‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন
৫.
আজ অফিস যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে এল আশফাক। ভুলবশত খুব ইম্পর্টেন্ট একটা ফাইল ফেলে গেছে সে। সদর দরজায় সামান্য ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। অসময়ে বাড়ির দরজা এভাবে খুলে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল আশফাক। মা কি ভেতরে নেই? নাকি কেউ এসেছে? ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে দিল আশফাক। কই দরজার সামনে তো কারো জুতো দেখা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চয়ই মা আশেপাশে কোথাও গেছে। ভেবেছিল এসেছে যখন মায়ের সাথে দেখা হয়েই যাবে। কিন্তু মা যখন নেই তখন দেখা না করেই ফিরে যেতে হবে। কারণ তার হাতে খুব একটা সময় নেই আজ। যত দ্রুত সম্ভব ফাইলটা নিয়ে অফিসে পৌঁছাতে হবে তার। নীরা থাকলে এমন ভুল কক্ষনো হতো না তার। অফিসে যাবার পূর্বে ঠিক সব কিছু গুছিয়ে এনে আশফাকের হাতে তুলে দিত।
আজকাল নীরার কথা বড্ড মনে পড়ে। পরক্ষণেই নীরার দেওয়া ধোঁকার কথা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল আশফাকের। কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছিল তাকে কিন্তু পরিবর্তে কি পেল সে? ভাবতেই ঘেন্না হয়। নীরা যা করেছে তার কোনো ক্ষমা হয় না, হওয়া উচিতও না। তবুও কেন নীরাকে ভুলতে পারছে না সে? কেন নীরার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের কথা বারবার মনে পড়ে যায়? কেন বাড়ি ফিরলেই মনে হয় এই বুঝি নীরা দরজা খুলে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেবে তার দিকে? কেন প্রতিটা কাজে সে অজান্তেই নীরাকে খুঁজে বেড়ায়? বারবার কেন মনে হয় নীরা তার সাথেই আছে,তার কাছে? নীরা চলে যাবার পর শুধুমাত্র নীরাকে ভোলার জন্য সে রাতদিন কাজে ডুবে থাকে। তবুও কেন ভুলতে পারছে না নীরাকে?
হঠাৎ ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘ছিঃ আশফাক ছিঃ! এখনো তুমি সেই প্রতারকের কথাই ভাবছো? তুমি কি ভুলে গেছ সেকি করেছে? এত কিছুর পরও তুমি তাকেই নিয়েই পড়ে থাকবে? এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দেবে? কই যাওয়ার পর সে তো তোমার কাছে একটিবারের জন্যেও ফিরে আসতে চায় নি। একটা ফোন পর্যন্ত করে নি তোমাকে। তুমি কেমন আছো? কিভাবে আছো কিচ্ছু জানতে চায় নি। তবে তুমি কেন তার কথা ভেবে ভেবে মরছো? কেন নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছ? তোমার কি সামান্যতম লজ্জা, আত্মসম্মান বোধ নেই? নূন্যতম ধিক্কার আর ঘৃণা পাওয়ার যোগ্যও কি সে নয়?’
