#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৬|
‘আপনি সামান্য একটা জমির জন্য নিধি কে বিয়ে করেছেন, জুভান?’
জুভান শান্ত গলায় জবাব দিল,
‘হু।’
স্মৃতি প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললো,
‘আপনার এত লোভ? আমি তো আপনাকে ভালো মানুষ ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনি… যখন জমির জন্য নিধি কে বিয়েই করেছিলেন তাহলে আজ এত কাহিনী করে ওর বাবার কাছ থেকে জমি কেন নিয়েছেন? এসব করতে আপনার একবারও বাঁধল না?’
জুভান জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। স্মৃতির দিকে ঘুরে বসে বললো,
‘দেখো, আমি নিধি কে বিয়ে করতে চাইনি। ওর বাবা আমাকে শর্ত দিয়েছিলেন যে ওকে বিয়ে করলে উনি আমাকে জমি টা দিয়ে দিবেন। আমি ভেবেছিলাম জমি টা পাওয়ার পর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। আর ঐ জমি টা আমার জন্য অনেক মূল্যবান। তুমি জানো না এই জমির জন্য আমাকে কত কিছু করতে হয়েছে, এত কিছুর পরেও কীভাবে জমি টা হাত ছাড়া করে দিতাম বলো? কিন্তু নিধির বাবা আমার সাথে বেইমানি করলেন। তাই আমিও বাধ্য হলাম উনার গায়ে হাত তুলতে। এতে আমার কোনো দোষ হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তবে এখানে একটাই ভুল হয়েছে যেটা হলো, আমি তোমার সাথে তখন খুব রাগ দেখিয়ে ফেলেছিলাম। আর তার জন্য আ’ম সরি।’
জুভান কথাটা বলে স্মৃতির গালে আলতো স্পর্শ করতেই স্মৃতি সেই হাত টা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। জুভান ব্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। স্মৃতি রূঢ় গলায় বললো,
‘এই সব কিছু কি আপনার কাছে কোনো খেলা মনে হচ্ছে? আমাকে বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় আপনি নিধি কে বিয়ে করে আনেন। আর আপনার মা সেই প্রথম থেকেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আসছেন। দিন রাত এত কাজ করেও কখনও আপনার মায়ের মন পাইনি। সবসময়ই উনি আমাকে কথা শুনিয়েছেন। আর নিধি কে মাথায় তুলে রেখেছেন। কেন রেখেছেন এখন বুঝতে পারছি, সব করেছেন খালি ঐ জমির জন্য। এখন জমি পেয়ে গেছেন বলে তাদের লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। মানে কত সহজ তাই না সবকিছু। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে জীবনেও এত কিছু সহ্য করতো না। কবেই আপনাকে ছেড়ে চলে যেত। অবশ্য আমিও চলে যেতাম যদি না…’
থেমে গেল স্মৃতি। আর কিছু বলার ইচ্ছে নেই তার। জুভান উঠে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে কঠোরতা উপচে পড়ছে যেন। সে চোয়াল শক্ত করে বললো,
‘আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা তুমি ভাবলে কী করে স্মৃতি?’
স্মৃতি অক্ষি পল্লব মেলে জুভানের মুখের দিকে তাকাল। বুঝে গেল যে জুভান রেগে গিয়েছে। সে তখন নিরব গলায় বললো,
‘আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি বলছি না। কিন্তু এত অন্যায়ও আর আমি মেনে নিতে পারছি না। আপনি আমাকে আর নিধি কে দুজনকেই ঠকিয়েছেন। একটা জমি কে কেন্দ্র করে এত কিছু না করলেও পারতেন। বিয়ের এত বছর পর এসে আপনার এই রূপ টা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, জুভান। আপনাকে নিয়ে আমার সব ভাবনা’ই কেমন যেন উল্টে গিয়েছে।’
জুভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মৃতির হাত ধরে তাকে তার কাছে টেনে নিল। অত্যন্ত নরম সুরে বললো,
‘তুমি শুধু আমার ভুলটাই দেখে যাচ্ছো। ঐ লোকটাও আমায় ঠকিয়েছে। আমার জমি আমাকে দিবে না, আমি এটা কীভাবে মেনে নিতাম বলো। এত বুঝালাম, এত সময় দিলাম তাও লাভের লাভ কিছুই হলো না। তাই আমি এসব করতে বাধ্য হয়েছি নয়তো আমি কখনোই উনাকে আঘাত করতাম না, বিশ্বাস করো।’
স্মৃতি চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করলো। মাথায় অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে তার। সবটা উপর দিয়ে যতটা স্বাভাবিক লাগছে ভেতর দিয়ে তা ততটাই অস্বাভাবিক। জুভানের এই আচরণ মোটেও সুবিধার না। তাকে এবার আরো সতর্ক থাকতে হবে। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। আর সবার আগে ঐ লোকটা কে খুঁজে বের করতে হবে, যার জন্য আজকে তাকে এত সব মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে।
স্মৃতির নিরবতা দেখে জুভান বিরস মুখে বললো,
‘এখনও অভিমান করে আছো? সরি।’
স্মৃতি স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘না, আমি ঠিক আছি। একটা কথা বলার ছিল?’
