অতঃপর তুমি আমি পর্ব ৩

গল্পঃ অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৩
কম্পিউটার বন্ধ করে নিচতলায় নামল পিউ। রান্নাটা আজ সকালেই সেরে ফেলেছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার মতো তেমন কাজ নেই। তাই টিভির সামনে বসল কিছুক্ষণ। চ্যানেলগুলো উল্টেপাল্টে একটাতে থিতু হলেও মাথা থেকে জুনায়েদ সরল না। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সেমিস্টার ফি দেখার পর থেকেই অস্থির লাগছে মন। জুনায়েদ কী ভেবে সেমিস্টার ফি পাঠাল, সেটা ভেবে কুলকিনারা করতে পারছে না কোনো। নয়টা মাস ধরে জুনায়েদের বেতনের অর্ধেকটা সরাসরি চলে আসে তার অ্যাকাউন্টে। এই বেতন থেকেই প্রতি মাসে অল্পসল্প পাউন্ড জমাত জুনায়েদ। প্রতি চার মাস পর সেটা জমা দিত ইউনিভার্সিটিতে। বেতনের বাকিটা থেকে এই বাড়ির কিস্তি শোধ করত। তারপর গাড়ির ইন্স্যুরেন্স, রোড ট্যাক্স, সংসারের আনুসঙ্গিক যাবতীয় খরচ তো ছিলই। কিন্তু এখন শুধুমাত্র অর্ধেক বেতন দিয়ে কীভাবে কী করতে পারছে সে? এই মাসে সেমিস্টার ফি পাঠানো মানেই তার হাতে আর কোনো পাউন্ড থাকবে না। তাহলে কীভাবে চলবে সে নিজে? একা থাকলেও খরচ তো আছেই। বাসা ভাড়া, ইউটিলিটি বিলস, কাউন্সিল ট্যাক্স, যাতায়াত খরচ এগুলো কীভাবে সামাল দেবে? এছাড়াও বাড়ির কিস্তি, গাড়ির ইন্স্যুরেন্স, রোড ট্যাক্স, বাড়ির কাউন্সিল ট্যাক্স, ইউটিলিটি বিল, বয়লারের ইন্স্যুরেন্স সবকিছু সময়মতো পরিশোধ হয়ে যাচ্ছে প্রতি মাসে। জুনায়েদ আগে যেমন সবকিছু পরিশোধ করত, এখনো সেভাবেই চলছে। তার মানে এই মাসে এগুলোও পরিশোধ করতে পারবে না জুনায়েদ। তবু কেন সে সেমিস্টার ফি পাঠাচ্ছে, সেটা পিউয়ের বোধগম্য নয়। অ্যাকাউন্টে বেশ বড়সড় অ্যামাউন্ট জমে গেছে। জুনায়েদের অর্ধেক বেতন আর সরকারি ভাতা মিলে যা পায়, খরচ করে তার চার ভাগের এক ভাগ মাত্র। বাকিটা থেকে সেমিস্টার ফি পরিশোধ করেও অনেক থাকবে। এটা কি জুনায়েদের অজানা?
কলিংবেল বাজল পর পর দুবার। পিউ ঝট করে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল। বিকেল ছয়টা বাজে! জুনায়েদের এখন অফিস থেকে ফেরার সময়। তবে কী জুনায়েদ ফিরল? দৌড়ে গিয়ে সদর দরজা খুলল সে। পরমুহূর্তে হতাশ হলো। ক্যাথি আর সুজান এসেছে। পিউ তাদেরকে কিচেনে নিয়ে গেল সরাসরি। ইলেক্ট্রিক কেটলি অন করে কফি মেকারে কফিবীন ঢালল। ক্যাথি পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
– জম্পেশ একটা প্ল্যান হয়েছে। ট্রুন যাচ্ছি আমরা। পরশুদিন শনিবার সকালে রওনা হব। রবিবার বিকেলে ব্যাক করব। লজ বুকিং দিয়েছি। তুমিসহ আমরা মোট আটজন যাচ্ছি।
– আমি যাব না।
– কেন?
