অরুণিকা পর্ব – ২৩+২৪+২৫

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৩||

৪০.
অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বলল,
“আমি বাসায় যাবো। আমাকে যেতে দিন।”

ছেলেটি অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“যদি যেতে না দেই কি করবে?”

বাঁধন পেছন থেকে এসে অরুণিকার সামনে দাঁড়ালো। অরুণিকা বাঁধনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাঁধন অপরিচিত ছেলেটিকে বলল,
“ভাইয়া, এই মেয়ের জন্য আহনাফ ভাই আর তাহমিদ ভাই সেদিন আমাকে মেরেছিল। ওর জন্য বাবা-মা আমাকে মেরেছে। এখনো বাবা আমাকে ওই বিষয় নিয়ে বকা দেয়। স্কুলে পাশ করি নি, তাই বাবা পুরো মহল্লার সামনে আমাকে পিটিয়েছে। আর বলেছে আমার মগজে নাকি সব নোংরামি, তাই পরীক্ষার ফল খারাপ এসেছে। এর আগে কখনোই বাবা আমাকে বকে নি। ওর জন্য আমি মার খেয়েছি। ভাইয়া, এই মেয়েকে একটা শাস্তি দাও। এতো মাস আমি সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ সুযোগ হয়েছে।”

আগন্তুক ছেলেটি সাড়ে এগারো বছরের ছেলে বাঁধনের মুখে এমন কথা শুনে অবাকই হলো। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাঁধন বড় হলে ওকে আমাদের গ্রুপে নেবো। এর দ্বারাই চাঁদাবাজি সম্ভব।”

বাঁধন হেসে বলল,
“ভাইয়া আমি যাই এখন। ওর বেনামি পরিচালকগুলো আসার খবর পেলে তোমাকে জানিয়ে দেবো।”

মহল্লার বাইরে থেকেই অরুণিকাকে টেনে নিয়ে গেলো আশিস। আশিস পাশের এলাকায় থাকে। সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজি করবে, আর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের উত্যক্ত করে সময় পার করবে। রাতে জুয়া খেলবে বা মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে। আশিস অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মাওশিয়াত রিকশা থেকে নামলো। মাওশিয়াত অরুণিকাকে আশিসের সাথে দেখে দৌঁড়ে এলো। ক্ষুব্ধ কন্ঠে আশিসকে বলল,
“এই ছেলে, ওকে ছাড়ো৷ কি করছো তুমি?”

আশিস কলার উঠিয়ে মাওশিয়াতের মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“তুমি কে? রাস্তা ছাড়ো। নয়তো তোমাকেও তুলে নিয়ে যাবো।”

পাশের ছেলেটি বলল,
“আশিস ভাই, শেষ কথাটা ফেলে না দেওয়ায় ভালো।”

মাওশিয়াত রাগী কন্ঠে বললো,
“আগে হাত লাগিয়ে দেখাও। তারপর বুঝিয়ে দেবো আমি কি জিনিস।”

ছেলেটি মজার ছলে মাওশিয়াতের গায়ে হাত লাগাতেই মাওশিয়াত ছেলেটির গালে চড় লাগিয়ে দিলো। আশিস ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“এই মেয়েকে ধর।”

মাওশিয়াত আশিসের নাক বরাবর ঘুষি মারতেই আশিস নাক ধরে দূরে সরে দাঁড়ালো। বাকি ছেলেগুলো মাওশিয়াতকে ধরতে এলেই, সে কয়েকটা ঘুষি দিয়ে তাদের মাটিতে ফেলে দিলো। অরুণিকা হাঁ হয়ে মাওশিয়াতকে দেখছে। আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। শতাব্দী স্কুল থেকে ফিরে মাওশিয়াতকে মারপিট কর‍তে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। অরুণিকা শতাব্দীর কাছে দৌঁড়ে এসে বলল,
“শতু আপু, মাওশিয়াত আপু ওদের মারছে। তুমিও মারো।”

শতাব্দী অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“কিন্তু মারছে কেন?”

“ছেলেগুলো বাঁধনের কথায় আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিল।”

শতাব্দী রাগী দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তার ব্যাগ দিয়েই ছেলেগুলোকে পেছন থেকে মারতে লাগলো। তাদের মধ্যে একটা ছেলে শতাব্দীর চুল ধরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। আর তখনই শতাব্দী উঠে দাঁড়ালো। এরপর চেঁচিয়ে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের উদ্দেশ্য করে বললো,
“ইশ, এই গুলো মানুষ নাকি উল্লুক। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে এদের গণ ধোলাইয়ের জন্য এগিয়ে আসুন। একটা মেয়ে মারছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন? নির্লজ্জ কোথাকার।”

লোকগুলো শতাব্দীর কথা শুনে এগিয়ে আসতে যাবে তখনই আশিস পালিয়ে গেলো। আশিসকে পালাতে দেখে বাকিরাও পালালো। এরপর অরুণিকা আর শতাব্দী মাওশিয়াতের কাছে এলো। অরুণিকা বলল,
“আপু, তুমি ওদের কিভাবে মেরেছো? তোমার এতো শক্তি? তোমার কাছে কি পাওয়ার আছে?”

মাওশিয়াত হেসে বলল,
“আমি তোমার বয়স থেকেই জুডো শিখেছি।”

“জুডো কি?”

“তুমি যেমন ছবি আঁকার জন্য ড্রয়িং ক্লাসে যাও। শতাব্দী যেমন নাচ শেখার জন্য নৃত্যের ক্লাস করে, তেমনি এমন বদমাশ ছেলেদের মারার জন্য আমি জুডো শিখেছি।”

শতাব্দী অবাক হয়ে বলল,
“মাওশিয়াত দিদি, তুমি আসলেই জিনিয়াস। ইমন তোমার কথা বলেছিলো।”

মাওশিয়াত বলল,
“কি বলেছিল ইমন?”

“বলেছে তুমি দেখতে যেমন সুন্দরী, পড়াশুনায়ও অনেক ভালো। আর তোমার কথাবার্তা শুনলে শুনতেই ইচ্ছে করবে। আর এখন দেখছি তুমি মারামারিও করতে জানো।”

মাওশিয়াত অরুণিকার হাত ধরে তাকে বাসায় নিয়ে এলো। এরপর তিনজন একসাথে মেঝেতে বসলো। মাওশিয়াত অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইমন কোথায়?”

“ও তো অনেক দেরীতে বাসায় আসে।”

“ইভান!”

