অবন্তর আসক্তি পর্ব ৬১+৬২ ও শেষ

#অবন্তর_আসক্তি
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা [লেখিকা]
#পর্ব____৬১

শীত কাল চলছে হাল্কা হাল্কা শীত পরেছে। গ্রামে গাছপালা বেশি থাকে আর তেমন ঘনবসতি ও নয়। তাই বাতাসের ঠান্ডা আবেশ শহরের তুলনায় বেশি।

শীতে কাপুনি ধরে আসছে হাতের তালু দুটো একসাথে গষতে গষতে কিচেনে আসে বর্ষা। জ্বলন্ত চুলার পাশে হাত রাখে যাতে করে আগুনের উষ্ণ তাপে কিছুটা আরাম পায়।

মুন্নি বর্ষার উদ্দেশ্য বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তোর এখন বাড়ির সকলকে ওর কথা বলে দেওয়া উচিত!’

বর্ষা হতবুদ্ধি চোখে মুন্নির দিকে তাকালো শুকনো ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল, ‘ আমি চাইনা এখনই কেউ ওর ব্যাপারে জানুক৷ ’

বলে বর্ষা মুন্নির সামনে থেকে রুমে চলে যায়। মুন্নি রান্না শেষে ডাইনিং টেবিলে খাবার গুলো সাজিয়ে রেখে বর্ষাকে ডাকতে যায়। বর্ষার রাগ ভাঙ্গিয়ে সাথে করে নিয়ে আসে। চেয়ারে দু’জনে পাশাপাশি বসেছে বর্ষা আহ্লাদী স্বরে বলে, ‘ তাপ্পি আজকে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা প্লিজ। ’

মুন্নি মৃদুস্বরে বলল, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে! ’

খাবার শেষে দু’জনে কিয়ৎক্ষণ টিভি দেখতে বসে। দেখার মতন তেমন কোনো কিছু না পেয়ে টিভি অফ করে দেয়। বাড়ির সকল লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে চলে যায়।

এই রাতের অন্ধকারে চারপাশ থেকে নানান পশুপাখির ডাক ভেসে আসছে। পুরোদিন কাজ করে ক্লান্ত থাকায় বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে যায় মুন্নি। এদিকে বর্ষার কোনো ভাবেই ঘুম আসছে না৷ বার বার এপাশ ওপাশ করছে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা হাতে নেয়। গ্যালারিতে এসে অভ্রর ছবি দেখতে লাগে কিয়ৎক্ষণ পর মোবাইল বুকের উপর রেখে সেও ঘুমিয়ে পরে।

রাত তখন গভীর, সময়ের অনুমান করা খুব কঠিন। রুমের মধ্যে লাল রঙের ড্রিমলাইট জ্বলছে বলে আবছা আবছা কম বেশি সবই দেখা যাচ্ছে। কোনো কিছুর শব্দ কানে আসতে ঘুম ভেঙে যায় বর্ষার পিটপিট করে চোখ জোড়া মেলে তাকায় আর দেখতে পায় একটা দানবের মতো ছায়ামূর্তি তার দিকে ধেঁয়ে আসছে। ভয়ে কপাল থেকে ঘাম জড়তে থাকে তার, এত বেশি ভয় পেয়েছে যে যার জন্য পাশে শুয়ে থাকা বোনটাকেও ডাকতে পারছে না বর্ষা। ছায়ামূর্তি টা একটু একটু তার দিকে এগিয়ে আসছে৷ বর্ষা মুখ খুলে আমতা আমতা করে বলল, ‘এই তাপ্পি উঠ না প্লিজ! ‘

মুন্নির কোনো হুঁশশ নেই, এদিকে বর্ষা আরেকবার তাকে ডাকতে যাবে তখন খেয়াল করল, ছায়ামূর্তি টা লাফ দিয়েছে আর লাফিয়ে তার উপরে পরতে যাচ্ছে। আচমকা চোখ মেলে তাকায় বর্ষা তৎপর বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। তারাতাড়ি করে ফোনের লাইট অন করে তারপর পুরো রুমে চোখ বুলাতে লাগে হতবিহ্বল হয়ে যায় সে কারণ রুমের চার কোণায় কিছুই নেই। বুকের উপর হাত রেখে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। পাশ ফিরে একবার মুন্নির দিকে তাকালো সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমাচ্ছে খারাপ স্বপ্ন দেখছে ভাবতে ভাবতে ফোনে সময় চেক করলো। রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি পাঁচ মিনিট কম তিনটা বাজে। বিছানা থেকে নেমে বর্ষা আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর অজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ভালো মত ওড়না গায়ের সাথে বেঁধে নেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে পরে। তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে বসে বসে তব্জি দিয়ে দোয়া কালাম পরতে লাগে। এতেই আধঘন্টার মতো সময় পাড় হয়ে যায়। তব্জি পাশে রেখে কোরআন শরীফ সামনে নিয়ে বসে। এক মনে কোরআন পড়তে থাকে। কোরআন পড়ায় এতটাই মগ্ন হয়ে পরেছিল যে সময়ের কোনো খেয়ালই ছিল না, দূর দিগন্ত থেকে কানে ভেসে আসে ফজরের আজান। কোরআন পড়া শেষ করে ফজরের নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে পরে। নামাজ শেষে আবারও তব্জি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মুন্নিকে ডাকতে লাগে, ‘ তাপ্পি উঠো ফজরের আজান দিছে অনেকক্ষণ উঠে নামাজ পরে নাও! ‘

মুন্নি কিয়ৎক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। তারপর নামাজ আদায় করে নেয়।

ইতিমধ্যে সূর্য তার স্নিগ্ধ আবেশ তুলে ধরেছে আকাশের বুকে। সকালের মিষ্টি রোদের আলো জানালা মেলে দিতে রুমে উপচে পরতে লাগলো। মুন্নি বর্ষার উদ্দেশ্য তারা দিয়ে বলল, ‘ আমি নাস্তা বানাচ্ছি! তুই বেলকনিতে গিয়ে ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে আয়। ’

বর্ষা ছোট করে বলে উঠল, ‘ আজ আমি নাস্তা বানাই? ‘

মুন্নি শাসিতকন্ঠে বলল, ‘ এই অবস্থাতে রান্না ঘরে একদমই যাবি না! যেটা বলেছি আপাতত শুধু ওটাই কর। ’

বর্ষা মুখ গম্ভীর করে বেলকনিতে চলে আসে, গাছগুলোতে পানি দিয়ে পাশেই চেয়ারে বসল, সদ্য উদয় হওয়া সূর্যটার দিকে এক মনে তাকিয়ে থেকে বর্ষা আবেগী হয়ে বলতে লাগল,

❝ হুট করেই চলে গেছো, কাছে থেকে দূরে বহুদূরে
বুঝিনা কিসের তরে থাকো কার কল্পনার ঘোরে!

স্বপ্ন দেখিয়ে ভেঙে দিয়েছো, দূরে বসে হয়তো খিলখিল হাসছে!
কিন্তু আমার মনের আয়নায় যে তুমি’ই স্বপ্ন হয়ে ভাসো!!

বিবর্ণতায় সাজাও ভূবন আমার, আচম্বিতে
বুকের মধ্যে উথাল ঊর্মির তোড়ে ফিরি সম্বিতে।

চোখের নদীতে বন্যা বয়ে যায় সেকি অভ্র বুঝে?
বুকের অথৈএ রক্ত চুয়ে চুয়ে সে’কি অভ্র খুঁজে?

অস্পৃশ্য ভালবাসায় ডুবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি
মোহের টানে নাগালে কারো অস্তিত্ব ঠের পাচ্ছি! সে কে? নীলাম্বরে ভেসে থাকা একটুকরো অভ্র কি?!

অভ্র শুনো, আমিতে ভেসে থাকা অভ্র’র মন শুভ্র কি?

অস্থিরতায় কাটছে সময় তুমিহীন, আসোনি অভ্র
তোমার শুভ্র ডানায় নিয়ে আজও ভাসোনি আমায়!!

শেষ ট্রামে চলে গেলে অভ্র, হয়ে শেষ বর্ষাধারা
তোমার জন্য অস্থির মন হলো যে পাগলপাড়া!

নিপুণ ছোঁয়ায় তুমি ভেঙ্গে দিলে মনের দেয়াল
অভ্র তুমি তীরে বসে দূরে!

তোমাকে ভেবে ভরছি খাতা সব অজ্ঞান লেখায়
অস্থির সময় যেনো শুধু কষ্ট পেতেই শেখায়!!

অভ্র তোমার ডানায় ভর দিয়ে উড়তে ইচ্ছে নিবে! অভ্র তোমার শুভ্র ছোঁয়ায় হারাতে মন অস্থির দিবে??

গলে পড়ো অবিরাম চোখের পাতা ছুঁয়ে বুকেতে
আলিঙ্গনে আত্মহারা হতে চাই আবার সুখেতে।

অভ্র বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে দাও সর্বাঙ্গে শীতল ছোঁয়া
তোমার তরেতে গেলে যাকনা আজ এ মন খোয়া! ❞

বলতে বলতে চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গালে ল্যাপ্টে থাকা জলটা মুছে নেওয়ার সাথে সাথেই বর্ষা তলপেটে ধরে চিৎকার করতে লাগলো। বর্ষার চিৎকার রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা মুন্নি শুনতে পেয়ে বারান্দার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। ফ্লোরে বসে তলপেট ধরে কেঁদে উঠছে বর্ষা মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে নানান আকুতি মিনতি করছে সে। মুন্নি এসে বর্ষাকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসায়ে বলল, ‘ একটু কষ্ট হবে বোন দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য কর প্লিজ। আমি চুলায় পানি গরম বসিয়ে দিয়ে আসছি। ’

বলে মুন্নি তারাহুরো করে রান্না ঘরের দিকে রওনা দিলো। এদিকে মরন যন্ত্রণার সাথে বকিফ হচ্ছে বর্ষা। তার আত্মচিৎকারের গতি বেড়েই চলেছে। এই বুঝি এখনই আত্মা টা বেরিয়ে যাবে।

মুন্নি বড় গামলায় করে গরম পানি এনে ফ্লোরের উপরে রাখলো। বর্ষা মুন্নির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ তাপ্পি, একটা মেয়ের সন্তান প্রসবের আগে এততত কষ্ট ও ব্যথা কেন হয়? ’

মুন্নি বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ মা ডাক শোনা কি চারটি খানের কথা। মা কি মেয়েরা এমনি এমনি হয়রে পাগলী। ‘মা’ শব্দটি শুধু একটি অক্ষর,ধ্বনি, বা বাক্য নয়রে এই শব্দটি এটার মধ্যেই এক উপন্যাস। কখনো কখনো পুরো পৃথিবীটাই যেন হয়ে ওঠে ‘মা’। যিনি সর্বংসহা তিনিই মা। ত্যাগের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যার বসবাস তিনি হচ্ছেন মা। একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এর বেশি সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একজন মা! প্রসবকালে ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা সহ্য করেন। বিজ্ঞান বলছে, এই ব্যথার যন্ত্রণা ১০টি হাড় একসঙ্গে ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে এই কষ্ট বা ব্যথা শুধু মা-ই সহ্য করতে পারেন, অন্য কেউ নন। মাতৃত্বই সব মায়া-মমতার শুরু এবং শেষ।

গর্ভে ধারণ করা মাত্রই মায়ের জীবন মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। দিন যত বাড়তে থাকে ঝুঁকিও তত বাড়ে। একজন মানুষের ভেতরে আরেকজন মানুষ ভাবা যায় আল্লাহর কত বড় নিয়ামত।

আমি এই নয় মাসে তোকে A to Z সব বলেছি ও বুঝিয়েছি তুই প্লিজ একটু সহ্য কর আল্লাহর উপর আস্থা রাখ তাছাড়া আমি তো আছি। আল্লাহ কবুল করলে আমিই তোর ডেলিভারি করবো ইন শা আল্লাহ।
__________________
সাত বছর পর-

দরজার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে বর্ষা। মুন্নি সকালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছে যাওয়ার আগে বলে গেছে তারাতাড়ি ফিরবে।

