অরুণিকা পর্ব -৫৭+৫৮+৫৯

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৭||

৯৪.
রাত দশটায় অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে আরাফ স্টেজে উঠে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজ আমাদের বন্ধু তার ভালোবাসার মানুষের সাথে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। আজকের এই দিনটি আরো বেশি মনে রাখার জন্য আমরা আরেকটা সুসংবাদ আপনাদের দিতে যাচ্ছি। আর হবে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান।”

সবাই আরাফের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আরাফের ইশারায় আহনাফ স্টেজে উঠে তার পাশে দাঁড়ালো। আর তাহমিদ অরুণিকার হাত ধরে তাকে স্টেজে উঠলো। অরুণিকা ফিসফিসিয়ে তাহমিদকে বলল,
“তাহমিদ, আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দেবে নাকি? আমি তো এখনো কোনো প্ল্যানই করি নি৷ এভাবে আমি বিয়ে করবো না।”

অরুণিকা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদ হাতের ইশারায় অরুণিকাকে চুপ করে থাকতে বললো। এবার আরাফ দুইটা রিং পকেট থেকে বের করে একটা আহনাফের হাতে দিলো, আরেকটা অরুণিকার হাতে দিলো। তারপর বলল,
“আগামী মাসে মাওশিয়াতকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে আসার পর আমাদের অরু আর আহনাফের বিয়ের আয়োজন হবে। তবে আজই তাদের এনগেজমেন্টটা রেখেছি। এটাই ছিল আজকের সারপ্রাইজ।”

অরুণিকা আর আহনাফ মুখোমুখি দাঁড়ালো৷ অরুণিকা হাত এগিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি আমার বিয়ে নিয়ে কতো প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছি, আমার এনগেজমেন্ট ঝর্ণার পাশে হবে, আর তোমরা ভূতের বাড়িতেই আমার এনগেজমেন্ট রেখেছো।”

আহনাফ আড়চোখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি রিং পরিয়ে দেওয়ার জন্য ইশারা করলো। আহনাফ রিং পরিয়ে দেওয়ার পর অরুণিকা আহনাফের আঙ্গুল ধরে বলল,
“এক শর্তে আমি তোমাকে রিং পরাবো।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার সব ব্যাপারে এতো শর্ত কেন থাকে?”

আরাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অরু, সবাই দেখে আছে। তাড়াতাড়ি রিং পরিয়ে দাও।”

অরুণিকা বলল,
“আগে ওকে বলো, আমার শর্ত মেনে নিতে।”

আহনাফ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোমার সব শর্ত পূরণ করবো।”

অরুণিকা হেসে বলল,
“আমাকে বাইকে করে পুরো চট্টগ্রাম শহরে ঘুরাতে হবে, আর আমি সেদিন যা ইচ্ছে করবো, তুমি আমাকে একটুও বকা দিতে পারবে না।”

আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে, এটা কোনো শর্ত হলো? আমি এই সপ্তাহেই তোমাকে নিয়ে ঘুরার প্ল্যান করবো। এখন আল্লাহর ওয়াস্তে রিং-টা তো পরিয়ে দাও।”

অরুণিকা রিং পরাতে পরাতে বলল,
“রিং পরার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে।”

আহনাফ চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরেরদিন সকালে কলিং বেল বাজতেই উপমা এসে দরজা খুলে দিলো। দেখলো বাড়ির দারোয়ান এসেছে। উপমা বলল,
“রহিম, তুমি এতো সকাল সকাল? কিছু লাগবে?”

“আপামণি, কে একজন এসেছে। স্যারদের খুঁজছে। ছোট মেডামকেও দেখতে চাচ্ছে।”

“কি নাম?”

“নাম বললো, রহমতুল্লাহ।”

“আরেহ উনি? আমি তোমার স্যারকে ডাকছি। উনি অনুমতি দিলে ঢুকতে দিও।”

উপমা তূর্যকে বলতেই তূর্য ইমনকে ডেকে ঘুম থেকে উঠালো। ইমন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে বলল,
“আমি উনার সাথে কথা বলছি। তুই বাকিদের আসতে বল।”

এবার নিচে নেমে ইমন রহমতুল্লাহকে বাসায় আনলো। আর সোফায় বসতে বলল। রহমতুল্লাহ বললেন,
“বড় হয়ে আমাকে একেবারে ভুলে গেছো।”

ইমন মুচকি হেসে বলল,
“ভুলে যাই নি। আপনাকে তো ভুলে যাওয়া সম্ভব না৷ শুধু ব্যস্ততার চাপে সময় পাচ্ছি না।”

“চার বছর হয়ে গেছে বাংলাদেশে এসেছো। এখানে আসার পর কোনো যোগাযোগ রাখো নি৷ তোমাদের নম্বরও ছিল না, বাসার ঠিকানাও জানতাম না। তাই মাঝে মাঝে তোমাদের অফিসে চলে যেতাম। ওখানেও দেখা পাই নি। এরপর আরাফের চেম্বারে গিয়েছিলাম। ও ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে গেলো। তোমরা এভাবে মুখ ফিরিয়ে না নিলেও তো পারতে। আমি গরিব মানুষ বলে কি তোমাদের কাছে টাকা খুঁজতে আসতাম?”

ইমন বলল,
“এখন ঠিকানা কিভাবে পেয়েছেন?”

“তোমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে জানতে পেরেছি তোমরা এই এলাকায় থাকো। তারপর সব বাড়ি ঘুরে টুইংকেল হাউজ দেখেই বুঝে ফেলেছি, এটাই তোমাদের বাড়ি।”

এদিকে বাকিরাও নিচে নামলো। তূর্য বলল,
“তা আপনার কি অবস্থা?”

রহমতুল্লাহ বললেন,
“ভালোই আছি। তোমরা শুধু এই গরিবের কোনো খবর নাও না।”

তাহমিদ হেসে বলল,
“আপনি আবার গরিব হলেন কখন? ভালোই তো আমাদের পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন। সামর্থ্য নেই, তবুও মাস শেষে আমাদের অনেক টাকা পাঠিয়েছিলেন। আপনার ঋণ তো শোধ করা সম্ভব না।”

রহমতুল্লাহ হালকা হাসলেন। আরাফ বলল,
“তা আপনার কার কার সাথে উঠাবসা হয়?”

রহমতুল্লাহ আরাফের প্রশ্নে চমকে উঠলেন। তখনই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে পড়লো অরুণিকা। অরুণিকার শব্দ পেয়ে রহমতুল্লাহ বললেন,
“আমাদের ছোট্ট সোনামণি!”

অরুণিকা বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে রহমতুল্লাহকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। তিনি হাতের ইশারায় অরুণিকাকে ডাকলেন। অরুণিকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ রহমতুল্লাহ মুগ্ধ হয়ে অরুণিকাকে দেখে বললেন,
“মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছো। তোমাকে যখন দেখেছিলাম, চার বছরের ছিলে।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তাহলে আমাকে কিভাবে চিনলেন?”

অরুণিকার প্রশ্নে ছ’জনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রহমতুল্লাহর দিকে তাকালো। রহমতুল্লাহ জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“আরেহ, আন্দাজ করেছি।”

“বাসায় তো ভাবীও আছে। ভাবীকে দেখে আন্দাজ করেন নি?”

“তোমার চেহারা তো তোমার বাবার মতো হয়েছে। তাই চিনতে পেরেছি।”

“আপনি আমার বাবাকেও চিনেন?”

“হ্যাঁ। চিনতাম তো। তুমি তো তোমার বাবার রাজকন্যা ছিলে।”

আরাফ অরুণিকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকার চোখাচোখি হতেই সে ইশারায় অরুণিকা ভেতরে যেতে বললো। অরুণিকা আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলো। রহমতুল্লাহ টুকটাক অনেক কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে অরুণিকা সেই মুহূর্তে কলেজের জন্য বের হলো। রহমতুল্লাহকে দেখে সে বলল, “আল্লাহ হাফেজ, আংকেল।”

“কোথায় যাচ্ছো, মা?”

“কলেজে যাচ্ছি।”

“ওহ, আচ্ছা।”

রহমতুল্লাহ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “একা যাচ্ছো?”

“না, আহনাফ নিয়ে যাবে।”

“আহনাফ কোথায়? দেখছি না যে!”

“আসছে।”

রহমতুল্লাহ কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে বললেন,
“শুনলাম তোমার সাথে আহনাফের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

অরুণিকা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ।”

“তুমি রাজি হয়ে গেছো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এটা কেমন কথা, মা? তুমি আহনাফকেই বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছো? আহনাফ তোমার চেয়ে এগারো-বারো বছরের বড়। আজকাল কি এতো বয়সের ব্যবধানে বিয়ে হয়?”

অরুণিকা রহমতুল্লাহর কথায় ভাবনায় পড়ে গেলো। হ্যাঁ, সে তো এটা আগে ভেবে দেখে নি। রহমতুল্লাহ অরুণিকাকে ভাবতে দেখে বললেন,
“কিছু মনে করো না মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম, করুন।”

“তোমার কি আহনাফকে পছন্দ? মানে তুমি কি ওকে ভালোবাসো?”

“না, তো।”

“তাহলে বিয়েতে কেন রাজি হয়েছো?”

“আরাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও চায়, আমার আর আহনাফের বিয়ে হোক।”

“ব্যস, এতেই রাজি হয়ে গেছো?”

“হ্যাঁ।”

রহমতুল্লাহ এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“সম্পত্তির লোভ মানুষকে কি থেকে কি বানিয়ে দেয়! একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এতো বড়ো ছেলের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে? কিছু মনে করো না, তোমার তো মাত্র আঠারো হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি কেউ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় না। তোমার কি পড়াশুনা করার ইচ্ছে নেই? ক্লাসে সবাই তোমাকে বিবাহিতা মনে করবে। তোমার স্বপ্নগুলো কখনো পূরণ হবে না। বিয়ে তো একটা দায়িত্ব। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েও একপ্রকার ব্যবসা হয়ে গেছে। আজকাল টাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি আপনার কথাটা বুঝতে পারলাম না। ব্যবসা মানে?”

“আরেহ, তোমার বাবাদের ব্যবসায়িক গ্রুপটা আবার চালু হয়েছে শুনো নি?”

“হ্যাঁ, শুনেছি। তার সাথে আমার বিয়ের কি সম্পর্ক?”

“শুনো, মৈত্রী গ্রুপের দুইটা ইউনিট। বি ইউনিটের ৫০ ভাগ অংশ ইমনের নামে। আর বাকিগুলো তূর্য আর ইভানের। আর এ ইউনিটের ৫০ ভাগ অংশ তোমার নামে। বাকিগুলো আরাফ, আহনাফ আর তাহমিদের। এই ৫০ ভাগ নিজেদের কাছে রাখার জন্য আহনাফ তোমাকে বিয়ে করছে। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেই ৫০ ভাগ অন্য কারো হয়ে যাবে। এখনো বুঝো নি?”

অরুণিকা চুপ হয়ে গেলো। সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আহনাফ আমাকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য বিয়ে করছে?”

“হ্যাঁ। আর নয়তো কেন বিয়ে করবে?”

“আরাফ এসব জানে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই জানবে।”

“তাহলে আহনাফই কেন বিয়ে করছে?”

“আরেহ, ইমন আর তূর্য তো বিয়ে করে ফেলেছে। আর তাহমিদ তো অন্য কাউকে ভালোবাসতো। আরাফ এমনিতেই ব্যবসা করতে ইচ্ছুক নয়। ও তো ডাক্তার মানুষ। ও ব্যবসা কেন কর‍তে যাবে? ও শুধু ব্যবসার লাভের অংশটাই পাবে। আর আহনাফ তো চমৎকার ব্যবসায়ী। ইটা গ্রুপের এতো উন্নতি তো আহনাফ আর ইমনের সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার কারণে হয়েছে। এদের মস্তিষ্ক খুবই তীক্ষ্ণ৷ কখন কি সিদ্ধান্ত নিতে হয় এরা ভালো করেই জানে।”

কথাটা বলেই রহমতুল্লাহ চলে গেলেন। অরুণিকা আবার ঘরে ঢুকে গেলো। আহনাফ সিঁড়ি বেয়ে নেমে অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,
“আমার বাইকের চাবিটা কোথাও পাচ্ছি না!”

অরুণিকা শীতল কণ্ঠে বলল,
“আলমারির ভেতরে।”

“ওখানে কে রেখেছে?”

“আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমাকে বিরক্ত করার প্ল্যান ছিল, তাই না?”

অরুণিকা কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহনাফ চাবি এনে অরুণিকাকে নিয়ে বাইকে উঠলো। অরুণিকা চুপ করে আছে দেখে আহনাফ বলল,
“আজকে মিস অরুর ইঞ্জিন বন্ধ কেন? তেল শেষ হয়ে গেছে নাকি?”

অরুণিকা আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে কলেজে দিয়ে আসো।”

আহনাফ লুকিং গ্লাসে অরুণিকাকে একনজর দেখে বাইক চালাতে লাগলো। কলেজের সামনে নেমে অরুণিকা ভেতরে চলে গেলো। একবারও আহনাফের দিকে তাকালো না। আহনাফ অরুণিকার ব্যবহারে অবাক হলো। অন্যদিন সে পুরো রাস্তা বকবক করে আসে, আর বাইক থেকে নামার পর আহনাফকে চিমটে দিয়ে আসে বা কখনো মানিব্যাগ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে ফেলে। আর আজ এসব তো করলোই না, উলটো ফিরেও তাকালো না। আহনাফ কিছুক্ষণ অরুণিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাইক নিয়ে সোজা অফিসে চলে গেলো।

৯৫.

একটি রেস্টুরেন্টে তাহমিদের মুখোমুখি বসে আছেন মুরশিদ জুবাইয়ের। তাহমিদের দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটছে। সে একবারো মুরশিদ জুবাইয়েরের চোখাচোখি হয় নি। সে টেবিলের উপর একটা হাত উঠিয়ে রেখেছে, এখন তার দৃষ্টি ঘড়ির দিকে। মুরশিদ জুবাইয়ের ঝুঁকে তাহমিদের হাতের উপর হাত রেখে বললেন,
“একবারো আমার দিকে তাকাও নি। তাহমিদ আমি তোমার মামা।”

তাহমিদ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “কেন ডেকেছেন?”

“হুম। শুনলাম এবং দেখলাম, তোমরা আবার মৈত্রী গ্রুপ চালু করেছো।”

“হ্যাঁ করেছি। তো?”

“তো! এটা তোমরা ভালো করো নি।”

তাহমিদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“শত্রুর ভয়ে লুকিয়ে থাকার মতো মন-মানসিকতা আমাদের নেই। আমাদের বাবারাও তেমন ছিলেন না। কিন্তু আমাদের শত্রুরা তো কাপুরুষ। তাই পেছন থেকে আঘাত করেছে। এমনিতেই কাপুরুষদের সামনা-সামনি এসে দাঁড়ানোর মতো সাহস নেই।”

“দেখো, তুমি আমার মরিয়মের শেষ চিহ্ন। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তাহমিদ এসব ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দেবো। ওখানে গিয়ে বিয়ে করো, সংসার করো, একটা ভালো চাকরি করো। কিন্তু বাংলাদেশের টপ বিজনেস গ্রুপগুলোকে চ্যালেঞ্জ কর‍তে যেও না। এরা মানুষ না। ক্ষমতার জন্য এরা মানুষ খুন করে ফেলে।”

“আপনি এই কথা বলছেন? আপনার হঠাৎ আমার প্রতি এতো মায়া কেন জেগে উঠেছে?”

“আমি তোমার মামা। আমার তোমার প্রতি মায়া থাকবে না? কি বলছো এসব তাহমিদ?”

“আমাদের শত্রুদের সাথে তো আপনার ভালোই আঁতাত আছে।”

মুরশিদ জুবাইয়ের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

“মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপের একটা প্রজেক্টে ভালোই ইনভেস্ট করেছিলেন।”

মুরশিদ জুবাইয়ের হেসে বললেন,
“আমার সম্পর্কে সব তথ্য নিয়ে ফেলেছো দেখছি। জেনে যেহেতু গেছো তাহলে শুরু থেকে সবটা বলছি। তোমার মায়ের সাথে আমার মনোমালিন্য হওয়ার কারণ তোমাদের অরূপা ফুফি। অরূপা যেই ছেলেকে ভালোবাসতো, সে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিল। আর অরূপাকে ভালোবাসতো রিয়াজ। রিয়াজকে তো চেনোই, বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমান। চৌধুরীদের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সে কলেজ জীবনে আমার ভালো বন্ধুও ছিল। অরূপা আত্মহত্যা করার আগে আমি তোমার বাবাকে বলেছিলাম, রিয়াজের সাথে বিয়ে না দিয়ে যাতে ওই ছেলেকেই মেনে নেয়। অরূপার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয়েছিল। ও আমাকে সেই ছেলের কথা বলেছিল। আমিই ওকে বলেছি, একটু ধৈর্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ও আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। আর সবাই মনে করতো, আমিই ওকে ইনফ্লুয়েন্স করেছি। আমার খুব রাগ হয়েছিল তখন, তাই আর কারো সাথে যোগাযোগ করি নি। পরে অবশ্য তোমার বাবা, আর চৌধুরীদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। কথাও হয়েছিল। আর অরূপাকে হারানোর পর রিয়াজ এখনো বিয়ে করে নি। আমি ওকে ভালো জানি। তাই ওর গ্রুপে ইনভেস্ট করা আমার অসুবিধের মনে হয় নি। আর মির্জা গ্রুপে ইনভেস্ট করেছি, রিয়াজের কথায়। কারণ ও চেয়েছিল মির্জাদের পেছনে ফেলার জন্য ওদের একটা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া উচিত। সেই সূত্রে এই ইনভেস্টমেন্ট। এগুলো বিজনেস পলিসি। তুমি এসব দেখে নিজের মামাকে সন্দেহ করছো?”

“তাহলে কেন বার-বার আমাদের সরে যেতে বলছেন? আপনার বিজনেস পলিসি ঠিক রাখার জন্য?”

