“যেদিন আমার বিয়ে হয় ঐ দিন রাতেই আমি ওনাকে বলে দিই যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’ উনি চুপ করে সোফায় বসে পড়েছিল। একটি বারও এসে বিছানায় আমার পাশে বসে নি। এক বার জিজ্ঞেসও করেনি, তবে কেন তার ঘরের বউ হয়ে আসলাম। আমিই আবার বলেছিলাম ঘুমের মাঝেও আমাকে টাচ করার চেষ্টা করবেন না। উনি মনে হয় কথাটিতে রেগে যান। উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ান, ওনার চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। হটাৎ ই উনি বিছানায় হাটু গেড়ে বসে বলতে শুরু করে
— ‘ ওই আপনি কি মনে করেছেন আমাকে,আমাকে কি মাতাল অভদ্র মনে হয়,ঘুমের মাঝেও যেন আপনাকে না স্পর্শ করি, এর মানে কি? আমি কি হিংস্র পশু যে রাতের আধারে আপনার উপরে ঝাঁপিয়ে পরব?’
তারপর আরো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকেই বের হয়ে যায়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে তাকাই, দেখি উনি নিরবে বসে আছেন। আর একটু পর পর চোখ মুছতে ব্যস্ত।
বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ভাবীর মুখে শুনেছিলাম। ‘ছেলেটা খুব ভালো অবন্তী দেখো তোমাকে অনেক আগলে রাখবে, জীবনে অনেক সুখে থাকবে।’
তখন ভাবীর কথাটা তেমন আমলে নেই নি। কিন্তু যখন ওনাকে কাঁদতে দেখি তখন ভাবতে থাকি একটা ছেলে মানুষও এভাবে কাঁদতে পারে? আমি যতটুকু জানতাম বিয়েটা ওনার মায়ের পছন্দেই হয়েছে। হয়তো ভাবছে, আমার যে ওকে পছন্দ নয় এটা যদি ওনার মা জানতে পারেন, তবে খুবই কষ্ট পাবেন। ওনার মা ক্যান্সার এর সাথে লড়ছিল কবে মারা যায় কোন ঠিক নেই। তাই সব সময় আমাকে বলতো, ‘ আমাকে আপনার পছন্দ না এটা ঠিক আছে তবে প্লিজ যত দিন আমার মা বেঁচে আছে আমার মায়ের খেয়াল রাখবেন। কখনো মায়ের অযত্ন করবেন না।’
.
উনি কথাটা এতো করুণ ভাবে বলছিল যে আমার নিজেরই কান্না পাচ্ছিল। উনার চোখেও বেদনার জল ঝলমল করছিল। চোখের পানি আড়াল করতে উনি আমার সামনে থেকে চলে যায়। আড়ালে গিয়ে চোখ মুছতে থাকেন।
.
একদিন উনি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসেন। আমি তখন আমার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ফোনে কথা বলতে ছিলাম। উনি এতো তারাতাড়ি দৌড়ে ঘরে ঢুকেন যে আমি আর ফোন টা রাখার সুযোগ পাইনি। উনি রুমে ঢুকেই আমার হাত থেকে ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে যায়।তারপর স্কৃনে কল রানিং দেখে ফোনটা এতো জোড়ে আছাড় দেন যে ডিসপ্লে গুঁড়া হয়ে যায়। তারপর প্রচুর রাগে বলতে শুরু করেন, “আপনার বাবা আপনাকে বিনে টাকায় এ বাড়িতে পাঠায় নি। দেনমোহর এর ২ লাখ টাকা দিতে হয়েছে,বিয়ের গয়না আর অন্য খরচ বাবদ প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ১০ বছরের সব জমানো ভালোবাসা আর টাকা দিয়ে তারপর আপনাকে এই বাড়িতে এনেছিলাম। এর কোন শুকরিয়া আপনি আদায় করেছেন হুম! কি চেয়েছিলাম আপনার কাছে, মোহরানার টাকা পরিশোধ করার পর আপনার উপরে আমার সম্পূর্ণ হক ছিল তবুও এক মুহুর্তের জন্য আপনাকে স্পর্শ করিনি।বিয়ে করে আনার পর এ বাড়ির ছোট বড় কাজ গুলো করাও আপনার দ্বায়িত্ব ছিল কিন্তু তাও কোন দিন আপনাকে কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম মাকে একটু দেখে রাখবেন। আর মা ১ ঘন্টা আগে তার খারাপ লাগার কথা বলেছে আমাকে ফোন দিয়ে। আমি অফিস থেকে চলে আসছি আর আপনি একটু পাশের রুমে গিয়েও দেখতে পারেন নি আমার মা কেমন আছে।আর দেখতেও হবে না আপনাকে। দেনমোহর এর অর্ধেক টাকা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাবেন এখান থেকে আপনাকে আমার প্রয়োজন নেই”।
.