দীর্ঘক্ষণ বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে রুমের ভেতরে চলে যায়। রুমের মধ্যে একা একা কিয়ৎক্ষণ পায়চারি করে তারপর রান্না ঘরে চলে আসে। টুকটাক কাজ করতে কারতে বলতে লাগল, ‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ণব স্কুল থেকে চলে আসবে। আর এসেই বলবে আম্মু আমার খিদে পেয়েছে। অর্ণব যতক্ষণে না আসছে ততক্ষণে নাহয় আমি ওর জন্য পেন কেক বানাই। ও আসলে দেখে খুশি হয়ে যাবে। ’

ত্রিশ মিনিট পর, কেক বানিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতেই, কেউ একজন তার মিষ্টি মধুর কন্ঠে ডাকতে ডাকতে আসছে, ‘ আম্মু? আম্মু? আমি স্কুল থেকে এসে গেছি। ’

বর্ষা ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে সরে অর্ণবের কাছে ছুটে গেলো। হাঁটু ভাজ করে অর্ণবের সামনে বসে দুইহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে এক চুমু একে দিয়ে বলল, ‘কেমন কাটালে স্কুলে আজকের দিন? ‘

অর্ণব ছোট্ট করে বলল, ‘ভালো! আজকে স্কুলে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ’

‘ বর্ষা অর্ণবের গালে হাত রেখে বলল, তাই! অর্ণ আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের কেক বানিয়েছি খাবে? ’

অর্ণব মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলল, ‘ খাবো তো আম্মু! ‘

স্কুলের পোশাক পড়েই অর্ণব ছুটে গেলো টেবিলের কাছে একহাত বাড়িয়ে কেক নিতে নিলেই বর্ষা অর্ণবর হাতে চাপড় দিয়ে বলল, ‘ আগে যাও হাত ধুঁয়ে আসো। ‘

হাত ধুঁয়ে আসার পর অর্ণবকে কোলে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগে বর্ষা। অর্ণব বর্ষার হাত ধরে মলিনকন্ঠে বলে, ‘ আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ‘

বর্ষা অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ হুম করো। ‘

‘ অর্ণব বলল, আমার বাবা কোথায় আম্মু? আমার স্কুলের সবার বাবা আছে শুধু আমারই বাবা নেই। তাদের বাবা’রা তাদের রোজ স্কুল থেকে নিতে আসে আরও অনেক খেলনা কিনে দেয়। তাদের বাবা’রা তাদের অনেক ভালোবাসে। ‘

‘ আমিও তো তোমাকে খেলনা কিনে দেই বাবা। তোমাকে আমিও তো অনেক ভালোবাসি। ‘ অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল বর্ষা।

‘ কিন্তু তুমি তো আমার বাবা নও আম্মু! আমার বাবা কোথায়? ‘

‘ তোমার বাবা নেই অর্ণব! তোমাকে আমি জন্ম দিয়েছি তাই আমিই তোমার সব। ’

অর্ণব অভিমানে মাথা নিচু করে ফেললো। তখনই ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসলো মুন্নি। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল বৈকি বর্ষা শানিতকন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘ কি হয়েছে তাপ্পি? এত চিন্তিত কেনো দেখাচ্ছে তোমাকে সব কিছু ঠিক আছে তো? ’

মুন্নি বর্ষার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকন্ঠে বলল, ‘ তোকে এবার আমার সাথে গাজীপুর যেতেই হবে বর্ষা। বড়’মা মৃত্যু সজ্জায় আর তিনি শুধু একবারের জন্য তোকে দেখতে চাচ্ছে। ‘

বর্ষা আচমকা দাঁড়িয়ে পরল আর বলে উঠল, ‘ আমি যাবো। ‘

মুন্নি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ অর্ণবকে দেখে বাড়ির সবাই ওর সম্পর্কে জানতে চাইবে তখন কি বলবি। আট বছর ধরে কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিসনি আর না তাদেরকে ওর কথা বলেছিস। শুধু ফোনে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিস। অর্ণবকে দেখলে তো তারা প্রশ্ন করবেই। তখন তুই কি জবাব দিবি বর্ষা? ‘

বর্ষা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে অর্ণবকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,‘ আমি অর্ণবকে নিঝুমের বাড়িতে রেখে যাবো। নিঝুমের উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে ও খেয়াল রাখবে আমার ছেলের। তুমি শুধু যত দ্রুত যাওয়ার ব্যবস্থা করো। ’

‘ তুই কি সারাজীবন অর্ণবকে সকলের থেকে আড়ালে রাখবি? কাউকেই বলবি না ওর কথা আর ওর ও তো অধিকার আছে পরিবারের সবার সাথে দেখা করার। ‘ বলল মুন্নি।

‘ আপাতত নয়, সময় হলে দেখা করিয়ে দেবো। এখনও সময় আসেনি। ‘

বলে বর্ষা চলে যেতে যাবে তখন মুন্নি আবারও বলল, ‘আরও একটা কথা বলার বাকি রয়ে গেছে?’

বর্ষা মুন্নির দিকে তাকিয়ে নির্মূলকন্ঠে বলল, ‘ হুম বলো! ‘

মুন্নি কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল, “ অভ্র তোর সাথে দেখা করতে চায়! কাব্যর সাথে কথা হয়েছে ওই বলেছে! ”

অভ্রর কথা শুনে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে বর্ষার। কোনো প্রত্যত্তর না করে এলোপাথাড়ি পা ফেলে রুমের দিকে চলে যায়। চক্ষু জোড়া জলে ছলছল করছে। এই বুঝি অশ্রু কণা গড়িয়ে পরবে।
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৬২ (অন্তিম_পর্ব)
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________________
“অভ্র তোর সাথে দেখা করতে চায়!” বাক্যটি বারবার কানের কাছে বেজে উঠছে বর্ষার। কপালে হাত রেখে গাড়ির জানালার সাথে হেলান দিয়ে মুন্নির বলা কথাটি বারবার ভাবছে সে মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল, আমাকে ছেড়ে চলেই তো গিয়েছো অন্য কারো কাছে তাহলে আজ কেনো আবার আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছো অভ্র?’

তখনই অর্ণব বর্ষার একহাত ধরে বলল, আম্মু পানি খাবো!

অর্ণবের ডাকে হুঁশশ ফিরে আসে বর্ষার। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এখনই দিচ্ছি বাবা!’

-রাতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকম নাস্তা করে গাজীপুরের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে। আট বছর ধরে এখানে বসবাস করছে ওরা তাই এখানকার অনেক গাড়ি চালক মুন্নির পরিচিত। রাতেই কল দিয়ে একজনকে বলে রেখেছিল তারা গাজীপুর যাবে এবং তাকেই নিয়ে যেতে হবে। সকালেই গাড়িচালক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার জায়গায় তার ছেলেকে পাঠায়। গাড়ি চালকের ছেলে মাস্টার্স পাস শুনে বেশ অবাক হয় বর্ষা। তবে ছেলেটা নিজেকে নিয়ে দ্বিধা বোধ করে না। তার বাবা যে একজন ড্রাইভার সে এটা গর্ব করে সবাইকে বলে কারণ, তার বাবা এই গাড়ি চালিয়েই তাকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। সবার সামনে নিজের পরিচয় দেয় সে তার বাবার সন্তান। মুন্নি মুগ্ধ হয় ছেলেটার সততা দেখে মুন্নি নিমজ্জিত হয়ে বলল,‘ আপনি আপনার বাবার ছেলে বুঝলাম। তো এই বাবার ছেলের নামটা কি জানতে পারি? ’

গাড়ি চালাতে চালাতে ছেলেটা ছোট্ট করে বলল, ‘ আমার নাম সোহরাব! ‘

বর্ষা অর্ণবকে বোতল দিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে। মুন্নির সোহরাবের প্রতি ইন্টারেস্ট দেখে আঁড়চোখে মুন্নির দিকে তাকালো, ধাতস্থ কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ‘ পছন্দ হয়েছে নাকি বাড়িতে বলবো? এক্কেবারে বিয়ে দিয়ে দিবে। ’

‘তাজ্জব, আমি জাস্ট নাম জিজ্ঞেস করেছি এখানে বিয়ে কোথা থেকে আসলো? তোর সামনে দেখা যাচ্ছে কারো সাথে কথা বলাও মুশকিল!’

বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো মুন্নি। বর্ষা মুন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে দুইপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ তোমার কিচ্ছু হবে না। যেমন ছিলে তেমন টাই রয়ে গেছো। ‘
.
.
.
চার ঘন্টা পর-

সোহরাবকে উদ্দেশ্য করে বর্ষা বলল, ‘ ভাইয়া গাড়িটা সামনের মোড়ে একটু দাঁড় করাবেন প্লিজ। ‘

সোহরাব কোনো প্রত্যত্তর না করে গলির মোড়ে গাড়ি ব্রেক করল। মুন্নিকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে বর্ষা অর্ণবকে সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে। দুইতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটায় চোখ বুলিয়ে গেইট খুলে ভেতরে গেলো। দারওয়ান চাচা এ বাড়িতে এক যুগ ধরে দারওয়ানের চাকরি করছেন। কলেজে পড়া কালিন নিঝুমের সাথে বহুবার এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল বর্ষার। দারওয়ান চাচাকে দেখে বর্ষা তার পাশে গিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। প্রথমত তিনি বর্ষাকে চিনতে পারেনি পরে যখন বর্ষা তার পরিচয় দিলো তখন তিনি চিনতে পারেন ও বর্ষার সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগেন। বর্ষা দারওয়ান চাচার উদ্দেশ্য বলল, ‘ চাচা নিঝুম বাড়িতে আছে? ’

দারওয়ান চাচা বলল, ‘ হো মা! নিঝুম মা’য় তো কালকেই শশুর বাড়ি থেকা আইছে। তুমি ভালা দিনেই আইছো। যাও উপরে যাও গেলেই তুমি দেখতে পারবা। ’

‘ আচ্ছা! ‘ বলে বর্ষা ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো। কলিংবেল চাপতে দরজা খুলে দিলো নিঝুম হাতে তার একটা বাটি। এত বছর পর বর্ষাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে পরে নিঝুম হাত থেকে বাটিটা ফ্লোরে পরে টুংটাং শব্দ তুলে। চোখ জোড়া ছলছল করছে। শুকনো ঢোক গিলে অস্ফুটস্বরে নিঝুম বলল, ‘বর্ বর্ষা?’

বলেই বর্ষাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নিঝুম। এত বছর পর দেখা হলো তাই দু’জনের মধ্যে কেউই নিজেকে সামলাতে পারছে না! নিঝুম বর্ষাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল, ‘ কতটা পালটে গেছিস তুই জান সেই আগের বর্ষা তো তুই তো নেই।’

বলতে বলতে নিঝুমের চোখ পরল বর্ষার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট রাজকুমারের উপর। অর্ণবকে দেখে মুগ্ধ হয় নিঝুম কোনো অংশে কম নয় সে। তাকে দেখেই যে কেউ বলে দিবে বাপের ছেলে। নিঝুম গভীর দৃষ্টিতে তাকালো অর্ণবের দিকে। কিয়ৎক্ষণ পর অর্ণবের গালে হাত দিয়ে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বর্ষার উদ্দেশ্য শালিনকন্ঠে বলল, ‘ও কে বর্ষা? ওকে দেখতে একদম তোর অভ্র ভাইয়ার মতো। দেখে মনে হচ্ছে অভ্র ভাইয়ার কার্বনকপি। ’

বর্ষা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, ‘ ওর নাম অর্ণব! আমার আর অভ্রর ছেলে। ‘

নিঝুমের চক্ষু জোড়া চড়কগাছ। হা করে বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইল। বর্ষা নিঝুমের হাত দু’টি ধরে বলল, ‘ ওর সম্পর্কে মুন্নি আপু ছাড়া আর কেউ জানে না এখন তুই জানলি। আমাকে বাড়ি যেতে হবে বড়মার অবস্থা খুব খারাপ। আর ওকে আমি আমার সাথে নিতে পারবো না। তুই প্লিজ ওকে তোর কাছে একদিনের জন্য রাখবি? আমি রাতেই চলে আসবো প্লিজ না করিসনা আমার তুই ছাড়া আর কেউ নেই। ’

