অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব -০৪+৫

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। তার জীবনে কি হচ্ছে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন অগোছালো নিয়মে এগিয়ে চলছে জীবন। এ জীবনের কোন মানে হয়? হতাশ চোখে বাইরে দৃষ্টি ফেলল সে। পাশের বাড়ির ছাদে ছোট বাচ্চারা খেলছে। তুলিও আছে সেখানে। লাল ফ্রকে তুলিকে সুন্দর লাগছে। চুলগুলো বেনুনি করা। ভিষণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। নানু মারা যাওয়ার পর পৃথিবীতে এই একমাত্র মানুষ যে তার কথা ভাবে। তাকে আপন মনে করে। বুকের ভেতর একধরনের সূক্ষ ব্যথা অনুভব হল। এ পৃথিবীতে সত্যিই তার কেউ নেই!

খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে প্রিয়তা। তার মন এখন অন্য কোথাও বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পূর্বে মামি এসে জানিয়েছে তাকে বিয়ে করতে হবে না। এটা শুনে প্রিযতা খুশি হলেও চিন্তার কারণ মামির বলা দ্বিতীয় কথাটা। কেউ একজন মামিকে শাসিয়েছে প্রিয়তার বিয়ে না দিতে এমনটাই বলেছে মামি। এখন কথা হচ্ছে এই কেউ একজন টা কে? আবার কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তাকে? সে যতই বিপদ থেকে দূরে যেতে চায় না কেন বিপদ যেন তাকে ছাড়তেই চায় না। সব সময় আগে পেছনে লেগেই আছে।
___________

লাল পাড় বিশিষ্ট সাদা রঙের শাড়িতে প্রিয়তাকে অপ্সরির মতো লাগছে। চুলগুলো খোপা করে ক্লিপ এটে নিলো। কিছু একটা মনে করে চোখে অল্প কাজল ও লাগালো। তেমন একটা সাজগোজ করা হয়না তার। জীবনেই যেখানে কোনো রঙ নেই সেখানি শরীরে রঙ মেখে ঘোরার কোনো প্রশ্নই আসে না। আয়নায় আরো একবার নিজেকে দেখে নিয়ে ব্যাগ হাতে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই মামার সাথে দেখা হলো। প্রিয়তার মামা জাহিদ বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকেন। আজ ভোরেই ফিরেছেন তিনি। প্রিয়তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘কেমন আছিস মা? চাকরি কেমন চলছে?’

বিনিময়ে প্রিয়তা শুকনো হাসলো। ছোট করে জবাব দিলো,

‘হুম ভালো।’

জাহিদ বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না। সে জানে মেয়েটার সাথে কতটা অন্যায় অত্যাচার হয় এ পরিবারে। কিন্তু সে নিরুপায়। মেয়েটাকে কেবল আশ্রয় দেওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবে সে সাহায্য করতে পারলো না। সে প্রতিবাদ করলে হয়তো মেয়েটার বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়াত। তার থেকে যেভাবে চলছে চলুক। প্রাণটা বেঁচে থাকুক। জাহেদ অপলক চোখে প্রিয়তার দিকে তাকালো। মেয়েটা ঠিক ওর মায়ের রূপ পেয়েছে। এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটাকে টোকা দিতেও কলিজা কাঁপে সেখানে সুজলা কিভাবে পারে এত অত্যাচার করতে? ওর কি হৃদয় নেই? জাহিদের গলা ধরে আসে। চোখ জ্বালা করছে। নিজের ব্যর্থতা গুলো পানি হয়ে ঝরতে চাইছে।

‘মা টাকা পয়সা কিছু লাগলে বলিস।’

‘হুম বলবো।’

প্রিয়তা বের হয়ে গেলো। পেছন থেকে জাহিদ ডাকল।

‘নাস্তাটা করে যা।’

প্রিয়তা শুনতে পেয়েও জবাব দিলো না। আর কিছুক্ষণ সে মামার সামনে থাকলে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু সে তার দুঃখ কাউকে দেখাতে চায় না। তার দুঃখগুলো নাহয় একান্তই তার হয়েই থাক।

