অনুভব
৫ম পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর
চোখের সামনেই এসে হাজির হল কুচকুচে একটা কালো বিড়াল৷ মেহুল আর অর্ণব দুজনেই বেশ বিব্রত হল, সাধারণ কালো বিড়ালকে অমঙ্গলের প্রতিক হিসাবে ধরা হয়। তাই বিড়ালকে হঠাৎ সামনে দেখে দুজনেই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল।অর্ণব এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
___ ” বিড়ালটা সামনে আসার আসার আর সময় পেল না।”
___ ” বিড়াল তো আর আর্মির ট্রেনিং করে নাই যে তার সময় জ্ঞান সেই লেভেলের হবে। ”
মেহুল কাঁধের ব্যাগটা হাতে নিয়ে চলল সামনের দিকে। বর্ডারের ইমিগ্রেশন এর ফর্মালিটিজ শেষ করে ওরা রওনা হল ওদের গন্তব্যের উদ্দ্যেশে। অর্ণব আর মেহুল যখন SNT তে পৌছালো তখন প্রায় সকাল দশটা বেজে গেছে। মেহুল চোখ কুঁচকে বলল,
___ ” আচ্ছা আমরা এখানে থামলাম কেন?”
___ ” বেগম সাহেবা যেখানে যাচ্ছি ওইটা তো আমার শশুরের এলাকা না যে পারমিশন ছাড়াই চলে যাব। তাই এখানে এলাম পারমিশন নিতে। আর হ্যাঁ ওয়েলকাম টু গ্যাংটক “।
মেহুলের খুব আগ্রহ ছিল সিকিম গ্যাংটকে যাওয়ার, তাই বিয়ের কথা ঠিক ঠাক হতেই যখন হাসনাহেনা বানু ওকে জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যেতে চায়। তখম মেহুল নির্দ্বিধায় বলেছিল গ্যাংটক যেতে চায়। সেজন্যই হানিমুনে এখানে আসা। রাস্তার দুধারে বাজারে হরেক রকম পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। আকাশের রঙটা খুব ঘোলাটে। যেন এখনই বৃষ্টি নামবে ঝুপঝুপ করে। কিন্তু এটা মেঘ না কুয়াশার আস্তরন। মেহুল আরক শুনেছে সকালের প্রথম সূর্যর আলো যখন বরফ ছুঁয়ে যায় তখন চারিদিকে এক অদ্ভুত আলোর সৃষ্টি হয়। মেহুলের খুব ইচ্ছা সেই আলোর খেলাটা দেখার।
সিকিমে ঢোকার ইনার পারমিট নিয়ে ওদের গাড়ি যখন আবার ছাড়লো তখন প্রায় তিনটা বেজে গেছে দুপুরের। হোটেল থেকে ওরা খেয়ে একটু রেষ্ট করে নিয়েছিল। অর্ণব চুপ করে বসে ঘোলা আকাশ দেখছিল আর বিরক্ত হচ্ছিল, কেমন জানি মরা মরা প্রকৃতি। মেহুল পিছন থেকে এসে অর্ণবের চোখ চেপে ধরতেই ওর নাকে এসে লাগল মিষ্টি সুবাসিত এক ঘ্রাণ। হাত ছাড়িয়ে ঘুরতেই অর্ণবের চোখে পড়ল মেহুল খিল খিল করে হাসতেছে। হাসির দমক সামলাতে সামলাতে বলল,
___ ” মেজর সাহেব, এত বিরক্ত কেউ হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার নাম অর্ণব আহমেদ না হয়ে বিরক্ত আহমেদ হওয়া উচিত ছিল….। ”
___ ” একটু লেট হয়ে গিয়েছ, আমার জন্মের পরে আকিকা দেওয়ার আগে যোগাযোগ করা উচিত ছিল তোমার। তাহলে হয়তো নাম চেঞ্জ করতে পারতে।”
অর্ণব শান্ত স্বরে উওর দিল। মেহুল জবাবে কিছুই না বলে শুধু হাসতেই থাকল। মেহুল হাসলে যেন ওর সাথে চারপাশের প্রকৃতিও হাসতে থাকে। অর্ণবের মনে হল আকাশ দেখার চেয়ে মেহুলের হাসি দেখা অনেক শ্রেয়।
গাড়ি আবার ছাড়তেই ওদের চোখে পড়ল পাহাড়ের সারি। একপাশে খাড়া পাহাড় অন্যপাশে খাড়া ঢাল। মেহুল একটু পর পর আঁতকে উঠতে লাগল খাড়া ঢাল দেখে। ওদের গাড়ির ড্রাইভার এই সিকিমেরই বাসিন্দা,নাম সিধু পোখরা। মাথায় সিকিমের ঐতিহ্যবাহী টুপি। অর্ণব ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা হিন্দি মিলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
___ ” দাদা বাড়ি কই।”
___ ” দেখেন আপনি উনারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লীজ। আপনার হিন্দি শুনে উনি এক্সিডেন্ট করতে পারেন।”
গাড়ির গদি খাঁমচে ধরে বলল মেহুল। অর্ণব বেশ লজ্জা পেয়েই চুপ করে রইল। র্যাংপোতে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল ওদের। তখন শীত খুব জাকিয়ে বসেছে। ওখানে পাসপোর্টে আরো কিছু সিল নিয়ে আবার রওনা হল। যখন গ্যাংটকের এমজি মার্গ এ ওদের হোটেলে এসে পৌছালো আটটা বেজে গেছে ততক্ষনে। আগারওয়াল সুইট লজে ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ড্রাইভার। অর্ণব মাফলারটা আরো উপরে উঠিয়ে নাক মুখ ঢেকে নিয়ে বলল,
