#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৫||
২৮.
ইমনকে দেখেই মাওশিয়াত তার সামনে ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত বুকে হাত গুঁজে বলল,
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি খেলায় নাম দিয়েছ।”
ইমন হেসে বলল,
“বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে?”
“আমার মনে হয় না তুমি ফুটবল খেলতে পারো।”
“মনে না হওয়ার কারণ কি?”
“তোমাকে দেখে মনে হয় না।”
আহনাফ ইমনের কাঁধে হাত রেখে মাওশিয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মানুষের দক্ষতা তার চেহারার মধ্যে থাকে না। এই দক্ষতা বোঝার জন্য উদার মন দরকার। আর তোমার মন-মানসিকতা একটুখানি। তাই তোমার হয়তো মনে হয় না।”
মাওশিয়াত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আহনাফের কথা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল,
“আরেহ আহনাফ, সবসময় মজা করিস কেন?”
আহনাফ বাঁকা চোখে মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিন্তু ইমন ভালো করেই চিনে। আমি সবসময় সিরিয়াস কথা বলি। মজা করার মতো মন-মানসিকতা আমার নেই।”
কথাটি বলে আহনাফ চলে গেলো। ইমন আহনাফের পিছু পিছু এসে বলল,
“তুই মাওশিয়াতকে এভাবে অপমান করেছিস কেন?”
আহনাফ ইমনের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি? ওকে আমি অপমান করেছি? বোকা ছেলে, ও তোকে অপমান করছিল। আমি শুধু ওকে ওর মানসিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”
ইমন চুপ করে রইলো। আহনাফ বলল,
“মনে হচ্ছে তুই মাওশিয়াতের ব্যাপারে খুবই সেনসিটিভ। প্লিজ ইমন, আমি চাই না তুই মানসিকভাবে কষ্টে থাক। ও তোকে নিয়ে ওভাবে চিন্তা করছে না। করবেও না।”
“কেন করবে না?”
“বয়স কত হয়েছে তোর?”
“খুব শীঘ্রই ষোলো শেষ হবে।”
“ষোলো বছর খুবই কম, ইমন। আর কিইবা আছে আমাদের? না আছে পরিচয়, না আছে নাম। এমন অবস্থায় আছি, যেখানে নিজের বংশ পরিচয় দিলেই বিপদ। সেখানে তুই প্রেম করবি? তাও আবার মাওশিয়াতের সাথে? ও এই দেশের। আর আমরা ভিনদেশি। ওর পরিবার এটা মেনে নেবে না, তারপর একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতো ঝামেলা নিতে পারবি?”
“ভালোবাসায় সব সম্ভব।”
“তুই যেই অনুভূতিকে ভালোবাসা ভাবছিস, সেটা আসলে ভালোবাসা না।”
“যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়? আমার তো মাওশিয়াতকে অনেক ভালো লাগে।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আশা করি বাইরের কারো জন্যই আমাদের ছ’জনের মধ্যে কোনো ঝামেলা হবে না।”
কথাটি বলেই আহনাফ চলে গেলো। ইমন পেছন ফিরে মাওশিয়াতের দিকে তাকালো। মাওশিয়াত তার বান্ধবীর সাথে গল্প করছে। ইমন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট, দুই মিনিট, এভাবে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। মাওশিয়াতও তার কথা শেষ করে ক্লাসে ঢুকে গেলো। কিন্তু তার চোখ একবারও ইমনের দিকে গেলো না। তাহলে কি আনমনেও মাওশিয়াতের দৃষ্টি ইমনকে খোঁজার চেষ্টা করে না? তাহলে এই বন্ধুত্বও কি মাওশিয়াতের কাছে মূল্যহীন?
ক্লাস রুমের সামনে খালি বারান্দায় ইমন দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার বাবাকে খুব মনে পড়ছে। বাবা আর মা ইভানের চেয়ে তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো। কারণ সে বয়সে ছোট ছিল। সে কখনোই কোনো অপূর্ণতায় ছিল না। কিন্তু আজ সে যা চাইছে, তা সহজে পাচ্ছে না। এই না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কালো রাতটির কথা। যদি সেদিন সেও বাবা-মার সাথে অনেক দূরে হারিয়ে যেতো? হয়তো তখন তাকে এতো আক্ষেপ করতে হতো না।
ইভানের কন্ঠে ইমনের ঘোর কাটলো। ইভানের পেছনে তাহমিদ, তূর্য, আরাফ আর আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। ইভান ইমনের দুই কাঁধে তার দুই হাত রেখে বলল,
“আমি জানি তোর এই সুযোগটা দরকার ছিল। তুই তো খেলতে চাস। এখন তোর স্বপ্ন পূরণের ছোট একটা পথ খুলে গেছে।”
তাহমিদ বলল,
“যারা মনে করে তোর মধ্যে কোনো ট্যালেন্ট নেই, তাদের দেখিয়ে দিতে হবে, ইমন কে!”
