#অপেক্ষারা
৪৭+৪৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! আমরা হঠাৎ ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম কেন?” বিরক্ত গলায় বলল কনা।
নাজ মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “শিহাব বলেছে, তাই।”
মালা ভ্রু কুঁচকে বলল, “শিহাব বললেই বেরিয়ে আসতে হবে? তাও আবার শিউলিকে একা ফেলে রেখে? তাহলে আর এত কষ্ট করে চিটাগংয়ে এসে লাভটা কী হলো?”
“আহ্ চুপ কর তো! জরুরি একটা কাজ করছি।”
কনা নাজের মোবাইলের ওপর উঁকি দিয়ে বলল, “কী এমন কাজ?”
তার দেখাদেখি মালাও উঁকি দিলো নাজের ফোনের ওপরে। নাজ কিছুক্ষণ আগে রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে করে ভিডিওটা প্লে করে দেখালো দুজনকে। ভিডিও দেখে তাদের চোখ যেন ছানাবড়া!
নাজ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ট্রিপল নাইনে ফোন করেছিলাম বুঝলি। ভিডিওটাও পাঠিয়ে দিয়েছে। পুলিশ রাস্তায় আছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”
মালা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “পুলিশ?”
“পুলিশের ব্যাপারটা আমার মাথায়ই আসেনি। অল থ্যাংকস টু শিহাব। ও বলছিল, আমরা যদি এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে না যাই তাহলে পুলিশ ডেকে শিউলিকে ফাঁসিয়ে দেবে। তখনই হঠাৎ মনে হলো, ও পুলিশ ডাকার আগেই যদি আমরা ডাকি তাহলে কেমন হয়।”
কনা বাঁকা হাসি হেসে বলল, “ভাগ্যিস ভিডিওটা করেছিল। ওই ব্যাটা শিহাব যে নিখুঁত অভিনেতা, পুলিশের সমানে এমন ভাব করতো যেন সে পৃথিবীর সেরা স্বামী।”
কয়েক মিনিটের মাথায় পুলিশের গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। পুলিশের এক কর্মকর্তা নাজের সঙ্গে কথা বলে তার দল নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বেশ অনেকটা সময় কড়া নাড়বার পর দেখা মিলল শিহাবের। পুলিশ দেখে বেচারার চোখ মুহূর্তেই উঠে গেল কপালে।
পুলিশ কর্মকর্তা থমথমে গলায় বললেন, “আপনি শিহাব হোসেন?”
শিহাব অপ্রস্তুত গলায় বলল, “জি। স্যার আপনারা?”
“এমন ভাব করছেন যেন জীবনে কোনোদিন পুলিশ দেখেননি। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।”
“কী অভিযোগ স্যার?”
“আপনি না-কি আপনার স্ত্রীকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করেন।”
শিহাব হতবিহ্বল গলায় বলল, “ছি ছি স্যার! কী বলছেন এসব? আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করবো আমি? এটা অসম্ভব স্যার। কেউ নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করে আমার নামে এমন অভিযোগ করেছে।”
“সেটা আমাদের বুঝতে দিন। আপনার কাজ আমাদের সঠিক ইনফরমেশন দেওয়া। আপনি নিশ্চিত যে আপনার দ্বারা আপনার স্ত্রী নির্যাতিত হয় না?”
“একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত স্যার।”
পুলিশ কর্মকর্তা তার মোবাইল থেকে নাজের রেকর্ড করা সেই ভিডিওটা চালু করে দিয়ে বললেন, “তাহলে এসবের মানে কী শিহাব হোসেন?”
ভয়ঙ্করভাবে হকচকিয়ে গেল শিহাব। কিছু একটা বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে।
“আপনার স্ত্রী কোথায়? ডাকুন উনাকে!”