গলি থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো প্রিয়তা। আজ যেন কোনো রিকশা এদিকটায় না আসার পণ করেছে। বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘চ’ বেরিয়ে এলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখে কপালের মাঝে সূক্ষ ভাঁজ ফেলল।

‘আজ লেট কেন করলেন প্রিয়? অপেক্ষা করছিলাম।’

প্রিয়তা ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো আয়াজের পানে। চোখের দৃষ্টিতে বোঝালো আর একটাও কথা বললে চিবিয়ে খাবো। কিন্তু এতে আয়াজের ভাবের পরিবর্তন হলো না। দুহাত চুলে চালান করে অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে আর একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো প্রিয়তার।

‘আপনাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। বিয়ের পর এভাবেই সবসময় শাড়ি পড়বেন।’

আর সহ্য হলো না প্রিয়তার। আয়াজের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘তুমি অতিরিক্ত মাত্রায় অসভ্য। একজন সিনিয়রকে কিভাবে সম্মান দিতে হয় তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তোমার।’

জবাবে মুচকি হাসলো আয়াজ। প্রিয়তা ফুঁসে উঠলো। ভাবনার চাইতেও অনেক বেশি অভদ্র ছেলেটা।

রিকশা পাওয়ার সাথে সাথে উঠে পড়লো প্রিয়তা। রোজকার মতো চোখের আড়াল না হওয়া অবদি অপেক্ষা করলো আয়াজ। সে শুধু তার এই অপেক্ষার সুমিষ্ট ফল উপভোগ করার অপেক্ষায় আছে। তার এই অপেক্ষার অবসান হয়তো খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই বাড়ির পথে পা বাড়ালো সে। আজ তাকে বাবার সাথে অফিসে যেতে হবে। তার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে এখনো দু বছর বাকি। কিন্তু সে চায় গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই অফিসিয়াল সব কাজে পারদর্শী হতে। তাকে নিজেকে প্রিয়তার যোগ্য করে তুলতে হবে। প্রিয়তা পর্যন্ত পৌছাতে তাকে যা যা করতে হবে সে তার সবটা করতে রাজি।
প্রিয়তার প্রতি তার এই অনুভূতি আজকের নয়। এর শুরু আরো চার বছর পূর্বে। আয়াজ তখন সবে ক্লাস নাইনে। সে চট্টগ্রামে নানা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। তার বাবার রাজনীতি জনিত কিছু কারণে তাকে সবকিছু থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো। সেবছর আয়াজ প্রথম ঢাকার মাটিতে পা রাখে। শুরু হয় নতুনভাবে জীবন জাপন। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়েছিলো। একদিন বিকেলে কাছের পার্কে ঘুরতে গেলে সে দেখতে পায় কোনার এক বেঞ্চিতে একটা মেয়ে বসে কেঁদে কেঁদে কাউকে অভিযোগ করছে। এতবড় মেয়ের এমন বাচ্চা স্বভাব দেখে আয়াজ সেদিন ভিষণ হেসেছিল। এরপর থেকে আয়াজ প্রায়ই মেয়েটাকে দেখতো। মেয়েটার বড় বড় চোখ করে তাকানো। গাল ফুলিয়ে একা পার্কে বসে থাকা সব তার ভিষণ ভালো লাগতো। আয়াজ যখন বুঝতে পারে সে এই মেয়েটার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে তখন সে গোপনে প্রিয়তার সকল খোঁজ নেয়। প্রিয়তা তার থেকে পাঁচ বছরের বড় জানতে পেরে সে নিজেও শক হয়েছিলো। প্রিয়তাকে দেখে তার কখনো মনে হয়নি মেয়েটা তার থেকে এত বড় হতে পারে। আয়াজ নিজেকে বন্দি বানিয়ে ফেলল। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই যেন ছিলনা তার জীবনে। নিজেকে অনেকটা সামলে নেয় সে এক বছরে। কিন্তু সমস্যা হয় তার কিছুদিন পর। সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। আজকের মতো করেই সেদিন প্রিয়তা লাল সাদা শাড়িতে নিজেকে সাজিয়েছিল। আয়াজ তার পরিচিত কিছু ফ্রেন্ডের সাথে রমনায় গিয়েছিলো ঘুরতে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা চলছিলো ঠিক তখন তার পেছনে রিনরিনে কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