তখনি সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে নেমে আসলো পিয়ম। বর্ষাকে দেখে নিঝুমের শাড়ির আঁচলের পেছনে লুকিয়ে পরল পিয়ম। বর্ষা মৃদুস্বরে বলল, ‘ তোর মেয়ে? ‘

নিঝুম উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ! ‘

নিঝুম পিয়মের হাত ধরে বর্ষার সামনে দাঁড় করালো বর্ষা কিছুটা ঝুঁকে পিয়মের গালে হাত রাখলো তারপর বলল,‘ ভয় কেনো পাচ্ছো মামনি? আমি তোমার এক খালামনি! ‘ বলেই পিয়মের গুলুমুলু গালে চুমু দেয়। নিঝুমের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া কি করে? কোথায় সে? ’

নিঝুম বলল, ‘ ডুবাই এক প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে তিন বছর আগে এসেছিল। তিন চার মাস পর আসবে তখন আমাদের দু’জনকে সাথে নিয়ে যাবে। ’

‘ও তখন তো তাহলে আর চাইলেও দেখা হবে না!’ বলল বর্ষা।

‘ এত বছরেও তো হয়নি! ‘ অভিমানী স্বরে বলল নিঝুম।

বর্ষা নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ সরি আর হবে না! আচ্ছা আমি এখন যাই তুই ওর খেয়াল রাখিস। ‘

বলে বর্ষা অর্ণবের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে কপালে এসে পরা থাকা চুলগুলো আঙুল দ্বারা পেছনে ঢেলে দিয়ে বলল, ‘ বাবাই লক্ষী ছেলের মতো খালামনির কাছে থাকবে একটুও দুষ্টামি করবে না ওকে। আম্মু রাতেই চলে আসবো। ’

বলে বর্ষা উঠে যেতে নিলে অর্ণব বর্ষার হাত ধরে নেয় কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ আম্মু আমিও তোমার সাথে যাবো। ‘

‘ বাবাই তুমি এখানে থাকো আমি তোমাকে আমার সাথে নিতে পারবো না। প্লিজ বুঝো আম্মু রাতেই চলে আসবো। ‘

বলে অর্ণবের হাত ছাড়িয়ে বর্ষা দরজার সামনে থেকেই চলে গেলো। এদিকে অর্ণব আম্মু আম্মু বলে কেঁদে উঠলো। নিঝুম অর্ণবকে কোলে নিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে উপরে চলে যায়।
বাহিরে এসে গাড়িতে উঠে বসতেই সোহরাব গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
.
.
নিঝুমের বাড়ি থেকে বর্ষাদের বাড়ি যেতে বিশ মিনিট সময় লাগে,
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামে বর্ষা ও মুন্নি। বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মুন্নির দিকে তাকায় বর্ষা। মুন্নি বর্ষার কাঁধের উপর হাত রেখে দুইবার চোখের পলক ফেলে। তারপর দু’জনে বাড়ির ভেতরে ঢুকে। বাড়ির সামনে থেকে আদিল বর্ষা ও মুন্নিকে দেখে চেঁচামেচি করতে লাগে, ‘ আম্মু, আব্বু, চাচি-আম্মু দেখো বর্ষা আপু আসছে। ’

আদিলের চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগে। যে ছোট্ট আদিল এক সময় বর্ষার পেছনে লেগে থাকতো সে এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। বোন দূরে চলে যাওয়ায় বোনের গুরুত্ব সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে এক দৌঁড়ে বর্ষার সামনে চলে যায়। দুহাতে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না জুড়ে দেয়। বর্ষা ও আদিলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ পাগলের মতো কাঁদছিস কেন? ‘

আদিল কান্না ভেজা কন্ঠে বলল, ‘ তুই অনেক সার্থপর রে আপু! তোর কি একবারও আমাদের কথা মনে পরেনি? তুই জানিস তোকে আমরা কত মিস করছি। তুই কেমনে পারছিস আমাদের সাথে এমনটা করতে তোর কি একবারও আমাদের কথা মনে পরেনি? ‘

বর্ষা আদিলের উদ্দেশ্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই কান্না করতে করতে ছুটে এসে বর্ষার গলা জড়িয়ে ধরে বর্ষার মা। হতবিহ্বল হয়ে যায় বর্ষা। সকলে সরু চোখে বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের ফেকাসে চেহারাই বলে দিচ্ছে তাদের মনে আকাশ সমান অভিমান জমেছে। বর্ষার বাবা দূর থেকে বলল, ‘ মেয়েটা সবে মাত্র এসেছে ওকে বাড়ির ভেতরে আসতে দাও। কড়া রোদের মধ্যে উঠানে দাঁড় করিয়ে রাখছো কেন? ’

বর্ষা তার বাবার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকন্ঠে বলল, ‘ বাবা! ’

অভিমানী স্বরে সাগর খান প্রত্যত্তর করলেন, ‘ আমি কারো বাবা নই। আমার কোনো মেয়ে নেই। আমার যদি সত্যিই কোনো মেয়ে থাকতো তাহলে সে কোনো ভাবেই পারতো না আমাদের সাথে আট বছরের দূরত্ব তৈরি করতে। ’

বর্ষা তার বাবার কাছে গিয়ে পাশে দাঁড়ালো সাগর খানের দুইহাত ধরে বলল, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। ’

অন্য দিকে তিন্নি সকলের আড়ালে গিয়ে অভ্রর নাম্বারে ডায়াল করল। দুইবার রিং হতে কল রিসিভ করে অভ্র। এপাশ থেকে তিন্নি বলল, ‘ তুই কোথায় ভাইয়া? ‘

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অভ্র জানালো, ‘ একটা কাজে আসছি। কেনো কিছু বলবি? ‘

তিন্নি ধীর কন্ঠে বলল, ‘ বর্ষা বাড়িতে আসছে। ‘

বর্ষার কথা শুনে ‘থ’ রয়ে যায় অভ্র। গাড়িতে অভ্র বাদে আরও চারজন ছিলো ড্রাইভ করছিলো মুরাদ অভ্র মুরাদের উদ্দেশ্য বলল, ‘ মুরাদ গাড়ি ঘুরাও আমরা নূর মঞ্জিলে যাবো।’

যেখানে যাওয়ার জন্য চারজনে বের হয়েছিল সেখানের উদ্দেশ্য বাকি দু’জনকে পাঠিয়ে নিজেরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
তিন্নি বলল, ‘ তোর না আজ খুব ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে তাহলে কিভাবে আসবি? ‘

অভ্র গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যত্তর করল, ‘ এত বছর পর আমার রাগরাগিণী ফিরে আসছে। তার জন্য তো আমাকে আসতেই হবে। তার সামনে যে আমার ইম্পর্ট্যান্ট থেকে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ও ফেঁকাসে। আমার কাছে যে তার থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট আর কিছু নেই। তুই চিন্তা করিসনা আমি সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবো। আর আমি যে আসছি সেটা কাউকে এখনই বলিস না। ‘ বলে কল কেটে দেয় অভ্র।

এদিকে সকলের মান অভিমান ভাঙাতে বেগ পেতে হয় বর্ষার। বোধগম্য হয়নি তার সকলে যে এত মান ও অভিমান করে আছে তার উপর। আর করবেই না কেনো? বাড়ির মেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বাড়ির বাহিরে থাকলে সকলেরই অভিমান হবে। তাছাড়া রাগ ও অভিমান সকলের উপরে করা যায় নাকি? যে অতন্ত্য আপন হয় তার উপরেই করা যায়। এত বছরে পুষে রাখা রাগ-অভিমান এত তারাতাড়ি মিটবে নাকি? উঁহু একদমই নয়, বর্ষা কোনো উপায় না পেয়ে সকলের সামনে কানে হাত দিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পরে। সকলে হতভম্ব হয়ে যায় বর্ষার এমনকান্ডে। মাথা নিচু করে সকলের কাছে আবারও ক্ষমা চায়। এত বছর পর মেয়েকে দেখে যতটা না অভিমান বৃদ্ধি পেয়েছে তার থেকে বেশি ইমোশনাল হয়ে পরেছে।

বর্ষা একটা বারের জন্যও কেনো ফিরে আসেনি কেনো কারো সাথে সাক্ষাৎ করেনি৷ এত কিসের অভিমান তার? এটাই হচ্ছে সকলের প্রশ্ন। বর্ষার বাবা ও মা এগিয়ে আসলো বর্ষাকে দুইহাতে দু’জনে জড়িয়ে ধরলো। বাড়ির সকলেরই চোখের জল গড়িয়ে গালে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বর্ষা উঠে দাঁড়ালো ও দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, সকলের কাছে একে একে গিয়ে ক্ষমা চাইলো৷

সকলে বর্ষাকে দুইহাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে আলতো চুমু একে দেয়।
____________
মান অভিমানের পালা শেষ হলে বর্ষা ফজিলা খাতুনের রুমের দিকে পা বাড়ায়। অসুস্থ বেশি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা পরিবর্তন দেখলে রোগী নিজেই বলেন, আমারে বাড়িতে নিয়া চল। এনো আমার ধম বন্ধ হইয়া আহে। ‘

রোগীর কথা ডাক্তার নিজেও শোনেন। এবং বাড়ির মুরব্বিদের সামনে গিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ পেসেন্ট আগের থেকে ভালো। উনি হাসপাতালে থাকতে চাচ্ছেন না, আপনারা বরং উনাকে বাড়ি নিয়ে যান। বাড়িতে গেলে হয়তো তিনি স্বস্তি পাবেন। ‘

মনোয়ারা বেগম সেদিনই তার মা’কে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ও তার দেখাশোনায় জেনো কোনো কমতি না হয় তাই ২৪ঘন্টার জন্য দু’জন নার্স নিয়জিত করেছেন। যারা ২৪ঘন্টা তার সাথেই থাকেন। ফজিলা খাতুন যখন কিছুটা কথা বলতে পারলেন তখন তিনি সবার কাছে তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করলো আর সেটা হচ্ছে বর্ষাকে একবার দেখা।

রুমের মধ্যে খাটের দুইপাশে দু’জন নার্স দাঁড়িয়ে আছে৷ বর্ষা ছুটে তার বড়মার কাছে গেলো। বিছানায় ফজিলা খাতুনের হাতের কাছে বসে, তার একহাত ধরে নিজের হাতের উপর রেখে আসতে করে বলল, ‘ বড়মা? ‘

বর্ষার ডাক শুনে পিটপিট করে আসতে আসতে চোখ জোড়া মেলে তাকালেন ফজিলা খাতুন। বয়স্ক হয়েছেন শরীরে হাড় ছাড়া মাংস একদমই নেই। খাটের সাথে জেনো মিশে শুয়ে আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে বর্ষাকে দেখেই চোখ জোড়া দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন ফজিলা। তা দেখে বর্ষা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল৷ ফজিলা খাতুনের হাত কপালের উপর ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। বর্ষার দাদি রুমের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে কাঁদছে। তার মায়ের এমন অবস্থা দেখে তার যে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। একমাত্র আল্লাহ জানেন এখন মনোয়ারা বেগমের মধ্যে কি চলছে?

