#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩২.
– কেমন আছো মেহেনূর?
সবাই যখন ডগিরাকে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই পরিচিত মানুষের ক্ষীণ কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই আঁতকে উঠলো মেহেনূর।বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো দরজার দিকে।অর্ক এসেছে।সবার সাথে যে অর্কও আসতে পারে এটা ওর মাথায়ই আসে নি।ডগিরাকে ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে এক পলক তাকালো মেহেনূর।ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁটের আগায় হাসি টেনে এগোলো দরজার দিকে।ধীর কন্ঠে অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া,আমি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?
– ভালো।
নরম গলায় বললো অর্ক।মেহেনূরের গলার স্বর শুনে এগিয়ে আসে রাওনাফ রোশনি।প্রানপ্রিয় বন্ধুকে দেখে আনন্দে আত্মহারা রাওনাফ।বন্ধুকে আলিঙ্গন করে ফিচেল হেসে বললো,
– সবাই মিলে এইভাবে আমাদের সারপ্রাইজ দিয়ে দিবি ভাবতেই পারি নি।সবাই তো অনেকক্ষণ আগেই চলে এসেছে তাহলে তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
– কোথায় ছিল আবার।ওর তো একটাই কাজ।
অয়ন মুখে বিরক্তির চাপ ফেলে কথাটা বললো।দিহাদ চাপা স্বরে অয়নকে কিছু একটা বললো ওর মুখ বন্ধ করার জন্য।তবে সেটা বাকিদের কর্ণধারে এসে পৌঁছায় নি।অয়ন মুখ ভেংচি দিয়ে অর্কের পাশ কাটিয়ে চলে যায়।অয়নের বলা কথার মানে বুঝতে না পেরে রাওনাফ ভ্রুকুটি করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।অয়ন চলে যেতেই রাওনাফ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– মানে?অয়ন কি বললো এটা?
– আরে ছাড় তো ওর কথা।আসলে আমার একটা কাজ ছিল তাই আসতে একটু দেরি হয়েছে।
স্মিত হেসে বললো অর্ক।রাওনাফও মেনে নিলো ওর কথা।যখন অর্ক নিজ থেকে বলবে সেদিনই না হয় রাওনাফ সবটা শুনবে,তার আগে ও কিছু জানতে চাইবে না।তবে রাওনাফ একটা জিনিস খেয়াল করেছে।অর্ক মাঝেমধ্যেই লাপাত্তা হয়ে যেত,যায়।কোথায় যায় কি করে না করে কিছুই বুঝতে পারে না ও।অবশ্য অর্ককে কোনোদিন সেকথা জিজ্ঞাসও করে নি।রাওনাফের মাথায় যখন এই কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন আবার ভাবে,যাইহোক এতটা পথ জার্নি করে এসেছে ও অবশ্যই অনেক ক্লান্ত।এখন ওর খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রামের প্রয়োজন।
রাওনাফ অর্ককে নিয়ে গেস্টরুমে চলে যায়।অন্যরা এসে ফ্রেশ হয়ে সবেই নিচে এসেছিল।এর মধ্যেই অর্কের আগমন ঘটলো।আর সবাই ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।সারপ্রাইজ দিবে বলে কাউকে বলে নি যে,ওদের সাথে অর্কও কানাডায় এসেছে।অর্ক চলে যেতেই সবাই আবার ডগিরাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।অর্ক ফ্রেশ হয়ে আসলে সবাই একসাথেই খাবে।
_______________________
– আচ্ছা মেহেনূর আপু,জাস্টিন ট্রুডোর সাথে আমি যদি একটা সেলফি তুলতে চাই তাহলে আমাকে কোথায় যেতে হবে।আই মিন তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
পুরো ডাইনিং টেবিলে জুড়ে পিনপতন নীরবতা।মাঝেমধ্যে চামচ আর পানির গ্লাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।রাতের শেষভাগে খাওয়ার মধ্যেই তিন্নির এহেন কথা শুনে সেই নীরবতা ভেঙে ফিক করে হেসে উঠলো ওহি।সবাই খাওয়া বন্ধ করে তিন্নির দিকে তাকায়।ওহি ওর হাসি বন্ধ করে সিরিয়াস হয়ে বললো,
– জাস্টিন ট্রুডোর সাথে দেখা করতে চাও সেলফি তুলছে আগেও বলবে না।এখানে আসার সময়ই তো উনার সাথে দেখা হলো আমার!