“না, তাহমিদ। আমি জানি না সেদিন মৈত্রী ম্যানশনে হত্যাযজ্ঞ কে চালিয়েছিল। কিন্তু এতোটুকু জানি যেই করেছে সে এখন বিজনেসের টপ পজিশনে আছে। আর তারা তোমাদের হটিয়ে দিতে আবার খুন করবে। তাই আমি চাই নি তোমরা কলকাতা থেকে আসো।”

মুরশিদ জুবাইয়ের এবার কলকাতায় তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা, তাদের পড়াশুনার খরচ দেওয়া, তাদের সাথে ঘটা প্রতিটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার লোক রাখা এবং বিক্রমকে বলে তাদের সাহায্য করার সব ঘটনা খুলে বললেন। তাহমিদ সব শুনে বলল,
“আমার তো রহমতুল্লাহকে সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু আপনি বললেন, রহমত চাচা আপনার কথায় আমাদের সাহায্য করেছেন।”

“রহমতকে তো আমারও সন্দেহ হচ্ছে। ও আজকাল অনেক রহস্যময় কথাবার্তা বলছে। কিন্তু সেদিন রহমতই আমাকে সাহায্য করেছিল।”

এবার মুরশিদ জুবাইয়ের অতীতের সেই দিনটিতে ফিরে গেলেন। জুবাইয়ের করিম ফোন করে সেদিন রাতে তাকে বলেছিলেন,
“হ্যালো, মুরশিদ আমরা শেষ হয়ে গেছি। তুমি এক্ষুনি আমবাগান যাও। আরাফরা স্কুলের পিকনিকে গিয়েছে। তাহমিদও আছে তাদের সাথে। ওরা বাসায় ফেরার আগেই তুমি ওদের আটকাতে পারলে বেশি ভালো হবে। নয়তো আমিই ওদের আমবাগান পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”

মুরশিদ জুবাইয়ের ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে জুবাইয়ের ভাই?”

জুবাইয়ের করিম চৌধুরী কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“বাসায় খুন হয়েছে। জিহানের মাকে নিয়ে বের হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও হয়তো আর বেঁচে নেই। বাকিরা কোথায় আছে জানি না। ঘরে সবার লাশ পড়ে আছে। এখন হাকিমের ঘরে ঢুকেছে। ওরা ইমতিয়াজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। একটু পর হয়তো এই বাড়িতেও লাগিয়ে দেবে। আমি এখান থেকে বের হতে পারবো কিনা জানি না৷ বের হতে পারলে আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ, আমার অরুকে নিয়েই বের হবো। আর তার দায়িত্ব আরাফ আর আহনাফের উপর ছেড়ে যাবো।”

মুরশিদ জুবাইয়েরের কপালে ঘাম জমেছে। তিনি কাতর কন্ঠে বললেন,
“ভাই সাহেব, খুব ভয় লাগছে। কি বলছেন আপনি?”

“আমাদের কেউ একজন খুন করতে এসেছিল। আমি তাকে চিনি। কিন্তু বুঝতে পারছি না সে কে! মুরশিদ, এখন বাসায় আর কেউ বেঁচে নেই হয়তো। কিন্তু আনিস মুখোশধারী লোকটার চেহারা দেখেছিল। ও কথা বলতে পারছিলো না। ইশারায় একটা কোড নম্বর দিয়েছে, আমি একটা কাগজের সাথে সেই নম্বরটি পাঠিয়ে দেবো। কাগজের লেখা নামগুলোর মধ্যেই খুনীর পরিচয় থাকবে।”

মুরশিদ জুবাইয়ের এবার বাস্তবে ফিরে এলেন, আর তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“জুবাইয়ের সাহেব ঘরে আগুন লাগার সাথে সাথেই ফোন কেটে দেন। এরপর আমি তড়িঘড়ি করে তোমাদের স্কুলে চলে যাই, আর রহমতুল্লাহকে আমবাগান পাঠিয়ে দেই। তোমাদের সাথে অরুণিকা থাকবে এটা আমি জানতাম। কিন্তু রহমতুল্লাহকে বলি নি। এরপর তোমাদের সিলেট নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর‍তে বলি। রহমতুল্লাহ আমাকে আশ্বস্ত করেন, বাকি সব কিছু উনি সামলে নেবেন। উনি যা বলেছিলেন, তাই করেছেন। কিন্তু ইদানিং আমার মনে হচ্ছে, এসবের পেছনে উনার কোনো স্বার্থ ছিল। আমি চাই নি তোমরা দেশে ফিরো। কিন্তু উনি চাইতেন তোমরা বাংলাদেশে আসো। কেন চান এটাই আমি বুঝতে পারছি না।”

তাহমিদ স্থির হয়ে বসে রইলো। মুরশিদ জুবাইয়েরের হঠাৎ জরুরী কাজে ফোন আসায় উনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। তাহমিদ অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। মামার শরীর থেকে সে মায়ের ঘ্রাণটাও পাচ্ছিলো, তাই হয়তো এতো খারাপ লাগছে। বাসায় এসে সে বাকিদের পুরো ঘটনা জানানোর পর ইভান বলল,
“তাহলে সেদিন আমবাগানে মুরশিদ মামার যাওয়ার কথা ছিল!”

ইমন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ওয়েট, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? আনিস আংকেল খুনিকে চেনার জন্য কোড দিয়েছেন। কিন্তু জুবাইয়ের আংকেল খুনিকে চেনেন না, অথচ জানেন এটা আমাদের পরিচিত কেউ, তার মানে!”

“তার মানে?”

“কোডযুক্ত সেই ব্ল্যাককোট, যেটা মৈত্রী গ্রুপের একটা অনুষ্ঠানে সবাইকে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের জন্যও তো ছোট সাইজে বানানো হয়েছিল। ওখানে নম্বরও ছিল। আমাদের জন্মসাল।”

আহনাফ বলল,
“হ্যাঁ, জন্মসাল দিয়েই তো কোটটা তৈরী করা হয়েছিল। আর সেদিন ঝোপের আড়াল থেকে আমরা সবাইকে কোট পরাই দেখেছি।”

“তাহলে কে খুনী?”

“শাহেদ মির্জাও সেই অনুষ্ঠানে ছিল। রিয়াজুর রহমান, শাহবাজ খান এরাও ছিল। আর সেই রাহেলার সিমটাও কিন্তু শাহবাজ খানের নামে।”

তাহমিদ বলল,
“শাহবাজ খানই এই কাজ করেছে। আর রহমতুল্লাহ তাকে সাহায্য করছে। মির্জা গ্রুপও তাকে সাহায্য করেছে।”

চলবে—#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮||

৯৫.
রুমের বাইরে থেকে অরুণিকার ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ পেয়ে দরজায় ঠোঁকা দিলেন আরবান তালুকদার৷ অরুণিকা কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চোখ মুছে দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। আরবান তালুকদার ভেতরে এসে অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে না বলতেই তার চোখ বেয়ে টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আরবান তালুকদার ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছো আমাকে বলো? অরুণিকা, আমি তো তোমার বাবার মতোই। আমাকে বলো মা, কি হয়েছে?”

অরুণিকা তার টেবিলে রাখা ছবির ফ্রেমটি হাতে নিলো। তিন ফ্রেমের ছবিযুক্ত ফ্রেমটির একপাশের ছবিটি ছোটবেলায় তার বাবা-মার সাথে তোলা, অন্যপাশেরটি তার জন্মদিনের দিন পুরো পরিবারের সাথে তোলা হয়েছিল, আর মাঝখানের ছবিটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ছয় পুরুষের ছবি। অরুণিকা মাঝখানের ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো বাবাকে দেখি নি, কিন্তু বাবার পরিবর্তে আমি আরাফকে পেয়েছি। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি। আমি মাকে দেখি নি, কিন্তু মায়ের পরিবর্তে তাহমিদকে পেয়েছি, যে সবসময় আমার খাওয়া-পরার খেয়াল রাখে। আমি দাদা-দাদিকে কাছে পাই নি, কিন্তু তাদের পরিবর্তে ইমনকে পেয়েছি, যে সবসময় আমাকে আরাফ আর ইভানের বকুনি খাওয়া থেকে বাঁচায়। আমি বড় ভাইয়াদের দেখি নি, কিন্তু ইভানকে পেয়েছি, যে আমাকে ভাইয়ের মতোই আগলে রেখেছে, আর দরকার হলে শাসনও করে। যাকে আমি খুব ভয় পাই, কিন্তু তবুও অনেক বিশ্বাস করি। আমি মনের সব কথা ভাগ করার জন্য রকস্টারের মতো বন্ধু পেয়েছি, যে আমাকে কখনো কাঁদায় নি। আমি পাশে থাকার মতো একজন বিশ্বস্ত কাজিন হিসেবে আহনাফকে পেয়েছি, যে আমাকে হাসায়, আমার সাথে ঝগড়া করে, আবার সব ঠিক করে নেয়৷ ও আমাকে বুঝতে পারে। কিন্তু এতোগুলো মানুষ যদি হঠাৎ নিজের কাছেই মিথ্যে হয়ে যায়, তখন কি করা উচিত? যাদের আমি এতো বিশ্বাস করি, যারা না থাকলে আমার কোনো অস্তিত্বই থাকতো না, তারা যদি আমার কাছে বেইমান হয়ে যায়, তখন আমি কোথায় আশ্রয় নেবো? কাকে বিশ্বাস করবো? কার ভরসায় বেঁচে থাকবো?”

