অন্তরিন প্রণয় পর্ব -২৪

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৪

পিনপতন নীরবতা মাঝে কুকুর গুলোর কান্না দেওয়ান বাড়িটাকে আরো ভীতগ্রস্ত করে তুলছে।ফাহমিদার হেচঁকি তোলা কান্নায় হুট করেই আবার নীরবতা লুপ্ত হয়।তার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে খুরশীদ আনওয়ার।মাথায় ব্যান্ডেজ।আফীফ নিজের মাথায় হাত দিয়ে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো, রাতের দুইটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি।ফাতেমা আফীফের পাশেই বসা ছিলেন।কুকুর গুলোর কান্নায় তিনি বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়তে শুরু করেন।
আফীফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে সুউচ্চ স্বরে বলেন,
– জানো নি দাদুভাই কুকুর কাদঁলে বিপদ আসে।

ফাতেমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সহসা জবাব দিলেন ফাহমিদা।
– আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?একমাত্র মেয়ের খোঁজ নেই।আজ আবার স্বামী মাথা ফাটিয়ে এই অবস্থা।এরা ছাড়া ব্যাক্তিগত জীবনে আমার আর কেউ নেই।তবে আমার আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?

ফাহমিদার হতাশ কন্ঠ।আফীফ ঘাড় ঘুরিয়ে ফাতেমাকে ইশারা করে চুপ থাকতে।হুট করেই যেন দুই তিনটা কুকুরের ডাক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
– ওই দেখ দেখ তোরা বিপদ আশেপাশে খালি ঘুরতাছে।
– দাদী তুমি থামবে।তোমার কুসংস্কার কথাবার্তা তা তুমি তোমার কাছে রাখো।

আফীফের রুষ্ট কন্ঠ।সহসা সবার মাঝ থেকে উঠে চলে আসে।বাড়ির বাইরে দৌবারিকদের ইশারায় ডেকে প্রশ্ন করে,
– সমস্যা কি?কুকুর গুলোকে দূর করছো না কেন?
– দূর করেছি ভাইজান কিন্তু ঘুরে ফিরে এদিকেই আসছে।

আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।বাগানের দিকটায় হাটা শুরু করে ভাবতে থাকে সেহেরিশের কথা।কে এমনটা করেছে, কী উদ্দেশ্য করেছে? যদি আফীফের কোন শত্রু হতো তবে কোন না কোন বার্তা ঠিকি প্রেরণ করা হতো কিন্তু আফীফের কাছে কোন বার্তা পৌঁছেনি।একরাশ চিন্তা নিয়ে আফীফ ব্লাক হাউজের দিকে রওনা হলো।পুরো বাড়িটি কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।বাড়ির পেছনের দিকটায় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো সে।

দরজা খোলার শব্দে ব্লাক হাউজে বন্দি থাকা মানবটি সহসা চোখ খুলে নিলো।গায়ে থাকা কাঁথাটা ভালোভাবে মুড়িয়ে উঠে বসতেই আফীফকে দেখে তিলার্ধেক হাসে।আফীফ একটি চেয়ারে বসে তাকে সহসা প্রশ্ন করে,
– কেমন আছেন আপনি?
– যেমন রেখেছো।

আফীফ ফস করে শ্বাস ছাড়লো।পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে ধরে গম্ভীর স্বরে বলে,
– চিনতে পারছেন আশা করি?
– হ্যা এটা তো সেই পুতুলটা তাকিয়া।তোমাদের বিয়ে হবে কবে?
– সে নিখোঁজ!
– ন…ন…নিখোঁজ? তবে কি বিয়ে হবে না?
– হাহ!মানুষের রঙ কত পালটে।স্বার্থের রঙ পালটে।নিজ স্বার্থে মানুষ কি না করতে পারে।এখন তাকিয়া আর আমার বিয়ে চাইছেন?এই কথাটা আগে কেন ভাবেন নি?
– আমি কিছু জানি না।আমি কিছু জানি না।

