#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৫
আকাশ তার বোনির দিকে একবার তাকায় তো আবার সামনে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে তাকায়। আকাশ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বোনির হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা তুললো। প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। আকাশ যখন উঠে প্রিয়তার দিকে তাকালো তখন প্রিয়তা আকাশের চোখ-মুখে বিষন্নতা দেখতে পেলো। আকাশ বিষন্ন মনে বলে,
–কি করলেন আপনি এটা? বোনিকে আমি কতো যত্ন করি। যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। এখন ওকে কয়েকমাস পর নিউ স্টুডেন্টদের কাছে বিক্রি করলে কি আমি আমার কেনা মূল্যের কাছাকাছি পাবো?
প্রিয়তার বুক কাঁপছে। ছেলেটা যে তার সিনিয়র সেটা বুঝতে পারছে। এখন সিনিয়র যদি র্যাগ দেয়! র্যাগিং কে অনেক ভয় পায় প্রিয়তা। স্কুলে একবার সিনিয়র আপুরে র্যাগ দিয়েছিল। সেদিন প্রিয়তার বেনি করা চুল খুলে দিয়ে সবার সামনে অপমান করেছিল। প্রিয়তার সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে জ্বর এসে গেছিল। এখন যদি এই সিনিয়র ছেলেটাও র্যাগ দেয়! চোখ ছলছল করে উঠলো প্রিয়তার। আকাশ তখন কথা গুলো বলে বোনির হাড্ডি গুলো ভালো করে দেখছিল। এরপর আবার সামনে তাকিয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। কারন তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে জল ভরে উঠেছে। যেকোনো সময় সেটা গড়িয়ে পরার অপেক্ষা। আকাশ তো তাকে এমন কিছু বলেনি যে কাঁদবে!
আকাশ ভরকে গিয়ে বলে,
–আপনি কাঁদছেন কেনো? প্লিজ কাঁদবেন না। মেয়েরা আমার সামনে কাঁদলে আমার গিল্টি ফিল হয়। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।
আকাশ যতই কাঁদতে মানা করুক, প্রিয়তার তো কান্না পাচ্ছেই। আকাশ বলাতে আরো কান্না করে দেয়। তারপর নাক টেনে বলে,
–আমাকে মাফ করে দিন ভাইয়া। আসলে আমি অন্যমনা ছিলাম। নতুন পরিবেশ তাও কাউকে চিনি না। স্যরি ভাইয়া।
আকাশ স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–কাঁদবেন না আপনি। পুরো দোষ আপনার না। আমিও টেনশনে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম। কপালে থাকলে আর কিছু করা যায় না।
ছেলেটার নম্র ব্যাবহারে কিছুটা শান্ত হয় প্রিয়তা। তারপর ছেলেটাকে কঙ্কালটার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তার খারাপ লাগে। প্রিয়তা বলে,
–কিছু মনে করবেন না। আমি মেডিকেলের প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। আমার কয়দিন পর মানব কঙ্কাল লাগবে। আপনি যদি এটা বিক্রি করেন তো আমি কিনবো। আমার জন্য ক্ষতি হয়েছে তাই আমি আপনার প্রাপ্য মূল্য দিবো।
আকাশ অবাক হয়। তারপর বলে,
–না সমস্যা নেই। আপনার কিনতে হবে না। আমি বুঝে নিবো। আপনি কেনো ভাঙা বোনি নিবেন?
প্রিয়তা তাড়া দিয়ে বলে,
–ভাঙা কোথায়? আমি তো কিনবো পড়ার জন্য। এতে যেমনি হোক। আপনি যখন বিক্রি করবেন আমাকে বলবেন। আমিই কিনবো।
আকাশ বিনিময়ে স্মিত মুচকি হাসে। তারপর চলে যায়। প্রিয়তা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটার নাম তার জানা হয়নি তবে ছেলেটার ব্যাবহার ও হাসিটা তার ভালো লেগেছে।
“প্রথম দেখাতে ছেলেটার ক্ষতি করে দিয়েও এতো নম্র ব্যাবহার! তাহলে ছেলেটা তার আপন মানুষদের সাথে কতোটা আন্তরিক!”
এগুলো ভেবে প্রিয়তা নিজের মাথায় নিজে চাটি মারে। তারপর মুচকি হেসে চলে যায়।
প্রথমদিন ইনট্রোডাক্টরি ক্লাস ভালোভাবে কাটে। তারপরের দিনও ভালো কাটে। এক সপ্তাহ ক্লাসের পরও প্রিয়তা সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। রুমমেট তিনটা মেয়ের মধ্যে একটা থার্ড ইয়ারের আছে।
একদিন ক্লাস শেষে প্রিয়তা ক্লান্ত হয়ে নিজের বেডে গা এলিয়ে দিলে রুমমেট বড় আপুটা কারো সাথে কথা বলছিল ফোনে তখন শুনতে পায়,
–আহারে! ছেলেটার পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। এক চাচা ছিল সেও চলে গেল। ক্লাস শেষে যখন ফোন তুলল তখন খবর পাওয়া মাত্র ছেলেটার সেকি কান্না! সত্যি খারাপ লাগলো ইয়ার।
—
–হ্যাঁ, আমি ওকে প্রতিদ্বন্দ্বী মানি পড়াশোনাতে। স্যাররা আকাশ বলতে পাগল। কিন্তু এতিম ছেলেটার দুনিয়াতে আর কেউ রইলো না। এক চাচা ছিলো। আজ সেও চলে গেলো। ওর ভদ্রতার জন্য ব্যাঙ্গ করতাম। খারাপ লাগছে খুব রে। আল্লাহ আর কাউকে ওর মতো পরিস্থিতিতে না ফেলুক।
প্রিয়তার এটুকু শুনে অনেক খারাপ লাগে। বাবা-মায়ের থেকে শুধু কয়েক মাইল দূরে থেকেই প্রিয়তার কষ্ট হচ্ছে তো ওই ছেলেটার কি অবস্থা! প্রিয়তা তো ছেলেটাকে চিনেও না। প্রিয়তা ছেলেটাকে চেনার জন্য ওই আপুর কাছে যায়। তারপর আপুর কথা বলা শেষ হবার অপেক্ষা করতে থাকে। কথা বলা শেষ হলে প্রিয়তা জিজ্ঞাসা করে,
–আপু, কার কে মারা গেছে?
