#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩৫
#তাশরিন_মোহেরা
আন্টির কথাটা যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সারা মুখ জুড়ে বিরাজ করছে বিস্ময়! চোখ দুটোও হঠাৎ ছলছল করে উঠলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মুখরের দিকে চেয়ে আছি। সে আমাকে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘সব ঠিক আছে তো, মিস.তিথিয়া? কি হলো? কথা বলছেন না কেন?’
আমি কাঁপা কণ্ঠে আন্টিকে জানালাম,
‘আ-আমি এখনি আসছি, আন্টি!’
ফোনটা ব্যাগে পুরে উত্তেজনায় মুখরের হাত দুটো চেপে ধরলাম শক্ত করে। আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নামাখা কণ্ঠে বললাম,
‘আব্বা, আব্বার জ্ঞান ফিরেছে, মুখর সাহেব!’
মুখরের হাত দুটো ধরে আলতো লাফাচ্ছি! উত্তেজনায় এখনি আকাশে মুক্ত পাখির মতো বিচরণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার! আব্বা, আমার আব্বা কোমা থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি আমায় ছেড়ে যেতে পারেননি কোথাও! আব্বা, আমি আপনাকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
মুখরের হাতটা ধরে টেনে রাস্তায় নামলাম। মুখর কিছু বলছে না, তবে তার মুখটাও হাসিহাসি। সে বোধহয় আমার এই খুশি হওয়াটাকে উপভোগ করছে। করুক, পুরো বিশ্ব আমার এই আনন্দটা দেখুক! আকাশের চাঁদ আমি চাইনি, কিন্তু আব্বার আমার কাছে ফিরে আসাটা আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই মূল্যবান।
একটা রিকশা নিয়ে রওনা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। খুশিতে গদগদ হয়ে রিকশা ভ্রমণটা উপভোগ করছি। পাশাপাশি বসে আছে মুখর। অন্য সময় হলে এতোক্ষণে লজ্জায় আমার কবরে যেতে হতো! তবে আমার খুশিটা আজ সব অনুভূতিদেরই ছাড়িয়েছে। মুখর যথাসম্ভব দূরত্ব রেখে বসতে চাইছে, তবে পারছে না। রিকশার ঝাঁকুনিতে বারবার আমার বাহুর সাথে তার বাহুটা হালকা করে ঘষা খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরা দুজনেই ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠছি! অস্বস্তিটা কাটাতে মুখর নীরবতা ভেঙে বললো,
‘খুশি হলে কি আপনি সবসময় এমনই করেন, মিস.তিথিয়া?’
আমি তার কথাটা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম প্রশ্নাত্মক চোখে। সে তার চোখটা ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই যে এভাবে কখন থেকে আমার পায়ে পাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।’
আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিচের দিকে দেখলাম। অতি উত্তেজনায় অযথা পা নাড়ানোটা আমার পুরোনো অভ্যাস। আর এই অভ্যাসটায় বাজেভাবে ফেঁসেছে মুখর। পা নাড়াতে গিয়ে খেয়ালই করিনি আমার হাফ হিলের প্রতিটা আঘাত তার পায়ের উপর পড়ছে। বেচারা সইতে না পেরে এখন বলে দিয়েছে! কি বিচ্ছিরি রকমের লজ্জায় পড়লাম। ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুণি রিকশা থেকে লাফ মেরে রাস্তায় গড়াগড়ি খাই। লজ্জাটা কোনোমতে ঢেকে কিছুটা সরে বসলাম। ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম,
‘দুঃখিত!’
সেও আর কথা বাড়ালো না। মুচকি হেসেছে শুধু। রিকশা চলতে লাগলো। আর জনবহুল প্রকৃতিটা হিম বাতাসের দোলায় আবিষ্ট চোখে দেখতে লাগলাম আমি আর মুখর। এই ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় হাজারো মানুষের আনাগোনা। তন্মধ্যে কেউ খুব খুশি, আবার কেউ খুব বেজার কিংবা অনেকেই খুশি-বেজারের মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে। ফুটপাতের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে কিছু ঘরছাড়া ভবঘুরেদের। যারা এই হিমশীতল নগরীতে রাস্তার ধারে বসে আছে পাতলা এক চাদর গায়ে জড়িয়ে। এদের দেখে হঠাৎ মনটা কেঁদে উঠলো। শীতটা বোধহয় এদের উপর ভারী হয়ে পড়েছে বেশ!
