#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩০.
অমাবস্যার মধ্যরাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের উষ্ণ নোনা জন্য বিসর্জন দিচ্ছে তনিমা।নিকষকালো অন্ধকারে শূন্যে দৃষ্টি স্থির রেখে নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে আছে।চারদিকে তপ্ত হাওয়া বইছে তীব্র ভাবে।দূরের আকাশে ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।মাঝেমধ্যেই কোথা থেকে যেন শীতল হাওয়া এসে আঁচড়ে পড়ছে ওর চোখে মুখে। সেই বাতাসের তোড়ে প্রতিবারই তনিমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।আর কাঁদবে না বলে যতবারই হাতের পিঠে চোখ মুছছে ততবারই অবাধ্য চোখের জল ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে আসছে।এইবার আর কাঁদবে না বলে মন শক্ত করে চোখ মুছে তনিমা।চোখ বড় বড় করে গাল ফুলিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ছাদ থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই অপ্রত্যাশিতভাবে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।শান্তর বিধ্বস্ত চেহেরাটা এক ঝলক দেখা মাত্রই কলিজাটায় মোচড় দিয়ে উঠলো।এ কি হাল হয়েছে মানুষটার?চুলগুলো কেমন উসকোখুসকো হয়ে আছে,পরনের কালো রঙের শার্টটার উপরের দুইটা খোলা বোতামের ফাঁক দিয়ে উন্মুক্ত বুকের পশম গুলো উঁকি দিয়ে আছে।ওষ্ঠদ্বয় শুকনো পাতার ন্যায় ঠেকছে।চোখের পাতা ভারী হয়ে নিচের দিকে ঢলছে,চোখগুলো কোনো রকমে টেনে টেনে খুলে রাখছে।মনে হচ্ছে কত রাত গত হয়েছে ওই চোখের পাতা এক করে নি।মুখশ্রী ফ্যাকাসে বিবর্ণতায় ছেয়ে গেছে।তনিমার বুকের ভেতরটায় হঠাৎ করেই ছ্যাঁত করে উঠলো।শান্ত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তনিমার দিকে।পরক্ষণেই তনিমা চোখ মুখ শক্ত করে নিয়ে শান্তর দিক থেকে চোখ সড়িয়ে নেয়।শান্তকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলেই শান্ত ওর হাত ধরে আটকে দেয়।তনিমা পিছন না ফিরে হাত মোচড়াচ্ছে হাতটা ছাড়ানোর জন্য।তনিমা কিছু বুঝে উঠার আগেই এক হেঁচকা টানে শান্ত ওকে ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।পিছন থেকেই তনিমার সামনে হাত দিয়ে ওর বাহু আর কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।শান্ত ওর শুকনো ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে তনিমার কাঁধে গভীর চুম্বন দিয়ে চাপা স্বরে বললো,
– সরি ক্যাটবেরি।
এই জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা মারাত্মক সুন্দর।মন খারাপে, রাগে, অভিমানে, ক্ষোভে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই হয়।এক নিমেষেই সকল মন খারাপ ভালো হয়ে যায়।তেমনি তনিমাও আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।মনের অজান্তেই দু’ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো শান্তর হাতের উপর।ঠোঁট টিপে কান্না সংবরন করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঠেকালো প্রিয় মানুষটার বুকে।শান্ত ঠোঁটে আগায় তৃপ্তির হাসি টেনে তনিমার কপালে গভীরতম চুম্বন এঁকে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
– ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি তোমায়, খুব ভালোবাসি ক্যাটবেরি।
শান্তর কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই চটজলদি মাথা তোলে নেয় তনিমা।কয়েক মুহূর্তের জন্য ও ভুলেই গিয়েছিল এই মানুষটার প্রতি ওর মনে অভিমানের স্তুপ জমে আছে।মনের মধ্যে জমে আছে যোজন যোজন অভিযোগ।যে মানুষটা বাসর রাতে তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারে তার মুখে অন্তত ভালোবাসি কথাটা মানায় না।
শান্ত আর তনিমার বিয়ে হয়েছে আজ পনেরো দিন।যেখাবে বিয়েটা হওয়ায় কথা ছিল ঠিক সেইভাবেই ওদের বিয়েটা হয়েছিল।রিসেপশন অবধি সব ঠিকঠাকই ছিল।কিন্তু রিসেপশনের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই শান্তকে চলে যেতে হয়েছিল।খবর আসে আটলান্টিক মহাসাগরে বাংলাদেশের একটি যাত্রীবাহী জাহাজ নিখোঁজ হয়ে গেছে।তাঁদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত শেষ খবর ছিল তাঁরা আটলান্টিক মহাসাগরে আছে এবং জাহাজটি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেই।ওটা অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে!নিকষকালো অন্ধকার রাতে সাগরের বিশালতায় জাহাজটি কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে নাবিকরা বলতে পারছে না।জাহাজটি দ্রুত ওর গতিপথও পরিবর্তন করছে!এই খবর শোনার পর বাংলাদেশ থেকে ত্রিশ জনের একটি ইউনিট তৎক্ষণাৎ আটলান্টিক মহাসাগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ইউনিটে থাকা ত্রিশ জন সদস্যের মধ্যে শান্তও ছিল।
– কথা বলবে না বুঝি?