অরুণিকা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পড়লো। আরবান তালুকদার অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুমি হঠাৎ এমন কথা কেন বলছো? কে তোমার সাথে বেইমানি করেছে?”

“সবাই। ওরা আমাকে একদমই ভালোবাসে না। সম্পত্তির ভাগ নেওয়ার জন্য আমার যত্ন নিয়েছিল। আর ওরা আহনাফের সাথে এইজন্যই আমাকে বিয়ে দিচ্ছে।”

“তোমাকে কে বলেছে এসব?”

“কাল একটা আংকেল এসেছে, উনিই বললো।”

আরবান তালুকদার চুপ করে থেকে বললেন,
“তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো। যারা তোমাকে এতো বছর ধরে বাবা-মার অভাব অনুভব করতে দেয় নি, তারা কি তোমার সাথে বেইমানি করবে?”

“আমি তো চাই এসব সত্য না হোক। তাহলে আংকেলটা কি মিথ্যে বলেছে?”

“দেখো, অরুণিকা। ব্যাপারটা পজিটিভ বা নেগেটিভ দুই ভাবেই নেওয়া যায়। তোমার নামে ৫০ ভাগ অংশ লিখিত আছে, এটা সত্য। কিন্তু এর মানে এই না যে আহনাফ সেই ভাগ পাওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়ে করছে। হয়তো আরাফ তোমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে চোখের আড়াল করতে চায় না। আর শুনেছি, তোমাকে কলকাতায় এডপশনের জন্য একটা এনজিওর পক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে তোমাকে ফেরত পাওয়ার জন্য আহনাফ বিয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। কারণ ছ’জন যুবক বয়সী ছেলে তোমার মতো উঠতি বয়সী মেয়েকে বড় করার দায়িত্ব নিয়েছে, এটা আসলেই অনেক জটিল কেইস ছিল। তাই তোমার নিরাপত্তার জন্য সেই এনজিও থেকে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছিল, কিন্তু অবশেষে ছ’জনই তোমাকে পেয়েছে। কারণ কি জানো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না, কারণ কি?”

“কারণ হচ্ছে, ওদের মনোবল। তোমার প্রতি ওদের ভালোবাসা।”

“এটাতো সম্পত্তির প্রতি ভালোবাসাও হতে পারে।”

“হতেও পারে। অসম্ভব কিছু না। কিন্তু একটা কথা বললাম না, একটা জিনিসের দু’টি দিক আছে পজিটিভ আর নেগেটিভ। তুমি নেগেটিভ ভাবলে, তোমার সাথে খারাপটাই হবে। আর পজিটিভ ভাবলে, ভালো কিছু হবে।”

“আমি এখন কি করবো?”

“নিজেকে কিছুদিন সময় দাও। এখন যেহেতু তোমার মাথায় একটা প্রশ্ন চলে এসেছে, তাহলে তাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো। হয়তো তাদের ভালো কিছু তোমার চোখে পড়বে, যা তোমার মনের সন্দেহ দূর করে দেবে। আবার হয়তো খারাপ কিছু নজরে আসবে, যেটা তোমাকে সত্যের কাছে নিয়ে যাবে।”

বিকেলে আহনাফ অরুণিকার ঘরে এলো। অরুণিকা আহনাফকে দেখে বলল, “তুমি!”

আহনাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে, অরু? গতকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছো!”

“তুমি যাও! আমি একা থাকবো।”

আহনাফ অরুণিকার হাত দু’টি নিজের হাতে আবদ্ধ করে নিলো আর অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল,
“তোমার চুপ হয়ে থাকাটা পুরো ঘরটাকে মৃত বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তুমি কেন বুঝো না, তোমার মন খারাপ হলে সবাই কতো কষ্ট পায়।”

অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিও পাও?”

আহনাফ শান্ত চোখে তাকিয়ে ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল,
“আমার সব হাসি-কান্না তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমার কাছেই আমার সব কিছুর সমাপ্তি। তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের? কেইবা আছে আমার?”

“বাকীরা নেই?”

“ভাই আর বন্ধু আছে। তুমি তো ভাই না, বন্ধুও না। তুমি আমাদের সাহস, প্রেরণা, শক্তি, আর আমার….”

আহনাফ ধীর কন্ঠে শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসা।”

এক অদ্ভুত মায়া ছিল এই শব্দে। এই শব্দটি শুনেই অরুণিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে হুট করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা আচমকা জড়িয়ে ধরাতে আহনাফ চমকে উঠলো।

অরুণিকা যেদিন থেকে সব কিছু বুঝতে শিখেছিল, উপমার মাধ্যমেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আরাফ আর আহনাফদের কাছ থেকে ঠিক কতোটা দূরত্ব রাখলে তাদের সম্পর্কটা মানানসই হবে। অরুণিকা যেহেতু ছ’জনের কোলেই বড় হয়েছে, তাই তাকে এটা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার কোল ছাড়ার বয়স হয়েছে। এরপর একদিন অরুণিকাও সব বুঝতে শুরু করে, যখন আরাফ আর তূর্য তার পাশ ঘেঁষে বসা বন্ধ করে দেয়। এখন খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউই অরুণিকার হাত ধরে না। তবে আহনাফ খুব অধিকার নিয়েই সেই হাতটি ধরে রাখে। আহনাফের সাথে এই দূরত্বটা তার কখনোই ছিল না। কিন্তু এতো কাছ থেকে জড়িয়ে ধরাটা আজ প্রথম অনুভব করছে আহনাফ। তার এই মুহূর্তে খুব শান্তি লাগছে। তার বুকটা এক মিষ্টি প্রশান্তিতে ভরে গেছে। অরুণিকা সেই বুকে শান্তি খুঁজে পেয়েছে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কিন্তু আহনাফ তাকে আঁকড়ে ধরার সাহস পাচ্ছে না। কোনো অজানা কারণেই তার হাত কাঁপছে। আলগা করে সে এক হাত উঠিয়ে অরুণিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরুণিকা তখন বলে উঠলো,
“আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমার কাছে তোমাদের চেয়ে কেউ গুরুত্বপূর্ণ না। আমি তোমাদের অনেক বিশ্বাস করি। আমি জানি, তোমরা আমার সাথে কখনোই প্রতারণা করবে না।”

আহনাফ অরুণিকার চুল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো, সে অরুণিকাকে ইমানের ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে। সে ইমানকে সেদিন অরুণিকার কথা বলে নি। ইমানও বিয়ের কথা বলে নি। সব আহনাফের বানানো ছিলো৷ কিন্তু এই সত্যটা অরুণিকা জানলে কি হবে তাদের সম্পর্কে? আহনাফ অরুণিকাকে সরিয়ে দিলো। অরুণিকা ইতস্তত ভাব নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি। ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।”

কথাটি বলেই অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আহনাফ মনে মনে ভাবলো,
“অরু সব জানার আগেই আমি ওকে নিজের করে নেবো। একবার বিয়ে হয়ে গেলে, ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। ও আমার ভালোবাসা। আমার দশ বছরের অপেক্ষা, আমার প্রাপ্তি, আমার স্বপ্ন, আমি সবকিছুর সমাপ্তি। আমি এতো উদার নই যে আমার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হাতে তুলে দেবো। ওকে আমি নিজের মতো করে ভালোবাসবো। ও আমাকে বিনিময়ে ভালোবাসুক, বা না বাসুক, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না।”

৯৬.

অফিস রুমে শান্ত হয়ে বসে আছে ইভান। তার হাতে শাহেদ মির্জার ছবি। খুব সূক্ষ্মভাবে সে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সে শাহেদ মির্জার সব তথ্য কয়েকবার করে পড়ছে। হঠাৎ তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল,
“মিস্টার শাহেদ মির্জা, তোমার দুর্বলতা আমি ধরে ফেলেছি। এখন তোমাকে সেই দুর্বল দিক দিয়েই আমি আঘাত করবো। খেলা শুরু হয়ে গেছে। আমি আমার এক চাল দিয়ে দিয়েছি। এখন অপরপাশ থেকে তোমার চাল দেখার অপেক্ষায় আছি, মিস্টার শাহেদ মির্জা!”

