অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ৫

#অন্তর্লীন_প্রণয়
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-০৫|

অহর্নিশ আয়ন্তিকার ডান হাতটা শক্ত করে মুঠো করে নিয়ে বলল ওড়না দিয়ে পুরো চেহারা ঢেকে নিতে। আয়ন্তিকা বিনাবাক্যে তাই করলো! কিন্তু শেষ পর্যায়ে সে তার উত্তেজনা থামাতে পারলো না।আয়ন্তিকা চিন্তিত কন্ঠে বলল,

-‘ বাসায় যাবেন না? এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’

অহর্নিশ ঘাড় বাকিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিপাত আয়ন্তিকার দিয়ে প্রতুত্তরে বলল, ‘ যাবো! ‘

অতঃপর সে ফের সামনে তাকায়। কয়েকজন ছেলে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখটা বিষন্ন। এই বিষন্নতা দেখে অহর্নিশ ধরে নিলো কিছু একটা হয়েছে। এই ছেলেগুলো তার সাথেই কাজ করে! রাজনীতি সে কঠোর পরিশ্রম করেছে। দিনরাত খাটুনি দিয়েছে এর পিছে। নিজ পছন্দের পেশা হিসেবে রাজনীতি করাকেই বেছে নিয়েছে অহর্নিশ। ছাত্র জীবন থেকে সে পলিটিক্স এর সাথে জড়িত! যার কারণে এখন অনেক মন্ত্রী, এমপিদের কাছে পলিটিশিয়ান হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া অসহায় মানুষদের কাছে অহর্নিশ তাদের ম্যাজিকাল ম্যান! তাদের বিপদের সময় ঠাঁই নেয়ার আশ্রয়স্থল অহর্নিশ! দিন রাতে না খেয়ে থাকা মানুষদের এক মুঠো ভাতের আশা অহর্নিশ!

ছেলেদের মধ্য হতে নাহিদ নামক একজন এগিয়ে আসে অহর্নিশের সন্নিকটে। বাকিরা একটু ব্যাবধান রেখে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে ইশারা করে বলল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে। আয়ন্তি একবার অহর্নিশের দিকে তাকিয়ে একটু পিছন দিকে চলে যায়। তপ্তশ্বাস ফেলে পূর্ণমান দৃষ্টি দেয় সে আকাশের দিকে!

নাহিদ এগিয়ে এসে মলিন কন্ঠে বলল,

-‘ ভাই মাসুদের লোকেরা আমাদের দলের চার পাঁচ জন লোক কে মেরে হাত পা ভেঙে ফেলছে! ‘

অহর্নিশের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। কাঠিন্যতা ছেপে যায় তার সর্ব মুখশ্রীতে। শক্ত কন্ঠে বলল,

-‘ কেনো মেরেছে? ‘

-‘ ভাই আগের সপ্তাহে যে আপনি মাসুদ রে থাপ্পড় মারছিলেন না সে এক রিকশাওয়ালা রে থাপ্পড় মারছে দেখে? তারই প্রতিশোধ নিছে। ‘

অহর্নিশ রাগান্বিত তীর্যক চাহনি মাটির দিকে দেয়। নিশ্চুপ থেকে পকের থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে বেশ কিছু টাকা সে নাহিদের হাতে দিয়ে দেয়। রাগ দমন করার প্রয়াস চালিয়ে সে বলল,

-‘ ওদের চিকিৎসা যাতে ভালো মতো হয়! খেয়াল রাখিস। আমি সন্ধ্যায় ওদেরকে দেখতে আসবো।’

-‘ আচ্ছা ভাই! ‘

সবাই চলে যেতে অহর্নিশ পিছন ঘুরে।তৎক্ষনাৎ আয়ন্তিকার ঘর্মাক্ত মুখটা তার দৃষ্টি স্থির করে দেয়। শুকনো ঢোক গিলে সে সামনে আগায়। আয়ন্তির সামনে এসে পদচারণ থামিয়ে বলল,

