#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বর্তমান,
ফোনের তীব্র আওয়াজে অতীতের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো খুশি৷ ফ্লোরে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে BB নামটা ভেষে উঠেছে। তবে সেটার থেকে বেশি খুশির নজর গেল ফোনের কোনায় ছোট সংখ্যায় থাকা সময়ের দিকে। যেটা ওর মস্তিষ্ক কে সতর্ক করে দিচ্ছে যে ও গত দু’ঘন্টা যাবৎ এভাবেই পড়ে ছিল। আৎকে উঠলো খুশি। মনে পড়ে গেল প্রহরের কথা। হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়াল খুশি। তড়িৎ গতিতে গিয়ে নিজের কাপড়চোপড় অগোছালো ভাবে লাগেজে ভরতে লাগলো। আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকা যাবে না। এখুনি চলে যেতে হবে ওকে। প্রহর যে ওকে এতো সহজে ছাড়বে দিবে না সেটা ওর থেকে ভালো আর কেউ জানে না। তাই ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। নাহলে যে সব বর্বাদ হয়ে যাবে। এতদিনের সব প্রচেষ্টা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
কোনরকমে কাপড়চোপড় গুলো ঢুকিয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো খুশি। ভয়ে ভয়ে দ্রুত লিফটের কাছে এসে বাটন চাপলো। ভয়ে বুক কাঁপছে। প্রহর দেখার আগে এখান থেকে বের হতে পারলেই হলো। লিফট খুলতেই ভেতরে ঢুকলো খুশি। লিফটে কাউকে না দেখে একটু স্বস্তি পেল। তবে তার এই স্বস্তির স্থায়িত্বকাল খুবই ক্ষীণ প্রমাণিত হলো। লিফট বন্ধ হওয়ার ঠিক মুহূর্তেই প্রহরের আগমন ঘটলো। লিফটের ফাঁকের মাঝে হাত দিয়ে লিফট আবারও খুলে ফেললো সে। মুখমন্ডলের কঠিনত্ব চরম পর্যায়ে তার। ভয়ে কেঁপে উঠল খুশি। যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হলো। এখন কি করবে ও? প্রহরের হাত থেকে নিস্তার পাবে কি করে?
খুশি তবুও যথাযথ সাহস যুগিয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। তবে বরাবরের মতোই প্রহরের কাছে ব্যার্থ হতে হলো তাকে। প্রহর খুশির হাত টেনে ধরে একহাতে লিফটের স্টপ বাটন চেপে লিফট থামিয়ে দিলো। খুশিকে আটকে ধরলো লিফটের দেয়ালে। খুশির দুই দিকে হাত রেখে মাঝখানে খুশিকে কারাবন্দী করে নিলো। খুশি মাথা নিচু করে আছে। প্রহরের দিকে তাকানোর সাহস নেই আপাতত। প্রহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির তীর নিক্ষেপ করে বলে উঠলো।
–আবারও পালানোর প্ল্যান চলছে তাইনা? বারবার একই কাজ করে ফেড আপ হওনা তুমি? তবে এবার না।দিস টাইম নট সো ইজি সুইটহার্ট। এবার আর পালাতে পারবেনা তুমি। তুমি হয়তো জানোনা যে রিসোর্টে তুমি আছ সেটা কার। এটা তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড প্রহর মেহরাবের রিসোর্ট। আর আমার জন্য তোমার বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা বের করা জাস্ট একটা তুড়ির কাজ। তো তুমি চাইলেও আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা। তুমি পালাতে চাও পালাও। তবে যেখানেই যাওনা কেন আমাকে তোমার সামনে পাবে।
চমকে গেল খুশি। এটা প্রহরের রিসোর্ট সেটা ওর জানাই ছিলোনা। প্রহর ওর বর্তমান ঠিকানায় পৌঁছে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আসল সত্যি টা জেনে যাবে ও। সব শেষ হয়ে যাবে তখন। খুশি বুঝতে পারছে এভাবে ও প্রহরকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলো।
–কি চাও তুমি?
প্রহর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
–যা চাই তা কি দিতে পারবে? এনিওয়ে, মেইন কথায় আসি। তুমি বলেছিলে না আমি চাইলে তোমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারি? তো এখন শাস্তি ভোগ না করেই চলে যাচ্ছো?