তূর্য ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“শুধু পড়াশুনা করলেই সম্মানিত হওয়া যায় না। যারা সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে, তারাই ক্লাসে প্রথম হয়। আর যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সংগ্রাম করতে থাকে, তারা জীবনে প্রথম হয়।”
আরাফ বলল,
“ইমন, এখন প্র্যাক্টিসে যা।”
আহনাফ ইশারায় ইমনকে শুভেচ্ছা দিলো। ইমনও মুচকি হেসে চলে গেলো। এরপর এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এক সপ্তাহ পর একাদশ শ্রেণির দুটি গ্রুপের মধ্যে ফুটবল খেলা হলো। সেই খেলায় ইমনদের দল জয়ী হলো। এভাবে দুই দিনের ব্যবধানে চারটি ম্যাচ হলো। চারটি ম্যাচে দুটি দল বাছাই করা হলো। এই দুটি দলের মধ্যেই এবার শেষ ম্যাচ হবে। যেই দল জিতবে, তাদের জন্য একটা সুযোগ থাকবে। তারা যদি ভালো খেলা প্রদর্শন করতে পারে, তাহলে তাদের অন্য স্কুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হবে।
শেষ ম্যাচের দিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এদিকে বাছাই পর্বে তূর্যের নাম এসেছে। এখন স্কুলের পাঁচজন বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে গানের প্রতিযোগিতা হবে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন অরুণিকা আর শতাব্দীও আরাফদের স্কুলে গেলো। অরুণিকা আজ সাদা ফ্রক পরে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। শতাব্দী নিজ হাতে অরুণিকাকে সাজিয়ে দিয়েছে। তাহমিদ অরুণিকার সাজ দেখে শতাব্দীকে বলল,
“একদম পুতুল বানিয়ে দিয়েছ!”
“ও তো পুতুলই।”
আরাফ অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।”
অরুণিকা ফ্রক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলল,
“আমাকে কি পুতুলের মতো লাগছে?”
“হ্যাঁ, একদম পুতুল লাগছে।”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসলো। আহনাফ দূর থেকে সেই হাসি দেখে মুচকি হেসে ইভানকে বলল,
“আমাদের অরু বড় হয়ে যাচ্ছে, দেখ।”
ইভান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, সামনে ওর ছয় বছর পূর্ণ হবে। কিভাবে যে দুইটা বছর কেটে গেছে!”
এবার তূর্য তার গিটার নিয়ে মঞ্চে উঠলো। অরুণিকা হাততালি দিয়ে বলল,
“দেখো, রকস্টার।”
তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে গান ধরলো,
“খোলা চোখখানা করো বন্ধ,
বাতাসের ঠাণ্ডা গন্ধ
বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে,
আসো ছোট্ট একটা গান করি,
যাতে ঘুম পাড়ানি মাসি এসে পাশে বসে
হাতখানা দিবে কপাল ভরে
ভয় নেই, আছি আমি পাশে
হাতখানা ধরে আছি হেসে
কোলেতে আমার মাথা তোমার।
.
অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজও জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল
.
আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয়
সে যাতে ভয় না পায়
.
পরি আয়, তার দুই হাত ধরে
নিয়ে যা স্বপ্নের খেলাঘরে
যেথা মিলবে তার সুখের ঠিকানায়
তারাদল ছুটে আয় এইখানে
তার ঘুমখানা যাতে না ভাঙে তাই
নিয়ে যা তাকে স্বর্গের বিছানায়
যদি দেখো সেথা আমায়
বসে গান তোমায় শোনাই
তুমি মিষ্টি এক চুমু খেয়ো মোর গালে।
.
অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজো জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল
.
আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয়।”
তূর্য গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে অরুণিকার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এই টুইংকেল, তোমাকে তো আজ পরীর মতো লাগছে।”
অরুণিকা তূর্যের গিটার ধরে বলল,
“আমাকে এটা দেবে?”
তূর্য গিটারটা সরিয়ে বলল,
“না, এটা ছোটরা ধরে না।”
শতাব্দী হেসে বললো,
“বাহ গায়ক সাহেব, একটু আগে তুমি তোমার টুইংকেলের দিকে তাকিয়ে গান করছিলে, আর এখন গিটারটাই ধরতে দিচ্ছো না! এ আবার কেমন ভালোবাসা।”
তূর্য ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“তুমি আমার ভালোবাসা বুঝবে না। আমার ভালোবাসা সবার চেয়ে ভিন্ন। এই ভালোবাসা দেখা যায় না।”
কথাটি বলতে বলতেই তূর্য হেসে দিলো।
শতাব্দী বলল, “হাসছো কেন?”
তূর্য ইশারায় আরাফ আর আহনাফকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“পাশের দুইটা রেগে যাচ্ছে বোধহয়।”
আরাফ ইশারায় অরুণিকাকে দেখিয়ে দিলো। তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। তূর্য অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেহ, আমার পিচ্ছি টুইংকেলকে আমি কত্তো ভালোবাসি, একদম ইমন, ইভান, আরাফ, আহনাফ, তাহমিদকে যেমন ভালোবাসি, ঠিক তেমনি। কিন্তু আমার গিটারের চেয়ে বেশি না। সরি টুইংকেল।”
অরুণিকা গিটারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি টুন-ঝুনকে বেশি ভালোবাসি। শতু আপুকেও ভালোবাসি।”
“আমাদের ভালোবাসো না?”
“হ্যাঁ, সবাইকে ভালোবাসি। তোমরা সবাই ভালো। কিন্তু ওই ছেলেটা পঁচা।”
অরুণিকা ইভানকে দেখিয়ে দিয়ে কথাটি বলল। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ, আমি পড়তে বসাই তাই পঁচা হয়ে গেলাম। এখন বাকিরাও পড়াক। তারপর সবাইকে কতো ভালোবাসে, দেখবো।”
এরপর পুরষ্কার বিতরনী পর্বে তূর্য গানের জন্য প্রথম পুরষ্কার পেলো। ক্রেস্ট নিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময় তাদের শ্রেণি শিক্ষক তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলো। তিনি তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার কন্ঠে অসম্ভব মায়া। তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে।”
“কি খবর স্যার?”
