অনুভব পর্ব ১

বাসর ঘরে ঢুকতেই অর্ণব দেখল তার সদ্য বিয়ে করা বউ সারা রুমময় ছুটে বেড়াচ্ছে বিয়ের শাড়ি পরেই৷ অনেকটা জগিং করার মতন করেই দৌড়াচ্ছে৷ গয়না একটার সাথে আরেকটা বাড়ি লেগে ঝুনঝুন, টুংটাং শব্দ হচ্ছে। আসলে শরীর গরম করার জন্য এমন উপায় বেছে নিয়েছে মেহুল। বাসর ঘরে দাঁত ভাঙ্গা শীতের মধ্যেও নাকি লেপ কম্বল এসব কিছুই দেওয়া হয় না…. এমন আজব নিয়ম মেহুল কোথাও দেখে নি। বিয়ের শাড়ির উপরে পাতলা এক চাদর জড়িয়ে ঠকঠকিয়ে কেঁপে যাচ্ছিল লাগাতার৷ ফর্সা গাল লাল হয়ে গিয়েছে অনেকখানিই কিন্তু মেকাপের ঝলকানিতে হয়ত বোঝা যাচ্ছিল না৷ তাই উপায় না পেয়েই মেহুলের এমন উপায় বের করে নিয়েছে। অর্ণবের খোলা মুখ যেন আরো খুলে যেতে লাগল। কিছু না বলেই অর্ণব হালকা কাশি দিল, কাশির শব্দ শুনে মেহুল দৌড় বন্ধ করে দুই হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলল,
___ ” আসলে খুব শীত করছিল তো তাই দৌড়াচ্ছিলাম আর কি?”
___ ” শীত লাগলে দৌড়াতে হয় এমন কথা আমি আগে কখনও শুনি নি “।
অনেকটা রোবটিক স্টাইল কথাটা বলেই অর্ণব ড্রেসিং টেবিলের কাছে চলে গেল হাত ঘড়িটা খুলতে খুলতে। মেহুল মুখ বাঁকা করে ফেলল অর্ণবের কথার স্টাইল দেখে, এমন যন্ত্রের মতন কেউ কথা বলে! অর্ণব হাত ঘড়ি খুলে রেখে একটা টাওয়াল নিয়ে ঢুকল ওয়াশরুমে, মেহুল ততক্ষনে খাটের উপরে বসেছে। মনে মনে মেহুলের খুব রাগ হতে লাগল ওর বাবাই এর উপরে, এক কুড়ি ছেলে বেছে শেষ পর্যন্ত বিয়ে দিল এই রস কষ সিঙ্গাড়ার সাথে। বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে আশপাশ দেখতে লাগল ও। রুমের সাইজটা মাশাল্লাহ ছোট একটা ফুলবলের মাঠের মতন। বিশাল এক কিং সাইজের বেড আছে রুমটায় কাপড় রাখার ক্লোজিটটা পশ্চিম পাশের পুরোটা দেওয়াল জুড়ে, খাটের মাথার কাছে অর্ণবের সোল্ড অফ অনার নেওয়া দৃশ্যটা ক্যামোফ্লাজ করে বাঁধাই করে টানিয়ে দেওয়া। সোফা আছে দুটো আর আছে বই আর বইয়ের শেল্ফ। এটাই সবচেয়ে ভাল লেগেছে মেহুলের প্রচুর প্রচুর বই আছে যেটা ওর সবচেয়ে বেশি পছন্দের জিনিস।