ফজিলা খাতুন তেমন কথা বলতে পারেন না তার মুখে একটা দাঁত ও নেই। নাকে বাজিয়ে বাজিয়ে কোনো রকম বলল, ‘ আমার লক্ষী জী তুই আইছোস? ’

বর্ষা কান্নার জন্য কথা অব্ধি বলতে পারছে না। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ হো বড় মা আমি আইছি দেহো তুমি আমারে। ‘

বর্ষার কান্না দেখে বাকিরা নিজেদের সামলে রাখতে পারছে না তারাও কান্না জুড়ে দেয়। একজন নার্স রাগী গলায় বলে উঠল, ‘ আপনারা রোগীর রুমে এসে এভাবে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সকলে বের হন রোগীর অস্বস্তি হচ্ছে। আর তার সামনে এভাবে কাঁদছেনই বা কেনো? আপনারা জানেন আপনাদের এভাবে কান্নার জন্য রোগী তার মনোবল হারিয়ে ফেলবে। প্লিজ দয়া করে সকলে বাহিরে চলে যান। ‘

নার্সের ধমকা ধমকিতে সকলে রুম থেকে বের হয়। ফজিলা বর্ষার হাত শক্ত করে ধরে রাখায় সে যেতে পারে না। বর্ষা অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, ‘ বড়মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? আমাকে মাফ করে দাও বড়মা আমি তোমার কাছে আগে আসতে পারি নাই। ’ কান্না করতে করতে বলল।

ফজিলা বর্ষার একহাত ধরে তার পেটের ডানপাশে রাখলো করুণকন্ঠে আমতাআমতা করে বলল, ‘ এই জায়গায় পুইড়া যাইতাছে জী পুইড়া যাইতাছে। মনে হইতাছে কেউ আগুনের কয়লা রাইখা দিছে। আমি মনে হয় আর বাঁচতাম না জী! ’

ফজিলা খাতুনের মুখে এমন কথা শুনে বর্ষা আরও জোরেজোরে কান্না করতে লাগে। এদিকে ফজিলা ও কাঁদছেন এতে করে উনার শরীর খারাপ হতে পারে ভেবে দ্বিতীয় নার্স বর্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ ম্যাডাম এভাবে কাঁদবেন না। একবার আপনার বড়মার অবস্থা দেখুন ওভাবে উনি কাঁদতে থাকলে এতদিনে যতটা সুস্থ হয়েছিল আল্লাহ না করুক আবার অসুস্থ হয়ে পরে। আপনি প্লিজ নিজেকে সামলান ও আপনার বড়মা কে সান্ত্বনা দিন। ‘

বর্ষা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গালের উপরের জল মুছে বলল, ‘ তুমি চিন্তা করো না বড়মা। আল্লাহ তো আছেন আমরা সকলে তোমার জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে সুস্থ করে দিবেন। আল্লাহর বান্দা দুই হাত তুলে কিছু চাইলে তিনি কখনো ফিরিয়ে দেননা যদি তার বান্দার ক্ষেত্রে সেটা কল্যাণকর হয়। আমাদের সৃষ্টি কর্তা যে পরমকরুণাময় তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে সুস্থ করে দিবেন। তুমি বিছানা থেকে আবারও উঠতে পারবে আবারও চলতে পারবে দেখো মিলিয়ে নিও আমার কথা। ‘

বলে বর্ষা ফজিলা খাতুনের কপালে এক চুম্বন একে দিলো। ফজিলা খাতুন বর্ষার কথায় আস্থা পেলেন আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো তিনি বললেন, ‘আমিন’

বর্ষা ফজিলা খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বাহিরে চলে যায়।

বাড়ির সকলে ভাবে বর্ষা তাদের কাছে একেবারে চলে আসছে। কিন্তু তাদের ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে বর্ষা বলল, ‘ আমি কিছুক্ষণ পরই চলে যাবো৷ আমি শুধু বড়মার সাথে দেখা করতে আসছি৷ এখানে থাকতে আসিনি আমাকে ফিরতে হবে আর সেটাও সন্ধ্যার আগে। ‘

বর্ষা চলে যাবে শুনে সকলে মুন্নির দিকে তাকালো ও তাকে নানান ভাবে জেরা করতে লাগলো। মুন্নি তাদের উদ্দেশ্য সন্তুষ্ট জনক কিছুই বলতে পারলো না। দুই তিন ঘন্টা পাড় হয়েছে ওরা বাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতর ঢোকার পর সময়ের অনুমানই করতেই পারেনি মুন্নির মাথা থেকে সোহরাব এর কথা পুরো পুরি বেরিয়ে গেছিল সকলের উদ্দেশ্য বলল, ‘ আমাদের যে নিয়ে আসছে সোহরাব ওকে বাড়ির ভেতরে আসতে বলতে ভুলে গেছি। না জানি কতক্ষণ ধরে বাহিরে বসে আছে আমি ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসি তোমরা বসো আমি আসছি। ‘

বলে মুন্নি কোনো রকম তাদের সামনে থেকে চলে যায়। অর্ণব বর্ষার ছেলে বর্ষাই চায় না তার সম্পর্কে কাউকে বলতে সেখানে তার কিছুই করার নেই। মিথ্যে বলার থেকে কোনো কিছু না বলে সরে যাওয়াই উত্তম। বর্ষা আবারও চলে যাবে শুনে সকলের মন বেশ খারাপ হয়। বর্ষার বাবা বলেন, ‘যাবিই যখন কিছুদিন অন্তত থেকে যা।’

কিন্তু বর্ষা তাতে রাজি হয় না বর্ষা সকলের উদ্দেশ্য বলে, ‘ আমি কথা দিচ্ছি এর পর থেকে আমি মাঝেমধ্যে এসে তোমাদের সাথে দেখা করে যাবো। কিন্তু আমাকে আঁটকিয়ো না তোমরা আমার যেতেই হবে। ‘

তিন্নি ঢের বুঝতে পারছে বর্ষা অভ্রর আসার আগেই চলে যাবে কিন্তু অভ্রর না আসা অব্ধি যে বর্ষাকে আঁটকে রাখতেই হবে। ওতোপ্রোতো আর না ভেবে তিন্নি বলে উঠল, ‘ বর্ষা যাবিই যখন সন্ধ্যার পরে যা। তুই এসেছিস শুনে অভ্র আসছে তোর সাথে দেখা করতে। চলেই তো যাবি যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য ওর সাথে দেখা করে যা। ’ বলল তিন্নি।

প্রথমত অভ্রর সামনে যেতে রাজি হচ্ছিল না বর্ষা। কেননা তার মনে ভয় সঞ্চয় হচ্ছিল, ‘অভ্র সামনে আসলে সে নিজেকে সামলাতে পারবে তো? যদি অভ্রর সামনে সে কোনোভাবে দূর্বল হয়ে যায়? না না, এটা কোনো ভাবেই হতে দেবে না বর্ষা, অভ্র সে তো হিয়ার। তার উপরে ওর যে কোনো অধিকার অবশিষ্ট নেই। ’ মনে মনে ভাবতে লাগে বর্ষা।

বর্ষার বাড়ি ছাড়ার পেছনে বাড়ির অনেকে অভ্রকে দ্বায়ী করে। অভ্র আসবে শুনে তারা উঠে তাদের রুমে চলে যায়। আর যারা অভ্রকে সাপোর্ট করে তারা বসে বর্ষাকে রাজি করাতে লাগে সে জেনো অভ্রর সাথে দেখা করে।

বহুবছর পর, সেই অনুভূতিটা আবারও হচ্ছে, যেটা প্রথম অনুভব করে ছিল বর্ষা অভ্রর প্রতি, ওই আগন্তুক চিঠিবাজের চিঠি পড়ে, তখন সে জানতো না আগন্তুক চিঠিবাজ অভ্র। কিন্তু অনুভূতি হয়েছিল সত্য এখন আবারও সে অনুভূতি টা হচ্ছে। বর্ষা তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। খুব জোরে জোরে বিট করছে। দুইহাত কচলাতে লাগল বর্ষা এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ হুম আমি অপেক্ষা করবো তার আসার। কিন্তু আবার এমনটা জেনো না হয়, আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত পাড় করে দিলাম আর সে আসলোই না। ‘

বলে বর্ষা সকলের সামনে থেকে চলে গেলো।
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৬২ (অন্তিম_পর্ব)
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________________
(অবশিষ্টাংশ)

সন্ধ্যার পরপর ছাঁদে আসে বর্ষা, বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে এখন পর্যন্ত অর্ণবের একটা খবর নেওয়া হয়নি।

দূর আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ, জ্যোৎস্না রাতে চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে। ছাঁদে উঠার পথে লাইট অন করে আসছে বর্ষা। লাইটের আলোর জন্য জ্যোৎস্নার আলো তেমন সোভা ছড়াতে পারছে না।

ছাঁদের এক পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিঝুমের নাম্বার ডায়াল করলো। একবার রিং হয়ে কল কেটে যায় নিঝুম কল রিসিভ করে না। হয়তো ফোনের কাছে নেই ভেবে বর্ষা নিঝুমের নাম্বারে আবারও কল দেয়। এবারও রিং হচ্ছে কিন্তু নিঝুম কল রিসিভ করছে না দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠে বর্ষা।

বেচারি নিঝুম কল রিসিভ করবেই বা কিভাবে? তার একটা দুষ্টু মেয়ে কি কম ছিল? এখন তো তার সঙ্গী হয়ে আসছে অর্ণব৷ দু’জনে মিলে নিঝুমের বাড়ি উলট পালট করে ফেলেছে। কোনো কিছুই তার জায়গায় নেই। সব কিছু ফ্লোরে, বিছানায় তো কিছু সোফার উপরে পরে আছে। এদিকে সব কিছু গুছাতে গুছাতে নিঝুমের নাজেহাল অবস্থা একদিক দিয়ে গুছাচ্ছে তো আরেক দিক দিয়ে বাচ্চারা আবারও অগোছালো করছে। এমতাবস্থায় ফোনের রিংটোনের শব্দ কানে ভেসে আসে কিন্তু ফোন কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না আল্লাহ মালুম, কোন বস্তুর নিচে চাপা পরে আছে৷

বিরক্ত হয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে ফেললো বর্ষা, তখনই পেছন থেকে এক চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসলো সে বলে, ‘ কেমন আছো? ’

তার কন্ঠ কানে আসতেই শ্বাস ভারী হয়ে আসে বর্ষার সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে যথাযথ শান্ত রাখার প্রচেষ্টা করে পেছনে ঘুরে তাকায়।

লাইটের আলোয় দুজন দু’জনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, বর্ষা ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলল, ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো! ’

প্রত্যত্তরে মলিন কন্ঠে অভ্র বলল, ‘ জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি? ’

‘ বর্ষা ধাতস্থ কন্ঠে বলল, ভালোই আছেন! যার সাথে ভালো থাকবেন ভেবেছেন তার সাথেই আছেন। তো কিভাবে ভাববো আপনি ভালো নেই! যাগ্গে সেসব কথা, এখন বলেন আমার সাথে দেখা করতে কেনো চেয়েছেন? আপনার তো দেখার মানুষ আছেই! ’

‘ এভাবে কথা কেন বলছো বর্ষা? আমি তো তোমার অপরিচিত কেউ নই, আমি তোমার..’

অভ্রকে থামিয়ে বর্ষা বলল, ‘ মনে আছে, বধু সেজে বিয়ের স্টেজে বসে অপেক্ষা করছিলাম আমি আপনার অথচ আপনি আসেননি। সেদিন থেকেই আপনি আমার জন্য অপরিচিত আমার হাতে সময় নেই। যা বলবেন তারাতাড়ি বলুন, আমাকে যেতে হবে। কেনো দেখা করতে চেয়েছিলেন? ‘

অভ্র নির্মূল কন্ঠে বলল, ‘ তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল! ‘

প্রত্যত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বর্ষা বলল, ‘ তুমি মিথ্যে, তোমার কথা মিথ্যে তোমার ভালোবাসাও মিথ্যে। তুমি শুরু থেকে শুধু আমার সাথে নাটক করে গেছো আর সময় বুঝে মাঝপথে একা ছেড়ে চলে গেছো। অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল পুরো শহর ব্যস্ত রাস্তায় আমি ছুটেছিলাম ছন্নছাড়ার মতোন। সম্পূর্ণ দুইদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আশায় ছিলাম তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে আর তোমার চলে যাওয়ার কারণ বলবে, কিন্তু তুমি আসোইনি। তোমাকে আমার যখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন আমি তোমাকে পাইনি অথচ দেখো তখন তুমি ছিলে হিয়া নামের মেয়েটার সাথে। আর এখন দেখো তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার সামনে। আমার মনে হয়কি জানো অভ্র আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। একদম কাগজে কলমে৷ তোমার আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেওয়া উচিত। ’

এতক্ষণ শান্ত থাকলেও বর্ষার এ কথার পিঠে ক্রোধিত হয়ে উঠে অভ্র আর বর্ষার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাগী গলায় বলে, ‘ আমি যতদিন বেঁচে আছি! তুমি শুধু আমার থাকবে। আমার মৃত্যুর আগ মূহুর্ত অব্ধি আমি তোমার স্বামী আর তুমি আমার স্ত্রী। কোনো কিছুর মূল্যে তোমাকে আমি ছাড়বো না। এই চিন্তা মাথা তেও আর এ্যনো না। ’

