হৈমন্তীকা পর্ব ২১+২২

হৈমন্তীকা

২১.
ঘড়িতে দশটা বেজে এক মিনিট।
রাবেয়া নয়টায় দিকে বাহিরে গিয়েছিলেন। একটু পরেই হয়তো চলে আসবেন। এদিকে তুষারের যাওয়ার নাম নেই। সে নিশ্চিন্তে সোফায় আরাম করে বসে আছে। রিমোটের বাটনে কড়া আঘাত দিয়ে টেলিভিশনের একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছে। তার এহেন নির্লিপ্ততায় ভীষণ বিরক্ত হৈমন্তী। হেমন্তর দিকে তাকিয়ে দেখল, সে তখনো নাস্তার টেবিলে বসে মিটিমিটি হাসছে। সেদিকে একবার কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুষারের কাছে এগিয়ে এলো হৈমন্তী। বিরক্ত সুরে বললো,
— “সমস্যা কি আপনার তুষার? এখান থেকে যাচ্ছেন না কেন?”

টিভি থেকে নজর সরিয়ে হৈমন্তীর মুখপানে আঁখিজোড়া স্থির করলো তুষার। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “বাসায় মেহমান আসলে তাদেরকে কি এভাবেই তাড়িয়ে দেন হৈমন্তীকা? আমি আপনার মেহমান। যান, আমার জন্য ঝটপট নাস্তা নিয়ে আসুন।”
হৈমন্তী শুনলো না। বরং অস্থির কণ্ঠে আবার বললো,
— “আপনি বুঝতে পারছেন না তুষার! মা এক্ষুণি চলে আসবেন।”
— “কিন্তু আমার এখন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না হৈমন্তীকা।”

তার একরোখা উত্তর। হৈমন্তীর এবার প্রচন্ড রাগ হলো। রেগে কিছু বলবে, তার আগে আগেই দরজার বাহির থেকে রাবেয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো কর্ণকুহুরে। সম্ভবত কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। এবং এরপরই টুংটাং শব্দে বেজে উঠলো কলিংবেল। পরপর দু’বার। হৈমন্তী ভড়কে গেল। রাবেয়া এসে পরেছেন। এখন কি হবে? তুষারকে তো রাবেয়া চেনেন। আসরাফ সাহেবকে যদি বলে দেন এটাই তুষার, তখন? হৈমন্তীর চিন্তা বাড়লো। অজানা আশঙ্কায় হাত-পা তীব্র ভাবে কাঁপতে লাগলো। অথচ তুষার আগের ন্যায়ই শান্ত, নির্লিপ্ত, নির্বিকার!

তৃতীয়বারের মতো কলিংবেল বাজতেই হেমন্ত জিজ্ঞেস করলো,
— “আপু? দরজা কি খুলবো?”
তুষার উত্তর দিলো,
— “খুলো।”
হৈমন্তী ‘না’ বলতে চেয়েছিল। তুষারের উত্তর শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো। উঁচু গলায় বললো,
— “পাগল নাকি? বাহিরে মা দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে দেখে ফেললে কি হবে ভাবতে পারছেন?”

জবাবে তুষার মুচকি হাসলো শুধু। বিন্দু মাত্র পরোয়া করলো না হৈমন্তীকে। হেমন্তর পানে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “তোমার আপুর রুম কোনটা হেমন্ত?”
— “ডানদিকের টা।”
— “আচ্ছা। তুমি দরজা খুলো যাও।”

বাধ্য ছেলের মতো দরজা খুলতে চলে গেল হেমন্ত। তুষার হৈমন্তীর রুমের দিকে পা বাড়ালো। হৈমন্তীও পিছু নিলো তার। তুষার কি করছে, না করছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না হৈমন্তীর। মস্তিষ্কে তীব্র ভাবে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে ধৈর্য হারা হয়ে উঠল। ধৈর্যহীন কণ্ঠে বললো,
— “আপনি ঠিক কি করতে চাচ্ছেন তুষার? আমার রুমে যাচ্ছেন কেন?”

