#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
২৮.
জানালার সামনের পর্দাটা সড়িয়ে দিতেই জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরের তীর্যক রশ্মি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকছে।প্রবল উত্তাপের প্রখরতায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় মেহেনূর।ঝটপট হাতের পিঠ ঠেকায় চোখের উপর।চোখ বন্ধ রেখেই আহ্লাদী গলায় বললো,
– ভাবী প্লীজ আরেকটু ঘুমাতে দাও না।
মেহেনূরের বিছানাটা একদম জানালার কিনার ঘেঁষে।ফলে সূর্যের আলো খুব তীক্ষ্ণভাবে ওর চোখে মুখে এসে পড়ছে।কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে মেহেনূর।টানা পাঁচ দিন পরে ভাই ভাবীকে কাছে পেয়ে গল্পগুজব করতে করতে কখন যে তিনটা বেজে গেছে টেরই পায় নি।তারপর আবার ঘুমোতে যাওয়ার আগে তনিমার সাথেও প্রায় একঘন্টা কথা বলেছে।তনিমার মুখ থেকে সব শুনে মেহেনূর খুব খুশি হয়েছে।এই মেয়ে অপরের সুখ থেকে কি আনন্দ পায় কে জানে!অথচ নিজের জীবনটা যে কত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে পার করছে সেই দিকে ওর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।সব সময় অন্যদের জন্য চিন্তা করে বেড়ায়।বিডিতে আসার পর থেকে তো বিয়ের ঘটক-ই হয়ে গেছে!রোশনি এবার সবকয়টা পর্দাই সড়িয়ে দিয়েছে।সাথে জানালার গ্লাস গুলোও খুলে দিয়েছে। মেহেনূরের দিকে এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বললো,
– অনেক ঘুমিয়েছো আর না।এবার কিন্তু মা খুব বকবেন।কয়টা বাজে সে খেয়াল কি আদৌ আছে তোমার?
– কয়টা বাজে?
– প্রায় সাড়ে বারোটা।
– কি সাড়ে বারোটা?
মেহেনূরের চক্ষু চড়াকগাছ।এক লাফে বিছানা থেকে উঠে বসলো।চোখ কচলিয়ে দেয়াল ঘড়িটায় তাকালো।বারোটা সাতাশ বাজে।আজকে দুপুর দুটোয় গাঙিনীপাড়ে শেষ বারের মতো তনিমা-শান্ত, দিহাদ-কলি আর অয়নের সাথে দেখা করতে যাবে ও।কারণ আজই মেহেনূর কানাডায় ফিরে যাচ্ছে।ইউনিভার্সিটি থেকে যে ক’দিনের ছুটি ছিল সেটার মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো দুদিন আগেই।রাওনাফ আর রোশনি কক্সবাজার ছিল বিধায় তিনটা দিন এক্সট্রা থাকতে হলো ওকে।মেহেনূর চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে যায়।
_____________________
চারদিকে শরতের শুভ্র কাশফুল, সাথে শরীর-মন জুড়িয়ে দেওয়া বাতাস। শরৎকাল মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সাথে শ্বেত শুভ্র কাশফুলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। ভাদ্র ও আশ্বিন জুড়ে এই দুইয়ের আভায় হৃদয়ে দোলা দেয় প্রকৃতিপ্রেমীদের। শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যাওয়া কাশবন গুলোতে মন জুড়াতে প্রিয়জনকে নিয়ে প্রতিদিন ভিড় করছেন শত শত মানুষ।কাশবনে ঘুরতে এসে আনন্দঘন মুহূর্তগুলো করছেন ক্যামেরাবন্দী।একঘেয়েমি নাগরিক জীবনে শরৎতের এই শুভ্র কাশফুল প্রশান্তি বয়ে এনেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে-প্রাণে।মেহেনূরও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গাঙিনীর তটে।দেখছে প্রকৃতির লীলা-লাস্যময় সৌন্দর্য্য।
– আর ক’টা দিন থেকে গেলে হতো না?এই মাসের ষোল তারিখেই আমাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়েছে।মেহেনূর প্লীজ আরেকটু থেকে যাও না।
তনিমা অনুনয় করে বললো কথাটাগুলো।কিন্তু মেহেনূরের আর একটা দিনও এখানে থাকা পসিবল না।ওর এক্সাম চলে এসেছে।তাছাড়া বিডিতে আসার আগে থেকেই কানাডায় অনেকগুলো প্রজেক্টে সাইন করেছিল।ঠিক সময়ে ওখানে উপস্থিত না হতে পারলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী হয়ে যাবে।তনিমার প্রশ্ন মেহেনূর মৃদু হেসে বললো,
– সেটা হয় না তনিমা আপু।এবার আমাকে যেতেই হবে।অনেকদিন তো হলো আর কত?আমি চলে যাচ্ছি বলে কি হয়েছে,ভাইয়া ভাবী তো এখানেই আছে।তোমাদের বিয়েতে তাঁরা তো থাকবেই।তবে হ্যাঁ,সবাই একসাথে থাকলে অবশ্য ভালো লাগতো।
– রাওনাফ আর কানাডায় যাবে না?