“আমাদের অতিথি মিস্টার সুমন রায় তোমার গান পছন্দ করেছেন। তিনি তোমাকে উনার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন।”
স্যার একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“হয়তো তুমি মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ পাবে। কারণ মিস্টার সুমন রায় মিডিয়ার সাথেই জড়িত।”
তূর্যের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সে আবার মনে করার চেষ্টা করলো, সে কি গান গেয়েছিল! গানটা কি সে এতো ভালো গেয়েছে, যার জন্য তার মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ হয়ে যাবে?
অন্যদিকে ইমনের দল জয়ী হয়েছে। তাদের বার্ষিক পরীক্ষার পর আবার অনুশীলন করতে হবে। এবার ভালো খেলতে পারলে সে পুরষ্কার হিসেবে টাকা পাবে। এদিকে খেলা শেষ হওয়ার পর পুরষ্কার নিয়ে সে যখন বন্ধুদের কাছে আসছিল, তখনই মাওশিয়াত তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
ইমন ক্রেস্ট দেখিয়ে বলল,
“আমি ভালো খেলি, এখন প্রমাণ পেয়েছো?”
“হ্যাঁ, ভালোই খেলেছ হয়তো। তবে আমি ফুটবল খেলা বুঝি না। সবাই তোমার অনেক প্রশংসা করছে, তাই বুঝলাম ভালো খেলেছ। তবে এসব খেলাধুলা করে তুমি বেশিদূর এগুতে পারবে না। আসল উন্নতি তো ভালো রেজাল্ট আসলেই হয়।”
ইমন মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“তোমার মনে জায়গা নেওয়ার জন্য আমি এখন থেকে খুব পড়বো। ভালো রেজাল্ট করবো। তখন হয়তো তুমি আমায় খুব পছন্দ করবে।”
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৬||
২৯.
আজ পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হবে। সবাই ক্লাসে এসে বসে আছে। মাওশিয়াত চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। তূর্য তা দেখেই হাসতে লাগলো। ইমন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“হাসছিস কেন? দেখ ওর মন কতো সুন্দর! তাই এই মুহূর্তে বাকীদের মতো বকবক না করে আল্লাহকে ডাকছে।”
তূর্য মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“পরীক্ষা শেষ, খাতাও কাটা শেষ। শুধু শুধু এসব করে কি লাভ?”
“তুই চুপ কর। তুই এসব বুঝবি না।”
শ্রেণি শিক্ষক ক্লাসে এসে সবার প্রথমে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নাম ঘোষণা করে তাদের হাতে রেজাল্ট কার্ড ধরিয়ে দিলেন। তারপর স্যার এসে তূর্যের দিকে রেজাল্ট এগিয়ে দিলেন। তূর্য ভয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো।
স্যার বললেন,
“অল্পের জন্য ফেইল কর নি। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন সবগুলোতেই তোমার অনেক খারাপ নম্বর এসেছে। তুমিই পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কম নম্বর তুলেছ। আমার তোমাকে ব্যক্তিগত ভাবে ভালো লাগে, কারণ তুমি ভালো গান গাইতে পারো। কিন্তু পড়াশুনাও তো করতে হবে। তাই না?”
তূর্যের দিকে তাকিয়ে মাওশিয়াত বাঁকা হাসি দিলো। তূর্য চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো। এবার প্রথম দশজনের নাম ঘোষণা করা হবে। ষষ্ঠ ধাপে ইমনের নাম ডাকা হলো। ইমন খুশিতে স্যারের কাছ থেকে রেজাল্ট কার্ড নিয়ে মাওশিয়াতের দিকে তাকালো। কিন্তু মাওশিয়াত দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে। আহনাফ পঞ্চম হয়েছে, আর আরাফ হয়েছে তৃতীয়। এবার মাওশিয়াত মুখ তুললো। তার দৃষ্টি একবার স্যারের দিকে, আরেকবার ইভানের দিকে। সে চাইছে এবার যেন ইভানের নামটাই নেওয়া হোক। কিন্তু না। স্যার মাওশিয়াতকেই ডাকলো। আর ইভানই প্রথম হলো। স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইমন মাওশিয়াতের কাছে এসে বলল,
“অভিনন্দন মাওশিয়াত।”
মাওশিয়াত রাগী দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকালো। তার রাগী চোখ দুটি ছলছল করছে। রাগ আর দুঃখ দুটিই মাওশিয়াতকে ঘিরে ধরেছে। সে তার সামনে থাকা বোতলের ঢাকনা খুলে বোতলের সব পানি ইমনের মাথায় ঢেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ইমনসহ যারা যারা ক্লাসে উপস্থিত ছিল সবাই নির্বাক হয়ে গেল। তখনই তাদের ক্লাসের আরেকটি মেয়ে মাওশিয়াতকে থামিয়ে বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তুমি কি এই কাজটা ঠিক করলে? ও তোমাকে অভিনন্দন দিতে এসেছে, আর তুমি?”
মাওশিয়াত তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“একটা ভিখারির মেয়ে আমাকে বলবে কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক?”