তনিমা শান্তর বুকের উপর থেকে মাথাটা সড়িয়ে নিতেই শান্ত চাপা স্বরে বললো।তনিমা শুধু শান্তর আলিঙ্গন থেকে বেরুনোর জন্য ছটফট করছে,মুখে কিছু বলছে না।দু’চোখ বেঁয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পরছে।শান্ত তনিমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে মৃদুস্বরে বললো,
– বারমুডা ট্রায়াংগেল।আমেরিকার কোলঘেঁষে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে একটি গভীরতম স্থান যার নিকটে রয়েছে গভীরতম বাহামা দ্বীপপুঞ্জ।এটি এমন একটি স্থান যা নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস আর সায়েন্স ফিকশন।যাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য হলিউড মুভিও তৈরি করা হয়েছে।একে বলা যায় সামুদ্রিক ও আকাশযানের কবরস্থান।সর্বপ্রথম চার্লস বার্লিটজ এর বারমুডা ট্রায়াংগেল বইটিতে এটা একটি ভয়ংকর রহস্যময় স্থান হিসেবে আলোচনায় আসে। কেউ কেউ বলে সেখানে নাকি এলিয়নদের আনাগোনা রয়েছে।অর্থাৎ চতুর্থ ডাইমেইনশন (4D)এর উপস্থিতি। Ufo অর্থাৎ ফ্লাইং সোসার বা উড়ন্ত চাকী করে তারা বারমুডার সমুদ্রে প্রবেশ করে।কেউ আবার বলে এতে ভয়ংকর কোনো প্রানীর উপস্থিতি রয়েছে।কেউ আবার বলে এতে ম্যাগনেটিক ভরটেক্স বিদ্যমান। আবার কেউ এটাও বলে এর সমুদ্রের তলদেশে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি প্রবল।কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন কথা বলে।বিভিন্ন খববের প্রতিবেদন আর নথিপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে,কখনো কখনো কিছু জাহাজ বা বিমান গুম হয়। আবার কখনো শুধু মানুষ গুম হয়।কখনো বারমুডার পানিতে হারানো কোনো জাহাজ বা বিমানকে পুনরায় দেখা যায় আবার কখনো হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে পুনরায় দেখা যায়!তবে আসল কথা হলো,সব বিমান,জাহাজ বা মানুষ গুম হয় না বরং অনেক বাচবিচার করেই গুম হয়!দেখা যায় সেখান দিয়ে অতিক্রমকারী যুগের সেরা ফ্লাইটার প্লেন বা সেরা সাবমেরিন গুম হয় নয়তো যুগের সেরা পাইলট বা নাবিক গুম হয়!
শান্ত এতটুকু বলেই থামে।ভ্রুকুটি করে তাকায় তনিমার দিকে।তনিমা শান্তর হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।হয়তো ওর কথা গুলো শুনে ভয় পাচ্ছে।অবশ্য ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।বারমুডা ট্রায়াংগেলের এই ভয়ানক রহস্যময় তথ্য জানে না বা শুনে নি এমন মানুষ হাতে গুনা কয়েকজন পাওয়া যাবে।শান্ত কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
– ভয় পাচ্ছো?