উৎকন্ঠিত স্বর জিজ্ঞাস করলো অয়ন।মেহেনূর স্মিত হেসে বললো,
– যাবে।তবে সামনের মাসে।তাঁদের আরো কিছুদিনের ছুটি আছে।আনফর্চুনেটলি আমি তো আর থাকতে পারছি না।তাই সেই জায়গা থেকে একটু খারাপ লাগছে।তবে অয়ন ভাইয়া আমার আফসোস রয়ে গেলো?
– কি?
– শুধু আপনার বিয়েটাই দেখতে পারলাম না!
মেহেনূরের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।দিহাদ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– শুধু অয়ন কেন অর্কের বিয়েও তো বাকি এখনো।
– উনার ব্যাপার স্যাপার আবার আলাদা!উনি কি আর যে-সে মেয়ে বিয়ে করবেন নাকি?উনার ভাষ্যমতে, মেয়ে হতে হলে কিরণ চৌধুরীর মতো হও।কথা বলতে হলে,কিরণ চৌধুরীর মতো করে বলো।ওর মতো গুণবতী হও, ওর মতো খাও, ঘুমাও,হাঁটো ব্লা ব্লা ব্লা…!কেন?ওই কিরণ চৌধুরী কি মানুষ না।ও কি কোনো ফেরেস্তা!আরে আগে তো ও একজন মানুষ,একটা সাধারণ মেয়ে।তারপর না সে একজন সিঙ্গার,রকস্টার।এই মেয়ে শখের বশে দু একটা গান রেকর্ড করে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে।সেগুলো মানুষ স্বাদরে গ্রহণ করে।এত মানুষের ভালোবাসা পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে গানের জগতে নিয়মিত হয়।গত এক বছর ধরে লাইভ স্টেজ শো কনসার্ট করে।এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিভিন্ন দেশে ওর নাম ডাক হয়েছে বলেই কি সব মেয়েকে ওই মেয়ের সাথে তুলনা করতে হবে।হ্যাঁ আমি মানছি, কিরণ চৌধুরী হয়তো আসলেই খুব ট্যালেন্টেড। তাই বলে সব মেয়েকে কেন কিরণের মতোই হতে হবে?প্রত্যেকের ভেতরেই কোনো না কোনো ইউনিক সুপ্ত প্রতিভা থাকে।আমরা যদি তাঁদের কোণঠাসা করে রাখি তাহলে কি তাদের প্রতিভাগুলো বিকশিত হবে?নিজেদের প্রুভ করার জন্য আমাদের তো ওদেরকে সুযোগ দিতে হবে।আমাদের তো উচিৎ যে যেমন তাঁকে সেই ভাবেই গ্রহণ করা।এমনটা তো হতেই পারে ওই মেয়ে গুলোর মধ্যেও হাজারটা কিরণ চৌধুরী লুকিয়ে আছে।সেই সব প্রতিভা উন্মোচনের জন্য হয়তো শুধু একটু সময় দরকার,উপযুক্ত পরিবেশ দরকার আর দরকার একটু উৎসাহ।পৃথিবীর কোনো মানুষই একজন আরেকজনের মতো হতে চাইলেও হতে পারে না।আমি মনে করি কারোর সাথেই কাউকে তুলনা করে উচিত না।পৃথিবীর সব মানুষের একটা নিজস্ব এবং আলাদা সত্তা রয়েছে।সবাই নিজ নিজ জায়গাতেই সুন্দর,ভিন্ন।
মেহেনূরের কথার সাথে তাল মিলিয়ে গাঙিনীর ঢেউ গুলোও যেন ছন্দ মিলাতে ব্যস্ত।মেহেনূরের প্রত্যেকটা কথাই সত্য,বাস্তব।সবাই চুপ হয়ে মেহেনূরের কথা শুনছে।মেহেনূর যে তিক্ততায় কথাগুলো বলছে সেটা সবার কাছেই স্পষ্ট। তবে ঠিক কি কারণে মেহেনূর উক্ত কথা গুলো বললো সেটাই কারোর বোধগম্য হচ্ছে না।কিন্তু এখানে যে অর্কের ভূমিকা আছে সেটা কিছুটা হলেও সবাই-ই আঁচ করতে পারছে।কারণ অর্কের প্রসঙ্গ আসতেই মেহেনূর কিরণের উপর খেপেছে।সবাইকে নীরব থাকতে দেখে মেহেনূর ফিচেল হেসে বললো,
– সবাই চুপ করে আছো কেন?কি ভাবছো আমি হঠাৎ এইসব কথা কেন বলছি?আরে ছাড়ো তো আমার কথা।আমি তো এমনই!এলোমেলো কথা বলি!তবে আমি কিন্তু কাউকে মিন করে কথাগুলো বলি নি।ভুলেও এই ভুলটা কেউ বুঝবে না,ঠিক আছে।আসলে ইদানীং দেখছি ছোট ছোট বিষয়গুলোর মধ্যেও কিরণ চৌধুরীকে টেনে আনা হচ্ছে,ভালো তেও মন্দ তেও।জীম কিরণ চৌধুরীর বিশাল বড় একজন ফ্যান।কালকে রাতে আমার খালুজান জীমকে পড়াচ্ছিল।তখন শুনলাম খালুজান বলছেন,কিরণ চৌধুরীর মতো হতে হলে এত খেলাধূলা করা যাবে না,বেশি বেশি করে পড়তে হবে।যদিও এটাকে পজিটিভ ভাবেই নেওয়া যায়।কিন্তু পরশু দিন বাবা বলছিলেন,আজ ওই কিরণ চৌধুরীর জন্য আমার মেয়েটা কষ্ট পেলো!আমার মেয়ের বি……
