অনুভূতি
পর্ব ৩৫
মিশু মনি
.
৫৪.
রাস্তায় একটা মেয়ে মরে পড়ে আছে। উলটা হয়ে শুয়ে আছে, বাম হাতটা গায়ের নিচে পড়েছে। কেমন যেন ভয় লাগছে দেখলেই। মেয়েটার সামনে লম্বা ঘন চুল বিস্তৃত হয়ে আছে। চুল দেখে সেটা মুখ নাকি পিঠ বোঝার উপায় নেই। দেখলেই ভয় লাগছে।
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “তুমি বসো আমি দেখে আসি।”
মিশু ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো, “না,আমি তোমাকে যেতে দিবো না। অন্য কেউ যাক।”
মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাচ্চাদের মত করোনা। আমি দেখে আসি। আরাফ, পূর্ব তোরাও চল।”
মিশু ও রোদকে লেগুনায় বসিয়ে রেখে ওরা সবাই নেমে পড়লো। লেগুনার ড্রাইভার ও নেমে পড়লো। সবাই টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। অনেক সময় এরকম দূর্গম নির্জন রাস্তায় বিপদের ফাঁদ ও ফেলে রাখা হয়। সেরকম কিছু কিনা বুঝতে পারছে না কেউ। সবার মধ্যে মেঘালয় একটু বেশি সাহসী। ও সবার আগে আগে যাচ্ছে। বাকিরা পিছনে। মিশু মাথা বাড়িয়ে দেখছে সামনে তাকিয়ে। মেয়েটির কাছে যাওয়ার পর মেঘালয় বসে উপুড় হয়ে ভালোভাবে দেখে বললো, “এর তো কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি। একদম নিঁখুত। কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে নাকি?”
সবাই এসে উপুড় হয়ে দেখতে লাগলো। সত্যিই মেয়েটির গায়ে কোনো ক্ষত নেই, আর রাস্তায় ও কোনো রক্ত নেই। মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেনি করেনি এটা নিশ্চিত। তবে কি হয়েছে? মেঘালয় মেয়েটির হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করে বললো, “একদম সুস্থ স্বাভাবিক। বোধহয় সেন্সলেস হয়ে গেছে।”
মেয়েটিকে ওরা সবাই মিলে ধরাধরি করে এনে লেগুনায় বসিয়ে নিলো। মেয়েটির হাত পা একদম ঠাণ্ডা বরফের মত হয়ে গেছে। মুখ থেকে চুল সরিয়ে দেখলো ফুটফুটে রূপবতী একটি মেয়ে। চেহারায় চাঁদের আলো ঝিকমিক করছে। সবাই ইমপ্রেসড তার রূপ দেখে!
মিশু প্রথমেই বললো, “জিন্স ও টপস না পড়ে শাড়ি পড়লে একে যা লাগতো না!”
মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “এরকম অবস্থায় একটা মানুষ কে দেখে তোমার শাড়ি পড়ানোর কথা মনে পড়লো?”
– “শুধু শাড়ি না, আরো অনেক কিছুই মনে পড়ছে। একে সব রঙের শাড়িতে মানাবে না। একদম ধূসর, ছাই কালার, কচি কলাপাতা রঙ এসবে মানাবে। কমলা রঙ ভালো শুট করবে।”
– “হয়েছে এবার এর সেবা যত্ন করো।”
মেঘালয় মিশু ও রোদের মাঝখানে মেয়েটিকে বসিয়ে দিলো। বোতল থেকে পানি ঢেলে ওর মুখে ছিটিয়ে দিলো। মিশু ও রোদ মেয়েটিকে চাদরে ঢেকে দিয়ে হাত পা মালিশ করতে লাগলো। ওদের উত্তাপে আর পানির স্পর্শে চোখ মেলে তাকালো সে। চোখ বড়বড় করে বললো, “চলে গেলো, চলে গেলো।”
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি চলে গেলো?”
– “আমার গাড়ি চলে গেলো।”
বলেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেললো। সবাই একদম হতভম্ব! সায়ান বললো, “এরকম ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করো কেন? কাঁদলে ভালো করে কাঁদো।”
মেয়েটি সায়ানের বুকে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, “ইউ বেয়াদব। আমি ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করি? আমি ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করি?”
সবাই আবারো থ। সায়ান বুক চেপে ধরে বলল, “মেয়ে মানুষ না দজ্জাল? এভাবে কেউ ঘুসি মারে? আমিও একটা মারি দেখো তো কেমন লাগে?”
সবাই মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটি অ্যাঅ্যা করে কেঁদে দিলো। আরো হাসি পাচ্ছে সবার। সায়ান বললো, “সরি। কাঁদেনা মধুর মা, কাঁদেনা।”
মেয়েটি চোখ মুছে উৎসুক হয়ে বললো, “আমার বাপের নাম মধু আপনি কিভাবে জানলেন?”
সবার হাসি পাচ্ছে। মিশু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো মেয়েটিকে পেয়ে। দারুণ একটা মেয়ে তো। কথায় কথায় ভ্যা ভ্যা করে কাদে। মিশুর কান্না পেলেও কখনো এরকম ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিতে পারেনা। মেয়েটি একটু এক্সট্রা কিউট!
ও বললো, “কে তুমি নন্দিনী? রাস্তায় মরে পড়ে ছিলে কেন?”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বললো, “আমি মরে পড়ে ছিলাম? আমাকে কেন মরা মানুষ বলছো অ্যাএএএএএ..”
