#অতঃপর_সন্ধি (২৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
পুষ্পিতা থমকালো,চামকালো। চেনা জানা অনুভূতিগুলো আবারও কড়া নাড়ল হৃদয়ের দোরগোড়ায়। শরীর অসাড় আর নিস্তেজ হয়ে এলো। শরীর আর মন জুড়ে বয়ে গেলো শীতলতা, প্রশান্তি। আগে এই মুখে এই কথাটা শুনলে মেজাজ খারাপ হতো। আর এখন মিষ্টি একটা অনুভূতি। দপদপ করে অন্তঃস্থলে জ্বলতে থাকা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান উবে গেলো মুহুর্তেই। কিন্তু তানজিফ কে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।আগে মিশে থাকুক মানুষটার সাথে। লেপ্টে যাক দেহ।
পুষ্পিতা মুখটা হাতের আঁজলায় নিলো তানজিফ। অপরাধীর স্বরে বলল,
‘স্যরি।’
তানজিফের হাতের বাঁধন না থাকায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে। হতভম্ব হয়ে গেলো সে। চোখ জুড়ে বিস্ময়করতা।
‘একদম আহ্লাদ দেখানোর চেষ্টা করবি না। তোকে আর তোর স্পর্শ আমি নিতে পারছি না।’
হতবিহ্বল চোখে নিমেষহীন চেয়ে রইলো তানজিফ
খাটে পা ঝুলিয়ে বসল পুষ্পিতা। উদাসীন, নির্লিপ্ত চোখে চাইলো তানজিফের হতভম্ব মুখের দিকে।
‘আমি কেঁদেছি বলে ধরে নিলি এখনো মায়ানকে চাই? অদ্ভুত না ব্যপারটা? আমি তোর জন্য সাজলাম, তোর প্রথম উপার্জনে কেনায় শাড়িটা আমার গায়ে জড়ালাম। তোর পছন্দের পায়েস রান্নার জন্য তোড়জোড় করলাম। সেগুলো তোর চোখে পড়লো না। তোর চোখে পড়েছে আমি কেঁদেছি।’
উবে যাওয়া রাগটা আবারও প্রজ্বলিত হলো পুষ্পিতার সর্বাঙ্গে।
‘মানুষ যখন অত্যোধিক কষ্ট পায় তখন কাঁদে। আবার যখন খুব খুশি হয় তখনো কাঁদে। ভুল করার পর যখন বুঝতে পারে তখনও কাঁদে। পানি চোখ দিয়েই আসে। তবে কারণ ভিন্ন। প্রেক্ষাপট ভিন্ন। হ্যা আমি কেঁদেছি। একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম বলে কেঁদেছি। জীবনের মূল্যবান সময় গুলো তাকে দিয়েছিলাম বলে কেঁদেছি। সে আমার ভালোবাসার মর্ম বুঝেনি। অনুভূতির মর্যাদা দেয়নি।’
আগুন লাল চোখে তানজিফের দিকে নেত্রপাত করল। রাগে, জেদে দাঁতে দাঁত পিষে।
‘আমাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার তুই কে? কে দিয়েছে তোকে সেই অধিকার? মায়ানকে বিয়ে করার হলে ওকেই করতাম। তোর কাছে যেতাম না একটু ভালোবাসার লোভে।’
তানজিফ পুষ্পিতার পায়ের কাছে এসে বসল। পুষ্পিতার হাত দু’টো আঁজলিতে নিলো।
‘আচ্ছা বললাম তো আমার ভুল হয়েছে।’
তানজিফের হাত দু’টো ঝাড়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।
‘বড্ড শখ তো বউকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার। মায়ানের বন্ধু আতিকের নাম্বারটা আমার ফোনে সেইভ করা আছে। আমি এখনই উনাকে ফোন করবো। মায়ানের সাথে কানেক্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি ফিরবো মায়ানের কাছে। শত অপমান করলেও।’