রাস্তার প্রত্যেকটা দোকান গুনে গুনে এগোচ্ছি। মনে মনে চাইছি, রাস্তাটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হোক। আব্বার মুখখানা দেখার তর সইছে না আমার। আজ সকালে তাকে দেখতে না যাওয়াতে ইচ্ছেটা আরো ঝেঁকে বসেছে। এর মাঝে আচমকা রিকশাটা মোড় নিলো। হুট করে সরে গিয়ে মুখরের বুকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। আচমকা এমন হওয়াতে ঠিক বুঝে উঠলাম না কি হলো। যখনি বুঝেছি মাথাটা ঠিক মুখরের বুকের মাঝামাঝিতে আছে, তখনই তড়িৎ মাথাটা তুলে নিতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। মুখর হাত দিয়ে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো আলতো করে। আমি চুপ করে বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছি কি হচ্ছে! মুখর আবেশমাখা কণ্ঠে তখন বলে উঠলো,
‘আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকুন, মিস.তিথিয়া, প্লিজ!’
কথাটাতে কি যেন ছিল! মনে মনে যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন, তার এই কথাটা ফেলতে ইচ্ছে হলো না। তাই এমন করে খানিকক্ষণ বসে রইলাম। মুখরের বুকের ধুকপুকানি আমার কান ছুঁইছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ধ্বক ধ্বক করছে তার হৃদপিণ্ড। ছেলেটা নিজেও বেশ বিচলিত! নিজের বুকে হাত রেখে বুঝলাম আমারটা তার চাইতেও বেশি ধুকপুক করছে। এই অবস্থায় থাকাটা খুব বেশি উপকারী নয় আমার জন্য। না হয় আব্বাকে দেখার আগেই একটা বড়সড় হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবো আমি! তাই চট করে মাথাটা মুখরের বুক হতে নিয়ে সটান হয়ে বসে পড়ি। পা দুটো অসম্ভব রকমের কাঁপছে। কপালটাও ঘামছে ভীষণ। এই ঠান্ডায় ঘাম জমাটা স্বাভাবিক নয়। তাই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম।
মুখরও নড়েচড়ে বসে বললো,
‘অস্বস্তিতে ফেলার জন্য দুঃখিত, মিস.তিথিয়া। একটু আগে যা হয়েছে ভুলে যান।’
এই বলে সে রাস্তায় চোখ ঘুরালো। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ‘আপনি যতটা সহজে ভুলতে বলছেন, ভোলাটা কি আদৌও এতো সহজ, মুখর সাহেব?’
এর মাঝেই দেখলাম রিকশাটা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাড়াটা মিটিয়ে দৌঁড়ে উপরে আব্বার কেবিনের সামনে এলাম। সেখানে বসে আছে আন্টি এবং মুগ্ধ। আব্বা ছাড়া আমার তেমন আপন কেউ নেই। আব্বার কারণে মায়ের দিক থেকে সবাই সম্পর্ক বাদ দিয়েছিলো একসময়। আর আব্বার দিক থেকে কেউই আব্বাকে আপন চোখে দেখে না। এই মুহুর্তে আব্বার পর আমার একমাত্র কাছের মানুষ হলো মুখরের পরিবারের সবাই। এদের সাথে পরিচয় হওয়াতে আমি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সৃষ্টিকর্তার কাছে। এরা-ই আমাকে বুঝিয়েছে, রক্তের সম্পর্ক থাকাটা জরুরি নয়। কাউকে আপন করে নিতে হলে দরকার একটা উদার মন। যা পাওয়ার অধিকার সবার নেই!
আন্টি আমাকে আসতে দেখেই এগিয়ে এলেন আমার কাছে। আমি শক্ত হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরি আন্টিকে। আজ আমার দিনটাই ভালো করে দিলেন এই মানুষটা!