ইভান ইমনের হাত ধরে মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি মেয়ে মানুষ, তাই আজ অনেক বড় ঝামেলা বাঁধে নি। নয়তো আমি কতোটা ভয়ংকর হতে পারি, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
মাওশিয়াত ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমার ভাই আমাকে অপমান করতে এসেছে। আমাকে খোঁচা দিতে এসেছে, আর তুমি আমাকে শাসাচ্ছো?”
তূর্য চেঁচিয়ে ইমনকে বলল,
“এই মেয়ে কতোটা স্বার্থপর দেখেছিস? আমি তোকে আগেই বলেছি ও তোর সাথে বন্ধুত্ব করেছে ইভানের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য।”
আহনাফ আর আরাফ ইভানকে টেনে ক্লাস থেকে বের করে আনলো। যদি মাওশিয়াতের কোনো কথায় ইভান আরো ক্ষেপে যায়, তাহলে এই ছেলে দেখবেই না তার সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ আর তূর্য ইমনের কাঁধে হাত রাখলো। আর ইমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইমনকে দেখে সেই মেয়েটি একটা রুমাল এগিয়ে দিয়ে মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হয়তো আমি গরিব ঘরের মেয়ে, কিন্তু কাউকে কষ্ট দিতে পারি না। কিন্তু বড় ঘরের মেয়েরা এতো সুখের মাঝে থাকে, তবুও তাদের চোখে মানুষের অনুভূতি মূল্যহীন।”
তূর্য রুমালটি নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। তারপর তারা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।
এদিকে অনেকক্ষণ ধরে ইমন স্কুলের মাঠের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। আর তাকে ঘিরে বসে আছে তার ভাই আর চার বন্ধু। হঠাৎ তাদের দিকে এগিয়ে এলো ক্লাসের সেই মেয়েটি। একই ক্লাসে পড়লেও ইমনের চোখ সেই মেয়ের দিকে কমই গিয়েছিল। শ্যামলা মেয়েদের দিকে হয়তো ছেলেদের দৃষ্টি সহজে পড়ে না। তবে আজ তার সুন্দর ব্যবহার ছ’জনকেই মুগ্ধ করেছে। মেয়েটি ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি ব্যাপার, বাসায় যাবে না?”
তাহমিদ বলল,
“যদি ওর মন ঠিক হয়।”
ইমন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি নাম তোমার?”
মেয়েটি অবাক কন্ঠে বলল,
“আমি তো টেন থেকেই তোমাকে চিনি। দুই বছরে তুমি আমার নামও জানলে না?”
ইমন তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“আরেহ, ও সায়ন্তনী। তুই সত্যিই চিনিস না? ও খুব সুন্দর নৃত্য করতে পারে।”
ইমন মুচকি হেসে বললো,
“আমি তোমার নামটাই জানতাম না। তোমাকে তো দেখেছি।”
সায়ন্তনী বলল,
“আমি তোমাদের সবার নাম জানি। তূর্যের সাথে অনেক কথা হয়েছিল।”
তূর্য বলল,
“আমার আশেপাশে মেয়ে আছে, আর আমি কথা বলবো না, তা কি হয়?”
তূর্যের কথায় সবাই হাসলো। সায়ন্তনী বলল,
“আমার তাড়া আছে। কাজে যেতে হবে।”
ইমন বলল,
“তুমি কি কাজ করো?”
“আমি দোকানে কাজ করি। আমার মায়ের চায়ের দোকান আছে। আমি ওখানেই বসি। মা অসুস্থ, তবুও স্কুলে থাকলে একটু বসে। আমাদের বাবা নেই। আমি দোকানে না বসলে মা-ভাই উপোস থাকবে।”
ইভান সায়ন্তনীর কথা শুনে বলল,
“আমাদের বন্ধু হবে?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। এরপর সবাই সায়ন্তনীর সাথে বন্ধুত্ব করলো। শুধু আহনাফ বলল,
“এর আগে একটা মেয়ে বন্ধু জুটিয়েছিলাম, সে এখনো পিছু ছাড়ছে না। আবার কোনো বন্ধু বানাতে চাই না।”
ইভান বলল, “সবাই যতির মতো না।”
সায়ন্তনী হেসে বলল,
“তাহলে আমার ভাই হয়ে যাও। বন্ধু হতে হবে না।”
আহনাফ হেসে বলল,
“ওকে আজ থেকে আমরা ভাই-বোন।”
এদিকে মাওশিয়াত ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখলো সায়ন্তনী ইভান আর ইমনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মাওশিয়াতের কেন যেন ব্যাপারটা ভালো লাগলো না। সে কোনো কিছু না ভেবেই ইমনের সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,
“ইমন, সরি। আমি এমনই। রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। আমি ভেবেছি ইভান প্রথম হয়েছে, তাই তুমি আমাকে খোঁচা দেবে।”
মাওশিয়াত কাঁদো কাঁদো মুখ করে ইমনের দিকে তাকালো। ইমনের মন মুহূর্তেই গলে গেলো। কিন্তু ইভান ইমনকে আটকে দিয়ে মাওশিয়াতকে উত্তর দিলো,
“তোমার মতো বদমেজাজী মেয়েগুলো কখনোই বন্ধু হওয়ার যোগ্য না। তার চেয়ে সায়ন্তনী অনেক ভালো।”
মাওশিয়াত সায়ন্তনীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। সায়ন্তনী মাথা নিচু করে রাখলো। মাওশিয়াত ইমনের কোনো উত্তর না পেয়ে চুপচাপ চলে গেলো।
সেদিন মাওশিয়াত বাসায় গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করলো। সে কখনো দ্বিতীয় হয় নি। তাই এই ফলাফলে সে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে ইমনকে অকারণে আঘাত দিয়েছে তাই। সে সারাদিন বসে ভাবলো, ইভান প্রথম হলেও সব সারির শিক্ষার্থীদের সাথেই তার বন্ধুত্ব আছে। অথচ মাওশিয়াত সবসময় প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের সাথেই বন্ধুত্ব করবে। হয়তো তার এমন ব্যবহারের জন্য সৃষ্টিকর্তা তার উপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু আর যাই হোক আজ সে সায়ন্তনীকে ইমন আর ইভানের সাথে একদমই সহ্য করতে পারছিলো না। মাওশিয়াত চায় না, তার বন্ধুরা অন্য কারো বন্ধু হোক। তাই সে মনে মনে ভাবলো, যে করেই হোক সে ইভান আর ইমনের মনে তার প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি করিয়ে তাদের ভালো বন্ধু হবে।
৩০.
