আমার সিঁথিতে সিঁদুর প্রথম দেওয়া হয়েছিলো ৭-৮বছর বয়সে। এখন বয়সটা ২৫’য়ের কোঠায়। সমাজে মেয়েদের বয়স ২০হলেই বলতে শুরু করে মেয়ে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমার বেলায়ও তাই। বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। একটু পরই আমাকে দেখতে আসবে বরপক্ষ। বিয়ে করতে চাই না। আমার রুমে বসে বসে নিজেকে অ-ইচ্ছাকৃত সাজাতে বসলাম। আমার সিঁতিতে সিঁদুর দেওয়া হয়ে গেছে। এখন নতুন করে দিয়ে কি হবে। যার হাতে প্রথম দেওয়া হয়েছে তার আশায় আছি আজও।
তখন আমি ২য় শ্রেণীতে পড়ি। আমরা সপরিবার সিলেট থাকতাম। বাসা ভাড়া করেই থাকতে হতো। বাবার চাকুরীর সুবাদে সিলেট থাকা। আমাদের এই বিল্ডিংয়ে থাকতো আরেকটা পরিবার। আমাদের মতোই তারা। রোহান নামের একজন ছেলে ছিলো। বয়স ১০-১১ হবে। তার বাবা আর আমার বাবা এক সাথেই পুলিশে চাকুরী করে। আমরা পাশাপাশি থাকার কারণে সবার ভিতর একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
দুর্গাপূজার সময় সবাই একসাথেই পুজার জন্য গেলাম। সবাই আনন্দ করছে। আমি আর রোহান একসাথেই পুজার ভিতর মানুষের ভিড়ে হাঁটতে থাকলাম। দুজনে নানান জায়গা ঘুরে। দুর্গার সামনে প্রণাম করলাম। মা দুর্গার সমান রাখা সিঁদুর থেকে আমার সিঁতিতে দিয়ে দেয় রোহান। আমি কিছুই বুঝতাম না।
পুঁজা থেকে ফিরে সবাই যার যার মতো। কয়েক মাস পরই রোহানের বাবার বদলী হয়ে যায় রাজশাহীতে। তখন ছিলো না কোন মোবাইল।
আমিও একা হয়ে গেলাম। বছরখানিক পর আমার পিসির বিয়েতে গেলাম কুমিল্লা। পুজারী মন্ত্র পড়ছে মন্ডবে, পাত্র-পাত্রী বসে আছে। সাতবার ঘুরে। ছেলে যখন মেয়ের মাথায় সিঁদুর দিচ্ছে এটা দেখেই মনে পড়লো রোহানের দেওয়ার কথা।
আমিও মা পাশাপাশি বসেই দেখছি, সবার সাথে বিয়ের কাজ। যখনই সিঁদুর দিলো মা’কে বললাম এটা কেনো দেয়? মা বলে, মেয়েদের সিঁতিতে সিঁদুর দিলে একজন অন্যজনের জীবন সাথী হয়। যতদিন বেঁচে থাকে তাদের একসাথে থাকার বন্ধন সৃষ্টি করতেই সিঁতিতে সিঁদুর দেয়।
মায়ের সেই কথা গুলোই আমার মনে পড়ে রোহানের কথা। ভাবে শুরু করি তাহলে আমার জীবন সাথী রোহান। দুর্গা মায়ের সমানেই আমার সিঁতিতে সিঁদুর দিয়েছে। আমরাও একে অপরের জীবন মরনের সাথী হয়ে যাই।
এভাবে চললো জীবন। আর কোনদিন দেখা হয়নি রোহানের সাথে। আমি অপেক্ষার প্রহর আজও গুনতেছি। অনার্স শেষ হয়ে গেছে আর পারছি না বিয়ে ছাড়া থাকতে। মা’কে বলে ছিলাম রোহানের সিঁদুর দেওয়ার কথা। মা বলে এটা ছোট বেলার খেলা কিছুই হবে। অনেক চেষ্টা করে বিয়ে বসি নাই। আর পারছি না কি হয়।
আমার এইসব ভাবনার ছেদ ঘটালো মা এসে।
_আর্তি তুই রেডি হয়। ওরা চলে আসবে কিছুক্ষণ পরই। (মা)
_আমাকে দেখে কি হবে। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। (আমি)
_যা বলছি কর। (মা)
আমাকে এইসব বলেই বের হয়ে গেলো। টেবিলে দুর্গার মু্র্তি আছে। আমি তাকিয়ে চোঁখ জল ফেলেই যাচ্ছি।
দুর্গার দিকে তাকিয়ে
….এক সিঁতে আর কতবার সিঁদুর দিবে আমায়? তোমার সামনেই আমার এই সিঁতে সিঁদুর দেওয়া হলো। তাহলে আজ তুমি কিছু করো না কেন দুর্গা মা? অসুরকে বধ করে যখন অসুরকে পরাজিত করতে পারোনি কারন তার রক্ত মাটিতে পড়লেই পুনরায় জীবন পেয়ে যায়। তুমি দুর্গা মা তখন সেই রক্ত মাটিতে পড়তে না দিয়ে সবাইকে মেরে ফেলেছিলে। তাহলে আজ কেনো এক সিঁতিতে ২য় জনের সিঁদুর পড়তে দিচ্ছো?২য়জনের সিঁদুর পড়ার আগে আমি মরে যাবো, আর এটার জন্য তুমি দুর্গা মা দ্বায়ী।
আমার মা আবার আসলো। এবার তিনি নিজেই আমাকে সাজাতে থাকলো। কিছু পরই রেডি হয়ে বসে আছি। বরপক্ষ আসলে আমাকে তাদের সামনে নেওয়া হলো। আমি নিচে দিকেই তাকিয়ে আছি। বরপক্ষ কারা সে দিকেও খেয়াল করি নাই।
আমাকে আর ছেলেকে আলাদা কথা বলতে দিলো। আমি আমার সিঁতিতে অন্যজনের সিঁদুর দেওয়ার কথা বলে দেই। আর এই কথা শুনে।
_ তাহলে আজও তুৃমি আমায় মনে রাখছো? (ছেলে)
_মানে?
_আমিই রোহান। কিছুদিন আগেই কানাডা থেকে আসছি পড়াশোনা শেষ করে। এসেই তোমার কথা খোঁজতে লাগলাম। তোমার বাবার নাম জানি তাই। সেটা দিয়েই ইন্টারনেট পুলিশের চাকুরী সবার নাম বের করলাম। তাদের সবার ছবি ভালো করে দেখে তোমার বাবার ঠিকানাও বের করি। দুদিন আগে এই কুমিল্লায় আসলাম। এসে এই গ্রামে খোঁজে তোমার বাবাকে বের করে বিয়ের প্রস্তাব দেই। আর বলি তোমাকে যেনো না বলে দেখবো কারো প্রতি ভালোবাসা আছে কিনা (রোহান)
_সত্যি তুমি রোহান?
_হুম।
আমি জড়িয়ে ধরলাম।আর বলি,,,,,আমার অপেক্ষা প্রহর শেষ হলো। আমার সিঁতিতে অন্য কারো সিঁদুর লাগতে দিবো না। তুমি দিবে,তুমিই।
দুর্গা মা আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ করলো।
সবাই খুশি আমাদের কথা শুনে। দুদিন পরই বিয়ে।
সমাপ্ত।
(ভুল হলে ক্ষমার চোঁখে দেখবেন)
ছোটগল্প -অপেক্ষার প্রহর।
লেখা-সোলাইমান রানা
তাইন্দং, খাগড়াছড়ি