#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৫
চৌদ্দটা দিন খুব দ্রুতই যেন কেটে গেলো। অবশেষে ঘনিয়ে এলো হলুদের দিন। বিয়ের দিন যত এগুচ্ছে রোজার মনে তত মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আদ্রিশের সাথে ওর বিয়ে, কথাটা ভাবলেই শিহরিত হয় মনপ্রাণ। বারবার শুধু ওর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথাই মনে হয়। ওদের বাড়িতে যাওয়া, থাকা, খাওয়া, ঘুরাঘুরি, কিছু ভুল বোঝাবুঝি, আবার সব ঠিক হয়ে যাওয়া, ওদের বিয়ের কথা হওয়া, আদ্রিশের বাচ্চামো, ওর নিজের বাড়াবাড়ি সবকিছু মিলিয়ে খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি। প্রথম দিকে তো ও আদ্রিশকে একপ্রকার সহ্যই করতে পারতো না, ভাবতো লোকটা খুব খারাপ। নিজের কর্তৃত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। লোকটা আসলেই ওকে খুব করে চায়। তবে দিনশেষে এসবকিছু পেছনে ফেলে ওই আদ্রিশের বউ হয়ে ওই বাড়িতেই যেতে হচ্ছে ওকে এটা ভেবেই ও নিজের ওপর অবাক হয় আজকাল। সত্যি, নিয়তি খুব অদ্ভুত। ভেবেই আলতো হাসলো রোজা। তপ্ত রোদ্দুরে ঢাকা সোনালী প্রকৃতি। হলদেটে একফালি সূর্যরশ্মি চুইয়ে এসে পড়ছে ওর ঘরের মেঝেতে, বারান্দায়। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে আসছে মৃদু বাতাস। চকচকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে মোহময় সূর্য। আজ ওর গায়ে হলুদ। সদ্য গোসল সেরে আসা রোজা তার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছছিলো। তখনি দরজায় টোকা পড়লো। চিন্তাজগত থেকে বেরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোজা গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। দরজার বাইরে রেশমি ফুফু দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে খাবারের ট্রে। সেখানে রোজার পছন্দের সব তরকারি আর পোলাও সাজিয়ে রাখা। রেশমি ফুফু ওকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন, ‘গোসল সারা হয়েছে? দেখি সর, ঘরের ভেতরে ঢুকতে দে।’
রোজা দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘শেষ। কিন্তু এত খাবার কার জন্য এনেছ? আমার জন্য হলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি এত খাবার খাবো না।’
রেশমি ফুফু জোর গলায় বললেন, ‘তুই খাবি না তোর ঘাড় খাবে। তোর জামাই খাবে।’
রোজা থতমত খেয়ে বলল, ‘জামাই খাবে মানে?’
রেশমি ফুফু বাঁকা হেসে বললেন, ‘তুই আমাকে যতটা বোকা ভাবিস, আমি অতোটাও বোকা না। তুই যদি খাবারগুলো না শেষ করিস তাহলে বাড়ির সবাইকে আমি সেদিন রাতের ঘটনা বলে দেব।’
রোজা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সেদিন রাতের কথা মানে? কোন রাতের কথা বলছো?’
রেশমি বেগম চোখ ছোট ছোট করে বললেন, ‘তুই আর তোর জামাই যে জানালায় দাঁড়িয়ে প্রেম করছিলি সেই রাতের কথা। তুই কি ভাবিস চোখ থাকতেও আমি অন্ধ? রাহা-রাহী অন্ধ? ওহহো৷’
রোজা বোকার মতো প্রশ্ন করল, ‘তু তুমি কীভাবে জানলে?’
‘রাহা-রাহী বলেছে। ওরা দেখেছে।’
‘কী?’