এদিকে সাহিল তার অফিস রুমে রাহিকে বসিয়ে রেখেছে। রাহি বিরক্ত হয়ে বলল,
“সাহিল, কি করছো তুমি? আমাকে এই বদ্ধ রুমটাতে আটকে রেখে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছো তো খেয়েই যাচ্ছো! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

সাহিল চেয়ার ছেড়ে উঠে রাহিকে কাছে টেনে এনে বলল,
“তাহলে তুমি কেন বুঝতে পারছো না, তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

রাহি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“আগে এই কাজ ছাড়ো, তারপর আমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখো।”

“এটা আমার ব্যবসা, এটা আমার স্বপ্ন, আর তুমি আমার ভালোবাসা, আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন। আমি একটা ছেড়ে অন্যটা ধরতে পারবো না। আমার দু’টোই প্রয়োজন।”

“সারাদিন কেউ না কেউ তোমাকে হুমকি-ধামকি দেবে। সাহিল, তোমার জন্য আমাদের সন্তানরা এমন পরিবেশে বড় হবে, যেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই।”

সাহিল রাহির হাত দু’টি তার দুই চোখে ঠেকিয়ে বলল,
“বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, রাহি। বিয়ে করবো তোমাকে। প্লিজ রাজি হয়ে যাও। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না।”

রাহি সাহিলের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“ভালোবাসি, সাহিল। ভালোবাসি তাই তোমাকে এই পথ থেকে সরে আসতে বলছি। আমরা চাইলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবো। এই মিডিয়া, বডিগার্ড এসবের বাইরে একটা জীবন আছে। স্বাধীনতা আছে। যেখানে খুন হওয়ার ভয় নেই। যেখানে মৃত্যুর জন্য একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করার সুযোগ আছে, মানুষকে নয়। কিন্তু তোমার জীবনটা এমন হয়ে গেছে, তুমি মানুষকে ভয় পাচ্ছো, বডিগার্ডের উপর বডিগার্ড রাখছো, নিজেকে বাঁচানোর জন্য যা যা করার সব করছো, ভেবে চিন্তে পা ফেলছো। অথচ আমি চাই, পা ফেলার আগে শুধু একটাই জিনিস ভাববো, আজ আমি কতোটুকু পথ শান্তিতে পাড়ি দিতে পারবো।”

সাহিল রাহির কথা শুনে বলল,
“তোমার এসব কাব্যিক কথাবার্তা বন্ধ করো। আমার তোমাকে যেকোনো মূল্যে প্রয়োজন। আমি আজ আবার বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবো। আশা করি, এবার আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।”

সাহিল রাহির হাত ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলো, আর বলল,
“আমি গার্ডকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেবে।”

রাহি কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে সাহিলের দিকে তাকিয়ে থেকে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।

অন্যদিকে শান্ত দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন শাহবাজ খান। পেছন থেকে তার স্ত্রী বলে উঠলেন,
“ওরা বেঁচে আছে কিভাবে এটাই ভাবছো? আমিও এটাই ভাবছি। এও ভাবছি, ওরা এতোদিন কোথায় ছিল?”

শাহবাজ খান কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি চুপ করে আছেন। তার স্ত্রী আবার বলে উঠলেন,
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা বেঁচে আছে শুনে তুমি একটুও অবাক হও নি।”

শাহবাজ খান বললেন,
“এখানে অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই৷ ওরা বেঁচে আছে, এটা অবাক হওয়ার বিষয় না। ওরা আমার কেউই না।”

“অরুণিকা তো তোমার ভাগ্নি।”

“হ্যাঁ, এটাই ভাবছি। ও আমার ভাগ্নি, আর ও এতো বছর আমাদের কাছ থেকে দূরে ছিল। ওর বাবা-মার পর আমরাই ওর আপনজন। কিন্তু ওকে বড় করেছে ওর বাবার বন্ধুর ছেলেরা। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।”

“আরাফ আর আহনাফ তো ওর চাচাতো ভাই। ওরা কি মেয়েটার কম অযত্ন করেছে? যা-ই হোক, বড় তো হয়েই গেছে। শুনেছি আহনাফের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার না এই সম্পর্কটাতে মত নেই। চলো দেশে ফিরি। মেয়েটাকে আমাদের সাথে আমেরিকা নিয়ে আসি। তৈমুরকে তো বিয়ে দেবো ভাবছি। অরুণিকার সাথেই না হয় ওর বিয়েটা হয়ে যাক। আর তৈমুর তো আহনাফের চেয়ে ছোট। এতো বড় ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দেওয়াটা ভালো হচ্ছে, বলো? অরুণিকা যখন হয়েছিল, ছেলেটা কত্তো বড় ছিল।”

“দশ-এগারো বছরের ছিল তখন। আসলে তুমি ঠিকই বলেছো। অরুণিকার দায়িত্বটা আমাদের নেওয়া উচিত ছিল। আর এখন অরুণিকার দায়িত্ব আমাদেরই নেওয়া উচিত। আর তৈমুরের সাথে বিয়ে হলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকবো।”

শাহবাজ খান এসব বলে আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ঠিক কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন তা ধরতে না পেরে তার স্ত্রী মিনিট খানিক দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।

কিছুদিন পর,
ইমনের বিয়ের বাজার করার জন্য ইভান একাই আজ মার্কেটে এসেছে। সে দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে কোন দোকানে ঢুকবে। হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে হাত নাড়িয়ে বলল,
“আমাকে চিনেছেন?”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বদমাশ লোকেদের হাত থেকে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করা সেই মেয়েটি, তাই না?”

সানায়া হালকা হেসে বলল,
“আমার ভাগ্যের উপর ভালোই পরিহাস করলেন, দেখছি।”

“আপনার তো সেই কপাল! বডিগার্ড নিয়ে ঘুরাঘুরি করা চাট্টিখানি কথা নয়।”

সানায়া চোখ ছোট করে বলল, “খোঁচা দিচ্ছেন?”

“মোটেও না। তা আজ আপনার বদমাশ লোকগুলো কোথায়?”

সানায়া হেসে বলল,
“চিন্তা করবেন না, কড়া আদেশ আছে। ওরা মার্কেটের বাইরেই আছে। ভেতরে ঢুকতে দেই নি।”

ইভান হাসলো। হঠাৎ কি ভেবে বলল,
“আপনি কি আমার একটা সাহায্য করবেন? আসলে অরুণিকার জন্য একটা শাড়ি কিনতে এসেছি। একটা পছন্দ করে দেবেন? আমার আসলে শাড়ির ব্যাপারে কোনো আইডিয়া নেই।”

“অবশ্যই করে দেবো। তা আপনি কি শুধু শাড়ি কিনতে এসেছেন?”

“না, ইমনের বিয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করবো।”

“তো বর কোথায়?”

“নিজে পরার জন্য কিনতে এসেছি। বর আলাদা ভাবে বাজার করবে। আর আপনি?”

“ও, আমিও কিন্তু বিয়ের বাজার করতে এসেছি, আপনার মতোই।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কার বিয়ে?”

“ভাইয়ার বিয়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রাহির সাথে। আসবেন কিন্তু বিয়েতে!”

ইভান রহস্যময় হাসি দিলো। সানায়া ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন কেন?”

ইভান হেসে বলল,
“ভাবছি দু’জনেরই ভাইয়ের বিয়ে, কি মিল আমাদের!”

সানায়া ইভানের কথায় অন্যদিকে তাকালো। আর আনমনে হাসতে লাগলো। ইভান সানায়ার হাবভাব দেখে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলেন?”

“না, সত্যিই বলেছেন। আমাদের খুব মিল।”

এদিকে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একটার পর একটা দোকানে যাচ্ছে সানায়া, আর তার পিছে পিছে যাচ্ছে ইভান। ইভানের রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে। তার বাম হাতে পাঁচটা ব্যাগ, আর ডানহাতে ছয়টা। সানায়ার হাতে শুধু দুইটা ব্যাগ, এতেই সে কিছুক্ষণ পর পর ব্যাগগুলো ইভানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কখনো চুল ঠিক করছে, কখনো ব্যাগ থেকে টাকা বের করছে। সানায়া কোনো ভাবেই ইভানের পিছু ছাড়ছে না। সানায়ার এই একটা স্বভাব, কেউ তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করলে, সে মানুষটিকে ছাড়তেই চায় না। যেমনটা এই মুহূর্তে ইভানের সাথে হচ্ছে। ইভান বিরক্ত হয়ে বলল,
“ব্যাগগুলো বরং গাড়িতে তুলে রাখুন।”

সানায়া ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, বদমাশ লোকগুলো আমাকে দেখলে এবার পিছু ছাড়বে না। ওরা নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। দেখছেন না কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিচ্ছে।”

ইভান উপায় না দেখে বলল,
“সত্যি বলতে কি আমার মাথা ঘোরাচ্ছে। কাল রাতে ঘুমাই নি তো তাই।”

সানায়া ব্যস্ত হয়ে সবগুলো প্যাকেট নিয়ে নিলো। আর ইভানকে বলল,
“চলুন, ডাক্তারের কাছে যাই।”

ইভান ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আরেহ, না না। ডাক্তার দেখানোর মতো খারাপ লাগছে না।”

“না আপনাকে যেতেই হবে ডাক্তারের কাছে। চলুন।”

সানায়া হনহন করে সামনে যেতে লাগলো। ইভান মুখ ছোট করে বিড়বিড় করে বলল,
“কোন নাছোরবান্দার পাল্লায় পড়লাম! আল্লাহ, মুক্তি দাও আমাকে।”

সানায়া ইভানকে ডাক্তারের কাছে নিয়েই গেলো। যদিও ইভান আরাফের চেম্বারেই এসেছে। সানায়া আরাফের নামফলক দেখে বলল,
“আরাফ তো স্কিনের ডাক্তার। আপনার তো মাথা ঘুরাচ্ছে।”

“ওই একই কথা৷ এলার্জির কারণেই মাথা ঘুরাচ্ছিল।”

“এলার্জির কারণে মাথা ঘোরায় নাকি?”

ইভান চোখ ছোট করে বলল,
“আমার ঘোরায়!”