“ইভান তো অনেকদিন বাসায় আসে না। জানো আপু, ইভান আর ইমন আঁড়ি নিয়েছে। ওরা এখন আর কথা বলে না।”

“আরাফ আর তাহমিদ কোথায়?”

শতাব্দী বলল,
“তাহমিদ তো এই সময় রেস্টুরেন্টে থাকে। ওখানে কাজ নিয়েছে তো। আর আরাফ হয়তো টিউশন করাতে গেছে।”

অরুণিকা বলল,
“সবাই সন্ধ্যায় বাসায় আসে। কেউ কেউ রাতে।”

মাওশিয়াত অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল,
“আর তুমি বাসায় একা থাকো?”

“হ্যাঁ। অন্ধকার হওয়ার আগেই তাহমিদ চলে আসে। আমার তো অন্ধকারে ভয় লাগে। আর এর আগে আমি বাসায় এসে টিভি দেখি।”

মাওশিয়াত ইভানকে ফোন করে বলল,
“আজ তোমাদের অবহেলার জন্য অরুণিকা অনেক বড় একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ইমনের সাথে দেখা করার জন্য এখানে এসেছিলাম। ওকে একা রেখে তোমরা কোথায় থাকো?”

ইভান ফোন রেখেই টিউশন থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাকিদেরও মেসেজ করে জানালো। সবাই কাজ ফেলেই বাসায় চলে এলো। আহনাফ সেই মুহূর্তে যতির সাথে ছিল। তাই সেও আহনাফের সাথে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে সব শোনার পর আরাফ অরুণিকার দুই হাত ধরে বলল,
“এগুলো ক’দিন ধরে হচ্ছে?”

অরুণিকা বলল,
“অনেকদিন। মুরাদ আর ওর বন্ধুরা আমাকে অনেকদিন ধরেই বিরক্ত করছিলো। কিন্তু এই ছেলেটা আজই এসেছে।”

ইভান রাগী কন্ঠে বলল,
“তাহলে এতোদিন আমাদের বলো নি কেন?”

অরুণিকা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাওশিয়াত রাগী কন্ঠে বললো,
“ওকে বকছো কেন? তোমাদের তো ওর যত্ন নেওয়ারও যোগ্যতা নেই। এতোদিন ভেবে এসেছি তাহমিদ ওর আপন ভাই। কিন্তু এখন শতাব্দী থেকে জানলাম তোমরা কেউই ওর ভাই না।”

যতি কথাটি শুনে অবাক হলো। যতি বলল,
“অরুণিকা তোমাদের আপন বোন না? আহনাফ, তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছো?”

ইমন বলল,
“আমরা এসব কথা কাউকে জানায় নি। মহল্লার কেউই জানে না। শুধু শতাব্দীরা, আর চাচা-চাচীরা জানে।”

“শতাব্দী, জানলে আমিও জানতে পারতাম। আমি তো আহনাফের গার্লফ্রেন্ড। আহনাফ আমার কাছ থেকে এতো বড় সত্য লুকিয়েছে কেন?”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি চুপ থাকো। আমার মাথা খেও না। এই মুহূর্তে তোমার এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার কাছে নেই।”

তূর্য হাঁটু গেড়ে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“টুইংকেল, তুমি আমাদের বলো নি কেন?”

অরুণিকা একবার আরাফের দিকে তাকালো, আরেকবার তূর্যের দিকে। তারপর বলল,
“তুমি আর আরাফ আগে আমার সাথে গল্প করতে, তাই না?”

তূর্য মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এখন তো করো না। বাসায়ও থাকো না। যখন আসো, তখন আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে স্কুলে চলে যাই, আর সময় পাই না৷ আমি তো বাসায় একাই থাকি। তোমরা বাসায় আসলেও আমার কথা শুনো না। আমি কিভাবে বলবো?”

আরাফ একপাশে বসে রইলো। তার এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কলেজ ছুটির পর সে দুই ঘন্টা সময় পায়। কিন্তু সে তখন সায়ন্তনীর দোকানে সময় কাটিয়ে আসে। সেই মুহূর্তে চাইলে সে বাসায় এসে অরুণিকার সাথে সময় কাটাতে পারতো।

আহনাফ অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে আর এক সেকেন্ডও একা থাকতে দিবো না। ক্লাস শেষে বাসায় চলে আসবো।”

যতি কথাটি শুনে মনে মনে ক্ষেপে গেলো। নিজের মনেই বলল,
“অরুণিকা আহনাফের আপন বোন নয়৷ তবুও ও সারাদিন অরুণিকার কথা বলবে। তাহলে আহনাফ কি অরুণিকাকে নিয়ে অন্য চিন্তা করে? আমার এদের আলাদা করতেই হবে। নয়তো আহনাফ যদি ওর সাথে থাকতে থাকতে ওকে ভালোবেসে ফেলে? মনের উপর তো কারো জোর নেই। বাকিদের এমন অনুভূতি সৃষ্টি হলে কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু আহনাফ তো আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি এই অরুণিকাকেই এদের থেকে আলাদা করে দেবো। ও এই বাসায় আহনাফের সাথে কখনোই থাকতে পারবে না।”

এদিকে যতিকে বাসায় পৌঁছে না দিয়ে আহনাফ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যতি মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও সে প্রকাশ করলো না। বাকিরা মাওশিয়াতকে ধন্যবাদ দিলো। মাওশিয়াত ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ইমন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভালো হতো যদি আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে।”

ইমন ইভানের দিকে তাকালো। ইভান চুপচাপ অন্যদিকে সরে দাঁড়ালো। ইমন বলল,
“আমি মাত্র বাসায় এসেছি। এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে।”

বাকিরা ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আরাফকে বলল,
“আরাফ, ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসতে পারবি?”

