোথায় আছে তা যে আমায় যে করেই হোক জানতে হবে।কারন এতেই যে আমার কাঠগোলাপ খুশি আর স খুশি মানে আমিও খুশি।’

কথাগুলো বলে আরাবীর কপালে চুমু খেয়ে বেড়িয়ে গেলো জায়ান।আর ভাবনায় ব্যস্ত রেখে গেলো আরাবীকে।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৬
ক্যাফেটেরিয়ার পরিবেশ বেশ রমরমে।এসির হাওয়ায় পরিবেশ শীতল বেশ।ক্যাফেটেরিয়ার বেশ কোনার সাইডের একটা টেবিলে বসে আছেন জিহাদ সাহেব।তিনি মূলত অপেক্ষা করছেন জায়ানের জন্যে।একটুপরেই জায়ানের দেখা পাওয়া গেলো।সাথে আছে ইফতি আর ফাহিম।ওদের দেখে অবাক হলেন জিহাদ সাহেব।জায়ান এসেই সালাম জানালো তাকে।তারপর বলে,
-‘ ভালো আছেন বাবা?’

জিহাদ সাহেব সালামের জবাব নিয়ে বলে,
-‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো? তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?আর আরাবী আমার বাচ্চাটা এখন কেমন আছে?’
-‘ কোন চিন্তা করবেন না বাবা।আমি থাকতে আপনার মেয়ের কিছু হবে না।ও ঠিক আছে।আর পরিবারের সবাই ভালো আছেন।

জিহাদ সাহেব সস্তির নিশ্বাস ফেললেন।এটা তিনি জানেন যে তার মেয়ে জায়ানের কাছে থাকলে যে ভালো থাকবেনা এটা হতেই পারে না।আরাবী যে ভালো আছে সেটা তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন।তাও বাবার মন সন্তানের জন্যে তো সব সময় ছটফট করবেই?জিহাদ সাহেব ফাহিম আর ইফতির দিকে তাকালো।তারপর প্রশ্ন করল,
-‘ ফাহিম আর ইফতি যে সাথে?কোন কিছু কি হয়েছে জায়ান?’

জায়ান জবাবে বলে,
-‘ কোন কিছুই হয়নি বাবা।আসলে আমি সেদিন বলেছিলাম না আরাবীর আসল বাবা মাকে আমি খুঁজে বের করবো?তাই এতে ফাহিম আর ইফতির সাহায্যও আমার লাগতে পারে।এইজন্যেই ওদের এখানে আনা।’
-‘ ওহ।তা কি করবে ভেবেছো কিছু?’

জায়ান এইবার বেশ গম্ভীর হয়ে বলে,
-‘ আপনি আজ আমাদের সেখানে নিয়ে যাবেন। যেখানে আপনি প্রথম আরাবীকে পেয়েছিলেন।আমার মন বলছে আমি সেখানে কিছু না কিছু ক্লু পাবোই।’
-‘ ঠিক আছে।চলো তাহলে আমি তোমাদের সেখানে নিয়ে যাই।’

আরো কিছু কথা বলে তারা চারজন মিলে ক্যাফেটেরিয়ার থেকে বের হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
—–
একাধারে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেছে আরাবী।আলিফা মনের ফুর্তিটা ফোন চাপছে।আরাবী আলিফার হাত থেকে ফোন টান দিয়ে নিয়ে নিলো।আলিফা হতবাক হয়ে বলে,
-‘ আরে আরে?কি? কি করছিস?আমার ফোন নিচ্ছিস কেন?’
-‘ আমি এখানে পড়তে পড়তে বেহুস হয়ে গেলাম আর তুই ফোন গুতোচ্ছিস?কি ব্যাপার হ্যা?ইদানিং ফোনে একটু বেশিই দেখছি?আমার পিঠ পিছনে কি করছিস তুই আমি জানি না?তুই মনে করিস?আমার দেবরকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে যে আমারই দেবরানি হতে চাচ্ছিস তা আমি ঢের বুঝি।’

হা করে রইলো আলিফা আরাবীর কথা শুনে।আলিফার মুখভঙি দেখে আরাবী কিটকিটিয়ে হেঁসে উঠলো।বলল,
-‘ এমন করার কিছুই নেই।আমার দেবর আর আপনি যে তলে তলে প্রেম করছেন তা আমি অনেক আগেই জানি।আমার দেবরজি-ই আমায় বলেছে।’

রাগে নাক ফোলালো আলিফা।লোকটা সবার কাছেই মনে হয় ঢোল পিটিয়ে সবাইকেই মনে হয় বলে বেড়িয়েছে।আলিফা বিরবির করে বলে,
-‘ নির্ল’জ্জ লোক এইভাবে বুঝি কেউ এসব বলে বেড়ায়?ফোন দিক না একবার।দেখে নিবো তাকে।’