–ঠিক আছে। যা শাস্তি দিতে চাও দাও। অ্যাম রেডি।
–গুড গার্ল। তো এখন তোমার প্রথম টাস্ক হলো ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ নিজের রুমে চলে যাবে। আর খবরদার পালানোর চেষ্টা করবে না। এতে বরঞ্চ তোমার ক্ষতিই বেশি হবে। গেট ইট।
মাথা দোলালো খুশি। মানে সে বুঝতে পেরেছে। প্রহর লিফট চালু করে দিলো। লিফট খুলতেই খুশি তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে গেল। প্রহর রহস্যময় হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলো খুশির পানে।
___
রাত আট টা,
ব্যালকনির গ্রীল ধরে উদাস মনে বসে আছে খুশি। শুন্য দৃষ্টি তার দূর আকাশের তারার দিকে। রাতের আঁধারের তুলনায় তার জীবনের আঁধারের পাল্লা ভারী। মলিন চোখে নেই কোন আশার আলো। যতদূর চোখ যায় শুধু আঁধারই ছুতে পায়। কেন হঠাৎ সব এমন দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেল? কি ছিল তাহার কসুর? কোন হেতু পাচ্ছে সে এমন দন্ড? এসব সত্তয়াল পুছিবে কাহার কাছে? সেটাও যে বৃহৎ ধাঁধা। যে প্রহরের কাছ থেকে এতদিন পালিয়ে বেড়িয়েছে। এখন কিভাবে উপেক্ষা করবে তাকে? কিভাবে তার সম্মুখে থেকে নিজের অবাধ্য মনের অনুভূতিকে সামলাবে? প্রহর যে এখন আহত বাঘ হয়ে আছে। তাঁকেই বা কিভাবে শান্ত করবে? চারিদিকে শুধুই চক্রধারা।
ভাবনায় ছেদ পড়লো ফোনের আওয়াজে। টুং করে একটা ম্যাসেজ এলো। খুশি ম্যাসেজকারীর নাম্বার দেখেই চমকে গেল। এই নাম্বার যে তার চিরপরিচিত। কিন্তু প্রহর ওর নাম্বার কোথায় পেল? খুশি নিজের ভাবনার ওপরই তিরস্কার করলো। যেখানে এই রিসোর্ট টাই প্রহরের,সেখানে ওর নাম্বার পাওয়া টা কি এমন কঠিন ব্যাপার। খুশি ম্যাসেজ ওপেন করে দেখলো,
“আজ রাত রিসোর্টের হলরুমে নিউ ইয়ার পার্টি অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। এন্ড ইউ আর মাই স্পেশাল গেস্ট। ইউ মাস্ট কাম। অ্যাল বি ওয়েটিং ফর ইউ সুইটহার্ট। ”
ম্যাসেজ পড়ে চিন্তাভীতে আড়ষ্ট হয়ে পড়লো খুশি। নাজানি প্রহরের মাথায় কি চলছে? আর কিইবা করতে চাচ্ছে ও? প্রহরের মাথা এখন ঠিক নেই। ক্রোধের বসে উল্টোপাল্টা কিছু করে না বসে? ম্যাসেজ যখন পাঠিয়েছে তখন যেতে তো হবেই। নাহলে আরও হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তবে ওর সামনে আমাকে যথাযথ স্বাভাবিক থাকতে হবে। যাতে ও এটা মেনে নেয় যে আমি ওর জীবন থেকে সত্যিই চলে গেছি। যতদ্রুত এটা ও মানবে ততই ও নিজের জীবনেও সুখী হতে পারবে।
পার্টি সেন্টারে নিউ ইয়ারের জাঁকজমক সেলিব্রেশন আরম্ভ হয়ে গেছে। সবাই মনের আনন্দে নাচগান হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। ফাহিমও ওর ফ্রেন্ডসদের সাথে এনজয় করছে। তবে প্রহর এসবের মাঝে তার ফেবারিট জায়গায় অবস্থান করে নিয়েছে। ড্রিংকস বারে বসে ইচ্ছেমতো অ্যালকোহল সেবন করে যাচ্ছে। নজর খুঁজে চলেছে শুধুই তার স্পেশাল গেস্ট খুশিকে। এখনো তার দর্শন হয়নি। কিছুক্ষণ পরে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির দর্শন পেল প্রহর।কালো জর্জেটের শাড়ী পড়ে এসেছে খুশি। তাকে দেখে যতটা না চোখের তৃপ্তি পাবে তারচেয়ে বেশি তিক্ততা ঘিরে ধরলো খুশির হাত ধরে রাখা ব্যাক্তিটাকে দেখে। খুশির বয়ান অনুযায়ী যে কিনা খুশির সো কল্ড হাসব্যান্ড। আহত হৃদয়ের ক্ষত দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। রক্তক্ষরণের ধারা বইছে হৃদবক্ষ জুড়ে। আর এই অসহনীয় যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ বাড়ছে শুধুই সীমাহীন ক্রোধ। যে ক্রোধ সব ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। মায়াময়ী চোখে ভেসে উঠছে ক্রোধের লালিমা।
খুশির নজর পড়লো প্রহরের দিকে। প্রহরকে এভাবে অ্যালকোহলে ডুবে থাকতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো খুশির। অপরাধ বোধে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে অন্তর। প্রহরের এই দূর্দশা যে ওর কারণেই হয়েছে সেটা থেকে ও অজ্ঞাত না। কিন্তু ওতো এটা চায়নি। সেতো প্রহর কে জীবনে সুখী দেখতে চেয়েছিল।
খুশি নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের নজর সরিয়ে নিল। জোরপূর্বক হেসে তার বর্ণিত স্বামী নামক ব্যাক্তিটার সাথে কথা বলতে লাগলো। যেন সে প্রহরকে দেখাতে চাইছে সে তার জীবনে কত সুখী। খুশি এবার সেই লোকটার হাত ধরে ডান্স ফ্লোরে এসে বাকিদের সাথে নাচতে লাগলো। সেসব দেখে প্রহরের ক্রোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।দাউ দাউ করে জ্বলছে মনের আগুন।কষ্ট আর ক্রোধের সংমিশ্রণে ভয়ংকর এক মনোভাবের সৃষ্টি হচ্ছে।ওদের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে থেকে একের পর এক ড্রিংকস শেষ করছে প্রহর।