‘মামা চার প্লেট ফুচকা। ঝাল একটু বেশি হবে।’

কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকাতেই তার হার্ট বিট মিস করেছিল যেন। সর্গ থেকে যেন কোনো এন্জেল নেমে এসেছে। মন্ত্রে বশিভুত হওয়ার মত করেই সে নিশ্পলক তাকিয়ে ছিল প্রিয়তার পানে। সেদিনের পর থেকে আয়াজের এক রোগ হলো। রোগের নাম প্রিয়তা। লক্ষণ গুলো এমন ছিল, রোজ নিয়ম করে যেমন মানুষ খাবার খায় ঠিক সেভাবেই নিয়ম করে তাকে প্রিয়তার মুখ দর্শন করতে হতো। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার ভিষণ প্রিয়তাকে দেখতে ইচ্ছা করত। এই ইচ্ছাবোধের ফল তার বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটাতে হতো। তার ভিষণ জ্বর হলে ঘোরের মাঝে সে বারবার প্রিয়তার নাম নিত। অস্পষ্ট স্বরে বলা তার এ নাম কেউ বুঝতে না পারলেও সবাই এটুকু বুঝত ছেলে কারো নাম বলছে। এ নিয়ে তার মায়ের চিন্তার অন্ত ছিলো না। এভাবেই সময় যেতে যেতে পরিস্থিতি আজ এ পর্যায়ে।
____________

‘তুমি কি কখনোই পাংচুয়াল হবে না?’

বাবার গম্ভীর কথায় আয়াজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তরিকুল সাহেব গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। অফিসের প্রথম দিন এক ঘন্টা লেইট! তার গোছাল ছেলেটা দিন দিন অগোছালো আনপাংচুয়াল হয়ে পড়ছে। সে বাবা হয়ে ছেলের এই অধঃপতন কিভাবে সহ্য করবে? করা কি উচিত?

চলবে…#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.

আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। যখনতখন ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে যাবে। বর্ষা কালের এই এক সমস্যা। সময় অসময় বৃষ্টি নামবে। এই দেখা যাবে আকাশের বুক উজ্জল করে সূর্য উঠেছে আবার মুহূর্তেই নিজের রূপ বদলে ছেয়ে পড়বে আঁধারে। কুঁচকানো কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে এলো আয়াজের। প্রকৃতির উপর ভিষণ রকম বিরক্ত সে। বড় দেয়াল ঘড়িতে নজর দিতেই বুঝলো প্রিয়তার বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। এতক্ষণে তার মুখে মুচকি হাসির সরল রেখা দেখা গেল। নিজের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই তার সহকর্মী মেয়েরা তাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লাগলো যেন। কেউ কেউবা ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিন্তু সে এতে পাত্তা দিল না। এ ধরনের ছেঁচড়া টাইপের মেয়ে তার একদম পছন্দ না। বিরবির করে বলল,’ শ্যামলেস!’

আজ ভিষণ মন খারাপ প্রিয়তার। মন খারাপের দিনগুলোতে তার মায়ের কথা ভিষণ মনে পড়ে। আজ ও মনে পড়ছে। মায়ের চেহারাটাও তার স্পষ্ট মনে পড়ে না। কেমন ঘোলাটে স্মৃতি। প্রিয়তার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে। আজ বাস আসতে লেইট করছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। দোকানপাটের অধিকাংশ শাটার টেনে দেওয়া হয়েছে। প্রিয়তা ঠিক করেছে সে আর লাল সাদা রঙের শাড়ি পড়বে না। এই শাড়ি পড়লে সেদিন ভিষণ রকম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি আর তার শাড়ির অদ্ভুত কোন এক কানেকশন আছে। ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে। এখন বিকেল হলেও দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে প্রিয়তা যাত্রী ছাউনীর নিচে পদাড়ালো। এই লাইনের বাসটার কোনো ঠিক নেই। আজ না আসলেও পারে। বিরক্ত চোখে আসপাশে তাকালো প্রিয়তা। ফাঁকা কোনো ট্যাক্সি পেলেও চলে। ভাড়াটা যদিও একটু বেশি চাইবে। বাট ইটস্ ওকে।

‘বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। এখন কোনো ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না।’

বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। চুল থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। সাদা রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। প্রিয়তা আয়াজের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় শুধাল,

‘এখানে কি করছ তুমি? আর এতটা ভিজলে কিভাবে?’

