#অপেক্ষারা
৪.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“এই মেয়ে, তোমার এসএসসির সার্টিফিকেটটা দাও তো!”, ব্যস্ত গলায় বলল সায়েম।
নাজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমার সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন, এই ছেলে?”
“তুমি আমাকে কী ডাকলে?”
“আপনি আমাকে যা ডেকেছেন তা-ই। মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেতে চাইলে, মানুষকেও সম্মান করতে হয়।”
রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে সায়েমের। সকাল সকাল অফিস থেকে ফোন এসেছে। দেশের বিশাল এক মাল্টিন্যাশাল কোম্পানিতে চাকরি করে সে। তার কাজটা হলো রাজ্যের সব বিদেশি ক্লাইন্টদের সঙ্গে ডিল করা, তাদের কাছে বিজনেস আইডিয়াগুলোর প্রেজেন্টেশন করা। অফিসের সবথেকে হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট ছেলে হিসেবে এই কাজটা অবশ্য তাকেই মানায়।
আজ হুট করে বিদেশি ক্লাইন্ট চলে এসেছে, এদের সামনে আজ প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। বিয়ের এই ঝামেলার কারণে বেচারা কোনো প্রস্তুতিই নিতে পারেনি। কী যে প্রেজেন্টেশন দেবে কে জানে। একদিকে দুশ্চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে আরেকদিকে এই মেয়েটা চালু করে দিয়েছে তার এফএম রেডিও। কোনো মানে হয়?
নাজ বলল, “আমার এসএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন?”
“কলেজে ভর্তি হতে হবে না?”
নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী? মানে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে?”
“অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে।”
“তাহলে বিয়ে করে লাভ কী হলো?”
সায়েমের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির আভা ফুটে উঠলো।
“কেন? তুমি কী ভেবেছিলে? বিয়ে হয়ে গেছে বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে?”
“হ্যাঁ!”
“তাহলে সেই স্বপ্ন পানি ঢেলে দাও। বিকজ দ্যাট ইজ নট হ্যাপেনিং।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “কিন্তু আমি পড়াশোনা করে কী করবো?”
“মানুষ পড়াশোনা করে যা করে, তুমিও তাই করবে। যাও, সার্টিফিকেট নিয়ে এসো।”
নাজের মনটাই ভেঙে গেল। ভেবেছিল সকলের জোরাজুরি বিয়ে করে একটা লাভ অন্তত হয়েছে, পড়াশোনা নামক জেলখানা থেকে আজীবনের জন্যে মুক্তি। কিন্তু তার সে স্বপ্নে কী অবলীলায় পানি ঢেলে দিলো ছেলেটা!
নাজ তার ঘর থেকে সার্টিফিকেট এনে টেবিলের ওপর রাখলো।
সায়েম সেটাতে একবার চোখ বুলিয়ে অবাক স্বরে বলল, “জিপিএ তিন পয়েন্ট পনেরো! আনবিলিভেবেল! এত খারাপ রেজাল্টও মানুষ করতে পারে?”
নাজ থমথমে গলায় বলল, “এই শুনুন! আমার রেজাল্ট নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। পড়াশোনা থেকে আমি সারাজীবন দশ হাত দূরে থেকেছি। তারপরও তিন পয়েন্ট পনেরো। আমার বাবা তো রীতিমত পুরো এলাকাকে মিষ্টি খাইয়েছে।”
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে এমন জঘন্য একজন ছাত্রীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। তুমি জানো
এসএসসিতে আমার রেজাল্ট কী ছিল? পুরো বোর্ডে চতুর্থ! আর সেখানে তুমি?”
“হয়েছে, হয়েছে। আপনার যুগে তো আর সৃজনশীল প্রশ্ন আসতো না। বড়ো বড়ো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে লিখে দিয়ে আসতেন। এ আর এমন কী?”
“আমার যুগ মানে? আমি কি বাবর-আকবরের যুগে পরীক্ষা দিয়েছি?”
নাজ চুপ করে রইল।
সায়েম বলল, “আগে যা করেছ, করেছ। কিন্তু এখানে ওসব চলবে না।”
“মানে?”