রেশমি বেগম বিরস কন্ঠে বললেন, ‘তোর এখনো না হওয়া জামাই নাকি জানালা দিয়ে লুকাইয়া লুকাইয়া তোর সাথে দেখা করে। আবার নাকি চু-মুও খাস। এই তোর মাথায় কি আক্কেল-বুদ্ধি নাই? ঘরে দুই-দুইটা উপযুক্ত মাইয়া রাইখা এইসব করস লজ্জা করে নাই? সব শহরের বাতাসে ওড়ায়া দিছস নাকি?’
রোজা হতভম্ব হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মানে সেদিন যা কিছু ঘটেছে সবকিছু রাহা-রাহী দেখে নিয়েছে ঘুমের ভান করে? আবার রেশমি ফুফুর কাছে সব উগলেও দিয়েছে? ছিঃ কি বিশ্রি ব্যাপার! মায়ের মতো এই মেয়ে দুইটারও সবদিকে দৃষ্টি থাকে। এই ঘটনা বোধহয় বাড়ির সবাইকে তারা বলেও দিয়েছে। ইশ, লজ্জায় রোজার ইচ্ছে করছিলো মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে পড়তে। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেশমি বেগম গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘খাম্বার মতো দাঁড়ায়া না থাইকা গিয়া বস। আমি নিজ হাতে খাওয়াইয়া দিই। তোর মায়ের হাতে মেলা কাজ। আইজ গায়ে হলুদ, কাল বিয়া। চইলা যাবি শ্বশুরবাড়ি। এর আগে পেটপুরে বাপের বাড়ির ভালোমন্দ খাওন খাইয়া নে। এই তোর শেষ খাওয়া।’
রোজা আৎকে ওঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? আর কখনো খেতে পারবো না নাকি?’
রেশমি বেগম বললেন, ‘পারবি না কেন? এইটা তোর নিজের বাড়ি, তোর অধিকার। আমি বুঝাইতে চাইসি যে, বিয়ার আগে আর পরের খাওনে তো খানিকটা পার্থক্য আছে সেইটা। এখন তুই একলা, তখন হবি দোকলা। বুঝলি?’
রোজা মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
রেশমি বেগম হাতের মুঠো থেকে রোজার ফোনটা বের করে ওর হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘শোন রোজা, আমারে আবার এতোটাও দা-জ্জা-ল-নী মনে করিস না। আমি আসলে দেখতে চাইছিলাম তোর জামাই তোরে কেমন ভালোবাসে, কথা না কইয়া থাকতে পারে কি-না। এইজন্যই তোর সাথে এদ্দিন কথা কইতে দেয়নাই। কিন্তু এই পোলা যে পাগলের মতো বাড়িতে আইসা বইয়া থাকবো ভাবি নাই। সত্যিই তোরে অনেক ভালোবাসে। আর এই ঘটনা কিন্তু বাড়ির কাউরেই আমি বলিনাই। এইটা তোদের স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এইসব দেখা-সাক্ষাৎ করবার আগে আশেপাশে কে আছে না আছে দেইখা নিবি। বুঝলি?’
রেশমি বেগমের কথা আর আদ্রিশের প্রশংসা শুনে রোজার মন ভালো হয়ে গেলো। ও বিছানায় নিজের পাশে রেশমি বেগমকে বসিয়ে বলল, ‘আমাকে খাইয়ে দাও তো ফুপি।’
রেশমি বেগম হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই সত্যিই ভাগ্যবতী মাইয়া। হীরের টুকরো জামাই পাইছিস একখানা। চেহারাসুরৎ মাশাল্লাহ। তোর সাথে মানাইবে ভালা। নে, এখন খাইয়া নে।’
রোজা হেসে বলল, ‘দাও।’
এদিকে আদ্রিশদের বাড়িতেও বিয়ের আয়োজন চলছে। এত এত মানুষের মাঝে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করাটা বেশ বিরক্তিকর মনে হলো ওর। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই কার্যক্রম সেরে রাত বারোটায় নিজের ঘরে চলে এলো ও। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে রোজাকে ফোন লাগালো। প্রতিবারের মতো এবারেও ভেবেছিল ফোনটা রেশমি ফুফু ধরবে। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণিত করে এবার ফোন রিসিভ করলো রোজা। ঘুমঘুম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি? এত রাতে? কিছু হয়েছে?’