পাগলপ্রায় হয়ে বালিশের তল হাতরে মোবাইল খুঁজে বের করলো। সুইচঅফ করে রাখা মোবাইল অন করলো। কল লগস গিয়ে আতিকের নামটা সার্চ অপশনে লিখার আগেই ছু মে’রে মোবাইল নিয়ে গেলো তানজিফ। গায়ের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে মা’রে বা পাশের দেয়ালে। মোবাইল দ্বিখণ্ডিত না হলেও ফ্রন্ট গ্লাসের অবস্থা নাজেহাল। অক্ষি যুগল বড় হয়ে গেলো পুষ্পিতার। নাক ফুলিয়ে,আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলার আগেই পুষ্পিতার দু’হাতের বাহু চেপে ধরে তানজিফ। খুব শক্ত করে। এতটা চাপ সহ্য করতে না পেরে মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো পুষ্পিতা। ব্যথায় ঘোলাটে হলো চোখ। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তানজিফের।
‘সব সময় নিজের দিকটাই ভেবে গেলি। নিজের রাগ নিজের জেদ সবকিছুর উর্ধে তোর। মানে মন যখন যা বলে তাই করিস। অপর পাশের মানুষটা সহ্য করতে পারবে কি না তা ভাবিস না। রাগ জেদ তোর একাই আছে আমার নেই? তোর চোখে আমি ছ্যাছড়া, বিরক্তিকর একটা মানুষ। কিন্তু আমার কাছে তুই আমার ভালোবাসার মানুষ। আমার সবকিছু। আদরে মুড়িয়ে রাখার মানুষ। আমার উপস্থিতি তোর বিরক্ত লাগতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তোর উপস্থিতি বক্ষঃস্থলে প্রশান্তির ঢেউ বইয়ে দেয়। রাগটা মানুষ সবার সামনে জাহির করে না। তুই বলেছিস তোকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করার জন্য। করেছি তো। সবার চোখে বেহায়া হয়েছি। নির্লজ্জ হয়েছি। ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। কারণ আমি তোকে পেয়েছি। তোর কাছে এইসব কিছু ফিকে। তোর উপর আমার পূর্ণ অধিকার থাকার পরও কোনো রাতে নিজের অধিকার চাইনি। আমি সর্বদা চেয়েছি তুই নিজ থেকে আমায় কাছে ডাক। নিজের ভালোবাসার চাদরে আমায় জড়িয়ে নে। বিবাহিত জীবনের একটা বছর চলে গেলো। তোর হাতে তোর প্রাক্তনের উপহার চোখে পানি। আমি কি ভাববো? আমার কি ভাবা উচিৎ? ওই সময় আমার যা মনে হয়েছে তাই করেছি। হয়তো আমি ভুল ছিলাম। তুই অভিমান করলি। অভিমান ভাঙাতে এলাম। কেন আমার মেজাজটা বিগড়ে দিচ্ছিস?’
বিরতিহীন কথাগুলো বলে থামল তানজিফ। চোখেমুখে রাগ ভাসমান। রাগে নিজের চুল টেনে ধরলো সে। পুনরায় বলল,
‘একটা বার আমার জায়গায় নিজেকে বসা। আমার পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবি। তুই আমাকে ভালোবাসিস না। আমি জানি। এরপরও যদি আমি তোকে বলি আমি অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিবো। তুই সহ্য করতে পারবি না। হাসির ছলে বললেও না। স্বামী স্ত্রীর ব্যপারটাই এমন। পরিপূরকের পাশে কাউকে সহ্য হয় না। সবকিছুর ভাগ হয়। শুধু ভাগ হয় না জীবনসঙ্গিনীর।’
তানজিফের রাগে র’ক্তি’ম হওয়া মুখপানে চেয়ে রইলো পুষ্পিতা। অপলক, অনিমেষ। বাহুর ব্যথার কথাও ভুলে গেলো।
‘আমার চোখের দিকে শেষ কবে তাকিয়েছিলি, মনে আছে?’
পুষ্পিতার তৃষ্ণার্ত, কাতর নেত্র যুগলের দিকে চাইলো তানজিফ। পুষ্পিতা আবারও বলল,
‘বিয়ের পর কখনো আমার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করেছিস?’