“মানে হলো এখন থেকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে তোমাকে। আমার সঙ্গে থেকে পরীক্ষায় যদি পাও জিপিএ তিন, তাহলে আমারই মান-সম্মান নিয়েই টানাটানি লেগে যাবে।”
নাজ আহত গলায় বলল, “জিপিএ তিন নয়, তিন পয়েন্ট পনেরো!”
“ওই একই কথা। রেজাল্টের যে অবস্থা, মনে তো হচ্ছে না ভালো কোনো কলেজে চান্স পাবে। তবুও আমি চেষ্টা করবো। আর আমাকে এখন অফিসে যেতে হবে। তুমি একা থাকতে পারবে তো?”
নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “হুঁ। এই শুনুন না! আমাকে কলেজে ভর্তি না করলে হয় না?”
“না, হয় না। মেয়েরা লেখাপড়া না শিখে, ঘরে বসে থাকবে – ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ নয়।”
নাজ চুপ করে রইলো।
সায়েম বলল, “দারোয়ান একটু পর একটা বুয়া নিয়ে আসবে। কথাবার্তা বলে দেখ, পছন্দ হলে কাজে রেখে ফেলবে।”
“আচ্ছা।”
“আর একা একা বাইরে যাবার দরকার নেই। এখনকার রাস্তাঘাট এখনো তোমার কাছে অপরিচিত।”
“আচ্ছা।”
“কী ব্যাপার? হঠাৎ করে তোমার এফএম রেডিও বন্ধ হয়ে গেল কেন?”
“পড়াশোনার নাম শুনলেই আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়।”
সায়েম বিড়বিড় করে বলল, “তাহলে তো এখন থেকে বই দিয়েই বসিয়ে রাখতে হবে।”
“কিছু বললেন?”
“কই না তো!”
একা থাকলেই দমবন্ধ লাগে নাজের, মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হয়। তবে আজ সেসব কিছুই হচ্ছে না। কারণ আজ তার মস্তিক আগে থেকেই বিরাট এক দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে। আচ্ছা, নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ করতে মানুষকে পড়াশোনাই কেন করতে হয়? অন্যভাবেও তো তা প্রমাণ করা যায়! যে ব্যাটা পড়াশোনা আবিষ্কার করেছে তাকে এভারেস্টের চূড়ায় নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে।
স্কুলে পরপর ছয় বছর অংকে সবথেকে কম নম্বর পাবার রেকর্ড আছে নাজের। এ এমনই এক রেকর্ড যা যেকোনো শিক্ষার্থীর পক্ষেই ভাঙা কষ্টসাধ্য। এখন এই নতুন শহরের নতুন কলেজে নতুন কী রেকর্ড সে গড়বে কে জানে।
নাজের সাতপাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়লো কলিংবেলের শব্দে। দারোয়ান এসেছে নতুন কাজের মেয়েকে নিয়ে। দুজনের মুখ হাসৌজ্জ্বল, সবগুলো দাঁত যেন জ্বলজ্বল করছে।
দারোয়ান বলল, “আফা, এরে নিয়া আসছি। আমগো বিল্ডিংয়ের বেশির ভাগ বাড়িত কাম করে।”
কথাগুলো বলেই দারোয়ানটা ঝড়ের গতিতে চলে গেল। মেয়েটা আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রইল। তার বয়স নিশ্চয়ই নাজের থেকে বেশিই হবে, তবে খুব একটা বেশি নয়। গাত্রবর্ন কুচকুচে কালো হলেও সেই কালোর আছে এক নিজস্ব উজ্জ্বলতা।
নাজ বলল, “আপনি ভেতরে আসুন।”
মেয়েটা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ও আল্লা! আফনে আমারে আপনি আপনি ডাকতেছেন কেন? আমারে আপনি ডাকা লাগবো না।”
“তাহলে তুমি ডাকবো? আপনি কিছু মনে করবেন না?”
“গরীব মাইনসের আর মনে করাকরি।”
“বেশ, বসো তুমি।”
সে ফ্লোরে বসতে গেলে নাজ আচমকা বলে উঠলো, “নিচে বসছো কেন? সোফায় বসো!”
মেয়েটা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সোফায় বসলো। মনে মনে নিশ্চয়ই সে বেশ অবাক হচ্ছে। শুরুতে আপনি ডাকছিল, এখন আবার সোফায় বসতে বলছে! এমনটা সম্মান তো কোনো বাড়িতেই মেলে না!