আরাফ মাওশিয়াতকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মাওশিয়াত যাওয়ার আগে একবার ইমন আরেকবার ইভানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমার জন্য তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে, তাই আমিই এই ঝামেলা দূর করবো। তুমি অনেক ভালো, ইমন। দেরীতে হলেও আমি বুঝেছি, মাঝে মাঝে যারা আমাদের ভালোবাসে, আমাদের যত্ন নেয়, তাদেরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক পাক্ষিক ভালোবাসা কষ্টের হলেও এখানে কোনো শান্তি নেই। ইভানকে ভালোবেসে আমি শান্তি পাই নি। যতোটা শান্তি তোমাকে নিয়ে ভেবে পাচ্ছি, ইমন।”

এদিকে তূর্য বাসা থেকে বেরিয়ে আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ বলল,
“আমি মুরাদকেও ছাড়বো না। ওই আশিসকেও ছাড়বো না।”

তূর্য বলল,
“তুই একা না। আমিও ছাড়বো না। কোথায় আছিস বল। আজই ওদের উচিত শিক্ষা দেবো।”

আহনাফ আর তূর্য দু’জন মিলে প্রথমে মুরাদ ও তার সঙ্গীদের মারলো। তারপর আশিসকে মারতে গেলো। আশিসের সঙ্গপাঙ্গও ইচ্ছে মতো আহনাফ আর তূর্যকে পিটিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড়ে নি৷ রাত দশটায় মার খেয়ে একেবারে মুখ ফুলিয়ে বাসায় এলো তূর্য আর আহনাফ। বাকিরা তাদের দেখে অবাক হলো। আহনাফ বলল,
“এই মার কিছুই না। এগুলো অরুর দিকে খেয়াল না রাখার শাস্তি। কিন্তু আশিস আর মুরাদ ওই দুইটা এক সপ্তাহ আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”

তাহমিদ বলল,
“আশিসের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু মুরাদের বাবা-মা যদি মামলা করে দেয়?”

তূর্য বলল,
“করুক মামলা। জেল হবে আর কি। শাস্তি পাবো, সমস্যা নেই। ওদের মেরেই এখন শান্তি লাগছে। মারতে না পারলে আজ রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কাল সকালে ওই বাঁধনকে ধরতে হবে। ও তো এখন বাসা থেকেই পালিয়েছে।”

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪||

৪১.
সালেহ আলী বাঁধনকে পুরো মহল্লার সামনে পিটিয়েছেন। আহনাফ আর তূর্য এক কোণায় দাঁড়িয়ে এসব দেখতে লাগলো। তখনই মুরাদের বাবা কয়েকজন লোক নিয়ে তাদের মহল্লায় ঢুকলো। মুরাদের বাবা আহনাফকে দেখেই তার কলার ধরে বললেন,
“তোর এতো বড় সাহস আমার ছেলেকে মেরেছিস?”

আহনাফের কলার ধরতেই আরাফ আর ইভান তেড়ে এলো। তারা একপ্রকার টানাহেঁচড়া করে মুরাদের বাবাকে আহনাফের কাছ থেকে দূরে সরালো। মহল্লায় মুহূর্তেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেলো। শতাব্দীর বাবা তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে সমস্যা মীমাংসা করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু মুরাদের বাবা কোনোভাবেই তা মানতে চাচ্ছেন না। তিনি আহনাফ আর তূর্যকে হুমকি দিতে লাগলেন। তখনই চেঁচামেচি শুনে অরুণিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আরাফ অরুণিকাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“অরু, তুমি বাসায় থাকো। বাইরে এসো না।”

অরুণিকা বারান্দায় এসে ভীড়ের মধ্যে শতাব্দীকে খুঁজতে লাগলো। শতাব্দী তার মা আর বোনের সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে অরুণিকাকে খেয়াল করে নি৷ অরুণিকা মনে মনে ভাবলো,
“আমার জন্য কাল রকস্টার আর আহনাফ ওই ছেলেগুলোকে মেরেছিল। এখন ওদের যদি সত্যিই পুলিশ এসে নিয়ে যায়?”

এসব ভাবতে ভাবতেই অরুণিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বারান্দার বাইরে আসলে তাহমিদ তাকে আবার টেনে ঢুকিয়ে দিতেই সে হাত ফসকে মুরাদের বাবার সামনে চলে এলো। তারপর চেঁচিয়ে বললো,
“ওরা ভালোই করেছে ওকে মেরেছে। মুরাদ সবসময় আমাকে বিরক্ত করে। আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে ফেলে, আমি স্কুল থেকে আসার সময় আমার হাত ধরে রাখে। আমাকে ছাড়েই না। আমার চুলও ধরে রাখে, বেণি খুলে ফেলে। আমার এসব ভালো লাগে না। আমি কতোবার বলেছি, ওদের আমাকে ছেড়ে দাও। কেন বিরক্ত করছ? ওরা বলে আমাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে।”

অরুণিকার কথায় আশেপাশের সবাই চুপ হয়ে গেলো। এবার অরুণিকা বাঁধনকে দেখিয়ে বলল,
“বাঁধনও রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। আমি স্কুল থেকে ফেরার আগে বাইরে থেকে টনি ভাইয়ার ভয়ংকর কুকুরটা গেইটের সামনে বসিয়ে রাখে। ও জানে আমি কুকুর ভীষণ ভয় পাই, তাই।”

শতাব্দী অরুণিকার কথা শুনে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই তার মা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“আমারও কিছু বলার আছে। এইটা অরুণিকার একার সমস্যা না। ও ছোট হয়ে যদি আজ সব কথা বলতে পারে, আমি বা আমাদের এলাকার বাকি মেয়েরা কেন চুপ থাকবে? আহনাফ আর তূর্য কি বিনা অপরাধে শাস্তি পাবে? আর যারা মেয়েদের উত্যক্ত করে, তারা মার খেয়ে বাসায় মায়ের আঁচলের নিচে বিশ্রাম নিবে, এটা আমি মানবো না।”

শতাব্দী ভীড় ঠেলে অরুণিকার পাশে আসতেই মাস্টারমশাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“শতাব্দী, তুই এখানে কেন এসেছিস?”

“বাবা, মুরাদ আমাকেও বিরক্ত করে। শুধু মুরাদ না, তার সাথে আরো কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে আমার মতো শিলা, রিনি, দূর্গা ওদেরকেও বিরক্ত করে। গত মাসেই কোয়েলের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অল্প বয়সেই ওর বাবা ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু কেন? কারণ মহল্লায় দাঁড়িয়ে থাকা এমন বদমাশ ছেলের জন্য যাতে তার মেয়ের সম্মান নষ্ট না হয়। দোষ করবে এরা, আর শাস্তি পাবো আমরা?”

