#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
২৬.
আকস্মিক হাতে হেঁচকা টানে চমকে উঠলো মেহেনূর।চটজলদি বাঁ হাতে চোখের বাঁধনটা খুলে সামনে তাকালো।অর্ক চোয়াল শক্ত করে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ককে সামনে দেখে মেহেনূরের কপাল কুঁচকে আসে।অর্কের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে পুরো ছাদে একবার চোখ বুলালো মেহেনূর।পুরো ছাদ ফাঁকা।ছাদে রোশান,জীম আর ও কানামাছি খেলছিল।কিন্তু এখন কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না।
– ওরা চলে গেছে।
ভারী কন্ঠে বলল অর্ক।অর্কের বলা কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহেনূর কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
– চলে গেছে?আমাকে না বলে।
– ওদেরকে আমি বলেছি চলে যাওয়ার জন্য।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলল অর্ক।মেহেনূর অর্কের কথায় অবাক হয়,সাথে একটু বিরক্তও হলো।ওরা কি সুন্দর খেলছিল, মাঝখানে খেলাটা ভেস্তে দিলো।আর রোশান, জীম শয়তান দুটো এইভাবে না বলে চলে গেলো?এখন যদি ছাদ থেকে পড়ে হাত পা ভাঙতো?মারাও তো যেতে পারতো ও।তখন কি হতো?মেহেনূরের ওদের দুজনের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।দুটোকে আগে হাতের কাছে পাক তার পরে বুঝাবে।চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস টানে মেহেনূর।মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– কেন?আমরা তো খেলছি…..
– তুমি নিজেকে কি মনে করো?তুমি কি মনে করো,তুমি যা চাইবে তাই হবে?দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে আমি তোমাকে কেন বিয়ে করতে চাইবো?তুমি আমাকে কতটুকু চিনো?আমার সম্পর্কে কতটা জানো তুমি?আমার মতামত না জেনে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে?বিবিজান হয়তো একটু ভুল বুঝে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই বলে তুমিও সেটার সু্যোগ নেবে?
মেহেনূরকে বলতে না দিয়ে ওর কথার মাঝে রূদ্ধশ্বাসে প্রশ্নগুলো করলো অর্ক।মেহেনূর হতভম্ব হয়ে শুধু অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্কের এইসব প্রশ্নের মানে বুঝতে পারছে না ও।তবে মেহেনূরের কাছে অর্কের প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর আছে।ওর বাঁ হাতে থাকা চোখ বাঁধার কাপড়টা পাশে ছাদের কার্নিশে রেখে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে অর্কের সামনে এসে স্মিত হেসে বললো,
– যদিও আপনার কথাগুলোর মানেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।তবে আপনার প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমি দিতে পারবো।বলি?
অর্কের জবাবের আশায় না থেকে মেহেনূর ফিচেল হেসে ফের বললো,
প্রথমত,আমি নিজেকে কি মনে করি?আমি যা চাই তাই হবে কিনা?
“আমি নিজেকে অন্যদের মতো একজন সাধারণ মেয়েই মনে করি।রিজিকের মালিক আল্লাহ।আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটাই তিনি আমাদের দিয়ে থাকেন।সব কিছু আমার মতে হবে,এটা আমি চাইবো তো দূর কোনোদিন চিন্তাও করি নি।”
দ্বিতীয়ত,দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইবেন?
“কেন আমি কি এই দুনিয়ায় থাকি না?আমি কোনো ভিনগ্রনী নাকি?আমিও আর পাঁচ দশটা মেয়ের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক,আমাকে বিয়ে করতে কারো আপত্তি থাকার কথা না।অবশ্য আমাকে যার পছন্দ হবে সেই তো বিয়ে করবে।কিন্তু আপনি কেন বিয়ে করতে চাইবেন না বা কেন চাইবেন সেটার উত্তর আপনার কাছে রয়েছে।”
তৃতীয়ত,আমি আপনাকে কতটুকু চিনেছি বা জেনেছি?
“আপনি এত বড় একটা এনজিও চালান শুধু অসহায় গরীব দুঃখীদের সাহায্য করবেন বলে।অবশ্যই নিঃসন্দেহে আপনি একজন উদার আর ভালো মনের মানুষ।আপনি খুব বেশি বদমেজাজী না হলেও একটু বদমেজাজ আপনার আছে।তবে আপনি একটু বেশিই রাগী,হুটহাট রেগে যান।একটু আধটু জেদ,অভিমান সবারই থাকে,আপনারো আছে।আমার কাছে আপনাকে খুবই উদাসীন আর চিন্তিত মনে হয়।হয়তো মনের মধ্যে না বলা অনেক কথাই আছে,কষ্টও আছে!হয়তো সেই অব্যক্ত কথা আর কষ্টগুলো কাউকে বলতে পারেন না বলেই,রাতের আঁধারে সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার অহেতুক চেষ্টা করেন!আপনি মানুষকে না বুঝে জাজ করে ফেলেন!তাঁকে বুঝার চেষ্টা করেন না।হয়তো নিজের অজান্তেই এমনটা করে ফেলেন।তবু,এই ভুলটাই আপনি করে থাকেন।যাকে আপনার পছন্দ না তাঁর ছায়াটাও আপনি দেখতে পারেন না।তবে আপনি কাছের মানুষদেরকে খুব ভালোবাসেন,ভালোবাসতে পারেন।নিজের মাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসেন,ভয় করেন,শ্রদ্ধাও করেন।এই তো আপনি!”