তিন্নি ওহির কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে আড়ঁচোখে তাকিয়ে আছে।তবে ভ্রুকুটি করে।এই ছেলেটাকে একদম সহ্য হয় না ওর।তনিমার বিয়ে ঠিক হওয়া অনধি ঠিক ছিল।কিন্তু বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওহির সাথে হ্যাঁ না ছাড়া ভালো করে একটা কথাও বলে নি ও।অবশ্য ওহি কথা বলতে চায়।সুযোগ পেলেই বেয়ান বেয়ান বলে গল্প জুড়ে দিতে চায়।কিন্তু তিন্নি টু শব্দটাও করে না।এক রকম পাত্তাই দেয় না ওহিকে।এর কারণটা অবশ্য ওহি-ই।শান্ত আর তনিমার বিয়ের দিন গেইট ধরা থেকে শুরু করে বরের জুতো লুকানো,সব কিছু ভন্ডুল করে দিয়েছিল ওহি।গেইটে দাবীকৃত টাকা না দেওয়া, বরের জুতো ফেরত দেওয়া পর পাওনা টাকা না দেওয়া,বরের হাত ধুইয়ে দেওয়ার পর যতেষ্ট টাকা না দেওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ওহির সাথে তুমুল ঝগড়া করে।সবকিছুতেই বাগড়া দেয় ওহি।ফলে তিন্নি ভীষণ রেগে যায় ওহির উপর। যদিও ওহি বেয়াই হিসেবেই মজা করে ওইগুলো করেছিল।মানে সাধারণত বিয়েতে বর পক্ষ আর কনে পক্ষের মধ্যে যা হয় আরকি।কিন্তু পরে সব টাকা দিয়ে দেয় ওহি।কিন্তু তিন্নি সেটা নেয় নি।উল্টো আরো টাকা এড করে ওহিকে ফেরত দেয়।ওহি সেইদিনই বুঝতে পেরেছিল এই মেয়ে আস্ত একটা ধানিলঙ্কা।বয়স কম হলেও ঝাঁঝ আছে ষোল আনাই।তারপরেও ওহি বার বার ওর পিছনে লাগে।কখনো আসলেই ভালো ভাবে কথা বলতে চায় আবার কখনো ইচ্ছে করেই তিন্নিকে রাগাতে যায়।কিন্তু তিন্নি বেশিই জেদি।একবার যখন কথা বলবে না ঠিক করে নিয়েছে তো বলবেই না।যার ফলে ওহির কোনো কথায়ই তিন্নি রিয়েক্ট করে না।
তবে এমনটা নয় যে ওহি গায়ে পরা স্বভাবের ছেলে,হ্যাংলামো করে।ছেলে কিন্তু দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ।স্কুল লাইফ থেকে এখন অবধি কতগুলো প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ও নিজেও জানে না।এতদিন প্রেম ভালোবাসায় এত ইন্টারেস্ট না থাকলেও তিন্নির সামনে সব কিছুই যেন তুচ্ছ মনে হয় ওর।কখনো সামনে পড়লে তিন্নির পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া, রাগী চোখে তাকানো,সুযোগ পেলেই মুখ ভেংচি দেওয়া,ওর বাচ্চামো,কথায় কথায় নাক টেনে কান্না করা,কারণে অকারণে ইগনোর করা এই সবকিছুই ওহির ভালো লাগে।তিন্নির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠে।ইদানীং ওহি ওর উপরই বেশ অবাক হচ্ছে।আগে কখনো তিন্নিকে দেখে বা ওর কথা ওইভাবে চিন্তা করে নি।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওর মন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।কোথাও গিয়ে ওর মন আটকে যাচ্ছে।
এইমুহূর্তে তিন্নি ওহির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ওহির মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও সত্যি বলছে!মানে হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে।কিন্তু তিন্নি এটা বুঝতে পারছে না ঔ তো সবার সাথেই এসেছে তাহলে জাস্টিন ট্রুডোকে ও কেন দেখতে পেলো না?প্রশ্নটা যখন তিন্নির মাথায় খুব তীব্র বেগে ঘুর পাক খাচ্ছে তখন তনিমা অবাক হয়ে বললো,
– ভাইয়া তুমি এইসব কি বলছো?কই আমরা কেউ তো দেখি নি।
– ভাবী তুমিও?জাস্টিন ট্রুডো…জাস্টিন ট্রুডো… কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো বুঝতে পারছো তুমি?সবকিছুরই একটা নিয়ম-নীতি থাকে,প্রক্রিয়া থাকে।কেউ চাইলে একটি দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারে না।তোমার বোনের কথায় যে কেউই ভাববে, জাস্টিন ট্রুডো সবসময়ই পথেঘাটে ঘুরে বেড়ান গেলাম আর দেখা হয়ে গেলো!যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা।
ওহির কথায় সবাই একস্বরে হেসে উঠলো।শুধু মেহেনূর আর তিন্নি ব্যাতিত।মেহেনূর কিছু বলার জন্য তিন্নি হাত ধরতে চায় কিন্তু তিন্নি সেই সুযোগ না দিয়ে হাত সড়িয়ে নেয়।ছলছল চোখে এক পলক মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যায়।তিন্নি চলে যেতেই সবাই অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।লজ্জা পেয়েছে ভেবে আরেক দফায় হেসে উঠলো সবাই।তবে এবার ওহিও মলিন মুখে বসে আছে।আগের মতো সবার সাথে তাল মেলায় নি।মেহেনূর হতাশ নয়নে তাকায় ওহির দিকে।আর কেউ না বুঝলেও ঠিক মেহেনূর বুঝতে পেরেছে ওহির বলা শেষ বাক্যটায় তিন্নি বেশ লজ্জা পেয়েছে সাথে কষ্টও পেয়েছে।মেহেনূরের চাহনি দেখে ওহি মাথা নিচু করে নেয়।ওর ভুলটা ঠিক কোথায়?সেটা এতক্ষণে বুঝে গেছে ও।কথাটা ও বলতে চায় নি।মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।মেহেনূর সবার দিকে চোখ বুলিয়ে ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে ধীর কণ্ঠে বললো,
– অন্যান্য দেশের প্রেসিডেন্টের মতো সিকিউরিটি নিয়ে জাস্টিন ট্রুডোকে চলাফেরা করতে হয় না।উনার সান্নিধ্য খুব সহজেই পাওয়া যায়।তিন্নির কথায় ভুল কিছু ছিল না।ও যতটুকু জেনেছে,দেখেছে বা শুনেছে ততটুকু তথ্যের ভিত্তিতেই কথাটা জিজ্ঞাস করেছে।শুধু শুধু মেয়েটা কষ্ট দিলে সবাই মিলে।
– মেহেনূর তুমি ভুল ভাবছো তিন্নির কথায় আমরা হাসি নি!ওহির কথায় হেসেছি!ও বলল না, জাস্টিন ট্রুডোর সাথে ওর দেখা হয়েছে?