তুষার এবারও জবাবহীন। রুমে প্রবেশ করেই সোজা বারান্দায় চলে গেল সে। বারান্দার আশপাশটা দেখতে দেখতে বললো, “এ বারান্দাটা মোটেও পছন্দ হয় নি আমার হৈমন্তীকা। কেমন বন,জঙ্গলে ভরপুর! শ্বশুর বাবাকে বলুন বাসা পাল্টাতে। নয়তো বিয়ের পর আপনি যখন রাগ করে বাবার বাড়ি চলে আসবেন, তখন বারান্দা বেয়ে উপরে উঠতে বেশ কষ্ট হবে আমার।”

বলতে বলতে বামদিকের রেলিংয়ে ওপর পা ঝুলিয়ে বসে পরল তুষার। হৈমন্তী এতক্ষণ চুপচাপ তুষারের কান্ড দেখলেও এবার ভয় পেয়ে গেল ভীষণ। আতঙ্কিত গলায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো, “রেলিং থেকে নামুন তুষার! পরে যাবেন!”

তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। নামলো না। সিক্ত গলায় অনুরোধ করল, “মিথ্যে হলেও একবার আমাকে ভালোবাসি বলবেন হৈমন্তীকা?”

নিঃসংকোচ, সুপ্ত আবেদন। হৈমন্তীর বক্ষস্থল কেমন কেঁপে, কেঁপে উঠলো। তোলপাড়ের খানিক আভাস পেল সর্বাঙ্গে। কাঁপতে লাগলো গলা। অচল কণ্ঠস্বরে ধমক দিতে চাইলো,
— “আপনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। নামুন রেলিং থেকে!”
— “আগে বলুন ভালোবাসি।”

ভেতরে ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো হৈমন্তী। শপথ করলো, সে ভালোবাসি বলবে না। অথচ না বলেও উপায় নেই। ড্রইংরুম থেকে রাবেয়ার হাঁক শোনা যাচ্ছে। আসরাফ সাহেবের গলাও শুনতে পাচ্ছে সে। হৈমন্তী নিজের শপথ রক্ষা করতে পারলো না। চোখ, মুখ খিঁচে বলে ফেললো, “ভালোবাসি… তুষার।”

মুহুর্তেই প্রকৃতি যেন অস্বাভাবিক ভাবে নীরব হয়ে গেল। কৃত্রিম কোলাহলগুলো কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করেই ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলো হৈমন্তী। বক্ষস্থল প্রবল ভাবে ওঠা-নামা করছে তার। হঠাৎ ধপ করে এক আওয়াজে ধীর,স্থীর ভাবে চোখ মেলে তাকালো সে। তুষারকে রেলিংয়েল ওপর না দেখতে পেয়ে আত্মা যেন শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল। ভীতু মনে দ্রুত রেলিংয়ের দিকটায় ছুটে গেল সে। দৃষ্টি ফেলল নিচে। তাকে ভয়াবহ ভয় পাইয়ে তুষার দিব্যি পাইপ বেয়ে দু’তলা থেকে নিচে নেমে গেছে। নেমে আর উপরে তাকায় নি। চশমা খুলে তা পকেটে রাখতে রাখতে চলে গেছে সেখান থেকে। হৈমন্তী তবুও তাকিয়ে রইলো তুষারের এক্ষুণি ধুলিসাৎ হওয়া স্থানটির দিকে। দৈবাৎ মায়ের উঁচু গলার ডাকাডাকিতে সম্বিৎ ফিরলো তার। দ্রুত ড্রইংরুমে পদচারণ করতেই আসরাফ সাহেবের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে।

— “তোর বন্ধু কই হৈমন্তী? দেখছি না যে!”
— “চলে গেছে বাবা।”

রাবেয়া তখন ডাইনিং টেবিলে বসে ঠান্ডা পানি পান করছিলেন। বন্ধু কথাটা শুনে অনুসন্ধানী গলায় বললেন,
— “কোন বন্ধু এসেছে রে? ছেলে নাকি মেয়ে? নাম কি?”
হৈমন্তী জবাব দিলো, “ছেলে। তৈমুর নাম।”
রাবেয়ার কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো,
— “তৈমুর? কোন তৈমুর? আফতাব ভাইয়ের ছেলে তুষার তৈমুর?”
তুষারের নাম শুনতেই তেঁতে উঠলেন আসরাফ সাহেব। প্রলয়ংকরী ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “এখানে ওই ছেলের নাম আসছে কোত্থেকে? তৈমুর কি অন্য কারো নাম হতে পারে না? কথায় কথায় ওই ছেলের নাম নিতে হবে কেন তোমার? আর ভাই কিসের হ্যাঁ? আফতাব সাহেব কোন জনমের ভাই লাগে তোমার?”