মাত্রারিতিক্ত রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে বর্ষা অভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্রর হাত অন্য হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বর্ষা কর্কশকন্ঠে বলে, ‘ তুমি যখন আমাকে ছাড়বেই না তখন শুনে রাখো অভ্র, তোমার আর আমার মধ্যে স্বামী স্ত্রীর আর কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই। যতটুকু থাকবে সেটা শুধু ফর্মালিটি। ‘

বলে হনহনিয়ে বর্ষা অভ্রর সামনে থেকে চলে যায়। বর্ষার যাওয়ার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভ্র। বুকের বা পাশটায় বড্ড জ্বলছে। প্রিয় মানুষটার মুখে এমন কথা শুনে মনে বড় আঘাত পায়, চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। অভ্রর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, এই অশ্রুকণা চোখের সামান্য জল নয় এটা আমার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার কষ্ট।

অভ্র এখানে শুধু একনজর বর্ষাকে দেখতে এসেছে। তাই বর্ষার কড়া কথা গুলো মুখ বুঝে শুনেছে। ছাঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে মুরাদ। ছাঁদে এসেছিল আহিতার সাথে কথা বলতে, আহিতার সাথে কথা বলা শেষ করে চলে যাবে তখনই তার কানে বর্ষা অভ্রর কথোপকথন ভেসে আসে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোতে আসলে তখন তাদের ডিস্টার্ব হবে ভেবেই মুরাদ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়। না চাইলেই তাদের সব কথা সে শুনে ফেলে৷ বর্ষার লাগামছাড়া কথাগুলো তার কাছেও ভালো লাগেনি। সে সিদ্ধান্ত নেয় বর্ষা গাজীপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই অভ্রর সব সত্য যা অভ্র বর্ষার থেকে আড়াল করেছে মুরাদ নিজে বর্ষাকে জানাবে।

জ্যোৎস্না মাখা চাঁদটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিস্তেজ কন্ঠে অভ্র বলল, ‘ভালোবাসি কতটা? তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি! শুধু আমার চলে যাওয়া টাই দেখলে যাওয়ার পেছনের কারণটা একটা বারও জানতে চাইলে না। কিন্তু আমার কোনো আক্ষেপ নেই কেনো জানো, কারণ শেষ মূহুর্তের আগে যে আমি আমার প্রাণভ্রমরটা কে দেখেছি! আফসোস করবে হয়তো সেদিন যেদিন শুনবে আমি আর নেই তোমাকে ভালোবেসেই চলে গেছি। ’

বর্ষা ছাঁদ থেকে এসে সোজা নিঝুমের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে।

মুরাদ মুন্নির থেকে জানার চেষ্টা করে বর্ষা কোথায় গিয়েছে? মুন্নি প্রথমত বলতে চায়নি কিন্তু মুরাদের জোরাজোরিতে বলে দেয় নিঝুমের বাড়ি।
মুরাদের কাছে নিঝুমের নাম্বার ছিল না দ্বিধায় সে আহিতাকে কল দেয়। আহিতার কাছেও নাম্বার নেই শুনে হতাশাজনক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুরাদ৷ অভ্রকে নিয়ে কোনো ভাবেই নিঝুমের বাড়ি যাওয়া যাবে না ভাবতে ভাবতে কল কেটে দেয়। মুরাদের আহিতার সাথে বলা সবকথা শুনে নেয় রিয়া সে শালিনকন্ঠে বলল, ‘ তুই নিঝুমের নাম্বার কেন খুঁজছিস? ‘

মুরাদ তরিঘরি করে বলল, ‘ এখন সময় নেই, পরে একদিন বলবো। ‘

বলে সে রিয়ার সামনে থেকে চলে যাচ্ছিল, রিয়া তখন পেছন থেকে বলে উঠল, ‘ নিঝুমের নাম্বার আমার কাছে আছে। কালই কথা হয়েছে সে ওদের বাড়িতে আছে। ‘

বর্ষা চলে যাওয়ার পরও ঘন্টা খানেক সময়ের মতো অভ্র একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফজিলা খাতুনের সাথে দেখা করতে যায়। অবশ্য দেখা করতে যায় বললে ভুল হবে কেননা ফজিলা খাতুন তখন ঘুমাচ্ছিল।
অভ্র তার পাশে কিছুক্ষণ বসে আনমনে কিছু বিড়বিড় করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সিঁড়ির অর্ধেক নেমে গিয়েছিল মুরাদ রিয়ার কথা শুনে ছুটে উপরে চলে আসে আর বলে, ‘ তারাতাড়ি দে প্লিজ খুব দরকার! ‘

রিয়া নাম্বার দিলে মুরাদ আবারও ছাঁদে চলে আসে। এবার একবার কল হতেই কল রিসিভ করে নিঝুম অচেনা নাম্বার দেখে অস্ফুটস্বরে বলে, ‘কে?’

মুরাদ নিঝুমের উদ্দেশ্য বলে, ‘ আমি মুরাদ! আমার তোর হেল্প দরকার এতেই সবার মঙ্গল হবে বর্ষা তোর বাড়িতে পৌঁছালেই আমাকে কল দিয়ে ফোন ওর হাতে ধরিয়ে দিবি প্লিজ এতটুকু অন্তত করিস। ‘

বলে কল কেটে দেয় কেননা ততক্ষণে মুরাদের ফোনে অভ্রর কল চলে আসে। ওয়েটিং দেখে কল কেটে দেয় অভ্র গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে মুরাদের ফেরার অপেক্ষা করছে। মুরাদ চটজলদি ছাঁদ থেকে নেমে সোজা বাড়ির বাহিরে চলে আসে। গাড়ির সামনে আসলে অভ্র জানতে চায়, ‘ কার সাথে কথা বলছিলে,? ‘

মুরাদ ছোট করে বলে, ‘ ববব, বউয়ের সাথে! ‘

তারপর দু’জনে গাড়িতে উঠে বসে। অভ্রকে তার ফ্লাটের সামনে নামিয়ে দিয়ে মুরাদ তার গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। তখনই ফোন বেজে উঠে তার হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি ব্রেক কষে কল রিসিভ করে। অপর প্রান্ত থেকে আগে কথা বলে বর্ষা। এপ্রান্ত থেকে মুরাদ শানিতকন্ঠে বলে, ‘ শোন বর্ষা! তোকে আমার কিছু মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কথা জানানোর আছে। যাওয়ার আগে প্লিজ একবার আমার সাথে দেখা কর৷ কাল সকাল আটটার মধ্যে আমাদের পুরানো আড্ডা যেখানে জমতো ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে চলে আসিস প্লিজ আসিস। না আসলে তুই খুব বড় একটা সত্য জানা থেকে অজ্ঞ রয়ে যাবি। ‘ বলে কল কেটে দেয় মুরাদ।

বর্ষাকে একটা কথা বলার সুযোগও সে দেয়নি। এক নিঃশ্বাসে শুধু নিজেই বলে গেছে। হাতের মধ্যে ফোনটা মুঠি বন্ধ করে ধরে বিড়বিড় করে বলল, ‘ ওর কি এমন জরুরি কথা বলার আছে যার জন্য দেখা করতেই হবে? ‘
___________
রাতের অন্ধকারে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। হঠাৎ করে সশব্দে ফোনের রিংটোন বেজে উঠে, এত রাতে কে কল দিয়েছে ভাবতে ভাবতে রুমে প্রবেশ করে সে। বিছানার উপর থেকে মোবাইল টা নিয়ে দেখল এক অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করে কানে লাগাতে অপর প্রান্ত থেকে অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘ জাঙ্ক লড়ার জন্য প্রস্তুত তো অভ্র? ‘

চোয়াল শক্ত করে অভ্র বলল, ‘ শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি লড়ে যাবো তবু হার মানবো না। এই আফনান আহমেদ অভ্র কারো কাছে হারতে শেখেনি। আর না লড়াইয়ের ময়দান থেকে পলায়ন করতে শিখেছে। ’

ভোরের আলো ফুটতেই আরও একবার নিঝুমের কাছে অর্ণবকে রেখে বর্ষা চলে আসে মুরাদের বলা জায়গাতে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা আর আগের মতো নেই। কৃষ্ণচূড়া গাছটা বাদে অন্য কোনো গাছপালা নেই সব কিছু কেটে এখানে বাচ্চাদের একটা ছোট্ট পার্ক বানানো হয়েছে। অনেক বাচ্চারা খেলা করছে তাদের গার্জিয়ানরা কিছুটা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় তারপর পাশেই এক বেঞ্চের উপর বসে। মিনিট দশেক পর মুরাদ একটা কালো গাড়ি থেকে নেমে তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগে। মুরাদকে দেখে বর্ষা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মুরাদ বর্ষার পাশ কেটে বেঞ্চের উপর বসতে বসতে বলে, ‘ আমি তোর অফিসের বস নই আর না তুই আমার পিএ বা কর্মচারী, যে আমাকে দেখে তোর উঠে দাঁড়াতে হবে। ‘

বর্ষা কোনো কিছু না বলে বেঞ্চের উপর বসলো৷ জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয় মুরাদ। চোখের উপর থেকে কালো রঙের চশমাটা খুলে বেঞ্চের উপর রাখে। একহাত দিয়ে চশমাটা ঘুরাতে লাগে এতে এক অদ্ভুত ভিন্ন রকমের শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার দৃষ্টি মাটির সবুজ রঙের ঘাসের উপর স্থির। মুরাদ সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘ বর্ষা মনে আছে কলেজে একদিন তুই বলেছিলি একটা সম্পর্কটিকে থাকে শুধু বিশ্বাসের উপর৷ তাই সেটা যে সম্পর্কই হোক না কেনো তাতে বিশ্বাস থাকাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট! ‘

বর্ষা সরু চোখে মুরাদের দিকে তাকালো আর উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন বলছিস? ‘

মুরাদ ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘তোর বলা কথাটা তুই নিজেই ভুলে গেলি। ‘

ভ্রুকুটি কুঞ্চন করে বর্ষা বলল, ‘ মানে? ‘

“ তুই আর তোর পরিবারের সকলে জানিস অভ্র ভাইয়া বিজনেস করে কিন্তু তোরা কেউ জানিস না অভ্র ভাইয়া আসলে কি বিজনেস করে। অভ্র ভাইয়া তোকে অনেক বার বলেছে, সময় হলে সে নিজে থেকে সব সত্য তোকে বলবে। কিন্তু সে সময়টা তুই তাকে দিসনি। ”

অস্ফুটস্বরে বর্ষা বলল, ‘ আমি কি করলাম? ‘

বর্ষার সামনে একহাত সোজা করে তুলে মুরাদ বলল, “ থাম! চুপ কর! আমাকে বলতে দে এখনই পুরোটাই বাকি, অভ্র সে একদিন তোকে একটা চিঠি লিখেছিল তাতে লিখা ছিল তার জীবনের সব সত্য ঘটনা সে কি করে এসব। কিন্তু তুই সেটা পড়তে পারিসনি। তারপর সে ভাবে কোনো একসময় তোকে নিজের মুখে সব বলবে কিন্তু সেটা আর হয় না। তুই অভ্রকে, এক মিনিট কিছু মনে করিস না অভ্র বলছি বলে, কেননা এতবার তার নাম নিতে হচ্ছে যার জন্য ভাইয়া বলে সম্ভোধন করা সুবিধাজনক হচ্ছে না। এখন মূল কথাই যাই, তুই অভ্রকে ভালোবেসেছিস ঠিকই কিন্তু তাকে বুঝতে পারিসনি। তার আড়ালে লুকায়িত যন্ত্রণা কষ্ট তুই উপলব্ধি করতে পারিসনি। অভ্র তোকে কখনো মিথ্যে বলেনি শুধু একটা সত্য লুকিয়ে গেছে। তুই অভ্রকে ভুল বুঝেছিস বর্ষা। ভুল বুঝে হারিয়ে গেছিস। তুই ভেবেছিস অভ্র তোকে হিয়ার জন্য ছেড়ে গেছে কিন্তু এটা সত্য নয়, অভ্র তার প্রিয় বন্ধু দুঃসময় ও ভালো সময়ের সঙ্গী আলভিকে বাঁচাতে গিয়েছিল। সেদিন সকালেই আমাদের টিমের কয়েকজন টিম মেম্বার হিয়াকে আহত অবস্থায় রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পায়। সে কথা অভ্রকে জানায়।অভ্র শেরওয়ানি পরে বর ভেসে পরিপাটি হয়ে বাড়ি থেকে কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্য বের হয়েছিল আমিও গাড়িতে ছিলাম। আচমকা অভ্রর তখন আলভির কথা মনে। অভ্র নিশ্চিত হয়ে বলে আজ আলভির সাথে জঙ্গলের রাস্তায় যেকোনো অঘটব ঘটবে। তারপর সে গাড়ি নিয়ে আলভি যেখান টায় যাচ্ছিলো, সেখানের উদ্দেশ্য চলে যায়। আমাদের সকলকে অন্য গাড়ি করে সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। অভ্র যাওয়ার আগে বলে যায় সে সময়ের আগে চলে আসবে।