আরাফের কেবিনে ঢুকতেই আরাফ ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। সানায়া বলল,
“আপনার বন্ধুর এলার্জি বেড়ে গেছে। এলার্জির কারণে মাথা ঘোরাচ্ছে।”

আরাফ অবাক হয়ে বলল,
“এলার্জি! কিসের এলার্জি।”

ইভানের চোখের ইশারায় আরাফ আবার বলে উঠল,
“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ এলার্জি আছে তো। অনেক এলার্জি আছে। ওর এলার্জির একমাত্র ওষুধ…”

ইভান ইশারায় কিছু একটা বলতেই সানায়া ইভানের দিকে তাকালো। আর বলল,
“হাত দেখিয়ে কি বলছেন উনাকে?”

আরাফ বলল,
“কিছু বলে নি, মাথা ঘোরাচ্ছে বোঝাচ্ছিল। ওর এই মুহূর্তে বিশ্রাম করা উচিত।”

ইভান বলে উঠল,
“হ্যাঁ, আমার খুব খারাপ লাগছে।”

সানায়া বলল,
“আরাফ, আপনি ওষুধ লিখে দিন।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওষুধ তো বাসায় আছে। ওগুলোই খেয়ে নেবো।”

সানায়া মাথা নেড়ে ইভানকে ধর‍তে যাবে ইভান বলল,
“আমি ঠিক আছি। আপনি বাইরে যান।”

সানায়া বের হতেই ইভান বলল,
“এই মেয়ে আস্ত একটা জোঁক। আমার মাথার সব রক্ত খেয়ে নিয়েছে। পুরো মার্কেট শুধু বকবক করেছে, আর আমার হাতে বস্তা ধরিয়ে দিয়েছে।”

আরাফ বলল, “কিসের বস্তা?”

“বিয়ের বাজার।”

“ইমনের?”

“জ্বি না। গেলাম তো সেই উপলক্ষেই, কিন্তু এই মেয়ে আমাকে দিয়ে নিজের সব জামা পছন্দ করিয়েছে। পুরো মার্কেট তুলে নিয়ে এসেছে গাড়িতে। ইচ্ছে তো করছিলো সবগুলো ব্যাগ দিয়ে মেয়েটাকে চেপে ধরে মেরে ফেলি।”

“আচ্ছা, এখন পানি খা।”

আরাফ পানি এগিয়ে দিতেই ইভান গটগট করে পানি খেয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি বাসায় যাচ্ছি। কাল থেকে সব মার্কেট তোরা করিস। আমি আর ওই মার্কেটের মুখ দেখতে চাই না।”

এদিকে চেম্বার থেকে বের হতেই রাহির মুখোমুখি হয়ে গেলো আরাফ। রাহি আরাফকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন?”

আরাফ বলল, “জ্বি ভালো।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“বাসায়।”

“ওহ আচ্ছা। সময় হবে আপনার?”

“কেমন সময়?”

“আমার একটু স্কিনে সমস্যা হচ্ছে।”

রাহি তার হাত দেখিয়ে বলল,
“এই দেখুন কেমন যেন দাগ হয়ে যাচ্ছে।”

আরাফ ভালোভাবে দেখে বলল,
“এটা ফাংগাল ইনফেকশন। আমি আপনাকে একটা ক্রিম লিখে দিচ্ছি ওটা এই জায়গায় লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।”

আরাফ ব্যাগ থেকে লেখার জন্য কাগজ বের কর‍তে যাবে তখনই রাহি বলল,
“পাশে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে ওখানে গিয়েও বসতে পারি।”

আরাফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, চলুন।”

এদিকে রাহি আর আরাফ রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সাহিল গাড়ির কাঁচ তুলে ড্রাইভারকে বলল,
“বাসায় চলো।”

আর সে মনে মনে ভাবছে,
“রাহি কি সত্যিই আমার কাজের জন্য আমাকে বিয়ে কর‍তে চায় নি, নাকি ওর না চাওয়ার কারণ আরাফ চৌধুরী? যদি এর কারণ আরাফ চৌধুরী হয়, তাহলে মিস্টার চৌধুরীর কপালে দুঃখ আছে।”

চলবে—#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৯||

৯৭.
সিগারেট হাতে নিয়ে টেবিলের উপর পা তুলে আয়েশ করে চেয়ারে বসে আছেন বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমান। বয়স আটচল্লিশ পেরিয়েছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ঘনিষ্ঠ সহচর নিয়াজ হোসেন। নিয়াজ হোসেন বয়সে রিয়াজুর রহমানের দুই বছরের বড়। তবুও তাদের মধ্যে তুইতোকারি বন্ধুত্ব। বয়সের ব্যবধান দুই বছর হলেও নিয়াজ হোসেনকে দেখলে তার বার্ধক্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু রিয়াজুর রহমানকে দেখলে আটচল্লিশ পার করেছেন বলে মনে হয় না। তার শুধু চুলগুলোই পেকেছে, যা তিনি কৃত্রিম রঙের স্পর্শে লাল করিয়ে রাখেন। বয়স হলেও দাঁড়ি রাখেন না। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন হওয়ায়, তিনি এখনো ফিট আছেন। তিনি এমন প্রকৃতির মানুষ, যা-ই কিছু হয়ে যাক, দিনলিপিতে একটুও পরিবর্তন ঘটান না৷ তার রুটিনে প্রতিদিন একটার বেশি সিগারেট থাকে না। পুরো দিন মানসিক চাপ না থাকলে তিনি রাতে তার ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকিয়ে থেকেই সিগারেট ধরান। আর যদি দিনে কোনো চাপ তার উপর এসে পড়ে, তাহলে রাতে আর প্রিয় মানুষটিকে দেখেন না৷ কারণ তার মানসিক চাপ হালকা করার জন্য ওই একটাই সিগারেট বরাদ্ধ থাকে।

এদিকে নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানকে সিগারেট খেতে দেখে বললেন,
“ভাই, আম্মা আর ক’দিনই বা আছেন! তার শরীর ভালো না। ডাক্তার তো জানিয়েই দিয়েছে যে তার সময় কম। তুই এবার আম্মার ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেল।”

রিয়াজুর রহমান কোণা চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দেখ, নিয়াজ। এতো শখ হলে তুই নিজেই আরেকটা বিয়ে করে নে।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছি, এই বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে?”

“তো আমাকে কেন বিয়ের কথা বলছিস?”

“তুই তো বিয়েই করিস নি। অরূপাকে কি এবার ভুলে যাওয়া উচিত নয়?”

রিয়াজুর রহমান মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন,
“সব মানুষ ভুলে যাওয়ার জন্য মনে জায়গা পায় না। কিছু মানুষ মরেও হৃদয়ে বেঁচে থাকে।”

“কিন্তু ভাই, তুই বিয়ে না করে যে পাপ করে যাচ্ছিস, সেটা কতোটা ন্যাক্কারজনক, জানিস?”

রিয়াজুর রহমান চুপ করে রইলেন। নিয়াজ হোসেন বললেন,
“আম্মা যদি জানে তুই বিয়ে ছাড়া মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখিস, একদিনও বাঁচবে না। আল্লাহকে ভয় কর। নামাজ দোয়া পড়। বয়স তো শেষ হয়েই যাচ্ছে।”

রিয়াজুর রহমান চেঁচিয়ে বললেন,
“অরূপাকে চেয়েছিলাম আমি। মেয়েটা আমার নেশা ছিল, নেশা। আমি ওর মধ্যে এতো ডুবে গিয়েছিলাম যে ওকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারতাম। কিন্তু ও আমাকে সুযোগ না দিয়ে আত্মহত্যা করে জাহান্নামে চলে গেছে। আমিও তাই জাহান্নামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

নিয়াজ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বললেন,
“আল্লাহ তোকে হেদায়েত করুক।”

নিয়াজ হোসেন এই বলে চলে গেলেন। এদিকে রিয়াজুর রহমানের টেবিলের উপর অনেকগুলো মেয়ের ছবি। মা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য এই ছবিগুলো সংগ্রহ করে নিয়াজের দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, আর তা দেখেই রিয়াজুর রহমানের মাথা বিগড়ে গিয়েছে।

তিনি ছবিগুলো সব একত্র করে লাইটার দিয়ে সব ছবিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যেদিন ঠিক অরূপার মতো কেউ আমার মনে জায়গা নিতে পারবে, সেদিনই আমি মানুষ হবো।”

ফোন বেজে ওঠায় তিনি ছবিগুলো বেসিনের উপর ফেলে দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন আর ফোন রিসিভ করে বললেন,
“মিস্টার রহমতুল্লাহ, আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? আমাকে ফোন দিয়ে আপনি এই পাড়া ওই পাড়ার খবর দিতে থাকেন। এই দায়িত্বের জন্য কি আপনাকে আলাদা করে কেউ বেতন দিচ্ছে?”

রহমতুল্লাহ হেসে বললেন,
“কি যে বলেন রিয়াজ সাহেব! আমি তো আপনার খবর নেওয়ার জন্যই ফোন দিয়েছি।”

“আমার খবর নেওয়ার চেয়ে আপনি অন্যের খবর আমাকে বেশি দেন।”

“আপনাকে জানাতে ভালো লাগে।”

“তা আজ কার খবর দেবেন?”