নাজ আরেকটা সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী নাম তোমার?”
“জরিনা।”
“তুমি রান্না করতে পারো?”
“এইডা কোনো কথা কইলেন আফা! মাইয়ামানুষ হইয়া রান্না করতে পারমু না। আমার তো আবার চেহারাসুরত ভালো না, গায়ের রং মাইয়া। তয় আমার শাশুড়ি আমার হাতের রান্না খাইয়া আর চেহারার দিকে তাকায় নাই, একদিনের মধ্যে ঘরের বউ করছে।”
“আমি আবার মেয়েমানুষ হয়ে রান্না করতে পারি না। আমাদের বাসার রান্নার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।”
“আফনে কোনো টেনশন করবেন না আফা। মোগলাই, আফগানি, চাইনিজ, বাঙালি – যা খাইতে চান টেবিলে হাজির করবো।”
“আপাতত বাঙালি হলেই চলবে। আর শোনো জরিনা, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন ধোয়া এসবও তোমাকে করতে হবে।”
“আচ্ছা আফা। তা আফনেরা বাসায় কয়জন থাকেন?”
“দুইজন। আমি আর আমার হাসবেন্ড।”
‘হাসবেন্ড’ শব্দটা উচ্চারণ করতে নাজের গা বেয়ে অন্যরকম হওয়া বয়ে গেল। কী অদ্ভুতভাবেই কয়েক দিনের ব্যবধানে খুব দূরের একটা মানুষের নাম তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে আজীবনের জন্যে।
জরিনা বলল, “আফা হিসাব কইরা দেখলাম আফনের এইখানে চাইর কাম পড়ে। চাইর কামের জন্যে আমারে তো চাইর দেওয়া লাগে।”
“চার কী?”
“চাইর হাজার।”
নাজের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। তাদের ময়মনসিংহে দেড় হাজার টাকায় দুনিয়ার কাজ করে দেয় কাজের মেয়েরা। আর এ কি-না চাইছে চার হাজার!
নাজ ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “বসো, আমি আসছি।”
নাজ চলে এল তার ঘরে। চার হাজার টাকা নিশ্চয়ই যে দেবে তাকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করা উচিত। গত রাতেই সায়েম তার ফোন নম্বর নজকে দিয়ে রেখেছে। যেকোনো সমস্যায় ফোন দিতে বলেছে। এটা তো বিরাট এক সমস্যা, ফোন না দিয়ে উপায় কী?
ফোন তুলেই গম্ভীর গলায় সায়েম বলল, “বলো।”
“বুয়া তো চার হাজার চাইছে!”
“চাইবেই তো! যা কাজ করবে তার তুলনায় কমই চেয়েছে।”
“তো রেখে ফেলবে?”
“না রাখলে এতগুলো কাজ করবে কে? তুমি?শোনো আমি একটু পর মিটিংয়ে ঢুকবো, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!”
নাজ জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। এখানে অযথা বিরক্ত কোথায় করা হলো। প্রয়োজন ছিল বলেই তো তাকে ফোন করেছিল নাজ!
নাজ ফিরে এসে জরিনাকে বলল, “তোমার চাকরি কনফার্ম। কবে জয়েন করবে বলো!”
জরিনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আইজ থেইক্কাই! দেরি কইরা লাভ কী?”
(চলবে)#অপেক্ষারা
৫.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
নতুন কলেজে নাজের প্রথম দিন আজ। রিকশায় বসে অনবরত হাই তুলে যাচ্ছে সে। কলেজে পৌঁছাবার আগেই শুরু হয়ে গেল তার যন্ত্রণা। নাজ আবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারে। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। কোথায় এই সময়ে তার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কথা! সে যাচ্ছে পড়ালেখা করতে। এত শান্তির ঘুম বাদ দিয়ে যে পড়ালেখা করা হবে, সেই পড়ালেখা থেকে কী-ই বা অর্জন করবে সে?
শহরটা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। দু-তিনটা দোকানপাট খুলেছে, হকারও তার সাইকেল নিয়ে বিরক্তমুখে পত্রিকা বিলি করতে বেরিয়েছে। রিকশা চলছে ধীরগতিতে। নাজের পাশে বসে আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সায়েম। ব্যাপারটা নাজ বুঝতে পারছে কি-না কে জানে।
এক পর্যায়ে সায়েম বলল, “জেগে ওঠো এবার, একদিনেই টিসি পাবে দেখছি।”
নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “তাহলেই ভালো হয়!”