– এখন আপনি বলুন তো,আমাকে বিয়ে করতে গেলে আপনার মতামত কেন নিতে হবে?আর আমি কেনই বা কারোর ভুলের সুযোগ নিতে চাইবো?কি করেছি আমি?আর আমি কার কি সুযোগ নিয়েছি?
অর্ক হা করে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।হাসি মুখে ওর মুখে উপর এতগুলো কথা বলে দিলো এই মেয়ে?মেহেনূর ওর সম্পর্কে যতটুকু বলেছে সবটাই সত্যি!এই মেয়ে এতটা বিচক্ষণ? তবে অর্ক মেহেনূরের শেষের প্রশ্ন গুলোর কথা ভেবে একটু বেশিই অবাক হচ্ছে।মেহেনূর এমন ভাবে কথাগুলো বলছে যে,অর্ক এই বিয়েতে রাজি না থাকলেও সমস্যা নেই,বিয়েটা হবেই!আবার সবকিছু জেনেও এমন ভান করছে যেনো ও কিছুই বুঝতে পারছে না।এইমুহূর্তে অর্কের কাছে মেহেনূরকে খুব হ্যাঙলা লাগছে।ওর উপর জোর খাটানোর পাইতাড়া করছে না তো আবার?চালাকচতুর থাকা ভালো।কিন্তু এত চালাকি আবার ভালো না।মেহেনূর চালাকি করছে ভেবে মুহূর্তেই অর্কের রাগ উঠে যায়।পরমুহূর্তেই নিজেকে প্রস্তুত করে মেহেনূরকে কিছু কটূ কথা শোনাবে বলে।কিন্তু কেন জানি ওর মন সায় দিচ্ছে না।অর্কের বরাবরই এমন হয়।মেহেনূরের চেয়ে ওর শব্দ ভান্ডার খুবই সীমিত!মনে হয় এই মেয়েটার সামনে ওর সব শব্দ শেষ হয়ে গেছে, ওর দম ফুরিয়ে যায়।মেহেনূরের চোখের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে কথা বলতে পারে না ও।অর্কের মনে হয় এই বুঝি মেহেনূর ওর কথায় কষ্ট পেয়ে কেঁদে দিলো।ধমক শুনে এই বুঝি চমকে উঠলো।অর্কের আবার এটাও মনে হয়,ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চুপ থাকা মেহেনূরের সাথে একদম বেমানান।কারণ এই মেয়ে স্পষ্টভাষী, বেপরোয়া, নিশ্চুপ,নম্রতা ভদ্রতায় সুশ্রী।পরমুহূর্তেই অর্ক ভাবে,মেহেনূর যাইহোক না কেন ওর অন্যায় থাকলে অর্ক ওকে কঠোরভাবে কথা শুনাবেই!অর্ক ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়াগলায় বললো,
– আমাকে বিয়ে করবে অথচ আমার মতামত নিবে না? স্ট্রেইঞ্জ!সামহাউ বিবিজান মনে করেছে আমি হয়তো তোমাকে পছন্দ করি বা এই রকম একটা কিছু ।এর সূত্র ধরে তিনি সবার কাছে তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছেন।কিন্তু তুমি তো জানো,আমি তোমাকে পছন্দ করি না তাহলে কিভাবে এই বিয়েতে তুমি রাজি হলে?এটাকে কি সুযোগ নেওয়া বলে না?
অর্কের বলা প্রথম কথাটা শুনেই মেহেনূর বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ছিল অর্কের দিকে।এখনও নির্বিকার ভাবেই তাকিয়েই আছে।অর্ক মেহেনূরের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে ওর উত্তরের আশায়।মেহেনূর অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– আপনাকে বিয়ে করছি মানে?এইসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছেন আপনি?আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই এটা কখন বললাম?
মেহেনূরের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অর্ক।মেহেনূর কি আদৌও জানেই না ওর বিয়ের কথা হচ্ছে?তাহলে সবাই যে বললো,ও বিয়ের জন্য রাজি।নাকি মেহেনূর ওর সাথে মজা করছে?মজা করার মেয়ে মেহেনূর নয়,এটা অর্ক ভালো করেই জানে। অর্কের সাথে মজা করবে এই সম্পর্কও ওদের দুজনের মধ্যে নেই।তাহলে কি ও সত্যিই জানে না?অর্ক আশ্চর্য হয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,
– তোমার বাবাকে তুমি বলো নি এই বিয়েতে তুমি রাজি?
– না!আপনি কি বলতে চাইছেন,আমি বাবাকে বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই?