কেবিনে ঢুকে চুপিসারে আব্বার পাশে বসলাম। আব্বা শুয়ে আছেন চোখ জোড়া বন্ধ করে। আমি আলতো করে ডাকলাম,
‘আব্বা?’
প্রথমবার আব্বার মাঝে কোনোরকম হেলদোল দেখা দিলো না। আমি দ্বিতীয়বার ডাকলাম। পিটপিট করে চোখ খুললেন তিনি। নিভে যাওয়া চোখ দুটো দিয়ে দেখলেন আমায়। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা আনন্দের ক্রন্দন বেরুলো আমার। আব্বা দূর্বল হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে চাইলেন। আমি হাতখানা খপ করে ধরেই আমার গালে ঘষে নিলাম। আব্বা অতি ধীর কণ্ঠে আমাকে ডাকার চেষ্টা চালালেন,
‘তি-তিথি!’
আমি আব্বার আধাপাকা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আলতো কণ্ঠে বললাম,
‘এইতো আমি আছি, আব্বা। আর কোনো ভয় নেই। আপনি খুব তাড়াতাড়িই ভালো হয়ে উঠবেন।’
বুক ভেঙে কান্না পেয়ে গেল আমার। আব্বার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। মনের সকল বেদনারা যেন ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেছে। আব্বার শুকনো হাতখানা ভিজে গেছে আমার কান্নায়। খানিকক্ষণ কেঁদে আব্বার ভেজা হাতটা মুছে দিলাম। আব্বার গাল বেয়েও গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা অশ্রু। আমি তাও মুছে দিলাম আমার ওড়না দিয়ে।
আব্বার পাশে বসে দেখছি আর ভাবছি, আমার জীবনের মূল্যবান মানুষের মধ্যে আব্বা একজন। যদিও অন্যদের মতো কখনো আব্বাকে সুপারম্যানের কাতারে ফেলতে পারিনি। কেননা আমি জানতাম আব্বা আমাকে সর্বদা কষ্টে রাখেন। কিন্তু আব্বার মৃত্যুর সাথে লড়াই করার সময়টাতে টের পেয়েছি, আমার আব্বা আমার জন্যে সুপারম্যান। কেননা তিনি তার মেয়েকে একা রেখে বেশিদিন কোমায় থাকতে পারেননি। ফিরে এসেছেন আবারো আমার কাছে। তার তিথি মা এর কাছে ফিরে এসেছেন মৃত্যুর সাথে লড়ে। এর চাইতে বড় কিছু আমার জন্য আর কি হতে পারে?
আব্বার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে বললাম,
‘এখন থেকে আপনি আমার সুপারম্যান, আব্বা। আর কখনো যেতে দেবো না এই সুপারম্যানকে।’
.
আব্বার কোমা থেকে ফিরে আসার আজ একমাস পূর্ণ হলো। আব্বাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তাররা এটাকে একটা মিরাকেল বলে ঘোষণা করেছেন। কোমা থেকে এতো তাড়াতাড়ি ফেরাটা হাজারে একজন রোগীর ক্ষেত্রে হয়। আর তার মধ্যে আমার আব্বা একজন।
আব্বা প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আর এজন্যে আমিও মুখরের বাসা হতে নিজের বাসায় ফিরে এসেছি। নিজের রুম, নিজের বিছানা, নিজের ঘর, আহা! একেই বলে শান্তি! রান্নাঘরে গিয়ে আব্বার জন্য কড়া লিকারের রঙ চা বানালাম। আব্বা ইদানীং রঙ চা-কেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ট্রে নিয়ে চা টা আব্বার সামনে রেখে আসতেই কলিংবেল বাজলো। আব্বা আমার চোখের দিকে, আমি আব্বার চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। আব্বা বললেন,
‘ঐ মুখর ছেলেটা, তাই না?’