এবার দূর্গার মা তাদের সামনে এলেন। তিনি বললেন,
“শুধু মহল্লার সামনে কেন? এই ছেলেগুলো আমার মেয়ের পিছু পিছু ওর স্কুল পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এদের জন্য এখন মেয়েকে ওর দাদা আনা নেওয়া করে। আহনাফ আর তূর্য ওদের মেরে একদম ঠিকই করেছে।”

এরপর তিনি আহনাফ আর তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“যাওয়ার আগে আমাকেও বলতে, আমিও কয়েক বেত লাগিয়ে দিয়ে আসতাম।”

মুরাদের বাবা চুপ করে রইলেন। তার সাথে আসা লোকগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে লাগলো। মাস্টারমশাই তাকে বললেন,
“দেখুন মশাই, আমরা পাশাপাশি এলাকায় থাকি। আপনার ঘরেও মেয়ে আছে। ঠান্ডা মাথায় বসে ছেলেকে বোঝান। আহনাফ আর তূর্য যা করেছে তা মোটেও ঠিক হয় নি। কিন্তু এভাবে মারামারি করে কোনো সমাধান হবে না। আমাদেরই ওদের বোঝাতে হবে। এখন সমস্যাটা এখানেই শেষ করলে ভালো হয়।”

মুরাদের বাবা অরুণিকার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আহনাফ অরুণিকার সামনে এসে তাকে আড়াল করে দিয়ে বলল,
“আংকেল, নিজের ছেলের দিকে এভাবে তাকালে হয়তো ছেলে মানুষ হবে। অন্যের বাচ্চাদের চোখ না দেখিয়ে নিজের সন্তানকে এই চোখ দেখান।”

মুরাদের বাবা রাগী কন্ঠে বললেন, “বেয়াদব ছেলে।”

“ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম। এবার যান।”

ভীড় কমতেই তাহমিদ শতাব্দীর সামনে এসে বলল,
“ধন্যবাদ, সামনে এসে সব কিছু বলার জন্য।”

শতাব্দী অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“ছোট সখীর সাহস দেখেই আমি সাহস পেয়েছি।”

অরুণিকা বলল,
“আমাদের ক্লাসে টিচার বলেছে, কোথাও ভুল দেখলে চুপ না থেকে ভুল শুধরে দিতে হবে, আর সত্য কথা কখনোই লুকিয়ে রাখা উচিত নয়।”

এবার আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমাদের অরু তো দেখছি এখন অনেক কিছুই বুঝে।”

“হ্যাঁ, আমি তো এখন বড় হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”

আহনাফকে অনেক বার কল দেওয়ার পরও যখন সে কল ধরলো না, তখন যতি সরাসরি বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই দেখলো আহনাফের পুরো মুখে দাগ। তার মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। যতি আহনাফের হাত ধরে বলল,
“তোমাকে এভাবে কে মেরেছে?”

অরুণিকা বলল,
“জানো, আপু। আহনাফ গতকাল ছেলেগুলোকে অনেক মেরেছে। এখন ছেলেগুলো আমাকে আর বিরক্ত করবে না।”

যতি রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর বলল,
“সব সমস্যার মূল তো তুমিই।”

আহনাফ যতির দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। যতি আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর জন্যই তুমি এতো মার খেয়েছো। আমার জন্য তো কখনোই তুমি এতোকিছু করো নি।”

আহনাফ যতির কাছ থেকে সরে বসলো। যতি আহনাফের বাহু চেপে তার কাঁধে মাথা রাখতেই আহনাফ তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। যতি বিষ্মিত হয়ে আহনাফকে বলল,
“তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আমি তোমার জন্য বেশি চিন্তা করি, এটা কি আমার অপরাধ?”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি তো চিন্তা করতে বলি নি। আর বার-বার আমার বাসায় আসা বন্ধ করো। আমার এটা ভালো লাগে না। যখন থেকেই আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছে, তুমি তো আমাকে ঠিকমতো শ্বাসই নিতে দিচ্ছো না।”

যতি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার দম আটকে রাখি? আমার সাথে থাকলে তোমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়?”

আহনাফ দুই হাত জোর করে মেঝেতে বসে চেঁচিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একা থাকতে দাও। আমাকে উদ্ধার করো। আমি নয়তো পাগল হয়ে যাবো।”

যতি আহনাফের কাছে আসতে যাবে তখনই আরাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখন যাও। ওর মাথা ঠান্ডা হোক আগে।”

যতি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি ওর গার্লফ্রেন্ড। আমি বুঝবো কিভাবে ওর মাথা ঠান্ডা করতে হবে।”

তূর্য যতির কথা শুনে ইমনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এমন টক্সিক মেয়ে আমি তো জীবনেও দেখি নি। আমার তো আহনাফের অবস্থা দেখেই প্রেম করার শখ পটল তুলতে গেছে।”

ইমন বলল,
“এই কথা ভুলেও মুখে আনিস না। আমাদের পীড়াপীড়িতেই আহনাফ এই মেয়ের সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল। ওর তো এমনতেই এসবে আগ্রহ ছিল না।”

এদিকে আহনাফ যতিকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে ছাড়ো। শুধু আজকের জন্য নয়, একেবারেই ছাড়ো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমার সাথে সম্পর্কে যাওয়া, তোমার সাথে বন্ধুত্ব করা, আর দুর্ভাগ্য তোমাকে পড়াতে যাওয়া, তোমার সাথে দেখা হওয়া।”

যতি অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“এই মেয়ে, তুমি ওর উপর কি করেছো, হ্যাঁ? জাদু করেছ, তাই না?”

আরাফ ধমকের সুরে বলল,
“এই তোমার মাথা ঠিক আছে? কি বলছো তুমি এসব?”

ইভান দরজা খুলে দিয়ে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই এই মেয়েকে এখনই আমাদের ঘর থেকে বের করে দিবি।”

আহনাফ কাছে আসতেই যতি বলল,
“একটা উঠতি বয়সী মেয়ে, তাও আবার আপন বোন নয়, ছয় জন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের সাথে এক ঘরে থাকছে, এই কথা একবার মহল্লায় ছড়িয়ে গেলে কি হবে, ভাবতে পারছো?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বুঝাতে চাইছো তুমি?”