– তুমি আঙ্কেলকে বলেছো,তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি।
অর্ক শক্ত গলায় বললো কথাটা।মেহেনূর কপালে ভাঁজ ফেলে শূন্যে দৃষ্টি স্থির রেখে কিছু একটা ভেবে ধীর কন্ঠে বলল,
– কালকে সন্ধ্যা সময় আপনাদের বাসার সবাই আমাদের বাসায় এসেছিল।সেখানে আপনার মামাও ছিল।রাতে বাবা যখন আমার রুমে আসেন তখন হয়তো উনারা সবাই চলে গিয়েছিলেন।বাবা এসে আমাকে বললেন,আমার বিয়ের জন্য নাকি সম্মন্ধ দেখছেন।বাবা এখন আমার বিয়েটা দিয়ে দিতে চান।তখন বাবা আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, আমি এখন বিয়ে করতে রাজি কিনা।তখন আমি বলেছিলাম উনাদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।উনারা যা ভালো মনে করবেন সেটাই করবেন।আমি জানতাম না যে আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে।
অর্ক হতবাক হয়ে মেহেনূর কথা শুনলো।তাহলে মেহেনূর সত্যিই জানে না অর্কের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে।অর্ক পূর্বের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন না করেই বললো,
– যাইহোক!তুমি এখন সোজা নিচে যাবে আর ওখানে গিয়ে তোমার বাবাকে বলবে আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না।তুমি এই বিয়েতে রাজি নও,ঠিক আছে!
– শুধু আমি কেন বললো?আমি যেমন এই বিয়েটা করতে চাই না,ঠিক আপনিও চান না।তাহলে তো আপনারো বলা উচিৎ।
– আমি অলরেডি বাসায় বলে এসেছি,আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।কারণ,আমি অন্য কারোর প্রতি দূর্বল।না তারথেকেও বেশি কিছু!আমি তাঁর প্রতি গভীরভাবে আসক্ত।
“আমার হৃদকুটিরে তাঁর বাস
মনপাড়ায় নীরব নিঃস্তব্ধতায় বিচরণ তাঁর
ওর আগুন ঝরা রূপে আমি হয়েছি আড়ষ্ট
ওকে ঘিরেই যতো ব্যাকুলতা,তাহাতেই আকৃষ্ট
বন্ধ চোখের পাতায় আঁকি তাঁরই প্রতিচ্ছবি
দক্ষিণা বাতায়নে কান পেতে শুনি তাঁর ঠা’ঠা হাসি
তবে আমি কিন্তু তাঁর গুণেই মুগ্ধ
তাঁর সুরের ঝংকারই আমার নিত্যতার সূত্র”
অর্কের বলা প্রত্যেকটা কথায় ছিল মাদকতা আর মুগ্ধতায় ঘেরা এক সুপ্ত বাসনা।ছন্দময় সতেজতায় পরিবেষ্টিত ছিল অর্কের প্রেমউক্তি।মেহেনূর অপলক ভাবে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ক মেহেনূরের দিকে তাকাতেই মেহেনূর ওর প্রসারিত দৃষ্টি সড়িয়ে নেয় অদূরেই।পরমুহূর্তেই মুচকি হেসে বললো,
– তা এই অন্য কেউটা কে শুনি।
– তুমি কিরণ চৌধুরীর নাম শুনেছো?
অর্কের মুখে কিরণ চৌধুরীর নাম শুনতেই আঁতকে উঠলো মেহেনূর।নিজের মনের অজান্তেই কলিজাটা কেমন ধুক করে উঠলো।অর্ক হঠাৎ করে কিরণ চৌধুরীর প্রসঙ্গে কথা বলছে দেখে মেহেনূর একটু বিস্মিত হয়।
– চিনো তো ওকে?
মেহেনূরের জবাব না পেয়ে অর্ক ফের প্রশ্ন করলো।মেহেনূর অর্কের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে অর্কের অগোচরে ঠোঁট টিপে হাসলো।ও কিরণ চৌধুরীকে চিনবে না সেটা কখনও হয় নাকি!মেহেনূর ঠোঁটের আগায় হাসি টেনে বললো,
– চিনবো না কেন। আমিই ত….
– হাহ্!কোথায় কিরণ আর কোথায় তুমি।তোমরা দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা বুঝলে?তোমাদের ওই কানাডাতেই তো থাকে ও।আমার থেকে হয়তো আরো ভালো তুমিই চিনো ওকে।কতবড় রকস্টার ও।অথচ পিচ্চি একটা মেয়ে।তোমাদের বয়স প্রায় একই হলেও তোমাদের দুজনের মধ্যে তফাৎ টা আকাশ পাতাল।তোমার কি মনে হয়?তুমি আদৌও কি ওর সমতুল্য?হ্যাঁ,তবে তুমি যতেষ্ট গুণবতী,বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচিউর।তুমি নম্রভদ্র,সুশ্রীও।আবার অন্যদের থেকে অনেক আলাদাও। হয়তো অনেকের চোখে তুমি অন্যন্যও।তাই বলে যার জন্য যে জায়গা বরাদ্দ তাকে সেটা না দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেবো?