আরাবী ভ্রু-কুচকে তাকালো বিরবির করতে থাকা আলিফার দিকে।তারপর বলে,
-‘ অ্যাই,তুই কি আমার দেবরকে বকাঝকা করছিস?একদম এসব করবি না।আমার দেবর অনেক ভালো।’
-‘ হ্যা কতো ভালো সে তা আমি ভালোভাবেই জানি।আমাকে আর তা বলতে হবে না।’

আরাবী নিজের মুখোভঙি হঠাৎ বদলে ফেললো।ও ঠেলে গিয়ে হঠাৎ করে আলিফার কাছে একটু করে এগিয়ে গেলো।বড্ড উৎফুল্ল হয়ে বলে,
-‘ আলু শুন না।বলছি কি যখন তোর ইফতি ভাইয়ার সাথে বিয়ে হবে।মানে আমরা দুজন জা হয়ে যাবো।ব্যাপারটা অনেক ইন্ট্রেস্টিং। নাহ দোস্ত?আমরা দুজন সারাদিন একসাথে থাকবো।অনেক মজা হবে তাই নাহ?আমরা দুজন মিলে তাদের দুইভাইকে নাকানিচুবানি খাওয়াবো।’

আলিফা হেসে হেসে বলে,
-‘ সে নাহয় হবে।কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি সহমত হতে পারলাম নাহ।জায়ান ভাইয়া তো এমনিতেই তোকে চোখে হারায়।তোকে কতো ভালোবাসে।তুই তার সাথে আর কি উল্টাপাল্টা করবি? সে অনেক ভালো একটা মানুষ।শ’য়তান হচ্ছে তোর দেবর।বজ্জা’ত কোথাকার।কথায় কথায় আমার সাথে ঝগড়া করে।’
-‘ ওমা তাই বুঝি?ইফতি ভাইয়া তোর সাথে শুধু ঝগড়াই করে?ভালোবাসে না মনে হয়?আদর টাদর দেয় নাহ?’

আরাবীর কথায় চোখ বড় বড় হয়ে যায় আলিফার।আরাবীর হঠাৎ এমন লাগামহীন কথায় লজ্জা পেলো আলিফা।আরাবী তা দেখে মৃদ্যু হাসলো।আলিফার কাধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-‘ কিরে?ব্যাপার কি?এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’
-‘ ধুর এসব কিছুই না।তুই যা ভাবছিস এমন কিছুই আমাদের মাঝে হয়নি।আর তিনি এসব করবেনও না আমি জানি।সে আমাকে বিয়ে করে বাড়ি তুলবে। তার আগে কিছু না।’

আরাবী মুঁচকি হেসে বলে,
-‘ অনেক ভালোবাসে না ভাইয়া?’
-‘ হ্যা।তার ভালোবাসাটা আমি খুব উপভোগ করি।সে আমার সাথে থাকলেই আমার সাথে ঝগড়া লাগাবে।তার নাকি আমার সাথে ঝগড়া করতে ভালোলাগে।অবশ্যও আমি তার এসব পাগলামি ভীষণ উপভোগ করি।আমি জানি সে ইচ্ছে করেই আমার সাথে লাগতে আসে।তার খুশিটুকুর জন্যেই আমিও তার সাথে ঝগড়া করি।’
-‘ আহা কতো ভালোবাসা গো।’

আলিফা হালকা হাসলো।পরক্ষনে চট করে আরাবীকে প্রশ্ন করে,
-‘ তোর কি খবর? বিয়ের তো কতোদিন হলো?আমি খালামুনি হবো কবে?’

আরাবী লজ্জায় লাল হয়ে গেলো আলিফার এমন কথায়।আসলে ও এমন কিছু এখনও ভাবেনি।জায়ানও কখনও আরাবীকে বাচ্চাটাচ্চা নিয়ে প্রেসার দেয়নি।না দিয়েছে ওর শশুড়বাড়ির লোক।আরাবী ধীরে বলে,
-‘ এমন কিছু এখনও ভাবিনি।সেও আমায় কিছুই বলেনা এসব নিয়ে।’
-‘ ওহ তা একটা বেবি নিয়ে নে ভালো হবে।’
-‘ দেখি উনি কি বলেন।’
-‘ তুই আবার রাগ করছিস নাকি আমি এসব বলায়?’
-‘ আরে নাহ কি বলিস এসব?’
-‘ দোস্ত একটা কথা রাখবি?’
-‘কি?’
-‘ তোর ছেলে হলে আর আমার মেয়ে হলে। তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।আমি কিন্তু সমন্ধ আগেই ঠিক করে রাখলাম।এটার কোন হেরফের হবে না।আমি উনাকেও বলে দিবো।তোর ছেলে আমার মেয়ের জন্যে বুকিং করা।’