তনিমা দ্রুত ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ও ভয় পাচ্ছে না।শান্ত স্মিত হেসে তনিমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বললো,
– আমাদের জাহাজটাও হয়তো ওই বারমুডা ট্রায়াংগেল সীমানার পৌঁছে গিয়েছিল।নাবিকরা জানিয়েছিল জাহাজটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।হঠাৎ করে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও নাকি জাহাজটি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছিল।তাঁদের সাথে শেষ কথা এতটুকু ছিল।এরপর তাদের সাথে আর যোগাযোগ করা যায় নি।এখন অবধিও তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায় নি।
তনিমা মাথা কাত করে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় শান্তর দিকে।শান্ত চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– জাহাজে থাকা চারজন নাবিক এখন পর্যন্ত নিখোঁজ।জাহাজের সবযাত্রী সহিসালামত থাকলেও নাবিকদের কোনো খোঁজ বা সন্ধান পাওয়া যায় নি।আমরা যতক্ষণে ওইখানে পৌছাই ততক্ষণে আমেরিকার দুটো জাহাজ অলরেডি আমাদের জাহাজটি উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সড়িয়ে নিয়েছিল।ওই ভয়ংকর দূর্ঘটনার পর যাত্রীরা কেউই আর সমুদ্র পথে আসতে রাজী হলো না।দেড়শো যাত্রীকে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য সব ধরনের প্রসেস কমপ্লিট করতে একসপ্তাহ চলে গেল।সবাই যখন দেশে ফিরে আসে আমরা তখনও আটলান্টিক মহাসাগরেক ভাসছি।নিজের দেশের সম্পদ তো আর অন্য দেশে ফেলে রেখে চলে আসা যায় না।জাহাজটা রিকভার করে তিনজন নাবিক নিয়ে আমরা আটজন আবার ওই সমুদ্র পথেই ফিরে আসি।এটা তো আমার পেশা বলো।আমি তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,আমি শপথ নিয়েছি। নিজের দেশের জন্য জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি সেই প্রতিজ্ঞাবাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। সমুদ্রের মধ্যে তো আর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।তাই আমি আমার ক্যাটবেরির সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি।আর আমি আমার ফোনটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম।
– কিভাবে?
থমথমে মুখে প্রশ্ন করলো তনিমা।শান্ত তনিমার কানে ফিসফিস করে বললো,
– ফিরতি পথে আমরাও ওই বারমুডা ট্রায়াংগেলের খপ্পরে পরেছিলাম!
শান্ত কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তনিমার বুকের ভেতরটায় ধুক করে উঠলো।সাথে সাথে সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।তড়িৎ বেগে শান্তর দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকাতেই শান্ত মাথা নাড়িয়ে বুঝায় ‘হ্যাঁ’।সব মান অভিমান ভেঙে তনিমা আচমকায় শান্তকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।বাঁধ ভাঙা নদীর মতো হুহু কেঁদে দেয়।মৃত্যুটা খুব কাছ থেকে দেখে এসেছে শান্ত।প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে সবাই কাতর হয়,তনিমাও তাঁদেরই দলে।তনিমা শান্তর বুকে মুখ গুজে কেঁদেই যাচ্ছে।শান্ত ভাবছে,তনিমাকে হয়তো এ কথাটা না বললেও পারতো।শুধু শুধু ভয় পেয়ে এখন কান্নাকাটি করছে।শান্ত ফিচেল হেসে বললো,
– আরে পাগলি তুমি কাঁদছো কেন?আমি তো জাস্ট দুষ্টুমি করে বলেছি ওটা।
তনিমা কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শান্তর দিকে।ওর অবুঝ চাহনি।শান্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– বউয়ের আদর পাওয়ার জন্য না হয় একটু মিথ্যে বলেছি,তাতে কি এমন ক্ষতি হয়েছে তোমার শুনি।
– আজই প্রথম এবং শেষ বারের মতো বলছি,ভবিষ্যতে আর এইরকম কোনো দুষ্টুমি করবে না।যদি করেছো তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে বলে দিলান।
কড়াগলায় চোখ রাঙিয়ে বললো তনিমা।শান্ত স্মিত হেসে তনিমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– ওকে ক্যাটবেরি।
– যদি তোমার কিছু হয় যেত?