হঠাৎ সেই লোকটির ফোন আসায় লোকটি ফোন নিয়ে বাইরের দিকে গেল। ভেতরে এত আওয়াজে কথা শোনা যাবে না। তাই ফোনে কথা বলার জন্য বাইরে চলে গেল।
খুশি ডান্স ফ্লোর থেকে সরে যেতে নিলেই হাতে টান পড়লো। এতক্ষণে প্রহর এসে খুশির হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। খুশি চমকে উঠে বললো।
–কি করছো প্রহর ছাড়ো আমাকে।
প্রহর মাতাল কন্ঠে বললো।
–কি করছি মানে? ডান্স করছি। কেন এতক্ষণ তো খুব লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছিলে। তো এখন আমার সাথে ডান্স করবে। কামন স্টার্ট।
–আমার এখন ডান্স করার ইচ্ছে নেই। ছাড়ো প্লিজ।
–আঃ আঃ তা বললে হচ্ছে না জানেমন। ডান্স তো তোমাকে করতেই হবে। ইউ নো না, ইউ কান্ট সে নো টু মি? সো লেটস স্টার্ট। শো মি সাম মুভস।
প্রহর খুশির হাত ধরে একপ্রকার জোর করেই খুশিকে নাচাতে লাগলো। খুশির হাত ধরে জোরে জোরে এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলো। খুবই রুডলি ভাবে খুশির কোমড় চেপে ধরে ডান্স করছে। নেশায় বুদ প্রহর এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নিজের কষ্ট আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে খুশির সাথে। খুশির প্রচুর ব্যাথা লাগছে। তবে খুশি বুঝতে পারছে প্রহর নেশায় মাতাল হয়ে গেছে।আর মারাত্মক রেগেও আছে। তাছাড়া প্রহর কখনো ওর এমন রুড বিহেব করতো না। খুশি নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে প্রহর খুশির হাত ধরে পিঠে হাত মোড়া দিয়ে নিজের সাথে আটকে ধরলো। খুশির পিঠ গিয়ে ঠেকলো প্রহরের বুকে।হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পাচ্ছে। ব্যাথায় চোখের কোনে পানি চলে এলো খুশির। প্রহর খুশির কাঁধে থুতনি রেখে বললো।
–কি হলো সুইটহার্ট এতো জলদি টায়ার্ড হয়ে গেলে? এতক্ষণ তো খুব হাসির ঝর্ণাধারা ঝরাচ্ছিলে। এখন কি হলো? আমার কাছে থাকতে বুঝি ভালো লাগছে না?
খুশি কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–প্রহর লাগছে আমার। ছাড় প্লিজ।
খুশির কান্না মিশ্রিত কন্ঠ কানে আসতেই প্রহরের হাতটা ঢিলা হয়ে এলো। সেই সুযোগেই খুশি নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে ওখান থেকে সরে এলো। বাইরে ব্যালকনিতে এসে মুখে হাত চেপে কান্না আটকানোর যথাযথ চেষ্টা করছে। কাদলে যে চলবে না। ওকে শক্ত থাকতে হবে। এখনো যে অনেক রাস্তা পারি দিতে হবে ওকে। এভাবে এইটুকুতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। হঠাৎ কোমড়ে কারোর স্পর্শ পেল খুশি। অন্তর কেঁপে উঠল। সে জানে এটা কে। প্রহর এবার আলতো করে পেছন থেকে খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে খুশির চুলে নাক ডুবিয়ে দিল। থমকে গেল খুশি। এই ভালোবাসার পরশ যে তার চিরচেনা। তার অস্তিত্বে গেঁথে আছে। এতদিন পর প্রিয়তমের স্পর্শে মনের জানালায় দক্ষিণা বাতাস ছুঁয়ে গেল। সব ভুলে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এই ধারায়।
খুশির চুলের ঘ্রাণে হারিয়ে মাতাল প্রহর আরও মাতাল হয়ে গেল। নেশায় মাতাল কন্ঠে বললো।
–সো সরি বাবু। আমার দুষ্টুপরি টাকে ব্যাথা দিয়ে ফেলেছি বুঝি।
দুষ্টুপরি, এতদিন পরে আবারও সেই ডাকটা শুনে বুকের মাঝে হু হু করে উঠলো। মন চাচ্ছে সময়টা যেন এখানেই থেমে যাক। তবে না। ওকে এভাবে দূর্বল হওয়া যাবে না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে খুশি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
–কি করছ প্রহর? তুমি কি ভুলে গেছ আমার বিয়ে হয়ে গেছে?
বিয়ের কথা শুনে প্রহরের ক্রোধ আবারও জাগ্রত হয়ে গেল। প্রহর খুশির কাছে এগিয়ে গিয়ে খুশিকে পেছনের দেয়ালের সাথে আটকে ধরে মাতাল কন্ঠে বললো।
–কেন কি হয়েছে? আমিতো আদর করছি তোমাকে। এসোনা আরও আদর করি।
প্রহর খুশির কোমড়ের কাছে শাড়ি সরিয়ে কোমড়ে স্লাইড করতে লাগলো। খুশি প্রহরের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো।
–কি হচ্ছে এসব প্রহর? অসভ্যতামী করছ কেন?
প্রহর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
–ওও তো এখন তোমার এসব অসভ্যতামী লাগে? আগে তো নিজেই আমার কাছে সবসময় আদর চাইতে। আর এখন আমার স্পর্শ তোমার অসহ্য লাগে? কেন আমার ছোঁয়ায় বুঝি আর মজা নেই? এখন ওই লোকটার ছোঁয়া ভালো লাগে তোমার তাইনা? তাইতো আমাকে ছেড়ে ওর কাছে চলে গেলে? ইস হি দ্যাট মাস গুড? টেল মি, হাউ ওয়াজ হি? ডিড হি রিয়্যালি স্যাটিসফাইড ইউ?