‘হ্যাঁ, বলো।’
স্মৃতি নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
‘মাসের তো শেষ হতে চললো। বাবাকে আবার টাকা দিতে হবে। ডাক্তার বলেছেন, সামনে আবার একটা অপারেশন করতে হবে। তখন আরো টাকা লাগবে, কিন্ত এত টাকা..’
‘টাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি আছি তো। কখন যাবে বাবার কাছে?’
‘কাল।’
‘ঠিক আছে। যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেও।’
স্মৃতি মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিচে নামতেই তার শাশুড়ি মা তাকে ডেকে বললো,
‘শুনো মেয়ে, তোমার সুখের কথা ভেবে আমি নিধি কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। এখন আর বলতে পারবে না, তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে। এখন পুরো সংসার তোমার একার। কেউ আর সেটা তে ভাগ বসাতে পারবে না। নিজ হাতে খুশি মনে এবার এই সংসার সামলাও।’
স্মৃতির প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে। সে চোখ মুখ কুঁচকে সে তার শাশুড়ি কে বললো,
‘আপনি আমার অনেক বড়ো উপকার করলেন মা। এতদিন আপনার প্রতি যাই একটু সম্মান আসতো আজ থেকে আর সেটাও আসবে না। আমার অবাক লাগে মা, মানুষ এত টা নিচু মনের কীভাবে হয় বলুন তো?’
এই বলে স্মৃতি রান্নাঘরে চলে গেল। তার শাশুড়ির পাক্কা দু মিনিট লাগল এটা বুঝতে যে স্মৃতি তাকে অপমান করে গিয়েছে। যখন তিনি বুঝতে পারলেন উনি চেঁচিয়ে তখন পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। কিন্তু উনার চিৎকারের আওয়াজে কেউই নিচে নামল না। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই উল্টা পাল্টা বকে তিনি সেই স্থান প্রস্থান করলেন।
রাতে খেতে বসে মারিয়াম আহমেদ ইনিয়ে বিনিয়ে ছেলের কাছে স্মৃতিকে নিয়ে অনেক বিচার দিলেন। কিন্তু ছেলে তার এসবে খুব একটা পাত্তা দিল না। তিনি তাতেই নাক মুখ ফুলিয়ে ফেললেন। খাবে না বলে চেয়ার থেকে উঠে গেলেন। এতসব নাটকে স্মৃতি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছিল। তাও সে তার শাশুড়ি কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার এনে টেবিলে বসালো। ছেলের সামনে তিনি স্মৃতির কাছে ক্ষমাও চাইলেন। মূলত নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য যা যা করার দরকার তিনি তার সবটাই করলেন।
সবকিছু গুছিয়ে স্মৃতি তার রুমে গিয়ে দেখল, জুভান ল্যাপটপে কাজ করছে। সে বারান্দা থেকে কাপড় এনে সেগুলো আলমারি তে তুলে রাখল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বারোটা দশ বাজছে। বিছানার এক পাশে গিয়ে বসতেই জুভান বললো,
‘স্মৃতি, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
স্মৃতি ভ্রূকুটি করে বললো,
‘কী?’
জুভান ল্যাপটেপ টা বন্ধ করে তার দিকে চাইল। বললো,
‘আমরা বাচ্চা নিব।’
স্মৃতি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। হুট করেই এমন কিছু শ্রবণ ইন্দ্রিয় তে প্রবেশ করায় সে যেন অনেকটাই ভড়কে যায়। তার অন্বিত কোনো প্রত্যুত্তর সে খুঁজে পেল না। জুভান তার কাছে কিছুটা এগিয়ে বললো,
‘কী হলো স্মৃতি? এমন স্তব্ধ হয়ে গেলে কেন? তুমি কি বেবি নিতে চাও না?’
স্মৃতি মস্তিষ্কে ক্ষণিক সন্ধান চালিয়েও কোনো উত্তর মেলাতে পারলো না। কিন্তু কিছু একটা বলতে হবে বলে সে বললো,
‘আগে আমাদের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’
জুভান বললো,
‘তা তো নিব’ই। কিন্তু তার আগে তো আমার তোমার মতামতও জানতে হবে। এখন বলো, তুমি চাও কিনা?’
স্মৃতি আমতা আমতা করে বললো,
‘আগে ডাক্তার দেখাবো, তারপর সিদ্ধান্ত নিব।’
স্মৃতির কথা শুনে জুভান খুব একটা খুশি হতে পারলো না। তাই সে বললো,
‘ঠিক আছে। তাহলে আমরা কালই ডাক্তারের কাছে যাবো।’
স্মৃতি কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
চলবে…
(আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ। সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। শুধু শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে পাশে থাকুন💙)