অর্ণব বের হতেই মেহুল আড়চোখে তাকালো ওর দিকে, বটল গ্রীন টিশার্টের নিচে চেক ট্রাউজার । বেশ ভালই মানিয়েছে। মেহুল মনে মনে বলল, ” না বরটা আমার মাশাল্লাহ দেখতে শুনতে সেই, এখন গুরু দ্বায়িত্ব হল এই গাধারে পিটায়ে মানুষ বানাতে হবে”। অর্ণব মুখ মুছতে মুছতে বলল,
___ ” অনেক রাত হয়েছে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো।”
___ ” একটা হেল্প করতে পারবেন”।
মেহুল বেশ নিরুপায় স্বর করে বলল৷ অর্ণব বেশ অবাক হয়েই মেহুলের দিকে তাকালো। ধীর গলায় বলল,
___ ” হুম বলো কি হেল্প?”
___ ” আপনার একটা টিশার্ট ধার দিতে পারবেন! আসলে আমি রাত্রে টিশার্ট পরা ছাড়া ঘুমাতে পারি না, আর আপনাদের এখানে বেড়াতে আসার সময় এক্সচুয়ালি মনে নেই টিশার্ট ব্যাগে ঢুকাতে।”
একশ্বাসে মেহুল কথাগুলো বলে থামল। অর্ণবের মাথা যেন ভোঁ চক্কর দিতে শুরু করল, প্রথমত বউ বাসর ঘরে দৌড়াচ্ছিল, তারপর চাচ্ছে টিশার্ট তার উপরে আবার বলতেছে এবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। আল্লাহ এ কি দেখে মা বিয়ে করাল ওকে, এ মেয়ে নাকি কোম্পানির জি এম আচ্ছা মেয়ে বদলে যায় নি তো আবার। না তো তা কি করে হয় ছবি আর আসল মানুষ সেইমই তো মনে হচ্ছে। এসব চিন্তা করতে করতে অর্ণবের মাথা ঘুরানি আরো বেড়ে গেল৷ মেহুল বেশ অবাক হয়ে বলল,
___ ” মেজর সাহেব আমি তো খালি টিশার্ট চেয়েছি, আপনি তো মুখের অবস্থা এমন করেছেন যেন আপনার ডান পাশের কিডনী চেয়ে ফেলেছি।”
___ ” না তেমন কিছুই না আমার টিশার্ট তো তোমার অনেক বড় হবে।”
___ ” ওতে দোষ হবে না আপনি দেন মেজর সাহেব।”
___ ” আমি মেজর না সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। ”
অর্ণব মুচকি হেসে বলল। মেহুল এবার স্বশব্দে হাসতে হাসতে বলল,
___ ” যে লাউ সেইই কদু, আমি তো মেজর সাহেবই বলব।”
অর্ণব আর কথা না বাড়িয়েই টিশার্ট বের করে মেহুলের হাতে দিল। মেহুল দুহাতে শাড়ি উঁচিয়ে সোজা চলল ওর কাপড়ের ট্রলির কাছে। খুঁজে খুঁজে ট্রলি থেকে একটা স্কার্ট বের করে নিয়ে চলল ওয়াশরুমের সামনে। তারপর গা থেকে গয়না খুলতে খুলতে ও অর্ণবকে বলল,
___ ” আপনি একটু রুম থেকে বের হন তো।”
___ ” মানে?”
অর্ণব চূড়ান্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। এবার মেহুল বেশ লজ্জায় পড়ে গেল। গালের চারপাশে রক্তিম আভা জমতে শুরু করল। কিন্তু আপায় উপায় না পেয়ে বলেই ফেলল,
___ ” শাড়ি খুলবো, ওয়াশরুমে খুললে ফ্লোরে পড়ে ভিজে যেতে পারে। ”
অর্ণব বেশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষনে ওর বোঝা হয়ে গেছে এতো মেয়ে না আস্ত একটা বোমা। যখন যেখানে খুশি ফাটতে পারে। অর্ণব আর কথা না বাড়িয়েই সোজা চলে গেল রুমের বাইরে। বাসার ড্রইংরুমে তখনও তুমুল আড্ডা চলছে, সাথে আছে ছোট ফুফুর হাতের জম্পেশ চা। অর্ণবের একবার মনে হল ও নিচে যেয়ে সবার সাথে আড্ডা দেবে।পরক্ষনেই আইডিয়া ক্যান্সেল করে দিল। কারণ হোক না হোক আজকে ওর বাসর রাত। এখন নিচে গেলে শুধু হাজার না কোটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ওকে। আর সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে দিদুনকে নিয়ে। তার মুখের ভাষা শুনলে কানের পোকা পর্যন্ত পড়ে যায়। অর্ণব বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়াবি এক মেয়ের মুখচ্ছবি সেইখানে। ওর মুখের চোয়ালটা আরো শক্ত হয়ে গেল ছবিটা ডিলিট করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বেশকিচ্ছুক্ষন। এর মধ্যে হঠাৎই পিছন থেকে অর্ণবের ছোট ফুফু বেনুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, মানে ছোট ফুফু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। অর্ণব এই শীতের মধ্যেও ঘামতে লাগল, ছোট ফুফু যদি এই অবস্থায় অর্ণবে রুমের বাইরে দেখেছেন তো কালকে সকালে আর মুখ দেখাতে হবে না কাউকেম প্রত্যেকের মুখে মুখে রসালো কাহিনী থাকবে। ও উপায় না পেয়ে দরজায় টোঁকা দিল কয়েকবার কিন্ত ভেতর থেকে কোন সাড়াই নেই। এবার ছোট ফুফু আসে আসে তার আগেই ও দরজার লক ধরে মোচড় দিতেই লক খুলে গেল।