রোজার কন্ঠ শুনতে পেয়েই আদ্রিশের সব ক্লান্তি নিমিষেই চলে গেলো। তারপর ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘না কিছু হয় নি। এটলিস্ট তুমি ফোনটা ধরলে।’
ওপাশ থেকে রোজা বলল, ‘এখন রাখুন। আমি ঘুমাচ্ছি।’
‘ঘুমাচ্ছো মানে? হলুদের অনুষ্ঠান হয়নি তোমার?’
‘হয়েছে। সন্ধ্যা’তেই শেষ। এটা তো গ্রামাঞ্চল, তাই আব্বুরা বেশি রাত করতে চায়নি। আপনার কি এতক্ষণে শেষ হলো?’
‘হ্যাঁ।’
রোজা ধীরগলায় বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? ঘুমিয়ে পড়ুন, ফোন রাখছি।’
আদ্রিশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘গুড নাইট।’
‘শুভরাত্রি।’
স্বস্তি ও শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে দু’জনেই ঘুমাতে গেলো। দু’জনের মধ্যে আর নেই কোনো বাঁধা, এবার শুধু এক হওয়ার পালা। কিছু স্বপ্ন সত্যিই অন্যরকম হয়, রুপকথার মতো। শেষ প্রহরের অস্ত যাওয়া চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু’জনেই একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন। ভোর থেকেই রোজাদের বাড়িতে হইচই। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সবাই কাজ আর সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। দুপুরের দিকে রোজাদের বাড়িতে আদ্রিশদের আগমন ঘটলো। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছিলো আদ্রিশের। নিজেকে বরের পোশাকে আবৃত দেখেও সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। রোজাদের আশেপাশের প্রতিবেশীদের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে জীবনে প্রথমবারের মতো খানিকটা লজ্জা লাগছিলো ওর। তবে নিমিষেই সেটা কাটিয়ে ওঠতে পেরেছিলো। রোজার বাবা-চাচা সবাইকে তদারকি করতে ব্যস্ত। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটিই রাখেনি তারা। নেহা-ফিহা-ইশা রোজার ঘরে বসে মজা আওড়াচ্ছে। উৎস আর তার বন্ধুরা আদ্রিশের সাথে সাথে রইলো। প্রাণোচ্ছল বিয়েবাড়ির আনন্দ নষ্ট করতে হঠাৎ করেই সেখানে আগমন ঘটলো রাফির। সে এতদিন গ্রামে ছিলো না, এইতো কিছুদিন আগে কেউ ওকে মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তারই চিকিৎসা নিতে এতদিন সদরের হাসপাতালে ভর্তি ছিলো ও। কিন্তু রোজার বিয়ের খবর পেয়ে মাঝপথেই চিকিৎসা থামিয়ে নিজের দলবল নিয়ে হাঙ্গামা করতে ওদের বাড়িতে চলে এসেছে লাঠিসোটা নিয়ে। এই অবস্থা দেখে মুহূর্তেই বিয়েবাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। এদিকে, রাগে রাফির মাথা ফেটে যাচ্ছে। রোজার বিয়ে? আর ও আজকেই জানতে পারলো? ও কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবে না। রোজা শুধু ওর-ই বউ হবে। তাই বিয়ে বাড়ির যা কিছু সামনে পাচ্ছে সেটার ওপরই ওর দলবল হামলা করছে। কেউ বাঁধা দিতে গিয়েও পারছে না। এদিকে রোজার বাবা-চাচা হতভম্ব। এই মুহূর্তে এসে রাফি যে এরকম কান্ড ঘটাবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি ওরা। উৎস ওর বন্ধুরা রাফিদের আটকাতে গেলে সে ইয়াদের মাথায় আঘাত করে বসে। এতে উৎস ক্ষুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এসব করছো কেন? এটা একটা বিয়ে বাড়ি।’
রাফি রাগী স্বরে বলে, ‘কোনো বিয়াটিয়া হইবে না এখানে। সব বন্ধ।’
‘মানে?’