সবাই হেসে উঠলো। লেগুনা ছেড়ে দিয়েছে। মিশু মেয়েটির চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদেনা বাবুটা। একদম কাঁদেনা। কাঁদলে তোমাকে ভালো দেখায় না। হাসবে, তাহলে সুন্দর দেখাবে।”
মেয়েটির বোধহয় বিশ্বাস হলো মিশুর কথা। ও বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। আর কাঁদবো না। কিন্তু আমার লেগুনায়ায়ায়ায়া…”
– “কি হয়েছে লেগুনার?”
– “আমি ট্যুরে এসেছিলাম। আমার গাড়ি আমাকে ফেলে চলে গেছে..”
– “গাড়ি কিভাবে চলে যায়? তুমি খেয়াল করোনি?”
মেয়েটি বললো, “আমি ঝরনায় গোসল করে ভেজা কাপড়ে যাবো কিভাবে ভাবছিলাম। সেজন্য একটা থামি কিনে নিয়েছিলাম। থামিটা পড়ার জন্য বাথরুমে ঢুকেছিলাম। বের হয়ে গিয়ে দেখি লেগুনা ছেড়ে চলে গেছে। আমার ভ্যানিটিব্যাগ ওদের সাথেই গেছে। আমার কাছে ফোন ও নাই। আর ওদের কারো নাম্বার আমার মুখস্থ ও নাই। আমি লেগুনার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারিনা।”
মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে এই কথা। আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি মরা লাশ।”
মেয়েটি আবারো ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো, “আমাকে লাশ বলছো কেন বারবার? তোমরা খুব খারাপ।”
মিশু বললো, “আমি খুব ভালো। শোনো, তোমার ভয়ের কিছু নেই। সিলেটে ফিরে তোমার হোটেলে তোমাকে রেখে আসা হবে। টেনশন করোনা একদম।”
– “হ্যা, তুমি খুব ভালো। লক্ষী একটা মেয়ে। আমার খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দিবা?”
সায়ান বললো, “নির্লজ্জ মেয়ে। বসতে দিলে শুইতেও চায়। ঘুষি মেরে আবার খাবার চাচ্ছে হুহ।”
মেয়েটি রেগে বললো, “আমি কখন শুতে চেয়েছি? আপনি চরম বেয়াদব একটা ছেলে। সবার থেকে বেয়াদব। আরো একটা ঘুষি দেয়া দরকার আপনাকে।”
– “আমি বেয়াদব? থাপ্পড় খাবা মেয়ে ”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কান্না করে দিলো। মেঘালয় বললো, “সায়ান রাগিস না। ও বাচ্চা মেয়ে। আমাদের দলে আরো একটা বাচ্চা যোগ দিলো।”
মেয়েটি বললো, “আমাকে দেখে কোন এংগেল থেকে আপনার বাচ্চা মনেহয়? সবকিছুর সাইজ বড়দের মতন। আপনি আমাকে বাচ্চা বলছেন কেন? আপনি ও বেয়াদব।”
মেঘালয় এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “এই মেয়ে, সাহস তো কম না। আমাকে বলো বেয়াদব। চেনো আমাকে?”
– “আপনি আবার কোন থানার চৌকিদার?”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মেঘালয় রেগে বলল, “মামা লেগুনা থামান তো। একে নামিয়ে দেন। এই মেয়ে নামো, নামো লেগুনা থেকে।”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কান্না করতে করতে বললো, “আপনি সত্যিই খুব খারাপ। চরম বেয়াদব একটা ছেলে। আমার মতো অবলা মেয়েকে লেগুনা থেকে নামিয়ে দিচ্ছেন। রাত হয়ে গেছে, কত রকম বিপদ আপদ হতে পারে। আপনাদের বিবেকবোধ বলতে কিচ্ছু নাই।”
মেঘালয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ওকে গাড়িতে তুলে আনা হলো ভালোর জন্যই। আবার এসব বলছে! আজব। মেয়েটির মাথায় গণ্ডগোল নেইতো? নাকি নিতান্তই বাচ্চামেয়ে?