রাবেয়ার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। চোখ জ্বলে চিকচিক করতে লাগলো। ছেলে মেয়ের সামনে এভাবে না বললে হতো না? তিনি নতজানু হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। হেমন্ত আর হৈমন্তীও নীরবে প্রস্থান করলো ড্রইংরুম।

_____

আজ অনেকদিন পর ভার্সিটি এসেছে হৈমন্তী। চিরচেনা কৃষ্ণচূড়া গাছটির ছায়াতলে বসে আছে। বই পড়ার পাশাপাশি বারবার আড়চোখে ভার্সিটির মূখ্য গেটের দিকে তাকাচ্ছে সে। পাশেই বসে বসে বাদাম চিবুচ্ছিল পারু। হৈমন্তীকে বারবার গেটের দিকে তাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “কিরে! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন বারবার? কাউকে খুঁজচ্ছিস?”

হৈমন্তী চমকে উঠলো যেন। থতমত গলায় বললো,
— “কা–কাউকে না। কাউকে খুঁজছিলাম না।”
পারু তার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করলো,
— “মিথ্যা বলছিস? আমি জানি তুই কাকে খুঁজছিস।”
— “উলটাপালটা কথা বলিস না। আমি কাউকে খুঁজছি না।”

হৈমন্তীর কথা বিশ্বাস করলো না পারু। ডিটেকটিভের সত্ত্বা নিজের মাঝে বহন করে বললো,
— “আমার মনে হয়, তুই তুষারকে খুঁজছিস। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, ও আজকে ভার্সিটি আসে নি।”
হৈমন্তী আনমনেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
— “কেন আসেনি?”

এবং প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই বিশাল বড় বিপদে পরে গেল সে। পারু নামক ভয়ংকর জীবটি হামলে পরে বললো,
— “দেখেছিস? আমি বলেছিলাম না, তুই তুষারকেই খুঁজছি? তুষারকে তুই ভালোও বাসিস। কিন্তু স্বীকার করতে চাচ্ছিস না।”

হৈমন্তী উত্তর দিলো না। আগ্রহীন দেখালো তাকে। পারু নিজ থেকেই আবার বলতে লাগলো,
— “দেখ হৈমন্তী, তোর হাবভাব বলে দেয় তুই তুষারকে ভালোবাসিস। তাছাড়া একদিন না একদিন আঙ্কেলও মেনে নেবেন তোদের সম্পর্ক। তাহলে কেন ছেলেটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিস? তুষার সত্যিই ভালোবাসে তোকে হৈমন্তী।”
ওপাশ থেকে হৈমন্তী অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, “বাবা মানবে না পারু। কক্ষনো মানবে না।”
হৈমন্তীকা

২২.
কড়া রোদে আশপাশ খা খা করছে। কারেন্টের তারে চুপচাপ বসে আছে কালো কুচকুচে একঝাঁক কাক। মাত্র গোসল সেরে এসেছে তারা। শরীর ঝাঁকিয়ে দেহের সমস্ত পানি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে বারংবার। হৈমন্তী ঘরের এককোণে থাকা টেবিলটা পরিষ্কার করছিল। ইদানিং পড়াশোনা সব লাঠে উঠেছে তার। টেবিলের ধারের কাছেও ঘেঁষে না সে। ফলস্বরুপ, টেবিলের জায়গায় জায়গায় ধুলোবালি বিরাট আস্তানা গেড়ে রেখেছে। উপরের তাকটা পরিষ্কার করতেই কোত্থেকে হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হলো হেমন্ত। কণ্ঠে হাজারো ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে চেঁচালো,
— “আপু? বাবা কেমন যেন করছে। কথা বলতে পারছে না। বিছানায় শুয়ে কেমন কাতরাচ্ছে…”
এটুকু শুনে উত্তেজিত হলো হৈমন্তীও। দ্রুত বাবার রুমে ছুটতে ছুটতে বললো,
— “মা বোধ হয় ছাদে হেমন্ত। মাকে ডেকে আন। আমি বাবার কাছে যাচ্ছি।”