‘আমি রোজাকে বিয়ে করমু, ওর সাথে অন্য কাউরো বিয়া হইতে পারে না। কিছুতেই না।’
উৎস রেগে বলল, ‘তোমার মতো একটা ফালতু ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেব ভাবলে কি করে? যাও এখান থেকে।’
রাফি চিৎকার করে বলল, ‘আমি কাউরে পরোয়া করি না। আমি এই বিয়া কিছুতেই হইতে দিমু না।’
এমন সময় আজিজুর রহমান আর তার বড়ভাই সেখানে আসেন। রাফির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তারা প্রচন্ড রেগে যায়। রোজার বাবা বলেন, ‘মেয়ে আমার, সিদ্ধান্তটাও আমার। তোমার মতো বখাটে ছেলের হাতে আমি কেন, কোনো বাপ-ই মেয়ে তুলে দেবে না। আর তুমি এখানে এসে যেভাবে হামলা করছো তাতে কিন্তু আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।’
রাফি বলে, ‘ডাকুন না তাইলে। আমি কী না করছি নাকি? আপনে জানেন আমার বাপের কত টাকা? আমি যদি কিছু না-ও করি তাইলেও আপনার মাইয়া সারাজীবন আরাম-আয়েশে কাটাইতে পারবো। কিন্তু হেরে আপনে আমার লগে বিয়া দিবেন না। কেন? আমি কি দেখতে অসুন্দর? সেইডাও না। খালি একটু উচ্ছন্নে গেছি। এইজন্য আপনেরা আমার লগে অবিচার করবেন সেইডা হইতে পারে না। আমি এই বিয়া হইতেই দিব না। দেখি কেমনে এই বিয়া দেন।’
পুরো ঘটনাটা দেখে-শুনে আদ্রিশ এবার নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। ঘটনাস্থলে গিয়ে পেছন থেকে রাফির কলার চেপে ধরে ওকে একটা থাপ্পড় মারলো। আচমকা থাপ্পড় মারায় রাফির হাতের অস্ত্রশস্ত্র মাটিতে পড়ে গেলো। সেখান থেকে একটা লাঠি তুলে নিয়ে ইচ্ছামতো রাফিকে মারতে লাগলো আদ্রিশ। রাফির সাথে থাকা সাঙ্গপাঙ্গরা আদ্রিশকে দেখেই হতভম্ব। কারণ কয়েকদিন আগেই ওদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে আদ্রিশ, কারণটা ওদের অজানা। ভেবেছিল আদ্রিশ হয়তো পুলিশের লোক, তাই ওর সাথে আর লাগতে যায়নি। সেদিনের কথা মনে পড়লেই আঁৎকে ওঠে ওরা। একজনকে তো থাপ্পড় দিয়ে তিনটে দাঁত ফেলে দিয়েছিল, রাফির হাত ভেঙে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এসব কথা মনে পড়তেই ওরা রাফিকে বাঁচানোর কোনোদিকই খুঁজে পেলো না। আর আদ্রিশের সাথেই রোজার বিয়ে হচ্ছে, যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো রাফি হতবাক হয়ে গেলো। যখন দেখলো রোজার বাড়ির লোকেরা ওকে পুলিশে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে তখন ও মনে মনে আরও ক্ষেপে গেলো। নিজের শরীরে আরকোনো শক্তি খুঁজে না পেয়ে আদ্রিশকে হুমকি দেওয়া গলায় বলল, ‘এর শেষ আমি দেইখা নিমু। আমার সাথে লাগতে আসলে কি কি হয়, সেইটা তখন বুঝাই দিমু সবাইরে। আপনেরা আইজ যেটা করলেন সেইটা মোটেও ঠিক করেন নাই। হাতে নয় ভাতে মারবো আপনাদের, কইয়া দিয়া গেলাম।’
বলেই পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাফি আর ওর সঙ্গীরা পেছনের জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল। ওদেরকে ধরার জন্য গ্রামের কিছু লোকজনও ছুটে গেল। আনন্দঘন পরিবেশটাতে নিমিষেই মন খারাপ ভাব চলে এলো। সেজন্য ইনায়েত সাহেব এবারে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করতে বললেন। রোজা শান্তভাবে আর আদ্রিশ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতেই ‘কবুল’ বলার মাধ্যমে বিয়ে নামক একটি নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো আজীবনের জন্য। #অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৭