নেশা,কষ্ট আর ক্রোধ সব মিলিয়ে প্রহরের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। সে কি বলছে তার কোন চৈতন্য নেই। তবে খুশি আর শুনতে পারলোনা। সারা শরীর কেমন রি রি করে উঠলো ওর। তাই আর সইতে না পেরে ঠাস করে প্রহরের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো।
–ছিহহ্…
আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল ওখান থেকে। আর প্রহর যথারীতি হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ভাঙতে শুরু করে দিল। নিজের ক্ষোভ এই নিষ্প্রাণ বস্তু গুলোর ওপর খাটাতে লাগলো।
__
জারিফ খুশির রুমের দরজায় কয়েকবার নক করে কোন সারাশব্দ না পেয়ে, নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে পুরো রুম অন্ধকার দেখতে পেল। জারিফ রুমের সুইচ খুঁজতে খুঁজতে বলতে লাগলো।
–কিরে খুশি তুই পার্টি থেকে কখন চলে এলি? আর আমি তোকে খুঁজে মরছি। একবার বলে আসবিনা আমাকে?
লাইট জালিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই চমকে গেল জারিফ। খুশি খাটের পায়ার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। ডান হাতের মাঝে কাচের গ্লাস চেপে ধরে আছে। যার দরুন হাতে কাচ বিঁধে গিয়ে ফ্লোরে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। জারিফ আৎকে উঠে দ্রুত খুশির সামনে গিয়ে বসলো। খুশির হাত ধরে হাতের ভেতর থেকে কাচের টুকরো বের করতে করতে বলতে লাগলো।
–হোয়াট দ্যা হেল! এসব কি করেছিস তুই? হাতের কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? পাগল হয়ে গেছিস তুই?
জারিফ ফাস্ট এইড বক্স বের করে খুশির হাত পরিস্কার দিতে লাগলো। খুশি তখন হাত টান দিয়ে বললো।
–ছেড়ে দাও বিবি। এই হাত ওর কর্মের ফল ভোগ করছে।ও বৃহৎ স্পর্ধা দেখিয়েছে।তাই ওর এটা প্রাপ্য।
জারিফ অবাক বলেন বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–হোয়াট রাবিশ। কি আবোল তাবোল বকছিস? হয়েছে টা কি তোর? তখন তো পার্টিতে ঠিকই ছিলি হঠাৎ কি হয়ে গেল?
খুশি ব্যাথিত কন্ঠে বললো।
–ও এসে গেছে বিবি ও এসে গেছে।
–কে এসে গেছে?
–যার কাছ থেকে এতদিন পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম সে এসে গেছে।
–এক মিনিট! তুই কি বলতে চাচ্ছিস ওই ছেলেটা? কি জেন নাম, প্রহর মেবি। ওর কথা বলছিস?
–হ্যাঁ প্রহর। আমার প্রহর। ও এখানে চলে এসেছে। আর আমাকেউ দেখে ফেলেছে।
–কখন? কিভাবে?
খুশি তারপর জারিফকে সবটা প্রথম থেকে খুলে ফেললো। সব শুনে জারিফ অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
–হোয়াট! তুই আমাকে তোর হাসব্যান্ড বলে দিয়েছিস?
–প্রহর আমাকে তোমার সাথে দেখে ভেবেছিল হয়তো তুমি আমার হাসব্যান্ড। তাই আমিও ওর ভাবনাকেই সঠিক প্রমাণ করে দিয়েছি। ওই মুহূর্তে এছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা আমার।
–বাহ্ আর তাই তুই আমাকে তোর হাসব্যান্ড ঘোষিত করে দিলি। এসব করার কি দরকার খুশি? ছেলেটাকে সত্যি বলে দিলেই তো হয়। শুধু শুধু তুইও কষ্ট পাচ্ছিস। আর ওকেও কষ্ট দিচ্ছিস।
–না বিবি, কিছুতেই না। সত্যি টা ওকে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না।নাহলে আমার এতদিনের সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। জানি হয়তো এখন কষ্ট পাবে। তবে চিরজীবনের কষ্টের চেয়ে এই কিছুদিনের কষ্টও যে ঢের ভালো। আমি চাই ও আমাকে তোমার সাথে হাসি খুশি দেখুক। তাহলে একসময় না একসময় ও এটা ঠিকই মেনে নিবে যে আমার জীবনে ওর আর কোন অস্তিত্ব নেই। তখন হয়তো ও আমাকে ভুলে নিজের জীবনে অগ্রসর হতে পারবে।
–আর যদি এমনটা নাহয়?
জারিফের এই প্রশ্নের উত্তর খুশিরও জানা নেই। জানা নেই আদৌও সে তার পরিকল্পনায় সফল হবে কিনা?