মেহেনূরের পুরো কথা না শুনেই অর্ক অনর্গল কথা বলছে।অর্ক যেমন মেহেনূরের দিকটা বলছে তেমনি কিরণ আর ও যে এক না সেটাও বার বার অর্ক ওর কথার প্যাচে বুঝানোর চেষ্টা করছে,মেহেনূর সেটা বুঝতেও পারছে।অর্ক হয়তো কথাগুলো তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে বলতে চায় নি।কিন্তু কথাগুলোর মানেটা ওইদিকেই নিয়ে যায়।অবশ্য অর্কেরও দোষ নেই।এই মেয়ের যত ফ্যান ফলোয়ার বাবা!কি এমন করে এই মেয়ে?শখের বসে একটু আধটু গানই তো করে!এতেই এত ঝাঁঝ!একটু বেশিই মানুষের মুখে মুখে থাকছে নাকি আজকাল!বেশি উড়া আবার ভালো না।যাইহোক, মেয়ের কদর আছে দেখে ভালো লাগলো।মেহেনূর আরো একবার ঠোঁট টিপে হাসলো।কিন্তু এক কথার মাঝখানে আরেক টপিক মানে কিরণ চৌধুরী কোথা থেকে এলো মেহেনূর সেটাই বুঝতে পারছে না।
– আমি যে ওই কিরণেই ঝলসে গিয়েছি।
অর্কের শীতল কণ্ঠে বলা কথাটা কর্ণধারে এসে ভিড়তেই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মেহেনূর।ভ্রু কুঁচকে দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে ও।পরমুহূর্তেই মনে মনে তাচ্ছিল্যে হাসে।অর্ক যদি ওর পুরো কথাটা শুনতো তাহলে হয়তো আজ এর একটা বিহিত করলেও করতে পারতো!কিন্তু অর্কের জন্য এটা আফসোসের নাকি দূর্ভাগ্যের মেহেনূরের জানা নেই।তবে হ্যাঁ,অর্কের ব্যবহারে ওর খারাপ লেগেছে।অর্ক ওর পুরো কথাটা শুনলোই না!আরে ঔ তো একজন মানুষ।ভালো লাগা,খারাপ লাগার অনুভূতি ওরো আছে।এই ছেলেটা বড্ড বেশিই আবেগের প্রথাবদ্ধ।সবসময়ই নিজের মর্জিতে বশবর্তী।সামনের মানুষটাকেও তো মাঝে মধ্যে বলার সুযোগ দেয়া উচিৎ।এতে অনেক সময় নিজের লাভ হবে বৈ ক্ষতি হবে না!মেহেনূর ক্ষুদ্র একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে।সবসময় কেন ও-ই ছাড় দেবে?অন্যের ভুলটাকে কেন প্রশ্রয় দেবে ও?কখনো যদি ভুল শুধরে শুদ্ধতা পায়,তবে নিজেই না হয় খুঁজে নেবে।আজ বরং ও চুপ করেই থাক।কি দরকার আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়ার?শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে!এইভাবেই তো বেশ আছে ও নির্ভেজাল,চিন্তামুক্ত।মেহেনূর মুখে হাসি ঝুলিয়ে জোর গলায় বললো,
– এই বিয়েটা হচ্ছে না।আপনি নিশ্চিন্তে বাসায় যান।
মেহেনূরের কথায় স্মিত হাসলো অর্ক।মেহেনূরের কাছ থেকে এই রকম জবাব পাওয়া অপ্রত্যাশিত নয়।কৃতজ্ঞতাসরূপ মেহেনূরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছাদ ত্যাগ করলো অর্ক।অর্ক চলে যেতেই দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহেনূর।পরমুহূর্তেই মাথায় তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। আচমকায় এই ব্যাথার আগমন ঘটলো কেন আবার!যাইহোক এইমুহূর্তে এক কাপ গরম চা না খেলেই নয়।এই মাথার ব্যাথা নিবারণের জন্য এক কাপ গরম চা-ই যতেষ্ট।
____________________
শরতের আকাশে চলছে মেঘবতীদের অবাদ আনাগোনা।শরতের আগমনে সাদা পাড়ের নীল শাড়িতে গাঙিনী নিজেকে সাজিয়েছে।গাঙিনীর নীলাক্ত জল আর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁশফুল তো গুলো তারই জানান দিচ্ছে!মেহেনূর অপলকে চেয়ে আছে গাঙিনীর পানে।মেঘবতীরা উড়ে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে।তাঁদের প্রতিচ্ছবি আঁচড়ে পড়ছে গাঙিনীর বুকে।গাঙিনীর অগণিত ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে।
মেহেনূর চুপচাপ বসে আছে।এতক্ষণ অপলক চেয়ে থাকলেও এখন প্রকৃতির লীলাখেলা দেখতে ওর দৃষ্টি অস্থির।একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে। তবে ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে,তবে তৃপ্তির!মেহেনূর কানাডায় টরেন্টো শহরে শরতের এই দৃশ্য দেখেছে বহুবার,বহুকাল।কানাডার বড় হ্রদ-গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অন্টারিও হ্রদ এই হ্রদের পাশেই কানাডার সবচাইতে বড় শহর অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী টরেন্টোর অবস্থান।লম্বায় প্রায় ৩০০ ও পাশে ৮৫ কিলোমিটার প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিম এই হ্রদের উত্তর পাড়ে কানাডার নায়াগ্রা, হ্যামিলটন, টরেন্টো ও কিংস্টোন শহরগুলো।আর দক্ষিণ পাড়ে আমেরিকার সমগ্র নিউইয়র্ক প্রদেশ বা স্টেট।এই হ্রদের গভীরতা কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ প্রায় ২৪৪ মিটার, পানির তাপমাত্রা ফেব্রুয়ারিতে প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি থাকলেও আগস্টের তা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়।টরেন্টোর সিএন টাওয়ার থেকে মেঘমুক্ত আকাশে ৮শ কিলেমিটার দূরের আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের আলোর ছটা নজরে আসে। গ্রীষ্মে এই অন্টারিও হ্রদই টরেন্টো বাসীদের সি-বীচের স্বাদ নিয়ে প্রধান আকর্ষণ রূপে আবির্ভূত হয় এবং সকল জাঁকজমকতা এই বীচকে ঘিরেই।