ক্ষীণ স্বরে বললো তনিমা।মেহেনূর ফিচেল হেসে শীতল কণ্ঠে বললো,
– আমি বুঝতে পেরেছি।কিন্তু তিন্নি তো ছোট মানুষ।ও কি আর এতো বুঝে?আর ও কিভাবে বুঝতে তোমরা কেন হাসছো।শুধু ও না ওর জায়গায় অন্যকেউ হলেও এটাই ভাবতো যে, সবাই ওর উপরই হাসছে।যাইহোক, সবাই গিয়ে এখন রেস্ট নাও,ঘুমাও।কাল সকালে দেখা হচ্ছে।যাই আমি গিয়ে দেখি তিন্নি কোথায় গেলো।
_______________________
মেহেনূর ওর রুমে এসে পুরো রুমে চোখ বুলালো কিন্তু কোথাও তিন্নি নেই।পরক্ষণেই তিন্নিকে খুঁজে বের করলো ওর ব্যালকনিতে।তিন্নি ডগিরাকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে আছে।মেহেনূর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধীর কন্ঠে ডাকলো ,
– তিন্নি?
মেহেনূরের কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো তিন্নি।পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়।পেছনে না ফিরেই ক্ষীণ স্বরে বললো,
– আমি কি ভুল কিছু বলেছিলাম আপু?
মেহেনূর গিয়ে তিন্নির পাশে বসলো।তিন্নির অবুঝ চাহনি দেখে স্মিত হাসলো মেহেনূর।তিন্নির গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো,
– না তো।তুমি এতো কোনো ভুল বলো নি।বরং ওরা ভুল বুঝেছে।আমি সবাইকে বকেও দিয়েছে।
মেহেনূরের কথার প্রত্যুত্তরে তিন্নি কিছু না বলে মৃদু হাসলো।তিন্নি জানে মেহেনূর ওদেরকে বকা না দিলেও ওর স্বপক্ষে কিছু বলে এসেছে।মেহেনূর তিন্নির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। তিন্নির এই গুণ টা ওর খুব ভালো লাগে।তিন্নি অনেকটা ওর মতোই চুপচাপ আর ঠান্ডা মেজাজের।অবশ্য ভেতরে ভেতরে যে রাগ অভিমান পুষে রাখে না তা কিন্তু নয়।তবে সবসময় রাগ দেখায় না।তবে এই টাইপের মানুষগুলোর অভিমান অভিযোগ গুলো সহজে কেউ ধরতে পারে না,বুঝতেই পারে না।হয়তো বোঝার চেষ্টা করে না বলেই!মেহেনূর মুখের হাসি বজায় রেখেই বললো,
– তোমার কথা শুনে কেউ হাসে নি,হেসেছে ওহির কথা শুনে।তুমি তাঁদেরকে ভুল বুঝো না কেমন।এখন ঘুমোতে চলো।
ঘুমানোর কথা শুনেই ডগিরা ঘেউঘেউ করে উঠলো।এক লাফে তিন্নির কোল থেকে নেমে মেহেনূরের কোলে উঠে পড়ে।মেহেনূর দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো দিতেই ডগিরা ফের উচ্চস্বরে ঘেউঘেউ করে উঠলো।মেহেনূর ভ্রুকুটি করে তাকায় ডগিরার দিকে।বুঝার চেষ্টা করছে ডগিরা কি বলতে চাইছে।ডগিরা তিন্নির দিকে তাকিয়ে আবার ঘেউঘেউ করে উঠতেই তিন্নি একটু হকচকিয়ে যায়।কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর ফিক করে হেসে দেয়।তিন্নি কিছু বুঝতে না পেরে তখনও মেহেনূরের দিকেই তাকিয়ে আছে। মেহেনূর ডগিরার কান ধরে বললো,
– ওরে দুষ্টু!এতক্ষণ তো দিব্যি ওর কোলে উঠে বসে ছিলি।এখন যেই ঘুমানোর কথা বললাম ওমনি ওর হিংসে হতে লাগলো না!