“ও আসলে একটু বাইরে গেছে…”
শিহাবের কথা শেষ হবার আগেই নাজ উঁচু গলায় বলল, “ও মিথ্যা বলছে স্যার। শিউলি ভেতরই আছে।”
পুলিশ কর্মকর্তা শিহাবকে রীতিমত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার পিছু পিছু প্রবেশ করলো নাজ, তার বান্ধবীরা এবং শওকত সাহেব।
শওকত সাহেব বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বললেন, “এসব কী হচ্ছে বৌমা? হুট করে পুলিশ এলো কোত্থেকে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“একটু অপেক্ষা করুন বাবা, সবই বুঝতে পারবেন।”
ঘরের ভেতরে শিউলিকে খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ডাইনিং রুমের সঙ্গে একটা বারান্দা আছে। সেই বারান্দার মেঝেতে বসে, হাঁটুতে মুখ গুজে অস্ফুৎস্বরে কাঁদছে মেয়েটা। এদিকে এত কান্ড যে ঘটে গেছে, তার টের বোধহয় এতক্ষণে পায়নি।
পুলিশ কর্মকর্তা বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার নাম দিলসাত খানম শিউলি। তাইতো?”
অচেনা কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো শিউলি। এতগুলো পুলিশকে এখানে দেখে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।
“কী হলো, বলুন!”
শিউলি অস্পষ্ট গলায় বলল, “জি।”
“আপনার বান্ধবী আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, আপনার স্বামী না-কি আপনাকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন করে আসছে। তার অভিযোগ কী সত্যি?”
শিউলি হকচকিয়ে গিয়ে তাকালো নাজের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করছে, এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা বাস্তব না কল্পনা।
“আপনি চুপ করে থাকলে কিন্তু আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না। বলুন, তার অভিযোগ কী সত্যি?”
প্রায় অনেকটা সময় চুপ করে থেকে শিউলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
নাজ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ধরেই নিয়েছিল, মেয়েটা শিহাবের ভয়ে পুলিশের সামনে মিথ্যা বলবে। কিন্তু সে তা বলেনি। শেষ মুহূর্তে প্রকৃতি তাহলে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে দিয়েছে তার মনে।
পুলিশ কর্মকর্তা তার সঙ্গে আসা অন্যান্য পুলিশদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, “একে ধরে রাখো, পালাতে যেন না পারে।”
দুজন পুলিশ গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দুদিক থেকে চেপে ধরলো শিহাবকে। ছাড়া পাওয়ার জন্যে সেই তখন থেকে আকুতি করছে, তবে কিছুই আর কাজ হবে না।
শওকত সাহেব হতবাক হয়ে বললেন, “ছি ছি ছি! স্ত্রীয়ের গায়ে হাত তোলে! তোমাকে তো ভালো ছেলে ভেবেছিলাম শিহাব।”
শিউলি কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নাজকে। মেয়েটার চোখের জল দেখে তার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে পরলো।
নাজ প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “এত বোকা কেন তুই? দিনের পর দিন কেন সহ্য করলি এসব? একবারও ফোন করে আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?”
শিউলি তার চোখের জল আটকে রাখার কোনপ্রকার চেষ্টা না করেই বলল, “তাই উচিত ছিল দোস্ত। আমি আসলেই খুব বোকা। তোর মতো সাহস আমার কখনোই হবে না।”
সকলে গিয়ে বসলো বসার ঘরে। শিহাবকে আপাতত এবাড়ির একটা ঘরেই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যাতে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে না পারে। শিউলির হাত পা এখনো কাঁপছে, তবে চোখেমুখে সেই ভয়ের কোনো ছাপ নেই।
পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, “আপনি কিন্তু চাইলেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটা কেস করতে পারেন। ভিডিওটা অনেক বড় প্রমাণ।”
শিউলি আঁতকে উঠে বলল, “না, না। আমি কোনো কেস করবো না।”
নাজ কঠিন গলায় বলে উঠলো, “আমরা কেস করবো স্যার। আপনি ব্যবস্থা নিন।”
শিউলি আবারও আঁতকে উঠে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাজের দিকে। নাজ চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল।
পুলিশ শিউলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেশ। আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। আপনাকে তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। বলুন তাহলে, প্রথম কবে আপনার গায়ে হাত তোলা হয়?”