– ভালো লাগছে না।
– পিউ, নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন? দিনের পর দিন নিজেকে এভাবে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখার মানেটা কী? এই সেমিস্টারে হাতে গোণা কয়েকটা ক্লাস করেছ। এমনকি নিজের প্রয়োজনের জিনিসপত্র কিনতেও বের হও না তুমি। এমন করে লাইফ চলে না।
– আমার বাইরে যেতে ভালো লাগে না। তাই বাসায় থাকি। শপিং যা কিছু লাগে, সব অনলাইনে অর্ডার করি।
– এভাবে সারাদিন বাসায় শুয়েবসে থাকলে তো মানসিকভাবে সিক হয়ে যাবে। ক্যাম্পাসে তো রেগুলার হও!
– আমি আর পড়ব না।
– মানে? পড়বে না কেন?
– এমনিই। ভালো লাগে না পড়তে।
পিউয়ের চেহারা দেখেই সুজান বুঝে গেল, কিছু একটা হয়েছে। পিউকে আজ অন্যদিকের তুলনায় বেশ আপসেট দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চোখ ফুলে আছে। গালে কান্নার শুকনো দাগ। এগিয়ে এসে পিউয়ের কাঁধে হাত রাখল সে। শান্ত সুরে বলল,
– কি হয়েছে পিউ?
পিউ মুখ ঘুরিয়ে বলল,
– কিছু হয়নি।
– লুকাচ্ছ কেন? আমরা তোমার ফ্রেন্ড। কিছু হলে শেয়ার করো। ভালো লাগবে।
– নাহ, তেমন কিছু না।
– আমার মনে হয় কী জান, তোমার উচিত বাংলাদেশে তোমার বাবামায়ের সাথে যোগাযোগ করা। এখন তো তোমার হাজব্যান্ড নেই। তাই তাদের সাথে যোগাযোগ করায় মানা নেই। তুমি ফোনে কথা বলো। সামনে ক্রিসমাসের ছুটি আছে। তখন ঘুরে আসো বাংলাদেশ থেকে। ভালো লাগবে তোমার। একাকী থাকতে গিয়ে বোরড হয়ে গেছ তুমি। ইউ নিড অ্যা রিফ্রেশমেন্ট উইথ সাম ওয়ার্ম কম্পানি। ইউ নিড ইউর প্যারেন্টস!
– আই নিড জুনায়েদ! পারলে ওকে খুঁজে বের করতে হেল্প করো আমাকে।
প্রায় নিঃশব্দে বাজ পড়ল রান্নাঘরে। ক্যাথি আর সুজান দুজনই হতভম্ব। পিউয়ের কাছ থেকে এমন কথা তারা কোনোভাবেই আশা করেনি। পিউ আবারও বলল,
– জুনায়েদ আজ সেমিস্টার ফি পাঠিয়েছে। ওকে জানানো দরকার যে…
ক্যাথি বলল,
– বি কেয়ারফুল, পিউ। লইয়ার কিন্তু বলেছিল, তোমার হাজব্যান্ড এই ডিভোর্স ক্যানসেল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আমার মনে হয়, যেহেতু সে তোমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছে না, সেহেতু সেমিস্টার ফি পাঠাচ্ছে যাতে করে তুমি নিজেই তার সাথে যোগাযোগ করো।
– আই ডোন্ট থিংক সো!
সুজান বলল,
– সেমিস্টার ফি পাঠিয়েছে, বেশ ভালো কথা। ওটা তোমার অ্যাকাউন্টে রেখে দাও।
– জুনায়েদ আমার সেমিস্টার ফি দিতে বাধ্য না। ভরণপোষণ বাবদ ওর স্যালারির অর্ধেকটা পাচ্ছি। সেটা দিয়েই আমার চলতে হবে ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত। সেমিস্টার ফি দেবার দায়িত্ব ওর না, আমার নিজের। এই বাড়ির কিস্তি, গাড়ির ইন্স্যুরেন্স, রোড ট্যাক্স সবকিছু সে আপডেট করে দিচ্ছে। এগুলোও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
– যদি তার সামর্থ্য থাকে, তাহলে তোমার অসুবিধে কোথায়? হি ইজ নট অ্যা লিটল বেবি!
– ওর সামর্থ্য নেই বলেই আমি এতটা কনসার্নড।
– তাহলে সেমিস্টার ফি দিল কীভাবে?