বলে ফিচেল হাসলো।
‘না তুই আর না মায়ান। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসেনি। আমি একজনের চোখের মোহ। আরেকজনের মনের মোহ। মোহ কে’টে যায়।’
সহসা তানজিফের শার্টের কলার চেপে ধরে সে। দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে বলল,
‘তোকে কেউ নিজের অধিকার ছেড়ে দিতে বলেছে? সামনে আসবি না আমার। একদম সামনে আসবি না। মোহ হয়ে থাকার চেয়ে দূরে চলে যাওয়া ঢের ভালো। বের হ আমার রুম থেকে।’
_____________________
পুষ্পিতা এইবাসায় আছে আজ চারদিন হলো। তানজিফ সেই যে গেলো আর একটা ফোনও করেনি। আর না খোঁজ নিয়েছে পুষ্পিতা। আফসানা হক মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেন না। তারপরও প্রশ্ন করে বসলেন,
‘তানজিফ কল করেছিলো?’
‘আমার মোবাইল ভাঙা।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পুষ্পিতা।
‘আমার মোবাইল থেকে কল করতি।’
‘আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি।’
দাঁত কিড়মিড় করে মেয়ের দিকে চাইলেন আফসানা হক।
‘তোর শ্বশুর আজ ফোন করেছিলেন।তোর সাথে নাকি কথা বলবে।’ আশহাব শেখের কথায় চমকে উঠে পুষ্পিতা।
‘সময় হলে কথা বলবো।’ বলেই নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।’
সন্ধ্যায় পুষ্পিতার রুমের জানালা আটকানো হয়নি। জানালা আটকানোর জন্য জানালার ধারে যেতেই দৃষ্টি সূঁচালো হলো তার। বাইরে পরিচিত অবয়ব। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পর্দার আড়ালে দাঁড়াল সে। অয়বয় একবার উপরের দিকে তাকায়।।আরো একটু চেপে দাঁড়াল পুষ্পিতা।
‘আমার প্রণয়ের দহনে পুড়িয়ে তোকে একেবারে ভস্ম করে দিবো।’
__________________
সাতসকালে পুষ্পিতাকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন আফসানা হক। পুষ্পিতা আবারও ধপাস করে শুয়ে পড়লো। ঘুমে চোখ জোড়া নিভু করছে। তানজিফ যতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো পুষ্পিতাও ততক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে তানজিফকে দেখছিলো।
‘পুষ্পিতা সুমনা এসেছে সেই কখন। তোকে এমন ঘুমোতে দেখলে কি ভাববে।’
পুষ্পিতা ঘুমো ঘুমো গলায় বলল,
‘মামনি কিচ্ছু ভাববে না। জানে আমি ঘুমকাতুরে মানুষ।’
দৈবাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ পিটপিটিয়ে তাকাল সে। একগাল হেসে সুমনা এহমাদের কোলে মাথা গুঁজল।
‘মেয়েদের এতো বেলা অব্দি ঘুমোতে হয় না।’
‘তোমার ছেলেটা আমাকে বড্ড জ্বালায় মামনি।’ বিড়বিড় করে বলল পুষ্পিতা। কথাগুলো সুমনা এহমাদের কান অব্দি এলো না।
‘নিজের সংসার ফেলে অনেক বেড়ানো হয়েছে বাপের বাড়ি। এখন চল আমি নিতে এসেছি।’
‘যাবো তো ও বাড়ি। আগে তোমাকে আর বাবাকে হানিমুনে পাঠাই। তারপর আমিও তোমার ছেলের সঙ্গে হানিমুন করবো।’
নিদ্রা উবে গেলো পুষ্পিতার। ঘুমের ঘোরে মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেও জানে না। জিভে কামড় দিয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল সে।
#অতঃপর_সন্ধি (২৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
বিগত দিনগুলোর ন্যায় আজও পুষ্পিতাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। একটু বাদে বাদে মশা মা’রছে।পর্দার আড়াল থেকে তানজিফকে পর্যবেক্ষণ করছে পুষ্পিতা। নিজের মোবাইলের কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘মা তোমার মোবাইল দাও তো।’
‘মোবাইল দিয়ে কি করবি?’