মেহেনূর কথায় কথায় মুখ ফসকে শেষের কথাটা বলে ফেলেছে।পরমুহূর্তেই ওর খেয়াল হলো ও কি বলতে কি বলে ফেলছে এইসব!অর্কের সাথে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল এ কথা কাউকে জানায় নি মেহেনূর।ইনফ্যাক্ট রাওনাফকে না।রাওনাফ জানতে পারলে যদি আবার অর্ককে ভুল বুঝে!সেই ভয়ে মেহেনূর রাওনাফকে কিছু বলে নি।রোশনিকে অবশ্য রেনুফা বেগম আগেই বলে দিয়েছিলেন।যখন বিয়ের কথা হচ্ছিলো।
সবাই মেহেনূরের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে।মেহেনূরের বলা শেষের কথাটি মানে কি?কিরণ চৌধুরীর জন্য ও কষ্ট পেয়েছে মানে?বাকি কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলো কেন?তবে কি অর্কের সাথে মেহেনূরের বিয়ের কথা হচ্ছিলো?নয়তো অর্কের প্রসঙ্গ আসতেই মেহেনূরের সুর পাল্টে কথা বলবে কেন?সবার মনে এই প্রশ্নগুলো ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে।মেহেনূর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে ফিচেল হেসে বললো,
– যাইহোক,বাদ দাও এইসব কথা।দিহাদ ভাইয়া আর কলি আপু তোমরা তনিমা আপুর বিয়ের পর সবাই মিলে হানিমুনে যাওয়ার জন্য কিন্তু কানাডাতেই প্রথম আসবে কেমন।তোমাদের পুরো কানাডাটা আমি ঘুরিয়ে দেখাবো।ওইখান থেকে পরে সুইজারল্যান্ড আর মালদ্বীপ হয়ে অন্য কোথাও যাবে, ঠিক আছে।বাকি কথা কানাডায় গিয়ে হবে।এখন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।বাসায় গিয়ে লাগেজ গোছাতে হবে।আসছি আমি,তোমরা সবাই ভালো থেকে।তোমাদের সাথে কাটানো সময়টা খুব বেশি মনে পড়বে আমার।তোমরা সবাই কত ভালো।দোয়া করি, তোমাদের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সারাজীবন।আমি কিন্তু রোজ তোমাদের ভিডিও কল করবো।তোমাদের কিন্তু খুব বিরক্ত করবো!গাইস,আমি তোমাদের সবাইকে সত্যি-ই খুব মিস করবো।
– আমরাও তোমাকে খুব মিস করবো।
সবাই সমস্বরে বললো।মেহেনূর যে কিছু একটা আড়াল করতে চাইছে বা ওঁদের অগোচরে কিছু একটা ঘটেছে সেটা মোটামুটি সবাই আন্দাজ করতে পেরেছে।তবে মেহেনূরকে কেউ কিছু জিজ্ঞাস করে নি।কারণ মেহেনূরই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া জন্য ওই প্রসঙ্গটা বাদ দিয়েছে।মেহেনূর এগিয়ে গিয়ে কলি আর তনিমাকে আলিঙ্গন করলো।তারপর হাসি মুখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে।শুধু সবার মাঝে রেখে যায় একরাশ মন খারাপের সাথে শূন্যতার ঘেরা এক বিদঘুটে অনুভূতি!
________________________
মেহেনূর, রোশান, সুফিয়া বেগম আর রশিদ সাহেব ফিরতি পথে।ন’টার সময় ওদের ফ্লাইট বিমানবন্দর ছেড়েছে।রেনুফা বেগম মেহেনূরের রুমে এসে চুপচাপ বসে আসেন।হয়তো নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।রুমের লাইট অফ।তবে দরজা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি নিজের প্রিয়তমার গতিবিধি লক্ষ্য করছেন সূক্ষ্মভাবে।তিনিও কেঁদেছেন,তখনও আর একটু আগেও।তবে সবার অগোচরে।মেহরাব সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সম্মুখে।স্ত্রীর পাশ ঘেঁষে বসতেই রেনুফা বেগম স্বামীকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠেন।মেহেনূর কানাডার চলে যাওয়ার পর রেনুফা বেগম ঠিক এইভাবে কাঁদেন,প্রতিবার।রেনুফা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন মেহরাব সাহেব।সেকেন্ড পাঁচেক পর শীতল কন্ঠে বললেন,
– মেহেনূর যাওয়ার সময় কি বলে গিয়েছিল মনে আছে তো?এইবার যদি এত কাঁন্নাকাটি করো তাহলে মেহেনূর কিন্তু বলে গেছে ও আর আসবেই না!
– আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে না গো?
রেনুফা বেগমের করুণ স্বরে বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মেহরাব সাহেবের কলিজাটায় মোচড় দিয়ে উঠে।শুধুমাত্র উনার কথাতেই মেহেনূর এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল।শুধু মাত্র ওর বাবা খুশি হবে বলে।শুধু উনি ওর বিয়ে দিতে চেয়েছেন বলে।নিজের মেয়েকে খুব ভালো করেই চিনেন তিনি।নিজের বাবা মা ভাই একদিকে আর বাকি সবকিছু অন্য দিকে।মেয়ের বুক ফাটবে তাও কোনো দিন মুখ খুলবে না।মেহরাব সাহেব চোয়াল শক্ত করে কড়াগলায় বললো,
– আমরা কি ওদের কাছে সেধে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম?ওরাই তো জোর করলো।আমি তো ওই বড়লোকদের বাড়িতে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই নি।একটা মেয়েকে এমন ভাবে প্রত্যাখ্যান করলো যে, ওকে কোনো মানুষই মনে করলো না!আমার মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো ওই ছেলে!ওইদিন যদি আমরা ওই ছেলের বলা কথাগুলো না শুনতাম?মেহেনূর তো এইগুলো আমাদেরকে কোনোদিনও বলতো না।
– একটা মানুষের মন কতটা সরল আর পবিত্র হলে সবকিছু হাসি মুখে সহ্য করে নেয়?অবশ্য তার দৃষ্টান্ত প্রমাণ আমার মেহেনূর।তাই না?ফুলের মতো পবিত্র, নদীর জলের মতো স্বচ্ছ।তবে এত সরলতার মধ্যেও আমার মেয়ের মনটা কিন্তু বড় কঠিন পাথরে গড়া।চাইলেই ওর মন পড়া যায় না!তুমি কখনো লক্ষ্য করেছো?আমার মেহেনূর মুখের ওই মিষ্টি হাসির আড়ালে হাজারো কষ্ট অনায়াসেই লুকিয়ে ফেলতে পারে।
– আমার মেয়ে যেদিন ওই কিরণ চৌধুরীর চেয়েও বড় গায়িকা হবে সেইদিন ওই অর্ককে আমি উচিত শিক্ষা দেবো।আমার মেয়ের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য যখন উদগ্রীব হয়ে ছুটে আসবে তখন আমার মেয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবো না!তুমি দেখে নিও!
– এইভাবে কেন বলছো?ভালোবাসা কি পাপ?মানুষ ভালোবাসলে এমনই করে!যখন সে প্রেমে পড়ে তখন মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে,মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ভালবাসাটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।পরিণতিতে সে মানুষটা তার শিরা উপশিরায় বিরাজ করতে শুরু করে। তখন তার ভালোবাসার মানুষটার ভুল-ত্রুটি গুলোকেও ভালো লাগে।মনে হয়,এই দুনিয়ায় সবকিছুই মরিচীকা,মিথ্যে শুধু তার ভালোবাসার মানুষটাই সত্য!
– তুমি কি ওই ছেলের পক্ষ নিচ্ছো রেনু?
– না,ভালোবাসার পক্ষ নিচ্ছি!
– রেনু!
– এটাই তো ভালোবাসা।এইটাই তো ভালোবাসার নীতি।কেন তুমিও তো একদিন ভালোবেসেছিলে!তুমিও তো ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরবে বলে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে এসেছে!তবে অর্কের ক্ষেত্রে কেন এটা মেনে নিতে পারছো না?তোমার মেয়েকে দেখছো না,কত সুন্দর করে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে।তুমি একটু ওর মতো করে ভেবো,দেখবে তুমিও মানিয়ে নিয়েছো।
– তাহলে তুমি কেন কাঁদছিলে?