জবাবে গা দুলিয়ে হাসলো আয়াজ। ভেজা চুলগুলো ঝাঁকিয়ে পানি ছিটালো প্রিয়তার দিকে। ছিটা ছিটা পানি এসে পড়লো প্রিয়তার মুখমন্ডলে। গরম চোখে আয়াজের দিকে তাকাতে সে আবারো হাসলো। প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

‘আপনার কি আমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে প্রিয়?’

‘একদম না। তুমি মরে গেলেও তোমাকে নিয়ে চিন্তখ করার মতো তুচ্ছ কাজ আমি করবো না।’

প্রিয়তা ভেবেছিলো তার এমধ কঠিন বাক্য আয়াজকে আহত করবে। আত্মসম্মানে আঘাত করবে কথাটা। আয়াজ তখন প্রতিউত্তরে বলবে,

‘আপনি ভিষণ জাদরেল টাইপ মেয়ে। এমন মেয়েকে আমি কখনোই আমার মূল্যবান প্রেম সমার্পন করবো না। যতটা করেছি তা সহিসালামতে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

প্রিয়তা তখন ভিষণ দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করে বলবে,

‘কেবল এতটুকুতেই তোমখর প্রেম ফুরিয়ে এলো?’

কিন্তু আয়াজ কোনো উত্তর দিবে না। তার গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলবে,

‘আমায় ট্রিক করার চেষ্টা করবেন না। আপনার ভোলাভালা মুখ দেখে আমি আর ফাঁসছি না।’

প্রিয়তার এতসব জল্পনা কল্পনাকে জলে ফেলে দিয়ে আয়াজ সুন্দর হেসে বলল,

‘আমি জানি। আর এজন্যই আমি মরতে চাই না। আমার তো এখনো আপনাকে ভালোবাসা বাকি। সংসার করা বাকি। বচ্চার মুখে বাবা ডাক শোনা বাকি। এত অপূর্ণতা নিয়ে মারতে পারি বলেন?’

প্রিয়তা জবাব দিলো না। তার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে সে অনেক প্রেমের প্রোপোজাল পেয়েছে। কিন্তু তার কেউই এক সপ্তাহের বেশি প্রিয়তার পেছনে ছুটতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ প্রিয়তার কঠিণতা। কিন্তু এই ছেলে তেমন নয়। তার কঠিণতা আয়াজকে তার স্থান থেকে এক চুল পরিমান নড়াতে পারেনি। প্রিয়তা হতাশ চোখে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি এখনো তেজ নিয়ে ঝড়ছে। এর শেষ কখন বলা যাচ্ছে‌ না।

‘এদিকে সরে দাঁড়ান প্রিয়তা। ভিঁজে যাচ্ছেন।’

ছিটা ছিটা পানিতে প্রিয়তার শাড়ি অনেকটা ভিঁজে গিয়েছে যা লক্ষ করেনি প্রিয়তা। আয়াজের গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করা তার নাম শুনে সে কেঁপে উঠলো কিছুটা। দিরুক্তি না করে বাধ্য মেয়ের মতো কিছুটা আয়াজের দিকে সরে দাঁড়ালো। এটাই হয়তো প্রথম আয়াজ তার পূর্ণ নাম ধরে ডেকেছে।
___________

‘রাত হয়েছে প্রিয়। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’

প্রিয়তা কোনো কথা বলল না। জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। আয়াজ প্রিয়তার এই অবাধ্যতা দেখে চোয়াল শক্ত করে নিলো। কঠিন গলখয় বলল,

‘আপনার এ ধরণের অবাধ্যতা আমি সহ্য করবো ভাবলে ভুল ভাবছেন।’

প্রিয়তা কোনো রিয়্যাকশন ছাড়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট দশেক একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে একটা ট্যাক্সি পেতে চড়া ভাড়ায় তাতেই চেপে বসলো প্রিয়তা। আয়াজ শুকনো গম্ভীর মুখ করে কেবল তাকিয়ে রইল। মেয়েটার অবাধ্যতা সীমা লঙ্ঘন করছে। অতি শীঘ্রই এর একটা ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

দরজায় কড়া নাড়তে সুজলা এসে দরজা খুলল। মামিকে দরজা খুলতে দেখেই প্রিয়তা বুঝতে পেরেছে আজ বড় কিছু ঘটতে চলছে। কিন্তু তার ভয় লাগলো না। এসবে সে ঐখন অভ্যস্ত।

‘এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি?’