শিউলি চুপ করে রইল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার নাজের দিকে একবার পুলিশ কর্মকর্কাতার দিকে তাকাচ্ছে।
নাজ রেগে গিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, “কীসের এত ভয় তোর? সারাটা জীবন তো ভয়ে ভয়েই কাটিয়ে দিলি। আর কত ভয় পাবি?”
তার এমন কথায় উপস্থিত সকলেই কিছুটা হকচকিয়ে গেল।
নাজ মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ গলায় বলল, “সরি।”
পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, “বলুন মিসেস শিউলি, চুপ করে থাকবেন না। আজ আপনার হাসবেন্ডের মতো মানুষদের শাস্তি না হলে, সমাজে যে কেউ এমন অপরাধ করার প্রশয় পেয়ে যাবে।”
শিউলি এবার নিরবতা ভঙ্গ করে ক্লান্ত গলায় বলল, “কী বলবো?”
“প্রথম কবে শিহাব হোসেন আপনার গায়ে হাত তোলেন।”
শিউলি ইতস্তত করে বলল, “বিয়ের ঠিক পরপর। সেদিন আমি জীবনে প্রথম রান্নাঘরে ঢুকেছি। বিয়ের আগে মা অনেকবার রান্নাবান্না শেখাতে চাইলেও আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এ বাড়ির নিয়ম, নতুন বৌদের না-কি বিয়ের পরদিন থেকেই রান্নার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। আমার আবার লবণের আন্দাজ নেই, কোনো খাবারে বেশি আবার কোনো খাবারে কম লবণ দিয়ে ফেললাম। শিহাব সেদিন আমার চুলের মুঠি টেনে ধরে কতগুলো কুৎসিত কথা শুনিয়ে দিলো।”
“আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি?”
“না।”
“কেন?”
“ভেবেছিলাম, সামান্য চুলই তো টেনে ধরেছে। এ আর এমন কী? তাছাড়া লবণ কম-বেশি হলে কারই বা খেতে ভালো লাগে বলুন?”
“তারপর?”
“এই ঘটনার পরপরই, আরেকদিন শিহাব গোসলে ঢুকেছে। আমি ওর জন্যে চা বানিয়ে টেবিলে রেখে অন্য কাজে চলে গেছি। ও বেরিয়ে আসতে আসতে চা ঠান্ডা হয়ে যায়। এটা কী আমার দোষ বলুন? ও আমাকে বলল, চা গরম করে আনতে। আমি আনলামও। এরপর…”
কথাটা শেষ করার আগেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো শিউলি।
“এরপর?”
“সেই আগুন গরম চা এক নিমিষে ছুঁড়ে মারলো আমার গায়ে। দেখুন, এখনো হাতে পোড়া দাগ আছে।”
“আপনি এসব সহ্য করলেন কেন?”
“আর কোনো উপায় ছিল আমার? এমনিতেও এই বিয়েতে বাবা-মায়ের সায় ছিল না। এখন কি চাইলেই আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবো?”