.
তারপর উনি হনহন করে চলে যায়। আমি কখনো এতো কষ্ট পাইনি ওনার কথায় যতোটা কষ্ট পাই। আসলেই তো এই বাড়িতে আমার হাজার টা দ্বায়িত্ব আর আমি কিনা ওনার একটা আবদার পূরণ করতে পারলাম না! আর কি যেন বলেছিল ১০ টা বছরের জমানো ভালোবাসা। মানে কি আসলে!
.
যেদিন থেকে যৌবনে প্রদার্পন করেন তখন থেকেই যে ব্যক্তি অনাগত স্ত্রীকে ভালোবাসাতে পারেন,আমি কিনা তাকে একটি বারের জন্য ও ভালোবাসতে পারিনি! তার একটা আবদার ও পূরন করতে পারিনি। ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়ি, আমার চোখ দিয়ে তখন অবিরাম পানি ঝরছিল। সেই প্রথম আমি মন ভরে কান্না করি। হটাৎ করে মাইক্রোবাস এর দরজা টানার আওয়াজে আমার হুস ফিরে। তারাতাড়ি ঘর থেকে বের হই। দেখি উঠানে একটা মাইক্রোবাস দাড়িয়ে আছে। আর উনি আম্মা(শাশুড়ী মা) কে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। কি হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে যাই। দেখি আমার শাশুড়ীর জ্ঞান নেই। বুঝতে বাকি রইল না যে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি উনাকে কেবল “আমিও যাব” কথাটা বলেই দৌড়ে রুমে চলে আসি। তারাতাড়ি বোরকাটা পরে রুম থেকে বের হই। আম্মাকে গাড়ির পিছনের বড় সিট টাতে লম্বা করে শোয়ানো হয়েছে আর মাথাটা আমার স্বামীর উরুর(রানের) উপরে রাখা। আমি ও গাড়িতে উঠে পরি। গিয়ে ওনার পাশে বসে বলি “আপনি সামনে চলে যান আম্মার মাথাটা আমার কোলে দিন”।
উনি কোন কিছু না বলে আমার দিকে রক্ত চোখে তাকান। উনার চাওয়াতে নিষেধ স্পষ্ট। বাধ্য হয়ে আমি পিছনের সিটে গিয়ে বসে পরি। আম্মাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকানো হয়। আর উনি পুরো বারান্দা জুড়ে পায়চারি করছেন। আমি বসে থাকতে পারছিনা কেননা উনি হাটতেছেন, এই অবস্থায় যদি আমি বসে বসে আরাম করি তবে উনি হয়ত আবারও কষ্ট পাবেন। আমি এগিয়ে গিয়ে উনাকে বসতে বলি। এতে উনি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকান আমি ভয়ে আর কিছুই বলিনি। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকি। উনি কিছুক্ষন পরে লোহার লম্বা চেয়ারটাতে গিয়ে বসেন।আমিও ওনার পাশে গিয়ে বসি।
.