– আমি তো বরাবরই কাঁদি!মায়ের মন তো,মনের মধ্যে অনেক কথায় উঠে!সব কথায় ধরতে হয় না।
___________________
আমেনা বেগম ওইদিন রাতেই চলে গিয়েছিলেন।অর্ক যখন বলে,ও এই বিয়ে করবে না তখন আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব অর্ককে বলেছিলেন, মেহেনূর খুব ভালো মেয়ে।উনারা মেহেনূরকেই তাঁদের ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চান।কিন্তু অর্ক ওর কথাতেই অনড় ছিল।তবে আমেনা বেগম অর্ককে কিছুই বলেন নি।হয়তো একটু কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু বাস্তবতাও মানতে হবে।বাড়ির বড়দের পছন্দ মতো যে কাউকে বিয়ে করে নিবে?আজকালের ছেলে-মেয়েরা কি আর এখনো সেই যুগে পড়ে আছে?আছে তো!কেন মেহেনূর!তবে আমেনা বেগম অভিমানের পাহাড় নিয়ে অর্কদের বাসা থেকে চলে গেছেন।কাউকে বুঝতে দেন নি।অর্ককে তো না-ই।বরং এমন আচারণ ছিল যে, এটা খুব নরমাল একটা বিষয়।কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই কষ্ট পেয়েছেন।
মেরেনূর চলে যাওয়ার আগে অর্কদের বাসায় এসেছিল বিদায় নিতে।কিন্তু আয়েশা বেগম বা আকাশ সাহেব কারোর সাথেই ওর দেখা হয় নি।শেষে মেহেনূর উনাদের সাথে দেখা না করেই চলে যায়।আসলে উনারাই মেহেনূরের সামনে আসতে চান নি।মেহেনূরের সামনে কোন মুখে যাবেন তারা?নিজেরা যেচে বিয়ের কথা বলছিলেন।মেহরাব সাহেব যখন মেয়ের বিয়ে দিবেন না বলে বেঁকে বসেছিলেন তখন তাকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হয়েছিল।আর যখন উনি রাজি হলেন তখন কিনা তাঁদের ছেলে বিয়ে ভেঙে দিলো।অবশ্য ভুলটা তাঁদেরই।তাঁরা যদি আরেকটু সর্তক হতেন তাহলে আজকে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব নিজেদের বোকামির জন্য লজ্জিত।লজ্জিত তাঁদের ছেলের ব্যবহারে।একটা ভিনদেশের মেয়ের জন্য মেহেনূরের মতো মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করলো?অর্ক যেমন ওই মেয়ের জন্য দেওয়ানা হয়ে আছে ওর মতো এমন আরো হাজারটা ছেলে আছে যারা কিরণ চৌধুরীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।তাই বলে সবার মনের খবর কি কিরণ চৌধুরীর পক্ষে রাখা সম্ভব?তাও অর্কের এই ব্যবহারটা মানা যেত যদি কিরণ চৌধুরীও ওকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো।কিন্তু তেমন কিছুই তো নেই ওদের মধ্যে।তাহলে অর্ক কিসের ভিত্তিতে এমব ব্যবহার করছে?এটা নিছকই অর্কের বোকামি মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই না।
আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব অর্কের সাথে একদম কথা বলা বন্ধ না করলেও প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি একটা কথাও কেউ বলেন না।এইমুহূর্তে তিনজন একসাথে ডিনার করছেন ঠিকই কিন্তু কেউই কারো সাথে কথা বলছে না।অর্ক মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করলেও হ্যাঁ না তে জবাব দিচ্ছেন দুজনেই। নিজের মতো চুপচাপ খেয়ে উঠে যান আকাশ সাহেব আর অর্ক।আয়েশা বেগমও নিজের খাওয়া শেষ করে টেবিল গুছাচ্ছেন।বাড়িতে কাজের মানুষ থাকলেও নিজের কাজগুলো তিনি নিজে করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
– আন্টি অর্ক কোথায়?
আয়েশা বেগম মাথা তুলে সামনে তাকালেন।এত রাতে দিহাদ, কলি, তনিমা আর অয়নকে দেখে উনার কপাল কুঁচকে আসে।পরমুহূর্তেই কুঁচকানো কপাল প্রসারিত করে মৃদুস্বরে বললো,
– হয়তো ওর ঘরেই আছে।
আয়েশা বেগমের জবাবটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না কারোর কাছেই।সবাই নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে সেটা শুধু ওরাই জানে না।সবাই সেকেন্ড দুয়েক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকে পা বাড়ালো অর্কের রুমের দিকে।
চলবে………#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
২৯.
অর্ক ডিনার শেষ করে নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।বৃদ্ধাশ্রম আর অনাথাশ্রম মিলিয়ে যে বিল্ডিংটা করা হবে ওইটারই ডিজাইন দেখছে।তনিমা আজ আবার এনজিওতে আসে নি,সাথে ওই হতচ্ছাড়া অয়নটাও।এনজিওতে আজ ওকে একাই সবকিছু সামলাতে হয়েছে।সারাদিনে একটা বারের জন্য কেউ ওর খোঁজ নিলো না।দিনকে দিন বন্ধু গুলোও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে।ইদানীং অর্কের নিজেকে খুব একা মনে হয়।চারদিকে কেমন শূণ্যতার, হাহাকার। কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র আশংকায় ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে মাঝে মধ্যেই।নিজের বাবা মাকেও এখন আর আগের মতো কাছে পায় না,তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে না।তাদের সাথে ওর সম্পর্কটা কি এইটাই ঠুনকো হয়ে গেছে?হয়তোবা!আগামী মাসে কানাডায় যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো অর্ক।যে করেই হোক ওকে কিরণ চৌধুরীর সান্নিধ্য পেতেই হবে।অনেক হয়েছে আর না।এইভাবে কি মানুষ বাঁচে নাকি?ধোয়াশায় মধ্যে থেকে কি জীবন চলে?অর্কের বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।জীবন বড়ই অদ্ভুত!