রুমমেট বড় আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–আর বলিস না। আমাদের ব্যাচের টপার আকাশ। যার সাথে আমার টপার হওয়া নিয়ে প্রতিযোগীতা চলে, তার চাচা মারা গেছে। শুনেছি ছোট বেলায় কার এক্সিডেন্টে ওর মা-বাবা দুজনেই মারা গেছিলো। এরপর থেকে ছোট আকাশকে ওর চাচা বড় করেছে। ওর চাচা যখন পড়াশোনা করতো তখন থেকেই ভাতিজাকে সে পালে। বিয়েও করেনি নাকি ওর চাচা। পনেরো বছর ধরে আকাশ ওর চাচার সাথে থাকে। আজ খবর এলো ওর চাচা নাকি স্ট্রোক করে মারা গেছে। ছেলেটার দুনিয়াতে কেউ রইলো না রে।
প্রিয়তার চোখ ভরে আসে। সে আবারো জিজ্ঞাসা করে,
–ভাইয়াটার কোনো ছবি আছে? আমি তো চিনি না। তাই!
রুমমেট বড় আপু তার ফোনে গ্রুপ ফটো থেকে আকাশকে দেখায়। প্রিয়তা চিনতে পারে কারন এটা সেদিনের ছেলেটাই। প্রিয়তা আর কিছু বলে না। নিজের বেডে চলে আসে। ওজু করে আসরের নামাজ পড়ে নেয়। নামাজের মুনাজাতে আকাশের চাচার আত্নার শান্তি ও আকাশের মনোবল বাড়ানোর জন্য দোয়া করে।
রাতেও ঘুমানোর সময় প্রিয়তার অস্থির লাগা ও চোখে বারবার পানি চলে আসছিল। কেনো আসছিল সেটাও প্রিয়তা বুঝতে পারছিল না। আকাশের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো জানার পর থেকে বারবার সেদিনের আকাশের দেয়া স্মিত মুচকি হাসি মনে পড়ছে। মন ছটফট করছে একবার আকাশকে দেখতে, স্বান্তনা দিতে যে
“তুমি নিজেকে একা ভেবো না। কেউ তোমার সাথে না থাকলেও আমি আছি!”
এর আগে প্রিয়তার কারো কষ্টের কথা শুনলে এতোটা কষ্ট হয়নি। স্বভাবত নরম হলেও কাউকে এভাবে স্বান্তনা বা সহানুভূতি দিতে চায়নি। আজ কেনো?
আরো চারদিন কেটে যায়,,
প্রিয়তা ক্যাম্পাসে আকাশকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। পাবেই বা কি করে! আকাশ এখনো ক্যাম্পাসে আসেনি। চারদিন পর যখন বিদ্ধস্থ আকাশকে ক্যাম্পাসে দেখলো, প্রিয়তা তৎক্ষণাৎ নিজের ক্লাসের কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে আকাশের কাছে যায়। তারপর হাঁপাতে থাকে। আকাশও হঠাৎ একটা মেয়েকে নিজের সামনে এসে হাপাতে দেখে আনমনা থেকো চমকে উঠে। প্রিয়তা এটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করে,
–কেমন আছেন আপনি?
আকাশ চুপ করে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তার মায়া লাগে এই অসহায় চাহনি দেখে। প্রিয়তা নরম স্বরে বলে,
–সামলান নিজেকে। জানি আপনার কস্ট হচ্ছে অনেক। আমার বলাতেও কস্ট কমবে না। তবে আপনাকে তো বাঁচতে হবে। সবাই চিরদিন থাকে না। জানি এ কথা শুধু স্বান্তনা দেওয়া যায়। যার হারায় সে বুঝে।
আকাশ মুখ খুলে। তারপর বলে,
–আমার কেউ নেই! আমি এই দুনিয়াতে এক ছিন্নমূল হয়ে গেছি। আমার আপনজন বলতে চাচা ছিল। যে কিনা আমার আপন চাচা না। সে আমাকে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পেয়েছিল। আমাকে সে সেদিন না বাঁচালে হয়তো বাবা-মায়ের সাথে আমিও মরে যেতাম। আমার আগের কিছু মনে নেই। তাই ৬ বছরের আমিকে চাচা নিজের কাছেই রাখে। আমার আদোও কোনো আত্নীয় স্বজন আছে বলে আমার মনে নেই ঠিক করে। ৬ বছরের বাচ্চা তখন আমি। নিজের নাম ও বাবা-মায়ের নাম বলতে পেরেছিলাম তাও এক্সিডেন্টের তিন সপ্তাহ পর কারন আমি খুব বাজে ভাবে আহত হয়েছিলাম। একা হয়ে গেলাম আমি।
প্রিয়তা কিছু বলবে তার আগেই আকাশ চলে যায়। প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের যাওয়া দেখছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,