– তুমি থাকতে আমার কিছু হবে না।আমি জানি।
– শুনো।
– হু বলো।
– তুমি বরং কাজী অফিসেই বসো!ওই কাজটাই না হয় মন দিয়ে করো।সাগর, জাহাজ, ইঞ্জিনিয়ার এইসব ঝামেলায় তোমাকে আর যাওয়া লাগবে না।
আহ্লাদী গলায় বললো তনিমা।তনিমার কথা শুনে ফিক করে সশব্দে হেসে উঠলো শান্ত।শান্তর কাছে এহেন প্রস্তাব রাখায় তনিমাও কিঞ্চিৎ লজ্জা পাচ্ছে।ও নিতান্তই বোকার মতো একটা কথা বলেছে,ঔ বুঝতে পারছে।তনিমা লজ্জায় শান্তর বুক থেকে মাথাই তুলছে না।বরং পারলে শান্তর বুকের ভেতর ঢুকে যায়,এমন ভাবেই কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে।শান্ত পরমুহূর্তেই নিজের হাসি থামিয়ে আঁড়চোখে তনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমার বন্ধুরা যখন আমাকে কাজী কাজী বলে ডাকবে তখন শুনতে পারবে তো?তখন কিন্তু গর্ব করে আর বলতে পারবে না,আমার জামাই একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
তনিমা অবাক হয়ে তাকায় শান্তর দিকে।শান্ত ঠোঁট টিপে হাসছে।এই অয়নটাও না হয়েছে আস্ত একটা হারামি।ও না হয় ওদের সামনে কথাটা বলেছেই, তাই বলে এটা শান্তকেও বলে দিতে হবে?কেন শান্ত কি জানে ও তনিমার জামাই।তনিমা ক্ষণকাল স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে লাজুক হেসে ফের মুখ লুকায় শান্তর বক্ষমাঝে।
____________________________
সময়ের পরিক্রমায় পাল্টে গেছে অনেককিছু।এই আঠারো উনিশ দিনে সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে।রাওনাফ আর রোশনি আরো ন’দিন আগেই কানাডায় ফিরে গেছে।অর্ক রোজ এনজিওতে যাচ্ছে।কলি,দিহাদ,অয়নও নিয়মিত এনজিওতে আসছে।শান্ত চলে যাওয়ার পর থেকে তনিমা শান্তর চিন্তায় নিজেকে একেবারে ঘর বন্দী করে নিয়েছিল।নতুন বউ বাসা থেকে হুটহাট বেড়িয়ে আসাটা লোকচক্ষু হলেও তনিমাকে কলি রোজ এনজিওতে নিয়ে আসতো।শান্তর অনুপস্থিতিতে তনিমা যাতে একাকিত্ববোধ না করে, সবসময় গুমোট হয়ে না থাকে তার জন্য ওরা সবাই তনিমাকে সময় দিতো।মাঝে মাঝে সবাই মিলে লং ড্রাইভেও যেতো।এইমুহূর্তে বিমানের চার জোড়া সীট দখল করে বসে আছে অর্ক-শান্ত,কলি-তনিমা, দিহাদ-ওহি, অয়ন-তিন্নি।তাঁদের সবার গন্তব্য কানাডা।গতকাল রাতে শান্ত ফিরেই সবাইকে বলে যে আজই ওরা কানাডায় যাবে।অবশ্য ওদেরকে শান্ত আর তনিমার বিয়ের পর মানে এক সপ্তাহের মধ্যেই যাওয়ার কথা ছিল।সেই হিসেবে যাদের পাসপোর্ট ছিল না তাদের পাসপোর্টও রেডি করা হয়েছিল।কিন্তু পরে শান্তর অনুপস্থিতিতে ওদের যাত্রা বিলম্বিত হয়।
– অর্ক ভাইয়া হানিমুনে তো শুধু তাদের যাওয়ার কথা ছিল তাহলে আমরা সবাই কেন যাচ্ছি?