তবে ওই জাঁকজমকপূর্ণ হৃদের চেয়ে গাঙিনীর এই রূপ বহুগুণ বেশি।নিজ দেশের নিজ জন্মভূমির আজকের এই বিকেলটা খুব মুগ্ধতার।শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্মল সবুজে ঠাসা।জীবনের ক্লান্তি, চাপ, ব্যাথাগুলো যত ভারী তরই হোক না কেন,এমন একটা বিকেল কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মাথাটা হালকা করে দেবেই।
আজ তিনদিন হলো!মেহেনূর সবাইকে সবটা বলেছে।অবশ্য গত দুই দিন বাসার সবাই একটু গুমোট ছিল,শুধু মেহেনূর ছাড়া।কিন্তু আজ সকাল থেকেই সবকিছু আগের মতোই,স্বাভাবিক।গত দুইদিনে মেহেনূর শান্তর সাথে কথাবার্তা বলে আজকে এই গাঙিনীর পাড়ে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়।তবে ওকে তনিমার ব্যাপারে এখনো কিছু বলে নি।আগে আসুক তারপরেই সবটা বলবে বলে ভেবেছে।মেহেনূর তনিমা দুজনেই এসেছে।তনিমা বাদাম কিনতে গেছে সেই কখন, এখনো আসার নাম নেই।মেহেনূর বার কয়েক উঁকিঝুঁকিও দিয়েছে।কিন্তু দৃষ্টি অপারগ।তনিমাকে নজর বন্ধি করতে পারলো না।তাই আবার প্রকৃতি দেখতেই ব্যস্ত মেহেনূর।
– মেহেনূর!
তনিমার ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে মেহেনূর।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করছে তনিমা কি বলতে চাইছে।তনিমা রীতিমতো দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসছে।তনিমা মেহেনূরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দু’হাতের মুঠোয় থাকা বাদামের ঠোঙাগুলো মেহেনূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে তনিমা।মেহেনূর তনিমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থেকে বাদামের ঠোঙার দিকে তাকাতেই ফিক করে হেসে উঠলো।ঠোঙার তলায় গোটাকয়েক বাদাম অবশিষ্ট আছে।ইতিমধ্যে দৌঁড়ের ছুটে সব পড়ে গেছে।তনিমা দাঁত দিয়ে জিভে কামড় দিয়ে অসহায় মুখ করে বললো,
– সরি।আসলে বুঝতে পারি নি।কখন যে সব বাদাম পড়ে গেছে টেরই পায় নি।
– ইটস ওকে।তা এইভাবে দৌঁড়ে আসার কারণ কি জানতে পারি?
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলো মেহেনূর।তনিমা চোখ নামিয়ে নেয়।ভাবটা এমন যে ও লজ্জা পেয়েছে।মেহেনূর ভ্রু নাচিয়ে ফের জিজ্ঞাস করলো,
– উনাকে দেখলে বুঝি?
– হুম।
তনিমার লজ্জামিশ্রিত জবাবে মেহেনূর ঠোঁট টিপে হাসলো।তনিমাকে নিয়ে এগোলো সম্মুখপানে।
চলবে………#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
২৭.
গাঙিনীর পাড়েই গাঙচিল নামক ছোট্ট ক্যাফেটার ভেতরে গোল টেবিলের চার আসনের তিনটা আসন দখল করলো মেহেনূর,তনিমা আর শান্ত।অবশিষ্ট খালি আসন খানি আপাতত শান্তর স্যুটের দখলে।অবয়ব দেখে দূর থেকে মনে হচ্ছে উক্ত আসনে একজন গলা কাটা সাহেব বসে আছে!শান্ত জানতো না এখানে তনিমাও আসবে।এই মেয়ে ওইদিন যা জ্বালান জ্বালিয়েছে ওকে,তারপর দ্বিতীয়বার ওর মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞাই করেছিল মনে মনে।কিন্তু এখানে এসে তনিমাকে দেখে শান্ত ভীষণ অবাক হয়।তবে মেহেনূর সবটা সামলে নিয়েছে।সামনা-সামনি বসে আছে শান্ত আর তনিমা।শান্তর ডানে আর তনিমার বামে অর্থাৎ দুজনের মাঝখানে মেহেনূর বসে আছে।মেহেনূর একবার শান্তকে দেখছে তো আরেকবার তনিমাকে দেখছে।দুজনেই দুই কাজে ব্যস্ত।শান্ত ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে।অবশ্য মেহেনূরের সায় নিয়েই কাজ করছে।আর তনিমা মনের আনন্দে ফোনে সেলফি তুলছে।ফাঁকে ফাঁকে শান্তর অগোচরে ওরো টুকটাক ছবি তুলে নিচ্ছে।মেহেনূর চোখ গোলগোল করে তাকায় তনিমার দিকে।মেহেনূরকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তনিমা মেকি হেসে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দেয়।
– ভাইয়া আপনার কাজ হয়েছে?
বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাস করলো মেহেনূর।শান্ত ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি রেখেই মৃদুস্বরে বললো,
– এইতো প্রায় শেষ।
মেহেনূর আর কিছু বললো না।তনিমার ফোনটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখে নিলো।সাড়ে পাঁচটা বাজে।সন্ধ্যায় ওকে আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে।রাওনাফরা কক্সবাজার থেকে চলে আসছে।ছয়টায় ওঁদের ফ্লাইট ল্যান্ড করবে।
– বলো কি বলতে ডেকেছো।
শান্ত ল্যাপটপটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বললো।তনিমার চোখ চকচক করে উঠলো,চোখে মুখে লাজুকতা।শান্ত আঁড়চোখে একবার তাকালো তনিমার দিকে।তবে আজ ওর কাছে তনিমাকে একটু অন্যরকম লাগছে।ওইদিনের তুলনায় আজকে ছটফটানি ভাবটা অনেক কম।আসার পর থেকে একবারও তনিমার গলার স্বরটা অবধি শুনতে পেলো না।ব্যাপারটা একটু খটকা লাগলো শান্তর কাছে।মেহেনূর স্মিত হেসে বললো,
– আসলে ভাইয়া কথাগুলো একটু পার্সোনাল।
– সমস্যা নেই।তুমি বলো কি বলতে চাও।
– ভাইয়া আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?
– দাদাজান,বাব- মা,আমি আর আমার একটা ছোট ভাই আছে।এইতো আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিপূর্ণ আর সুখী পরিবার।
– কিন্তু আমার তো পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে না।পরিপূর্ণ হতে হলে তো আরো সদস্য প্রয়োজন!
মেহেনূরের কথা শুনে মুচকি হাসলো শান্ত।মেহেনূরও মৃদু হাসে। তনিমার অপলক দৃষ্টি স্থির শান্তর উপর।শান্ত মুখের হাসি প্রসারিত করে বললো,
– আমার ভাই ওহি,ও এখনো অনেক ছোট।সবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।তবে আমার জীবন পরিপূর্ণ হতে খুব বেশি একটা দেরি নেই!আমার জীবনে দাদাজানের কথাই শেষ কথা।দাদাজানই আমার আইডল,বেস্ট ফ্রেন্ড।আমিও তাঁর কথাই মানি।দাদাজান আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করেছেন।উনার কোনো এক বন্ধুর নাতনি।উনার ইচ্ছা সেই মেয়েকেই আমার বউ হিসেবে দেখতে চান।আমিও তাঁর এই ইচ্ছাটাকে অপূর্ণ রাখতে চাই না।আর তাই দাদাজানের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি।অবশ্য আমি এখনো মেয়ে দেখি নি।দাদাজান তাঁর নাম, ঠিকানা আমাকে কখনোই বলে নি।আমি জানতে চায় নি।তবে,দাদাজানের মুখে শুনেছি সে নাকি যতেষ্ট সুন্দরী।দাদাজানের কাছে তার যতটুকু বিবরণ শুনেছি তাতেই আমার কল্পনার রাজ্য সাজিয়েছি।আমার কল্পনা রাজ্যে সেই আমার সম্রাজ্ঞী।বাস্তবেও তাকেই আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মনে করি।আমরা আজই……
শান্ত কথা বন্ধ করে দিয়ে বিস্মিত হয়ে তনিমার দিকে তাকায়।কারণ তনিমা হুট করেই টেবিলে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।শান্তর বলা কথাগুলো হজম করার মতো শক্তি তনিমার নেই।কলিজাটা অজানা ভয়ে বার বার মোচড় দিয়ে উঠছে।চোখ ঘোলাটে হয়ে এসেছে।যেকোনো সময় ভারী বর্ষণ হলে হতেও পারে!তনিমা এখানে আর একমুহূর্তও থাকতে পারবে না।শরীরটা ক্রমশ দূর্বল, অসাড় হয়ে আসছে।কাঁপাকাঁপা হাতে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে এক পলক তাকায় শান্তর দিকে।শুকনো একটা ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে বললো,
– মেহেনূর আমি আসছি।
কথা বলেই বেড়িয়ে যায় তনিমা।।তবে তনিমার এইরূপ আচারণে মেহেনূর মোটেও অবাক হয় নি।কারণ মেহেনূর তনিমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছে।মেয়েটা জীবনের প্রথম কাউকে ভালোবাসলো।আর যাকে ভালোবাসলো তাঁকে ভালোবাসি বলার আগেই দূরে চলে গেলো।অন্যকারো হয়ে গেলো।শান্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– ওর আবার কি হলো?