অভ্রর ধারণা ছিল ওরা আলভিকে মা’রতে চায় কিন্তু সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারে তাদের মেইন টার্গেট হচ্ছে অভ্র। আর তাকে সেখানে নেওয়ার জন্যই এত কিছু প্রথমে হিয়া পরে আলভি। তারা অভ্রকে তাক করে গুলি চালায়। কিন্তু সে গুলি বুক পেতে নেয় আলভি। বেঁচে যায় অভ্র আর মৃত্যুর দিকে দু’পা এগিয়ে যায় আলভি। অভ্র আলভিকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে আসে, সে হাসপাতালে আগে থেকেই এডমিট ছিল হিয়া। তার উপর বিরক্ত হয়ে অভ্র তাকে তার মামা বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুক্ষণ পর আলভি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে অভ্র তার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। তার বাবা মা’কে সান্ত্বনা দেয় আলভির শেষ মূহুর্তের সব কিছু সে নিজে করে কবর দেওয়ার পর সেখান থেকে চলে আসে। আর আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। পরদিন সকালে যখন বাড়ি আসবে তখন অভ্র কোথা থেকে জেনো শুনে শেষ মূহুর্তে তোর বিয়ে আদ্রিকের সাথে হয়েছে। তাই অভ্র আর ফিরে আসেনি। আর যতক্ষণে সত্য টা জানতে পায় ততক্ষণে তুই গাজীপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলি।

বর্ষা একটা কথা জানিস, অভ্র ভাইয়া তার পুরো লাইফে শুধু তোকেই ভালোবেসে ছিল। যার পরিমাপ তুই করতে পারিসনি।

আমার এতগুলো কথা হয়তো তুই বুঝতে পারছিস না। তাই শুরু থেকে বলি আমিও এসব কথা অভ্র ভাইয়ার টিমে যুক্ত হওয়ার পরই জেনেছি।

তুই খুন খারাপি, মারামারি এসব পছন্দ করিসনা। তাই অভ্র ভাইয়া ভেবেছিল সঠিক সময় এলে তোকে সবটা ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলবে, কিন্তু অভ্র ভাইয়া প্রতিনয়ত ভয় পেতো সবটা জানলে যদি তুই তাকে ঘৃণা করিস সেজন্য সে তোকে এড়িয়ে যেতো বলতে চেয়েও সাহস পেতো না।

বর্ষা মুরাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, “তুই এটা কেন বললি সব শুনলে আমি তাকে ঘৃণা করবো? ”

মুরাদ নিজেকে শক্ত করে বলল, ‘ কারণ অভ্র ভাইয়া সে নিজে একজন খু’নি! খুন খারাবি এটাই তার নিত্য দিনের কাজ। ‘

বর্ষা আচমকিত চমকে তাকালো মুরাদের দিকে। মুরাদ থমথমে রয়ে গেলো কিয়ৎক্ষণ পর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এ’বি গ্রুপের নাম শুনেছিস? ”

বর্ষা চোখ জোড়া ছোটছোট করে একটু ভাবনা চিন্তা করে বলল, “ হ্যাঁ শুনেছি। ঔটা একটা সিকরেট মাফিয়া গ্রুপ! ওরা সিকরেটলি বেশ অনেক ইলিগাল কোম্পানি, গোডাউন এইরকম আরো অনেক টিমের মালিকদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছল। সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানির মালিকদের আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি।”

মুরাদ মলিন কন্ঠে বলল, ‘ ঐ এ’বি টিমের লিডারকে জানিস? আর এ’বি গ্রুপের এ’বি এর পূর্ণরূপ কি জানিস? ‘

বর্ষা খানিক বিরক্ত হয়ে কপালের চামজা ভাজ ফেললো আর বিরক্তিকর স্বরে বলল, ‘ আমি কিভাবে জানবো আজব! ‘

মুরাদ ক্ষীণস্বরে বলল, ‘ এ’বি নামের পূর্ণরূপ হচ্ছে অভ্র-বর্ষা, এ ফর অভ্র, বি ফর বর্ষা আর সেই মাফিয়া গ্রুপের লিডার আর কেউ নয় স্বয়ং অভ্র ভাইয়া।

বর্ষা অবাক হয়ে মুরাদের দিকে দৃষ্টি সংযত করল তারপর বড়সড় একটা ঢোক গিলে বলল, ” কি?”

মুরাদ গলা ঝেড়ে বলল, ‘ হুম! ‘

অভ্র ভাইয়ার ভালো কাজগুলোর জন্য লোকে তাকে না দেখেই তার জন্য শুভ কামনা করতো। তার ভালো কাজের জন্য আড়ালে থেকেই সে লোকেদের ভালোবাসা পেয়েছিল প্রচুর। কিন্তু এমনও লোকজন ছিল যারা মোটেও অভ্রর কাজগুলো পছন্দ করতো না। অভ্রর কাজগুলো তাদের ইলিগাল কাজগুলোতে বাঁধা সৃষ্টি করতে লাগল। একে একে অনেকে অভ্রর শত্রু হতে লাগল। সকল চেনা শত্রুর মধ্যে উদয় হল এক অচেনা শত্রু যার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ অভ্র ও এ’বি গ্রুপের সকল টিম মেম্বার। হাজারও চেষ্টা করে আমরা কেউই তার আসল পরিচয় জানতে পারিনি। তার সাথে অভ্রর শত্রুতা ছিল পার্সোনাল।

তুই চলে যাওয়ার পর অভ্র ভাইয়া পুরো পুরি ভেঙে পরেছিল। সে তোকে খোঁজার জন্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ছিল কিন্তু মাঝপথ থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসে। অভ্র চাইলে একদিনের মধ্যে তুই কোথায় আছিস সেসব ঠিকানা বের করে তোর কাছে চলে যেতে পারতো কিন্তু সে চায়নি। ”

বর্ষার চোখ ছলছল করছে জড়ানো কন্ঠে সে বলল, ‘ কিন্তু কেনো চায়নি? ’

“ কিন্তু টা হচ্ছে, অভ্রর সেই আড়ালে লুকায়িত শত্রু, সে সেদিনই অভ্রর মুখোমুখি হয় যেদিন অভ্র তোকে খুঁজতে বের হয়। অভ্র সেদিন জানতে পারে ওই শত্রু আর কেউ নয় সে হচ্ছে আদ্রিক। ”

অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় বর্ষা অস্ফুটস্বরে বলে উঠে, “ আদ্রিক? ”

মুরাদ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বলল, ” হুম! এমনভাবে অভ্র ও চমকে ছিল। সেদিন অভ্র জানতে পারে আদ্রিকের আমাদের জীবনে আসার আসল কারণ, সেটা হচ্ছে তোর ক্ষতি করা! আদ্রিক হচ্ছে আহানার ভাই, এই সেই আহানা যে অভ্রকে ভালোবাসতো কলেজ লাইফে, অভ্র তাকে পাত্তা দিতো না বলে একদিন সে ঘরে ফ্যানের সাথে ওড়না বেঁধে সুইসাইড করে। এবং মরার আগে আদ্রিকের নাম্বারে একটা মেসেজ দেয় সেটা ছিল এমন, তার মৃত্যুর জন্য শুধু মাত্র অভ্র দ্বায়ী কারণ অভ্রর অবহেলা সে আর সহ্য করতে পারছিল না। ”

ওই মেসেজ টা পাওয়ার পর থেকে আদ্রিকের মেইন টার্গেট হয় অভ্রকে শেষ করা। কিন্তু কোনো বারই সে সফল হতে পারেনি। কোনো ভাবে আদ্রিক জানতে পারে অভ্র তোকে ভালোবাসে, তারপরই আমাদের কলেজের সে অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর স্যারের ছেলে সেজে আসে। আসলে আদ্রিক স্যারের ছেলেকে কিডনেপ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। স্যারকে ব্লাকমেইল করে তারপর সে স্যারের ছেলে সেজে আসে যাতে তোর ক্ষতি করতে পারে। কারণ তোর কিছু হলে অভ্র নিজেকে সামলাতে পারতো না সে সুযোগে আদ্রিক তার ক্ষতি করতো কিন্তু সে তার প্লান মাফিক কাজ কখনো করতে পারেনি। কারণ অভ্র ভাইয়া বেশিরভাগ সময় তোর সাথেই থাকতো। আদ্রিকের সাথে তোর জেনো বিয়ে না হয় সেজন্য আদ্রিককে প্লান করে কিডনেপ অভ্র ভাইয়াই করিয়েছিল।

কোনো কিছু বলার পরিস্থিতিতে নেই বর্ষা অনবরত হাত পা কাঁপছে তার৷

আহানার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই আসে আদ্রিক। সে তোকে বলেছিল সে তোকে ভালোবাসে, কিন্তু সবটাই ছিল তার মিথ্যে, আদ্রিক সর্বদা ওতপেতে থাকতো কখন তোর ক্ষতি করতে পারবে। আদ্রিক অভ্রকে বলে, তার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্য সে সব করতে পারবে। তুই চলে যাওয়ার পর আদ্রিক তোকে পুরো গাজীপুর হন্ন হয়ে খুঁজেছিল শুধু তোকে মারবে বলে। কিন্তু সে জানতেই পারেনি তুই কোথায়? আদ্রিক আরও বলে, আদ্রিক তোকে আর তোদের পরিবারের যে কাউকে যেকোনো সময় মারবে তোদের কারো কোনো ক্ষতি না করা অব্ধি সে থামবে না। অভ্র বুঝতে পারে তোকে সেদিন খুঁজতে গেলেই পরিবারের যেকারো ক্ষতি করে ফেলবে আদ্রিক। আর তোকে খুঁজে বের করলে সে তোরও ক্ষতি করবে। অভ্র নিজের জন্য তোদের কারো কোনো ক্ষতি হতে দিতে চায়না বৈকি সেদিন বলে, তোমার শত্রুতা আমার সাথে, আমার পরিবারের কারো কোনো ক্ষতি কোরো না। কিন্তু সেদিন আদ্রিক পিস্তলের মাথা কপালের সাথে ঠেকিয়ে অট্ট হাসিতে মেতে উঠেছিল। অভ্র খুব ভালো করেই বুঝতে পারে আদ্রিক তখন কি করতে চাচ্ছিল। চোখের পলকে আদ্রিকের পিস্তল থেকে একটা গুলি বেরিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসে।

অভ্রর বুকে গুলিটা লাগতেই ছিটকে গিয়ে পরে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পরে রয়। রক্তে তার পুরো দেহ চিপচিপে হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ডাক্তার সায়েদ। তিনি অভ্রকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। সম্পূর্ণ একদিন পর আমরা অভ্রর খবর পাই, অভ্রর অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল থাকায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ডাক্তার আশা ছেড়েই দিয়ে ছিলেন। তারা বলেন অভ্র আর কিছুদিনের অতিথি যে কোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমাদের বলে, সব পরিস্থিতি ফেস করার জন্য প্রস্তুত হতে।
আমরাও ভেঙে পরেছিলাম ভেবেই নিয়েছিলাম ভাই আর আমাদের মাঝে ফিরবে না। কিন্তু বলে না, আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব, যখন আমরা তোদের পরিবারে কল দিয়ে খবর জানাবো ভাবলাম তখন ডাক্তার এসে বলেন, অভ্র কোমা থেকে বাহিরে এসেছে আর আগের থেকে ভালো আছে। মাস খানেকের মতো বেড রেস্টে রাখতে হবে।