তূর্য আজ গানের অডিশন দিতে গেলো। প্রতি বছরই কলকাতার শিশু সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে একটা গানের প্রতিযোগিতা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সব ব্যবস্থায় করে দিলেন সুমন রয়। অনেক দিন ধরেই সেই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে তূর্যের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কিন্তু আজ সে অডিশন থেকে বাদ পড়লো। আর এরপর থেকে সে মলিন মুখে বসে আছে। তার পাঁচ বন্ধুর সান্ত্বনা, সায়ন্তনীর দেওয়া আশা, অরুণিকার মিষ্টি কথা, শতাব্দীর দেওয়া উৎসাহ কোনো কিছুই তাকে স্বাভাবিক করতে পারছে না।
টানা এক সপ্তাহ সে চুপচাপ বসে ছিল। এক সপ্তাহ পর তূর্য বলল,
“আমার গান ভালো হোক বা হোক, আমি গান গাওয়া ছাড়বো না। কেউ শুনুক বা না শুনুক আমি জোর করে তাদের শোনাবো। তারা বাধ্য হয়ে আমার গান শুনবে।”
তাহমিদ অবাক কন্ঠে বলল,
“জোর করে কিভাবে শোনাবি?
তূর্য ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে ফোনটা তাহমিদের দিকে এগিয়ে দিলো। তাহমিদ ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তূর্য একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে। সে বাকীদের দিকে তূর্যের মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিলো।
আহনাফ বলল,
“তাহলে তুই ইউটিউবে ভিডিও ছাড়বি?”
তূর্য বলল,
“হ্যাঁ, তূর্য ছাড়বে না। এই গানগুলো রিকি ছাড়বে। আজ থেকে আমার দুটো পরিচয় থাকবে। আমি তোদের কাছে তূর্য, যার পড়াশুনা ভালো লাগে না। তবুও সে এখন থেকে পড়বে, আর পাশাপাশি ছোট ছোট দলে গান গাইবে। আর আমার দ্বিতীয় পরিচয় হবে রিকি, দা রকস্টার। যে গান গাইবে কোনো বাঁধা ছাড়া, কিন্তু কেউ তাকে দেখবে না।”
“মানে তুই নিজেকে প্রকাশ না করে গান ছাড়বি?”
“হুম। এটাই হবে আমার গানের জীবনের শুরু। রিকির জন্ম আজ থেকেই শুরু হলো। প্রথম গানটা আমি কালই ছাড়ব।”
আহনাফ বলল,
“ব্যাকগ্রাউন্ডটা কিন্তু আমিই সাজাবো।”
এদিকে অরুণিকার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে কয়েক মাস হলো। সুরাইয়া ঘরে এসে ছ’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাবুনের তো ছ’বছর হয়ে গেলো! বলছি কি ওর কর্ণ ছেদন করিয়ে দিলে ভালো হতো।”
আরাফ ভীত কন্ঠে বললো,
“ও ব্যথা পাবে না?”
আহনাফ বলল,
“এসবের কোনো দরকার নেই।”
সুরাইয়া বললেন,
“আরেহ বাবা, বড় হলে আরো ব্যথা লাগবে। আর মেয়েদের কানের দুল পরতে হয়৷ এটা তো মেয়েদের শখ। দেখবে কিছুদিন পর ও নিজেই পরতে চাইবে। তখন কি করবে?”
তাহমিদ বলল,
“চাচী ঠিকই বলেছে। ওকে কানের দুল পরলে দারুণ লাগবে। মাঝে মাঝে শতাব্দীর কানের দুলগুলো কানের কাছে ধরে রাখে, তখনই দেখতে খুব মায়াবী লাগে।”
আহনাফ রাজী হলেও আরাফ কোনোভাবেই অরুণিকার কর্ণ ছেদন করাতে চাইছিলো না। শেষমেশ বাকীদের জন্য সে আর নিষেধও করলো না।
এদিকে পার্লারে গিয়ে আরাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। একটা মেয়ে এসে অরুণিকার দুই কানের যেই পাশে ছেদন করবে, সেই দুই পাশ চিহ্নিত করে রাখলো। অরুণিকার পাশেই আরেকজন কর্ণ ছেদন করতে এসেছে। সে মেয়েটি অরুণিকার চেয়ে বড় জোর দুই-তিন বছরের বড় হবে। মেয়েটি ভয়ে কাঁপছিল। মেয়েটিকে দেখেই অরুণিকা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আরাফ, আমার ভয় করছে। আমাকে ওরা ব্যথা দেবে।”
আরাফ অরুণিকার সামনে আসা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে দিয়ে বলল,
“অরু, তোমার কিছু হবে না। আমি আছি তো।”
আহনাফ পাশেই বসা ছিল। সে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“একদমই ব্যথা লাগবে না। দেখি, চোখ বন্ধ করো।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না, করবো না।”
পার্লারের মেয়েটি হেসে অরুণিকার এক কানে দুল পরিয়ে দিলো। ব্যস অরুণিকার কান্না শুরু। সে ব্যথায় কান ধরে বসে আছে। পার্লারের মেয়েটি বলল,
“এতো ব্যথাও করে না। ও একটু বেশিই কাঁদছে?”