‘বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম।’

প্রিয়তার সহজ জবাব সুজলার পছন্দ হলো না। প্রিয়তার কোনো কিছুই তার পছন্দ হয় না। তার মতে তার সংসারের অশান্তির মূল কারণ প্রিয়তা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন একদিন এই মেয়ের কারণেই তাদের পথে বসতে হবে। লোকে দুটাকা দিলে দুমুঠো খেতে পাবে নয়তো নেই। সুজলা চোখ বাঁকা করে তাকালো প্রিয়তার দিকে। মুখ ঝামটা মেরে বলল,

‘আমার বাড়িতে থাকতে গেলে এসব নষ্টামি চলবে না। আমি কিছু বুঝিনা তাই ভাবছো? বাপের রক্ত বইছে শরীরে। বাপের মতো নষ্ট হতে সযয় লাগবে না।’

‘সব কথার মাঝে আমার বাপকে না টানলেই কি নয় মামি?’

‘আহা! খুব গায়ে লাগছে দেখছি!’

প্রিয়তা আর জবাব দিলো না। সে জানে মামি এখন তাকে রাগাতে চখিছে এসব বলে। সে কোনো উত্তর দিলেই মামর কাছে বিচার বসাবে। এরপর এই সূত্র ধরে বিশাল ঝামেলা। কিন্তু সে কোনো ঝামেলা চায় না। রুমে ঢুকে ভেজা কাপড় বদলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিন পর নরম বিছানায় পিঠ লাগাতেই ঘুম এসে ধরা দিলো চোখে। সকল হতাশা চিন্তা ভুলে ঘুমের দেশে গা ভাসিয়ে দিলো সে। একটা লম্বা ঘুম দরকার।

মাঝরাতের দিকে প্রচন্ড ক্ষুদায় ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রিয়তার। এপাশ ওপাশ করেও কোনো লাভ হয় না। রান্নাঘরে ঢুকে কোথাও কোনো খাবার খুঁজে পেল না। অবশিষ্ট কোনো খাবার রাখা নেই। শেষে এক কাপ চা আর দুটো বেকারি বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পরতে হলো। আপাতত এটুকুতেই রাতটুকু চলবে।

__________

পরপর দুদিন আয়াজের কোনোরকম খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রিয়তা বেশ অবাক হলো। সাথে কিছুটা চিন্তিত ও। আয়াজকে সে যতটুকু চেনে‌ এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পাত্র সে না। তাহলে? একটা সূক্ষ্ম চিন্তায় কপালের মাঝে ভাঁজ পড়লো। পরক্ষণেই চিন্তাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। আয়াজ আসছে না এতে তো তার স্বস্থি পাওয়ার কথা চিন্তা নয়?

রিকশা‌ এসে বাস স্ট্যান্ড এ থামতেই প্রিয়তা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। বাস এখনো আসেনি। প্রিয়তা ব্যস্ত নজরে আশপাশে তাকালো। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের ভাঁজে গুজে দিয়ে সময় দেখলো। মাথা থেকে আয়াজ নামটা সরছে না। ছেলেটা আশপাশে থেকেও তাকে বিরক্ত করে না থেকেও সেম। প্রিয়তা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার থেকে এত ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে ভাবনা তাকে মানায় না। আয়াজ বাচ্চা ছেলে! পাগলামি করছে কিন্তু সে তো বুঝে! প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে এলো। ছোট ছোট করে বলল,

‘তুমি কেন আমার আগে জন্ম নিলেনা? আমি একটা আপন মানুষ পেতাম। ভরসার একটা হাত পেতাম। কিন্তু আমি যে বড্ড অভাগী!’

চলবে……….…….

(ইনশাআল্লাহ পরপর দুদিন গল্প দিয়ে গ্যাপ পূরণ করে নিব। প্লীজ বকাবকি করিয়েন না😞।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here