একটি ভোর, নতুন এক জীবনে প্রবেশ করার প্রথম দিনের সূচনালগ্ন। সকালের নরম রোদের ঝিকিমিকি আর হিমেল হাওয়ায় আদ্রিশের ঘরের পর্দাগুলো ফরফর করে ওড়াওড়ি করছিলো। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল রোজার। আধবোজা চোখজোড়া খুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলো সে এখন কোথায় আছে। সেকেন্ডের মধ্যেই সচল মস্তিষ্ক জানান দিলো সে এখন তার শ্বশুরবাড়িতে আছে। কথাটা মনে হতেই সে কোনোমতে লাফ দিয়ে ওঠলো। গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে দু-হাতে মুখ ঢেকে খানিকক্ষণ বসে রইলো বিছানার ওপর, কোনোদিকে তাকালো না পর্যন্ত। গতরাতে রোজা এত ক্লান্ত ছিলো যে কখন তার চোখ দুটো লেগে এসেছিল বুঝতেও পারে নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আদ্রিশকে দেখতে পেলো সে। আর তখনই ওর হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেল। আদ্রিশ নামক লোকটা ওর চির-জীবনের সঙ্গী, ওর বর। ব্যাপারটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি চমকপ্রদ। কিন্তু কে ভেবেছিলো এই রাগী, উদ্ভট লোকের পাশেই শান্ত, নমনীয়, কঠোর রোজার নামটা জুড়ে যাবে? কেউ কি ভেবেছিল? উহু! রোজা নিজেই তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। আচ্ছা, গত রাতে আদ্রিশ আসার আগেই সে যে ঘুমিয়ে গেছে এজন্য কি লোকটা ওর প্রতি রাগ দেখাবে? অবশ্য রাগ দেখালেও সমস্যা নেই, রোজা ওর রাগকে পাত্তা দেবে না। বিয়ে বাড়িতে রাফিকে মারধর করায় সে নিজেই তো আদ্রিশের ওপর খেপে আছে, অবশ্য এখন আর রেগে নেই। কিন্তু সেটা আদ্রিশকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। রোজা দেয়াল ঘেঁষে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে আদ্রিশকে দেখতে লাগলো। কি এমন আছে যে, ও লোকটার ওপর রাগ দেখালেও মনে মনে ভীষণ ভাবে ওকে অনুভব করে? আদ্রিশের ভালোবাসা নাকি অভিমান দেখে? হয়তো দুটোই। রোজা ভাবনার গভীরে গিয়ে ঘুমন্ত আদ্রিশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সাদা পোলো শার্টে আদ্রিশকে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিলো। কপালের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো তখনো বাতাসে ওড়ছে। কিন্তু আদ্রিশ বাঁকা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কুশনের ওপর পা তুলে দিয়েছে আর গায়ের কম্বল অর্ধেকটা বিছানায় অর্ধেকটা মেঝেতে পড়ে আছে। রোজা বরাবরই গোছানো মেয়ে, কিন্তু ওর কপালেই যে এমন অগোছালো লোক পড়বে কল্পনাতেও ভাবেনি সে। কোনো ছেলের ঘুম যে দু’বছর বয়সী চঞ্চল বাচ্চার মতো হয় এটা ভাবতেই ও বিরক্তিবোধ করলো। সে আস্তে করে ডাক দিলো আদ্রিশকে। নারী কন্ঠের ডাক শুনে আদ্রিশের পাতলা ঘুমটা ভেঙে গেল। ভ্রু কুঁচকে সে তাকালো রোজার দিকে। সবকিছু মনে পড়তেই ও শোয়া থেকে ওঠে বসলো। রোজার দিকে এগিয়ে যেতেই হতভম্ব হয়ে রোজা একটু দূরে সরে গেল। সেটা দেখে আদ্রিশ রেগে গিয়ে বলল, ‘সমস্যা কী তোমার?’