পুলিশ কর্মকর্তা চুপ করে রইলেন। শিউলির করা প্রশ্নটা তাকেও কিছুটা ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে হয়তো।
শিউলি আবারও বলল, “আমি পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম, অনেক বড় হতে চেয়েছিলাম। বিয়ের পর চিটাগংয়ে এসে ও আমাকে নতুন কলেজে ভর্তি করালো ঠিকই কিন্তু ক্লাস করতে দিলো না। তখন সবে ওর মায়ের অসুখ ধরা পড়ে। শিহাব আমাকে বলল, ঘনঘন ক্লাসে গিয়ে কী হবে? এর থেকে আম্মা যে কয়দিন বেঁচে আছেন তার সেবাযত্ন করে পূণ্য কামাও। পরীক্ষার সময় শুধু গিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম ভুল কিছু তো বলেনি। পরীক্ষা তো পরেও দেওয়া যাবে। একটা মানুষ মৃত্যুশয্যায়। সেবাযত্ন করে তার জীবনের শেষ কয়েকটা দিনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেই ব্যবস্থা করি। কিন্তু কষ্ট তো তখন হলো, যখন দেখলাম ও আমাকে পরীক্ষাও দিতে দেবে না।
সেদিন আমাদের বাড়িভর্তি লোকজন। পাড়া-প্রতিবেশীরা আম্মাকে দেখতে এসেছেন। আমি রান্নাঘরে কাজ করছি, ও হঠাৎ কী মনে করে আমার কাছে গিয়ে বলল তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে না। তুমি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আম্মার দেখাশোনা কে করবে, ঘরের কাজকর্ম কে সামলাবে? আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম জানেন। রেগে গিয়ে বললাম, আমাকে বিয়ে করার আগে কে সামালতো তোমার বাড়ির কাজকর্ম? কে করতো আম্মার দেখাশোনা?
রেগে যাওয়াটাই আমার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ালো। শিহাব বাড়িভর্তি লোকজনের তোয়াক্কা করলো না। সকলের সামনে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে প্রচন্ড মারলো। আমার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছিলো, হাত-পা ছিলে গেল – তবুও ও থামলো না। সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যাকে ভালোবাসে আমি বিয়ে করেছিলাম, এই মানুষটা সে নয়।”
“ও যে আপনার ওপর এমন নির্যাতন করতো আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি জানতেন না?”
“জানতেন তো। তাদের চোখের সামনেই কত মার খেয়েছি, কোনো হিসাব নেই।”
“তারা কখনো প্রতিবাদ করেনি?”
“না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে এসেছে। হয়তো তারা ভাবতো কী দরকার শুধু শুধু স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলায় জড়িয়ে!”
নাজ উঠে চলে গেল। মর্মান্তিক এই কথাগুলো আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। সে এসে দাঁড়ালো বাড়ির বারান্দায়। সূর্য একটু একটু করে ঢলে পড়ছে। পৃথিবীর আরেক অর্ধ যে তার আলো ছড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে। আচ্ছা পৃথিবীটা এত বৈচিত্র্যময় কেন? পৃথিবীর থেকেও বিচিত্র তার মানুষগুলো।
একই পৃথিবীতে একদিকে জন্ম নেয় মহাপুরুষেরা অন্যদিকে জন্ম নেয় কুখ্যাত অপরাধীরাও। পৃথিবীর একদিকে একদল মানুষ যেমন সকলের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করে, অন্যদিকে আরেকদল ছক কষে পৃথিবীটাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেওয়ার। নাজ আজ উপলব্ধি করলো, একেকটা মানুষের কাছে পৃথিবী একেক রকম।
বিবাহিত জীবন মানেই তার কাছে একরাশ সুখ আর মুগ্ধতার অনুভূতি। সায়েম নামের মানুষটার সাথে দেখা প্রতিটি সকালই তার জন্যে নিয়ে আসে আনন্দের বার্তা। সায়েমের বুকে মাথা রেখেই পূর্ণতা পায় নাজের সমগ্র চিত্ত। বিয়ের আগে তো জীবন এতটা সুন্দর, এতটা রঙিন ছিল না!
বিবাহিত জীবন মানেই স্বর্গীয় কোনো অনুভূতি। এমন ধারণা নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না নাজের। অথচ শিউলির কাছে বিবাহিত জীবন মানেই যেন এক বিভীষিকা, পৃথিবীর জঘন্যতম অনুভূতি। ওই মেয়েটা কি আর কোনদিনও পারবে, কাউকে ভরসা করতে?