– তনিমা আপু আপনাকে ভালোবাসে।
মেহেনূরের শীতল কন্ঠ নীরব চাহনি।বিস্ফোরিত চোখে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত।মেহেনূর স্মিত হাসলো।হয়তো শান্তর চোখে কিছু প্রশ্ন ঠাওর করতে পারছে ও।ধীর কন্ঠে বললো,
– আমিও তাঁকে বলেছি,ওইটুকু সময়ে ভালোবাসা হয় না।কিন্তু সে আমার কথা মানতে নারাজ।আমার সামনে ভালোবাসার যুক্তি দাঁড় করিয়েছে।ওটা নাকি ক্ষনিকের মোহ বা ভালো লাগা নয়,ভালোবাসা।জোর গলায় বলেছে,সে ভালোবাসে আপনাকে।যদিও আমার এখন এই কথাটা বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে জানি না তাও বলছি,তনিমা আপু আপনাকে সত্যিই খুব ভালোবেসে ফেলেছে ভাইয়া।যাইহোক,ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।মানুষ তো আর ভাগ্যের লিখন খণ্ডাতে পারে না।প্রত্যাশিত কিছু ঘটলে যেমন আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয় ঠিক তেমনি অপ্রকাশিত কিছু ঘটলে সেটার জন্যও শুকরিয়া আদায় করতে হয়,সন্তুষ্ট থাকতে হয়।কারণ,আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
– হ্যাঁ।
শান্তর ক্ষীণ স্বরের জবাব।মেহেনূর ফের বললো,
– আপনি ব্যস্ত মানুষ, তাও আপনার মূল্যবান সময় থেকে একটু সময় বের করে কষ্ট করে এত দূর আমাদের জন্য এসেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।আর আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। আসি ভাইয়া,ভালো থাকবেন।
– মেহেনূর শোন!
মেহেনূর চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়াতেই শান্তর কথায় পুনরায় চেয়ারটা দখল করে বসলো।আগ্রহী কন্ঠে বললো,
– জ্বি ভাইয়া বলুন।
– তনিমা কি এই বিষয়টা নিয়ে একটু বেশিই সিরিয়াস?
– হয়তো বা!আসলে প্রথম প্রেম তো!তবে আপনি টেনশন করবেন না।তনিমা আপু অনেক ভালো আর সুন্দর মনের একজন মানুষ।উনি আর যাই করুক অন্তত টিনএজের মেয়েদের মতো ঘরে বসে কান্নাকাটি করবে না।হয়তো একটু মন……..
ফোনের রিংটোনের শব্দে থেমে যায় মেহেনূর।ব্যাগ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে এক পলক দেখে নিয়ে ফের তাকায় শান্তর দিকে।মেহেনূরের চোখে বিস্ময় দেখে শান্ত ফিচেল হেসে বললো,
– কে?তনিমা?
– হ্যাঁ!
– কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও।
মেহেনূর শান্তর কথা মতো কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয়।ওপাশ থেকে তনিমার ঝাঁঝালো কণ্ঠে শোনা গেলো,
– তোমার ওই সো কল্ড শান্ত ভাইয়াকে বলে দিও,ছ্যাঁকা খেয়ে ডজন ডজন টিস্যু বক্স ফুরানোর মেয়ে এই তনিমা না।জীবনে অনেকেই একটু আধটু ছ্যাঁকা টেকা খায়।দূর্ভাগ্যবশত আমিও সেই দলে পড়ে গিয়েছিলাম এখন থেকে ঠিক পাঁচ মিনিট আগে!কিন্তু এখন আমি একদম পারফ্যাক্ট আছি।দাদু মাত্রই কল করছিলেন।বললেন,আমাকে আজকে সন্ধ্যা বেলায় পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।হয়তো আজ এনগেজমেন্টও করে ফেলতে পারে।এখন ওই শান্তকে বলে দিও,আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসছি আমি।
রাগে গজগজ করতে করতে কলটা কেটে দিলো তনিমা।তনিমা ক্যাফের বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে।ওখান থেকে স্পষ্ট শান্ত আর মেহনূরকে দেখতে পাচ্ছে ও।তনিমা এটাও দেখতে পেয়েছে মেহেনূর ওর কলটা স্পিকারে দিয়ে শান্তর আর ওর সামনে ধরে রেখেছে।আজকে ওকে দেখতে আসছে এটা ঠিক কিন্তু এনগেজমেন্টের কথাটা তনিমা শান্তকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে।হারামজাদা ছেলে!এইভাবে ওর মনটা এক নিমিষেই ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিলো?শান্তকে বকাবকি করছে সাথে ওর চোদ্দগুষ্টির নামও উদ্ধার করছে!পর ক্ষনেই তনিমার স্মরণ হয়,রাগের মাথায় বলে তো দিয়েছে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসছে।কিন্তু পাত্র যদি পছন্দ না হয়?তখন?