রোজা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আমার তো কোনো সমস্যা নেই। আপনারই সমস্যা।’
আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো। রোজা কী বলতে চাইছে? ওর আবার কীসের সমস্যা থাকতে পারে? ভ্রুকুটি করেই সে রোজার কথার মর্মোদঘাটন করলো এবং চওড়া হাসলো। ওর হাসি দেখে রোজা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন? আমাকে দেখে কী হাসির পাত্রী মনে হচ্ছে?’
আদ্রিশ একটু থেমে বলল, ‘উহু, মোটেও না। তবে তুমি ভীষণ ইন্টিলিজেন্ট। ভাবনাচিন্তায় আমার থেকে বহুদূর এগিয়ে আছো। কিন্তু এটা নিয়ে আমি প্রাউড ফিল করছি না।’
রোজা প্রশ্ন করল, ‘মানে?’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘মানে আমি যে বিষয়ে এখনো কিছু ভাবিইনি; সে বিষয়টা নিয়ে তুমি অনেককিছুই ভেবে বসে আছো। রিল্যাক্স, এত হাইপার হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবকিছুরই একটা সময় আছে, অসময়ে সেটার অভ্যাস করতে চাই না।’
রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই আদ্রিশ ওর খুব কাছে এসে কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভোরবেলার প্রেম অস্বাস্থ্যকর হয় প্রিয়। নিজের ভাবনাগুলো সামলে রাখো, নয়তো অঘটন ঘটে যেতে পারে। সব কথার বড় কথা, আমি একজন পুরুষ মানুষ এবং সম্পর্কে তোমার বর হই। তাই নয় কী?’
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্রই রক্তিম আভায় লালায়িত হয়ে ওঠলো রোজার গাল। চারপাশের শব্দ যেন থেমে গেল। আসলেই তো, ও তো এক্ষুনি আদ্রিশকে নিয়ে উল্টাপাল্টা চিন্তা করে বসেছিলো। আর লোকটা তা বুঝেও গেলো। হায় ধরণী, দ্বিধা হও। রোজা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে নিলে আদ্রিশ ওর হাত টেনে ধরলো। ফলে ব্যালেন্স করতে না পেরে রোজা বিছানার ওপর পরে গেলো। আদ্রিশ খানিকটা রাগ নিয়ে ওকে হেডবোর্ডে চেপে ধরে বলল, ‘লাফাচ্ছো কেন তুমি? একটু রিল্যাক্স করতে পারছো না?’
রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। রাগী স্বরে বলল, ‘নিজেই তো বললেন সবকিছুরই একটা সময় আছে। এখন আপনিই এডভান্টেজ নিতে চাইছেন? দিস ইজ নট ফেয়ার। আমি রেডি নই। দয়া করে আমাকে যেতে দিন। এসব করা ভালো নয়।’
আদ্রিশ সন্দেহী চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানে? তুমি এখনো ওসব-ই মিন করছো?’
‘তা নয়তো কী?’