হেমন্ত ছাদের উদ্দেশ্যে দৌঁড় লাগালো। বাবার রুমে প্রবেশ করতেই হৈমন্তীর নজর প্রথমেই আসরাফ সাহেবের ঘর্মাক্ত মুখখানায় আটকালো। পুরো শরীর ঘেমে একাকার উনার। সটান হয়ে শুয়ে কেমন হাসফাস করছেন। হৈমন্তী দৌঁড়ে বাবার মাথার কাছটায় হাঁটু গেড়ে বসল। দু’হাতে উনার একহাত চেপে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা? এমন করছো কেন? খারাপ লাগছে?”
আসরাফ সাহেব মেয়ের দিকে ঝাপসা চোখে তাকালেন। কণ্ঠ যেন অচল তার। বহু কষ্টে থেমে থেমে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
— “বুকে কষ্ট হচ্ছে মা। খুব কষ্ট হচ্ছে।”

হৈমন্তী আরও ব্যস্ত হয়ে পরলো। আসরাফ সাহেবকে উঠানোর চেষ্টা করে বললো,
— “একটু কষ্ট করে উঠার চেষ্টা করো বাবা। আমরা হাসপাতালে যাবো।”

আসরাফ সাহেব প্রায় অজ্ঞান। তাকে উঠাতে গিয়ে হৈমন্তী টের পেল, তার শক্তি ফিকে পরে যাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও উনাকে উঠাতে পারছে না। এদিকে রাবেয়া এসেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। নিরুপায় হৈমন্তী হেমন্তকে বললো,
— “পাশের বাসার আঙ্কেল আছে কি-না দেখে আয় হেমন্ত। উনাকে ডেকে আন।”
— “উনারা নেই আপু। আসার সময় দেখে এসেছি আমি। দরজায় তালা মারা।”

‘বিপদে যখন আসে সবদিক থেকেই আসে’ — প্রবাদটি একদম সত্য মনে হলো হৈমন্তীর। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। কি করবে বুঝতে করছে না। মস্তিষ্ক একদম শূণ্য! হঠাৎ তুষারের কথা মনে পরলো তার। একবার ফোন করবে কি? চটজলদি রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলো সে। তুষারের নম্বরে ডায়াল করলো। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। তুষার প্রথমেই নরম স্বরে ডাকলো, “হৈমন্তীকা?”

এতক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা হৈমন্তী যেন নিমিষেই গুড়িয়ে গেল। নিশ্বাস ঘন হলো তার। চোখ থেকে গড়িয়ে পরতে লাগলো বিন্দু বিন্দু জল। অশ্রুসিক্ত গলায় সে বললো,
— “বাবা কেমন করছে তুষার। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”

ওপাশে অসহ্য রকমের নীরবতা। সে চুপচাপ শুনছে হৈমন্তীর কান্নার শব্দ। খানিক্ষণ পরেই উত্তর এলো, “আমি আসছি, হৈমন্তীকা।”

_____

আসরাফ সাহেবকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে হার্ড এট্যাক করেছে তিনি। কেবিনের সামনে লাল, নীল, হলুদ রঙের ছোট্ট চেয়ারগুলোর একটিতে চুপচাপ বসে আছে হৈমন্তী। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ভেতরটা হাহাকারে চিৎকার করছে বারবার। তুষার মাত্র ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। নিঃশব্দে হৈমন্তীর পাশে বসলো সে। অনেক্ষণ কিছু বললো না। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো প্রিয়তমার লালচে মুখপানে। পরক্ষণেই আস্তে আস্তে হৈমন্তীর হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। কোমল স্বরে আওড়ালো,
— “কান্না চেপে রেখেছেন কেন হৈমন্তীকা? বুকে আসুন। ভেতরকার কষ্টে ভিঁজিয়ে দিন আমার বুক।”

হৈমন্তীর কি যেন হলো। এক অক্ষরও অমান্য করলো না কথার। ঝাপিয়ে পরলো তুষারের প্রশস্ত বুকে। তুষার সযন্তে আগলে ধরলো প্রিয়তমাকে। ছোট্ট মাথাটা চেপে ধরলো বুকের বা’পাশটায়। হৈমন্তী কেঁদেই গেল। যতক্ষণ না কষ্ট কমলো ঠিক ততক্ষণ কাঁদলো। ফাঁকা ফ্লোরের অল্প কিছু নার্স আর রোগী অবাক চোখে দেখতে লাগলো ওদের।

কান্না থামলো বেশ কিছুক্ষণ পর। আলতো হাতে হৈমন্তীর আঁখিজোড়া মুছে দিলো তুষার। বললো,
— “আঙ্কেলকে দেখে আসুন হৈমন্তীকা। যান!”