কলেজে পৌঁছেই প্রচন্ড বিস্ময়ে নাজ ঘুমটুম সব কেটে গেল। ময়মনসিংহে তার কলেজটা ছিল একতলা দালান। কিন্তু এই কলেজটা একটা পাঁচতলা ভবনে। নাজের কাছে মনে হলো এত সুন্দর ভবন সে তার জীবনে দেখেছি। মূল বিল্ডিংয়ের সামনেই প্রকান্ড এক মাঠ। মাঠের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশাল এক কাঠবাদাম গাছ। গাছের প্রশস্ত ডালপালাগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন মাঠের ওপরে ছাতা ধরে আছে।
এতক্ষণ নাজের ব্যাগটা সায়েমের কাঁধে দিলো। সে এবার ব্যাগটা নাজের কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, “আমি গতকাল এসে হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বলে গেছি। তুমি নিচতলায় অফিসে একবার তার সঙ্গে দেখা করে ক্লাসে যাও।”
“আবার দেখা করতে হবে কেন?”
“আমি বলেছি, তাই। আর শোনো, যত পারবে কম কথা বলবে। উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবে না।”
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “আপনি দেখি আমার মায়ের মতো শুরু করলেন। মাও কোথাও যাবার আগে আমাকে বারবার বলে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।”
“ঠিকই তো বলে! খবরদার একটাও বাজে কথা বলবে না। এক কাজ করো, তুমি বরং মুখই খুলো না। একদম চুপ করে বসে থাকবে।”
“শেষে উনি যদি আমাকে প্রতিবন্ধী ভাবে?”
“উফ! এত জ্বালাও কেন তুমি? আমি গেলাম। ছুটির পর এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। গেটের বাইরে বের হবে না!”
হেডমিস্ট্রেসের অফিসে প্রায় মিনিট দশেক ধরে বসে রয়েছে নাজ। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চেহারায় রাগের ভাব স্পষ্ট। নাজের তো মনে হচ্ছে মানুষটা আসলে রাগী নয়, হেডমিস্ট্রেস হবার খাতিরে রাগী ভাবটা ধরে রাখতে হয়। সেই তখন নাজকে বসিয়ে রেখে কী সব কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছে। নাজের একবার ইচ্ছা হলো বলতে, “আমাকে অযথা বসিয়ে রেখেছেন কেন? আপনার কাগজ ঘাটাঘাটির দৃশ্য দেখার কোনো আগ্রহ আমার নেই। আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ক্লাসে যাই।”
একটা মেয়ে জোরে জোরে পা ফেলে অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
হেডমিস্ট্রেস তার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় ডাকলেন, “তুষি! এই তুষি! এখানে এসো।”
তুষি নামের মেয়েটা অফিসের ভেতরে প্রবেশ করলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ভয়ের ছাপ।
হেডমিস্ট্রেস গম্ভীর গলায় বলল, “ঘোরাঘুরি করছো কেন? তোমার ক্লাস নেই?”
“সরি ম্যাম।”
কথাটা বলেই তুষি চট করে বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।
হেডমিস্ট্রেস হুংকার দিয়ে বললেন, “কোথায় যাচ্ছ? আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি?”
তুষি এবার যেন পাথরের মতো জমে গেল।
হেডমিস্ট্রেস নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো নাজনীন, আমাদের কলেজের একটা মান আছে। এমনিতেই বছরের মাঝামাঝিতে নতুন আমরা ছাত্র-ছাত্রী নেই না। তোমার জন্যে বিশেষ সুপারিশ ছিল বলে নিয়েছি।”
নাজ ভেবে পেল না তার জন্যে বিশেষ সুপারিশটা আবার করলো কে? সায়েম? কিন্তু তিনিই বা কী এমন মন্ত্রী-মিনিষ্টার যে তার এক কথায় নাজকে ভর্তি করে নিয়েছে।
হেডমিস্ট্রেস আবারও বললেন, “আশা করি তুমি আমাদের কলেজের মান বজায় রাখবে। এমন কোনো কাজ করবে না যাতে আমাদের সন্মান ক্ষুণ্ণ হয়।”
নাজ ঘাড় করে সায় দিলো। এই মহিলার সঙ্গে কথায় যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
“তুষি তুমি ওকে আমাদের কলেজটা ঘুরে দেখাও, স্যার-ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, নিয়ম-কানুনগুলো জানিয়ে দাও। আজ আর তোমাকে ক্লাস করতে হবে না। অবশ্য এমনিতেও ক্লাস করো না!”