তিন্নি কলি আর তনিমাকে দেখিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো।অর্ক কিছু বলার আগেই শান্ত হতাশার স্বরে বললো,
– সিরিয়াসলি তিন্নি!আমাদেরকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি?বরং আমার তো মনে হচ্ছে,আমরা কোনো স্টাডি ট্যুর দিতে যাচ্ছি।এখানে আমরা সবাই বাধ্যগত শিক্ষার্থী আর ওই যে সামনে বসে আছেন, তারা হলেন আমাদের দুজন দায়িত্ববান মেডাম!এই এটা করা যাবে না,ওটা ধরা যাবে না,চুপচাপ বসে থাকো ব্লা ব্লা ব্লা….. আরো কত কি।প্লে নার্সারির বাচ্চাদেরকেও কেউ এইভাবে শাসনে রাখে না।
শান্তর কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় কলি আর তনিমা।বাকিরা মুখ টিপে হাসছে।শান্ত আর দিহাদের মনে এত রং নেই।তাদের হাসার মতো কোনো কারণও নেই।দিহাদের দিকে কলি আঁড়চোখে তাকাতেই দিহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।তনিমাও শান্তর দিকে তাকায়।পরমুহূর্তেই মুচকি হেসে চোখ সড়িয়ে নেয়।শান্ত অসহায় দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ ষোল দিন হয়ে গেল বিয়ে করেছে।অথচ বেচারার বাসরটা তো এখনো হলোই না বরং এখন যাও একটু ভেবেছিল বউয়ের সাথে পাশাপাশি সীটে বসে কয়টা রোমান্টিক কথাবার্তা বলবে সেটাও করতে দিলো না।বন্ধুদের সাথে থাকলে ওদের ছাড়া আর কিছু বুঝেই না একেবারে।
অর্ক হাসি থামিয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে তিন্নির দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি এই মাসে এমনিতেই কানাডায় যেতাম।আমি জানতাম না ওরাও কানাডাতেই যাবে।একই জায়গায় যেহেতু যাবো তো একসাথেই না হয় গেলাম।হানিমুনে যাওয়ার জন্য পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা থাকতে ওরা কানাডায় কেন যেতে চাইছে আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না।যাইহোক,ওদের ইচ্ছা,আমার কি!আমি না হয় কাজে যাচ্ছি আর ওরা যাচ্ছে হানিমুনে।তা তুই কেন যাচ্ছিস শুনি?
– সকালে আপু বললো যে আমার নাকি পাসপোর্ট ভিসা রেডি আমাকে কানাডায় যেতে হবে।এয়ারপোর্টে আসার পর দেখলাম সবাই মিলে হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করেছে।ওরা হানিমুনে যাবে সেটা তো ভালো কথা।কিন্তু মাঝখানে শুধু শুধু আমাকে কেন কাবাবের মধ্যে হাড্ডি বানাতে গেল সেটাই বুঝতে পারছি না।
– হানিমুনে পরে যাবো তিন্নি।আমরা আগে মেহেনূরের কাছে যাবো।তোকে কানাডায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মেহেনূরই বলেছে।আর আমরা সবাই যখন যাচ্ছি তখন আমার একমাত্র দেবর বেচারা কি দোষ করেছে,ওকে কেন রেখে যাবো।তাই ওকেও নিয়ে যাচ্ছি।
তনিমার কথা শুনে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় অর্ক।অর্ককে তো একবারও বললো না ওরা মেহেনূরের কাছে যাবে।পরমুহূর্তেই মনে মনে তাচ্ছিল্যে হাসে অর্ক।ভাবে,ওকে না বলার কারণটা হয়তো ও-ই।
চলবে…….#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩১.
নিঃস্তব্ধ রাতে মাউথ অর্গানে সুর তুলে ল্যাম্পপোস্টের আলোর পথ ধরে হেঁটে চলা মানবীর দিকে তাকিয়ে আছে টরেন্টোবাসী।তাঁদের মধ্যে বাঙালীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।টরেন্টোর আবহাওয়া তুলনামূলক ভাবে ভালো।চাকরীর সুযোগ সবচেয়ে বেশী এবং সবচেয়ে বেশী বাঙালী এই টরেন্টো অর্থাৎ এই অন্টারিও প্রভিন্সে বসবাস করে।তাদের সবচেয়ে প্রিয় গন্তব্য টরেন্টো।কেউ জানালার পর্দা সড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে তো কেউ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।ছাদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই ওর দিকে হাত নাড়িয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।বিনিময়ে সেও একগাল হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে।তাদের মধ্যে থাকা একজন উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
– কবে ফিরলে?এতদিনে বুঝি আমাদের কথা মনে পড়লো?
– এসেছি প্রায় মাস হতে চললো।ক’দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম গো,তাই দেখা হয় নি।
গলার স্বর উঁচু করে বললো কিরণ।অন্যপাশ থেকে কেউ একজন হাঁক ছেড়ে জিজ্ঞাস করলো,
– কোথা থেকে আসা হচ্ছে?শো ছিল নাকি?