মেঘালয় বললো, “তোমার মত কচি খুকিকে কে ট্যুরে নিয়ে এসেছিলো? নাক টিপলে দুধ বের হবে।”
মেয়েটি রেগে বললো, ‘আপনি শুধু বেয়াদব ই নন,চরম মূর্খও। কি টিপলে কি বের হয় তাও জানেন না। নাক টিপলে দুধ বের হবে কিভাবে? নাক টিপলে সর্দি বের হবে।”
সবাই থ! এবার আর কারো মুখে কোনো কথা বের হলোনা। উত্তরে কি ই বা বলা যায়? মেয়েটি বাচ্চাদের থেকেও ছোট কিছু থাকলে সেটাই। ন্যাকা,একে কিছু বলা যায়না।
মেয়েটি বললো, “আপনার মত ছেলেদের কক্ষনো বিয়ে হবেনা। মেয়েদেরকে সম্মান দিতে জানেন না, অবলা মেয়েকে লেগুনা থেকে নামিয়ে দিতে চান,থাপ্পড় দিতে চান। এজন্যই আপনারা গার্ল ফ্রেন্ড পান না।”
মেঘালয় ক্ষেপে গিয়ে একটা হেচকা টান দিয়ে মিশুকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলো। মেয়েটি মিশুর হাত ধরে বলল, “তুমি এই খারাপ লোকটার পাশে বসবেনা।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। মেঘালয় কাছে টানলে মিশুর না গিয়ে উপায় আছে? মিশু মেঘালয়ের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। মেঘালয় মেয়েটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে মিশুর কাঁধে মাথা রেখে ওর গালের সাথে গাল ঘষতে ঘষতে বললো, “আই লাভ ইউ মিশমিশ।”
মিশু মেঘালয়ের মুখ ধরে বললো, “আই লাভ ইউ টু মেঘমনি।”
মেয়েটি খুব ক্ষেপে গেলো। রেগে রেগে বললো, “তোমরা সবাই খারাপ। বাজে ছেলে মেয়ে। গাড়ি থামাও,আমি নেমে যাবো।”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সবাই ভালো করেই জানে এই রাস্তায় পিচ্চি মেয়েটি কখনোই নামবে না। তবুও বলা যায়না। যেরকম মেয়ে, নেমে যেতেও পারে। মেঘালয় বললো, “মামা লেগুনা থামান তো।”
মামা লেগুনা দাড় করালেন। মেঘালয় বলল, “নামো যাও। নেমে যাও গাড়ি থেকে।”
মেয়েটি নেমে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো যতদূর চোখ যায় শুধু জংগল আর জংগল। আর ঝিঝির ডাকে ভৌতিকতা বিরাজ করছে সবখানে। ও ভয়েই লাফিয়ে উঠে লেগুনায় উঠে বসে বললো, “না নামবো না। আপনাদের সাথে যাবো। এখানে নামলে আমাকে ভূতেরা চিবিয়ে চিবিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে।”
সবাই হেসে উঠলো শব্দ করে। মেঘালয় গায়ের উপর চাদর টেনে নিয়ে একই চাদরের ভেতর দুজন ঢুকে দুষ্টুমি, খুনসুটি করতে লাগলো। বাইরে থেকে কিছু বোঝা না গেলেও ওদের মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি দেখে ঠিকই অনুমান করা যায়। কেউ কিছু মনে করলো না। সবাই নিজেদের মতন ফোন টেপাটিপিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেয়েটি একাই একটা চাদর গায়ে দিয়ে মুখ গোমরা করে বসে আছে। বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয় আর মিশুর দিকে। আর রীতিমত ক্ষেপে যাচ্ছে।
মেঘালয় মিশুর কানেকানে ফিসফিস করে নানান কথা বলে তারপর মিশুও ফিসফিস করে জবাব দেয়। মেয়েটি দেখতে দেখতে ক্ষেপে যাচ্ছিলো।ওর একদম অসহ্য লাগছে মিশু ও মেঘালয়কে। মেয়েটি ক্ষেপে মিশুকে বললো, “এই ছোট মেয়েটা, তুমি এত বেহায়া কেন? এভাবে বড়দের সামনে এরকম প্রেম করছ লজ্জা করছে না?”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হা করে তাকাল। মিশুও হতভম্ব। সায়ান বললো, “ওরা হানিমুনে এসেছে। এখন ওদের মধুচন্দ্রিমা। ওরা প্রেম করবে না তো আমরা প্রেম করবো?”
মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বললো, ” ও আচ্ছা। এইটুকুন বাচ্চাকে বিয়েও দিয়েছে! মূর্খ গার্ডিয়ানস।”
সবাই থতমত খেয়ে গেলো। মেয়েটি বারবার বেয়াদব, মূর্খ, বেহায়া, এই টাইপের গালি দিচ্ছে। সমস্যা কি ওর? মেঘালয়কে চরম বেয়াদব বলায় মিশুর খুব রাগ হয়েছিলো। পুঁচকে মেয়ে বলে কিছু মনে করেনি। তবে সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। হাস্যকর লাগছে ওর কথা বলার স্টাইলটা। বাচ্চাদের মতন করে কথা বলে।
মেয়েটি বললো, “কার কার বিয়ে হয়েছে?”
সায়ান মেঘালয়কে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওরা দুজন বাদে আমরা সবাই সিংগেল।”
– “ও আচ্ছা। তোমরা কিন্তু আমাকে কেউ লাইন মারবে না। আমি এখনো অনেক ছোট, এত তাড়াতাড়ি আমি প্রেম করবো না। কেউ প্রেমে পড়বে না আগেই বলে দিচ্ছি। আগে বড় হবো, তারপর ওসব।”
সবাই মুখ টিপে হাসলো। আরাফ বললো, “তোমার প্রেমে পড়ার কিসের ঠেকা পড়ছে শুনি?”
– “আমার মত সুন্দরী দেখলে সবার মাথা এমনিতেই ঘুরে যায়। তাছাড়া এই ছেলেটা কিভাবে যেন তাকাচ্ছে। আমি আরো শুরুতেই ওকে ঘুষি মেরেছি। প্রেম কিন্তু এভাবেই শুরু হয়। ঘুষি থেকে শুরু হতেও পারে।”
সায়ান থতমত খেয়ে বললো, “থাপ্পড় লাগাবো একদম। আমি কখন তোমার দিকে তাকালাম? যে আমার চেহারা, তার নাম আবার পেয়ারা। ঘটি ডোবেনা, নামে তালুকদার।”
– “আমার নাম তালুকদার নয়।”
– “নাম কি তোমার?”