“আজ যেই ছেলেগুলোর সাথে মারপিট করে তুমি মুখের বারোটা বাজিয়েছো, কাল তারাই তোমাদের প্রশ্ন করবে। কারণ এটা সুস্থ সমাজ। এখানে এমন নোংরা সম্পর্কের কোনো জায়গা নেই। কে বিশ্বাস করবে তোমরা ওর সাথে…”

আহনাফ যতিকে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না। সে যতির গালে চড় লাগিয়ে দিলো। ইমন আহনাফের কাছে এসে তাকে আটকালো। তাহমিদ আর আরাফ যতিকে ঘর থেকে বের করে দিলো।

প্রায় দশমিনিট যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফের কান গরম হয়ে গেছে। এমন কথা শোনার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিলো না। অরুণিকা এক পাশে বসে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে যতিকে বকে যাচ্ছে। সে যতির কথা বুঝতে না পারলেও এতোটুকু বুঝেছে, যতি তাকে পছন্দ করে না। আর আহনাফকে অনেক বিরক্ত করে। তাই অরুণিকাও যতিকে পছন্দ করে না।

এদিকে রাতে কেউই কোনো কথা বললো না। তাহমিদ অরুণিকার দিকে ভাতের প্লেট এগিয়ে দিয়ে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়লো। এরপর তূর্য অরুণিকাকে বিছানা করে দিলো। তারপর অরুণিকা বিছানায় উঠে যাওয়ার পর ঘরের বাতি বন্ধ করে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দিলো, কারণ অরুণিকা অন্ধকারে ঘুমাতে ভয় পায়। অরুণিকা বালিশে শুয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ শুয়ে পড়তেই সে বলল,
“আরাফ, তুমি এখানে বসবে না?”

আরাফ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ঘুমাও। আমার ঘুম আসছে।”

“আমার ভয় লাগছে। তুমি পাশে বসো।”

তূর্য বলল,
“আলো জ্বালানো আছে তো। তুমি ঘুমাও। আমরা এখানেই আছি।”

“না, আরাফ তো প্রতিদিন পাশে বসে থাকে। এখন এখানে বসো। আমার ঘুম আসছে না।”

প্রতিদিন ঘরের বাতি বন্ধ করে দেওয়ার পর যতোক্ষণ অরুণিকা ঘুমাবে না, ততোক্ষণ আরাফ তার পাশেই বসে থাকবে। আর মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে না রাখলে অরুণিকা কান্নাকাটি করে। এই কয়েক বছরেও তার এই অভ্যাস যায় নি। এদিকে আরাফকে আসতে না দেখে অরুণিকা মশারি তুলে নিচে নেমে আরাফের পাশে এসে বসলো। আহনাফ মাথায় বালিশ চেপে ধরে চেঁচিয়ে বললো,
“প্রতিদিন এক একটা ঝামেলা! আমি এসব আর নিতে পারছি না। এখন কি কেউ আমাকে ঘুমাতেও দেবে না?”

আহনাফের কথায় অরুণিকা আবার বিছানায় উঠে বসলো। সে এবার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ইভান অরুণিকাকে দেখে বলল,
“তুমি কি এখন ঘুমাবে নাকি বারান্দায় রেখে আসবো?”

অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“না, আমার ভয় লাগছে। এখানে এসে বসো, প্লিজ।”

তাহমিদ উঠে তার পাশে এসে বসলো। আর বলল,
“এখন ঘুমাও।”

অরুণিকা মশারির উপরই তাহমিদের শার্টের কোণা ধরে শুয়ে পড়লো। অরুণিকা ঘুমানোর পরই তাহমিদ বিছানায় শুতে গেলো।

সকালে চেঁচামেচির শব্দ শুনে দরজা খুললো আরাফ। বাইরে যতিকে দেখে সে অবাক হলো। শতাব্দী গেইটের কাছে এসে বলল,
“ও সবাইকে বলে দিয়েছে ছোট সখী তোমাদের বোন না, আর তোমরাও আপন ভাই না।”

আরাফ গেইট খুলে বের হতেই মহল্লার সব মহিলারা তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সুরাইয়া এসে বললেন,
“বোন না তো কি হয়েছে? বোনের মতোই তো। এটা নিয়ে তামাশা করার কি আছে?”

বাকি পাঁচ জন বের হতেই মহিলাগুলো বলতে লাগলো,
“আমরা এদের এই বাড়িতে থাকতে দেবো না। এতোগুলো ছেলে একটা মেয়ের সাথে এক বাড়িতে থাকবে! আগে মেয়েটা ছোট ছিল, এখন তো বড় হচ্ছে। একটা সম্মানেরও ব্যাপার আছে।”

যতি বলল,
“ভালো হয় অরুণিকাকে যদি কেউ নিজের মেয়ে হিসেবে আইনগতভাবে দত্তক নেয়। সে মা-বাবাও ফিরে পাবে, আর ওর ভবিষ্যও উজ্জ্বল হবে।”

আহনাফ যতির হাত চেপে ধরে বলল,
“তুমি আজ যা করলে এটা মোটেও ঠিক করো নি।”

যতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আর আমি এতোটাও বোকা নই। আমি সব বুঝি। হয়তো অরুণিকা তোমাকে নিয়ে কোনো রকম চিন্তায় করে না। কারণ ওর এখনো এসব বোঝার বয়স হয় নি। কিন্তু আমি জানি, তুমি ওকে নিয়ে কি চিন্তা করো।”

“তুমি পাগল হয়ে গেছো, যতি।”

“পাগল তুমি ওই মেয়ের জন্য হয়ে গেছো। সারাদিন অরুণিকা আর অরুণিকা। আমার সাথে বাইরে ঘুরতে গেলেও তুমি অরুর জন্য এটা নিলে ভালো হবে, ওটা দেখলে খুশি হবে, এসবই বলো। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, তোমার ওর জন্য আলাদা করে খাবার নিতে হয়, কেন? এতোদিন ভাবতাম ও তোমার আপন বোন। কিন্তু এখন জানলাম ও তোমার কাজিন। কাজিনের জন্য কেউ এতো কিছু কখন করে? কেন করে বলো?”

“ভালোবাসি তাই করি। কিন্তু এই ভালোবাসা তোমার মতো অসভ্য মেয়ে বুঝবে না। অরু, আমার কাজিন। আমার আপন চাচার মেয়ে। যেই চাচা মৃত্যুর আগে আমাদের ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। চাচার অবর্তমানে আমি ওকে আদর করবো, যত্ন নেবো, ভালোবাসবো, তাতে তোমার কি সমস্যা?”

যতি চোখের কোণে আসা পানিগুলো মুছে বলল,
“আমি তোমার মনে কখনোই ছিলাম না। আমি জানতাম, আমি তোমাকে কখনোই পাবো না। কিন্তু আমি মেয়ে, তাই অনেক কিছুই বুঝি। তুমি অরুণিকাকে নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করো। শুধু চিন্তা করা আর অধিকার দেখানো আলাদা ব্যাপার। বাকিদের মধ্যে আমি ওটা দেখি নি, যেটা তোমার মধ্যে দেখেছি।”

আহনাফ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি কি ভাবো না ভাবো আমার তাতে কোনো আসে যায় না।”

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৫||

৪২.
সুরাইয়া আর সালেহ আলী মহল্লার লোকেদের শান্ত করিয়ে অরুণিকাকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে সুরাইয়াকে বলল,
“বাঁধন এতো কিছু করার পর, আমরা অরুকে আপনাদের সাথে থাকতে দেবো না।”

সুরাইয়া কথাটি শুনে আরাফের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের কুকর্মের জন্য এখন কেউই তাদের বিশ্বাস করতে চাইছে না।

তূর্য মহল্লার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমরা অরুর অভিভাবক। আমরা থাকতে ও ওই বাড়িতে কেন থাকবে?”

তূর্যের প্রশ্নের উত্তরে মহল্লার একজন মহিলা বলে উঠলেন,
“বাবা-মার অবর্তমানে চাচা-চাচীই অভিভাবক হয়। প্রাপ্ত বয়ষ্ক যুবক ছেলে নয়। আজ তোমরা থাকবে, কাল অন্য ছেলেরাও তার বান্ধবীদের নিয়ে থাকতে চাইবে।”

ইভান রাগী কন্ঠে আরাফকে বললো,
“এদের কি মাথায় সমস্যা আছে? আমাদের সম্পর্কটাকে কিসের সাথে তুলনা করছে?”

আহনাফ আরাফের কাছে এসে বলল,
“অরুকে হোস্টেলে দিয়ে দে, আরাফ৷ নয়তো ওরা অরুকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে৷ হোস্টেলে থাকলে অন্তত অরুকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। আমরা ওকে সপ্তাহে একদিন দেখতে যাবো। কিন্তু এখন যদি কোনো পরিবার এসে ওকে নিয়ে যায়? তখন ও অন্য কোথাও চলে যাবে। এরপর ওর নতুন পরিবার যদি আমাদেরকে ওর সাথে দেখা করতে না দেয়? আমি ওকে যেতে দেবো না। আরাফ, কিছু তো কর।”

আরাফ আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“সব তোর জন্য হয়েছে। তোর যখন যতিকে ভালোই লাগতো না, তাহলে ওর সাথে সম্পর্কে কেন গিয়েছিস?”

আহনাফ যতির দিকে একনজর তাকালো। যতি একপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে আর আহনাফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“আমি তো যেতে চাই নি। তূর্য, ইমন ওরা আমাকে বাধ্য করেছিল।”

“নিজের ইচ্ছে না থাকলে কেউ বাধ্য করতে পারে না। আর আমি জানি, তুই কেন যতির সাথে সম্পর্কে গিয়েছিস!”

আহনাফ আরাফের হাত ধরে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে একবার আহনাফের দিকে তাকালো, আরেকবার আরাফের দিকে। আরাফ আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
“তুই যা চেয়েছিস তাই হয়েছে। এখন আর অরুর ব্যাপারে তোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।”

আহনাফ আরাফের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ঠিকই বলেছে, জোর করে কোনো সম্পর্ক শুরু হয় না। যতির সাথে সম্পর্কে যাওয়াটা শুধুই ইমন আর তূর্যের জোরাজুরিতে হয় নি। এখানে তারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই ইচ্ছেটা তো ভালোবাসা থেকে আসে নি। এই ইচ্ছের কারণটাই তো জটিলতায় ঘেরা। যেই জটিলতা তাকে কোনোভাবেই ভালো থাকতে দিচ্ছে না।

ছ’জনের কেউই রাতে ঘুমাতে পারে নি। আহনাফের কথায় বাঁধন আজ তাদের সাথেই ছিল। আর অরুণিকা সুরাইয়াদের বাড়িতে। মধ্য রাতে আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠে অরুণিকা যেই বিছানায় ঘুমায় সেখানে উঠে বসলো। আরাফ তাকে উঠে বসতে দেখে নিজেও বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর আহনাফের পাশে বসে বললো,
“ভালোবাসিস ওকে?”

আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি না। একদম ভালোবাসি না। কিন্তু কোথাও তো একটা মায়া আছে। আর আমি এই মায়া কাটাতে পারছি না। পারবো কিনা সন্দেহ।”

আরাফ বলল,
“কিন্তু তুই এটাই চেয়েছিলি।”

আহনাফ আরাফের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো।

আরাফ আবার বলল,
“অরু, আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে। দাদা-দাদী ওকে অনেক বেশি পছন্দ করতো। অরু বাড়ির সবার আদরের মেয়ে ছিল। ওকে এভাবে অন্য কেউ দত্তক নিয়ে যাবে, এটা অন্যায় হবে। ওর চৌধুরী বংশের পরিচয়েই বড় হতে হবে। কিন্তু এখন কি করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

আহনাফ বলল,
“পালিয়ে যাই চল। আবার কোনো নতুন ঠিকানা খুঁজে নিবো। আচ্ছা, দেশে ফিরে গেলেই তো ভালো হয়, তাই না? এই শহরে কোনো প্রাণ নেই। দেশে গিয়ে অরুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আমরা একটা বাসা নেবো। আবার সব নতুন করে শুরু করবো।”

আরাফ বলল,
“খবর রাখিস না, তাই এই কথা বলছিস।”

“কেন কি হয়েছে?”

“মির্জা গ্রুপের এমডি, এবারের ভোটে মন্ত্রী হয়েছে। তার এখন অনেক ক্ষমতা। আমাদের এখন জনসম্মুখে মেরে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না। অরুর মামার খবর নিলাম ওইদিন, শুনলাম হঠাৎ উনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। ওখানে বাড়িও কিনেছেন।”

“থানার ওসির তো এতো সামর্থ্য থাকার কথা না। আর যতোটুকু জানি, উনিই ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, অরুর মামা কি সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন?”

আরাফ বলল, “জানি না।”

“আমরা না হয় তার কেউই ছিলাম না। কিন্তু চাচী? নিজের বোনকে কি কেউ হত্যা করতে পারে?”