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★আরও একটা বিষাদময় রাতের অবসান ঘটিয়ে সকালের ঝলমলে আলো ফুটে উঠলো। যদিও এ আলোর কিরণ প্রহরের মাঝে পৌঁছাতে ব্যার্থ। তার ভেতরের কালো আধার সারাতে ব্যার্থ। এই আধার যে একমাত্র খুশি নামক আলোতেই ঘুচবে। প্রহরের সব সরণি যে খুশিতেই প্রারম্ভ আর খুশিতেই অন্ত।রাগে, অনুরাগে, শয়নেস্বপনে সর্বত্রই খুশির আধিপত্য। প্রহরের সূচনাও খুশি আর উপসংহারও খুশি। তাইতো প্রহরের ভাবনার জুড়ে শুধু তারই পদচারণ।
দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে প্রহর। নেশার ঘোর কেটেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে কাল রাতের কথা। কাল নেশার ঘোরে, রাগের মাথায় খুশির সাথে অনেক বাজে বিহেব করে ফেলেছে সে। অপরাধ বোধে তলিয়ে যাচ্ছে সে। কিভাবে পারলো খুশির সাথে অমন ব্যাবহার করতে? ও যদি আবারও পালিয়ে যায় তাহলে কি করবো আমি? না না ওকে আবারও হারাতে পারবোনা আমি কিছুতেই না। অস্থির মনে দ্রুত বেড়িয়ে গেল খুশির খোঁজে। খুশিকে না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাবে না ও।
খুশির রুমের সামনে এসে দেখলো রুম লক করা। তারমানে খুশি ভেতরে নেই। তাহলে কি সত্যি সত্যিই চলে গেল ও? নো নো দিস টাইম ইট কান্ট বি হ্যাপেন্ড। প্রহর অশান্ত হয়ে চারিদিকে খুশিকে খুঁজতে লাগলো। রিসোর্টের কোথাও না পেয়ে প্রহর এবার বাইরে এসে বিচের দিকে গেল খুঁজতে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর দেখা পেল খুশির। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো প্রহর। ওইতো সামনে ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসে আছে ওর প্রনয়ণী।আনমোনা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের বিশাল সমুদ্রের দিকে। বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ছে। প্রহর খুশির দিকে যেতে নিয়েও আবার গেলনা। এইমুহূর্তে ওকে ডিস্টার্ব না করাটাই ঠিক মনে হলো। প্রহর দূরে বসেই খুশিকে অবলোকন করতে লাগলো। ওর খুশিটা আর আগের মতো নেই।সেই প্রাণচাঞ্চল্যতা,দূরন্তপনা সব যেন গায়েব হয়ে গেছে। চেহারায় কেমন উদাসীনতা বিরাজ করছে। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। অনেক টা শুঁকেয়েও গেছে।
খুশির এই রুপান্তরিত রুপ প্রহরকে আরও দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।নিজের ওপর চরম রাগ হচ্ছে। কাল রাতে করা ওর কাজের জন্যই হয়তো খুশি এতো আপসেট। প্রহর বুঝতে পারছে ওর খুশি ভালো নেই। থাকবেই বা কি করে? প্রহরের খুশিতো শুধু প্রহরের কাছেই ভালো থাকবে। আর কারোর কাছে না। প্রহর আর খুশি দুজন দুজনার পরিপূরক। একজনকে ছাড়া আরেকজন ভালো থাকতেই পারে না। হঠাৎ প্রহরের নজর গেল খুশির হাতের দিকে। হাতে ব্যান্ডেজ দেখে বুক কেঁপে উঠল ওর। কি হয়েছে খুশির হাতে? কাল রাতে তো ঠিকই ছিল।তাহলে হঠাৎ কি হয়ে গেল? ওই রাস্কেল টা আবার কিছু করলো নাতো খুশির সাথে? যদি ওই রাস্কেল টা কোনকারণে খুশিকে আঘাত করে থাকে তাহলে ওর আয়ুকাল সমাপ্ত হয়ে এসেছে। কুল ডাউন প্রহর। কোন কিছু না জেনে আগেই কোন স্টেপ নেওয়া ঠিক হবে না। এতে খুশির আরও ক্ষতি হতে পারে।
তবে খুশির এই মলিন চেহারা প্রহরের সহ্য হচ্ছে না। আপাতত খুশির মুখে একটু হাসি কিভাবে ফুটানো যায় সেই চিন্তা করছে প্রহর। তখনই পাশে তাকিয়ে দেখলো কিছু বাচ্চারা বেলুন দিয়ে খেলছিল। প্রহর বাচ্চাগুলোকে ডেকে কানে কানে কিছু বললো। বাচ্চারা মাথা ঝাকিয়ে সবাই দৌড়ে খুশির সামনে গেল। খুশির সাথে ওরা বেলুন দিয়ে খেলতে লাগলো। মাছুম বাচ্চাদের দেখে খুশির ঠোঁটে আপনাআপনি এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আর খুশির ঠোঁটের এই সামন্য হাসিটুকুই যেন প্রহরের মনে এই বিশাল সমুদ্রের জলরাশি সমান তৃপ্ততা বয়ে আনলো।
তখনই ফাহিম এসে প্রহরের পাশে বসে বলে উঠলো।
–কি করছিস তুই ইয়ার? খুশিকে জোর করে এখানে রেখে তুই কি করতে চাইছিস?
প্রহর খুশির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো। –কি আবার করবো? আমার খুশিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবো ব্যাস আর কি?
–প্রহর তুই কেন বুঝতে পারছিস না? খুশির বিয়ে হয়ে গেছে? ও এখন অন্য কারোর সাথে হাসিখুশি সংসার করছে। তুই কেন ওর লাইফে কমপ্লিকেশন ক্রিয়েট করতে চাচ্ছিস?
প্রহর ফাহিমকে খুশির দিকে ইশারায় দেখিয়ে বললো।
–হাসিখুশি? কিসের হাসিখুশি? তুই একটু ভালো করে দেখতো খুশিকে। দেখ কোথায় ওকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে? আরে ওকেতো খুশিই মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে অন্য কেউ। ওর মাঝে তুই আমাদের আগের খুশির মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিস? যে খুশি সবাইকে তার উদ্দীপনায় মাতিয়ে রাখতো, সেই খুশি আজ নিজেই হারিয়ে গেছে। একে তুই হাসিখুশি থাকা বলছিস?
–তুই কি বলতে চাইছিস?