– “আমার নাম বিদ্যা ”
মেঘালয় বললো, “ও আচ্ছা। সেজন্যই তখন থেকে আমাদের মূর্খ, বেয়াদব এসব বলে যাচ্ছো।”
– “বেয়াদবি করলে বলবো না? আর হ্যা, তুমি অত বড় একটা লোক এরকম বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো কেন? কচি কচি মেয়েদের খুব ভালো লাগে তাইনা? আজকালকার ছেলেরা খুব খারাপ।”
– “কাকে বাচ্চা মনেহচ্ছে তোমার? আচ্ছা কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
– “আমি ক্লাসে কেন পড়বো? আমাকে অতই বাচ্চাবাচ্চা লাগে? আমার চুল দেখেছেন কত বড়?”
সবাই হাসলো। মেয়েটির চুল সত্যিই অনেক লম্বা। কিন্তু চুল লম্বা তো পাঁঁচ বছরের বাচ্চার ও হতে পারে। তাই বলে সে কি বড় হয়ে যায়? আসলেই এই মেয়েটা এখনো অনেক ছোট। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কিসে পড় তুমি?”
– “আমি এইবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে উঠেছি। কলেজে পড়ি।”
– “ওরে বাবা! কলেজে পড়ে!”
সবাই এমন ভাব করলো যেন খুব বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। বিদ্যা এবার খুশি হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, “এই ছোট মেয়েটা কোন ক্লাসে পড়ে?”
মেঘালয় বললো, “এই ছোট মেয়েটা আমার ওয়াইফ,মিসেস মেঘালয়। সে অনার্স ফাস্ট ইয়ারে।”
বিদ্যা চোখ কপালে তুলে বললো, “আল্লাহ! এত বড়। আমিতো ভেবেছিলাম ক্লাস নাইন টেনে পড়ে। দেখতে তো একদম টিং মিং।”
সবাই হেসে ফেললো। সায়ান এবার আড়চোখে তাকালো। মিশুর জমজ বোন মনেহচ্ছে মেয়েটাকে। মিশু যেমন একটু বেশিই কিউট, এটাও সেরকম। মিশুর চেয়ে আরো বেশি খুকি।
সায়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিদ্যা বললো, “বলেছিলাম না আপনি কিভাবে তাকিয়ে থাকেন। তখন তো বিশ্বাস হয়নি। এখন দেখছেন কেন? এভাবে তাকিয়ে থাকলে প্রেম হয়। আর আমি চাইনা আপনার মত থার্ড ক্লাস ছেলের প্রেমে পড়তে। এরকম কত শত ছেলে আমার পিছে পিপড়া আর মৌমাছির মতন ঘুরঘুর করে যেন আমি মধু।”
– “নাহ, আপনি তো মধুর মা।”
– “মধু আমার বাপের নাম। শোনেন,আপনি কিন্তু খুব লুচ্চা।”
সায়ান হেসে বললো “এভাবে ছেলেদের গালি দিতে ওরা প্রেম তো দূরে থাক, তোমার ধারে কাছেও ঘেষবে না। মুখে লাগাম দাও বুঝলে।নয়ত কপালে বর জুটবে না।”
– “ইহ,কত ছেলে লাইন লেগে আছে। আপনার মত ছেলে ছেলেকে লুচ্চা বলেছি এটা আপনার ভাগ্য। আপনাকে তো একেবারে মিশা সওদাগরের মতন লাগে।”
তারপর আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো, “আর আপনাকে গাংগুয়ার মতন লাগে।”
আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “গাংগুয়া যেন কে?”
সবাই হেসে উঠলো। মেয়েটি যা মুখে আসছে সবাইকে গালি দিয়ে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে মেজাজ খারাপ হয়ে উঠছে আবার ভালো ও হচ্ছে। কখনো রাগ ওঠে, কখনো হাসি পায়। মেঘালয়কে এই জীবনে কেউ প্রথমবার বেয়াদব বলেছে সেটা নিয়ে খুব হাসাহাসি হলো।
বাংলোয় ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলো সবাই। খাওয়া দাওয়ার পর সায়ান গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার জন্য বললো। বিদ্যাকে ওর হোটেলে রেখে আসা হবে। কিন্তু গাড়ির কাছাকাছি এসে বিদ্যা বললো, “এখন গিয়ে তো লাভ হবেনা। হোটেলে তো আমাকে থাকতে দেবেনা।”
সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
বিদ্যা বললো, “আমাদের আজকেই ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা ঢাকার পথে পারি দিয়েছে।”
“সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন? তুমি এখন যাবে কোথায়?” -উদ্বিগ্ন হয়ে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো। বিদ্যা বললো, “আমি এখন আপনাদের সাথে থাকবো। আপনারা যেদিন চলে যাবেন আমিও যাবো।”
অচেনা একটা পাগলী মেয়েকে এভাবে রাখতেও ভরসা পাচ্ছেনা মেঘালয়। তার উপর মেয়েটি একদম অবুঝ। অনেক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো কি করা যায়। বিদ্যার কাছে নাম্বার নিয়ে ওর বাবাকে কল দিয়ে কথা বলিয়ে আশ্বস্ত করলো মেঘালয়, মিশু ও রোদ। বিদ্যা নিজেও কথা বলে বাবাকে নিশ্চিত করে দিলো। ওর বাবা বললেন উনি এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন সিলেট থেকে। মেঘালয় নিজের পরিচয় দিয়ে দেয়ার পর উনি একটু নিশ্চিত হয়েছেন। সবকিছু মিটমাট হয়ে গেলে যে যার রুমে শুতে গেলো। বিদ্যাকে ঘুমাতে দেয়া হলো রৌদ্রময়ীর সাথে।
কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি ই ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটি। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপর থ মেরে বসে রইলো। রোদের দিকে অনেক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। ওর মাথায় এখান শয়তানী বুদ্ধি খেলা করছে। ঘুম আসছে না কিছুতেই।
বারান্দায় বের হয়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ও। বাইরে খুব সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে। চাঁদের আলো আর কুয়াশা মিলে অন্যরকম সৌন্দর্য ধারণ করেছে প্রকৃতি। বিদ্যা চুপচাপ খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে একদম নড়াচড়া বিহীন ভাবে। একটু পরেই সায়ান বাথরুমে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে বের হলো। সায়ানের দরজার সামনেই পিছন দিকে ফিরে বাইরে চেয়ে আছে বিদ্যা। বাংলোয় এসে বিদ্যা মিশুর জামা পড়ে নিয়েছে। পিছনে লম্বা চুল গুলো পিঠ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। সায়ান দরজা খুলেই ওকে দেখে ভয়ে ঢোক গিললো। যখন বুঝতে পারলো এটা বিদ্যা ও এসে পাশে দাঁড়ালো।
বিদ্যা সায়ানকে দেখে বলল, “কিরে বেয়াদব ছেলেটা, একটা মেয়েকে একলা দেখেই এসে দাড়াতে হবে?”
সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে বেয়াদব মনে হয় তোমার?”
– “সব এঙ্গেল থেকে। আয় বাইরে যাই, হেঁটে আসি। যাবি? ”
সায়ান থতমত খেয়ে ঢোক গিললো। ওরা নিশ্চয়ই কোনো ভূত পেত্নী তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। কোনো স্বাভাবিক মেয়ে এরকম হতে পারে? আজব ক্যারেকটার একটা। এত রাতে সে নাকি বাগানে যাবে হাঁটতে!
বিদ্যা বললো, “যাবানা? না গেলে এইখানে খাম্বার মত দাঁড়াইয়া থাকো, আমি যাই হেঁটে আসি।”
বলেই বারান্দা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো। সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা নিয়ে নিজেও নেমে পড়লো। কোনো একটা অচেনা শক্তি যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। হা করে চেয়ে আছে বিদ্যার দিকে, আর অপ্রকৃতস্থের মত পিছুপিছু যেতে লাগলো।
চলবে..
অনুভূতি
পর্ব ৩৬
মিশু মনি
.
৫৫.
সায়ান ও বিদ্যা হাঁটতে হাঁটতে চা বাগানে চলে এলো। বাগানের পাতাগুলো চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় চিকমিক করছে। সায়ান বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে বিদ্যার দিকে। মেয়েটি দিব্যি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। এ কেমন মেয়েরে বাবাহ! এত রাতে কেউ ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হয়?
বিদ্যা বললো, “এই ছেলে তোমার নাম কি?”
– “সায়ান।”
– “সায়ান সায়ানা। তোমার বউয়ের নাম হবে সায়ানা। তোমার বউটা হবে খুব সেয়ানা।”
সায়ান হেসে ফেললো ওর কথায়।বিদ্যা একটু করে এগোচ্ছে আর নিচু হয়ে চা পাতার ঘ্রাণ নিচ্ছে। এটা তো মিশুর ই প্রতিফলন মনেহচ্ছে। মিশুও পাহাড়ে গিয়ে গাছপালার গন্ধ নেয়,মাটির ঘ্রাণ নেয়। দুজনেই একই ধাচে গড়া। সায়ান হা করে বিদ্যার চাল চলন খেয়াল করছে। বিদ্যা বললো, “বলোতো আজকে চাঁদের আলো এত কম কেন?”
– “চাঁদের আলো বেশিই আছে। আজকে কুয়াশা পড়েছে বলে আলো কম মনেহচ্ছে।”
– “আমার সাথে সায়েন্স কপচাপা না। সাহিত্য কপচাও।”
– “বুঝলাম না। এর সাথে সায়েন্স আর সাহিত্যের কি সম্পর্ক?”
– “তুমি যেটা বললা সেটা সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা হয়ে গেলো না? সাহিত্যের ভাষায় বলো, “বিদ্যা আজ তোমার রূপের কাছে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে।”
সায়ান হো হো করে হেসে উঠলো। বিদ্যা ভ্রু কুচকে বললো, “হাসছো কেন? ভূল বলেছি?”