‘আহা! দাও না কাজ আছে।’
‘চাইছে দিয়ে দাও। এতো কথার কি আছে?’ চশমা ঠিক করে বললেন আশহাব শেখ।
‘আজ সুমনার সাথে ফিরে গেলি না কেন?’ দাঁত কিড়মিড় করে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন আফসানা হক।
বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে পুষ্পিতা।
‘তুমি মা বেশি কথা বলো। বলেছি না আমাদের ব্যপার নিয়ে চিন্তা করবে না। মামনিকে যা বলার আমি বলেছি। তুমি এবার একটু প্রেশারটা কম নাও।’
চোখ গরম করে চাইলেন তিনি।
‘হ্যা, এখন আমি বেশি কথা বলি,,,,,,,,’
পুষ্পিতা মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বিছানার উপর থেকে মোবাইল নিয়ে সুর সুর করে চলে এলো। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণই কথা শুনাবেন তিনি।
______________
রিং হতেই পকেট হতে মোবাইল বের করে তানজিফ। স্ক্রিনে শ্বাশুড়ির নাম ভাসতেই শির উঁচিয়ে উপরের দিকে তাকায়।
থমথমে মুখে, চাহনি সূঁচালো করে কানে মোবাইল ঠেকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। বিস্তর হাসলো সে। প্রফুল্ল মনে কল রিসিভ করলো।
‘বখাটেদের মতো আমার বাসার নিচে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
ভড়কে গেলো তানজিফ। চোয়াল ঝুলে গেলো তার।
‘আমি বখাটে?’
‘একটা অবিবাহিত মেয়ের বাসার দাঁড়িয়ে আছিস। তো কি বলবো?’
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো তানজিফের।
‘তুই অবিবাহিত?’
‘অবশ্যই, কোনো সন্দেহ আছে?’ বলেই গা জ্বালানি হাসি দিলো সে।
নিচ থেকে পুষ্পিতার হাসি বুঝা না গেলেও তানজিফ বুঝতে পারলো তাকে জ্বালিয়ে মজা পাচ্ছে পুষ্পিতা।
‘এই বিল্ডিংয়ে নিশ্চয়ই শুধু একা তোরাই থাকিস না। আরো ভাড়াটিয়া থাকে। ছয় তলায় একটা মেয়ে থাকে। সম্ভবত কলেজে পড়ে। কি মিষ্টি দেখতে। দেখলেই ইচ্ছে করে,,,,’
মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো পুষ্পিতার। রাগ ভর করে চেহেরায় রাগে ফুঁসতে লাগে সে। ক্রূর হাসলো তানজিফ। আড়মোড়া ভেঙে পুনরায় বলল,
‘আসলে বউ বলেছে, আমার চোখে যার রূপ আটকেছে। আমার মনে যে আছে তার কাছে চলে যেতে। তাই বউয়ের কথা রাখতে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। উফ! মেয়েটা কি যে সুন্দর।’
রাগে জানালার পর্দা চেপে ধরলো পুষ্পিতা। রেগে ফুস ফুস করতে থাকা সেই আধান তার কর্ণে এসে ঠেকল। আরো রাগাতে আবারও তানজিফ বলল,
‘মেয়েটা একটু বাদে বাদে বারান্দায় এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি ওর অপেক্ষায় আছি।’
তিনতলার জানালা দিয়ে মাথা কাত করে ছয় তলায় দেখার বৃথা চেষ্টা করলো পুষ্পিতা। জানালার গ্রিল বাদে কিছুই দেখা গেলো না।
নিচ থেকে এমন দৃশ্য দেখে মুখ টিপে হাসলো তানজিফ।