– জানি না। আমার জানামতে, তার স্যালারির অর্ধেকটা থেকে আমাকে সেমিস্টার ফি দেবার পর তার কাছে খুবই অল্প কিছু পাউন্ড থাকার কথা, যেটা দিয়ে কোনোরকমে চলতে পারা যায়। দ্যাট মিনস, বাড়ির কিস্তি আর বাকিসব পেমেন্ট সে করতে পারবে না। নো প্রবলেম, আমি নাহয় পেমেন্ট করব। কিন্তু আমাকে তো বুঝিয়ে দিতে হবে কীভাবে, কোথায়, কত পাউন্ড পে করতে হয়। আমি কখনো এসব করিনি।
ক্যাথি হতাশ সুরে বলল,
– আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কেন তোমার হাজব্যান্ডের হ্যাডেক নিজের মাথায় তুলে নিচ্ছ। তার সামর্থ্য না থাকলে সে নিশ্চয়ই এগুলো পে করতে পারত না। সেমিস্টার ফি পাঠিয়েছে, এজন্য তুমি এখন তার সাথে যোগাযোগ করতে চাচ্ছ, এটা আমার কাছে জাস্ট ননসেন্স মনে হচ্ছে।
– আরো কিছু ব্যাপার আছে।
– কী?
– তুমি অতটা বুঝবে না। তবু বলি। ওকে এভাবে পথের ফকির বানাবার কোনো ইনটেনশন ছিল না আমার। এখনো নেই। আমি জাস্ট ডিভোর্সটা চেয়েছিলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিল, কোনো একটা কারণে আমাকে সে সহ্য করতে পারছে না। ও আমাকে এই দেশে নিয়ে আসতে চায়নি। এখানে আসার আগেই আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। আমি জোরজবরদস্তি করে তাতে ভেটো দিয়েছি। ওকে ব্ল্যাকমেইল করেছি, যাতে করে আমাকে সাথে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
– কিন্তু কেন?
– কারণ, আমি ওকে ভালোবাসি।
– কেন ভালোবাস, পিউ? এই লোকটা তোমাকে সবসময় টর্চার করে। তোমাকে একরকম বন্দি করে রাখে। কারো সাথে মিশতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। সে তোমাকে যেভাবে কব্জা করে রাখে, সেটা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ না। তারপরেও তুমি তাকে ভালবাস কেন?
– আছে, অনেক কাহিনী আছে আমার লাইফে। এতটা বলতে ইচ্ছে করছে না। এখন শুধু এটাই বলতে পারি যে, আমার লাইফের সবথেকে খারাপ সময়ে ও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর কেউ আসেনি আমাকে উদ্ধার করতে। আমার লাইফে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। লাইফটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আমি নতুন করে লাইফ শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা-মা বা ফ্যামিলির অন্য কেউ আমাকে সাপোর্ট করেনি। এমন নয় যে, আমাকে সাপোর্ট করার সামর্থ্য নেই তাদের। আমি বাংলাদেশে একটা রিচ ফ্যামিলির মেয়ে। লাক্সারিয়াস স্টাইলে বড় হয়েছি। একমাত্র মেয়েকে সাপোর্ট দেয়া তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু…
– কিন্তু কী?
– বাদ দাও। আর ভালো লাগছে না বলতে। জাস্ট এতটুকু শুনে রাখ, এই ভালোবাসা সে ডিজার্ভ করে। চাইলে আমাকে সে রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে পারত। কিন্তু সে ওসব কিছু করেনি। উলটো আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। আজ আমার এই সাজানো গোছানো লাইফ দেখতে পাচ্ছ, আমি ভালো রেজাল্ট করি, তোমার সবাই বলো, আমি লাইফে অনেকদূর যেতে পারব। এসবের ক্রেডিট জুনায়েদের। সে আমার লাইফটা আবার নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে। এই নতুন লাইফে ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কেউ না!
– নিজেকে শক্ত করো, পিউ। এই দুনিয়াতে অনেক মানুষ আছে, যাদের কেউ নেই। তারপরেও তারা বেঁচে আছে। নতুন করে জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। তোমাকেও তাই করতে হবে। একবার মন থেকে চেষ্টা করো। ভুলতে চেষ্টা করো জুনায়েদকে। তার সাথে লাইফ কাটানো মানে নিজেকে শেষ করে দেয়া, এটা জানার পরেও তুমি চাচ্ছ তার সাথে থাকতে! স্ট্রেঞ্জ!