মেহুল ওর পাতলা চাদরটা গায়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শীতে বারেবার কেঁপেকেঁপে উঠছে। অর্ণব এসিটা ওয়ার্ম মুডে দিয়ে বারান্দায় যেয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে সাথে নিজের কষ্টটুকুও উড়িয়ে দেয়। ওর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না এতকিছুর পরেও বিয়ে করে ফেলেছে। আর কারো জন্য না দিদুনের জন্য মেহুলকে না দেখেই ও বিয়ে করেছে, না হলে হয়ত এ জীবনে বিয়ে নামক জিনিসটা ওর লাইফেই আসত না। ঘরের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় দুটো ছুঁই ছুঁই করছে ঘড়ির কাঁটাটা। বারান্দায় রাখা এশট্রেতে সিগারেটের পোড়া অংশটুকু গুঁজে দিয়ে রুমে আসতেই অর্ণবের চোখ পড়ল ঘুমন্ত মেহুলের মুখের দিকে। বেশ অবাক হয়েই মেহুলের দিকে তাকিয়ে রইল ও। এত এত মেকাপ করেছিল মেয়েটার মুখে যে আসল সৌন্দর্য্যটুকু বোঝাই যাচ্ছিল না। গোলগাল ফর্সা ধবধবে মুখের বাঁপাশের গালে বেশ বড় একটা তিল। চোখ দুটো বুজে আছে তারপরও যেন মনে হচ্ছে টলটলে দীঘির পানিতে ভাসতেছে। মেয়েটার পাতলা ঠোঁটে এখনও লিপস্টিক লেগে আছে। ঠোঁটগুলো দেখলেই মন চায় একটু ছুঁয়ে দিতে।অর্ণবের টিশার্টটা পরে ঘুমিয়েছে মেহুল কিন্তু অনেক বড় হয়েছে ওর। প্রায় হাঁটুর কাছে নেমে এসেছে, হাতা গুলো কনুই ছুঁইছুঁই করছে। বাচ্চাদের মতন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এবার অর্ণবের একটা বেশ ভালই সমস্যা হল, ও ওর বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারে না মোটেও আবার মেহুল বিছানায় শুয়ে আছে। কি করবে কি না করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। অর্ণব মনে মনে ভাবল বিছানা তো অনেক বড়, এক পাশে শুয়ে পড়ে মাঝে কোল বালিশ দিলে সব সমস্যাই মিটে যাবে। অর্ণব মাঝে কোল বালিশ দিয়ে আস্তে করে চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল ওর চোখে। প্রচুর পরিশ্রম গিয়েছে এই কয়েকদিনে ওর। তাই নিদ্রাদেবী চোখেভর দিতে বেশ সময় লাগল না।

পরের দিন সকালে অর্ণবের ঘুম ভাঙ্গতেই ও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইল। ঘুম ভেঙ্গেছে একটা কারণে কিন্তু কি কারণ সেটাই ও বের করতে পারছে না। চোখ মেলে পাশে তাকাতেই ওর বুকের ভেতর কে যেন জোরে খামচে ধরার অনুভূতি হল। ও দেখল…..

চলবে
অনুভব
পর্ব ১
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here