আলিফার কথার ধরনে খিলখিল করে হেসে দিলো আরাবী।হাসলো আলিফাও।তাদের হাসিতে মুখোরিত হলো চারপাশ।
______
জিহাদ সাহেব জায়ানদের নিয়ে গন্তব্যে এসে পৌছালেন।তিনি ধরা গলায় বলে,
-‘ এখানে! ঠিক এখানটায় পেয়েছিলাম আমি আমার আরাবীকে।আমার ছোট্টো আরাবীটা ক্ষুদার জ্বালায় কি যে কাঁদছিলো।’

জিহাদ সাহেব চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিলেন।জায়ান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে।ওর চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।জিহাদ সাহেবের কারনে আজ সে তার আরাবীকে পেয়েছে।তার ভালোবাসার মানুষটা আজ জিহাদ সাহেবের কারনেই বেঁচে আছেন।এই ফেরেস্তার মতো মানুষটা যদি সেদিন ছোট্টো আরাবীকে নিজের পিতৃস্নেহের গাছের তলায় যদি জায়গা না দিতো। তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে যদি বুকে আগলে না নিতো।তবে যে কি হতো আরাবীর?আদৌ বেঁচে থাকতো মেয়েটা?নাকি কোন শি’য়াল কু’কুরের খাদ্য হয়ে যেতো?ভাবতেই তো বুক কেঁপে উঠে জায়ানের।শিরা-উপশিরায় কেমন যেন ভ’য়ংকর কাঁপন ধরে যায়।জায়ান ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিলো।তারপর ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ ফাহিম?তুমি তো এইপথ দিয়েই তোমার কোচিং সেন্টারে যাও তাই নাহ?’
-‘ হ্যা ভাইয়া।’
-‘ তো তুমি কি বলতে পারো এখানে আশেপাশে এখানে সবচেয়ে বেশি পুরনো হাসপাতাল কোনটা?’
-‘ জি ভাইয়া এখানে একটাই হাসপাতাল আছে বেশ যা পুরনো।’

জায়ান শান্ত কন্ঠে বলে,
-‘ তাহলে চলো সেখানেই যাওয়া যাক।আমরা হাসপাতালে গিয়েই তো খোঁজ নিতে পারি। বাবা আরাবীকে যতো সালে আর যতো তারিখে পেয়েছিলেন তা যদি মনে রাখতে পারেন।তাহলে সেই হাসপাতালে গিয়ে সেই দিনেরই কতোগুলো বাচ্চা জন্মেছে তার লিস্ট নিলেই তো হবে।আর সেই বাচ্চাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেই তো হবে।’

ফাহিম জায়ানের উপস্থিত বুদ্ধিতে হতবাক।এই বুদ্ধিতা আগে কেন মনে আসলো না তাদের মাঝে কারো।ইফতি খুশি হয়ে বলে,
-‘ ইউ আর জিনিয়াস ভাইয়া। এটা একটা এক্সিলেন্ট আইডিয়া।আর দেরি কিসের?চলো যাওয়া যাক।’

জায়ান,ফাহিম,ইফতি আর জিহাদ সাহেব মিলে রওনা হলেন সেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।হাসপাতালে পৌছেই ইফতি ক্যাশকাউন্টারে বসা একটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ এক্সকিউজ মি মিস।’
-‘ ইয়েস স্যার।হাও কেন আই হেল্প ইউ?’
-‘ আসলে যদি আপনি একটু এদিকে আসতেন।আসলে একটু জরুরি কথা বলতাম।’
-‘ ওকে।’

মেয়েটাকে নিয়ে ওরা একটু নিরিবিড়ি জায়গায় আসতেই জায়ান এইবার গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ আসলে মিস আমাদের আপনার সাহায্য প্রয়োজন।আপনাদের হাসপাতালের ২০০০ সালের মার্চের ১ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত জন্ম নেওয়া সকল বাচ্চাদের ডিটেইলস প্রয়োজন ছিলো।’

মেয়েটি জায়ানের কথায় ভড়কালো।আসলে কাউকে এসব বিষয়ে জানার জন্যে হাসপাতালে আসতে দেখেনি তাই এই অবস্থা।মেয়েটি বেশ রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
-‘ আ’ম এক্সট্রেমলি সরি স্যার।এগুলো আমাদের হাসপাতালের রুলস এর বাহিরে।আমি এসব দিতে পারবো মা আপনাকে।’