– আসতে পারি?
কথাটা কানে এসে বারি খেতেই চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকায়।নিজের অজান্তেই অর্কের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো,মুখে মলিন হাসি।ওর বন্ধুরা এসেছে।বিছানা থেকে নেমে দৌঁড়ে গিয়ে সবাইকে জড়িয়ে ধরলো।উতলা কন্ঠে বললো,
– জানিস তোদের কথা না খুব মনে পড়ছিল।আর তোরাও চলে আসলি।আমাদের আত্মার কত টান দেখেছিস।
নিজেদেরকে সবাই আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো।দিহাদ অর্কের পিঠ চাপড়ে বললো,
– তা কেমন আছিস?
– একটু আগে অবধি ভালো ছিলাম না রে।কিন্তু এখন মন প্রান দিল সব ভালো হয়ে গেছে।আয়, এদিকে আয় সবাই।
সবাই যার যার মতো গিয়ে বসলো।বিছানার উপর থেকে অর্ক ওর ল্যাপটপটা নিয়ে সবাইকে বিল্ডিংয়ের ডিজাইন গুলো দেখাতে লাগলো।কয়েক মুহূর্ত পরেই অর্কের ঘরে বড়সড় একটা ট্রে হাতে আগমন ঘটে আয়েশা বেগমের।কলি চটজলদি উঠে গিয়ে উনার হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে ব্যস্তস্বরে বললো,
– আন্টি এত রাতে আপনি এইসব করতে গেলেন কেন?আমরা সবাই তো খাওয়া দাওয়া করেই এসেছি।
– তাতে কি হয়েছে।এইটুকু খাবার খেতে পারবে,কিচ্ছু হবে না।
স্মিত হাসলো কলি।পরমুহূর্তেই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বললো,
– আন্টি আপনাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছেন কেন?আর মুখটা মলিন,আপনি কি অসুস্থ?
কলির কথায় সবাই আয়েশা বেগমের দিকে দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে থাকলেও অর্ক তাকায় নি।সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়েশা বেগম ইতস্ততভাবে বললেন,
– আমার কিছু হয় নি মা।আমার আবার কি হবে!তবে একটা কথা কি জানো,মাঝে মাঝে আমরা না কিছু মানুষের কাছে একটু বেশিই আশা করে ফেলি।কিন্তু যখন সেই আশার আলো নিভে যায় তখন আবার আমরাই আফসোস করি,দূর এইটা হয়তো না করলেও পারতাম!বড্ড বোকামি করে ফেলি ইদানীং।ভুলেই যাই ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের কাছে হুটহাট এত আবদার করতে নেই!কারণ সেই আবদারের মর্যাদা না থাকলে পরে তো আবার সেই নিজেদেরকেই এর মাশুল দিতে হয়।হয়তো মান দিয়ে নয়তো জীবন দিয়ে।বাদ দাও আমার কথা।তোমরা কিন্তু খাবারটা খেও সবাই।আমার ভালো লাগবে।এটাও এক প্রকার আবদারই বলতে পারো!
কথাগুলো বলতে বলতেই আয়েশা বেগমের চোখ দুটো ছলছল করে উঠে।সবার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার আগেই অর্কের রুম থেকে বেড়িয়ে আসেন।সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ক অসহায় ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।আয়েশা বেগমের প্রত্যেকটা কথা চাপা অভিমান আর অভিযোগে আবৃত্ত ছিল।”বড্ড বোকামি করে ফেলি ইদানীং।ভুলেই যাই ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের কাছে হুটহাট এত আবদার করতে নেই!কারণ সেই আবদারের মর্যাদা না থাকলে পরে তো আবার সেই নিজেদেরকেই এর মাশুল দিতে হয়।হয়তো মান দিয়ে নয়তো জীবন দিয়ে” মায়ের বলা এই কথা গুলো অর্কের বুকে তীরের বেগে এসে বিঁধেছে।অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অর্ক।ভেতর থেকে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ও।এইবার হয়তো প্রিয়মানুষ গুলোকে আঘাতটা একটু বেশিই করে ফেলেছে।
– কেন করলি এমন?
আক্ষেপের স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো দিহাদ।অর্ক মুখ তুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।তবে কি ওরা সবটা জেনেই এসেছে?কিভাবে?অর্ক একটা ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,
– মানে?
– মেহেনূরকে এয়ারপোর্ট অবধি দিয়ে আসলাম।যাওয়ার সময় বলছিল,আঙ্কেল আন্টির সাথে নাকি ওর দেখা হয় নি।তাঁরা নাকি বাসায় ছিলেন না।কিন্তু আঙ্কেল আন্টি তো বাসায়ই আছেন।তাহলে মেহেনূরের সাথে দেখা করলেন না কেন?
– মেহেনূর চলে গেছে?