–দেখ আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। আমি বুঝতে পেরেছি হয়তো খুশির ফ্যামিলি ওকে জোর করে বা কোনরকম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ওকে এই বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। আর এই কারনেই ও এভাবে আমার জীবন থেকে গায়েব হয়ে গেছে। তবে আমি জানি আমার খুশি অন্য কারোর সাথে কিছুতেই ভালো থাকতে পারে না। ও শুধুমাত্র আমার সাথেই সুখী হবে। তাই যে করেই হোক আমার খুশিকে আমি আবারও আমার কাছে ফিরিয়ে আনবো। এবার আর হারাতে দেবনা ওকে।
ফাহিম আর কিছু বললো না ওকে। জানে বলে লাভ নেই। প্রহর খুশির জন্য দিওয়ানা। খুশির জন্য ও পাগলামির সর্বোসীমা ছাড়িয়ে যাবে। করোর কোন কথাই মানবে না। বাচ শুধু আশা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
__
ফাহিম একটু বিচে এসেছে ঘুরতে। প্রহরতো ওর কাজেই মত্তো তাই ফাহিম আপাতত ওর বাকি বন্ধুদের সাথে এসেছে। সমুদ্রের পানিতে দাঁড়িয়ে টুকটাক আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে। সব পর্যটকেরা যার যার মতো আনন্দ উল্লাসে মাতোয়ারা। কেউ পরিবারের সাথে, কেউ বন্ধুবান্ধবদের সাথে, আবার কেউবা এসেছে তাদের নব বিবাহিত জীবনের কিছু সুন্দর মুহূর্ত গড়তে।
এমনই এক ফ্রেন্ডসার্কেল ফাহিম দের থেকে কিছুটা দূরে আড্ডা দিচ্ছে। সবাই মিলে হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। তবে ওদের মাঝে একটা মেয়ে ওর নজর আকৃষ্ট করেছে। না মেয়েটার রুপের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়নি ফাহিম।যদিও মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দর। তবে ফাহিমের কৌতুহলের কারণ হলো মেয়েটিকে কেন যেন ওর চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে ও মেয়েটাকে। ফাহিম ব্রেনের হার্ড ডিস্কে সার্চ মারলো। মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে সেটা মনে করার চেষ্টা করছে। অতঃপর সফল হলো তার প্রচেষ্টায়। মনে পড়লো কোথায় দেখেছে সে মেয়েটাকে। আর মনে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এলো ফাহিমের। এই মেয়ে এখানে? এভাবে?
(ফ্লাসব্যাক)
মাসখানেক আগের কথা। ফাহিম ওর মায়ের অনেক জোড়াজুড়িতে বিয়ের জন্য, অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে যায়। রেস্টুরেন্টে গিয়ে টেবিল বুক করে বসে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাঁচ মিনিট একটা মেয়ে সেখানে আসে। ফাহিম মেয়েটাকে দেখে একটু বিভ্রান্ত চোখে তাকায়। মেয়টা কেমন পুরানো দিনের মতো ঢিলাঢালা সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে। চোখে ইয়া বড়ো বড়ো মোটা ফ্রেমের চশমা।চশমার পাওয়ার তো মনে হচ্ছে সর্বোনিম্ন মাত্রায়। চুলগুলো মনে হচ্ছে তেলের মধ্যে ডুবিয়ে এনেছে। মেয়েটা তার বাঁধাই করা দাঁত গুলো বের করে বললো।
–জ্বি আমি তিশা।
ফাহিম নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো।
–ও হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ফাহিম। বসুন না প্লিজ।
তিশা ফাহিমের মুখোমুখি চেয়ার টান দিয়ে বসে লাজুক ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফাহিম একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বলে উঠলো।
–আপনি কি খাবেন? চা না কফি?
তিশা কিছু না বলে ওভাবেই বসে আছে। ফাহিম আবারও বলে উঠলো।
–বলছিলাম যে আপনি কি কিছু অর্ডার দিবেন?
তিশা তখন বলে উঠলো।
–কি বললেন আরেকটু জোরে বলুন না? আসলে আমি কানে কম শুনি তো। আগে তো একদমই শুনতে পেতাম না। এইতো কিছুদিন আগে অপরেশন হয়েছে। তাই এখন আধটু শুনতে পাই।
বেচারা ফাহিম হতবিহবল হয়ে গেল। ওর মা কি দেশে আর কোন মেয়ে খুজে পায়নি? শেষমেশ কিনা এই মেয়ে? তবুও নিজের মনোভাব কোনরকমে দমিয়ে নিয়ে একটু উচ্চস্বরে বললো।
–আমি বলছিলাম আপনি কি খাবেন?