আমিও নিশ্চিত ছিলাম এই সময়ে মুখর ছাড়া আর কেউই আসতে পারে না। আমি ইতস্তত করে আব্বার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। আব্বা চায়ে চুমুক বসিয়ে বললেন,
‘যা, দরজা খুলে দিয়ে আয়।’
আমি দরজাটা খুলতেই দেখলাম মুখর হাত ভর্তি করে ফলমূল নিয়ে এসেছে। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে হাতে থাকা মস্ত কাঁঠালটা মেঝেতে রাখলো সে। অন্য হাতে আছে আনারস আর আম। আব্বা ফল খেতে পছন্দ করেন বলে মুখর এসব নিয়ে এসেছে। আব্বা সুস্থ হওয়ার পর থেকেই মুখর আব্বার পছন্দের এমন টুকটাক জিনিস নিয়ে আসছেই! একজন রোগীর জন্য মুখরের এমন দরদ দেখে হাসি পেয়ে গেল আমার।
ফলগুলো রেখেই মুখর টুপ করে ঢুকে পড়েছে আব্বার রুমে। আমি নাস্তা দেওয়ার জন্য রান্নাঘরে চলে এলাম। নাস্তা বানিয়ে খানিক বাদে আব্বার রুমে ঢুকতেই দেখলাম মুখর বসে আব্বার পা টিপছে। আমি অবাক হয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি করছেন, আব্বা? মুখর সাহেবকে দিয়ে পা টেপাচ্ছেন কেন আপনি? মানুষটা আপনাকে দেখতে এসেছে, আব্বা!’
আব্বা পেপারটা মুখের উপর ধরে বললেন,
‘সে নিজের ইচ্ছেতেই করছে। আমি কিছু বলিনি।’
আমি দ্বিগুণ অবাক হয়ে মুখরের দিকে দেখলাম। সে ইশারায় বলছে, তার কোনো সমস্যা নেই। আমি তাকে ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসি। সমস্যা না থাকুক, তাই বলে এভাবে আব্বার পা টেপা দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। নাস্তাটুকু খেয়েই মুখর তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। নিজের কাজ ফেলে ছেলেটা আব্বার সেবা করতে এসেছে! আমি আব্বার রুমে এসে তাকে ধমকে বললাম,
‘আপনি মুখরের সাথে এমন করছেন কেন, আব্বা? গত একমাস ধরেই সে আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করছে। আর আপনি কিনা তার দিকে ফিরেও তাকাননা। কেন আব্বা?’
আব্বা পেপারটা বন্ধ করে শান্ত গলায় বললেন,
‘ছেলেটা এসব কেন করছে তুই বুঝছিস না?’
আমি বললাম,
‘সে আপনাকে সম্মান করে বলেই করছে। এছাড়া আর কি?’
‘সে তোকে বিয়ে করতে চায় তিথি! আর আমেনার ছেলের সাথে তোর বিয়েটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না। আমাকে আর জ্বালাস না। না হয় দ্বিতীয়বার কোমায় যেতে বেশিদিন লাগবে না আমার।’
(চলবে)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩৬
#তাশরিন_মোহেরা
আব্বার কথাটা শুনে মনটা কেমন যেন ছোট হয়ে গেল। আমার প্রতি মুখরের দূর্বলতাটা আমিও খেয়াল করেছি বেশ আগে। তবে আব্বার অসুস্থতার কারণে এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবা হয়নি। তবে মুখর বিষয়টাকে সরাসরি বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছে, যা আমাকে বেশ অবাক করলো। সাথে আব্বার এমন কথায় মনটা ভেঙে গেল। ভেবেছি কোমার পর হয়তো আব্বার মানসিকতা কিছুটা হলেও বদলাবে। আমার মনটা কিছুটা হলেও বুঝবেন তিনি! তবে আমিই ভুল ছিলাম। আব্বা কখনোই তার স্বভাবকে বদলাতে পারবেন না। উল্টো আমাকেই চার দেয়ালে বন্দীর মতো জীবন কাটাতে হবে।
রুমে এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটা নিয়ে ভাবছি। ভাগ্যটা আমার বড্ড খারাপ! আর এই পোড়া কপাল নিয়ে আমি কিনা সুখী থাকার আশা করছিলাম। আশা করছিলাম যাকে চেয়েছি তাকেই পাবো! হাহ্! তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে মন চাইছে। আমি কি কখনোই যা আশা করেছি তা পেয়েছি? তবে মুখরকে নিয়ে কেন মন মাঝে এতো আশা আমার? কেন তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছেটা এমন পেয়ে বসেছে আমায়?