তিন্নি মেহেনূরের কথা শুনে মুখ টিপে হাসছে।ডগিরা মেহেনূরের বুকে মাথা গুঁজে ক্ষীণ শব্দ করছে।যার অর্থ মেহেনূরের সাথে ও ঘুমাবে তিন্নি না।মেহেনূর আলতো হাতে ডগিরার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে,
– তিন্নি আপু তো ওকে কত্ত আদর করে।আসার পর থেকে তো তাঁর কোলে চড়ে বেড়াচ্ছিস তাহলে এখন বেড শেয়ার করতে এমন কার্পণ্য করছিস কেন তুই?তুই তো আগে এমন ছিলি না।
ডগিরা কোনো শব্দ করছে না দেখে মেহেনূর ডগিরার মুখটা উপরে তোলে দেখে ডগিরার চোখে পানি।ওর চোখে পানি দেখে মেহেনূর ফিচেল হেসে বললো,
– কারোর জায়গা কেউ নিতে পারে না ডগি।আমি তোকে আমার মতো করে ভালোবাসি,যেমনটা তুই বাসিস।তোর জায়গায় আমি অন্য কাউকে কখনও চিন্তা করতে পারি বল?তুই যেমন আছিস সারাজীবন আমার কাছে তেমনই থাকবি।আচ্ছা কথা দিচ্ছি আজকের পর থেকে তোকে একা রেখে আর কোথাও যাবো না,প্রমিজ।
মেহেনূরের কথা শেষ হতেই ডগিরা লাফিয়ে উঠলো।মেহেনূরের মুখ চেটে দিয়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।অন্যদিকে এই দুজনের মধ্যে চলা কথোপকথনের কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তিন্নি।ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেনূর বললো,
– বাংলাদেশ থেকে আসার পর থেকেই ও এইরকম করে।অনেকদিন আমাকে কাছে না পেয়ে ভেবেছিল হয়তো আমি ওকে আর ভালোবাসি না,তাই তো ওকে রেখে চলে গিয়ে ছিলাম।বাংলাদেশে যাওয়ার আগে বাসায় ফিরতে আমার যদি দেরি হতো তখন একা খেয়ে ভাইয়া-ভাবীর বা অন্যকারো কোলে ঘুমিয়ে পড়তো।কিন্তু এখন আমি না আসা পর্যন্ত ঘুমায় না।কারো হাতে খায়ও না।
– তুমি ডগিরার সব কথা বুঝতে পারো না আপু?
– বুঝবো না কেন।গত আট বছর ধরে আমার সাথে সাথে ও।ওর বয়স যখন তিন মাস তখন ভাইয়া ওকে এনে দিয়েছিল।আচ্ছা চলো এখন ঘুমাতে যাই।
– তোমার ঘরে ডগিরা আমাকে ঘুমাতে দেবে?
তিন্নি ডগিরার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বললো।মেহেনূর উঁচু স্বরে বললো,
– ডগিরাকেই না হয় জিজ্ঞাস করো।
– ডগিরা তুমি কি আমাকে অনুমতি দিবে?বড্ড ঘুম পেয়েছে আমার।এখন হয়তো এখানেই ঘুমিয়ে পড়বো,এই ব্যালকনিতেই!
ডগিরা মেহেনূর কোল থেকে নেমে আমার তিন্নির কোলে উঠে পড়ে।ঘেউঘেউ করে ঘনঘন লেজ নাড়াচ্ছে।অর্থাৎ তাঁর কোনো আপত্তি নেই।তিন্নি হেসে আলতোভাবে ডগিরাকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ পরে ডগিরাকে কোলে তোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেহেনূর সাথে তিন্নিও।পা বাড়ালো রুমের দিকে।কিন্তু দরজার কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ায় দুজনেই।একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফের তাকায় সামনের দিকে।মেহেনূরের বিছানার ঠিক মাঝখানে আসন পেতে থমথমে মুখ করে বসে আছে তনিমা।তিন্নি মেহেনূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আপু আর ভাইয়ার মধ্যে এখনো তেমন কিছু……
– আমি সবটা জানি তিন্নি ।
তিন্নিকে বলতে না দিয়ে জোর গলায় বললো মেহেনূর।মেহেনূর ফের বললো,
– কিন্তু আমি তনিমা আপুকে নিয়ে ভাবছি না।
– তাহলে?
মেহেনূর তিন্নিকে চোখের ইশারায় ডগিরাকে দেখিয়ে বলে,
– এখন ওকে কি বলে সামলাবো!
ডগিরা একবার বিছানার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার মেহেনূরের দিকে।বেচারা ডগিরা কিছুই বুঝতে পারছে না।তবে এতটুকু ঠিকই বুঝতে পারছে এই দুই বোন আজ এই বিছানাতেই ঘুমাবে।ডগিরা মলিন মুখে মেহেনূরের দিকে তাকাতেই মেহেনূর আর তিন্নি দুজনই ফিক করে হেসে দেয়।
#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩৩.
