অনুভবে তুই পর্ব -শেষ

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৮ (অন্তিম)

আদ্রিশ ‘আসছি’ বলে যে-ই না ফিরতে যাবে তখনি ফিহার পেছন থেকে উৎস জিজ্ঞেস করল, ‘জীবনে প্রথমবার বাসর রাত পালন করেছ। কী’রকম অনুভূতি হচ্ছে তোমার ভাই?’

কথাটা শুনে আদ্রিশ চোখ গরম করে তাকাতেই উৎসের হাসিমাখা মুখটা নিমিষেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। থতমত খেয়ে বলল, ‘ভুল করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর হবে না। স্যরি ভাই।’

ওর কাঁচুমাচু চেহারা দেখে আদ্রিশ দারুণ একটা ভাব নিয়ে বলল, ‘রোজা তোর কাজিন। আর কাজিনের বাসর ঘরে কি হয়েছে না হয়েছে সেটা জানতে চাস? নূন্যতম লজ্জা নেই? আচ্ছা সে যাইহোক, নেহা তো তোর নিজের বোন; তো ওর বাসর ঘরে কি হয়েছে সেটা জানিস? নাকি আমি বলবো? নিজের বোনেরটা শুনতে নিশ্চয়ই তোর দারুণ লাগবে? তাই নয় কী…’

নেহার প্রসঙ্গ আসতেই উৎস দু’হাতে কান চেপে ধরলো। নিজের বোনের বাসর ঘরের কাহিনী এখন ওকে জানতে হবে বড়ভাই হয়ে? ছিঃ! উৎস লজ্জাবনত চেহারা নিয়ে চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘প্লিজ ভাই, এই টপিক বন্ধ করো। আমি এ বিষয়ে কিছু শুনতে চাচ্ছি না।’

আদ্রিশ চেহারায় কাঠিন্যতা ফুটিয়ে বলে ওঠল, ‘উহু, টপিকটা শুরু করেছিস তুই। শেষ করবো আমি। তোর এই ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখে ভালোই লাগছে। ছোট আব্বুকে বলতে হবে তোমার গুণধর উৎস বাবাজির বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। সে এখন লোকের ঘরে উঁকিঝুঁকি মেরে রাতের ঘটনা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।’

উৎস অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমাকে এসব মানাবে না ভাই। আমি আর জ্বালাবো না তোমাকে। কিন্তু প্লিজ আব্বুকে এসব বলো না।’

উৎসের চেহারা দেখে আদ্রিশ বাঁকা হেসে ওর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ওকে। তবে চিন্তা করিস না, তোর ওয়েডিং নাইটে তোর ঘরে ক্যামেরা লাগানো থাকলেও থাকতে পারে। একটু চেক করে নিস।’

উৎস সেখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ার জন্য বলল, ‘আ আমি যাই। ব্রেকফাস্ট করতে এসো।’

আদ্রিশ ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

উৎস দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লো। এতক্ষণ মৌন থেকে দু-ভাইয়ের কথা শুনছিলো ফিহা। মনে মনে প্রচুর হাসি পেলেও মুখে তা ফুটে ওঠলো না। উৎস যেতেই আদ্রিশকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাইয়া তুমি কিন্তু সত্যিই দিনদিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছো। আর রোজা যে নির্লজ্জ লোক পছন্দ করে না সেটা ভালোভাবেই জানো।’

আদ্রিশ কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘এই কথা তুই বলছিস? বাহ ফিহা!’

ফিহা আলতো হেসে বলল, ‘খেতে আসো।’

বলেই ফিহা চলে গেলো। আদ্রিশ কতক্ষণ বোকার মতো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবনার প্রহর কাটিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
চুলগুলো ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। ও পিছু ফিরে দেখলো রোজা গোসল সেরে বেরিয়েছে। ভেজা, সিক্ত চুলের পানি টপটপ করে পড়ে ওর হলুদ রঙের কামিজ ভিজিয়ে দিচ্ছে। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে রোজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। ওর হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে নিজেই ওর চুলগুলো মুছে দিতে লাগলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এত সকালে গোসল করার কোনো প্রয়োজন নেই। এরপর থেকে আর করবে না। তোমার তো মাথাধরার সমস্যা আছে।’

রোজা শান্ত গলায় উত্তরে বলল, ‘হাতমুখ ধুতে গিয়ে জামাটা ভিজে গিয়েছিল। তখন খেয়াল করিনি। সেজন্যই গোসল সেরে নিলাম। এরপর আর করবো না।’

আদ্রিশ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর গলায় ছোট্ট করে চু’মু খেলো। আচমকা এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো রোজা। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে, নড়াচড়া যেন সম্পূর্ণ ভুলে গেলো। অবস্থা দেখে ওকে স্বাভাবিক করার জন্য আদ্রিশ হালকা হেসে বলল, ‘চলো, সবাই অপেক্ষা করছে।’

রোজা ওর কথা শুনতে না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে, ‘কোথায়?’