আদ্রিশ হতাশ হয়ে ওর কপালে হাত রাখলো। কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করে হাতটা সরিয়ে রোজার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো। তারপর বলল, ‘তোমার যে গতরাতে জ্বর এসেছিলো জানো তুমি? সারারাত তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম। জ্বর নেমেছে কিনা সেটা চেক করতেই তোমাকে বসতে বলেছি। আর তুমি উল্টাপাল্টা ভেবে আমার মাথা খাচ্ছো। অসুস্থ রোগীর সাথে রোম্যান্স করার কোনো মুড আমার নেই। আমার বাসর রাতটাই নষ্ট করে দিয়েছো তুমি।’
প্রথম কথাগুলো শুনে গিলটি ফিল হলেও আদ্রিশের শেষের কথাটা শুনে রোজা রেগে গেল, ‘সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কী বলেছি আমার সেবা করতে? আর বাসর রাতটা আপনার একার নয়, আমারও ছিল। আপনি দেরি করে এসেছেন বলেই সেটা নষ্ট হয়েছে।’
আদ্রিশ সেটা মানতে নারাজ। রোজাও নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। আদ্রিশ বলল, ‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ায় সেটা নষ্ট হয়েছে, আমার জন্য না। সহজ কথাটা মেনে নিলে তোমার জন্যই ভালো।’
রোজা এবার বেশ রেগে গেলো। আদ্রিশ অহেতুক ওকে কথা শুনাচ্ছে যেন সবটা দোষ রোজার। আর ও নিজে কিছুই করেনি। রোজা রাগী কন্ঠে বলল, ‘বেশ হয়েছে। ভালো করেছি।’
আদ্রিশ ভীষণ রেগে গেল, ‘আস্ত একটা বজ্জাত মেয়ে কোথাকার।’
রোজা আগুনে ঘি ঢালতে ঢেলে বলল, ‘এই বজ্জাত মেয়েকে বিয়ে করতেই তো মরিয়া হয়ে ওঠেছেন। আঙ্কেলের পায়ে পর্যন্ত ধরেছেন। ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না? আমি সব জানি। একটা ছ্যাঁ-ছ-ড়া লোক কোথাকার।’
আদ্রিশ মুখ কালো করে বলল, ‘বিয়েটা কী আমার একা হয়েছে? তুমি করো নি বিয়ে?’
রোজা বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দটি উচ্চারণ করে বলল, ‘আমি বাবা-মা’য়ের বাধ্য মেয়ে বলেই আপনার মতো ছ্যাঁ-ছ-ড়া লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।’
আদ্রিশ প্রতুত্তরে বলল, ‘তুমি যে মিচকা শ-য়-তা-ন্নী সেটা তো জানতাম না। তুমি নিজে থেকে ‘ভালোবাসি’ বলার পরই আমি আব্বুকে তোমার কথা জানাই। এখন সেসব অস্বীকার করছো?’
রোজা সেই মুহূর্তে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কখন আপনাকে ‘ভালোবাসি’ বলেছি?’
আদ্রিশ অধৈর্য নিয়ে রোজার মুখটা ওপরে তুলে রাগী স্বরে বলল, ‘কেন? নেহার বিয়ের দিন? ছাদে? বলো নি?’