-‘ চলো! ‘

আয়ন্তিকা অধর যুগল প্রসারিত করে শ্বাস টেনে বলল,

-‘ ওরা কারা ছিলো? ‘

-‘ ওরা আমার দলের লোক! পলিটিক্স করি তার সাথে ওরা আমাকে সাহায্য করে। ‘

-‘ অহ! ‘

ছোট্ট করে প্রতুত্তর করে আয়ন্তিকা থেমে থাকা পায়ের পদচারণা শুরু করে। অহর্নিশ আসে আয়ন্তির পিছন পিছন। ক্ষনের মাঝেই তারা তাদের এপার্টমেন্টের কাছে এসে পড়ে। লিফটে উঠে ১৩ তলায় এসে নিজেদের ফ্লাটে এসে পড়লো। আয়ন্তি ফ্লাটে এসে নিজের রুমে যেতে নিলে পিছন হতে তার কর্ণগোচর হয়ে গম্ভীর কন্ঠস্বর!
অহর্নিশ হাতের ব্যাগগুলো সোফায় রেখে বলল,

-‘ ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। আমরা লাঞ্চ করে মিরপুর যাবো। আম্মু তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন। ‘

আয়ন্তিকা চমকে অহর্নিশের দিকে তাকায়। খুশিতে সে আপ্লুত। মাথা নেড়ে সে ‘ হ্যা ‘ বলল ইশারায়। রুমে এসে হাতের শপিং ব্যাগগুলো রেখে মুচকি হাসি দিলো। মামির বাসায় গেলে এ বাসাতে ভুলেও সে আসবে না! থাকবে না এই ভয়ংকর মানবের সাথে। এতোটা সময় নিয়ে সে চুপ থাকতে পারবে না। মামির বাসায় গেলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে হলেও আয়ন্তি ঐ বাসাতেই থেকে যাবে। যা করার করুক অহর্নিশ!

.

অতিষ্ঠ গরমে পুনরায় গোসল করে আয়ন্তিকা। এবার যেনো খারাপ লাগাটা একটু কমেছে! শান্তি মিলেছে মন গহীনে। ভেজা চুলগুলোকে আলত করে টাওয়াল দিয়ে মুছে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। জামার চেইনটা খোলা! পিঠের দিকের একদম মাঝখান থেকে শুরু এই চেইন। তাই সে লাগাতে পারছে না! চিন্তার সাগরে যখন সে ডুবোপ্রায় তখন বেশ জোরেসোরে কিছু পড়ার শব্দ কানে এলো তার। ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়েই পিছন দৃষ্টিপাত দেয় আয়ন্তিকা! সঙ্গে সঙ্গে স্তম্ভিত হলো।

পিছন দিকটায় অহর্নিশ দাড়িয়ে। দরজার কাছে! চোখজোড়া স্বাভাবিকের ন্যায় একটু বড় বড় করে সে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে। অহর্নিশের থেকে কিছুটা দূরে পড়ে আছে তার ফোন!

আয়ন্তিকা নুইয়ে যায়। ড্রেসিং টেবিল থেকে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে মিশে দাড়ায়। পরিশেষে বহু চেষ্টা করে সে পিঠের মধ্যিখানে থাকা চেইনটা লাগাতে সক্ষম হয়। প্রশান্তি মূলক শ্বাস ছাড়লেও তার অস্বস্তি হচ্ছে! লজ্জা গ্রাস করছে তাকে তীব্রতর ভাবে। যদি শুরুর দিকে একটু মনোযোগী হয়ে চেষ্টা করতো তাহলে তাকে নিশ্চিত এই বেসামাল পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

অহর্নিশ দৃষ্টিগোচর করে তার থতমত রূপটি। চেহারায় টেনে নিজের স্বাভাবিকতা! গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাবটি।অহর্নিশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-‘ তৈরি হয়ে নিচে আসো জলদি! ‘

আয়ন্তিকা মাথা উঁচু করে চোরা দৃষ্টিতে ‘ আচ্ছা ‘ বলল। তবে অহর্নিশ আয়ন্তিকার উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহনিয়ে বের হয়ে গিয়েছে রুম থেকে খানিক আগেই। যাওয়ার আগে দরজা শব্দ করে লাগিয়ে যায়। কাঁপুনি দিয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত স্থাপন করলো আয়ন্তিকা। ফ্লোরে তাকাতে দৃশ্যমান হয় অহর্নিশের ব্যাটারি আলাদা হওয়া ফোনটা। নিতে যে সেই ব্যাক্তি ভুলে গেছে ফোনটাকে তা বোধগম্য হলো তার।

পরবর্তীতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সে। বিড়বিড় করে মুখ বিকৃতি করে বলল,

-‘ এই লোক এতো গম্ভীর কেনো? সারাক্ষণ তেঁতো কন্ঠে কথা বলে। অদ্ভুত! আমার সাথেই কেনো তার এই ব্যাবহার? দোষটা কি আমার?’