ক্ষণে ক্ষণেই আতশবাজির জ্বলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠছে টরেন্টো শহর।শহরের অলিগলির পথ থেকে শুরু করে নগর প্যাচানো লেকের পাড় রঙবেরঙের আলোয় মুখরিত।রাস্তায় বড় বড় বিলবোর্ড গুলোয় আজ রকস্টার কিরণের ছবি।প্রত্যেকটা বিলবোর্ড এর পাশে স্ট্রীট কন্সার্ট করছে কিরণ প্রেমী তরুণ তরুণীরা।ফলে লোক সমাগমের ভীড় বেশ জোড়ালো।আজকে হঠাৎ এতো মানুষের উল্লাসের মেতে উঠা,আনন্দে আপ্লুত হওয়ার কারণটা অবশ্য একটু স্পেশালই।আজ কিরণ চৌধুরীর জন্মদিন।কিরণ প্রেমীরা তাঁদের স্পেশাল মানুষটার স্পেশাল এই দিনটিকে একটু স্পেশাল ভাবে উদযাপন করতেই এতো এতো আয়োজন করছে।
ডগিরা এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে মেহেনূর।দৃষ্টি স্থির অদূরের ওই জমকালো শহরে।আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ,লেকের স্বচ্ছ পানিতে চাঁদের আলো পড়ে চিলিক দিয়ে উঠছে বারে বারে।বাতাসে তোড়ে যখন লেকের পানিতে ঢেউ উঠে তখন মনে হয় আকাশের ওই চাঁদ হতে এক টুকরো চাঁদ হয়তো ওই লেকের পানিতে এসে পড়েছে।অশান্ত জলের সাথে অভিমান করে ঢেউয়ের ভাঁজে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।প্রকৃতি এই অদ্ভুত লীলা খেলাই নজরবন্ধি করছে মেহেনূর।মেহেনূর যেখানে আছে ওই এলাকাটা কটেজ কান্ট্রি বা মুসকোকা নামে পরিচিত।এই অঞ্চলটি টরেন্টোর এক ঘন্টা উত্তরে অবস্থিত এবং লেক মুসকোকা এবং অন্টারিওর অন্যান্য জনপ্রিয় হ্রদের চারপাশে কেন্দ্রীভূত।এই জায়গাটা অনেক বেশিই জনপ্রিয়।যদিও অন্টারিওর অনেকগুলি গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যাবে যা অনেক সুন্দর।তবুও টরেন্টোর সাথে এই অঞ্চলের সান্নিধ্যই এটিকে এতো বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে।হ্রদগুলির চারদিকে রয়েছে উচ্চ-প্রান্তের কটেজ এবং গ্রীষ্মের বাড়িগুলি যা টরেন্টনিয়ানদের মালিকানাধীন।উইকএন্ডের শেষের দিকে, টরেন্টো থেকে শান্ত গ্রীষ্মের যাত্রার জন্য লোকেরা পালাতে পালিয়ে যাওয়ার কারণে কুটির দেশের হাইওয়েগুলি যানজটে ভরা থাকে।এই এলাকাটি প্রচুর বিলাসবহুল কটেজে আর রিসোর্টে পূর্ণ।এটি মানুষের দর্শনীয় স্থানগুলোর জন্য একটি পছন্দের জায়গা।কুটির দেশের প্রাথমিক শহর হ’ল গ্র্যাভেনহার্স্ট, যা মুসকোকার লেকের তীরে অবস্থিত। এখান থেকে দর্শনার্থীরা হ্রদে শর্ট ক্রুজের জন্য স্টিমশিপে যেতে পারেন।এই জায়গাটা মেহেনূরের খুব পছন্দের।
মেহেনূরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ডগিরা একটু পর পর ওর কোলে উঠে ওর মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।মেহেনূর যখন বরাবরের মতোই চুপ,তখন ডগিরা এসে মেহেনূরের গালে নিজের গাল ঘষে অস্পষ্ট স্বরে ওর মনের উৎকন্ঠা,অস্থিরতা প্রকাশ করলো।মেহেনূর ঘনঘন চোখের পলক ফেলছে কিন্তু চুপ।অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন নিজের মালিকের কোনো আদর পেলো না তখন ডগিরা নিজের মুখ নামিয়ে মেহেনূরের কোল থেকে নেমে যায়।চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই মেহেনূর আচমকায় ডগিরাকে জড়িয়ে ধরে।ডগিরা মেহেনূরের বন্ধন থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।এক পর্যায়ে পরাস্ত হয়ে ও শান্ত হয়ে যায়।তবে মেহেনূরের দিকে তাকায় নি।মেহেনূর ডগিরাকে ওর পাশে বসিয়ে দেয়।যেমন করে ও বসে আছে ঠিক তেমন করে।ডগিরাকে এক হাতে জড়িয়ে সামনের পা দুটো আলতো হাতে ধরে রেখেছে।ক্ষণকাল পরেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে বলল,