“আপনি বোধহয় ইদানীং নিউজ দেখছেন না।”

“আমার এসব নিউজ দেখার সময় নেই। আমাকে নিয়ে কোনো খবর থাকলে আমার লোকেরা আমাকে জানিয়ে দেয়।”

“তবে এই খবরটা আপনার অজানা রয়ে গেল কিভাবে জনাব?”

“কোন খবর!”

“মৈত্রী গ্রুপ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে! শুনেন নি?”

রিয়াজুর রহমান কথাটি শুনে কপাল ভাঁজ করে চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন,
“বুঝলাম না। সোজাসুজি কথা বলুন।”

“আপনার প্রাক্তন বন্ধুদের ব্যবসায়িক গ্রুপ নিজের জায়গা আবার ধরে নিয়েছে।”

“অসম্ভব।”

“সম্ভব জনাব, সম্ভব।”

“ওদের কেউই বেঁচে নেই। তাহলে এটা….”

রহমতুল্লাহ রিয়াজুর রহমানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“বেঁচে আছে বলেই তো সম্ভব হয়েছে।”

“কে বেঁচে আছে!”

“আপনার কাছের বন্ধুর ভাগ্নে তাহমিদ, আপনার পুরোনো পার্টনার আনিস চৌধুরীর ছেলে আহনাফ। আরো আছে। আপনি বরং এই এক সপ্তাহের খবরগুলো দেখুন। তারপর সব জানতে পারবেন।”

রিয়াজুর রহমান ফোন রেখে গত চারদিনের পত্রিকা ঘাঁটতেই সব তথ্য পেয়ে গেলো। তিনি সাথে সাথেই নিয়াজ হোসেনকে ফোন করে বললেন,
“মৈত্রী গ্রুপের নতুন দুই এম.ডির সব তথ্য আমাকে পাঠা, ফাস্ট। আর বাকি যারা বেঁচে আছে, তাদের সবার ডিটেইলসও দিবি।”

এদিকে সন্ধ্যায় এলাকার গলিতে হাঁটতে বের হয়েছে ইভান। হঠাৎ সে দেখলো গলির সামনে দুইটা ছেলে একটা মেয়েকে উত্যক্ত করছে। সে কাছে যেতেই দেখলো মেয়েটা আর কেউ নয়, বরং সানায়া। ইভান সানায়াকে তার এলাকায় দেখে কিছুটা অবাক হলো। সানায়া ইভানকে দেখে আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“আপনি আসবেন আমি জানতাম।”

ইভান সানায়ার কথায় কিছুটা অবাক হলো। সানায়া ইভানের হেলদোল না দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“আরেহ, স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মারুন এদের।”

ইভান ছেলেগুলোর কলার ধরে এক ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরালো। তখনই সানায়ার বডিগার্ডগুলো এসে সানায়ার পেছনে দাঁড়ালো। ইভান ছেলে দুইটাকে মারতে যাবে সানায়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, থাক, আর মারতে হবে না। ওরা বুঝে গেছে ওরা কাকে বিরক্ত করছিল। এখন ভুলেও আর আমাকে বিরক্ত করার সাহস দেখাবে না।”

সানায়া এবার ছেলে দু’টোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই ছেলেরা, দেখেছো। আমার আশেপাশে কতো লোক আছে? আমার চেহারাটা মনে রেখে দাও। পরের বার আমাকে দেখলে যাতে রাস্তা পরিষ্কার দেখি।”

ইভান সানায়ার কথায় ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। ছেলে দুইটা দৌঁড়ে চলে গেলো। সানায়া তার বডিগার্ডদের দিকে ফিরে বলল,
“কোথায় থাকো তোমরা? আজ তোমাদের বেখেয়ালির জন্য আমার কতো বড় বিপদ হতে পারতো, জানো?”

তাদের মধ্যে একজন বলল, “সরি ম্যাম।”

সানায়া ইভানকে দেখিয়ে গার্ডগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আজ ইনি না আসলে আমার অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতো। স্যালুট করো উনাকে।”

তারা সানায়ার কথায় ইভানকে স্যালুট করলো। সানায়া এবার নরম কন্ঠে বলল,
“তোমরা এবার এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করো। আমি উনার সাথে আছি, বুঝেছো? উনি থাকতে তোমাদের প্রয়োজন নেই।”

কথাটি বলেই সানায়া ইভানের হাত ধরে সামনে হাঁটতে লাগলো। ইভান অবাক হয়ে সানায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুদূর যাওয়ার পর ইভান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“সব ব্যাপারটাই কেন যেন আমার স্ক্রিপ্টেড মনে হলো!”

সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তাছাড়া আমার উপায় ছিল না। ছেলে দুইটাকে আমি ভাড়া করে এনেছি। আমার ক্লাসমেটের এলাকার ছেলে।”

“কিন্তু এগুলো করার কারণ কি!”

“দেখছেনই তো বডিগার্ডগুলো উঠতে বসতে আমার পেছনে লেগেই থাকে। এখন ভেবেছি, ওদের সামনে কাউকে যদি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়, ওরা হয়তো তার সাথে আমাকে একা ছাড়বে। তাই এই নাটক করা।”

ইভান বুকে হাত গুঁজে বলল,
“বাহ! তা এই নাটকে আমাকে ঢুকিয়েছেন কেন?”

সানায়া হালকা হেসে বলল,
“কারণ আমার আপনাকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।”

“ইন্টারেস্টিং। কয়েকবার দেখেই আপনি আমাকে বিশ্বাস করে ফেলেছেন?”

“হুম, আচ্ছা, এসব বাদ দিন। এখন যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য মনেই হয়েছে, তাহলে এটা একটু আগাক।”

“কি আগাবে?”

“আমাদের সম্পর্কটা!”

“যেমন?”

সানায়া হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ফ্রেন্ডস।”

ইভান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আগে বলুন, এই স্ক্রিপ্টেড নাটকে আমার এখানে আসাটা কি আপনার নাটকে আগে থেকেই লিখিত ছিল?”

সানায়া লাজুক হেসে বলল,
“না, আসলে, আমি আপনাকে কয়েকদিন ফলো করিয়েছিলাম। ওই দুইটা ছেলেই আপনার বের হওয়ার সময়টা আমাকে জানিয়েছে। আপনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিশ মিনিট হাঁটেন। তাই না?”

ইভান হেসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ফ্রেন্ডস।”

সানায়া তাড়াতাড়ি হাত মিলিয়ে একটা দীপ্তিময় হাসি দিলো। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, তার বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ইভান সেই হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

৯৮.

দরজা খুলতেই শাহবাজ খানকে দেখে অবাক হলো আহনাফ। সেই পনেরো বছর বয়সে সে শাহবাজ খানকে দেখেছিল। তবুও এই লোকটাকে চিনতে তার একটুও দেরী হলো না। শাহবাজ খানও আহনাফকে চিনতে পেরেছেন। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“আহনাফ, অনেক বড় হয়ে গেছো, দেখছি।”

কথাটি বলেই আহনাফের অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকে পড়লেন। আহনাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

শাহবাজ খান আহনাফের শীতল কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“খুব অভদ্র হয়ে গেছো মনে হচ্ছে!”

আহনাফ কপাল ভাঁজ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শাহবাজ খান বললেন,
“বড়দের দেখলে সালাম দিতে হয়, সেটা হয়তো জানো না। জানবেও বা কিভাবে, শেখার বয়সেই তো সব শিক্ষক হারিয়েছ!”

আহনাফ ক্ষ্যাপা কন্ঠে বলল,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“অরুণিকাকে নিতে এসেছি।”

“ওকে নিতে আসার তো আপনার কোনো অধিকার নেই।”

“আমি ওর মামা। আমি ওকে নিয়ে যেতেই পারি।”

“এসব কোন ধরণের তামাশা? আপনি হঠাৎ কোথা থেকে এসে এসব কথা বলছেন?”

“আর তুমি আমার সাথে কেমন তামাশা করছো? আসার সাথে সাথেই অভদ্রের মতো কথা বলছো।”

“আপনিও খুব একটা ভদ্রভাবে ঘরে ঢুকেন নি। আপনার হাবভাবে কোনো ভদ্রলোকের লক্ষণ দেখা যায় নি। তাই আমিও ভদ্রতা দেখানোর প্রয়োজন মনে করছি নি।”

শাহবাজ খান হঠাৎ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“তাহলে এই ছেলেই হবে আমার ভাগ্নির উড বি হাসবেন্ড? এমন অভদ্র, বেয়াদব ছেলের সাথে অরুণিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে? তোমাকে তো আমার সেই সময় থেকেই অপছন্দ ছিল।”

উপর থেকে তূর্য দুই সিঁড়ি নেমে শাহবাজ খানকে দেখে আবার উপরে উঠে গেলো। সে গিয়ে উপমাকে বলল,
“উপমা, তুমি টুইংকেলের কাছে যাও। ওর সাথে কিছুক্ষণ থাকো। ও যাতে কোনোভাবেই নিচে না নামে।”

উপমা চিন্তিত কন্ঠে বললো, “কি হয়েছে?”

