#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৩| (অন্তিম পর্ব)
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একে একে সবাই তাদের জবানবন্দী দিল। বাকি সব অপরাধীর সাথে নিজের বাবা আর ভাইয়ের নামে সত্য বলতে একবারও বুক কাঁপলো না জারার। সে যতটুকু জানে যা জানে সবটাই জর্জ কে বলল। নিধিও তার জবানবন্দী দিল। তাদের প্রতি হওয়া প্রত্যেকটা অন্যায়ের বিচার সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চাইল। সবশেষে পালা এল স্মৃতির। স্মৃতি কে ও অন্য সবার মতো কাঠগড়ায় ডাকা হলো। স্মৃতি এগিয়ে গেল সেদিকে। তার মন আর মস্তিষ্কে কী চলছে তা এই মুহূর্তে বোঝা দুষ্কর। সে কাঠের রেলিং দেওয়া মঞ্চে উঠে দাঁড়াল, যার অপর পাশেই তার তথাকথিত স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতি বুঝতে পারছে তার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। কিন্তু সেটা ভয় নাকি দুশ্চিন্তা আর নাকি উত্তেজনায় সেটা সে বুঝতে পারছে না। স্মৃতি কে তার পক্ষের উকিল এসে সব সত্যি বলতে বলল।
স্মৃতি ঢোক গিলল। তার ঝাপসা দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অপর প্রান্তের মানুষটার দিকে। সেই মানুষটা নির্বাক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এখনও তার চোখে মুখে সেই কাঠিন্য ভাবটা রয়ে গেছে, রয়ে গেছে সেই আক্রোশ। স্মৃতি চোখ নামিয়ে ফেলে। কষ্ট হলেও একে একে বলতে থাকে সবকিছু। এতটা রুক্ষ, এতটা কর্কশ স্বরে সে আগে কখনো কথা বলেনি। নিজের মনের আশ মিটিয়ে সে সবার সামনে ঐ বাপ ছেলের সমস্ত সত্য উন্মোচন করে এসেছে। এখন তার শান্তি। অনেকগুলো দিন পর আজ তার মনটা কিছুটা হলেও হালকা হয়েছে।
অবশেষে সমস্ত প্রমাণ জুভান আর তার বাবার বিরুদ্ধে। তাদের পক্ষের উকিলও লড়তে লড়তে একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। আর কত, শত চেষ্টা করেও তিনি সত্যকে ঢাকতে পারেননি। জুভানের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা বেশি। শেষ পর্যায়ে গিয়ে সেও স্বীকার করে নিল সবকিছু। তবে সেটাও নরম ভাবে না, এমনভাবে বুক ফুলিয়ে বলেছে যেন সে খুব গর্বের কাজ করেছে। জুভানের এই আচরণ স্মৃতি কে আরো বেশি আঘাত করে। অনন্ত একবার সে নিজের ভুলটা সহজ মনে মেনে নিত। একবার তার জন্য অনুশোচনা করত। তাও স্মৃতি তার মনটাকে বোঝাতে পারতো। কিন্তু এই মনহীন বিবেকহীন মানুষটা পাপ করতে করতে আজ পাথর হয়ে গিয়েছে তাই তার গায়ে আর কোনো আঘাত’ই লাগে না।
অনেক বিচার বিবেচনা করে জর্জ সাহেব উনার রায় প্রদান করলেন। জুভানকে আর জিহাদকে দেয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর মজুমদার সাহেবকে দেওয়া হলো ত্রিশ বছরের জেল তার সাথে বিশাল অংকের টাকার জরিমানা।
.
জুভানকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময় স্মৃতি তার সামনে যায়। জুভান স্মৃতিকে দেখে হেসে বলে,
‘কনগ্রাচুলেশন, ফাইনালি ইউ উইন।’
স্মৃতি জড়ানো গলায় বলল,
‘আমি আপনাকে কখনও ক্ষমা করব না জুভান।’
জুভান শক্ত গলায় বলল,
‘আমার ক্ষমার প্রয়োজন নেই। তবে একটা কথা ভেবে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে জানতো, এতকিছুর পরও তোমার একটা ইচ্ছে এখনও অপূর্ণ’ই রয়ে গেল; আমার ফাঁসিতে ঝুলা তোমার আর দেখা হয়ে হলো না।’
স্মৃতি জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘এত সহজে মরে গেল মরার মর্ম বুঝবেন না। আস্তে ধীরে ঢুকরে ঢুকরে মরুন। তাহলেই বুঝবেন মৃত্যুর কত যন্ত্রণা।’
জুভান জবাব না দিয়েই সেখান থেকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেই জারা আসে সেখানে। জারাকে দেখে জুভান আলতো হেসে বলে,
‘তোর সব আবদার এখন কে পূরণ করবে শুনি?’
‘না হয় আমার আবদারগুলো অপূর্ণ’ই থাকবে তাও আমি চাই না আমার আবদার কোনো খুনী এসে পূর্ণ করুক।’
জারার এই কথাটা জুভানের মনে খুব আঘাত হানে। সে পুনরায় কোনো উক্তি না করে সেখান থেকে চলে যায়। তার পরপরই সেখান দিয়ে মজুমদার সাহেবকেও নিয়ে যাওয়া হয়। বাবা আর ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে জারা আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না। সে স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগে। স্মৃতিও এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলে। সে কী করে বোঝাবে জুভানের জন্য এখনও তার বক্ষে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।
___________________________________
এক মাস পর,
স্মৃতি তার বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে তার মা আর ভাইও রয়েছে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
‘আমি পেরেছি বাবা, অবশেষে তোমার জমি উদ্ধার করতে পেরেছি। আর তার সাথে তোমার খুনীদেরও শাস্তি দিতে পেরেছি। আর আমার কোনো কষ্ট নেই। এবার তোমার কথামতো আমি আর ভাই মিলে জমিতে একটা মসজিদ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করব। সেখানে অনেক এতিম বাচ্চা থাকবে। অনেক হাফেজ পড়াশোনা করবে আর তোমার জন্য সবাই দোয়া করবে। তুমিও দোয়া করো বাবা, যেন আমি আর ভাই মিলে তোমার সেই অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।’
.
বাবার কবর থেকে ফিরে আসার পথেই স্মৃতি দেখতে পায় একটা মেয়ে একটা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে খুব কাঁদছে। কবরটা দেখে নতুন মনে হচ্ছে। হয়তো বেশিদিন হয়নি এই কবরের। সে কৌতুহলবশত মেয়েটির কাছে যায়। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,
‘ইনি আপনার কে হোন?’
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমার স্বামী।’
স্মৃতি ঢোক গিলল। মেয়েটির বয়স তার মতোই। অথচ সে আজ স্বামী হারিয়ে বিধবা। অন্যদিকে তার স্বামী দেখেও সে সধবা হতে পারল না। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল,
‘জানেন, আমার স্বামী আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্টের সময়, উনি গাড়ির নিচে খুব খারাপ ভাবে চাপা পড়ে ছিলেন। উদ্ধার কর্মীরা উনাকে আগে বের করতে আসলে উনি তাদের বারণ করে বলে তারা যেন আমায় আগে বের করেন। আর আমাকে বের করতে গিয়েই বাঁধল বিপদ। ঐটুকু সময়ও উনি অপেক্ষা করতে পারলেন না। গাড়ির চাপে দম আটকে মারা যান। এখন বলুন তো, আমাকে বাঁচিয়ে কী লাভ হলো? উনি তো জানতেন উনাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন।’
এই বলে মেয়েটা আরো জোরে জোরে কাঁদতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদেই কিছু লোকজন এসে উনাকে জোর করে সেখান থেকে নিয়ে যায়। উনি যেতে চাইছিলেন না। শাফিন শাফিন বলে খুব চেঁচাচ্ছিল। তবুও উনাকে এখানে থাকতে দেওয়া হলো না। জোর করে শাফিনের কাছ থেকে তার ভালোবাসাকে আলাদা করে দেওয়া হলো। আহ, ভালোবাসা! কেউ ভালোবাসার জন্য মরতে পারে তো আবার কেউ সেই ভালোবাসাকেই মারতে পারে। সবাই’ই স্বার্থপর।
“সমাপ্ত”