– ডগিরা,তুই কি কখনো খেয়াল করেছিস?মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার এই সময়টা’তে আমার কেমন জানি অদ্ভুত টাইপের মন খারাপ হয়!তখন চারদিকের সব কিছুতেই কেমন যেন নাই নাই লাগে!দুনিয়ার কোনো কিছুই তখন ভালো না।হঠাৎ হঠাৎ বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করে!মনে হয় এই মহাশূন্যে আমি হয়তো ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছি।এই ব্যাপারটা অদ্ভুত,কিন্তু সত্য!এই যেমন ধর এখন,একটু আগ অবধিও দিব্যি ভালো ছিলাম।যেই সন্ধ্যা নামলো ওমনি মনের কোণেও আঁধার নেমে এলো।দেখ এই শহরের মানুষগুলোর কতশত আয়োজন।তবু মনে শান্তি মিলছে না,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পাচ্ছি না।
এতটুকু বলে মেহেনূর এক পলক ডগিরার দিকে তাকিয়ে ফের বললো,
– আমার এতো চাকচিক্যময় জীবন চাই না।কি হবে এই চাকচিক্যে ঘেরা জীবন দিয়ে?যদি আমার মনে শান্তিই না থাকে!ইদানীং নিজেকে বড্ড একা লাগে রে।কখনো কখনো মন বলে,এই মহাশূন্যে এমন একজন মানুষ থাকুক,যদি কখনো বিধ্বস্ত হয়ে ভেঙে পড়ি তখন হতাশার চরমে ডুবে গিয়ে তাঁকে একটাবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলেই মনের ভেতর প্রশান্তি অনুভব হবে।যাকে জড়িয়ে ধরলে শতকষ্ট ভুলে গিয়ে মনে প্রাণে আসবে সজীবতা,চোখে মুখে ফোঁটে উঠবে বেঁচে থাকার আজন্ম সাধ।এমন একজন মানুষ থাকুক যার কাছে সবটা বলা যাবে অবলীলায়।তাঁকে কত কথা জানানোর বাকী।প্রায়ই আমার হৃদ কুটিরে দলা পাকিয়ে আসে নিঃসঙ্গতার গল্পগুলো।তখন খুব করে বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু বলা হয়ে উঠে না আর!এমন একটা মানুষ থাকুক না,যে আমার চোখের শীতল চাহনি দেখেই বুঝে নিবে বুকের ভেতরটার নিঃঙ্গতার শূন্যতা,হাহাকার!একটা মানুষ থাকুক এই বিধ্বস্ত ধরনীর এক টুকরো জমিনে দাঁড়িয়ে যে কিনা সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাকে পাওয়ার তীব্র আকুতি জানাবে।একজোড়া হাত মোনাজাতে শুধু আমাকে পাওয়ার জন্যই প্রার্থনা করবে।আমাকে হারানোর শঙ্কায় অশ্রুসিক্ত হবে একজোড়া পবিত্র চোখ।
ডগিরা চুপ করে বসে আছে।মেহেনূরের কথায় ও ব্যথিত হয়,হচ্ছে।শুধু প্রকাশ করতে পারছে না।সেই ছোট থেকে মেহেনূরকে দেখছে ও।মেহেনূরের ভালো লাগার হোক বা খারাপ লাগার সেই সব অনুভূতিগুলো ওর সাথেই শেয়ার করে।ওর মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলে ওর মনটাকে খানিকটা হালকা করে।আজ আবারও মেহেনূর ওর মনের সুপ্ত বাসনাগুলো উগলে দিচ্ছে ওর সামনে।হয়তো এই কথাগুলো প্রতিনিয়তই লালন করে যাচ্ছে খুব যত্ন করে।
ডগিরাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেনূর স্মিত হেসে শীতল কন্ঠে বললো,
– এটা কিন্তু আমার স্বপ্ন নয়,আমি সত্যিই চাই রে!শুধু ভালোবাসার জন্য নয়,কেউ একজন থাকুক যে আমার এই পুরো আমিটার মায়ায় পড়বে।যে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমার সাথেই থাকবে।ছন্নছাড়া আর এলোমেলো এই আমিটাকে গভীর যত্নে আগলে রাখবে তাঁর বুকের মাঝে।আমি চাই,আজীবন পথচলার সঙ্গী হয়ে কেউ একজন আসুক আমার জীবনে।
ডগিরা মেহেনূরের গায়ে হেলান দিয়ে শান্ত হয়ে বসে আছে।একদম কোনো নড়াচড়া করছে না।হয়তো মেহেনূরের বলা প্রত্যেকটা কথা খুব সূক্ষ্মভাবে অনুধাবন করছে ও।একটা মেয়ে সবাইকে শুধু দিয়েই যায় বিনিময়ে মুখ ফুটে কিছু চায় না।অবশ্য না চাইতেই অনেক কিছু ওর ভাই ওকে দিয়েছে,দেয়।কিন্তু তাই বলে সব খবর রাখতে পারবে এমনটা তো নয়।কারোর মনের খবর কি কেউ জানে?সবাই কি সবার মন পড়তে পারে?
ডগিরাকে এতটা চুপচাপ দেখে মেহেনূর মাথা কাত করে আঁড়চোখে ডগিরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়ে ধীর কন্ঠে আবার বললো,
– আচ্ছা ডগিরা,আজকের রাতটা যদি এখানেই কাটিয়ে দেই তাহলে কেমন হয় বল তো?