অর্কের বিস্মিত কন্ঠস্বরের সাথে চোখে অবিশ্বাস্য চাহনি।অর্কের প্রশ্নে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।মেহেনূর যে চলে গেছে অর্ক সেটা জানেই না?আশ্চর্য!সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।এখন ওরা নিশ্চিত যে,ওদের অগোচরে এই দুই পরিবারের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। অর্কও এমন ভাবে চমকালো মনে হচ্ছে এইমাত্রই ও শুনলো।তনিমা ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাস করলো,
– তুই জানিস না?
– না।
অর্কের কথায় স্মিত হাসলো কলি পরমুহূর্তেই কটাক্ষের স্বরে বললো,
– তোর এই না জানার পিছনে তুইয়েই দায়ী না তো আবার!
– কি বলতে চাইছিস তুই?
– আঙ্কেল আন্টি বাসায় থাকা সত্ত্বেও মেহেনূরের সাথে দেখা করলেন না কেন?মেহেনূর বাংলাদেশ ছেড়েছে আরো দু’ঘন্টা আগে আর তুই এইমাত্র জানতে পারলি?মেহেনূর কি তোকে বলে নি,ও চলে যাবে?আর তখন আন্টির বলা কথাগুলোর মানে কি?অর্ক দেখ,আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোদের দুই পরিবারের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে।বল কি হয়েছে?
– একটা ঝামেলা হয়েছিল,তবে এখন মিটে গেছে।
– মেহেনূর চলে যাওয়াতে!
অর্ক দিহাদের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকাতেই দিহাদ ফিচেল হেসে ফের বললো,
– আমরা কেউই নির্বোধ নই।এতটুকু বুঝার মতো ক্ষমতা হয়তো আমাদের আছে।মেহেনূর একটা হীরার টুকরো মেয়ে।ওকে এক দেখায় যে কারোরই ভালো লেগে যায়।অবশ্য তোর ক্ষেত্রে আবার উল্টোটা।আসল ঘটনাটি কি আমরা হয়তো জানি না।তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি।আঙ্কেল আন্টি হয়তো চেয়েছিলেন মেহেনূর এই বাড়িতে বউ হয়ে আসুক।কিন্তু সেটা তো আর তুই হতে দিবি না।সেলিব্রিটিদের প্রেমে সবাই পড়ে।তাকে নিয়ে কল্পনায় বিভোর থাকা, দিবাস্বপ্ন দেখা এইসব নিছকই মোহ মায়া।এছাড়া আর কিছুই না।নাটক সিনেমায় যেটা দেখানো হয় সেটা শুধু ওই পর্দাতেই সীমাবদ্ধ,ওইখানেই মানায়।বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।তবে তোর ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা রয়েছে।কিরণ চৌধুরীর সঙ্গ পাওয়ার যোগ্যতা তোর আছে।কিন্তু তোর পরিস্থিতিটা তো অন্যরকম।অন্য আর পাঁচটা রিলেশনশিপের মতো তো তোদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুই এইসব করছিস?মরিচীকার পিছনে ছুটতে গিয়ে শেষে না আবার খাঁটি সোনাটাই হারিয়ে ফেলিস।
– আমি যদি কখনো কিরণকে না-ও পাই তাহলেও ওর জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না।
– তোর লাইফ তোর ডিসিশন।তবে,এইবার হয়তো আন্টি অনেক কষ্ট পেয়েছেন রে।এই মানুষটাকে কখনো এতটা বিষন্ন থাকতে দেখি নি আমি।কখনো যদি তুই রাগ করে বাসা থেকে চলে যেতি তখন আন্টিও তোর প্রতি রাগ দেখাতো।তবে তোর রাগটা সত্যি হলেও মায়েরটা হতো অভিনয়।তুই বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার পর এই মানুষটাই সবার আগে আমাদেরকে কল করতেন।তোর খেয়াল রাখতে বলতেন।নানাভাবে তোর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতেন।আজ তোর মতো রাগ নয় মানুষটার মনে অভিমানের পাহাড় জমে গিয়েছে।মায়ের মতো হতে পারবি?পারবি তার এই অভিমানটা ভাঙতে?তাকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারবি?
দিহাদ একদমে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় অর্কের দিকে।দিহাদের হঠাৎ হঠাৎ কেন যেন ভীষণ রাগ হচ্ছে অর্কের উপর।আবার নিমিষেই সেই রাগটা কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।না পারছে বন্ধুকে কটুবাক্য শুনাতে আর না পারছে এই গুমোট পরিবেশে থাকতে।অর্ককে চুপ থাকতে দেখে দিহাদ একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসে।কলি দরজার পাশে দিহাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সড়িয়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে বললো,
– মেহেনূরকে বিয়ে করলে কি এমন ক্ষতি হতো তোর?কিরণ চৌধুরীর মাঝে যা রয়েছে মেহেনূরের মাঝে হয়তো তা নেই। কিন্তু মেহেনূরের মাঝে যা রয়েছে তুই তা খুঁজে পেতে ব্যর্থ। স্রষ্টা কারো ওপর অন্যায় করে না কাউকে রূপ দেন,কাউকে চরিত্র,কাউকে মেধা,কাউকে যোগ্যতা কাউকে আবার অর্থ।অন্যরা যা করবে বা পারবে সেটা তুইও পারবি তা কিন্তু নয়।তুই যেটা পারিস তোকে সেটাই করা উচিত।সৌন্দর্য কেবল মানুষের চেহারার দ্বারাই প্রকাশিত হয় না।সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় মানুষের কথায়, ব্যবহারে, কাজে, চিন্তায়, ব্যক্তিত্বে,চরিত্রে।যেটা মেহেনূরের মধ্যে রয়েছে।মেহেনূরের অন্যেদের মতো হওয়ার দরকার নেই,ও ওর নিজের মতোই সুন্দর।
অর্ক হতবাক হয়ে গেছে।দিহাদ,কলি,অয়ন বা তনিমা এদের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারছে না।ওদের এইসব কে বললো?মেহেনূরকে নিয়ে এত কথা ওর ভালোও লাগছে না।শক্ত গলায় বললো,
– তোঁদেরকে কি এইসব মেহেনূর বলেছে?
– এত দিনে তুই ওকে এই চিনলি?যে মেয়ে নিজের ভাইকে অবধি বলে নি ওর বিয়ের কথা হয়েছিল তাও আবার তোর সাথে।আমাদের বলার তো প্রশ্নই আসে না।তবে বিকালে মেহেনূরের কিছু কথায়,আন্টির কথায় আর তোর ব্যবহারে আমাদের সবটা বুঝতে এখন আর বাকি নেই।
অর্ক শান্ত চুপচাপ হয়ে বসে আছে।নতুন করে ওর কিছুই বলার নেই।যা বলার ও আগেই বলে দিয়েছে।কলি হতাশ হয়ে ফের বললো,
– দিহাদ একবার বলেছে এখন আমিও বলছি,জীবনটা যখন তোর তাই জীবনের সিদ্ধান্তগুলোও তোর।তুই আবার এটা ভেবে নিস না,আমরা তোকে জোর করছি বা দোষারোপ করছি।আমাদের মনে যা ছিল তাই বললাম।যাকগে,সেইসব কথা বাদ দে।তনিমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জানিস তো।
– কেউ একটু মাকে জিজ্ঞাস করে আয় তো,আমি অবাক লগ্নে জন্মেছিলাম নাকি!তোদের বলা প্রত্যেকটা শব্দে প্রত্যেকটা বাক্যে আমি আজ অবাক হচ্ছি।তনিমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আর আমি জানিই না।
– শুধু তুই না কেউই জানতো না।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এটা আমিই জানতাম না!তোদের কিভাবে বললাম।ওদেরকেও আজকেই বলেছি।ষোল তারিখ বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়েছে।
– হে রে বিলাই, তোর বিয়ের কাজী কি তোর জামাই-ই থাকবে?
অয়নের কথা শুনে তনিমা দাঁত কড়মড় করে অয়নের দিকে তাকায়।ওর চোখ ব্রাউন বলে সেই ছোট বেলা থেকেই ওকে ক্যাট অথবা বিলাই বলে খেপাত অয়ন, অর্ক, দিহাদ।তবে এখন এই শব্দটাকে বেশি পাত্তা না দিলেও নিজের বরকে নিয়ে কোনো হাসি ঠাট্টা সহ্য করবে না।অর্ক অয়নের কথার মানে বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে।তনিমা দাঁতে দাঁত চেপে মেকি হেসে বললো,
– আমার জামাই একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।উন্মুক্ত জলরাশির ওই বিশাল বিশাল জাহাজ নিয়ে ও কাজ করে বুঝেছিস।কাজী সাহেবের ভূমিকাটা আমার দাদাশ্বশুরের ইচ্ছায় করেছিল।ওইদিনই ফাস্ট শান্ত কাজী অফিসে গিয়েছিল।তবে এই পিছনের কারণটাও মেহেনূর!কাজী আমার দাদাশ্বশুর।শখের বশে তিনি এই পেশায় জড়িত।বিয়ে পড়ানোর বিনিময়ে উনি কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নেন না।ওইদিন আমার দাদাশ্বশুর অসুস্থ ছিলেন।উনি মেহেনূরকে বলে দিয়েছিলেন দিহাদ আর কলির বিয়েটা উনি দিতে পারবেন না।ওদের বিয়ের দিন সকালে খুব ভোরে মেহেনূর তাদের বাসায় গিয়ে উনাকে রাজি করায়।কিন্তু উনি তো আসতে পারবেন না।তাই শান্তকেই আসতে হয়েছিল।আর তাই ওইদিন যতগুলো বিয়ে পড়ানোর কথা ছিল সবগুলোই শান্ত পড়িয়েছিল।
– শেষমেশ ওই কাজী বিয়ে পড়ানোর বদলে এখন নিজেই বিয়ে নিচ্ছে।
– অর্ক!
চোখ পাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো তনিমা।পরমুহূর্তেই তনিমা চোখ ছোট ছোট করে অর্কের দিকে তাকাতেই ফিক করে হেসে দেয় অর্ক,সাথে বাকিরাও।
চলবে………