ফাহিম রেগে গেলো মেয়েটির কথায়।তেড়ে গিয়ে বলে,
-‘ দিতে পারবেন না মানে?কেন পারবেন নাহ?এই সামান্য জিনিস নিয়ে আপনারা এমন করছেন কেন?দিয়ে দিলে কি হবে? কতো টাকা চাই আপনার বলুন?সব দিবো।তাও আমাদের সেই ডিটেইলসগুলো দিন।’

মেয়েটিও রেগে বলে,
-‘ দেখুন মিষ্টার আপনি কিন্তু আমার সাথে মিসবিহেইব করছেন।আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছেন?আর ধমকাধমকি করছেন কেন?আমি কিন্তু পুলিশে ফোন লাগাবো।’

জায়ান ইফতিকে ইশারা করলো ফাহিমকে আটকাতে।ইফতি ভাইয়ের ইশারা পেয়ে তাই করলো।জায়ান এসে ফাহিমের কাধে হাত রাখল।শান্ত কণ্ঠে বলে,
-‘ ফাহিম শান্ত হও।এমন হাইপার হলে চলবে না।মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে।’
-‘ সরি ভাইয়া।’
-‘ ইটস ওকে।’

জায়ান এইবার মেয়েটিকে বলে,
-‘ উই আর সরি মিস।আপনি যেতে পারেন।’

মেয়েটি তীক্ষ্ণ চোখে ফাহিমকে দেখে নিয়ে তারপর চলে গেলো।ফাহিম হতাশ হয়ে বলে,
-‘ এখন কি করবো আমরা?কিভাবে তথ্যগুলো জোগাঢ় করব।’

ইফতিও হতাশার নিশ্বাস ফেলল।হঠাৎ ওর নজর গেলো হাসপাতালের নেমপ্লেটের দিকে।ও চট করে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
-‘ আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।এই হাসপাতালের-ই ডক্টর আমার এক ফ্রেন্ড।ওর মাও এই হাসপাতালের-ই ডক্টর।ওদের সাথে কথা বললেই তো হয়ে যাবে।তারাই আমাদের সব ব্যবস্থা করে দিবে।আন্টিকে সব বললে আমায় আন্টি কখনও ফিরিয়ে দিবে না।আমি জানি।’

জায়ান চট করে থা’প্পড় মেরে বসল ইফতির মাথায়।ইফতি ব্যাথা পেয়ে আহ সূচক আওয়াজ করে উঠল।ঠোঁট উলটে বলে,
-‘ মারলে কেন ভাইয়া?’
-‘ তোকে মারবো না তো কি করবো বেয়া’দব।এই কথাটা আগে বললে কি হতো?আগে বললে কি আমাদের এতো ঝামেলায় পরতে হতো।’

ইফতি মাথা চুলকালো।নিজের বোকামিতে সে কি বলবে ভেবে পেলো না।ও আসলেই একটা হাদারাম।আলিফা ঠিকই বলে।আলিফার কথা মনে আসতেই মনটা আকুপাকু করে উঠলো ইফতির।ইস,মেয়েটাকে কতোক্ষণ হয়ে গেলো দেখে না।বাড়িতেই নাকি আছে আলিফা।অফিসের কাজ জলদি শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে।আলিফার সাথে একটু চুটিয়ে প্রেম করে নিবে।ভেবেই আনমনে হাসছে ইফতি।জায়ান ভ্রু-কুচকে তাকালো ইফতির দিকে।ওকে এমন হাসতে দেখে ক্ষিপ্র কণ্ঠে বলে,
-‘ এমন একটা আহাম্মক মার্কা কাজ করে তুই হাসছিস?’

হকচকিয়ে উঠলো ইফতি।আমতা আমতা করে বলে,
-‘ সরি ভাইয়া।খেয়াল ছিলো নাহ আসলে।আর এমনটা হবে না।’
-‘ হুম মনে থাকে যেন।এখন এখান থেকে যাওয়া যাক।’
-‘ আচ্ছা চলো।’

ইফতি আর জিহাদ সাহেব চলে গেলেন অফিসের উদ্দেশ্যে।আরাবী অসুস্থ তাই জায়ান অফিস যাবেনা কয়েকদিন।ও ঘরে বসেই অফিসের কাজ যতোটুকু পারে করে।ও যাবে সোজা বাড়িতে।আরাবী কথা ভেবে হাসলো।মেয়েটা ওর জন্যে অপেক্ষায়।দ্রুত বাড়ি পৌছাতে হবে।মেয়েটাকে ছাড়া যে তারও কিছু করতে ইচ্ছে করে না।এক মুহূর্তের জন্যেও আরাবীকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না।এদিকে ফাহিম রওনা হলো ওর কোচিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে।

#চলবে_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here