–জ্বি ধন্যবাদ আমি এখন কিছু খাবোনা। আসলে আমার আবার গ্যাসের সমস্যা আছে। একটুখানি গড়বড় হলেই বোম ব্লাস্ট শুরু হয়ে যাবে। তাই মা বলেছে আমি এবার যেন কিছু না খাই। নাহলে গত উননব্বই নাম্বার ছেলেটার মতো আপনিও ব্লাস্টে উড়ে যাবেন।
বেচারা ফাহিম সেদিন কোমায় যেতে যেতে রক্ষা হয়েছিল। বাসায় গিয়ে সেদিন ওর মার সাথে অনেক রাগ দেখিয়ে ওই বিয়েতে মানা করে দেয়।
কিন্তু আজকের এই তিশা তো অন্যই একজন মনে হচ্ছে। সেদিনের সেই তিশার সাথে কোন মিল নেই এই মেয়ের। এই মেয়েতো একেবারে মডার্ন মেয়েদের মতো জিন্স প্যান্ট, টপস পড়া। চোখে নেই কোন চশমার বালাই। চুলগুলোও এখন বাতাসে দোল খাচ্ছে। কাহিনি কি? এটা কি সত্যিই তিশা? নাকি ওর কোন জমজ বোন? বিষয় টা ক্ষতিয়ে দেখার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ফাহিম মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েগুলোর কাছাকাছি যেতেই ওদের কথপোকথন কানে এলো ফাহিমের। তিশার এক বান্ধবী বলছে।
–ওয়াও ইয়ার কত্তো মজা হচ্ছে। আমার তো এখান থেকে যেতেই ইচ্ছে করছে না। সব তোর জন্য হয়েছে তিশা। থ্যাংকস ইয়ার।
তিশা ডাকায় ফাহিম শিওর হলো এই মেয়েটিই তাহলে তিশা। এবার তিশা বলে উঠলো।
–মেনশন নট দোস্ত। আরে আমিওতো এই ফ্রিডম লাইফ চাই। তাইতো কোন বন্ধনে আবদ্ধ হইনা। দেখিস না বাবা মার আনা ছেলে গুলোকে কিভাবে ভাগাই। আমও খাই লাঠিও ভাঙিনা। এমন নাটক করি যে ছেলেগুলো নিজে থেকেই বিয়েতে মানা করে দেয়। আর মাঝখান আমি দুখিয়ারি সব সিমপ্যাথি পেয়ে যাই। আর আমার মন ভালো করার জন্য বাবা আমাকে ট্রিপে পাঠিয়ে দেয়। এটা হলো তিশার ক্যালমা।
পেছন থেকে সব শুনে ফাহিম হতভম্ব হয়ে গেল। মানে এই মেয়েটা ওকে এভাবে উল্লু বানিয়ে দিয়েছে? একে তো আমি মজা দেখাচ্ছি। অনেক সখ না দুখিয়ারি সাজার? এবার দেখাবো আমার ক্যালমা। ফাহিম বাঁকা হেসে মাথায় কিছু সয়তানি আঁটতে লাগলো।
__
রাত আট টা,
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন আজ। তীব্র শীত চারিদিকে। হিম শীতল বাতাসে শরীর যেন জমে যাওয়ার উপক্রম।রুমের ভেতর বসে বসে ভালো লাগছিল না খুশির।তাই গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাইরের দিকে এলো। বাইরে এসে দেখলো রিসোর্টের খোলা জায়গায় অনেক ছেলেমেয়ে আগুন জ্বালিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ আবার গিটার বাজিয়ে গান ধরেছে।বিষয় টা খুশির ভালোই লাগলো। খুশিও এগিয়ে গিয়ে ওদের মাঝে বসলো। সবার সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগলো।
কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর ওখানে প্রহরও এসে উপস্থিত হলো। সেও ওখানে বসে খুশিকেই অবলোকন করতে লাগলো। প্রহরকে দেখে খুশি একবার উঠে যেতে চাইলো, আবার ভাবলো এভাবে উঠে গেলে হয়তো আরও রেগে যেতে পারে প্রহর। তখন সবার সামনে উল্টো পাল্টা কোনকিছু করে বসবে। অগত্যা ওভাবেই বসে রইলো খুশি। প্রহরের নজর খুশিতেই আবদ্ধ। আগুনের প্রজ্বলিত আলোয় খুশির মায়াবী মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। যে আলোয় মোহময় হচ্ছে প্রহরের মন বাগান। খুব ইচ্ছে করছে পাগলীটাকে বুকের মাঝে নিয়ে,এ বুকের দহন মেটাতে। সমুদ্র কিনারে তাকে নিয়ে চন্দ্রবিলাস করতে। কিন্তু শতইচ্ছা থাকা সত্বেও পারছে না তা করতে। কেন এতো বাঁধা বিঘ্নতা ওদের মাঝে?
হঠাৎ পাশের একটা ছেলের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো প্রহরের। এখানকার অনেকেই প্রহরকপ চেনে।তাদের মাঝে একটা ছেলে প্রহরের দিকে গিটার এগিয়ে দিয়ে বললো।
–ভাইয়া একটা গান শোনান না? আমাদের সবার রিকুয়েষ্ট প্লিজ?
প্রহর একবার খুশির দিকে তাকালো। তারপর গিটার টা হাতে তুলে নিল। খুশির পানে দৃষ্টি রেখে, তাদের ভালোবাসাময় মধুর স্মৃতি গুলো মন করে গেয়ে উঠলো।
♬ তুম মেরে হো ইসপাল মেরে হো
♬ কাল শাহেদ এ আলাম না রাহে
♬ কুছ এইসা হো তুম তুম না রাহো
♬ কুছ এইসা হো হাম হাম না রাহে
♬ ইয়ে রাস্তে আলাগ হো যায়ে
♬ চালতে চালতে হাম খো যায়ে
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
♬ ইস চাহাত মে মার যাউঙ্গা
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
♬ এইসে জরুরি হো মুঝকো তুম
♬ জেইসে হাওয়া এ শ্বাসো কো
♬ এইসে তালাসু মে তুমকো
♬ জেইসে কি পের জামিনো কো
♬ হাসনা ইয়া রোনা হো মুঝে
♬ পাগাল সা ঢুনডো মে তুঝে
♬ কাল মুঝকো ইজাজাত হো না হো
♬ কাল মুঝ সে মোহাব্বত হো না হো
♬ টুটে দিলকে টুকরে লেকার
♬ তেরে দার পে হি রেহ যাউঙ্গা
♬ হোও ওওও ও
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
♬ ইস চাহাত মে মার যাউঙ্গা
♬ মে ফিরবি তুমকো চাহুঙ্গা
প্রহরের গানের মাঝে তার আহত হৃদয়ের বেদনার সুর ভেসে উঠেছে। চোখে ভেসে উঠেছে মর্মবেদনার লাল লালিমা। খুশির পক্ষে আর সহ্য করা অসম্ভব। প্রহরের এই নিদারুন সুর তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে। খুশি আর থাকতে না পেরে দ্রুত ওখান থেকে উঠে এলো। দৌড়ে এলো সমুদ্র পাড়ে। নিঃশ্বাস টা কেমন আটকে আসছিল ওর। একটুখানি কাঁদার খুব দরকার ওর। নাহলে দম আঁটকে মরে যাবে ও। খুশি মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো।
তবে শান্তিতে বেশিক্ষণ এটাও করতে পারলোনা ও। প্রহর ওর পিছে এসে বললো।
–কি হলো পালিয়ে এলে কেন? নাকি আমার কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না তোমার?