হঠাৎ এবার আশফাকের ভেতরের আরেক কঠোর সত্তা বলে উঠল,’ হ্যা ঘৃণা করি আমি নীরাকে। পৃথিবীর সব চাইতে বেশি ঘৃণা করি তাকে। আমি আর তার কথা ভাববো না। কোনোদিনও না। তাকে ভুলে বেশ থাকবো আমি। এটা আমার নিজের কাছে নিজের প্রমিস।’
এটা ঠিক যে নীরা যদি একটি বারের জন্যেও আশফাকের কাছে এসে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতো সব ভুলে আশফাক ঠিক তাকে ক্ষমা করে দিত। কোনোদিনও তাকে ডিভোর্স দিত না। হাজার হোক মায়ের পরে পৃথিবীতে এই একটা মানুষ,একটামাত্র মেয়েকেই সে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে, আর সে হল নীরা। কিন্তু কই এলো না তো? এ কয় মাসে একটা বার তার খোঁজ পর্যন্ত নেওয়ার চেষ্টা করেনি। আশফাক কিভাবে আছে? কেমন আছে? কখনও জানতে চায়নি। এমনকি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর পরও যদি নীরা তার কাছে ছুটে আসতো আশফাক তা ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র নীরাকেই কাছে টেনে নিত। কত আশা নিয়ে বসে ছিল নীরা হয়তো আসবে এই ভেবে। কিন্তু এলো না। আর আসবেই বা কি করে? সে নিশ্চয়ই এতদিনে ঠিক মিজানের সাথে সেটেল হয়ে গেছে। হয়তো ওরা একসাথে খুব সুখেই আছে।আচ্ছা মিজানের মধ্যে এমন কি ছিল যা আশফাকের মধ্যে ছিল না? এমন কি দিল মিজান যার জন্য নীরা তার সাথে এভাবে বেঈমানী করল,তাকে ঠকালো। ভাবতেই রাগে আশফাকের মাথার রগ ছিঁড়ে যাবার উপক্রম।
নীরাকে নিয়ে মনের গভীর এত চিন্তা ভাবনার জন্য নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল আশফাক। অবশেষে নীরাকে নিয়ে সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁড়ে ফেলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় মায়ের ঘর অতিক্রম করতেই হাসাহাসির শব্দ শুনে থমকালো আশফাক। এই অসময়ে আবার কে এল? কৌতূহলবশত এগিয়ে গেল মায়ের ঘরের দিকে। মায়ের ঘরের দরজাটা সামান্য ভিড়ানো। ভেতর থেকে শুধুমাত্র মায়ের আট্টাহাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আশফাক ডিস্টার্ব করবে না ভেবে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই হঠাৎই একটা নাম শুনে থমকে গেল।
‘মিজান তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাবা। অনেক বড় একটা উপকার করলে। তুমি না থাকলে তো ঐ ফকিন্নির বেটিকে আমার বাড়ি থেকে বেরই করতে পারতাম না।’ রাহেলা বেগমের গলায় খুশি উঁপচে পড়ছে।
চমকে উঠল আশফাক। তার মা কোন মিজানের সাথে কথা বলছে? আর কাকেই বা ফকিন্নির বেটি বলছে? স্বভাব বিরোধী হওয়া সত্বেও আজ কেন জানি আড়ি না পেতে পারলো না আশফাক। কান খাড়া করে মায়ের সমস্ত কথা শোনার সর্বচ্চ চেষ্টা করল। ফোনের ওপর পাশ থেকে কি বলল তা অবশ্য শুনতে পাওয়া গেল না । হঠাৎ আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন রাহেলা বেগম। হাসতে হাসতে বললেন,’না না তা তো অবশ্যই। ফকিন্নির বেটির সাহস কত আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। ভাগ্যিস সেদিন আদর দেখিয়ে তাকে নিজের হাতে শরবত বানিয়ে খাইয়ে ছিলাম। আর সেই শরবতে বেশ কয়েকটা ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ঔষুধ মেশানো শরবত খেয়ে নীরা ঘুমিয়ে পড়তেই সুযোগ বুঝে খুব সাবধানে আশফাক আসার কিছুক্ষণ আগে চুপিচুপি তোমাকে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম। আমি তো জানতাম সেদিন আশফাকের অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। আশফাকের সেক্রেটারিই তো আমাকে সে খবরটা দিল।
তোমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে আমি বাহিরেই অপেক্ষা করছিলাম আশফাকের জন্য। তোমাকে ঢোকানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আশফাক এসে হাজির হল।আশফাক আসলে আমি এমন ভাব করলাম যেন সদ্য হাটাহাটি করে এসেছি। ওর সাথে কুশলাদি বিনিময়ের উছিলায় এমনভাবে ওর ঘরের ভেতর এগিয়ে এলাম যেন আমি কিছুই জানিই না। দরজা খোলার পর তোমাদের ওভাবে দেখে আমার ছেলে মুখটা একদম রক্তশূন্য হয়ে গেল। আর তুমি যা এ্যাকটিং করলে না।’ বলেই হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লেন রাহেলা বেগম।