‘পরশুদিন চলে যাবো ভেবেছিলাম। আর যাবো না। তোর শাস্তি আরো বাড়লো।’
খট করে মোবাইল কেটে গজগজ করতে করতে মায়ের রুমের দিকে গেল।
মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়েছেন আশহাব শেখ। কিন্তু রুমে আফসানা হক নেই। হয়তো ওয়াশরুমে। বালিশের উপর মোবাইল রেখে ফিরে এলো নিজের রুমে।
আবারও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তানজিফকে দেখলো। নাক ফুলিয়ে পর্দা টেনে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো সে।
____________________
সকালে ডিম ভাজতে গিয়ে আফসানা হক খেয়াল করলেন ফ্রিজে ডিম নেই। পরিচিত মুদিওয়ালাকে কল করতে গিয়ে ভুল করে মেসেজ অপশনটায় ক্লিক করে ফেললেন। একদম উপরে তানজিফের নাম্বার দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। মেসেজ আন সীন।
‘আমি উপরে আসি? মেইন দরজাটা,,,,,,,,’
অর্ধ সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ে কৌতূহল বাড়লো উনার। ইনবক্সে গেলেন তিনি। উপরের মেসেজ গুলো পড়ে থতমত খেয়ে গেলেন। অস্বস্তি বাড়লো উনার। ত্বরিত গতিতে মেসেজ অপশন থেকে বেরিয়ে এলেন।
পেঁয়াজ কুচো করছেন আফসানা হক। মেয়ের প্রতি রাগের মাত্রা তরতর করে বাড়ছে। এমন খামখেয়ালিপনা মোটেও উনার পছন্দ না। মেয়ের এমন করাটা মোটেও ভালো লাগছে না। সবকিছু নিয়ে মজা সাঝে না।
‘মা? বাবা কি কলেজে চলে গিয়েছে?’ হাই তুলতে তুলতে বলল পুষ্পিতা।
‘কাল রাতে তানজিফ এসেছিলো?’
আমতা আমতা করতে লাগলো পুষ্পিতা।
‘তোর কি সবকিছু ছেলেখেলা মনে হয়? খেলনাবাটি খেলতে বসেছিস? ছেলেটাকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিস কেন? যেদিন মুখ ফিরিয়ে নিবে সারাজীবনের জন্য সেদিন বুঝবি।’
‘শক্ত বাঁধনে বাধছি। যেন মুখ ফিরিয়ে না নিতে পারে।’
‘বাঁধন যত শক্ত করবি ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবনতা তত বেশি থাকবে। বাঁধন বেশি টাইট করতে নেই। একটু ঢিলে রাখতে হয়।’
মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে পুষ্পিতা।
‘চিন্তা করো না মা। যখন দেখবো দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার পথে তখন ঢিলে করে দেবো।’
_____________________
সতেরো দিন পর!
তিতিরকে পুষ্পিতাদের বাসায় দিতে এসেছেন সুমনা এহমাদ। দরজার বাইরে থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পুষ্পিতা বলে উঠলো,
‘মামনি বাড়ির চাবি?’
‘ইশ মনেই ছিলো না।’ বলে তাড়াতাড়ি করে পার্স থেকে চাবির গোছাটা দিল পুষ্পিতার হাতে। দাড়াঁলেন না আর দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলেন। হাসলো পুষ্পিতা।
নিচে নেমেই গাড়িতে উঠে তাজওয়ার নওশাদের এর পাশে বসলেন।
‘তোমার ছেলের বউ যে কি করে না। এই বুড়ো বয়সে এসব সাঝে?’
