রাজিতা বাসরঘরে বসে ওর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে৷ কেউ হয়ত হুইলচেয়ারে করে রুমে দিয়ে যাবে সেই আশায় বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। দুপুর থেকে কান্না করতে করতে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছে।
–“খুব বেশিই অপেক্ষা করিয়ে ফেললাম মনে হচ্ছে?”
প্রশ্নটা শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় রাজিতা। সেখানে হুইলচেয়ারে বসা কেউ নেই! ওর সামনে জলজ্যান্ত একটা বলবান পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। যার রূপের আলো পুরোঘরে যেন ঠিকরে পড়ছে। কিছুক্ষণ অবাক চোখে সেই রূপের সুধা পান করে রাজিতা। তারপর হঠাৎ ওর মনে পড়ে যে এই ঘরেতো ওর স্বামীর থাকার কথা যে হুইলচেয়ার ছাড়া একমুহূর্ত নড়তে পারেনা। তাহলে এই লোকটা কে?
–“আ-আপনি কে? আর এখানে কি করছেন?”
বলেই বিছানা থেকে নেমে কিছু একটা খুঁজতে থাকে রাজিতা। ছেলেটা হাসিমুখে ওরদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
–“একটু আগেই যার নামে কবুল পড়লে তাকেই চিনতে পারছো না?”
রাজিতা সারাঘর খুঁজে একটা কলম হাতে নিয়ে সেটার ক্যাপ খুলে ছেলেটার দিকে এগিয়ে ধরে পিছনে যেতে থাকে। ভয়ে ওর ফর্সা মুখটা পাংশু হয়ে গেছে।
–“দেখুন আপনি কিন্তু আর সামনে এগুবেন না। আমি কিন্তু এ-এই কলমটা দিয়ে আপনাকে-আপনাকে…”
এতক্ষণে ছেলেটি ওর সামনে চলে এসেছে। খপ করে রাজিতার দুর্বল আর ভীত হাত থেকে কলমটা কেড়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
–“আনান রেদোয়ান এর স্ত্রী এত বোকা হলে চলবে? এই কলম দিয়ে তুমি নিজেকে রক্ষা করবে মিসেস রাজিতা রেদোয়ান! ”
আনান রেদোয়ান নামটা শুনেই রাজিতা চমকে উঠে। এই নামের ছেলের সাথেইতো ওর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু ওই ছেলেতো হাঁটতে পারেনা। তাহলে ইনি কি মিথ্যে বলছে! কান্নাকাটিতে রাজিতা এতটাই বিভোর ছিল যে সারা রাস্তা পাশে বসে থাকা ছেলেটাকেও খেয়াল করেনি যে সে দেখতে কেমন।
–“এইবার কিন্তু আমি চিৎকার করব৷ বলুন উনি কোথায়? আর আপনি কে?”
বলতে বলতে দরজার কাছে গিয়ে লক খুলতে যায়৷ আনান গিয়ে রাজিতার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। আনান অবাক চোখে রাজিতার ফুলে যাওয়া চোখ-মুখ দেখতে থাকে।
হঠাৎ রাজিতা অনেক জোরে চিৎকার করে উঠে। আনান ভয়ে ওকে ছেড়ে দিলে রাজিতা কান্না করতে করতে দরজা খুলে বাইরে চলে যায়।
ততক্ষণে দরজার সামনে আনানের বাবা তানজীব রহমান আর ওর মা সামিরা রহমান এসে গেছে।
আনানের মাকে জড়িয়ে ধরে রাজিতা বলতে থাকে,
–“আন্টি দেখুন এই লোকটা আপনার ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। বলছে উনিই নাকি আনান…”
–“এই মেয়ে আন্টি কি হ্যাঁ! মা বলো। শশুরবাড়িতে প্রথম এসেই শাশুড়ীকে আন্টি বলছ! তোমার মা-বাবা তোমাকে এই শিখিয়েছে?”
বলেই চেঁচাতে থাকে আনান। আনানের মা উল্টো আনানকেই ধমক দিয়ে বলল,
–“কি বলেছিস তুই ওকে? মেয়েটা কি পরিমাণ ভয় পেয়েছে দেখতে পাচ্ছিস না!”
রাজিতা দুজনের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারে না।আনানের মাকে আগেও দেখেছে ও তাই চিনে। রাজিতা চুপ হয়ে গেছে একদম। আনানের মা রাজিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–“এটাইতো আনান মা। ”
–“কিন্তু সবাই যে বলছিলেন উনি..”
–“হ্যাঁ। এটা আনানের পাগলামি ছিলো। ওকে বলেছিলাম যে, মেয়ের সাথে আলাদা দেখা করতে,কথা বলতে, কিন্তু ও জিদ ধরে বসেছিল যে মেয়েকে যেন ওর পরিচয় না দেওয়া হয়। বিয়ে যেহেতু করতেই হবে, কেউ কারো সম্পর্কে না জেনেই বিয়ে করবে৷ আর আমরা কেউ জানতাম না যে বিয়ে করতে ও হুইলচেয়ারে করে যাবে। এটাও ওর প্লান ছিল। ”
রাজিতা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ও সবসময় চাইত যে ওর জীবনে ড্রামাটিক কিছু হোক, কিন্তু এত ড্রামাটিক কিছু হবে কল্পনাও করতে পারেনি।
–“তোমার কোনো বোন-ইতো আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো না৷ তুমি কেন হলে?”