আরাফ বলল,
“এমনি এমনি কেন কাঁদবে? নিশ্চয় বেশি ব্যথা করছে।”
আরাফ দ্বিতীয় কানটি ছেদন করতে দিচ্ছিলো না। এবার আহনাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে বসলো। মেয়েটিও তার কাজ করে ফেললো। এদিকে অরুণিকা রাগে ফুঁসতে লাগলো। সে দাঁত দিয়ে আহনাফের হাত কামড়ে ধরেছে। আহনাফও চুপচাপ ধৈর্য ধরে ছিল। কর্ণ ছেদনের পর অরুণিকা ক্ষোভ নিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরো রাস্তা সে আরাফের কোলে বসে ছিল। আহনাফ কিছু বললেই কানে হাত দিয়ে রাখতো। বা আরাফের কান ঢেকে রাখতো, যাতে আহনাফের কোনো কথা আরাফের কানে না যায়। অরুণিকার এমন ব্যবহারে আহনাফ প্রচন্ড বিরক্ত। আরাফও তো প্রথম দুল পরানোর সময় ওকে কোলে নিয়েছিল, তাহলে রাগ সব তার উপর কেন হবে?
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরতে যাবে তখনই অরুণিকা হাত সরিয়ে দিয়ে আরাফকে বলল,
“আমি দুষ্টু ছেলেদের সাথে কথা বলি না।”
আহনাফ তার হাত দেখিয়ে বলল,
“আর একটা বদমাশ মেয়ে যে আমার হাত কামড়ে দিয়েছে, ওর সাথে কি কথা বলা উচিত?”
অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“আরাফ, রিকশা থামানো উচিত। চল, ওকে এখানে রেখে আমরা চলে যাই। মেয়েটা দিন দিন বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে।”
অরুণিকা কথাটি শুনে আরাফকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো। এরপর আহনাফের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার সাথে কখনো কথা বলবো না।”
আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, সরি। এক কানে দুল পরলে কি ভালো লাগবে বলো? তোমার শতু আপু কি এক কানে দুল পরে? এখন তুমি কানে দুল পরবে। তোমার জন্য নতুন নতুন দুল কিনে আনবো, ভালো হবে না?”
“সত্যি? আমার জন্য দুল কিনে আনবে?”
“হ্যাঁ, সত্যি।”
“অনেকগুলো?”
“একদম এক বক্স।”
অরুণিকা আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি আনবে না। আরাফ আনবে।”
আরাফ হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমি আনবো।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“দিনশেষে আমিই খারাপ। যেমন দাদা, তেমন নাতনি। দাদাও এমন করতো। যে যা-ই করুক, সব দোষ আমার উপরই দিতো।”
“কারণ দাদা তোকে বেশি ভালোবাসতো।”
“আচ্ছা, তাহলে দাদার নাতনি কি আমাকে বেশি ভালোবাসে?”
আরাফ হাসলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“দাদা-দাদি অরুকে খুব পছন্দ করতো। তোর দাদির কথাগুলো মনে আছে?”
আহনাফ অন্যদিকে চোখ সরিয়ে বলল,
“আমি এসব মনে করতে চাই না।”
“কিন্তু আমি জানি তোর মন থেকে কিছুই মুছে যায় নি। আমি তোকে চিনি। আমার চেয়ে তোকে কে ভালো চিনবে বল?”
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭||
৩১.
তাহমিদ আজ স্কুলে যায় নি। কাল রাতে সে অনেকগুলো সিঙ্গারা ও সমুচা বানিয়েছিলো। ভাবছে সেগুলো আজ বিক্রি করতে পারলে অনেক টাকা হাতে আসবে। এমনিতেই আগামী সপ্তাহে অরুণিকাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। তারপর ওর স্কুলের ড্রেস, জুতো, নতুন বইসহ আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। তাই এখন হাতে টাকা থাকা বেশি জরুরি।
তাহমিদ একটা বড় হাঁড়ির ভেতর সব ভাজা সিঙ্গারা আর সমুচা রাখলো। এবার রিক্সা নিয়ে চলে এলো একটা স্কুলের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে স্কুলের টিফিন ছুটিতে তার হাতে বানানো সিঙ্গারা আর সমুচা বিক্রি করতে লাগলো।
হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বলল,
“এই সমুচা ওয়ালা দাম কতো সমুচার?”