____ ” হানিমুনের শখ বের হয়ে গেছে আমার। বাপরে কি শীত।”
___ ” শীতের মজা ভয় পেয়ে না উপভোগ করে নিতে হয়। ”
মেহুল অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বলল।
___ ” কথায় পেট ভরবে না চলো হোটেলে যাই। এখানে থাকলে শীতে কাত হয়ে যেতে হবে।”
ট্রলি টেনে হোটেলের উপরের সিঁড়িতে পাড়া দিল। মেহুক আর অর্ণবকে হোটেলের একজন স্টাফ নিয়ে এলো চার তালায়৷ দরজা খুলেই যেন মেহুল আর অর্ণব অবাক হয়ে গেল। সারারুম ফুলে ফুলে সাজানো, মোমবাতি গুলো সুগন্ধ ছড়িয়ে জ্বলছে মৃদু আলো করে। ধবধবে সাদা চাদরের খাটের মাঝে গোলাপের লাল পাঁপড়ি দিয়ে লাভ শেপ ডিজাইন করা। স্টাফ বলল,
___ ” স্যার ম্যাম আপনাদের বুকিং হানিমুন অফারে করা ছিল তাই আমাদের এই ছোট্ট ডেকোরেশন। ”
দুজনেই বেশ লজ্জা পেল এবার। রুমের দরজা আটকিয়ে লাইট অন করল অর্ণব। মেহুল বিছানায় শুয়ে পড়ল ফুলের পাপড়ির উপরে।
___ ” তুই শিওর”।
ঝিলমিল এক মাথা চুলের মধ্যে হাত বুলাতে বুলাতে বলল। শাওন চোখ টিপ দিয়ে বলল,
___ ” একদম শিওর। অর্ণবের বউটা নাকি সেই লেভেলের সুন্দরী। যাকে বলা যায় কাঁচকাটা সুন্দরী।”
___ ” জানিস শাওন কাঁচ কাটে কি দিয়ে? কাঁচ কাটা যায় হীরা দিয়ে, আর সেই হীরাটা হলাম আমি।”
ঝিলমিল ক্রুর এক হাসি দিয়ে বলল। শাওন এবার বেশ অবাকই হল,
___ ” দেখ ঝিলমিল অর্ণবকে থাকতে দে ওর মতন, কেন ঝামেলা পাকাচ্ছিস তুই।আর এটাও তুই ভাল করেই জানিস অর্ণব কখনও আর ভালবাসবে না”।
___ ” ওর ভালবাসা চায়টা কে? আমি জাষ্ট ওকে চাই। আর হ্যাঁ আমাকে এত জ্ঞান না দিয়ে যা করতে বলেছি সব কিছু ঠিকঠাক মতন যেন করা হয়।”
শাওন যেন এই ঝিলমিলকে চিনতেই পারল না। উন্মাদের মতন করতেছে মেয়েটা। কিছু না বলে শাওন বেরিয়ে গেল ঝিলমিলের রুম থেকে। ড্রইংরুমে বসে ছিলেন আতিক সাহেব, উনি শাওনের দিকে তাকিয়েই বললেন,
___ ” পারলে না তো বুঝাতে, আমিও পারি নাই। কি যে করব কি করব না আমি বুঝতেছি না।”
___ ” আংকেল ওকে ওর মতন থাকতে দেন। ”
___ ” দিয়েছি বাবা, কিন্তু আমি জানি মেয়েটা দিন যাচ্ছে আর ভয়ংকর হয়ে উঠতেছে।”
শাওন চুপ করে রইল কথাটা যে সত্যি সেটা ও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। খুব ইচ্ছা করতেছে শাওনের সব কথা অর্ণবকে বলতে। যে কি ভয়াবহ বিপদ আসতেছে ওর জন্য। কিন্তু ও একদমই চাচ্ছে না ঝিলমিলের কুটিল নজরে পড়তে।
সকালের সূর্যের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ো অর্ণবের মুখের উপরে। চোখ খুলতেই ওর সামনে এসে পড়ল সূর্যের মিষ্টি মোলায়েম আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা মেহুল৷ ধীর পায়ে অর্ণবের পাশে এসে বসে হাতে থাকা ধোঁয়া উঠা কফির মগটা এগিয়ে দিল। অর্ণবের কেন জ্যনি না খুব ইচ্ছা করল মেহুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না.। মেহুল অর্ণবের ঘাড়ে মাথা লাগিয়ে ওর বুকের উপরে হাত দিয়ে বলল,
___ ” অনেক অনেক ধন্যবাদ, আমাকে এত সুন্দর এক সকাল উপহার দেওয়ার জন্য।”
অর্ণবের মনের মধ্যে যেন বাঁশির সুর বেজে উঠল। মেহুলের সেই মাতাল করা কথা যেন ওর মনের মধ্যে সুরের রেশ ধরিয়ে দিল৷ কিন্তু সেই রেশ কেটে গেল ফোনের রিংটোনের শব্দে। মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিতেই অর্ণবের যেন…….
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর