ভরদুপুরে নবদম্পতির গভীরতম স্পর্শের উথাল। ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলে রাসিদা বিবির কান ছুঁয়ে যেতেই। চোখ বসায় নারিকেল পাতার বেড়ার ফাঁকে। একপলক সঙ্গম দর্শনে তোবড়ানো মুখটায় আরো কুৎসিত ভঙ্গিতে ‘ছিঃ ছিঃ’ শব্দ সূচক মাথা নাড়াতে নাড়াতে নিম্নমুখী বদন নামিয়ে নিয়েছে তৎক্ষণাৎ। নাকের উপর কাপড় তুলে তেলে বেগুনে ছিটতে লাগলেন। সাথে বাজখাঁই গলার কু-শ্রব্য কথার বাহার।
‘ ছিঃ ছিঃ ছিঃহ্ এমন মাইয়্যা মানুষ জীবনেও দ্যেহিনু। দিনদুপুরে আদর সোহাগ। ছিঃ। কী যুগ আইলো মাবুদ। লজ্জা ঘিনার বালাই শ্যাষ। ও মনসুরের মা। হুনছো, কাল গেছে কলিতে। জাত যাওয়ার বোধ নাই।’
মনসুরের মা কাঁদা মাখানো হাতে কোনমতে চুলের খোঁপা টা গুজে মুখ তুলে তাকালো। উঠোন নিকানো প্রায় শেষ। শেষ পোঁচ বাকী। মুখের মধ্যে টলটলে পানরস রেখেই বললো,
‘কী হয়াছে বু?’
আচমকা চিৎকার চেঁচামেচিতে অন্তমোহ ঘোর ছুটে গেল নজরুলের। পরনের লুঙ্গিটা কোনমতে কোমরে জড়িয়ে স্ত্রীকে সময় দিলো গোছানোর। এরপর টিনের আগল ঠেলে বেড়িয়ে এলো নজরুল পেছন পেছন নব্য বিবাহিতা পারু। লম্বা ঘোমটা টেনে দাওয়ায় খুঁটি ধরে দাড়িয়ে পড়লো পারু। নজরুল এগিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাসিদা তিন লাফে পিছিয়ে জিব কেটে বললো,
‘ছিঃ ছিঃ সর, সর। দূরে যা। দূরে যা শয়তান।’
নজরুল চোখ সংকুচিত করে কৌতুহলি গলায় বললো,
‘কী হয়াছে মা?’
গলা ফুলিয়ে চুপ করে রয় রাসিদা বিবি। নাকের ওপর তখনো আঁচল চাপা দেওয়া। পাশ থেকে মনসুরের মা কাঁদা জলের ঘোলা বালতিতে হাত ডুবিয়ে লালচে দাঁত বের করে একই ভঙ্গিতে বললো,
‘ এই আটফাইট্যা রোউদের মধ্যে এতো হাউস। লইজ্জা সরমের মাথা গিলা? রাইতে কী চুরি করতে যাবানি?’
বুঝতে বাকি রইলো না নজরুলের, মাথা নুয়িয়ে চটচটে লুঙ্গিটার দিকে তাকালো। রাসিদা বিবি দ্রুত পায়ে হেঁটে দাওয়ায় উঠলেন। পারুর থেকে হাত তিনেক দূর সরে ভেংচি কেটে ঘরে ঢুকলেন। গোটা বিষয়টা পারু বুঝেছে মাত্রই। নেহায়েৎ খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছে নয়তো মাটিতে গেড়ে যেত তৎক্ষণাৎ। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো। চোখের কোন ঘেঁষে শিশির জমেছে। নতুন বউদের চোখের জল সহজলভ্য। সামান্য বিষয়েও জল গড়ায়। যদিও বিষয়টা মোটেও সামান্য নয়। নজরুল মনসুরের মায়ের সাথে কি যেন বলছে। পারু দাওয়া থেকে শুনতে পায়না। এরপর নজরুল দাওয়ায় এগিয়ে এসে বললো,
‘গামছা ডা দেও দেখিনি, যাই দুইডা ডুব দিয়ে আহি।’
পারু নজরুলের দিকে না তাকিয়েই দড়িতে ঝুলতে থাকা গামছাটা ছুড়ে দেয়। নজরুল সেটা গলায় নিয়ে একটা গানের সুর আওড়াতে আওড়াতে লুঙ্গির এক কোণের খোট ধরে এগিয়ে গেল।
‘ বুঝলি নজরুল দিনকাল যা পইড়েছে, মাইয়্যা মাইনষের যে এতো চাহিদে আগে জানতেম না। যদি যানতেম তালি পারে সত্যি সত্যি এ জেবনে বিয়েই করতেম না। খালি বায়না। এতো বায়না ধরলে চলে? বল দেখিনি।’
সুগন্ধি সাবানটা মাথায় ঘষতে ঘষতে কথা গুলো বলতে লাগলো মোহন। নজরুল সান বাঁধানো ঘাটের ধাপ গুলো দিয়ে পানিতে নেমে বললো,
‘ ক্যান ভাই, বৌদি নতুন কী এমন বায়না ধরেছে? যাতে তুমি এমন আকুতি মিনতি করতেছো।’
‘আর কোইসনে। লক্ষন বাড়ির পালায় যাতি চায়। বলে কিনা, কহনো কিছু চাইনি, এইবার ওই পালাতে নিয়ে যাতি হবে। কহনো কিছু চাইনি বইলে সব মাইনে নিতে হবি? এই রাইত দুহারে ম্যাইয়্যা মানুষ নিয়া যাওয়া যায়?’
‘ যাতি চায়,নিয়ে যাও। জোছনা রাইত দুজনে হাত ধরাধরি করে যাইবা আবার আইবা। এ আর অমন কী বায়না। দুজনেই তো।’
‘ ইস্, তোমার নতুন বউ। হাউস আমার থেইকা তোমার বেশি। তুমিই যাও ভাই।’
‘আমি তো যামুই। তোয়ারে বলি। তুমিও যাইও বৌদিরে লোইয়া।’
রাতে মাটিতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে নজরুল। পারু ট্যাংরা মাছের ঝোল তুলে পাতে দিতেই নজরুল বললো,
‘ মায় খাইছে?’
‘হ’
‘তুমি খাইছো?’
‘না।’
‘খাওনাই যে?’
‘ খামুনে’
‘ তাড়াতাড়ি খাইয়া লোইও’
গলার স্বর আরো চাপিয়ে সামনের দিকে মুখ বাগিয়ে নজরুল বললো,
‘লক্ষন বাড়ি আইজ যাত্রায় যামু, তৈয়ার থাইকো। মাঝরাইতে শুরু হইব। মায় হুনলে যাইতে দিব না।আমি কোইছিলাম। না কোইরা দিছে।’
পারুও গলাটা নামিয়ে বললো,
‘কি কয় তোমার মায়?’
‘ কয় নতুন বউ গায়ের’তোন অহনো ঘ্রান যায় নায় আর এর মধো রাইতবিরাইতে পাড়া দৌড়ানি। গ্যালে আমার একলা যাওন লাগবো।’
‘তুমি কি কোইছো?’
‘ কোইছি আচ্ছা আমি একলা যামুনে। কিন্তু সত্তি কথা হইলো তোমারে আমি লইয়াই যামু।
পারুর ঠোঁট দুটো বেঁকে উঠলো। মুচকি একটা হাসি অনেক কষ্টে চেপে গলাদিয়ে নামিয়ে নিয়েছে। ভেতরের ঘরে থাকে রাসিদা বিবির গলার আওয়াজ,
‘ খাওনের সমোয় ও এতো ফিসিরফাসির। জেবনে যা না দেখছি।’
পারু দ্রুত শূন্য একটা থালায় নিজের জন্য ভাত বারলো।
মাঝরাতে চাপা একটা ডাকা কানে বিঁধতেই পারু চোখ খুললো। নজরুল যাত্রায় যাওয়ায় শ্বাশুড়ির সাথেই পারু শুয়েছিলো। পারু রাসিদা বিবির দিকে তাকিয়ে খুব ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো। রাসিদা বিবি বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে টিনের আগল ঠেলে বেরিয়ে এলো পারু। নজরুল পারুকে দেখে বললো,
‘ শুরু হইয়া গেছে। তাড়াতাড়ি চলো।’
পারুর হাত ধরে টানতে লাগলো নজরুল। প্রথমে ধীর পায়ে এগুতে এগুতে দৌড় লাগালো দু’জনেই। জোছনা রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দুজোড়া পা ছুটে চলেছে নির্বিঘ্নে। কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে যাওয়ার পর পারুর অপার্থিব হাসিতে প্রতিধ্বনিতে হচ্ছিল আলোআধারির পরিবেশ। নজরুল পা থামালো। পারুর হাসিতে ফুলেফেঁপে ওঠা বদন দেখছে। কত মায়াবী। নজরুল অস্ফুট স্বরে বললো,
‘ তুমি অনেক সুন্দরী।’
পারু চুপ করে গেল। চোখ নিচে নামিয়ে নিয়েছে। বোধহয় লজ্জা পেয়েছে।
রাসিদা বিবির ঘুম বড়ো পাতলা। গাছ থেকে পাতা খসে পড়লেও কান খাড়া হয়। আর টিনের আগল খোলার শব্দ তার কানে যায়নি এটা মানা যায় না। চোখ বুজেই হাসি হাসি মুখ করে পাশ ফিরে ঘুমালেন রাসিদা বিবি। মনে মনে বললেন,
‘ আমাগো জেবনে এমন দেহিনাই। দুইডা পাগল এক্কেরে। একটা বউ পাগলা পোলা প্যাটে ধরছিলাম।’
ছোটগল্প: অনুষঙ্গ
লেখা: তরিকুল ইসলাম শাওন