মেয়েটির সম্বোধন তাহমিদের পছন্দ হলো না, যদিও সে অনেক বার ফেরিওয়ালা, দোকানদার, মিষ্টিওয়ালা এসব নামেই সম্বোধিত হয়েছিল।
তাহমিদ তবুও ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল, “আট টাকা।”
মেয়েটি ক্ষ্যাপা কন্ঠে বললো,
“একটা সমুচার দাম আট টাকা? অসম্ভব! তিন টাকা দিয়ে দাও।”
তাহমিদ অবাক কন্ঠে বললো,
“তিন টাকার সময় কি এখন আর আছে? এই একটা সমুচা বানাতেই আমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে। আট টাকা তো আমি বেশি চাই নি।”
মেয়েটি বাঁকা চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার সাথে বাড়াবাড়ি করবি? তুই রাস্তার দোকানদার আমাকে শেখাবি টাকা বেশি হয়েছে কিনা?”
মেয়েটি তাহমিদকে ধাক্কা দিতেই তাহমিদ মাটিতে পড়ে গেলো। তাহমিদ মাটি থেকে উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“আমি তো আপনার সাথে বেয়াদবি করছি না। তাহলে আপনি আমাকে এভাবে ধাক্কা দিলেন কেন?”
মেয়েটি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“দিলাম ধাক্কা! কি করবি তুই? বল কি করবি? আমাকে মারবি? তোর মতো রাস্তার ছেলে আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে? একবার মেরেই দেখ, এমন মার খাওয়াবো, বাবার নাম ভুলে যাবি।”
“আটটা টাকার জন্য এতো নোংরা ব্যবহার না করলেই হতো।”
তাহমিদ একটা সমুচা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার তিনটাকা লাগবে না। আপনি বরং টাকা ছাড়াই খেয়ে যান। আমার সমস্যা হবে না। আমার বাবা-মা আমাকে আট টাকার জন্য কারো গায়ে হাত তোলা শেখায় নি। তাই আমাকে আমার বাবার নাম ভুলতে হবে না। আমি তাদের নাম সারাজীবন মাথায় রাখবো।”
মেয়েটি ক্ষুব্ধ হয়ে তাহমিদের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। তখনই শতাব্দী স্কুলের গেইট দিয়ে বের হলো। বের হয়ে দেখলো তার ক্লাসমেট তুতুল তাহমিদকে চড় মেরেছে। এদিকে তাহমিদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুতুল তাহমিদকে বলল,
“তোর মতো ছেলে আমার জুতোর ধুলো পাওয়ারও যোগ্য নয়, আর তুই আমার উপর কথা বলছিস?”
শতাব্দী তাহমিদের কাছে এসে তুতুলকে বলল,
“তুতুল, তুমি ওকে চড় মারলে কেন?”
“কারণ ও একটা চোর। তিন টাকার সমুচা আট টাকা দিয়ে বিক্রি করছে।”
শতাব্দী রাগী কন্ঠে বললো,
“চোর ও না। চোর তুমি।”
“আমি চোর? আমি কি চুরি করেছি?”
“অন্যের পরিশ্রমের টাকা দিতে চাইছো না, এটাকেই তো চুরি বলে। এদিকে কাল তো মেলা থেকে কয়েক হাজার টাকার কেনাকাটা করেছো, তাও আবার নতুন প্রেমিকের টাকায়। তো তোমার প্রেমিক কি তোমাকে আটটা টাকাও হাতে দিয়ে যায় নি? নাকি তোমার বাবা-মা তোমাকে তিনটাকা ধরিয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে?”
তুতুল আর কিছু বললো না। সে হনহন করে চলে গেলো। শতাব্দী এবার তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদের চোখেমুখে মলিনতা। তবুও সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদের সেই অসহায় মুখটি দেখেই শতাব্দীর মায়া লাগলো। সে তাহমিদের হাঁড়িটা নিয়ে স্কুলের ভেতর চলে গেলো। তাহমিদও তার পেছন পেছন গিয়ে বলল,
“কি করছো শতাব্দী?”
শতাব্দী তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। এবার শতাব্দী কোথা থেকে একটা ছোট ঘন্টা নিয়ে এলো। তারপর স্কুলের গেইটের সামনে সেই ঘন্টা বাজিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলো,
“খেতে চাও কি সিঙ্গারা, বাড়াতে চাও শক্তি? তাহলে চলে আসো মিষ্টিবাবুর ছোট্ট দোকানে। সাথে আছে সমুচা। মুখে দিলে যেন লেগে থাকবে তারই স্বাদ, মিষ্টি বাবুর হাতে জাদু, টক-ঝাল-মিষ্টি কোথাও নেই খাত। আসো আসো। খেতে আসো।”
স্কুলের মেয়ে সমুচা বিক্রি করছে এটাই যেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ক্লাসের কয়েকজন শিক্ষক এসে সমুচা কিনে নিলো। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অভিভাবকও কিনে নিলেন, শিক্ষার্থীরা তো ভীড় লাগিয়ে দিয়েছে। হাঁড়িতে আর একটাও অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু এখনো ভীড় কমে নি। এদিকে তাহমিদ শতাব্দীর দিকে শুধু তাকিয়ে আছে। শতাব্দী পুরো টাকা আর খালি হাঁড়ি তাহমিদকে দিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই সব ক’টা বিক্রি হয়ে গেছে।”
তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“ধন্যবাদ শতাব্দী।”
“ধন্যবাদ দিলে হবে না।”
“কি চাও তুমি?”
“আমি সময় চাই মিষ্টি মশাই। আমার জন্য কি তোমার কাছে সময় হবে?”