সব শুনে আশফাকের পুরো পৃথিবীটা যেন টলে উঠল। পায়ের নিচে প্রবল ভূমিকম্প অনুভব করল। এসব সে কি শুনছে? তার মা…! না না এ হতে পারে না। মা কোনোভাবেই এমনটা করতে পারে না। নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই সে ভুল শুনছে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগল আশফাক।
কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে রাহেলা বললেন,
‘আমি সত্যি ভাবিনি আমাদর ছেলেটা তার গুনধর বৌকে ছেড়ে তোমার ওপর হামলা চালাবে। আর তুমিও এত মার খেয়েও কি নিখুঁত অভিনয়টাই না করে গেলে। আরেকটু হলে তো আমার ছেলেটা তোমাকে বোধহয় মেরেই ফেলতো। ভাগ্যিস আমি গিয়ে ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলাম। আর ওকে নানা ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দু-মাসের মাথায় ঐ নীরাকে ডিভোর্স দেওয়ালাম।’
নাহ,এ কোনো স্বপ্ন নয় সে যা শুনছে সব ঠিকই শুনছে। এসব অপকর্মের পেছনে তার মায়ের হাত। আর নীরা..! তার নীরা সম্পূর্ণ নির্দোষ! পৃথিবীতে যাকে সে সব থেকে বেশি বিশ্বাস করে সেই মা’ই কিনা মেইন কালপিট! মা এমনই একজন মানুষ যাকে আশফাক মরে গেলেও অবিশ্বাস করতে পারবে না। সেই মানুষটাই কিনা তাকে এভাবে ঠকালো? আর নীরা! তাকে কত অবিশ্বাস করেছিল সে। একটিবারও তার কোনো কথা শুনতে চায় নি। উল্টো তাকে অবিশ্বাস করে, অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল যার কিনা এখানো কোনো দোষই ছিল না। নিজের সন্তানকে পর্যন্ত অস্বীকার করতে ছাড়ে নি সে। আর আজ…!
আশফাক খুব করে চাইছে, মাটি ফেটে দু’ভাগ হয়ে যাক যেন সে তাতে লুকিয়ে পড়তে পারে। এই সব মিথ্যে হয়ে যাক। আশফাক মনে মনে খুব করে প্রার্থনা করতে লাগল, এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন হয় যার রেশ ঘুম ভাঙলেই কেটে যাবে। কিন্তু না এমন কিছুই ঘটলো না। একসময় আশফাক উপলব্ধি করতে পারল এই সব বাস্তব। সব সত্যি। আর কষ্ট হলেও এই নির্মম সত্যিটা তাকে মেনে নিতেই হবে।
রাহেলা বেগম কানে ফোন ঠেকিয়ে আছেন।
অপরপাশ থেকে কি বলছে তা ঠিক শোনা গেল না। ওপাশে কথা বলা শেষ হলে রাহেলা বেগম এবার আফসোসের গলায় বলতে শুরু করলেন,’আর বলো না, এত কিছুর পরও ছেলে আমার ঐ মেয়েকে ডিবোর্স দিতে নারাজ। আমার ভাবতে অবাক লাগে মাকে ছেড়ে কোনো ছেলে একটা দু’দিনের মেয়েকে কিভাবে এতটা ভালোবাসতে পারে? যাক বাবা অবশেষে যে ডিবোর্স দেওয়াতে পেরেছি এই অনেক। আপদ বিদায় হয়েছে। আমার ছেলেকেও আমি ফিরে পেয়েছি আর তুমিও তোমার চড়ের বদলা নিতে পেরেছ। এখন আমাদের রাস্তা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার।’
ওপাশ থেকে মিজান আবার কিছু বলতেই রাহেলা বেগম চাপা চিৎকার করে উঠলেন,’বলছো কি? রাজি হয়নি? এত কিছুর পরও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি?’
ওপর পাশ থেকে কিছু একটা শুনতেই রাহেলা বেগম এবার গর্জে উঠলেন,’কি বললে? ফকিন্নির বেটি বলে কি! ডিবোর্সের পরেও আমার ছেলেকেই ভালোবাসে! আমার ছেলে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না? সাহস কত বড় ফকিন্নির বেটির। শোনো মিজান ওকে সাফ সাফ জানিয়ে দিও আমি এই একমাসের মধ্যেই আমার ছেলেকে আরও সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দেব। আর সে মেয়ে এমন মেয়ে হবে যে আসার পরও আমার ছেলে আমারই থাকবে। আর ঐ মেয়েও আমার কথায় উঠবে আমার কথায় বসবে। আচ্ছা ফোন রাখি…. হ্যা ওয়ালাইকুমুসসালাম।’
রাহেলা বেগম ফোন রেখে ঘুরে দাড়াতেই চমকে উঠলেন। সাথে সাথেই তার হাতে থাকা ফোনটা পড়ে গেল নিচে।
চলবে…