“ক্ষমতা আর টাকার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।”

আহনাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি জড়িত থাকলে ওনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় নি কেন? কিন্তু রহমত চাচা বলেছিলেন, সবাই উনাকে সন্দেহ করছে।”

আরাফ বলল,
“হয়তো উনাকে ছাড়িয়ে এনেছে আর মিডিয়ার সামনেও এই খবর আসে নি। অনেক খবরই তো মিডিয়ার কাছে পৌঁছায় না।”

আহনাফ অরুণিকার বালিশে মাথা দিয়ে বলল,
“এখন শুধু অরু আবার এখানে ফিরে আসুক। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

পরের দিন থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। কাজ, স্কুল কিছুই বন্ধ নেই৷ পার্থক্য শুধু অরুণিকা আর ছ’জনের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যাচ্ছে না। অরুণিকা ছ’জনের সাথেই নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। সে সুরাইয়াদের বাসায় কোনোভাবেই থাকতে চাইছে না। ঠিক মতো খাচ্ছে না। রাতে ঘুমানোর সময় কান্নাকাটি করে। এদিকে ছ’জনেরও একই অবস্থা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে আরাফ, তূর্য আর আহনাফের। তিন জনই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কলেজ শেষে এখন অরুণিকার স্কুলে চলে যায়। সেখানেই তাদের অরুণিকার সাথে দেখা হয়। কারণ মহল্লায় এখন তাদের একসাথে দেখলেই লোকজন কানাঘুঁষা করে। তারা বুঝতে পারছে না, অরুণিকার সাথে কথা বললে, তাদের সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু সমস্যাটাতে যে যতি মারাত্মক জট লাগিয়ে দিয়েছে। এখন এই জটের সমাধান একমাত্র সময়ই দিয়ে দেবে।

এক সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেছে। এক সপ্তাহ পর এনজিও থেকে দুইজন মহিলা এলো। অরুণিকাকে তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে দত্তক দেওয়া হবে। যতি জানতে পেরেছিলো সুরাইয়া আর সালেহ আলী তাদের আপন চাচা-চাচী নয়। তাই সে তার কাজিনের সাহায্য নিয়ে এই কথা এনজিওর লোকদের জানায়। তারা সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের হাতেই অনাথ বাচ্চাদের দত্তক দেয়।

এদিকে অরুণিকাকে নিতে আসলেই ইমন এসে তাদের আটকায়। কিন্তু কোন সম্পর্কে সে অরুণিকাকে ধরে রাখবে? একজন বেকার অবিবাহিত ছেলে একটা আট বছর বয়সী মেয়েকে দত্তক নেবে, এটা তো সম্ভব না। অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমি ওদের সাথে যাবো না। তুমি অনেক পঁচা। তুমি আমাকে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছ।”

অরুণিকা কেঁদেই দিয়েছে। ওর কান্না ক্রমশ বাড়ছে। তার চোখে পানি দেখে আরাফ আর তূর্য ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহনাফ নিজের অশ্রু গুলো আটকে রেখেছে। তার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। ইমন আর তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এখনো বুঝতে পারছে না, হঠাৎ সবকিছু এমন উলোটপালোট কেন হয়ে গেল? তবে ইভান শান্ত হয়ে বসে নেই। সে কাঁদছে না, বরং অরুণিকাকে আইনগত ভাবে এমন পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ইভানকে সাহায্য করছে শতাব্দীর বাবা।

অরুণিকা এনজিওর মহিলাদের সাথে যাওয়ার পর থেকেই কান্নাকাটি করে পুরো আশ্রম মাথায় তুলে ফেলেছে। যতির কাজিনের বান্ধবী এনজিওতে কাজ করে। সে-ই অরুণিকাকে এই আশ্রমে নিয়ে এসেছে। এদিকে ইভান থানায় যতির বিরুদ্ধে মামলা করে এসেছে। তারা ঘটনা ভালোভাবে তদন্ত করবে বলে ইভান আর মাস্টারমশাইকে আশ্বস্ত করে বিদায় করলো।

এদিকে অরুণিকা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সে এতোদিন সুরাইয়ার সাথে থেকেছিল, কারণ সে ছোটবেলা থেকেই সুরাইয়াকে দেখে আসছে। কিন্তু এখন এখানের কাউকেই সে চিনে না।

যতি বিকেলে আশ্রমে এসে অরুণিকার সামনে বসলো। অরুণিকা ক্ষুব্ধ হয়ে তার পাশে থাকা ফুলদানিটি যতির দিকে ছুঁড়ে মারলো। যতি তাড়াতাড়ি সরে যাওয়াতেই অল্পের জন্য রক্ষা পেলো। সে অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারি। আমার সেই ক্ষমতা আছে। দেখেছো, তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছি? আমি তোমাকে আহনাফ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”

অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি অনেক খারাপ। আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। যাও এখান থেকে। যাও, যাও।”

অরুণিকা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে। সেখানে কর্মরত একজন কর্মচারী দৌঁড়ে অরুণিকার কাছে এলেন। তিনি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরতেই, সে মহিলাটির বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলো। যতি উঠে যেতেই অন্য শিফটে থাকা একজন কর্মচারী তার পথ আটকে বলল,
“তুমি এখানে কেন এসেছো? তোমাকে এখানে আসার অনুমতি কে দিয়েছে?”

যতি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোশিবা, আমি ওর বান্ধবী। আমি আমার এক্স প্রেমিকের চাচাতো বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

যতি আশ্রম থেকে বের হতেই আহনাফ আর ইভানের মুখোমুখি হলো। আহনাফ তাকে দেখে বলল,
“তুমি এখানে?”

যতি মুচকি হেসে বললো,
“অরুর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাদের একা ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। প্লিজ তুমি আমার জন্য অরুর কোনো ক্ষতি করো না।”

“তুমি কি চাও অরু আবার ওই ঘরে ফিরে যাক?”

ইভান বলল,
“অবশ্যই। আর খুব শীঘ্রই এটা হবে। তোমার এসব উদ্ভট ষড়যন্ত্র বেশিদিন ঠিকবে না। কারণ তোমার এই কাজগুলো খুবই অযৌক্তিক ছিল। আর অরুণিকাকে আমাদের সাথে রাখার অনেক যৌক্তিকতা আছে।”

“হ্যাঁ, তবে ভালো হবে যদি আহনাফ আমাকে বিয়ে করে ফেলে। এমনিতেই আইনগত ভাবে আমাদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আর বিয়ের পর অরুণিকা ভাইয়া-ভাবীর সাথে থাকতেই পারে।”

আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই যে আজ সকালে বললি, অন্য উপায়ে অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।”

“হ্যাঁ।”

“আমি উপায় পেয়েছি।”

যতি কথাটি শুনে হাসলো। আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে ধন্যবাদ, আমার মাথায় ভালো একটা বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছ। এখন বাসায় গিয়ে তোমার মাথাটাকে বিশ্রাম দাও। এতো ঝামেলা সৃষ্টি করেছো, দেখা যাবে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটবে।”

ইভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“যার মস্তিষ্ক আগে থেকেই বিকৃত, তার আবার নতুন করে বিকৃতি হবে না।”

আহনাফ ইভানকে নিয়ে অরুণিকার সাথে দেখা না করেই বাসায় চলে এলো। সে অরুণিকাকে বের করে আনার সেই উপায়টি সবাইকে বলল। সব শুনে আরাফ ছাড়া সবাই অবাক হলো। ইমন বলল,
“অরুকে বিয়ের চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, আহনাফ?”