অফিস থেকে বেরিয়ে তুষি বিড়বিড় করে বলল, “ডাইনোসর একটা!”
নাজ অবাক গলায় বলল, “কে? আমি?”
তুষি হেসে ফেলে বলল, “না, না! তুমি কেন হবে? উনি। আমরা আড়ালে ওনাকে ডাইনোসর ম্যাম ডাকি।”
নাজ খিলখিল করে হেসে উঠলো।
তুষি বলল, “ডাইনোসর ম্যাডাম আমাকে দেখতেই পারে না জানো। আমি কি কোনো দোষ করেছি? দোষের মধ্যে শুধুমাত্র একবার ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করেছি। এই কারণে উনি আমাকে সহ্যই করতে পারেন না।”
নাজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তুষির দিকে। পৃথিবীতে যে তার থেকেও খারাপ ছাত্রী থাকতে পারে, এটা নাজের ধারণার বাইরে ছিল। সেদিন জিপিএ তিন পয়েন্ট পনেরোর জন্যে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো সায়েম। অথচ কতো মানুষ যে পাশই করতে পারে না, এটা তার জানা নেই।
“বাই দা ওয়ে, আমি তুষি। তোমার নাম নাজনীন তাই না?”
“হুঁ, তবে আমি নাজনীন নামটা শুনে অভ্যস্ত না। সবাই আমাকে নাজ বলেই ডাকে।”
তুষি সিড়িতে পা রেখে বলল, “বাহ্! তাহলে চলো নাজ, তোমাকে আমাদের মহান কলেজ ঘুরে দেখাই।”
নাজ তুষির পিছু পিছু সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “শুনেছি এই কলেজটা না-কি অনেক ভালো, জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা এখান থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। আসলেই কি এমন কিছু?”
“মোটেই না! কলেজের অবস্থা বলতে গেলে ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট টাইপ। আর দুদিন পরপরই এরা হাজির হয় একেকটা টেস্ট নিয়ে। শর্ট টেস্ট, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, ফাইনাল টেস্ট! এত টেস্ট দিলে মানুষ পড়বে কখন?”
তুষি নাজকে তিনতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। এখানে কলেজের ক্লাস হয় না। ডে শিফটে স্কুলের বাচ্চাটা এখানে পড়ে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা কী সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে ক্লাসরুমগুলোকে। একটা ক্লাসরুমের দেয়ালে
বিশাল এক ছবি। বোঝাই যাচ্ছে ছবিটা ক্লাসের সকলে মিলে এঁকেছে। ছবিতে মহাচারী খোঁজ পেয়েছে নতুন এক গ্রহের। নাজের মহাকাশ নিয়ে বরাবরই প্রবল আগ্রহ।
ঠিকই তখনই ক্লাসরুমের বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলেন এক স্যার। লোকটা মধ্যবয়স্ক, চোখেমুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। তার মুখের ভঙ্গিমা যেন জানান দিচ্ছে কলেজের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর ওপর তিনি অসম্ভব বিরক্ত।
তুষি নিচু গলায় বলল, “ওই দেখো! শেখর স্যার। আমরা আড়ালে ডাকি সাত্রী স্যার।”
“ছাত্রী স্যার?”
“ছাত্রী না, সাত্রী!”
“মানে?”
“একটু পরেই টের পাবে।”
তুষি নাজকে নিয়ে শেখর স্যারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “গুড মর্নিং স্যার।”
স্যার ভ্রু কুঁচকে বলল, “এখানে কী করো? তোমার ক্লাস নাই?”
“এই আমাদের নতুন ছাত্রী স্যার। ওকে কলেজটা ঘুরে দেখাচ্ছি।”
শেখর স্যার একবার ভ্রু কুঁচকে নাজের দিকে তাকালেন। আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুষির দিকে নিক্ষেপ করে বললেন, “ক্লাসে তো তোমার দেখাই পাওয়া যায় না। সারাদিন শুধু ঘোরাঘুরি!”