হাতটা এগিয়ে ওনার কাঁধে রাখতে মন চাইছে কিন্তু ভয়ে এগোতে পারছিলাম না। মন চাইছিল ওনার বুকে মাথা রেখে কতোক্ষন কান্না করি হয়তো উনি এতে কিছু টা ভরসা পাবেন, আর আমারও একটু ভালো লাগবে। কিন্তু অতটা সাহস আমার তখন নেই। তবুও কাচুমাচু করে ওনার পাশের চেয়ার টাতে গিয়ে বসি। মনে মনে ভাবতে থাকি আমার এহেন কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া অনেক জরুরি। কিন্তু হাসপাতালে তো আর পায়ে ধরে মাফ চাওয়া যায় না। আর স্বামীর কাছে স্ত্রী ক্ষমা চাইতে হলে পায়েও ধরতে হয় না। আলতো করে হাতটা ধরে দু’ফোটা চোখের জল ফেলা’ই যথেষ্ট। অথবা ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো করে স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে নিলেই হয়। হয়তো প্রথমে স্বামী, স্ত্রীর দিকে একটু গরম নজরে তাকাবে। তবে তখন স্বামীর চোখের দিকে অসহায়ের মতো তাকালেই হয়ে যায়। একটা লম্বা সময় নিতে কোন মেয়ে যদি তার প্রিয় মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে তবে সেই ছেলেটা যত রাগি হোক না কেন সে অবশ্যই গলে যাবে। অতঃপর শক্ত করে জড়িয়ে বুকের সাথে মিলিয়ে গেলেই সব শেষ।
.
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে মোটেই এমন সুযোগ ছিল না। কেননা ওনার সাথে আমার স্বামী-স্ত্রীর কোন সম্পর্কই ছিল না। কোনদিন একটু সময় নিয়ে ওনার সাথে কথাও বলিনি। তবে ভাবলাম একটু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! ওনার ডান হাতটা টেনে আমার দুই হাতের মধ্যে নিলাম। উনি কিছুই বল্লেন না। একদৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পারি চিন্তায় উনি এই বিষয়টি খেয়াল পর্যন্ত করেন নি। আমি ওনার দৃষ্টি আমার দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলাম। ওনার হাতটা শক্ত করে আমার দু’হাতের তালুর মধ্যে নিলাম। তাতেও কোন কাজ হয়নি দেখে আমি নিজেকে ওনার একদম কাছে নিয়ে গেলাম। ওনার কাঁধে মাথা রেখে ওনার বাহুটা জড়িয়ে ধরলাম। এবার উনি আমার দিকে তাকালো। আমিও ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁট গুলো বারবার বাঁকাতে লাগলাম আর ঘনঘন ঠোকর গিলতে গিলতে একটা করুণ দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি কি ভাবলো জানি না। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখের পাতা দু’টো এক করতেই কয়েকটি ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। উনি বাম হাতে চোখ মুছে নিয়ে আমার হাতের তালুর পিঠটা চেপে ধরে রাখল। আমার কাছে তখন কেমন লাগছিল সেটা আমি আজও কল্পনা করতে পারি না। কোন একটা অজানা অনুভূতি এসে গ্রাস করছিল আমাকে। ওটাই ছিল ওনার প্রথম স্পর্শ। প্রিয় মানুষটার কাছে প্রতিটা নারীই হয়তো এমন একটা স্পর্শের আশায় থাকে। তবে আমদের মধ্যে একে অপরের প্রিয় হওয়ার মতো কোন সম্পর্কই তখন নেই। তাই ঐ সব কিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল আমার। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরক্ষণেই উনি আমার কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে সামনে চলে গেলেন। আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উনি একবারের জন্যও আর আমার দিকে ফিরে তাকায়নি।
.
.
একটু পর ডাক্তার রুম থেকে গোমড়া মুখে বেড়িয়ে আসে। আমার স্বামী দৌড়ে ওনার কাছে যান। উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে থাকেন ওনার দিকে। ওনার সেই করুণ দু’চোখের দৃষ্টি আজও আমার চোখে ভেসে উঠে। অতঃপর ডাক্তার ওনার কাঁধে হাত রেখে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আস্তে আস্তে কিছু একটা বলতে থাকে। আমিও উঠে সেখানে যাই শোনার জন্য। কিন্তু ডাক্তারের যা বলল তা শোনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
( চলবে ইনশা আল্লাহ)