প্রকৃতপক্ষে খুঁত মানুষের মধ্যে থাকে না, ভালোবাসায় থাকে। নিখুঁত ভালোবাসা সমুদ্রের স্রোতের মতো। হাজার চেষ্টা করেও তাকে আটকে রাখা যায় না। আর ত্রুটিপূর্ণ ভালোবাসা তার ঠিক বিপরীত। ভালোবাসায় ত্রুটি থাকে তা এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে, তাকে টেনে-হিঁচড়েও এগিয়ে নেওয়া যায় না।
শিহাব কোনোকালে শিউলি ভালোবাসলেও সেই ভালোবাসা ছিল খুঁতে ভরপুর। তাই তো বিয়ের পর মন থেকে সকল অনুভূতি উধাও হয়ে গেছে।
আর সায়েম? ছেলেটা কি আজকে থেকে তাকে ভালোবাসে? নাজ যখন নিতান্ত বাচ্চা একটি মেয়ে সেই তখন থেকে সায়েম মন দিয়ে ফেলেছে তাকে। মনের অন্তঃস্থল থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে আসছে। যে ভালবাসা আজও সজীব, আজও প্রাণচঞ্চল। নিখুঁত ভালোবাসা মানুষের মনে এক অগাধ বিশ্বাসের জন্ম দেয়। সেই বিশ্বাসের বলেই নাজ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে, আর যাই হয়ে যাক না কেন সায়েম চিরকাল তাকে একইভাবে ভালোবেসে যাবে।
আরো একবার নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে। প্রবল ভাগ্যগুণেই সায়েমের মতো একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিল।
শিহাবের বাবা জালালউদ্দিন সাহেব বাজারে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে এতগুলো পুলিশ দেখে রীতিমত থ বনে চলে গেলেন তিনি।
পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বললেন, “আপনার ছেলেকে আমরা থানায় নিয়ে যাচ্ছি। ঘরের বউয়ের গায়ে হাত তোলার মজা এবার সে টের পাবে!”
জালালউদ্দিন সাহেব রীতিমত কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ওকে ছেড়ে দিন স্যার। আমার ছেলের কোনো দোষ নেই।”
“কোনো দোষ নেই? স্ত্রীকে নির্যাতন করা দোষ নয়?”
“আমার ছেলেটা সবসময় টেনশনে থাকতো স্যার। মায়ের অসুখ, এতগুলো টাকা কীভাবে জোগাড় হবে সেই চিন্তা করতে করতেই পাড় করতো। টেনশনে রেগে গিয়ে মাঝে মধ্যে…”
“একটা মানুষ চিন্তাগ্রস্ত হলেই স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার লাইসেন্স পেয়ে যায় না। মান্ধাতা আমলের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। দেশে এখন ডোমেস্টিক ভয়োলেন্সের বিরুদ্ধে শক্ত আইন করা হয়েছে। আর আপনি যেটাকে মাঝে মধ্যে বলছেন, সেটা আপনার বৌমার জন্যে ছিলো প্রতিদিন।”
জালালউদ্দিন সাহেব আকুতির স্বরে বললেন, “ওকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন স্যার। বৌমা তুমি উনাদের থামাও।”
শিউলি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। পুলিশকে থামানোর কোনো ভাবলক্ষণ তার মধ্যে প্রকাশ পেল না।
পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, “আমি ক্ষমা করার কেউ নই। ক্ষমা বা শাস্তি যাই করার আদালত করবে। আপাতত আমরা আপনার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি।”
জালালউদ্দিন সাহেব কাঁদতে কাঁদতে ধপাস করে সোফার ওপরে বসে পড়লেন।
শওকত সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে আক্ষেপের সুরে বললেন, “ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি, এখন আর কেঁদে কী হবে ভাইসাহেব?”