– না গো।
– তবে?
– রাত্রি বিলাশে বেরিয়েছি।
– রাত্রি বিলাশে বের হয়েছ সাথে একজন সঙ্গী থাকলে কিন্তু মন্দ হতো না।
– আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার এই মাউথ অর্গানই যতেষ্ট।
জোর গলায় বললো কিরণ।কিরণের কথার প্রত্যুত্তরে উনি কিছু বলতে পারলেন না,শুধু এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া।আসলেই কিরণের কারোর সঙ্গের প্রয়োজন হয় না।ওর সঙ্গী ও নিজেই!ওর সুর,ছন্দই ওকে সঙ্গ দেয়।কিরণ মৃদু হেসে বললো,
– আজ যাই গো অন্যদিন আসবো।ভালো থেকো সবাই।
– ঠিক আছে।সাবধানে যেও।
সমস্বরে বলে উঠলো সবাই।সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের মতো মাউথ অর্গানে ফের সুর তুললো কিরণ।দেখতে দেখতেই আদো আলো আদো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ওর অবয়ব।ধীরে ধীরে অর্গানের সুরও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়।
_________________________
ঘুমে চোখ টলোমলো।ঢলতে ঢলতে বাসায় ঢুকলো কিরণ।অনেক দিন পর বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসেছে ও।কিন্তু শরীরটা ক্লান্ত হলেও আজ মনটা বেশ শান্ত, প্রফুল্ল,সজীব।চিরচেনা মানুষগুলোকে কতদিন পর দেখলো তার হিসাব কষার দরকার নেই।চোখের দেখা দেখতে পেয়েছে,কথা বলেছে এটাই অনেক।নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে।ডগিরা উচ্চস্বরে ঘেউঘেউ করে উঠতেই চমকে উঠলো কিরণ।পরমুহূর্তেই অসহায় মুখ করে ডগিরার দিকে তাকায়।ও ভেবেছিল ডগিরা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।তাই ওকে আর বিরক্ত করতে চায় নি।কিন্তু ও বুঝতে না পারলে কি হবে ডগিরা ঠিকই টের পেয়ে গেছে যে, কিরণ বাসায় ফিরেছে।কিরণ হয়তো ভুলেই গিয়েছিল ওদের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর থেকে প্রখর তর।পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গন্ধ শুঁকে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মলগ্ন থেকেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত।কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের থেকে আটাশ হাজার গুন বেশি।কিরণ স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় ডগিরার দিকে।ডগিরা দৌঁড়ে এসে কিরণের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।ডগিরাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরলো কিরণ।ডগিরা কিরণের গাল চেটে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।কিরণও গভীর মমতায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
বাংলাদেশে যাওয়ার আগে ডগিরাকে কানাডায়-ই রেখে গিয়েছিল।তার কারণ ছিল বাংলাদেশের ওয়েদার।কানাডার ওয়েদারে বেড়ে ওঠা ডগিরা বাংলাদেশের ওয়েদারে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে না বলে স্নেহের ডগিরাকে কানাডায়-ই রেখে যায় কিরণ।ওর অনুপস্থিতিতে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে নি।খাবারের অনিয়ম হয়েছে বিধায় ডগিরার শরীরটা ভেঙে গেছে।আজও হয়তো কিচ্ছু খায় নি।তাই তো পেট’টা ওমন করে পড়ে আছে।হয়তো আজ ওর খাবারটা কিরণ খাইয়ে দেই নি বলেই অভিমান করে বসে আছে।কারণ প্রত্যেকবার কিরণই ওকে খাইয়ে দেয়।