‘ডাইনিংয়ে।’

কিন্তু রোজা আগের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে রইলো। ও সেন একটা ঘোরের ভেতর রয়েছে। সেটার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আদ্রিশ মনে মনে হেসে রোজার ডানহাতটি শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রোজা হতবাক নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আ আপনি একটু আগে এটা কী করলেন?’

আদ্রিশ ধীরগলায় ব্যক্ত করল, ‘ভালোবাসলাম।’

রোজা রেগে বলল, ‘এটাকে ভালোবাসা বলে না। ছিঃ আপনি আমার অনুমতি ছাড়া…’

আদ্রিশ রেগে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম। আজ, কাল এবং আজীবন কাল।’

ওর কথা শুনে রোজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ও তো তেমন কিছু মিন করতে চায়নি। শুধু মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল কথাটা। এই সামান্য কথাটায় এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে রোজা বুঝতে পারলো না। এদিকে রোজার ব্যবহার দেখে আদ্রিশের মুখখানা রক্তিম থমথমে রুপ ধারণ করলো। রোজার থেকে এমন ব্যবহার ও আশা করে না। কিন্তু মেয়েটা ওকে কখনো বোঝার চেষ্টাও করে না, ওর ভালোবাসাকে মোটেও কেয়ার করে না। ডাইনিংয়ে সবার সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেও রোজার দিকে ফিরেও তাকালো না আদ্রিশ। নিজের মতো খেয়েদেয়ে সেখান থেকে ওঠে চলে গেলো। বিয়ে উপলক্ষে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে বিধায় রাগ দেখিয়ে অফিসে যেতে পারলো না সে। হুট করে রেডি হয়ে এক বন্ধুর সাথে দেখা করার বাহানা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। রোজা ওর সাথে কথা বলার সুযোগই পেলো না। সারাদিন গিয়ে রাত হয়ে এলো। আদ্রিশের ফেরার নামগন্ধ নেই। এদিকে, ছেলের কান্ডে মিতালি কিছুই বুঝতে পারছে না। রোজার বিরস চেহারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে তিনি ওর সঙ্গে কথা বললেন। রোজা লিমিটের মধ্যে থেকে বাকিটা তাঁকে বুঝিয়ে বললে মিতালি ফোন করলেন আদ্রিশকে। তখন রাত বারোটা। আদ্রিশ মায়ের ফোন রিসিভ করে সোজাসুজি বলে দিলো সে আজ রাতে ফিরছে না। মিতালিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে সে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ও আশ্রয় নিয়েছে এক কলিগ বন্ধুর ফ্ল্যাটে। সে কলিগ বেচারা বুঝতে পারছে না বিয়ের পরদিন কোনো মানুষ কীভাবে বাড়ির বাইরে বউ ছাড়া রাত কাটায়?

আদ্রিশের রাগ যে এতটা প্রখর সেটা দেখে রোজা ভীষণ অবাক হলো। এদিকে ছেলের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন মিতালি। অনেক কষ্টে তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলো রোজা। তারপর বলল, ‘ওনি না ফিরলে না ফিরুক। আপনি প্যানিক করবেন না প্লিজ।’

মিতালি কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, ‘তুমি ওর ব্যবহারে কিছু মনে করো না মা। জানোই তো ও কেমন। আর স্বামী-স্ত্রীর’ মধ্যে এরকম অনেক ঝামেলাই ঘটে। এগুলো বাইরের কাউকে না বলে নিজেরা মিলে সমাধান করে নিও। তবে আর যাইহোক, এটা বলতে পারি আমার ছেলে যতোই অপদার্থের মতো কাজ করুক, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তুমিও ওকে একটু বোঝার চেষ্টা করো মা।’

রোজা তাঁর কথার পিঠে আরকিছু বললো না। মিতালি অবশ্য সঠিক কথাই বলেছে। ঘরের খবর বাইরের মানুষকে জানালে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে যায়। যেমন উৎসরা এই মুহূর্তে ভীষণ মজা নিচ্ছে। যাতে রোজা বেশ আনইজি ফিল করছে। আদ্রিশের মা আরও কিছুক্ষণ ওর সাথে কথাবার্তা বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তারপর নিশিতা এসেও ওর সাথে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে ঘুমাতে বলে চলে গেলেন। সবাই যাওয়ার পর রোজা দরজার সিঁটকিনি আটকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। আদ্রিশেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো। এই লোকের অভিমান কীভাবে ভাঙ্গাবে সে? অহেতুক অভিমানের কোনো মানে হয়? সবসময় দু’লাইন কমই বুঝে সে। এসকল ভাবনার মাঝেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতে পারে নি রোজা। বারান্দার দরজাটা না বন্ধ করেই সে ঘুমিয়ে পড়লো আগের রাতের মতোই।