মানবটি কাঁথা মুডিয়ে শুয়ে পড়ে।আফীফ ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে উঠে যায়।এবং সহসা সেখান থেকে বের হতেই দৌবারিকদের কলহ শুনতে পায়।আফীফ এক ছুটে বাগান পেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
– কি হয়েছে এখানে এত শোরগোল কিসের?
– ভাইজান কে আইছে একবার দেহেন।

আফীফ মাথা উচু কথা তাকায়।হাটু মুড়িয়ে বসে থাকা সেহেরিশকে দেখে এক মূহুর্তের জন্য তার অনুভূতিরা থমকে যায়।মস্তিষ্ক তার অচল হয়ে গেছে এই মূহুর্তে কী করতে হবে?কি করতে হবে তার?হুট করেই কানে আসে সেহেরিশের চাপা কান্নার আওয়াজ।আফীফের যেন সৎবিৎ ফিরে এসেছে।সহসা সেহেরিশের সামনে হাটু মুড়ে বসে।সেদিনের সাজ আজ এলোমেলো।গালের লাল রঙটা রক্তিম আভায় ছড়িয়ে আছে।মেয়েটাকে দেখতে একদম বিদস্ত লাগছে।

– স..সেহেরিশ!
সেহেরিশ মাথা তুলে আফীফের দিকে তাকায়।আফীফের ডান হাতটা আকড়ে ধরে আরেকটু শব্দ করে কেঁদে দেয়।আফীফ দেরি না করে ঝটপট সেহেরিশকে কোলে তুলে নেয় এবং বাড়ির ভিতরে হাটা শুরু করে।
.

– মারে তুই কোথায় ছিলি?
ফাহমিদার প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।তুন্দ্র,কেইন,মারুফা সহ বাকি সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে।আফীফ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পরখ করছে।পায়ে, হাতে শক্ত কোন মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধার ফলে চামড়া ছিড়ে রক্ত শুকিয়ে দাগ লেগে আছে।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে ফস করে শ্বাস ছাড়লো।

– আমি রুমে যাবো মামনি আমাকে নিয়ে যাও আমি হাটতে পারছি না।

সেহেরিশের কথায় কেইন তুন্দ্র এগিয়ে এসে সেহেরিশকে তুলে দাড় করায়।কিন্তু এক কদম এগোতেই পায়ের ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে।আফীফ ডানে বায়ে না তাকিয়ে কাউকে পরোয়া না করে আবারো সেহেরিশকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।এবং সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে সেহেরিশের রুমে নিয়ে যায়।লজ্জা, সংশয়, ভয়ে নুইয়ে আছে সেহেরিশ।বার বার ঠোঁট কামড়ে কান্না দমন করছে।আফীফের চিন্তা মগ্ন চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ তাকে বিছানায় বসাতেই বালিশ টেনে সহসা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।সেহেরিশের কান্ডে অবাক না হয়ে পারলো না আফীফ।
– কোথায় ছিলে তুমি সেহেরিশ?
– আমি জানি না।
– কে নিয়ে গেছিলো তোমায়?
– আমি জানি না।
আফীফ মাথা নত করে সেহেরিশের হাত কাছে টেনে নেয়।ফর্সা হাত যুগলে রক্তের ছাপ লেগে আছে।চোখের কোনে কান্নার ফলে গালেও দাগ লেগে আছে।
– তুমি জানো পাগলের মতো খুঁজে ছিলাম তোমায় কিন্তু তোমার কোন হদিস পাইনি।প্লিজ সেহেরিশ কি হয়েছিল আমাকে খুলে বলো।
– আমি জানি না কিছু। আমার হাতে পায়ে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।মুখে কাপড়।নিরিবিলি একটা রুমেই বন্দি ছিলাম।মাঝে মাঝে এক দুইজন পুরুষের কন্ঠ পেতার আর হ্যা একজন মহিলা!
– মহিলা?
– হ..হ্যা সে এই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেত।ছেড়ে দেওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলেছিল “দুইপক্ষের কারনে রেষারেষি আজ এতদূর।” কিন্তু কি বললো আমি তার অর্থ খুঁজে পেলাম না।আমাকে গাড়ি করে পুকুর পাড়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় আর বাকিটা আমি নিজেই চলে আসি।