তাজওয়ার নওশাদের কথায় হাসলেন সুমনা এহমাদ।
‘প্রথমে যখন বলেছিলো এমনটা করবে তখন আমারও খুব অস্বস্তি হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে বেশ ভালো হয়েছে। কতগুলো দিন চলে গেলো তোমার সাথে একান্তে বসে আকাশ দেখা হয় না। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। বয়স বাড়ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদা গুলো কেমন তলিয়ে যাচ্ছে পড়ে যাচ্ছে বয়সের চাপে।’
‘আমাদের সাথে উনারা আসলেও ভালো হতো।’
‘আফসানাদেরও পাঠানোর প্লানিং ছিলো। কিন্তু আশহাব ভাইয়ের ছুটি নেই।’
____________________
রাত ন’টা কি সাড়ে ন’টা। সেজেগুজে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো পুষ্পিতা।
টিভিতে কার্টুন দেখছে তিতির। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে ডাকলেন আফসানা হক। সবাই উপস্থিত হলেও পুষ্পিতা কে না দেখে বকতে বকতে রুমের দিকে গেলেন। গিয়ে দেখলেন দেয়ালে চিরকুট আটকানো।
‘আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি তানজিফের সাথে আছি। আজকে রাতে তুমি তিতিরের সাথে আমার রুমে থেকো।’
মেয়ের এমন পাগলামি দেখে হাসলেন আফসানা হক। হাসতে হাসতে প্রস্থান করলেন রুম থেকে।
তালা খুলে মাত্রই বাড়িতে ঢুকলো তানজিফ। তিমিরে আচ্ছাদিত পুরো বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই বলে আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরেছে। দিনকে দিন ব্যবসা বাড়ছে। সাথে কাজের প্রেশারও। বড্ড ক্লান্ত সে। পুষ্পিতাকে এক নজর দেখার জন্য মন আর চোখ কাতর হয়ে আছে। কিন্তু পুষ্পিতাদের বাসায় যাওয়ার জন্য শরীরে কুলচ্ছে না৷ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াল।
রুমের দরজার কাছে আসতেই ফুলের মিষ্টি সুভাস নাকে এসে ঠেকল তানজিফের। ব্যপারটাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না সে। কিন্তু লাইট অন করে চক্ষু চরাক গাছ তার। রুমের প্রতিটা কোণা ফুলে ফুলে সজ্জিত। খাটটাও সুন্দর করে সাজানো। যেন একটু পরেই নবদম্পতি প্রবেশ করবে। মনের ভ্রম ভাবলো তানজিফ। চোখ কঁচলে পুনরায় সামনে চাইলো। না সে ঠিক দেখছে। কিন্তু কে সাজাবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
হাততালির শব্দে ঘোর কাটে তানজিফের। পিছনে পুষ্পিতাকে দেখে কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো। যদি বিশ্বাস হচ্ছে না পুষ্পিতা এসেছে।
‘বাহ্! বাহ্! আমিও বাসায় নেই। মামনি বাবাই ও বাসায় নেই সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালি? কয়েকটা দিন তোর চোখের সামনে ছিলাম না বলে তুই অন্য কারো সাথে,,,,,,,?’
বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
হতভম্ব হয়ে গেলো তানজিফ। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতার দিকে। পুষ্পিতার কথাগুলো যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো তার।
‘কোথায়, কোথায় সেই মেয়ে? নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে? ভাগ্যিস এসেছিলাম না হলে তো জানতেই পারতাম না এসব কিছু।’
বলেই দৌড়ে চলে গেলো। কথা বলার সুযোগ টুকু পেলো না তানজিফ। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সেও ছুটলো পুষ্পিতার পিছু। পুষ্পিতাকে সিঁড়ির দিকে ছুটতে দেখে অজানা আতংক বাসা বাঁধে মনে। শরীরের সকল ক্লান্তি যেন উবে গেলো।
ছাদে উঠে হাঁপাতে লাগলো সে। পুষ্পিতা রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
‘পুষ্পিতা স্টপ দেয়ার। আর এক পা ও এগোবি না।’
আরো একটা কদম বাড়ায় পুষ্পিতা। তানজিফ তড়িঘড়ি করে বলল,
‘আরে আমি জানি না এসব কে সাজিয়েছে। আমি সেই সকালে বেরিয়েছি আর মাত্র বাসায় এলাম। ভীষণ ক্লান্ত আমি। আমার চোখ নিভু নিভু করছে সিরিয়াস ব্যপার নিয়ে পাগলামি করবি না প্লিজ।’
বেঁধে রাখা চুলগুলো ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। রাতের নিস্তব্ধ হাওয়ায় এলোমেলো উড়ছে সেগুলো। অদ্ভুত আচরণে কপাল কুঁচকে গেলো তানজিফের। পুষ্পিতা রেলিঙে হাত রেখে।নম্র স্বরে বলল।
‘কুড বি আস তানজিফ? উইল বি মাইন ফরএভার?’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।