রোজা স্বীকার করতে পারলো না। প্রসঙ্গটা এড়াতে বলল, ‘মনে নেই আমার। কিন্তু আপনিও সুবিধের লোক নন। নেহা আপুর এনগেজমেন্টের রাতে আমার সাথে যে ব্যবহার করেছেন, দিস ইজ নট ফেয়ার।’
বলেই থেমে গেল রোজা। সেনসেটিভ টপিক এড়াতে গিয়ে আবার এসব প্রসঙ্গেই অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢুকে গেছে সে। কিন্তু এবার আর আদ্রিশ রেগে থাকলো না, বরংচ শান্ত হয়ে গেলো সে। এরপর রোজাকে বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তারপর স্বপ্নালু চোখে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে তাকালো। ঘন নীলের সমাহারে অজানার উদ্দেশ্যে ওড়তে থাকা মেঘকুঞ্জের ধীরগতিতে ছুটে চলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার জীবনের প্রথম চু’মু ছিলো। অনিচ্ছাবশত, কিন্তু মধুর।’
রোজা আদ্রিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলো। কিন্তু ওর মুখ থেকে এ কথাটা শুনে অস্বস্তি নিয়ে বলে ওঠল, ‘এটা আমারও প্রথম চু’মু ছিলো। অনিচ্ছাবশত এবং জঘন্য।’
এই একটা কথাই আদ্রিশের প্রেমিক মনের ইতি টানার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সে রোজাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে ওঠে পড়লো। দেয়াল ঘড়িটা জানান দিলো এখন সকাল সাড়ে ছ’টা। টি-শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে আদ্রিশ ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। আর রোজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। আদ্রিশের না থাকার সুযোগে বিছানা, বালিশ, কম্বলগুলো ভাঁজ করে রাখলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো। একটু পর আদ্রিশ বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। এরপর রোজা নিজেও ফ্রেশ হতে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে রুমে আসতেই আদ্রিশকে দেখলো একটা কালো রঙের প্রস্ফুটিত গোলাপ হাতে আদ্রিশ ঘরে ঢুকছে। ফুলটা এতটাই আকর্ষণীয় যে ওটা ছুঁয়ে দেখতে রোজার খুব লো’ভ লাগলো। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। আড়চোখে ফুলটা দেখতে লাগলো। আচমকা আদ্রিশ এসে ওর দিকে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার জীবনে আসার জন্য অনেক ভালোবাসা তোমাকে। আজকের মতো প্রতিটি সকাল যেন তোমার সাথেই উপভোগ করতে পারি। তুমিই যেন সূর্যের প্রথম কিরণের মতো আমার জীবনে উজ্জ্বল আলো ছড়াও। তুমিই যেন আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা হও। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসো; এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি থাকতে পারি।’
রোজা ফুলটা হাতে নিয়ে ভাবুক কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু আমাদের জীবনের প্রথম সকাল তো ঝ’গড়া দিয়ে শুরু হলো।’
আদ্রিশের প্রেমিক মনটা আবারও আ’হত হলো। অসহায় দৃষ্টিতে রোজার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা ওর অনুভূতির সাথে ভালোই খেলা করতে পারে; ভেবেই আদ্রিশ গম্ভীর হয়ে ওকে জ’ড়িয়ে ধরে কপালে চু’মু খেয়ে বলল, ‘ঝ’গড়ার পর তো আরও বেশি করে ভালোবাসবো। তখন প্রতিটি সকালই আজকের মতো নতুন আর প্রেমময় হবে।’
এবার রোজা নিশ্চুপ রইলো। মুহূর্তটা উপভোগ করতে লাগলো সে, আদ্রিশের হৃদপিন্ডের মৃদু শব্দটা ওর বেশ ভালো লাগছে। এই শব্দগুলো নিশ্চয়ই মানুষের মনের অনেক অজানা কথাগুলো জানিয়ে দেয়। প্রকৃতির নীরবতা আর ওদের দু’জনের নিস্তব্ধতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু ঠিক তার পরেই দরজায় কে যেন ক্রমাগত আঘাত করতে লাগলো। রোজাকে ছেড়ে আদ্রিশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে ফিহার গলা শোনা গেল, ‘তোমরা উঠেছ ভাইয়া? তাহলে ব্রেকফাস্ট করতে এসো। সবাই তোমাদের অপেক্ষা করছে।’
আদ্রিশ ‘আসছি’ বলে যে-ই না ফিরতে যাবে তখনি ফিহার পেছন থেকে উৎস জিজ্ঞেস করল, ‘জীবনে প্রথমবার বাসর রাত পালন করেছ। কী’রকম অনুভূতি হচ্ছে তোমার ভাই?’
—————————————————————————–
[…