এদিকে ওপরে ওপরে যতই রাগ দেখানোর চেষ্টা করুক, আদ্রিশ কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। রোজার ঘুমন্ত মুখটা দেখার তীব্র তৃষ্ণায় রাত দেড়টায় সে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কলিগের ফ্ল্যাট থেকে। কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় সেই কলিগের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে। তাতে আদ্রিশের কিছু যায় আসে না। একপ্রকার তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে আদ্রিশ দেখলো মেইন গেইট বন্ধ। দারোয়ানকে ফোন করে গেইট খুলে দিতে বলে সে। বাড়ির সদর দরজা বন্ধ দেখে মনটাই বিষণ্ণ হয়ে গেলো। এত রাতে তো কেউ আর ওর ফেরার জন্য বসে থাকবে না! তাছাড়া কাউকে ফোন করে দরজা খুলতে বলার অবস্থাটাও নেই। অগত্যা বাগান থেকে একটা মই নিয়ে নিজের খোলা বারান্দায় ওঠার চেষ্টা করলো এবং দারোয়ানের সহযোগিতায় সফলও হলো। ঘরে প্রবেশ করে সে আগের রাতের মতো ঘুমন্ত রোজাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিয়ের পর মেয়েদের ঘুম বেড়ে যায় নাকি? এই মেয়ে তো আগে মাঝরাত অবধি জেগে পড়াশোনা করতো। আমার বউ হওয়ার পরই সে কুম্ভকর্ণ হয়ে গেছে।’

ধীরগলায় কথাটুকু বলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো আদ্রিশ। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে রোজা ফোলা ফোলা চেহারা নিয়ে ওর দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে আছে। রোজা ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি? ঘরের ভেতর কীভাবে এসেছেন? ওহ মাই গড! আ আপনি আদ্রিশ তো? ন নাকি ক কোনো অশরীরী?’

আদ্রিশ একথা শুনে হতাশ গলায় বলল, ‘অশরীরীরা যে ওয়াশরুম ইউজ করে জানতাম না তো!’

রোজা একটু ভয়ার্ত স্বরে বলল, ‘ও ও ওদের আনাগোনা ওয়াশরুমেই বেশি। সত্যি করে বলুন আ আপনি কে?’

আদ্রিশ ওকে ভয় পেতে দেখে বলল, ‘রিল্যাক্স। এটা সত্যিই তোমার বর। বিশ্বাস না হলে পরখ করে দেখো।’

রোজা থতমত খেয়ে ওর দিকে এগিয়ে ছোট্ট করে ওর গালে চিমটি কাটলো। যখন দেখলো এটা সত্যিই আদ্রিশ তখন একটু শান্ত হলো। এরপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আপনি ঘরে কীভাবে এসেছেন? দরজা তো বন্ধ।’

আদ্রিশের তখন মনে পড়লো সে তো রাগ করে আছে। তাই সে ভাবটা বজায় রাখতে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘বারান্দা দিয়ে এসেছি। তোমাকে এত ভাবতে হবে না।’

তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথাটা শুনে রোজা ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো ওর দিকে। আদ্রিশ ওকে উপেক্ষা করে আলমিরা থেকে ট্রাউজার বের করে চেঞ্জ করে এলো। রোজা বিছানার এক কোণে বসে ওর কান্ড দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী রেগে আছেন আমার ওপর?’

আদ্রিশের মাথাটা গরম হয়ে গেলো। এই মেয়ে কী বুঝতেই পারছেনা আদ্রিশ ওর ওপর রেগে আছে? ও রোজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিছানার এক পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো রোজার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। বিষয়টা দেখে রোজা ওর চোখ এড়িয়ে বাঁকা হেসে নিজেই ওর পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। আদ্রিশ তখন রাগী ভাব নিয়ে বলল, ‘এভাবে শুলে আমার ঘুম হয় না। দূরে যাও তুমি।’

রোজা ওর কথা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে আরও ঘেঁ’ষে শুলো। আদ্রিশ বিরক্তি ভাব নিয়ে তাকাতেই রোজা এবার ফট করে ওর কপালে চু’মু খেলো। রোজার কান্ডে আদ্রিশ হতভম্ব হলেও সেটা প্রকাশ করলো না, উলটো দিকে ফিরে শুয়ে ঘুমানোর ভান করলো। রোজা তখন বলল, ‘ভালোবাসা তো অনুমতি ছাড়াই হয়ে যায়, তাহলে আপনি এত নাটক করছেন কেন?’