পর্দাটা টেনে ঘর আঁধার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ফোনটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠলো। দেখলাম মুখর ফোন দিয়েছে। ফোনটা ধরলাম না আমি। ছেলেটাকে অযথা নিজের জীবনে জড়িয়ে লাভ নেই। তার চাইতে বরং দূরে থেকে আমায় ভুলে যাওয়াটাই অধিক শ্রেয় তার জন্য! সে পরপর দু’বার ফোন দেয়। রিসিভ করিনি। মুখরের অযথা বারবার ফোন দেওয়ার অভ্যাস নেই। ফোন রিসিভ না করলে সে টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে আমি ব্যস্ত আছি কিনা! এখনো টেক্সট করেছে। তবে টেক্সটটা উপর থেকে দেখেই ফোনটা অফ করে দিলাম। তার সাথে কথা বলতে খুব মন চাইছে, ইচ্ছে করছে সবটা ছেড়ে ছুটে যাই তার কাছে। দুজনে কোনো অচিনপুরে হারিয়ে যাই। তবে আমার এমন অবান্তর ইচ্ছেদের কোনো ঠাঁই নেই। আব্বার বেড়াজালে বন্দী আমি!
মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠলো। বুকে প্রবল রক্তক্ষরণ হচ্ছে যেন! ব্যাথায় অসহ্য হয়ে উঠেছে শরীর। মনের ব্যাথা বোধহয় এমনি। অশ্রুগুলোও বাধ মানলো না। অঝোরে গড়িয়ে পড়লো বালিশময়। বালিশটা তক্ষুণি ভিজে গেল আমার নোনাজলে। মুখটা বালিশের মাঝেই চেপে খানিক আর্তনাদ করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ কান্নার পর চোখ দুটো বুজে এলো। কান্না করতে গিয়ে দূর্বল হয়ে গেছি। ঘুমিয়ে পড়লাম তৎক্ষণাৎ।
.
ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে বসেছি। আব্বা তার রুটিটা ছিঁড়ে মুখে পুরতেই বললেন,
‘কাল অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মনটা তেতো হয়ে গেছে কেমন যেন। তাই আব্বার কথাতে তেমন একটা সাড়া দিলাম না। নিজের জন্য একটা পাউরুটি নিয়ে তাতে জেলি লাগিয়ে আনমনে খেতে লাগলাম। আব্বার দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতেও মন চাইছে না আমার।
আব্বা নিজে নিজেই বললেন,
‘যেহেতু মেয়ে হিসেবে জন্মেছিস, তোকে তো সারাটাজীবন আমার সাথে রেখে দিতে পারি না। সমাজেও নানান ধরনের কানাঘুঁষা শুনতে হবে না হয়।’
আমি ভ্রু কুঁচকে পাউরুটির দিকে চেয়ে আছি। তবে কানটা আব্বার কথার দিকে। হঠাৎ এসব কি বলছেন আব্বা? আব্বার মুখে কখনো সমাজের কথা শুনতে দেখা যায়নি। তবে আজ এসব কি বলছেন তিনি হুট করেই? কিছু না বলে চুপচাপ শুনলাম। আব্বা আবারো বললেন,
‘তাই ভেবেছি তোকে একটা বিয়ে দেবো।’
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার সাথে সাথে। বড় বড় চোখ নিয়ে আব্বার দিকে তাকালাম। বিশ্বাস হতে চাইলো না কিছুই! আব্বা বলছেন তাও আবার আমার বিয়ের কথা? মানে কি? আব্বা আমার হা হয়ে যাওয়া মুখটা একবার দেখলেন। তারপর বললেন,
‘হ্যাঁ, তোকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। যতই কষ্ট হোক, তোকে তো আর নিজের কাছে রেখে দিতে পারি না। সব বাবাদেরই এই পরিস্থিতির জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়।’
বিয়ের কথা শুনে চোখেমুখে আচমকা একটা মুখই ভেসে উঠলো আমার। মনটা খারাপের দিকে থেকে উলটে ভালোতে রূপ নিয়েছে। আব্বা কি তবে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন? মুখরকে কি তবে আব্বা আমার জন্য উপযুক্ত মনে করছেন? তা হলে কি আমার আশাটাই শেষমেশ পুরণ হতে চলেছে? আব্বার দিকে গদগদ হয়ে তাকিয়ে আছি।
তবে, আমার আশায় পানি ঢেলে বলে উঠলেন,
‘তবে পাত্র মুখর শিকদার নয়। আমেনার ছেলেকে আমি তোর স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না তা আগেই বলেছি, তিথি!’