মেহেনূর চোখ বড়বড় করে হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে।শান্তর মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ড আগেই এখানে টর্নেডো এসে নৃত্য করে গেছে!
– যে মেয়ের কন্ঠে এমন ঝাঁঝ,তাকে আদৌ কোনো ছেলে বিয়ে করতে চাইবে তো?
– আলবাত চাইবে।মেয়ে দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ,তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো।তনিমা আপু মনের দিক থেকেও খুব নরম,কোমল।রেগে গেলে ম্যাক্সিমাম মানুষ ওই টোনেই কথা বলে!এখন তনিমা আপুও আপনার উপর রেগে আছে বিধায় ওইভাবে কথা বললো।
– আচ্ছা মেহেনূর আমি আসি কেমন,ভালো থেকো।
– জ্বি অবশ্যই ভাইয়া।
____________________
ভাদ্রের আকাশে পূর্নিমার রূপালী চাঁদটা ঠিক তনিমার মাথার উপর।ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তনিমার পড়নে গোল্ডেল সুতোয় বুনা গাঢ় লাল জামদানী শাড়ি।বাদামী বর্ণের চুলটা ঘাড়ের উপর ঢিলে খোঁপা করা।সামনের বেবি হেয়ারগুলো বাতাসের তালে তালে সায় দিয়ে খুব বিরক্ত করছে ওকে।আঙুলের ভাঁজে টেনে কানের পৃষ্ঠে গুজে দিয়েছে বার কয়েক।বাতাসের স্রোতে গাঁ ভাসাতে কানের পাশ থেকে বার বার উঁকি দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে অবাধ্য কেশরীর দল।
– যারা মুক্ত হয়ে উড়তে চায় তাদেরকে জোর করে আটকে রাখতে নেই,মুক্ত করে দিতে হয়!
আবারো কানের পাশে চুল গুটানোর জন্য উদ্যত হয় তনিমা।আচমকায় আগন্তুকের বলা উক্ত কথাটা কর্ণগোচর হতেই হকচকিয়ে যায় তনিমা।চটজলদি হাত নামিয়ে নেয়।পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে ফের একই কাজ করতে গেলো তনিমা।কিন্তু সেটা করার আগেই নিজের পিঠের উপর চুল গড়িয়ে পড়তেই চমকে উঠলো।বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আগন্তুকের দিকে।পরমুহূর্তেই দৃষ্টি সড়িয়ে নেয় অদূর অন্ধকারে।পুরুষালি শক্ত হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতেই আঁতকে উঠলো তনিমা।নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে ও।এই মানুষটার সাথে সাথে ঘটনাটাও যে তনিমার কাছে অপ্রত্যাশিত।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতেই আলিঙ্গনের মাত্রা আরো শক্ততর হতে লাগলো।নিরুপায় হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় তনিমা।
– কংগ্রেচুলেশন মিসেস শান্ত!
কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই আরেক দফায় আঁতকে উঠলো তনিমা।মনে হচ্ছে রগে রগে শীতল তরল বিশিষ্ট কিছু তীব্র ভাবে ছুটাছুটি করছে।বুকের ভেতর হওয়া ধুকপুক আওয়াজটা হয়তো ওর শরীর ভেদ করে পিছনের মানুষটার কাছ অবধি পৌঁছাচ্ছে অনায়াসেই।কানের লতিতে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ পেতেই তড়িৎ বেগে শান্তর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তনিমা।এই স্পর্শের অনুভূতি বলে বুঝাবার নয়।শান্তর প্রত্যেকটা স্পর্শে ছিল শিহরণ জাগানো অনুভূতি।লজ্জা আর ভয়ের সাথে এক আকাশ সমান অভিমান খুব করে চেপে ধরেছে তনিমাকে।শান্ত এগিয়ে গিয়ে আবারও তনিমাকে পিছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো।অসহায় কন্ঠে বললো,
– সরি ক্যাটবেরি!
বিস্ময়ে ঘাড় কাত করে ছলছল চোখে শান্তর দিকে তাকায় তনিমা।শান্ত তনিমার কাঁধ ধরে ওর দিকে ফেরায়।তনিমা মাথা নিচু করে নেয়।শান্ত ঝুঁকে তনিমার মুখটা এক পলক দেখে নেয়।তনিমা কাঁদছে!শব্দহীন কাঁন্না গুলো খুব ভয়ংকর হয়!তনিমার থুতনি ধরে ওর মুখটা উপরে তুলতেই পুনরায় একই কাজ করে তনিমা।শান্ত স্মিত হেসে তনিমার দু’গাল হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নেয়।অশ্রুসিক্ত আঁখিদুটি মেলে শান্তর দিকে তাকায়।শান্ত ফিচেল হেসে বললো,
– আরে পাগলি আমি কি জানতাম এই তুমিই আমার অদেখা সেই তুমি!আমার মনের রানী।আমাদের মিলনটা হয়তো এইভাবেই হওয়ার ছিল।তোমার অগোচরে আমি আর আমার অগোচরে তুমি।
চলবে………..