– দেয়ারস নাথিং টু বি স্ট্রেঞ্জ। আমি ওর ভেতরের আসল ভালোবাসাটা ফিল করতে পারি। আমি জানি, তার লাইফে শুধুমাত্র আমিই আছি। আর আমাকে সে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। অ্যান্ড আই ক্যান বেট, দুনিয়ার অন্য কোথাও এই ভালোবাসা পাব না আমি। ওর সাথে ডিভোর্স হলে হয়তো অন্য কেউ আসবে আমার লাইফে। সে হয়তো আমাকে অনেক ভালোবাসবে। কিন্তু ওর মতো করে কখনো ভালোবাসতে পারবে না।
– ফাইন! কিন্তু আমাকে বলো, এভাবে টানাহেঁচড়া করে এই রিলেশনটা কতদূর নিতে পারবে তুমি? বিশেষ করে তার দিক থেকে যখন কোনো চেষ্টাই নেই এই রিলেশনটাকে প্যাম্পার করার। উলটো তোমাকে টর্চার করছে। আর তুমিও বেহায়ার মতো ঝুলে আছ তার লাইফে।
– এখন তো আর ঝুলছি না। একটা তুচ্ছ কারণে বিশাল ঝামেলা বাধল। কী থেকে কী হয়ে গেল আর এই সুযোগে সে দূরে সরে গেছে। কোথায় গেছে কে জানে। আমি কোনোভাবেই ওকে ট্রেস করতে পারছি না। আবার ওকে ছাড়াও থাকতে পারছি না।
– এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না, পিউ। শক্ত হও।
– গত নয় মাসে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, ওর কাছ থেকে আলাদা হলে আমি কোনোভাবেই সারভাইভ করতে পারব না। বেঁচে থাকার জন্য হলেও ওকে আমার দরকার। আই নিড হিম ব্যাডলি।
– ভুল। বেঁচে থাকতে হলে যে সাপোর্ট দরকার হয়, সেটা তোমার অলরেডি আছে। তুমি শুধু মেন্টালি স্ট্রং হও।
– সাপোর্টও তো ওরই দেয়া।ওর নিজের স্যালারি থেকে একটু একটু করে জমানো পাউন্ড, বাড়ি, সংসার সব আমাকে দিয়ে চলে গেছে। তারপরেও তো সারভাইভ করতে পারছি না…
– পিউ, তুমি যা বলছ, বুঝেশুনে বলছ তো? আমার তো মনে হয়, তুমি নিজেও জান না কী বলছ। মার্ক মাই ওয়ার্ডস, জুনায়েদ তোমাকে টর্চার করতে করতে একদিন মেরেই ফেলবে। না মারলেও এমন অবস্থা করবে তোমার, তুমি নিজেই সুইসাইড করে বসবে। তার সাথে তুমি একটুও সেফ না!
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল পিউ। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলল,
– প্লিজ, আর কিছু বলো না। আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। জাস্ট জুনায়েদের সাথে কথা বলতে চাই একটুখানি। একবার দেখা করতে চাই।
ক্যাথি জড়িয়ে ধরল ওকে। বলল,
– কান্না থামাও, পিউ। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।
সুজানও জড়িয়ে ধরল ওকে। কিছুক্ষণ পর পিউ শান্ত হলে শান্ত সুরে বলল,
– তুমি সত্যিই জুনায়েদকে অনেক ভালোবাস। আফসোস এটাই, জুনায়েদ তোমার ভালোবাসাটা কখনো মুল্যায়ন করেনি। তোমাকে সে কখনো বুঝতে চায়নি, বোঝার চেষ্টাও করেনি।আমার সন্দেহ লাগে, সে কখনো তোমাকে মন থেকে একটু ভালোবাসেওনি। তুমি হয়তো তার কাছে শুধুমাত্র একটা প্রয়োজন, একটা অভ্যাস। আর কিছু না। এটা ভালোভাবে জেনেবুঝেও তুমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাস। জুনায়েদ যদি একবার বুঝত, কী পেয়েছে সে লাইফে! (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here