– “না, বিদ্যা আজ তোমার রূপের কাছে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে।”
– “এবার ঠিকাছে। এভাবেই প্রেম হয়।”
সায়ান আবারো হেসে উঠলো। কুয়াশা পড়েছে দারুণ। মৃদু জোৎস্নায় কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে দুজনে চা বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে লাগলো। সায়ানের ভয় হচ্ছে পোকা মাকড় নিয়ে। কিন্তু বিদ্যার এ নিয়ে কোনো ভয় নেই। সে দিব্যি গুনগুন করে গান গাইছে আর হাঁটছে।
মেঘালয়ের হঠাৎ ঘুম ভাংলে দেখলো মিশুর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মিশু রীতিমত কাঁপছে। ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলো মেঘালয়। মিশুর কপালে ও গলায় হাত দিয়ে জ্বর অনুভব করে দেখলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে লাগেজ খুলে থার্মোমিটার বের করলো। মিশুর শিয়রে বসে জ্বর মেপে দেখে চিন্তায় পড়ে গেলো মেঘালয়। হুট করেই এত জ্বর এসে গেছে মেয়েটার। সন্ধ্যা থেকেই হয়ত জ্বর জ্বর লাগছিলো, কিছু বলেনি তখন। ওর মুখটা শুকনা দেখাচ্ছিলো। বিছানাকান্দি থেকে ভেজা গায়ে ফিরেছে, নৌকায় বাতাস লেগেছিলো গায়ে। গতরাতেও ঝরনা স্নান করে ভেজা কাপড়ে ফিরেছে। এজন্যই হয়ত ঠাণ্ডা লেগে গেছে মেয়েটার। ও দ্রুত ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করলো। টুকটাক জ্বর,সর্দি, মাথা ব্যথার ওষুধ কোথাও গেলে সাথে নিয়ে যায় ও। এক গ্লাস পানি এনে মিশুকে একটু তুলে ধরে ওষুধ খাইয়ে দিলো। মিশু ওকে আলগা করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার হাত পা ঝিমঝিম করছে মেঘ।”
ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলো মেঘালয়। গায়ের উপর ভালো মতো কম্বল টেনে দিলো। তারপর হাতে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিয়ে বললো, “ভালো লাগছে এখন?”
মিশু জ্বরের ঘোরে বললো, “গা টা কেমন যেন করছে। ব্যথা করছে। পায়ে বেশি ব্যথা করছে। খুব ঝিমঝিম করছে।”
মেঘালয় ওর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিতেই মিশু বললো, “বর কখনো বউয়ের পা টিপে দেয়? দিওনা দিওনা।”
মেঘালয় বললো, “আমি ওসব নিয়ম মানিনা। তুমি আমার কাছে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
মিশু আর কিছু বললো না। জ্বরের ঘোরে কিছু বলতেও পারছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। মেঘালয় বসে বসে ওর পা টিপে দিতে লাগলো। পা দুটো সুন্দর করে টিপে দিচ্ছে আর মিশু আরামে ঘুমোচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে।
আবারো মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘালয় এখনো ওর পায়ের কাছে বসে পা টিপছে। মিশুর অতটা খেয়াল ছিলোনা। ঘোরের মাঝেই ও পা ঝাড়া দিতেই মেঘালয়ের বুকে লাত্থি দিয়ে ফেললো। মেঘালয় আচমকা এরকম পরিস্থিতিতে পড়েও নিজেকে সামলে নিলো। কিন্তু মিশু ওকে লাথি দিয়ে ফেলেছে বুঝতে পেরে ব্যস্ত হয়ে বিছানার উপর উঠে বসলো। মেঘালয়ের বুকে খুব জোরে লেগেছে। ও বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। মিশু এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে বসে দুহাতে মেঘালয়ের মুখটা ধরে বললো, “আমি এটা কি করলাম! আমি বুঝতে পারিনি মেঘমনি। তুমি কি ব্যথা পেয়েছো? সরি মেঘ।”
মেঘালয়ের বুকে লাথিটা একটু জোরেই লেগেছে। তবুও ও ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, “তুমি একটা পাগলী। এটা তো একটা এক্সিডেন্ট, আমি কিছু মনে করিনি।”
– “তুমি ব্যথা পাওনি?”
– “না রে পাগলী টা। ব্যথা পাইনি একটুও।”
– “সত্যি তো?”
– “সত্যি, একদম সত্যি।”
মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে যে জায়গাটায় লাথি লেগেছিলো সেখানে মাথা রেখে বললো, “আমাকে মাফ করে দাও মেঘ। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এখানে বসে আমার পা টিপছ। আমার অতটা হুশ ছিলোনা।”
মেঘালয় মিশুকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলো। নিজে বসে রইলো ওর মাথার কাছে। মিশুর মাথাটা ওর কোলের উপর নিয়ে বললো, “ভূলে যাও এ ব্যাপারটা। ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। আর তুমি ইচ্ছেকৃত ভাবে লাথি দিলেও আমি কখনো কিছু মনে করবো না। তুমি পুরো টাই আমার। তোমার মাথাটা যদি আমার বুকে জায়গা পায়,পা কেন পাবে না? তুমি তো আমার ই।”
মিশু কেঁদে ফেললো কথাটা শুনে। উঠে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেঘালয় ওকে উঠতে দিলোনা। মিশু মেঘালয়ের একটা হাত বুকে চেপে ধরে বলতে লাগলো, “এত ভালো কেন তুমি! এত সুন্দর করে কিভাবে ভাবো? আমি বারবার আঘাত করে ফেলি তোমায়। আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে।”
– “একদম এই কথা বলবা না। তুমি আমার লক্ষী একটা বউ। এবার ঘুমোও তো। শরীর কেমন লাগছে এখন?”