মেহেনূরের কথাটা বলতে দেরি ডগিরার ঘেউঘেউ করে উঠতে দেরি নেই।মেহেনূর বাঁকা চোখে তাকায় ডগিরার দিকে।ওর তাকানোর ভঙ্গিমাটা এমন,ডগিরা যে ওর কথার প্রত্যুত্তরে এইভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা যেন ও জানতোই!তাও নিজের মনকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললো।আজ কেন যেন এখান থেকে যেতে মন চাইছে না ওর।মেহেনূর একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যপাশে।
আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে ডগিরা আবার ঘেউঘেউ করে উঠলো।এবার বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ডগিরার দিকে তাকালো মেহেনূর।মাঝে মাঝে ডগিরার উপর খুব রাগ হয় ওর।ডগিরার এই অভিভাবকপনা খরব দারি আচারণে মনে হয়,শুধু ও-ই সবকিছু জানে বুঝে!মেহেনূর কিছু জানে না।মেহেনূর রুদ্ধশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়।ডগিরাকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
– এইভাবে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?আমাকে একটু নিজের মতো করে থাকতে দিবি না বলে তো ঠিক করেই নিয়েছিস!চল তাহলে।
কথাটা শেষ করেই মেহেনূর হাঁটা শুরু করে।মেহেনূরের কথাটায় নমনীয়তা না থাকলেও ডগিরার জন্য ওই একটা শব্দই হাজার কথার মানে।”চল” মানে মেয়ের সুমতি হয়েছে।মেহেনূর কিছুটা রাগ নিয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।মেহেনূরের পিছন পিছন যাচ্ছে ডগিরা।দেখে মনে হচ্ছে তাঁকে কিরণ চৌধুরীর পার্সোনাল বডিগার্ড হিসেবে রাখা হয়েছে আর এই মুহূর্তে সে তাঁর দায়িত্ব পালন করছে।
_________________
মা বাবা কাছে যাওয়া জন্য সকাল হতেই হালকা নাস্তা করে মেহেনূরদের বাড়ি থেকে চলে আসে দিহাদ আর কলি।সাথে তনিমা,শান্ত,অয়ন আর ওহিও এসেছে।তিন্নি আসে নি।ও মেহেনূরদের বাসায়ই রয়ে গেছে।যেখানে ওহি যাবে সেখানে ওর যাওয়া প্রশ্নই আসে না।কাল রাতের পরে তো একদমই না।দিহাদের বাসায় সবাক নিজেদের মতো আলাপ আলোচনা করছে।ওহি তনিমার ফোন নিয়ে গেইম খেলছে।সারাক্ষণই ফোনে গেইমস খেলে বলে শান্ত ওর ফোন নিয়ে নিয়েছে।তনিমাই ওর ফোনটা ওহিকে দিয়েছে গেইমস খেলার জন্য।সবার থেকে একটু দূরে বসে আছে ওহি।হঠাৎ ফেইসবুক থেকে একটা নোটিফিকেশন আসতেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো ওহি।তিন্নির আইডি থেকে নোটিফিকেশন এসেছে দেখে ওহির কপালের ভাঁজ দ্বিগুণ হয়ে যায়।কৌতূহলবশত নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই ওহির চক্ষু চড়াকগাছ।ওহি হা করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।জাস্টিন ট্রুডোর সাথে তিন্নির ছবি?বিশ্বাসই হচ্ছে না ওহির।গুনেগুনে কুঁড়িখানা ছবি আপলোড দিয়েছে।লোকেশনটা খুব পরিচিত লাগছে।তবে বেশ জাঁকজমকভাবে সাজানো বলে ঠিক চিনতে পারছে না।ওহি সবগুলো ছবি এক এক করে চেক করতে লাগলো।না তাও চেনতে পারছে না।পরমুহূর্তেই বার্থডে গার্ল ক্যাপশনে আরেকটা নোটিফিকেশন আসে সেইম আইডি থেকেই।নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই মেহেনূরের হাস্য উজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো।দ্বিতীয় ছবি আসতেই চমকে উঠলো ওহি।মেহেনূর কেক কাটছে!অন্য আরেকটি ছবিতে জাস্টিন ট্রুডো মেহেনূরকে কেক খাওয়াচ্ছে।ছবিগুলো দেখা মাত্রই ওহি বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
– আজ মেহেনূর আপুর জন্মদিন?