“হ্যাঁ, কেন হবে না? অবশ্যই হবে।”
শতাব্দী তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“তাহলে চলো আমার সাথে।”
শতাব্দী তাহমিদকে নিয়ে একটা খালি উদ্যানে ঢুকলো। যার চারপাশে সবুজ ঘাস। উদ্যানের শেষে একটা পুকুর। আর তার সাথে লাগানো একটা বটবৃক্ষ। শতাব্দী একপাশে তার স্কুল ব্যাগ আর তাহমিদের হাঁড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখলো। এরপর তাহমিদের হাত ধরে চলে গেলো পুকুরের পাশে। বটবৃক্ষের মোটা শেকড়ের মধ্যে দু’জনই বসে পড়লো। আর স্থির দৃষ্টিতে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে রইলো।
তাহমিদ হঠাৎ বলল,
“আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় আমরা নিজেরাও জানি না। কিন্তু অরুণিকার জন্য আমি সব সহ্য করতে প্রস্তুত।”
শতাব্দী তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরুণিকাকে খুব ভালোবাসো তাই না?”
“হ্যাঁ। আমার কোনো বোন ছিল না। ও আমার আপন বোন না। আমি চাইলেও ওকে বোন বলতে পারবো না। সম্পর্কের কিছু দেয়াল আছে, সেটা আজীবন থেকে যাবে। কিন্তু আমি কি অনুভব করি, এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”
“তুমি কি অনুভব করো, আমায় বলবে?”
“কাকে নিয়ে?”
“অরুণিকাকে নিয়ে!”
“বোনের মতোই। ও আমার কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আগেও একসাথে ছিলাম। দেশে একই এলাকায় আমাদের বাড়ি ছিল। বিকেলে ও ওর বয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে বের হতো। আর আমি ওকে দেখতাম। মাঝে মাঝে চোখেও পড়তো না। আমি কখনোই ভাবি নি ও আমার কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। একই সাথে থাকতে থাকতে ওর প্রতি মায়া জমে গেছে।”
দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ শতাব্দী বললো,
“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম, করো।”
“কাউকে বারবার দেখার ইচ্ছে, কারো সাথে কথা বলতে চাওয়া, বেশি সময় কাটাতে চাওয়া, এসবের কি কোনো নাম আছে? এসবের কারণ কি!”
তাহমিদ শতাব্দীর দিকে তাকালো। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মধ্যে কি এসব চলছে নাকি!”
শতাব্দী হেসে বলল, “অনেকটাই।”
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কে সে?”
“আছে কেউ। তুমি চিনবে না।”
তাহমিদ চুপ করে রইলো। তার ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
শতাব্দী আবার বলল,
“আরেহ আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
তাহমিদ বলল,
“আমার তো এমন কখনো হয় নি, তাই আমি বুঝতে পারছি না। তবে কাউকে ভালো লাগলেই এমন অনুভূত হয়।”
“তাহলে কি আমি তাকে পছন্দ করি?”
তাহমিদ বলল,
“তোমার এসবের বয়স হয় নি।”
শতাব্দী তাহমিদকে হালকা ধাক্কা দিলো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। শতাব্দী শব্দ করে হাসলো। তাহমিদও মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলো। শতাব্দী তার গালে হাত দিয়ে বলল,
“অনেক লেগেছে, তাই না?”
তাহমিদ হাত সরিয়ে দিলো। শতাব্দী বলল,
“তুমি কি জানো, তোমার হাসি খুব সুন্দর!.ছেলেরা এতো সুন্দর করে হাসতে পারে!”
তাহমিদ এবার শব্দ করে হাসলো। আর বলল,
“চলো বাসায় যাই।”
“হুম, হুম লজ্জা পাচ্ছো, তাই না? এখন মেয়েদের মতো লম্বা চুল থাকলে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলতে চলো বাসায় যাই, আমার লজ্জা করছে। তারপর লজ্জায় মুখ হাত দিয়ে ঢেকে দিতে।”
তাহমিদ উঠে দাঁড়ালো। আর শতাব্দীকেও টেনে তুললো। এরপর বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোমার প্রশংসা শুনে আমি লজ্জা পাই না। আমি মনোবল পাই। এখন যে বললে আমার হাসি সুন্দর, ভাবছি এখন থেকে দাঁত বের করে হেসে নাস্তা বিক্রি করবো৷ দেখবে সবাই পইপই করে ছুটে আসবে, আর আমার নাস্তা কিনে নেবে। মেয়েদের দেখে আরো বেশি হাসবো।”
শতাব্দী তাহমিদের বাহুতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
“তুমি মিষ্টি মশাই থেকে দিন দিন দুষ্টুমশাই হয়ে যাচ্ছো। এখন বাড়ি চলো। আর রাতে মাছ ভাজা করলে আমাকে ডেকো। আমি দেখেছি গায়ক সাহেব মাছ কিনে এনেছে। আমি রাতে তোমাদের সাথে খাবো।”
তাহমিদ আর শতাব্দী গল্প করতে করতে তাদের গন্তব্যে যেতে লাগলো। শতাব্দীর কাঁধে ব্যাগ, হাতে তাহমিদের আনা হাঁড়ি। আর তাহমিদের হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ। তারা ঘাসের উপর হাঁটছে। মৃদু বাতাস ঘাসে আলোড়ন ছড়াচ্ছে। সেই আলোড়নে আলোকিত হয়ে আছে দুটি মানুষ ও তাদের অনুভূতি।
চলবে-