সেহেরিশ থামে।অনবরত তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।আফীফ উঠে যায় দরজা খুলে বের হতে নিলেই বাড়ির সবাইকে এক সঙ্গে দেখতে পেয়ে মুনিফকে ইশারা করে তার সাথে যেতে।

– কি রে সেহেরিশ কি বলেছে?
– এই বাড়ির কারো সাথে আততায়ীদের যোগাযোগ রয়েছে।
– ম..মানে ক..কি বলছিস।
– হুম ঠিক বলছি।আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।তা না হলে প্রত্যেক টা টোপ কি করে এত সুক্ষ্ম ভাবে সফল হয়।এই সব কিছুর পেছনে মেইন লিডারশীপ একজন মহিলা।
– কি সব অদ্ভুত কথা বলছিস তুই?
– যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি।তোর দায়িত্ব বাড়ির সকল কর্মচারীদের মোবাইল চেক করা।
– এখন রাত সাড়ে তিনটা বাজে এতরাতে এইসব করার কি মানে?
– আমি করতে বলেছি করবি।এত প্রশ্ন করবি না।সব কিছুর ডিটেইলস আমি চাই।

মুনিফ মাথা নামিয়ে চলে যায়।আফীফ মাথা নুইয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে।

____

কেটে গেছে প্রায় তিন দিন।সেহেরিশ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছে।খুরশীদ আনওয়ার এখন মোটামুটি সুস্থ।মারুফা এবং ফাহমিদার সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে তারা সিধান্ত নেন আজকের মধ্যেই এই গ্রাম ছড়ে চলে যাবেন।প্রয়োজন নেই তাদের জমি। যেখানে জানের ভয়,জীবন মরণের প্রশ্ন আসে সেখানে আর এক মূহুর্তেও থাকা যায় না।আহনাফ দেওয়ান বসার ঘরে কপালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন।তৎক্ষণাৎ খুরশীদ আনওয়ারের উপস্থিতি টের পেয়ে নড়ে নড়ে বসেন।
– কিছু বলবেন?
– জি।আমরা সিধান্ত নিয়েছি আজি এই গ্রাম ছেড়ে যাবো
– সে কি কথা আপনাদের জমি….
– যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে জমি জামার আমার প্রয়োজন নেই।
খুরশীদ আনওয়ারের কথার মাঝে আফীফ তাদের সামনে দাঁড়ায়।ততৎক্ষনাৎ আহনাফ দেওয়ান উস্খুস করে খুরশীদ আনওয়ারের হাত জড়িয়ে ধরেন।
– আমার একটা প্রস্তাব আছে যদি রাখতেন।
– প্রস্তাব!বেশ বলুন।
– আপনার মেয়ে সেহেরিশকে আমরা এই বাড়ির বউ হিসেবে চাই।আপনি এভাবে যাবেন না।অন্তত…
– মাফ করবেন আমায়।আমি আপনার এই প্রস্তাবটি রাখতে পারলাম না।আমার মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে আছে আশা করি বুঝতে পারছেন।
খুরশীদের কথায় চমকে তাকায় আফীফ এবং আহনাফ।
– ক… কি বলছেন আপনি?
– আমি ঠিকি বলছি।আমরা বরং আজ ফিরে যাবো।

খুরশীদ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়।আফীফ আহনাফ দেওয়ানের দিকে কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সহসা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।
– আরে দাদুভাই শুন আমার কথা।

আহনাফ দেওয়ানের কথা শেষ হতেই তার কানে আসে দরজা বন্ধ করার বিকট শব্দ।এই শব্দ শেষ বার শুনেছিল আট বছর আগে যখন সেহেরিশ পালিয়ে যায় এই বাড়ি ছেড়ে।

#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here