দুইমাস পর আমাদের সকলের জোরাজোরি করাতে অভ্র ভাইয়া আমাদের সব সত্যি কথা খুলে বলেন। উনি এটাও বলেন, যে সে জানতো না আহানা আর নেই।

অভ্র ভাইয়ার তোর সাথে কনটাক্ট না করার মূল কারণ এটাই বর্ষা। সে তোকে কখনো ঠকায়নি সে আজও তোকে প্রচুর ভালোবাসে যা তুই কল্পনা করতেও পারছিস না। তোরা যাতে ভালো থাকিস তার জন্য আদ্রিকের সাথে অভ্র ভাইয়ার একটা ডিল হয়েছে, সেটা হচ্ছে শুধু ওদের দু’জনের মধ্যে লাস্ট একটা লড়াই হবে সেটাই ঠিক করবে তাদের দু’জনের ভাগ্য, আদ্রিক লড়াইতে অভ্রকে মারতে চাইবে। আর অভ্র লড়াই করবে তোদের সেভ করার জন্যে, কাল রাতে সে তোকে শেষ বারের মতো দেখতে আসছিল বর্ষা। এটাই ছিল তার শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর আগে একবার তোকে দেখতে পাওয়া। অভ্র ভাইয়া শুধু তোকেই ভালোবাসে অন্য কোনো মেয়ের তার জীবনে কোনো জায়গা নেই বর্ষা। এতগুলো বছর তুই শুধু তাকে ভুল বুঝেই কাটিয়ে দিলি। এখন চাইলেও সে ভুল আর সংসদন করতে পারবি৷ খুব বেশি দেরি করে ফেলেছিস, ফিরে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস বর্ষা। তুই তোর জীবনের সব থেকে মজবুত লাঠিটাকে হারিয়ে ফেলেছিস।

কান্নায় ভেঙে পরে বর্ষা হাঁটু ভাজ করে মাটিতে বসে পরে। আশেপাশের লোকেরা বর্ষার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বর্ষা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ ও শুধু আমাকে ভালোবাসে। আর আমি কিভাবে পারলাম ওর উপর বিশ্বাস না করতে? কত কথা শুনিয়েছি আমি ওকে, বুকের দাবানলে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো সে আর আমি তার কষ্ট বিন্দুমাত্র ও কমাতে পারিনি। যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছিল তখন আমি মলম হয়ে সে যন্ত্রণা কমাতে পারিনি উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছি। কেনো আমি বিশ্বাস করলাম না আমার অভ্রকে? ‘

মুরাদ বর্ষার কাঁধের উপর হাত রাখলো, বর্ষা মুরাদের হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘ তুই জানিস ওই বিয়ের দিন স্টেজে যখন আমি একা বসে ছিলাম তখন আদ্রিক এসেছিল আমার কাছে সেই আমাকে বলেছিল, অভ্র আমাকে ছেড়ে হিয়ার কাছে চলে গেছে। আমিও বোকার মতো ওর কথা বিশ্বাস করে নিয়ে ছিলাম। ’

মুরাদ বর্ষার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে যাবে তখন দেখল ওদের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে নিভ। দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ঘনঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেলে পরক্ষণে বলল, ‘ মুরাদ, অভ্র ভাইয়া চলে গেছে। ‘

মুরাদ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো আর বলল, ‘ চলে গেছে মানে? ‘

‘ আদ্রিকের সাথে অভ্র ভাইয়া কাল রাতে লাস্ট কথা হয়েছে আর আজ তাদের দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ হবে। কাউকে কিছু না বলেই সে চলে গেছে। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে নিভ বর্ষার দিকে তাকালো বর্ষা কে কাঁদতে দেখে সে অনুমান করে নেয়, যে সে কেনো কাঁদছে। মুরাদের উদ্দেশ্য গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘ অভ্র ভাইয়া বলেছিল বর্ষাকে কিছু না জানাতে!’

মুরাদ নিভ এর কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, ‘ বর্ষার অধিকার আছে অভ্র ভাইয়ার সব সত্য জানার কারণ, বর্ষা অভ্র ভাইয়ার বউ। ‘

বউ কথাটা শুনে চমকে যায় নিভ তবে এটাই সত্যি।

জঙ্গলের এক পুরানো বাড়ির সামনে আদ্রিক ও অভ্র দু’জন দু’জনকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। শরীরের বহু জায়গা কেটে চুইচুই করে রক্ত জড়ছে।

বর্ষা কর্কশকন্ঠে বলল, ‘ আমার থেকে অনেক কিছু লুকিয়েছে অভ্র সত্য লুকিয়ে অন্ধকারে রেখেছে আমায়। সে নির্দোষ হওয়া সত্বেও আমি তাকে ভুল বুঝেছি। অভ্রর কপালে যদি মৃত্যু থাকে তাহলে সে যাত্রায় সঙ্গী হবো আমি৷ একসাথে বাঁচতে না পারি মরতে তো পারবো। ‘

বলেই বর্ষা হুট করে মুরাদের হাত ধরলো পরক্ষণে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘ অভ্র কোথায় গেছে তোরা নিশ্চয় জানিস। আমাকে প্লিজ ওর কাছে নিয়ে চল। ‘

মুরাদ উপর নিচ মাথা নাড়ালো পরক্ষণেই তিনজনে ভূ দৌঁড়ে ছুটতে লাগলো গাড়ির দিকে।
.
.
.
রক্তাক্ত অবস্থায় হাঁটু গেঁড়ে আদ্রিকের সামনে বসে আছে অভ্র। বিশ পঁচিশ হাত দূরে অভ্রর দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিক।

গাড়ি থেকে নেমে এ-দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় তিনজনে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে ভালোবাসার মানুষকে চিরতরে হারানোর কষ্ট বোধহয় খুব বেশিই মর্মান্তিক হয়। অভ্রর মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে শরীরের কোনো অংশই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। রক্তে চিপচিপে হয়ে আছে পুরো শরীর।

বর্ষা গাড়ির ধারে স্থির আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না খিঁচে দিলো দৌঁড়। অভ্রর সামনে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে দুইহাতে অভ্রকে জড়িয়ে ধরল। ঠিক সেই সময়ে গুলি চালালো আদ্রিক। মূহুর্তেই গুলিটা বর্ষার পিঠে ঢুকে গেলো মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠে, ‘ অভ্র? ‘

স্তব্ধ হয়ে আছে অভ্র কোনো কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না বর্ষা এখানে আসলো কিভাবে?

বর্ষার গায়ে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মুরাদ ও নিভ দু’জনে ওদের কোমড় থেকে পিস্তল বের করে আদ্রিককে শুট করলো। দু’জনের পিস্তলে যতগুলো গুলি ছিল সবগুলো গুলি আদ্রিকের চিবুক ঝাঁঝড়া করে দিয়েছে। নিমিষেই আদ্রিকের আত্মাটা বেরিয়ে তার নিস্তেজ দেহ মাটিতে পরে যায়।

অভ্র বর্ষাকে নিজের কোলে শুইয়ে ক্ষীণকন্ঠে বলতে লাগল, ‘ তুমি এখানে কেনো আসতে গেলে? কেনোই বা আমার দিকে ধেয়ে আসা গুলি তুমি নিজের বুকে নিলে? তুমি চিন্তা করো না বর্ষা আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। ‘

বলে অভ্র বর্ষাকে পাঁজাকোলে নিতে যাবে তখন অভ্রকে থামিয়ে দিয়ে বর্ষা নির্মূলকন্ঠে বলল, ‘ মিথ্যে বলছো তুমি আবারও মিথ্যে বলছো। কেনো এতগুলো বছর নিজের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছো। একটা বার সত্যি গুলো কি আমাকে বলা যেতো না? ভালো কি তুমি একাই বেসে ছিলে আমি বাসিনি? আমাদের ভালোর জন্য নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলে অভ্র? একটাবারও ভাবোনি তুমি ছাড়া আমি মরুভূমি। একবার সাহস করে সত্যটা আমাকে বললে আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে কোথাও যেতাম না। ’

অভ্র বর্ষাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ তুমি কোনো কথা বলো না। তোমার এখন ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। ‘

বর্ষা অভ্রর হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘ এভাবে কথা কেনো বলছো? আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছি বলে? কিন্তু তুমিও তো আমাকে কষ্ট দিয়েছো। তখন আমার কিছু করার ছিল না অভ্র আমি যে পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। আমি তোমার সাথে বাঁচতে না পারলাম, মরতে তো পারবো। অভ্র শুনো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্লিজ এমন কিছু বলো যেটা আমার যন্ত্রণা কমাতে পারবে। ‘

অভ্র আমতাআমতা করে বলল, ‘ কি শুনতে চাও বলো। ‘

বর্ষা অভ্রর হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘ বলো তুমি শুধু আমাকেই পছন্দ করো। ‘

অভ্রর চোখের কার্নিশ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো সে বর্ষাকে তুলে তার আষ্টেপৃষ্টের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আমি ভালোবাসি তোমাকে। ’

বর্ষা শব্দ করে কান্না করে দিয়ে বলে, ‘ আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে কথা দাও অভ্র আজ থেকে তুমি যেখানে যাবে আমার হাত শক্ত করে ধরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। সেটা হোক ইহকাল বা পরকাল। আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখবে! আমার শেষ সময়েও তুমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখবে, কখনো আমার হাত ছাড়বে না কথা দাও। ’ বলল বর্ষা।

বর্ষার একহাত মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে অভ্র শানিতকন্ঠে বলল, ‘ কথা দিলাম। ‘

ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বর্ষা বলল, ‘ খুব ভালোবাসি আমি আমার চিঠিবাজটাকে। ‘

বলেই বর্ষা তার হাত পা ছেড়ে দেয়। অভ্রর কাঁধের উপর থেকে বর্ষার মাথা সরে যায়। বর্ষার দেহ টাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে কান্না করে দেয় অভ্র। তারপর দু’জনের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পরে।

দূর থেকে আদ্রিক আর নিভ ওদের দু’জনের দিকেই দৌঁড়ে আসছে। এখনো বর্ষা’র হাত অভ্র’র হাতের মধ্যেই মুঠি বদ্ধ।
#অবন্তর_আসক্তি
#সারপ্রাইজ_পর্ব
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে। যদিও এখন বর্ষাকাল নয় কিন্তু তবুও বাংলাদেশে আজকাল আর ঋতুভেদ বলে কিছুই হয়না।

হাসপাতালের এক কেবিনে অভ্র সেন্সলেস হয়ে শুয়ে আছে। আদ্রিকের দেওয়া আঘাতের ফলে অভ্র সেন্সলেস হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর অভ্রর ট্রিটমেন্ট চলে সে সুস্থ আছে কিন্তু এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

অন্য দিকে বর্ষার অপারেশন চলছে, আইসিইউর সামনে বাড়ির প্রতিটা মানুষ দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কয়েকজন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, কান্নাকাটি না করতে। এখানে কান্না করে চোখের জল নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। বরংচ লাভ আছে আল্লাহকে ডাকা এই বিপদের মূহুর্তে একমাত্র সাহায্য করতে পারবেন যিনি তিনিই হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা।

নিভ আর মুরাদ বর্ষাভ্রকে ধরাধরি করে গাড়িতে উঠায় সেখান থেকে কাছেপিঠে কোনো এক হাসপাতালে নিয়ে আসে। মুরাদ কল দিয়ে সকলকে ইনফর্ম করে দেয় তারাও হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরেন। বর্ষাকে আইসিইউতে ঢোকানোর পর থেকেই মুসুল দ্বারায় বৃষ্টি হচ্ছে। অভ্রকে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারপর তাকে কেবিনে শিফট করে দেয়। বাড়ির সকলের কাছ থেকে লুকানোর মতো অবশিষ্টাংশ এখন আর কিছুই নেই! বাধ্য হয়ে মুরাদ সমস্ত কিছু তাদের কাছে পূণরায় আবৃত্তি করেন। সব কিছু জানার পর তারা নিজেদেরও দোষী মানতে লাগেন। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে তাদের। অভ্রর সাথে কেবিনে দেখা করতে যায়। ঘুমন্ত অভ্রর চুলে হাত বুলিয়ে তার সাথে করা অন্যয়ের জন্য ক্ষমা চায়।