আয়ন্তিকা ব্যাস্ত হয়ে পড়লো চুলের মাঝে চিরুনির ছোঁয়া দিতে। হাঁটু অব্দি লম্বা চুলগুলোকে সে আস্তে ধীরে পরিপাটি রূপে ধারণ করতে লাগলো। চোখ মুখে এঁটে সেঁটে আছে শ’খানেক বিরক্তির ভাব।

দরজা হতে সরে দাঁড়ায় অহর্নিশ। সে যায়নি! দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আয়ন্তিকার কথা শুনে মৃদু হাসি দেয়। হাসিটা ছিলো একটু উদ্ভট! সেই উদ্ভট হাসি দেখে প্রকৃতিও নিশ্চিত অহর্নিশকে গালাগাল করেছে। এই মানব কেনো তার ভেতর এতো রহস্য নিয়ে ঘোরে তার জন্য!

_________________________

লাঞ্চ করে বেড়িয়ে পড়লো মিরপুর এর উদ্দেশ্যে আয়ন্তিকা, অহর্নিশ! দেড় ঘন্টা বাদেই পৌঁছে যায় তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গাতে। গাড়ি থেকে নেমে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে আয়ন্তিকা! তার চোখমুখ দেখা যাচ্ছেনা। অহর্নিশ তাকে হিজাব পড়ে মাস্ক পড়তে বলেছে। মাস্ক পড়ার কারণে বিরক্তির সীমার শেষ নেই আয়ন্তিকার! এই গরমে হিজাব তার ওপর মাস্ক দুটো হজম করা কষ্টকর। অভ্যাস নেই তার।

অহর্নিশ গাড়ি পার্ক করে এসে আয়ন্তিকার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ চলো! ‘

ব্যস এতটুকুই! খুবই অল্প শব্দ ব্যাবহার করে কথা বলে অহর্নিশ। আয়ন্তিকা ভেবে নিয়েছে অহর্নিশ ইন্ট্রোভার্ট! অবশেষে তার কপালে একজন ইন্ট্রোভার্ট জুটলো ভাবতেই দুঃখে মন জর্জরিত হচ্ছে।

বাসার ভেতর প্রবেশ করা মাত্রই মামি এক প্রকার দৌড়ে আসলেন। সাথে আসলো সাহির! নানুর পিছন পিছন সে ছোট্ট পায়ে এগিয়ে আসছে। মামি এসেই আয়ন্তিকা কে জরীয়ে ধরলেন! কোমল কন্ঠে তিনি বললেন,

-‘ কেমন আছিস আয়ু? ‘
-‘ ভালো মামি। তুমি কেমন আছো?’
-‘ এইতো আছি! তোদের ছাড়া ভালো থাকা যায়? ‘
-‘ আর্নিয়া আপু, মামা কই তারা? ‘
-‘ তোর মামা তো অফিসে। অহর্নিশ কে কতবার সে বলে একটু অফিসে বসতে এই ছেলে তা শুনলে তো! বাবার ওপর চাপ দেয় শুধু। আর আর্নিয়া রুমে, মাথা ব্যাথা করছে নাকি তাই ঘুমোচ্ছে! ‘

অহর্নিশ তার মায়ের কথা সম্পূর্ণ হতে সরু রাস্তা দেখে কেটে পড়ে। তার কাছে ভালো লাগছে না এসব অযৌক্তিক কথা। মাথা ব্যাথা করছে! এখন না ঘুমালে তার পুরো দিনের শিডিউল বিগড়ে যাবে।

অহর্নিশ চলে যেতেই তার মা অহনা ইফ্রাত মুখ কুঁচকে নিলেন। ছেলের এই স্বভাবটা বড্ড অপছন্দের তার। তিনি কাতর কন্ঠে বললেন,