ওহির কথা শুনে সবাই ভ্রুকুটি করে তাকায় ওর দিকে।ওহি ওর হাতে থাকা ফোনটা সবার দিকে ঘুরিয়ে ফের বললো,
– দেখো স্বপরিবারে জাস্টিন ট্রুডো এসেছে মেহেনূর আপুদের বাসায়।
– ভাই তুমি এইসব কি বলছো?মেহেনূরের জন্মদিন আর ও আমাদের বলবে না সেটা কখনো হয় নাকি।
– আরে ভাবি আমি সত্যি বলছি।বিশ্বাস না হলে দেখো।তোমার বোন শুধু জাস্টিন ট্রুডোর সাথেই বিশটা ছবি আপলোড করেছে।আর বাকি গুলো মেহেনূর আপুর কেক কাটার মুহূর্তের।এই যে দেখো।
ওহি এগিয়ে এসে তনিমার হাতে ফোনটা দেয়।সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে।আজ মেহেনূরের জন্মদিন?অথচ ওরা কেউই জানে না?অবশ্য না জানাটাই স্বাভাবিক।কেউ তো ওর সম্পর্কে সেইভাবে জানতেই চায় নি কখনো।মেয়েটার কাছ থেকে সবাই শুধু নিয়েই গেলো।বিনিময়ে কিছু দিতে পারে নি।
এইদিকে মেহেনূর নামটা অপরিচিত হলেও মেহেনূরের মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে দিহাদের মা বাবার কাছে।কোথায় যেন দেখেছে।হুট করেই স্মরণে আসে ও তো কিরণ,কিরণ চৌধুরী।কিন্তু সবাই ওকে মেহেনূর কেন ডাকছে তাঁরা সেটাই বুঝতে পারছে না।পরমুহূর্তেই ভাবে হয়তো এটা কিরণই আরেকটা নাম।
_________________
দূরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক।চোখে মুখে বিস্ময়।মিনিট তিনেক আগেই বাসায় ফিরেছে ও।আসার পর থেকেই ওইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।আজ মেহেনূরও জন্মদিন এটা জানে না বলে ও অবাক হচ্ছে না।অবাক হচ্ছে জাস্টিন ট্রুডোকে দেখে।কিভাবে?মেহেনূরের সাথে এমন কি সম্পর্ক আছে যে ওর বার্থডে সেলিব্রেশনে শামিল হয়েছেন স্বয়ং জাস্টিন ট্রুডো।এই মেয়েটা ভারী অদ্ভুত!নিমিষেই খোলস পাল্টে ফেলতে পারে।যেখানেই যায় সেখানেই সবার মন জয় করে নেয় এক্কেবারে।আজকে মেহেনূরের বার্থডে কেউ তো ওকে বলেও নি অবধি।আর এইটুকু সময়ের মধ্যে এত আয়োজন কে করলো?কিভাবে সম্ভব?রাওনাফ তো কানাডাতেই নেই।বিকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও তো বাড়িতে একটা ফুলের পাঁপড়ি অবধি চোখে পরে নি।আর এখন এই বাড়িটাকে কয়েক হাজার সতেজ ফুলের সমন্বয়ে একটি উদ্যান মনে হচ্ছে।বাহির থেকে মনেই হচ্ছিল না এটা কোনো সাধারণ মানুষের বাড়ি!
অর্ক কথাগুলো ভাবছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে প্রত্যেকটা মানুষের গতিবিধি নজরবন্দী করছে সূক্ষ্ণভাবে।পরমুহূর্তেই রোশনিকে দেখতে পেয়ে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়।রোশনি এগিয়ে এসে অর্ককে নিয়ে যায় মেহেনূরের কাছে।সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে মেহেনূরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এক টুকরো কেক তুলে দিলো মেহেনূরের মুখে।অর্কের এহেন কান্ডে আর কেউ অবাক না হলেও মেহেনূর বেশ অবাকই হয়েছে।কারণ ঘটনাটি এতটাই দ্রুত হয়েছে যে মেহেনূর কিছু বলার আগেই অর্ক ওর মুখে কেক পুরে দিয়েছে।মেহেনূর হা করে তাকিয়ে আছে অর্কের দিকে।অর্ক ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলো,”কি?”মেহেনূরের মুখ ভর্তি কেক ফলে কথা বলতে পারছে না।অর্ক মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়।
এইদিকে ওহি সেই কখন থেকে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ও।ওর এতো ভাবনার কারণ অবশ্যই তিন্নি।সকাল থেকে দেখছে ও,আজ তিন্নি একটা বারও ওর দিকে ভালো করে তাকায়ও নি অবধি।যতটা পারছে দূরত্ব রেখে চলাফেরা করছে। হয়তো কাল রাতের ব্যবহারের জন্য কষ্ট পেয়েছিল।তাই ওকে ইগনোর করছে।
– তিন্নি তো জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ছবি তুলে তোমায় দেখিয়ে দিলো।
অয়নের কথায় ওহির ভাবনার সুতো ছিড়ে।স্মিত হেসে বললো,
– তাই তো দেখছি।আচ্ছা ভাইয়া,জাস্টিন ট্রুডো এখানে কিভাবে আসলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।মেহেনূর আপু বা এই বাড়িতে স্পেশাল এমন কি আছে যে,জাস্টিন ট্রুডোকে পার্সোনালি ইনভাইট করা হয়েছে আর উনি চলেও আসলেন?
– জাস্টিন ট্রুডো চলে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলতে শুনলাম,তাঁর মেয়ে নাকি বায়না ধরে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে।মেহেনূর বা ওর পরিবারের কেউ জানতোই না তিনি আসবেন।
– তারপর?
– তাঁকে শুধু এতটুকুই বলতে শুনেছি।
– ভাইয়া এই ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে না?
ওহি কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে প্রশ্নটা করল।অয়ন অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,
– আশ্চর্যজনক লাগবে কেন?
– না মানে শুধুমাত্র উনার মেয়ের কথায়…..
– মেহেনূরের কাছ থেকে পরে শুনে নেবে।এখন চলো ওইদিকে যাওয়া যাক।
_________________
সবাই যখন নিজের মতো ব্যস্ত ঠিক তখনই সবার অগোচরে একজন মেহেনূরের ঘরে ঢুকে পরলো।তাঁর জহুরির চোখ দিয়ে পুরো ঘরটা স্ক্যান করছে।তিল পরিমাণ জায়গাও মনে হয় আজ অবশিষ্ট রাখবে না,এমন ভাবেই দৃষ্টি চালাচ্ছে।মিনিট দুয়েক পরেই দরজার বাহিরে কারোর পায়ের আওয়াজ কানে আসতেই থমকে দাঁড়ায়।
চলবে……..
চলবে…….
[