তূর্য তাগাদা দিয়ে বলল,
“তোমাকে যা বলেছি আপতত তাই করো।”

উপমা উপরে উঠতেই তূর্য বাকিদের ঘরে গিয়ে শাহবাজ খানের আসার খবর দিলো। সবাই নিচে নামতেই শাহবাজ খান বললেন,
“সৈন্যবাহিনী নিয়ে চলে এসেছো দেখছি। এবার অরুণিকাকেও আসতে বলো।”

আরাফ শাহবাজ খানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি চান আপনি?”

“অরুণিকাকে দেখতে এসেছি। ওকে নিতে এসেছি।”

“আপনার হাতে অরুকে দেবো, এটা আপনি ভাবলেন কিভাবে?”

“কেনই বা দেবে না?”

“তা আপনি ভালো করেই জানেন, মিস্টার শাহবাজ খান।”

শাহবাজ খান দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“জানি, সেই খবরটাই তো দেখেছো, যেটা দেখে তোমরা আমাকে খুনী ভাবছো! ভাবছো আমি সেই রাতে মির্জাদের সাথে মিলিত হয়ে সবাইকে খুন করিয়েছি? ওকে ফাইন। ভাবো, যা ভাবার। আমি কাউকে এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন মনে করি না।”

ইভান শাহবাজ খানের হাত ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“শুধু প্রমাণটা একবার পাই, তারপর সব দাদাগিরি বেরিয়ে যাবে।”

এরপর ইভান টেনে শাহবাজ খানকে ঘর থেকে বের করে দিলো। শাহবাজ খান বললেন,
“আমি এতোটুকুই বলবো, অরুণিকা আমার বোনের মেয়ে। জিহান, জিসান আমার ভাগ্নে ছিল। নিপা আমার বোন ছিল। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী আমার ভগ্নিপতি ছিল। আমি বাইরের কারো সাথে আত্মীয়তা রাখি না, কিন্তু আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তা ভালোই রাখতে জানি। এখন কেউ যদি আমার নামে মিথ্যে অভিযোগ করে। মিডিয়া যদি আমাকে খুনী মনে করে, তাহলে আমার কিছুই করার নেই। তবে একটা কথা শুনে রাখো, অরুণিকা নিজ থেকেই আমার সাথে যেতে চাইবে। আর ওই আহনাফকে বলে দিও, আমার ভাগ্নির বিয়ে ওই বেয়াদব ছেলের সাথে কখনোই হবে না।”

ইভান ধড়াম করে শাহবাজ খানের মুখের উপর দরজা বেঁধে দিলো। ইমন বলল,
“এখন বাড়ির বাইরে আরো কয়েকজন পাহারাদার লাগাতে হবে। সিকিউরিটি আরো শক্ত করতে হবে।”

এদিকে রাতে অরুণিকার ফোনে একটা কল এলো। অরুণিকা ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“ছোট্ট সোনামণি, অরুণিকা, কেমন আছো মা?”

“কে আপনি?”

“আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী!”

অরুণিকা কিছুটা অবাক হলো। লোকটি আজ তাকে তার মামার বাসায় আসার ঘটনাটি বললো, আর কিভাবে ছ’জন তাকে অপমান করে বের করেছে সব জানালো। অরুণিকা বলল,
“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন?”

“তোমাকে সতর্ক করতে চাইছি। এই ছ’জন তোমার সাথে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারে৷ ভুলে যেও না, তুমি ৫০ ভাগ অংশের মালিক। এই ৫০ ভাগ অংশে মৈত্রী ম্যানশনের অর্ধেক জায়গা এসে পড়ছে। তোমার বাবা-দাদার পৈতৃক সম্পত্তিসহ অনেক কিছু। তুমি একাই কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছো। এখন এই টাকাগুলো তোমার কাছ থেকে নেওয়ার জন্যই এই ছ’জন তোমাকে ব্যবহার করছে।”

অরুণিকা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ করুন। আমার লাগবে না ৫০ ভাগ সম্পত্তি। নিলে নিয়ে নিক। আমার তাতে কিছুই আসে যায় না। আমার মূল সম্পদ সেই ছ’জন পুরুষ, যাদের নিয়ে আপনি আমাকে এখন উল্টোপাল্টা কথা বোঝাচ্ছেন। আরেকবার ফোন করলে আপনার নামে আমি মামলা করে আসবো। আপনার সিম বন্ধ করিয়ে দেবো।”

অরুণিকা ফোন কেটে দিলো। লোকটাকে যাচ্ছেতাই শুনালেও অরুণিকা কোনোভাবে নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না। সে বুকে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আর কেউ আমাকে ধোঁকা দিলেও আরাফ কখনোই আমাকে ধোঁকা দেবে না। আমি আরাফকে বিশ্বাস করি।”

আজ অনেকদিন পর নিয়াজ হোসেনের সাথে মার্কেটে এসেছেন রিয়াজুর রহমান। সাধারণত তার জিনিসপত্র কেনার দায়িত্ব নিয়াজ হোসেনের উপরই থাকে। তবে আজ তিনিসহ এসেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো। তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছেন। নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানকে থমকে যেতে দেখে বললেন,
“কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে গেলি কেন?”

রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“নিঁখুত সৌন্দর্য।”

নিয়াজ হোসেন সামনে তাকিয়ে একটা মেয়েকে দেখে বললেন,
“আমার মেয়ের বয়সী মনে হচ্ছে!”

রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কার মেয়ের বয়সী জানতে চাই নি। আমার যেহেতু মেয়ে নেই, তাহলে মেয়ের বয়সী বলতে কোনো নারীই আমার জন্য এই পৃথিবীতে নেই। সবগুলোই আমার বয়সী। আমি এই মেয়ের সব ডিটেইলস চাই।”

নিয়াজ হোসেন বললেন,
“পৃথিবীর সব মেয়ের ডিটেইলস নিয়ে আমি বসে থাকি না। আমাকে কি তোর গুগল মনে হচ্ছে?”

“মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সময় এসে গেছে, নিয়াজ।”

নিয়াজ হোসেন অবাক হয়ে বললেন,
“তুই এই মেয়েকে দেখেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস?”

রিয়াজুর রহমান কোনো কথা না বলে মার্কেট থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নিয়াজ হোসেন মনে মনে বললেন,
“এই রিয়াজ আমাকে আবার কোন ঝামেলায় ফেললো। বুড়ো বয়সে আমাকে হেনস্তা করিয়ে ছাড়বে।”

এদিকে ইভান আর সানায়া একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ইদানীং তাদের প্রায়ই দেখা হয়। তাদের বন্ধুত্বও খুব জমে উঠেছে। যেই ইভান খুব কম হাসতো, সে এখন প্রাণখুলে হাসে। আর সেই হাসি বরাবরই সানায়াকে মুগ্ধ করে। প্রথমদিন থেকেই ইভানের ব্যক্তিত্ব সানায়াকে মুগ্ধ করেছিল। সেই থেকে সে যতোবারই ইভানকে দেখেছিল, মুখে গম্ভীর ভাব রাখলেও মনে মনে খুব খুশি হতো। মাওশিয়াত আর ইমনের এনগেজমেন্টেও যাওয়ার মূল কারণ ইভানকে দেখা। তবে সানায়া তার অনুভূতির কথা কাউকে বলে নি, এমনকি রাহিও এসব জানে না। তার ভালো লাগা সে নিজের মাঝেই জমিয়ে রেখেছে।

সানায়া আর ইভান কথা বলছিল, হঠাৎ এক মহিলা চেয়ারে বসতে গিয়ে ধপ করে নিচে পড়ে গেলো। ইভান উঠে মহিলাটিকে বসিয়ে তার কোলের বাচ্চাকে নিয়ে নিলো। মহিলাটির কোলে এক বছর বয়সী একটা বাচ্চা ছিল। রেস্টুরেন্টের অনেকেই মহিলাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর ইভান সেই বাচ্চাটির কান্না থামানোর জন্য বিভিন্ন মুখোভঙ্গি দিচ্ছে। সানায়া তা দেখে আনমনে হাসছে। ইভান মহিলাটির ব্যথা কমলে, তার কোলে বাচ্চাটিকে দিয়ে দিলো। এরপর সে খাবারের বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। সানায়া তাকে বলল,
“বাচ্চাদের সাথে খুব সখ্যতা আছে দেখছি!”

ইভান হেসে বলল,
“ওটা তো অনেক শান্ত বাচ্চা ছিল। যেখানে একটা রগচটা বাচ্চাকে বড় করে তুলেছি, সেখানে সখ্যতা তো থাকবেই।”

“কে সে?”

“অরুণিকা। সেই দুষ্টু ছিল মেয়েটা। তবে ও আমাকে অনেক ভয় পাই।”

“স্বাভাবিক, যা এক্সপ্রেশন দেখাও। তোমার চোখ দেখলে বড়-বুড়োরাও ভয় পেয়ে যাবে।”

ইভান হেসে বলল,
“কিন্তু, তুমি তো একটু ভয় পাও না।”

সানায়া মনে মনে বলল,
“যেই রাগী চেহারার উপর পটে আছি, সেটা দেখে ভয় পাই কিভাবে বলো?”

(পরবর্তী পর্বে থাকবে থ্রিলড।)

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here