খুশি দ্রুত চোখের পানি মুছে ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু প্রতিবারের মতো ব্যার্থ হলো সে। প্রহর খুশির হাত ধরে আটকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–কি হলো বলোনা? কেন চলে এলে? নাকি আমার মুখোমুখি থাকার ক্ষমতা অর্জন করতে পারছনা? আমি জানি তুমি যাই বলনা কেন, আমার কষ্ট তুমি আজও সইতে পারোনা। তাইনা বলো? তাহলে কেন দূরে থাকছ? কেন কষ্ট দিচ্ছ আমাকে?
খুশি অনেক জোর খাটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
–এ এমন কিছুই না। তুমি ভুল ভাবছ। যেতে দাও আমাকে।
প্রহর আবারও খুশিকে নিজের সাথে আটকে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে অবুঝের মতো করে বলতে লাগলো।
–না ছাড়বোনা। কিছুতেই ছাড়বোনা আমি।
খুশি ক্লান্ত হয়ে বললো।
–এমন কেন করছ প্রহর? তুমিতো অনেক আদর্শ আর নীতিবান ছেলে ছিলে। তাহলে এখন কি হয়েছে তোমার? এমন অশোভনীয় আচরণ কেন করছ?
প্রহর ক্ষোভের সুরে বললো।
–কি লাভ হলো এতো ভালো মানুষ হওয়ার? ভালো মানুষ হওয়ার প্রতিদান স্বরূপ তোমাকে হারালাম। তারচেয়ে তো আমিও তোমার মতো বেপরোয়া হলেই ভালো হতো। নিজেকে সংযত না রেখে তোমাকে যদি একান্ত নিজের করে নিতাম। তাহলে হয়তো আজ তুমি আমার কাছে থাকতে। তাই এখন যদি তোমাকে ফিরে পেতে আমাকে জঘন্য খারাপও হতে হয় তবুও আমি হবো।
খুশি চমকে উঠে বললো।
–ফিরে পেতে মানে? কি বলছ এসব? দেখ,তুমি কিন্তু বলেছিলে তুমি যদি আমাকে শাস্তি দিতে চাও তাই এখানে আটকে রেখেছ। তাহলে এই ফিরে পাবার কথা কোথাথেকে আসছে?
প্রহর তিরস্কার মূলক হাসি দিয়ে বললো।
–শাস্তি? কিসের শাস্তি? যার নামে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস চলে তাকে কি শাস্তি দিবো আমি? এই অন্তর্দেশ জুড়ে যার পদচারণ তাকে কি শাস্তি দিবো? যার দর্শন বিনা মরেও শান্তি পবোনা তাকে কি শাস্তি দিবো বলতে পারো? আরে শাস্তি তো আমি পাচ্ছি। তাও বিনা অপরাধে। দিনরাত প্রতিটি মুহূর্ত পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছি। আমি আর পারছিনা খুশি। প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে।আই প্রমিজ আমি কখনো তোমাকে কোন প্রশ্ন করবোনা। কখনো তোমার কাছে কোন কৈফিয়ত চাইবো না। বাচ আমার শুধু তুমি চাই খুশি। শুধু তুমি।
কথাগুলো বলতে বলতে প্রহরের চোখ ভরে এলো। প্রহর ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়লো। দুই হাতে শক্ত করে খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মাথা ঠেকিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো।
–প্লিজ খুশি। আই কান্ট লিভ উইথাউট ইউ। প্লিজ কাম টু মি।প্লিজ প্লিজ প্লিজ….
খুশির বুকটা যে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।কঠোর আত্মমর্যাদা পূর্ণ প্রহরের এই নিদারুন অবস্থা খুশি কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর। যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, আজ তাকেই না চাইতেও কষ্ট দিতে হচ্ছে। খুশি আর সইতে পারলো না। তাই কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে আবারও ছুটে চলে গেল। প্রহর ওভাবেই বসে থেকে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো।
–প্লিজ খুশি যেওনা। কাম ব্যাক টু মি। একবার মনে করো সেই দিনগুলো। কত খুশি ছিলাম আমরা। কত মধুর ছিল সেই দিনগুলো।
বলতে বলতে প্রহর বালির ওপরই চিত হয়ে শুয়ে পড়লো। খুশিকে পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে নিজেও হারিয়ে গেল সেই মধুই দিনগুলোতে। যেখানে তাদের সুখের সীমা ছিলনা।
চলবে…..