আইসিইউ থেকে ডাক্তার বের হয়ে আসলেন এবং সকলের উদ্দেশ্য বললেন, “ টেনশনের কিছু নেই, আমরা গুলি বের করতে সক্ষম হয়েছি! ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেসেন্ট কে কেবিনে শিফট করা হবে। তখন আপনারা তার সাথে দেখা করতে পারবেন। তবে পেসেন্টের জ্ঞান ফিরতে কয়েক ঘন্টাও লাগতে পারে আবারও কয়েক দিনও লাগতে পারে। ” বলে ডাক্তার চলে গেলেন।

দু’ঘন্টা পর অভ্রর জ্ঞান ফিরে আসে, অভ্রকে দেখে তার মা কান্না জুড়ে দেয়। দুইহাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগেন। সকলের কাছ থেকে অভ্র ক্ষমা চায়। তারাও অভ্রর কাছ থেকে ক্ষমা চায়।

খানিক সুস্থ অনুভব করার পর, অভ্র বর্ষার সাথে দেখা করতে আসে, এদিকে বর্ষার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

অভ্র নিজেও অসুস্থ হওয়ায় ডাক্তার তাকে রেস্ট করার জন্য তার কেবিনে যেতে বলেন। অভ্রকে এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে অবশ্য যেতে চায়নি।

মুরাদের নাম্বারে একটা কল আসে, কল রিসিভ করতে নিঝুম রাগান্বিত কন্ঠে বলে, ‘ বর্ষা সেই সকালে তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল এখনো আসেনি। তুই জানিস ও কোথায়? ‘

ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মুরাদ বর্ষার গুলি লাগার কথা বলল এবং তাকে বলল হাসপাতালে চলে আসতে। নিঝুম আর কোনো কথা না বলে কল কেটে দেয়। প্রিয়মকে তার নানির কাছে রেখে অর্ণবকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে।

বর্ষাভ্রর পরিবার ও বাকিরা বর্ষার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র কেবিনের ভেতরে গিয়েছে একান্ত বর্ষার সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য, বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে অভ্র বলছে, ‘নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসো তাহলে এতগুলো বছর দূরে কিভাবে ছিলে হুহহ বলো রাগরাগিণী? এখনও কি অভিমানে চোখ বুঝে থাকবে?’

হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সোজা রিসিপশনে চলে যায় নিঝুম৷ বর্ষা নামের পেসেন্ট কত নাম্বার কেবিনে আছে জিজ্ঞেস করে। রিসিপশনে একটা মেয়ে বসেছিল সে কিছু একটা দেখে বলল, ‘ ম্যাম ১০২ নাম্বার কেবিনে! ‘

‘ থ্যাঙ্কিউ! ’ বলে অর্ণবের হাত ধরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিঝুম।

কিয়ৎক্ষণ পর,

অর্ণবকে নিয়ে নিঝুম সকলের সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্ণব দেখতে ছোট্ট রাজকুমারের মতো ফুটফুটে সুন্দর, উপস্থিত সকলের দৃষ্টি স্থির তার উপর আকর্ষিত লাগছে অর্ণবকে তাদের কাছে। কষ্টের মধ্যেও অর্ণবের মুখটা দেখে সকলের মুখে এক তৃপ্তিময় হাসির রেখা ফুটে উঠে।

আহিতা ও মুরাদ নিঝুমের উদ্দেশ্য বলে, ‘ শুনেছিলান তোর মেয়ে হয়েছে কিন্তু ওকে তো দেখতে ছেলেদের মতো লাগছে। ’

ভ্রুযুগল কুঁচকে অপূর্ব অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছে। সে সকলের থেকে কিছুটা দূরে ও একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ণবের কাছে হেঁটে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসলো৷ চুলগুলো তে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ ও নিঝুমের বাচ্চা কিভাবে হতে পারে? ওকে তো দেখতে পুরোপুরি অভ্রর মতো লাগছে, দেখে মনে হচ্ছে অভ্র’রই ছেলে! ”

অপূর্বর কথায় সকলে কড়া দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো তাদের ও মনে হলো সত্যিই তো তাই অর্ণবের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তারা সেদিকে লক্ষ্যই করেনি।

মুন্নি পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো, অর্ণব এখানে উপস্থিত কাউকেই চিনে না শুধু মুন্নি আর নিঝুম ব্যতিত। মুন্নিকে দেখা মাত্রই অর্ণব ধীর কন্ঠে চেচিয়ে বলল, “ খালামনি! ”

বলে ছুট্টে গিয়ে মুন্নিকে জড়িয়ে ধরলো। সকলে হতবুদ্ধি হয়ে মুন্নির দিকে তাকালো ভ্রুযুগল কুঁচকে বলে উঠল, ‘খালামনি?’

মুন্নি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাদের সকলের দিকে তাকালো জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া হালকা ভিজিয়ে বলল, “ তোমরা সবাই ঠিক ভাবছো! ওর নাম অর্ণব আর আমি ওর সেজো খালামনি! অর্ণব বাহিরের কেউ নয়, ও তোমাদের নিজের রক্ত। অর্ণবের বাবা মা আর কেউ নয় বর্ষা-অভ্র। অর্ণব বর্ষা আর অভ্রর ছেলে। ”

মুন্নির কথায় সকলে অবাক হয়। মুন্নি তাদেরকে বর্ষা ও অভ্রর বিয়ের কথা বলে, তাদের ওই রাতে গ্রামের লোকের জোর করে বিয়ে দিয়েছিল এবং তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। তিন্নি সেও পিছিয়ে থাকেনি তিন্নিও বলে সবকিছু অভ্র কতটা পাগলামি করেছিল বর্ষার জন্য।

মুন্নি আরও বলে, ‘ বর্ষার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার, এবং না ফিরে আসার একমাত্র কারণ অর্ণব! ও চায়নি তোমরা অর্ণবের সম্পর্কে জানো। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, ও ভেবেছিল ও প্রেগন্যান্ট জানলে তোমরা ওর বাচ্চা টাকে নষ্ট করে ফেলবে সে ভয়েই তোমাদের থেকে দূরে গিয়ে ও সন্তান জন্ম দেয়৷ কোনো ভাবেই নিজের সন্তানের ক্ষতি সে চায়নি। মা তো কিভাবে নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? আমি ওর বড় বোন, আমি মনপুড়া যাওয়ার আগের দিন রাতে আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল বর্ষা। আর মিনতি করেছিল ওকে জেনো আমার সাথে নিয়ে যাই। আর ওর বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসতে জেনো সাহায্য করি। আমি ওর কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি তাই ওকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যাই। ’

সবকিছু শোনে সকলের চোখে পানি চলে আসে। তারপর মুন্নি অর্ণবকে তার নানা-নানি, দাদা-দাদি ও পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারাও ইমোশনাল হয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু খায়। এত বছর পর পরিবার পেয়ে অর্ণবও খুশিতে ডগমগ করছে। সে তো জানতোই না তার এতবড় একটা পরিবার আছে।

অর্ণব ক্ষীণকন্ঠে বলল, “ আমার আম্মু কোথায়? আমি আমার আম্মুর কাছে যাবো। ”

অর্ণবকে মুন্নি কেবিনের দরজা হাল্কা খোলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়৷ সাদা চাদরের বেডের উপর বর্ষাকে শুয়ে থাকতে দেখে অর্ণব তার দিকে দৌঁড়ে যায়। অভ্র অর্ণবকে আসতে দেখে একহাত তার সামনে তুলে ধরে অর্ণবের উপর দৃষ্টি সংযত রেখে বলল, ‘ কে তুমি এখানে কি করছো? ’

অর্ণব নির্মূলকন্ঠে বলল, “অর্ণব আহমেদ!”

ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অভ্র বলল, “কে অর্ণব আহমেদ? ”

অর্ণব একহাত তার মায়ের দিকে তাক করলো অর্থাৎ বর্ষার দিকে, অর্ণবের হাতের ইশারা লক্ষ্য করে অভ্র বর্ষার দিকে এক পলক তাকালো পরক্ষণে আবারও অর্ণবের দিকে তাকালো।

অর্ণব বর্ষার দিক থেকে হাত সরিয়ে নিজের বুকের উপর রেখে বলল, ‘ আমি আমার মা’য়ের ছেলে। ”

হতবিহ্বল চোখে অভ্র অর্ণবের দিকে তাকায়। শাহাদাত আঙুল বর্ষার দিকে তাক করে সে অস্ফুটস্বরে বলে, ‘ ও তোমার মা? ‘

অর্ণব উপর নিচ মাথা নাড়ায়। অভ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে। অভ্র যে অবাক হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই অর্ণবের। এক’পা দু’পা এগিয়ে আসে অভ্রর দিকে আর সন্দিহান কন্ঠে বলে, “ আপনি অনেক সুন্দর! আপনাকে দেখতে অনেকটা আমার মতো, আপনি কে আঙ্কেল? ”

অভ্র একহাত বাড়িয়ে দিলো অর্ণবের দিকে, চোখের পাপড়ি দুইবার পলক ফেলে বলল, ‘ এদিকে আসো! ‘

অর্ণব অভ্রর কাছে আসে তারপর অভ্র অর্ণবকে কোলে তুলে নেয়৷ দুইহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অর্ণব সে-ও অভ্রর বুকের মধ্যে চুপটি করে রয়েছে।

কিয়ৎক্ষণ পর অভ্র অর্ণবকে নিজের সামনে বসালো, অর্ণবের দুইগালের উপর অভ্র তার হাত রেখে বলল, “ অর্ণব আমি তোমার বাবা! ”

অর্ণব যে তার বাবার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এক পিপাসকের মতো ফটফট করতো। আজ সে তার বাবার কোলে বসে আছে। অস্ফুটস্বরে ‘বাবা’ বলে কান্না করে দেয় অর্ণব।

বর্ষার একহাত শক্ত করে ধরে অভ্র ও অন্য হাত দিয়ে ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। এত বছর ধরে সে জানতোই না তার একটা ছেলে আছে আর সে এত বড় ও হয়েগেছে। এত বছর পর ছেলে তার বাবাকে পেলো আর বাবা তার ছেলেকে পেলো, বলে বুঝানো যাবে না এই মূহুর্ত কতটা মধুর।
.
.
.
বাতাসের সাথে কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে জোড়ে পরছে লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল।

সামনেই অর্ণব খেলা করছে অন্য বাচ্চাদের সাথে, গাছের নিচে হাতে হাত রেখে বসে আছে বর্ষাভ্র।

অভ্র বর্ষার হাত শক্ত করে ধরে ঠোঁটের সামনে আনলো হাতের উল্টো পিঠে আলতো করে এক চুমু দিয়ে বলল, “ভালোবেসে ধরেছি এই হাত! ভালোবেসে সারাজীবন ধরে রাখবো। কথা দিচ্ছি যতই বিপদ আপদ আসুক না কেনো, এই বর্ষাভ্রর অভ্র কখনো তার রাগরাগিণীকে ছেড়ে যাবে না। ”

বর্ষা অভ্রর হাতের উপর তার অন্য হাতটি রেখে বলল, “ কথা দিচ্ছি, আমিও আর কখনো তোমাকে ভুল বুঝবো না।”

তখনই অর্ণব “আম্মু-আব্বু” বলে জোরে জোরে চিৎকার করে এগিয়ে আসতে লাগল, বর্ষা ও অভ্রর মাঝখানে এসে বসলো অর্ণব। দুজনের হাতের উপর নিজের ছোট্ট ছোট্ট হাতটি রেখে বলল, “ আমার আব্বু আম্মু আর আমি আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি! ”

বলে ফিক করে হেসে ফেললো অর্ণব সে সাথে সাথে বর্ষা ও অভ্র দুইপাশ থেকে অর্ণবের গালে চুমু একে দিলো। অর্ণব দুইহাতে তার মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আজ ওরা তিনজনেই খুব খুশি। জীবনের সব বাধা প্রতিকুলতা পার করে নিজেদের মতো করে ভালোবাসাময় জীবনে সম্পূর্ণ ভালোবাসাতে পূর্ণ ওরা।

#সমাপ্ত 🌸
🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here