-‘ দেখলি আয়ু, কই কতদিন পর এসেছে মায়ের সাথে একটু কথা বলবে তা না তিনি চোরের মতো চলে গেলেন! ‘

আয়ন্তিকা বুঝলো অহনা কষ্ট পেয়েছে। তাই সে আলত হেঁসে বলল,

-‘ তার হয়তো ক্লান্ত লাগছে মামী। তাই চলে গেছে! আমাকে একটু পানি দাও না। তৃষ্ণা পেয়েছে। ‘
-‘ আয় ভেতরে! ইশশশ! এতক্ষণ দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ‘

সাহিরকে কোলে নিয়ে মামীর সাথে ভেতরে চলে যায় আয়ন্তিকা। সাহির আর্নিয়ার ছেলে! সাহিরের বাবা নেই। আর্নিয়ার স্বামী আফিম তাদের দুজনের ডির্ভোস হয়েছে এক বছর হবে। কি কারণে ডির্ভোস হলো এই কারণটা কারোরই জানা নেই! জানার চেষ্টা করলে আর্নিয়া কখনো বলতো না। চেপে যেতো! তাই পরবর্তীতে কেও কিছু জানার চেষ্টা করেনি। তবে আর্নিয়া বলেছিলে আফিম পরকীয়া তে আসক্ত! মারধর করে তাকে। তাই এ পন্থা অবলম্বন করা।
____________________________

মামীর সাথে সময় কাটিয়ে সাহিরকে ঘুম পারিয়ে রেখে আয়ন্তিকা রুমে আসে! প্রতিবার ও এসে যেই রুমে থাকতো এবার সেই রুমটাতে থাকার জো নেই। এবার থাকতে হবে তাকে অহর্নিশের সাথে। অহর্নিশের সাথে কিভাবে এক রুমে থাকবে আয়ন্তি তা ভাবতে নিলেই গলা শুকিয়ে আসে!

অহর্নিশের রুমের সামনে এসে দরজা হালকা করে ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। রুমটা হালকা অন্ধকার! পর্দা টানানো জানালায়। আয়ন্তিকা রুমে প্রবেশ করে দরজা আগের মতো হালকা মতোন চাপিয়ে দেয়। বেডে সটান হয়ে শুয়ে থাকা অহর্নিশের দিকে তার দৃষ্টিপাত আবদ্ধ হয়! অহর্নিশ বারংবার এপাশ ওপাশ করছে তো মাঝেমধ্যে মাথা চেপে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে নিচ্ছে।

আয়ন্তিকা ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ আপনি ঠিক আছেন?’

জেগে ছিলো অহর্নিশ! তীব্র মাথা ব্যাথায় ঘুম আসছে না। চোখ খুলে সামনে তাকায় সে! আয়ন্তিকার ইতস্তত চাহনি তার চোখে এসে বিঁধে। অহর্নিশ বলল,

-‘ আমি ঠিক আছি! ‘

আয়ন্তিকার মন মানলো না। অনুমান স্বরূপ সে এবার মিনমিন সুরে বলল,

-‘ আপনার কি মাথা ব্যাথা করছে? ‘
-‘ হ্যা একটু! ‘
মিথ্যা বলতে গিয়ে গলা আঁটকে আসে তার। অহর্নিশ নিম্ন কন্ঠে সত্যটা বলে চুপ হয়ে যায়। চোখ ফের বন্ধ করে নেয়!

আয়ন্তিকা লজ্জা, ভয় সবকিছু ফেলে বেডের দিকে এগিয়ে যায়। অহর্নিশের মাথার পাশে বসে চিকন আঙ্গুলের অধিকারী তার কোমল হাতটা সন্তপর্ণে রেখে দেয় অহর্নিশের কপালে। আস্তেধীরে ম্যাসাজ করে দিতে থাকে!

অহর্নিশ চটজলদি চোখ খুলে আয়ন্তিকা কে নিজের পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। তার থেকে আরো বেশি চমকে যায় আয়ন্তিকার হাত তার কপালে দেখে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারিত করলো না। চোখ বন্ধ করে নেয় ফের সে। মনে মনে বড্ড প্রশান্তি অনুভূতি হয় তার।আয়ন্তিকা কি তবে তাকে মেনে নিতে শুরু করেছে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here