শিউলি পুলিশ কর্মকর্তাকে বলল, “স্যার, আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই।”
“ঠিক আছে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে আপনাকে জানবো। আপনাকে আরেকবার চিটাগংয়ে আসতে হবে। আপাতত আপনি সকলের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান।”
নাজ হাসিমুখে বলল, “আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনারা না এলে শিউলির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনাদের মত নাগরিকরা আছে বলেই সমাজে ভালো মানুষের মুখোশধারী এসব জঘন্য অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে। এভাবেই সবসময় পুলিশকে সহায়তা করবেন আশা করি।”
রাতের বাসেই শিউলিকে নিয়ে তারা ফিরে আসছে। এই বাসটা ঢাকা পর্যন্ত যাবে। ঢাকায় নেমে নাজকে রেখে সকলে আরেকটা বাসে করে যাবে ময়মনসিংহে। যদিও নাজের ইচ্ছা ছিল ময়মনসিংহে পৌঁছে নিজে গিয়ে শিউলির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আগামী পরশুই সায়েম ফিরে আসবে তার বিজনেস ট্রিপ থেকে।
বাসের একদম পেছনের সিটে চার বান্ধবী বসেছে পাশাপাশি। যদিও বাসের পেছনের দিকে বসাটা তেমন নিরাপদ নয়, তবুও তারা বসেছে।
মালা দাঁতে দাঁত চেপে রাগী গলায় বললেন, “বারবার বলেছিলাম, বিয়ে করিসনা ছাগলটাকে। শুনলি আমার কথা?”
কনাও তার সুরে তাল মিলিয়ে বলল, “সেটাই তো! আর বিয়ে করেছিস ভালো কথা, কিন্তু যখন দেখলি সে এমন নোংরা মনের একটা মানুষ – তখনও পড়ে রইলি? কোনো একদিন সে সুধরে যাবে, সেই আশায়?”
শিউলি অসহায় গলায় বলল, “তোরা সব দোষ আমাকে দিচ্ছিস কেন?”
নাজ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “না না, তোমার তো কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই ঘাটের মরা শিহাবের তাই না?”
“মানে?”
“বিয়ের আগে তো কত ঘোরাফেরা করেছিস একসঙ্গে। একটা বারের জন্যেও বুঝতে পারিসনি, ওই ভালোমানুষের আড়ালে একটা জানোয়ার বাস করে।”
“একবারও বুঝতে পারিনি দোস্ত, বিশ্বাস কর। বুঝলে কি আর ওকে আমি বিয়ে করি?”
মালা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বুঝতে পারলেও তুই একেই বিয়ে করতি। কেন জানিস? আর তুই প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলি। অন্ধরা কি আর দেখতে পায় কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ?”
“তোরা আমাকে দোষ দেওয়া বন্ধ কর তো। এমনিতেই আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি।”
কনা বলল, “আবার কীসের ভয়?”
“বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে কী বলবো?”
নাজ আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “যা সত্যি তাই বলবি। তারা তোর বাবা-মা, তোকে ঠিকই বুঝতে পারবে।”
সকাল গড়িয়ে পড়ার বাসটা এসে থামলো ঢাকার স্টেশনে।
নাজ চিন্তিত গলায় শওকত সাহেবকে বলল, “আজকের দিনটা আপনারা এখানে থেকে গেলেই পারতেন বাবা। সারারাত বাস জার্নি করলেন, এখন আবার বাসে করে এতটা পথ যেতে কষ্ট হবে আপনাদের।”
“তা একটু হবেই বৌমা। কিন্তু আজই ফিরে যাওয়া উচিত। শিহাবকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, বাড়িতে ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে। শিউলির বাবা-মা না-কি একটু পর পর তোমার শাশুড়িকে ফোন করছে। এদিকে আমরা যে শিউলিকে নিয়ে আসছি এটাও তোমার শাশুড়ি জেনে গেছে। ওদেরকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না।”
“বাবা, আমি তো যেতে পারলাম না। আপনাকেই শিউলির দায়িত্ব দিচ্ছি। আপনি কিন্তু নিজে গিয়ে ওর বাবা-মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন, দরকার হলে ওই ভিডিওটাও দেখাবেন। ভিডিও কনার ফোনে আছে।”
“কোনো চিন্তা কোরো না বৌমা। আমি আর তোমার মা দুজনে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলবো তাদের। তারা ঠিকই বুঝবে। কোনো বাবা-মাই চাইবে না তাদের সন্তানকে অমন পরিবেশে রাখতে।”
(চলবে)