ইভান বলল,
“ও ঠিকই বলেছে। এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। আর এটা সম্ভবও। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। তবে খুবই কম।”

তাহমিদ বলল,
“সব বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের চুক্তি কার সাথে হবে?”

তূর্য বলল,
“আমাদের মধ্যেই কি কেউ একজন এই চুক্তি করবে? আর এটা তো কোর্টে গিয়ে জানাতে হবে। তারপরই তো সব সম্ভব হবে। কিন্তু টুইংকেল যদি বড় হয়ে এই চুক্তির জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যায়? ওর তো একটা পছন্দ থাকতে পারে, তাই না?”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ও চলে গেলে আটকাবো না। আমরাই ওর বিয়ে দেবো। চুক্তিটা শুধু ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য হবে। বিয়ে তো আর করছি না। শুধু চুক্তি করছি। আর অরু এখানেই থাকতে চাইবে। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ও কোর্টে জানাবে ও আমাদের সাথেই থাকবে। ওর মতামত শুনে এই চুক্তির কথা উঠবে। তারপর আমাদের মধ্যেই কেউ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এরপরই সে আইনগত ভাবে অরুর দায়িত্ব নেবে।”

তাহমিদ বলল, “কিন্তু সে কে হবে?”

সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। আরাফ তখন বলে উঠল, “আহনাফ।”

তূর্য কথাটি শুনে ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকালো। ইমন বলল,
“আহনাফের প্রেমিকার জন্য এতোকিছু হয়েছে, ও কেন দায়িত্ব নেবে?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে কি তুই নিতে চাস?”

ইমন ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, ভাই তো নিতে পারতো।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুই আমার কথা কেন বলছিস? মাওশিয়াতের জন্য?”

ইমন আমতা-আমতা করে বলল,
“চুক্তি করলে বিয়ে হয়ে যায় নাকি!”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি কোনো চুক্তি করতে পারবো না।”

তাহমিদ বলল,
“ভাই, তোরা দুই জন এখনো যুদ্ধ করবি? আর আমার মনে হয়, আরাফ ঠিকই বলেছে। আহনাফই এই চুক্তিতে আসুক। যতির একটা ভালো শিক্ষা হবে। আর চুক্তি মানে তো বিয়ে না। ওর তো বয়স হয় নি। আর অরুণিকার আঠারো বছর হওয়ার আগেই আমরা এই দেশ ছেড়ে বের হয়ে যাবো। আর মাত্র চার-পাঁচ বছর এখানে থাকতে হবে।”

পরের দিন মাস্টারমশাইকে সব জানাতেই তিনি অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার উপায়টি পছন্দ করলেন। তিন দিন পর কোর্টে গিয়ে লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হলো। এবার যতির বাবা-মার কানেও এই খবর পৌঁছালো। আহনাফকে পাওয়ার জন্য তাদের মেয়ে এমন উদ্ভট কাজ করবে তারা সেটা কল্পনাও করতে পারে নি। যতির মা ইচ্ছেমতো মেয়েকে মারলেন। যতিকে বাসায় আটকে রাখা হলো। তার বাবা তার কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন। মেয়ের জন্য পুলিশ তার বাসায় এসেছে, এটা তার জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। এদিকে মাওশিয়াত সব শুনে তার বাবাকে বলেছে ছয় জনকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে। মাওশিয়াতের বাবাও এগিয়ে এলেন।
এদিকে তদন্ত করে এনজিওর সদস্য তোশিবার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হলো। কারণ সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অরুণিকাকে নিয়ে এসেছে। আর এটা আরো সম্ভব হয়েছে অরুণিকা শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায়।কারণ আশ্রমে গিয়ে অরুণিকা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর প্রশাসনিকে ভাবে মহল্লার লোকেদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, অরুণিকাকে খাওয়া- পড়া আর ওর দেখাশুনার কোনো কমতি রাখে নি সেই ছয় জন যুবক। শেষমেশ বিয়ের চুক্তিতেই অরুণিকাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।

বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে অরুণিকাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নেবে আহনাফ, এই চুক্তিতে আহনাফ স্বাক্ষর করলো। অরুণিকাকে তার নাম লিখতে বলা হলো। সে কাঁচা হাতে না বুঝেই স্বাক্ষর করলো। এরপর আইনগত ভাবে তারা অরুণিকাকে ফিরে পেলো। তবে এবার তারা আর পুরোনো বাসায় গেলো না। মাস্টারমশাই তাদের অন্য মহল্লায় তিন রুমের বাসা খুঁজে দিলেন। অরুণিকা বড় হচ্ছে, তাই এখন তার জন্য আলাদা ঘর থাকা প্রয়োজন। তারা কোর্ট থেকেই সরাসরি নতুন বাসায় উঠলো। নতুন বাসায় উঠে অরুণিকা অনেক খুশি। এখনো জিনিসপত্র না আসায় ঘরটা খালি খালি লাগছে। শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরুণিকা সেই প্রতিধ্বনিত শব্দ শুনে মজা পাচ্ছে।

সমাজের নিয়মগুলো জটিল হয়। কিন্তু আত্মার সম্পর্কের কাছে সব জটিলতার পরাজয় ঘটে। এই কয়েক সপ্তাহ ছয়টা ছেলের অস্থিরতা, সেই বারান্দার সামনে নিঃস্ব মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, সকাল হলেই পানির জন্য ছোটাছুটি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অরুণিকাকে খাওয়ানো, এখন সবই শূন্য। যারা তাদের বিরুদ্ধে ছিল, এখন তারাই সেই শূন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছেলেগুলো অনেক ছুটেছে। কিন্তু তারা হেরে যায় নি। তাদের কাছে সমাজই হেরে গেছে। তারা জয়ী হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে আত্মার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি গভীর হয়।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here