সঙ্গে সঙ্গে মনটা মিইয়ে গেল। সারা মুখজুড়ে ঘন অন্ধকার নেমে এলো আমার। পাত্র মুখর নয় মানে? কেন নয়? কি দোষ আছে ছেলেটায়? আব্বার দিকে রাগত্ব দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে আব্বা চোখ নামিয়ে বললেন,
‘তোর রানা চাচার কথা মনে আছে? তার একটা ছেলে আছে শোয়েব। রানা তার পরিবার নিয়ে এখনো কুমিল্লায়ই থাকে। তোর দাদাবাড়ির পাশেই।’
আমি ভেঙে পড়া মন নিয়ে বসে আছি। খাওয়ার রুচিও চলে গেল মুহুর্তেই। আব্বার কোনো কথা-ই কানে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেন আব্বা বারবার আমার সাথে এমন করছে? বারবার আমার মন ভেঙে কি লাভটা হয় আব্বার?
আব্বা আমার মন খারাপটা দেখেও না দেখার ভান করলো। বললো,
‘ঐ শোয়েব ছেলেটার সাথেই তোর বিয়ে দেবো ভেবেছি। আর আমিও তোর সাথে কুমিল্লায় নিজের বাড়ি চলে যাবো। এক ঢিলে দুইপাখিও মারা যাবে।’
আমি নিজের কষ্ট আর ধরে রাখতে পারলাম না। কান্নারা ছিটকে চলে এলো চোখ বেয়ে। অঝোরে অশ্রুধারা পতন হতে লাগলো। রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। টেবিলে সশব্দে আঘাত করে বললাম,
‘আপনি বারবার এমন করছেন কেন, আব্বা? আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই আপনার কাছে? আমি কি আপনার মেয়ে না আব্বা?’
আব্বা শান্তভাবটা বিদ্যমান রেখে বললেন,
‘এখানে তোর মেয়ে হওয়া না হওয়া নিয়ে কথা উঠছে কেন, তিথি? তোর ইচ্ছেটা সঠিক নয়।’
আমি চোখ মুছে চিৎকার করে বললাম,
‘কি সঠিক নয়? মুখরকে ভালোবাসাটা সঠিক নয়? মুখর আমাকে বিয়ে করতে চাইছে এটা সঠিক নয়? কেন আব্বা? মুখরকে কেন আপনার সঠিক মনে হয় না? কেন আপনি মুখরকে মেনে নিতে পারবেন না? আমাকে বলুন!’
আব্বা চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে যেতে যেতে বললেন,
‘এসব বলতে আমি ইচ্ছুক নই, তিথি।’
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। আব্বার সবকিছুই আমার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আব্বা আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন এমন একজনের সাথে যাকে কিনা আমি কখনো দেখিইনি। তার চাইতে বড় বিষয়, ছেলেটাকে আমি ভালোবাসি না।
আমি বিয়ে করতে চাইনা। মুখরকে ছাড়া আমি কাউকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেবো কি করে?
চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। কিছুই ভালো লাগছে না আমার! ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। আব্বার এসব আমি আর সইতে পারছি না। তন্মধ্যে মুখর আবারো কল দিলো ফোনে। তার ফোন এসেছে দেখে কান্নার বেগ আরো বাড়লো। ছেলেটাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। আমি তাকে ছেড়ে যেতে চাইনা অন্য কোনো সংসারে। অন্য কেউ আমাকে ভালোবাসুক আমি তাও চাই না। আমার শুধু মুখরকেই চাই! কি করবো আমি এই পরিস্থিতিতে? হে সৃষ্টিকর্তা! আপনি আমার সাথে বারংবার এমন খেলা কেন খেলছেন?
(চলবে)
(পর্বটা একটু ছোট হয়ে গেল। তার জন্য দুঃখিত পাঠকগণ!)