হৈমন্তী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো। কেবিনে গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াতেই শক্ত মুখে অন্যদিকে ফিরে তাকালেন তিনি। হৈমন্তী বিস্মিত হলো। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা? মুখ ফেরালে কেন?”

আসরাফ সাহেব জবাবহীন। সে আরেকবার জিজ্ঞেস করতেই দূর্বল গলায় ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “এত অপমান, লাঞ্চনার পরও তুই কিভাবে ঐ তুষার ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিস? লজ্জা করলো না তোর? দরকার হলে আমি মরে যেতাম। তবুও কেন ওই ছেলেকে সাহায্যের জন্য ডাকলি তুই? আর কোনো মানুষ ছিল না?”

আসরাফ সাহেব থামলেন। হৈমন্তী অসহায় চোখে মায়ের দিকে চাইলো। তিনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। সে কাঁপা গলায় বলতে নিলো,
— “বাবা…”
আসরাফ সাহেব বলতে দিলেন না সম্পূর্ণ কথা। কাঠকাঠ গলায় আবার বললেন,
— “ভাববি না ওই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে কখনো দেব আমি। এক্ষুণি ওর সাথে সব যোগাযোগ বিছিন্ন করবি তুই। তোর পরীক্ষা শেষ হলেই নাওয়াজের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবো আমি। যদি না মানতে চাস, তাহলে বাবাকে ভুলে যা আজীবনের জন্য।”

গলায় কথা দলা পাকিয়ে গেল হৈমন্তীর। কিছু বলতে পারল না। একবার করুণ নয়নে বাবাকে দেখে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল সে। চেয়ারগুলোর দিকে নজর যেতেই দেখল, তুষার নেই এখানে। আশেপাশে তাকিয়েও তুষারের দেখা মেললো না। হৈমন্তী বেদনাদায়ক এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এগিয়ে গিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো চেয়ারে।


এর আধাঘণ্টা পরই কোত্থেকে এক কাগজ নিয়ে হৈমন্তীর পাশে ধপ করে বসে পরলো তুষার। কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বললো,
— “এখানে সাইন করুন হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী পিটপিট করে তাকালো। তুষারের মুখশ্রী গাম্ভীর্যে ভরপুর। কণ্ঠস্বরও গম্ভীর ভীষণ। সে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “কি এটা? সাইন করবো কেন?”
তুষার আগের ন্যায়ই বললো,
— “হাসপাতাল থেকে দিয়েছে। সাইন করুন।”

হৈমন্তী কিছু না বলে কাগজটা পড়তে নিলেই ধমকে উঠলো তুষার,
— “পড়তে বলিনি আপনাকে হৈমন্তীকা। সাইন করুন!”
হৈমন্তী বিমূঢ় হলো। স্তব্ধ হয়ে তাকালো। বলতে চাইলো, “পড়লে কি অসুবিধে…?”
— “বেশি কথা বলছেন হৈমন্তীকা। সাইন করুন। দেড়ি হচ্ছে আমার।”

একরাশ দ্বিধা নিয়ে সাইন করে দিলো হৈমন্তী। সাইন করার সময় খেয়ালে এলো, পাশে টি(T) দিয়ে আরও একটি সাইন করা। হয়তো নার্স তুষারকেও বলেছে সাইন করতে। সাইন করার সাথে সাথেই কাগজটা ছিনিয়ে নিলো তুষার। তার অদ্ভুদ আচরণে হতবিহ্বল হৈমন্তী তখন আরও একবার প্রশ্ন করলো,
— “এবার তো বলুন, এটা কিসের কাগজ? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন সাইন করতে বলেছে? পড়তে দিন আমাকে।”
— “এটা রেজেস্ট্রি পেপার ছিল।”
তুষারের এক বাক্যে থমকে গেল হৈমন্তী। চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো, “কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে আপনার?”

এতক্ষণে তুষারকে শান্ত দেখালো। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর গলায় কপাল ঠেকালো সে। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “আমি ক্লান্ত, হৈমন্তীকা।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here