– “ভালো।”
– “জ্বর একটু ও কমেনি। তুমি ঘুমোও তো মিশু।”
মেঘালয় উঠে গিয়ে একটা বাটিতে করে পানি ও রুমাল নিয়ে এলো। রুমাল ভিজিয়ে মিশুর কপালে দিয়ে দিলো। তারপর বললো, “এখন চুপচাপ শান্ত মেয়ের মত ঘুমোও। ওষুধ খেয়েছো, এবার দেখবে জ্বর পালাবে। আর না পালালেও আমি জোর করে জ্বরকে তাড়িয়ে দিবো।”
মাথায় জলপটি দিয়ে দেয়াতে মিশুর খুব আরাম লাগছে। কপাল ও চোখের উপর মেঘালয় রুমাল ভিজিয়ে রেখে দিয়েছে। এখন আরামে চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। মিশু কি যেন বললো বোঝা গেলো না। ঘুমে ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় বারবার রুমাল ভিজিয়ে জলপটি দিয়ে দিচ্ছে। মিশু ঘুমের ঘোরে বললো, “আমার শরীরে শুধু তোমার প্রেমের বীজ থাকবে,কোনো অসুখ বিসুখের বীজ তুমি থাকতেই দেবেনা। তুমি খুব…”
শেষে কি বললো বোঝা গেলো না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে মিশু। মেঘালয় হাসলো। পাগলী একটা মেয়ে। বুকের যে জায়গাটায় মিশু লাথি দিয়েছে সেখানে হাত রেখে মনেমনে বললো, “শরীরে কত আঘাত দিতে পারিস দে। কখনো বুকের ভেতরে আঘাত দিস না মিশু। আমি তোকে খুব বেশি ভালোবাসি। তোর দেয়া আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো না।”
মেঘালয়ের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ও মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনেমনে প্রার্থনা করতে লাগলো যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় মিশু। ওর শরীর অসুস্থ থাকলে মেঘালয়ের ও কষ্ট হবে। মেঘালয় তোয়ালে ভিজিয়ে মিশুর শরীরটা মুছে দিলো।মিশু এখন আরামে ঘুমোচ্ছে। আর মেঘালয় ওর মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একটু পরপর জলপটি ভিজিয়ে আবারো কপালে দিয়ে দিচ্ছে।
সায়ান ও বিদ্যা অনেক্ষণ হাটাহাটি করলো একসাথে। বিদ্যার স্কুল জীবনের নানান মজার মজার গল্প বলছে ও। সায়ান শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনছে। বিদ্যা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড় ভাইয়া ভার্সিটিতে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। বাবা মা সবাই ওকে খুবই আদর করে আর আদরে আদরে ও একদম বাদর হয়ে গেছে এসব গল্প বলতে লাগলো সায়ানকে। সায়ান ও হেসে হেসে নানান প্রশ্ন করতে লাগলো।
– “আচ্ছা বিদ্যা, বেয়াদব বলাটা কি তোমার মুদ্রাদোষ?”
– “আমার কোনো দোষ নেই। যে বেয়াদব তাকে বেয়াদব তো বলবো ই তাইনা?”
– “তুমি জানো মেঘালয় কত বড় মনের একজন মানুষ? ওর মত মহান ব্যক্তি আর একটাও দেখিনি আমি আমার লাইফে। তুমি আর কক্ষনো ওকে এভাবে বলবে না। সম্মান দেখিয়ে কথা বলবা।”
– “উনি কোন থানার চৌকিদার?”
– “বিদ্যা, এভাবে বড়দের বলতে হয়না। মেঘালয় একজন মাউন্টেউনার।”
– “মাউন্টেইনার রা তো কালা কুচকুচে হয়। মেঘালয় এত ফর্সা কেন?”
– “আজব প্রশ্ন করো। ও কয়েক বছর যাবত আর অভিযানে যায়না। আন্টি ওকে যেতে দেয়না। সেজন্য ফর্সা হয়ে গেছে আবার। কিন্তু যেবার হিমালয় থেকে ফিরে এসেছে, আমরা কেউই ওকে দেখে চিনতে পারিনি। গায়ের রঙ একদম চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিলো।”
– “এত তাড়াতাড়ি সে আবার ফর্সা হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই ফর্সা হওয়ার নাইট ক্রিম ইউজ করে?”
– “হা হা হা। হাসালে আমায়। ও যেরকম পরিবেশে থাকে, তাতে গায়ের ময়লা এমনিতেই কেটে যায়। এর জন্য ফর্সা হওয়ার ক্রিম ইউজ করতে হয়না।”
– “ওহ আচ্ছা। যাক ভালো, একজন বড় মানুষকে বেয়াদব বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছি আমি।”
– “এটা কি গর্ব করার মত কিছু?”
– “অবশ্যই গর্ব করার মতই কিছু। মেঘালয়কে কেউ কখনো এই গালিটা দেয়নি। যেটা প্রথম আমি দিয়েছি ”
– “তুমি ওকে শুধু মেঘালয় বলবে না। মেঘালয় ভাইয়া বলে ডাকবা।”
– “উনি আমার কেমন ভাই? আমার বাপের একটাই মাত্র ছেলে।”
– “সবসময় নিজের ভাইকেই ভাই বলতে হয়? প্রত্যেক মুসলিম একে অপরের ভাই।”
– “তাহলে তো মেঘালয় আমার বাপের ও ভাই। আমার তাকে চাচা ডাকা উচিত। আপনি ও তাহলে আমার চাচা।”
সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “তা বুঝাইনি। বয়স অনুযায়ী কাউকে ভাইয়া ডাকতে হয়,আর কাউকে আংকেল ডাকতে হয়। বুঝেছো? আমাদের বয়স অনুযায়ী আমাদের কে তুমি ভাইয়া ডাকবা।”
– “ওহ আচ্ছা। বুঝেছি। এবার তাহলে ফিরে যাই আসুন। আমার ঠাণ্ডা লাগছে।”
দুজনে আবারো বাংলোর দিকে ফেরার জন্য পা বাঁড়ালো। সায়ানের হাসি পাচ্ছে বিদ্যার পাগলামি ভরা কথাগুলো শুনতে শুনতে। মেয়েটা পারেও বটে।
৫৬.
মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো আবারো। ও চোখ মেলে দেখলো মেঘালয় এখনো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ও বললো, “মেঘমনি।”
– “হুম মিশু সোনা।”
– “তুমি ঘুমোও নি?”
– “তোমাকে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে ঘুমাই বলো? তোমার কেমন লাগছে এখন?”
মিশু একটু উঠে বসার চেষ্টা করলো। মেঘালয় ওকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। মিশু উঠে মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো দুহাতে। আস্তে আস্তে বললো, “সারারাত এভাবে বসে থাকবা? কয়টা বাজে?”
মেঘালয় ঘড়ি দেখে বললো, “প্রায় চারটা।”
– “আমার কান্না পাচ্ছে মেঘ।”
মেঘালয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন মিশু?”
মিশু বললো, “অনেকে বাবা মায়ের থেকেও এরকম সেবা পায়না। আমিতো কখনোই পাইনি। আমার অসুখ হলে মাথায় পানি ঢেলে দেয়ার মত কেউ ছিলোনা। ছোটবোন তো তার মত ব্যস্ত, আর আম্মু তো অসুস্থ। আজকে প্রথম কেউ আমার এভাবে সেবা করলো। সারারাত বসে জলপটি দিয়ে দিলা, পা টিপে দিলা, মাথা মালিশ করে দিচ্ছো। এভাবে কেউ আমাকে ওষুধ খাওয়ায় নি, আমার অসুখ হলে নিজেকেই ওষুধ কিনে এনে তারপর খেতে হতো।”
মিশু আঁকড়ে ধরে আছে মেঘালয়কে। মেঘালয় বললো, “তোমার সেবা করতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনেহচ্ছে মিশু। আমি তোমাকে যত ভালোবাসি, তত কম মনেহয়।”
-“এত ভালোবাসো কেন মেঘ? তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি,মাথায় আঘাত পেয়েছো। আজকে আবার বুকে লাথি দিয়েছি। সেদিন ট্রেনে কতগুলা হিংস্র আচড় দিয়েছি। কত আঘাত দেই আমি তোমাকে। অথচ তুমি আমাকে কত্ত ভালোবাসো!”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ভালোবাসলে বাসার মতই বাসবো, যেন আমার প্রিয় মানুষ টার লাইফে আর কারো ভালোবাসার প্রয়োজন না পড়ে।”
– “আমি কি তোমার এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?”
মেঘালয় মিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “যোগ্যতা আমি বুঝিনা। আল্লাহ তোমাকে পাইয়ে দিয়েছেন, এতে তার কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া। আমি সুখী তোমাকে পেয়ে,এটাই সবচেয়ে বড়। তোমাকে আমার পাশে মানাচ্ছে কিনা সেটা আমার দেখার বিষয় না।”
মিশুর চোখে পানি এসে গেলো। মেঘালয় বুঝতে পেরে ওর চোখ মুছে দিয়ে বললো, “আমার শুধু একটাই চাওয়া তোমার কাছে, সবসময় আমার পাশে থেকো। কখনো যদি একটুও আড়াল হও,আমি পাগল হয়ে যাবো।”
মিশুর সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এত ভালবাসা পেয়েও কি কখনো আড়াল হওয়া যায়? জীবনটাই তো উৎসর্গ করা যায় এই মানুষ টার জন্য। অজান্তেই লাথি দিয়ে ফেলাটা খুব অপরাধ হয়ে গেছে। মিশুর খুব খারাপ লাগছে সেজন্য। কথাটা আরেকবার বলতেই মেঘালয় বললো, “আমি ভূলেই গেছি ব্যাপারটা। তুমি এখনো সেটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো?”
– “সরি মেঘমনি।”
– “একদম মন খারাপ করে থাকবা না। তোমার অসুখ তাড়াতাড়ি সেরে যাক।”
– “তুমি আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নাও না।”
মেঘালয় শিউড়ে উঠলো মিশুর কথায়। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো ওর। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। অজান্তেই মেঘালয় এই পাগলী টাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে সেটা কি ও বোঝে? কখনো কি বুঝবে মেঘালয় ওকে কতটা ভালোবাসে? ওর মুখে হাসি ফোটাতে, ওকে একটু আনন্দ দিতে সবকিছু করতে রাজি ও। মিশু কি জানে সে কথা?
মিশু মেঘালয়ের কলার টেনে ধরে বললো, “তোমাকে ছাড়া আমি অপূর্ণ মেঘালয়। আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছো তুমি।”
মিশুর জ্বর কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভোর হতে শুরু করেছে। দুটো সুখী মানুষ একে অপরকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে, এ তো সুখের কান্না!
চলবে..