কিরণ ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ডগিরার দিকে।ডগিরা ক্ষীণ স্বরে অভিমানী আর্তনাদ করে।কিরণ ডগিরার দু’গাল ধরে কপালে একটা চুমো দেয়।ডগিরা খুশিতে গদোগদো হয়ে লেজ নাড়িয়ে আরেক দফায় কিরণের গাল চেটে দেয়।ডগিরার আহ্লাদী পনা দেখে ফিক করে হেসে দেয় কিরণ।ডগিরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বললো,
– চুপটি করে এখানে বসে থাকবি। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
ডগিরা কিরণের কথা শুনে জিভ বের করে ঘনঘন লেজ নাড়াচ্ছে।ভাবে বোঝাচ্ছে ও এতক্ষণ এইটারই অপেক্ষায় ছিল।কবে কিরণ আসবে আর ওকে খাইয়ে দেবে।কিরণ ডগিরার ভাব দেখে ঠোঁট টিপে হেসে ঘরের ভেতরে চলে আসে।
ডগিরার জন্য সদ্য কিনে আনা শুকনো খাবারগুলো থেকে কিরণ একটা প্যাকেট বের করেছে মাত্র ওমনি ডগিরা এসে কিরণের জামা কামড়ে ধরে টানতে শুরু করে।আচমকায় এমন হওয়ায় কিরণের হাত ফস্কে প্যাকেটটা নিচে পড়ে যায়।কিরণ চকিত দৃষ্টিতে ডগিরার দিকে তাকায়।ও কিছু বুঝে উঠার আগেই ডগিরা ওর জামা কামড়ে ধরে ব্যালকনির দিকে নিয়ে যেতে থাকে।কিরণ ভ্রুকুটি করে ডগিরার দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ করে ওর আবার কি হলো?তখন তো খাবারের কথা শুনে দিব্যি তো লাফাচ্ছিল।এখন খাবারটাই নিতে দিলো না।
– আরে ডগিরা তুই করছিস কি।আস্তে যা,পড়ে যাবো তো।
কিরণ উৎকন্ঠিত স্বরে বললো।ডগিরা নিজের মতো কিরণকে টেনে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে ছাড়ে।কিরণ হাটু মুড়ে ডগিরার সামনে বসে ওর দু’গালে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে বললো,
– কি হয়েছে আমার ডগিরার?আমার উপর বড্ড রাগ হয়েছে বুঝি?
কিরণের কথা শুনে ঘেউঘেউ করে উঠলো ডগিরা।কিরণ কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে ডগিরার দিকে।ডগিরাকে কেমন যেন উত্তেজিত দেখাচ্ছে।ও সচরাচর এমন করে না।যখন খুব বেশি অভিমান বা খুশি হয় তখনই এমন করে।কিরণ ডগিরাকে পরখ করে দেখে নিয়ে নরম গলায় বললো,
– কিছু বলতে চাস তুই?
ডগিরা আবার ঘনঘন লেজ নাড়াচ্ছে।কিরণ মুচকি হাসলো।ডগিরা লাফ দিয়ে কিরণের কোলে উঠে বসে।কিরণ ডগিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– বল কি বলবি?
ডগিরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো। কিরণ ভ্রু কুঁচকে ডগিরার দিকে তাকায়।ডগিরা কিরণের দিকে তাকিয়ে দিকে কিরণ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ডগিরা ক্ষীণ স্বরে ঘেউঘেউ করতেই কিরণের কপাল আরো সংকুচিত হয়ে যায়।ডগিরা ফের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো।এইবার কিরণের সংকুচিত কপাল প্রসারিত হয়ে যায়।এতক্ষণে ও বুঝতে পারে ডগিরা ওকে কিছু দেখার জন্য বার বার রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করছে।কিরণ চটজলদি রাস্তার দিকে তাকায়।রাস্তায় দিকে তাকাতেই ঠোঁটের আগায় হাসি ফুটে উঠে কিরণের।পরমুহূর্তেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ডগিরার দিকে।ডগিরা জিভ বের করে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।যার ফলস্বরূপ ওর সারা শরীর কম্পিত হচ্ছে।কিরণ অবাক হয়ে বললো,
– ডগিরা সিরিয়াসলি!তোকে মাত্র একবার তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি,তাও আবার ছবিতে।আর তুই এই একদিনেই তাদেরকে চিনে ফেললি?