আদ্রিশ উত্তর দিলো না। রোজা বকবক করতে থাকলো। কিন্তু আদ্রিশের হেলদোল না দেখে বেশ জোরে কা’ম’ড় দিয়ে বসলো ওর ডান হাতের পিঠে। ব্যথায় এবার চুপ করে থাকতে পারলো না সে। লাফিয়ে ওঠে বসলো বিছানায়। রোজাকে বেশ শক্ত একটা ধমক দিতে গিয়ে দেখলো ও গম্ভীর চেহারা করে বসে আছে। আদ্রিশ আর রাগ করে থাকতে পারলো না। বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভালোবাসা চাই?’

রোজা খোঁচা মেরে বলল, ‘ভালোবাসা কী চাইলেই পাওয়া যায়?’

আদ্রিশ খানিকটা রাগ নিয়ে বলল, ‘সবসময় এভাবে খোঁচা মেরে কথা বলো কেন তুমি? বয়সে আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। অথচ বড়দের মতো কথা বলো। অবশ্য বোকা চেহারার রোজাকে আমি ভাবতেই পারি না।’

শেষের কথাটা বলার সময় আদ্রিশ নিঃশব্দে হেসে ফেললো। রোজার মনটাও ভালো হয়ে গেলো। যাক, এই আবোলতাবোল-পাগল লোকের রাগটা তাহলে ভাঙানো গেছে। জানালা দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের রশ্মি এসে রোজার চোখেমুখে পড়তেই আদ্রিশ ঘোর ঘোর গলায় বলল, ‘আমারও একটু অন্যরকম ভালোবাসা চাই।’

বলে রোজার দিকে এগুবে সেই মুহূর্তেই ওর হাসি পেয়ে গেল। অনুভূতি গুলো আবার টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আদ্রিশের। ওর চেহারায় সেটা ফুটে ওঠতেই রোজা চুপ হয়ে গেলো। আদ্রিশ বলল, ‘তোমার প্রতি ভেঙে যাওয়া অনুভূতিরা কখনো মরে না। একটু ভালোবাসা ছাড়া আরকিছু চাওয়ার নেই তোমার থেকে।’

সেদিন পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে বাগানের ফুলেরাও যেন হেসে ওঠেছিল। চারপাশের নীরবতা ছেদ করে নিশিরাতের পাখিরা গুণগুণ করে গান গাইতে লাগলো। সমস্ত রাগ-অভিমানকে দূরে ঠেলে স্রোতের বিপরীতে থাকা দু’জন মানব-মানবী এক সুতোয় বাঁধা পড়েছিল। প্রতিটি অনুভবে, হৃদস্পন্দনে তাঁরা তাঁদের ভালোবাসার মানুষটাকেই খুঁজে নিয়েছিলো।

[পরিশিষ্ট: কিছু বছর পরের কথা। সময় চলছে তার আপন গতিতেই। সবার জীবনের মোড় পাল্টেছে। উৎস বাবার সাথে পারিবারিক ব্যবসায় যোগদান করলেও তার জীবনে কোনো মেয়ে আসেনি। এখন পারিবারিকভাবে তার বিয়ের কথা চলছে তার ক্লাসমেটের সঙ্গে। আর নেহা-রিজভী বসবাস করছে সিঙ্গাপুরে। আদ্রিশ-রোজা আছে দেশ থেকে দূরে, লন্ডন শহরে। তাঁদের সাথে আছে ফিহা। উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সে আছে দেশ থেকে বাইরে। আর ইশার বিয়ে হয়েছে বছর দু’য়েক আগে। সেও সাংসারিক জীবনে বেশ সুখেই আছে৷ সবার জীবনের নতুন ছন্দ বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছে তারা। জীবন সুখপূর্ণ। এটুকু ভাবলে সত্যিই জীবন সুখের মনে হয়। সেইবার এক মনোমুগ্ধকর বসন্ত। পিচঢালা পথের ফুটপাতে শীতের মরা পাতার আনাগোনা চলছিলো উত্তালভাবে। হালকা কুয়াশার শিশিরকণা টুপটাপ ঝরে পড়ছিলো ঘাসের ওপর। পার্কে সময় কাটাতে এসে এক বেঞ্চে বিগত দিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অতীতে ফিরে গিয়েছিল রোজা। ওর ভাবনার দীর্ঘ এই ক্ষণের সমাপ্ত ঘটে বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা মেয়ের ডাকে। মেয়েলু গলার ডাক শুনে রোজা ওঠে দাঁড়ালো। শীতের পোশাকটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে মেয়ের কাছে গেলো সে। মেয়েকে কোলে নেওয়ার আগেই আদ্রিশ এসে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে নিয়ে নিলো। তারপর রোজাকে চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘আমার মেয়ের এমন গম্ভীর একটা মা হলো কেন বলো তো?’