আনানের প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালো রাজিতা। আসলেই কি এই লোকটা ওর স্বামী! নাকি ও আবার কোনো স্বপ্ন দেখছে! মাঝেমধ্যেই এমন অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে রাজিতা৷
–“আন্টি আমাকে একটা চিমটি কাটুনতো। ”
বলেই আনানের মায়ের দিকে নিজের গালটা এগিয়ে দেয় রাজিতা। আনানের মা একগাল হেসে আনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আনু বাবা, বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা। ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। একদিনে এতগুলো ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না।”
বলেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন উনি। রাজিতা এবার আনানের বাবার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
–“আংকেল আপনি বলুন না এসব কি হচ্ছে?”
–“মা, তুই ঘরে যা। অনেক রাত হয়েছে৷ কাল তোকে সব খুলে বলব। আনান, ওকে ঘরে নিয়ে যা।”
আনানের বাবা-মা উনাদের রুমে চলে যেতেই আনান রাজিতাকে বলল,
–“এইবার আপনার কনফিউশান দূর হয়েছে মিসেস রাজিতা রেদোয়ান? এইবার ঘরে চলুন৷ আমার সিংগেল লাইফের বিছানাটা আজ ডাবল হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। ”
রাজিতা মুখটা আরো ফুলিয়ে বলল,
–“যাবো না আমি কোথাও। আপনারা সবাই মিথ্যাবাদী। আমার বিয়ে নিয়ে যত স্বপ্ন ছিল সব পুড়িয়ে ছাড়-খাড় করে দিয়েছেন। ”
বলেই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
–“একটা মানুষ এত কান্না কিভাবে করতে পারে কে জানে। চোখের জলগুলো জমিয়ে রাখলে আমাদের সুইমিংপুলে আর আলাদা করে পানি দিতে হতো না।”
–“আপনি একটা ধোকাবাজ। নীলা আপুকে ধোকা দিয়েছেন।”
–“তোমার নীলা আপুকে আমি ধোকা দেইনি। আমি হাঁটতে পারি না শুনেই উনি নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।”
–“তো আপনি মিথ্যে কেন বলেছিলেন?”
–“এটাতো একটা পরীক্ষা ছিল মাত্র। আর সেই পরীক্ষায় তুমি লেটার নিয়ে পাশ করেছো। যেকেউতো আর আনান রেদোয়ানের বউ হতে পারে না। তাই না?”
রাজিতা কান্না একটু থামিয়ে বলল,
–“আপনি নিজেকে কি মনে করেন কি হুম?কোন দেশের রাজপুত্র! ”
–“আমি আমার রাজ্যের রাজা, বাবা-মায়ের রাজপুত্র। আর আজ থেকে রাজিতা ম্যামের রাজা।এবারতো ঘরে চলুন মহারানী! ”
–“যাবো না আমি আপনার ঘরে। ”
কথাটা বলতেই আনান মুহূর্তের মধ্যে রাজিতাকে কোলে তুলে নিলো। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
–“দেখেছো দাদু, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে আমাকে আজ এসব আলু-পটলকে কোলে নিতে হচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, আবার প্রশংসাও করতে হচ্ছে।”
–“কিহ! আমি আলু-পটল! আর আপনি কি? আপনিতো একটা ঢেড়স!”
আনানের কোলে থেকেই চেঁচাতে থাকে রাজিতা।
–“নো৷ ওটাও তুমি। কারণ ঢেড়সতো ‘লেডিস-ফিংগার’।শুধুমাত্র দাদুর আত্মার শান্তির জন্যই তোমাকে এখনো সহ্য করছি আমি। নইলে এতক্ষণে… ”
বলেই বিছানায় নিয়ে ঠাস করে ফেলে দেয় রাজিতাকে।
আসলে আনানের দাদু আর রাজিতার দাদু দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিল। তারা চেয়েছিল যে তাদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য আত্মীয় হবে৷ কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! দুজনের কারোরই মেয়ে হয়না। রাজিতার দাদার দুই ছেলে, আর আনানের দাদার এক ছেলে হয়৷ পরে তারা তাদের ওয়াদা রক্ষা করার জন্য নতুন আরেকটা ওয়াদা করে যে তাদের নাতি-নাতনীদের বিয়ে দিবে৷ আনানের বাবার যেহেতু একটাই সন্তান, সেহেতু যাই হয়ে যাক না কেন আনানকে রাজিতাদের পরিবারেই বিয়ে করতে হবে৷
আর রাজিতার মা-বাবা ওর ছোটবেলাতেই একটা দুর্ঘটায় মারা গেছে। ওর চাচার কাছেই ও বড় হয়েছে৷ ওর চাচার আবার এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে নিলার সাথেই আনানের বিয়ে ঠিক করেছিল৷ আর বাকিটাতো বোঝাই যাচ্ছে৷ নিজের চাচা-চাচির ঋণ শোধ করতে আর নিজের মৃত দাদুর স্বপ্ন পূরণ করতে অবশেষে রাজিতাই রাজি হয়েছিল হুইলচেয়ারে বসা একটা ছেলেকে বিয়ে করতে৷ কিন্তু এখনতো সব চেঞ্জ হয়ে গেছে৷ সামনে আরো কি কি হতে চলেছে কে জানে!
চলবে…..
#অপরাজিতা
#সূচনা_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। নতুন লেখা কেমন হলো জানাবেন।