তুষি বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে বলেছেন ওকে ঘুরে দেখাতে।”
“প্রিন্সিপাল ম্যাম তোমাকে ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুরতে বলেছেন?”
“জি স্যার!”
“বেয়াদপ কোথাকার! শিক্ষকদের নিয়ে মিথ্যা কথা বলে! পড়াশোনা কিছু করো না-কি তাও ফাঁকিতে পড়ে গেছে?”
“করি স্যার।”
“সাত্রীর বাহার! পরীক্ষার খাতায়ই টের পাওয়া যায় সাত্রীর নমুনা।”
কথাগুলো বলেই শেখর স্যারে হনহন করে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। তার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
তুষি হাসতে হাসতেই বলল, “সাত্রীর বাহার! এটা স্যারের কমন ডায়লগ।”
এবার তুষি নাজকে নিয়ে গেল তার ক্লাসরুমে। তার ক্লাসরুমটা পাঁচতলায়। নাজ তো আগেই ভেবেছিল, ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েরা হয়তো প্রচন্ড অহংকারী। অহংকারে তাদের মাটিতে পা-ই পড়বে না। কেউ হয়তো তার দিকে ফিরেও তাকাবে, মফস্বল থেকে এসেছে বলে তাকে বিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই হলো না। ক্লাসের সবাই যথেষ্ট আন্তরিক। এদের আন্তরিকতা যেন নাজকে মুগ্ধ করে তুলল।
সকলে হাসিমুখেই নাজের সঙ্গে পরিচিত হলো। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল নাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে!”
নাজ তুষিকে বলল, “তোমাদের কলজের সবাই কত ভালো! আমি তো ভেবেছিলাম এখানে সবাই অহংকারী।”
তুষি বলল, “তুমি কী ভেবেছো? এখানে অহংকারী মানুষ নেই? অহংকার যে কী জিনিস সেটা আমি শিখেছিই এই কলেজে এসে।”
“তাই নাকি?”
“হুঁ! আসো, তোমাকে নিজ চোখে অহংকারীর
দর্শন করাই।”
দুজনে চলে গেল অন্য পাশের ক্লাসটায়। ক্লাসরুমের সামনেই দুটো মেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলছে। দুজনের চোখেই ভারী চশমা।
তুষি বলল, “এরা হলো সায়েন্সের স্টুডেন্ট। এমন একটা ভাব যেন সায়েন্স নিয়ে আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে ফেলেছে। আমাদের মতো কমার্সের স্টুডেন্টদের সঙ্গে এরা কথা পর্যন্ত বলবে না।”
নাজ অবাক গলায় বলল, “বলো কী?”
“বিশ্বাস হয় না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি!”
তুষি ওই মেয়ে দুটোর মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিরে ইলমা! কী করে খবর?”
ইলমা নামের মেয়েটি তার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সবেমাত্র আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো এলিয়েনকে দেখছে। তারা তুষি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবারও ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের কথোপকথনে।
তীব্র রাগের স্রোত বয়ে গেল নাজের সমস্ত শরীর বেয়ে। সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলে কমার্সের স্টুডেন্টের সঙ্গে কথা বলবে না? আরে বাবা সায়েন্স নেওয়া মানেই কি তুই আইনস্টাইন-নিউটন টাইপ কেউ হয়ে গেছিস?
নাজ উঁচু স্বরে ওই দুজনকে শুনিয়ে বলল, “ছি তুষি! এমন মহামান্য বিভাগের ছাত্রীকে তুমি কিনা বলছো কিরে? তোমার মধ্যে কী এতটুকুও বুদ্ধি নেই, যে এই সেকশনের মেয়েদের তুই ডাকা যায় না? তুই কেন, তাদের তো তুমি ডাকাও অন্যায়। চলো আমরা বরং এক কাজ করি, সবাই মিলে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে আবেদন করি, যেন সায়েন্সের স্টুডেন্টদের আপনি ডাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।”
সায়েন্সের ছাত্রী দুজন হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। অতঃপর লজ্জিত ভঙ্গিতে চলে গেল তাদের ক্লাসে।
নাজ আর তুষি একসঙ্গে ফিক করে হেসে উঠলো।
(চলবে)
[সবাই রেসপন্স করবেন প্লিজ!]