রোজাও প্রতিত্তোরে চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘কারণ তার বাবা পাগল। সেই তো জোর করে তাঁর মা’কে বিয়ে করেছে।’

আদ্রিশ থতমত খেলেও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘এসব মিথ্যে অযুহাত না দেখালেই নয়?’

‘থামো বাবা। আমি জানি তুমিই সবসময় মাকে বিয়ে করতে চাইতে। উৎস কাকু বলেছে।’

মেয়ে টুইংকেলের ধমক শুনে আদ্রিশ কাচুমাচু মুখ করে ফেললো আর রোজা হেসে ফেললো। বলল, ‘এবার বোঝা গেল তো কে মিথ্যে অযুহাত দেখায়?’

আদ্রিশ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বোকাবোকা হাসার চেষ্টা চালিয়ে বলল, ‘ইয়ে মানে তোমার উৎস কাকু জানে না তো তাই…’

টুইংকেল গম্ভীর গলায় বলল, ‘মিথ্যে বলো না। আমার জুতোর ফিতেটা ঠিক করে দাও। আমি হাঁটতে পারছি না।’

আদ্রিশ তখনি মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে বেঞ্চে বসালো। খুব যত্ন করে ফিতেটা লাগিয়ে দিলো সে। টুইংকেল বাবার কপালে চু’মু খেয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ বাবা।’

আদ্রিশও হেসে বলল, ‘ওয়েলকাম পিচ্চি।’

টুইংকেল তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আদ্রিশের দিকে। প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘আমি পিচ্চি নই। আমার বয়স ছয় বছর। পিচ্চি বলবে না আমাকে। স্যরি চাও এখনি।’

আদ্রিশের মুখের হাসি উবে গেলো। কাঁচুমাচু চেহারা নিয়ে মেয়েকে স্যরি বলতেই রোজা হেসে ফেললো। আদ্রিশ অসহায় ভঙ্গিতে মেয়ের আড়ালে গিয়ে হতাশ গলায় রোজাকে বলল, ‘তোমার মেয়ে সম্পূর্ণ তুমিটাই। এই বয়সে এত গম্ভীর বাচ্চা কীভাবে হয়? এত সিরিয়াসলি নিয়ে নেয় সবকিছু। ভালোবেসে পিচ্চিও বলা যায় না। কি মারাত্মক ব্যাপার!’

রোজা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘বলেছিলেন না, আমার মতোই একটা ছোট্ট রোজা চান আপনি? এবার দেখুন। মেয়ে তো আমার মতোই হয়েছে। আপনার গম্ভীর বউ-বাচ্চা নিয়ে এবার সুখে থাকুন।’

আদ্রিশ মুচকি হেসে রোজার গালে হাত ছুঁয়ালো। ছোট্ট করে চু’মু খেলো মা-মেয়েকে। দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তবুও ওদেরকেই আমার চাই। হয়ে যাক আরও গম্ভীর, আমার ভালোবাসা তোমাদের প্রতি সবসময় নতুন অনুভূতির মতোই প্রিয় থাকবে।’

রোজাও আলতো হেসে বলল, ‘আমারও।’

আদ্রিশ প্রশ্ন করল, ‘একবার ভালোবাসিও বললে না?’

রোজা উত্তরে বলল, ‘ওটা আমার গোপন অনুভূতির মতোই গোপন থাকুক। সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই।’

সেই যে ছাদে একবার রোজা আদ্রিশকে ‘ভালোবাসি’ বলেছিলো; বিয়ের এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার সেটা উচ্চারণ করে নি রোজা। আদ্রিশও আর জোর করে নি। সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আদ্রিশ এবার শান্ত স্বরে বলল, ‘প্রকাশিত ভালোবাসা আবারও প্রকাশ হোক। পৃথিবী জানুক আদ্রিশের অনুভবে তুমিই আছো। আর সে আছে তাঁর রোজানুর মনের গহীনে। খুব যত্নে। ভালোবাসা খুঁজে নেবে সে একটু একটু করে।’

—————————————————————————–
।]

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here