ডগিরা মাথা নিচু করে গুঙিয়ে উঠলো।সঙ্গে সঙ্গে ডগিরাকে জড়িয়ে ধরে কিরণ।অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দেয় ডগিরাকে।ডগিরাও পরম আদরে মাথা ঠেকায় কিরণের বুকে।হঠাৎ করেই স্মরণে এলো এমন করে চমকে উঠলো কিরণ।ওর যে এক্ষুনি নিচে যাওয়া প্রয়োজন সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে,আনন্দে আত্মহারা হয়ে।কিরণ চট করে ডগিরাকে কোলে তোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত পা চালিয়ে ব্যালকনি প্রস্থান করে।
_______________________
রাস্তার দুপাশে থাকা সারি সারি দালানগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলেও কিরণদের বাড়িটা উজ্জীবিত, আলোকিত হয়ে আছে।বাসায় থাকা পাঁচ জন কাজের লোকই পুরো দমে কাজ করছে।দুজন কিচেনে আর বাকি তিনজন গেস্টরুম গুলো সাজিয়ে দিচ্ছে।যদিও কিরণ সবকিছু গুছিয়েই রাখে সবসময়।এই বাড়ির প্রত্যেকটা কোণা নিজের হাতে ডেকোরেশন করেছে কিরণ।কিন্তু প্রথমবারের মতো ওর প্রিয় মানুষগুলো ওর কাছে আসছে তাঁদের জন্য স্পেশাল ভাবে নতুন করে কিছু করতেই হয়।বিছানার চাদর, কুশন, জানালার পর্দা,ওয়ালপেপার, ওয়াল মেট, একুরিয়াম, ফুলের টব,এমনকি পাপোশ গুলোও পরিবর্তন করা হয়েছে।
কলিং বেলের শব্দটা কর্ণগোচর হতেই ডগিরা লাফ দিয়ে কিরণের কোল থেকে নেমে যায়।ও এতক্ষণ অবধি কিরণের কোলেই ছিল।ডগিরা দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খোলার জন্য লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।এই কাজটা ওর সাধ্যের বাইরে জেনেও বেচারা বৃথা চেষ্টা করছে।ডগিরা দরজার লক খুলতে পারে!কিন্তু ওর একটু সাহায্য লাগে শুধু।কিরণ অনেকক্ষণ যাবৎ ডগিরাকে লক্ষ্য করছে।গেস্টদের আগমনে ও খুব খুশি হয়েছে।অথচ ওর এত খুশি বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণটা কিরণের কাছে স্পষ্ট নয়।তবে হ্যাঁ, যেটাতে কিরণ খুশি সেটাতে ডগিরাও খুশি।কিরণ সেটা জানে।আর হয়তো সেই কারণেই ও ওমন করছে।
দরজা খোলার জন্য ডগিরার এত কৌতূহল দেখে ফিক করে হেসে উঠলো কিরণ।দরজার লকটা নাগাল পাচ্ছে না তাও হাল ছাড়ছে না,লাফিয়েই যাচ্ছে।কিরণ একটা চেয়ার নিয়ে দরজার কাছে রাখলো।ডগিরা এক লাফ চেয়ার উঠে বসলো।এক পলক তাকালো কিরণের দিকে।কিরণ মুখের হাসি প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে বুঝালো ওকে পারমিশন দেওয়া হয়েছে।ও এবার দরজাটা খুলতে পারে।
দরজার বাহিরে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকা কয়েক জোড়া চোখ ডগিরাকে দরজা খুলতে দেখেই হতবাক।ভেবেছিল হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে।দরজা খোলার পর সামনে ডগিরাকে দেখে সবাই আশাহত হয়ে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।পরমুহূর্তেই কিরণ উচ্চস্বরে হেসে উঠতেই চমকে উঠলো প্রত্যেকটি অস্তিত্ব।অস্থির দৃষ্টিতে তাঁকে খুঁজতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– ডগিরা গেস্টদের ঢুকতে দাও।
আদুরে গলায় বলল কিরণ।সবাই চকচক চোখে তাকালো কিরণের দিকে।সবার ঠোঁটে কোণে মিষ্টি হাসি,চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ।ডগিরা কিরণের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফের সম্মুখে তাকিয়ে শরীর ঝেড়ে উঠতেই সামনে থাকা ক’জন একটু নড়েচড়ে উঠলো।ডগিরা ধীর গতিতে দুবার মাথা নুইয়ে চেয়ার থেকে নেমে এক দৌঁড়ে আবার চলে যায় তাঁর মালিকের কোলে।ডগিরা চলে যেতেই ভৃত্যদের একজন এসে দরজার সামন থেকে চেয়ারটা সড়িয়ে নেয়।বাকিরা এসে গেস্টদের লাগেজগুলো নিয়ে যায়।কিরণ ডগিরাকে ওর জন্য বরাদ্দ আসনে রেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো।স্মিত হেসে শীতল কণ্ঠে বলল,
– এতদিনে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো তবে!
চলবে…….
[ রিচেক হয় নি,তাই বানান ভুল থাকতে পারে ]