অরুণিকা পর্ব -৭০+৭১

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৭০||
#রহস্যের_উন্মোচন

১১৪.
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই আহনাফের ঘুমটা ভেঙে গেলো। চেয়ার থেকে মাথা তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে লাইব্রেরিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পাশের চেয়ারে তূর্য মাথা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে সামনের সোফা থেকে একটা কুশন এনে তূর্যের মাথার নিচে দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে লাইব্রেরি থেকে বের হলো। সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে তখনই মাওশিয়াতের চেঁচামেচি শুনে থমকে গেলো। অরুণিকার রুম থেকেই চেঁচামেচির শব্দটা আসছে। আহনাফ সেদিকে যেতেই আরাফ আর ইভানও নিজেদের রুম থেকে বের হলো। তারা মাওশিয়াতকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই অরুণিকার রুমে ঢুকে তিনজনই স্তব্ধ হয়ে গেলো। মাওশিয়াত শতাব্দীকে মেঝে থেকে উঠানোর চেষ্টা করছে। আর ঘরে কোথাও অরুণিকা নেই। আহনাফ পুরো ঘরে অরুণিকাকে না পেয়ে অন্য ঘরে তাকে খুঁজতে গেলো। এদিকে ইভান আর মাওশিয়াত শতাব্দীকে উঠিয়ে হুইলচেয়ারে বসালো। শতাব্দীর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। তার চোখেমুখে ভীতি। সে নিজের সব শক্তি দিয়ে কন্ঠ থেকে শব্দ বের করার চেষ্টা করতে চাইছিলো। কিন্তু একটা শব্দও বের করতে না পেরে, সে কেঁদে দিলো। শতাব্দীর ছটফটানো দেখেই সবাই বুঝলো ভালো কিছু হয় নি। আরাফ বারান্দায় গিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলো, বারান্দায় অরুণিকার পায়ের স্যান্ডেলটা পড়ে আছে। স্যান্ডেলটা হাতে নিয়ে সে রুমে এসে দেখলো, অন্য স্যান্ডেলটি ঘরের ভেতরে। আরাফ শতাব্দীর সামনে বসে বলল,
“শতাব্দী, রাতে কি কেউ ঘরে এসেছিল?”

শতাব্দী চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললো। আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “অরু কোথায়?”

শতাব্দী বারান্দার দিকে তাকালো। ইভান বারান্দায় এসে ভালোভাবে আশেপাশে তাকালো। তারপর রুমে ঢুকতেই আহনাফ অরুণিকার ঘরে এসে বলল,
“অরু কোথাও নেই।”

তাহমিদ, তূর্য আর ইমনও ততোক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তাহমিদ নিচে নেমে বাইরে পাহারারত পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলো, অরুণিকাকে দেখেছে কিনা। কিন্তু তারা কাউকে ঘরের আশেপাশে আসতেও দেখে নি, যেতেও দেখে নি। তারা সবাই চিন্তিত হয়ে বসার ঘরে পায়চারি করছে। মাওশিয়াত শতাব্দীর হাত ধরে একপাশে বসে আছে। হঠাৎ আরাফের ফোনে একটা কল এলো। আরাফ নম্বর না দেখেই কল রিসিভ করে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“হ্যালো, হ্যালো, অরু?”

ওপাশ থেকে অট্টহাসির শব্দ ভেসে এলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আরবান মামা?”

আরবান নামটা শুনেই ইমন আরাফের কাছ থেকে ফোন টেনে নিয়ে কলটা লাউডস্পিকারে রাখলো।

আরবান তালুকদার বললেন,
“হ্যাঁ, আমি আরবান তালুকদার। তোমার মামা।”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অরু কোথায়?”

আরবান তালুকদার আবার হেসে উঠলেন। আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন,
“বাব্বাহ, আমাদের ছোট্ট সোনামণির জন্য তোমাদের কতো চিন্তা! জেনে বেশ ভালোই লাগছে। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী বেঁচে থাকলে নেহাত বলতেন, আমার মেয়ে ভাগ্য নিয়ে এসেছে। সৌভাগ্যবতী অরুণিকা।”

তূর্য চেঁচিয়ে বললো,
“কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলুন, অরুণিকা কোথায়?”

“অরুণিকা চৌধুরী, ওরফে তোমার টুইংকেল তার ছোট্ট জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন সে আল্লাহকে স্মরণ করছে। খুব শীঘ্রই সে তার বাবা-মার কাছে চলে যাবে।”

আহনাফ এই কথা শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাগের মাথায় সামনে থাকা ছোট টেবিলটিতে সজোরে লাথি মারলো। ইমনের হাত থেকে ফোন টেনে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“অরুর যদি কিছু হয়, আমি তোকে খুন করবো।”

আরবান তালুকদার হেসে বললেন,
“আগে তো তোমার ছোট্ট বউকে বাঁচাও। তারপর এমন ভারী ভারী বাক্য শুনবো। এখন তেমন একটা মজা পাচ্ছি না। মজা তো তখন হবে, যখন তোমরা ছ’জন কুকুরের মতো দৌঁড়াবে, আর ওদিকে আমাদের ছোট্ট সোনামণি বিড়ালের মতো মিউ মিউ….”

আহনাফ আরবান তালুকদারের পুরো কথা শুনলো না। রাগের মাথায় ফোনটা মেঝেতে আছাড় মারলো। আরাফ আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ফোন ফেলে দিলি কেন? অরু কোথায় আছে, এটা তো জানতেই পারলাম না।”

আহনাফ আরাফের কলার ধরে বলল,
“তোর রুমের পাশেই অরুর রুম ছিল। তুই একটুও বুঝতে পারিস নি? তোর তো কোনো মাথা ব্যথায় নেই।”

তূর্য আহনাফকে একপাশে টেনে আনলো। আরাফ স্তব্ধ হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আরাফের কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলল,
“ওর মাথা ঠিক নেই। অরুণিকার চিন্তায় উল্টাপাল্টা বকছে।”

আরাফ ইমনকে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আমার চেয়ে বেশি ওর চিন্তা হচ্ছে? অরু আমার প্রাণ। ও আমার বাচ্চা। আমি বাবার মতো ওকে বড় করেছি। আমি শরীর আর মনের সব শক্তি খরচ করে ওকে এতো বড় করে তুলেছি। তুই কি বুঝবি আমার মাথা ব্যথা?”

ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“তোরা চুপ করবি এখন? এভাবে ঝগড়া করে কি কোনো লাভ হবে?”

এবার তাহমিদ বলল,
“কেউ বারান্দা টপকে অরুণিকার ঘরে এসে ওকে নিয়ে গেলো, আর বাইরের পাহারারত পুলিশ কর্মকর্তাগুলো কি সারারাত ঘাস কেটেছিল?”

এদিকে ইমান ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার মায়াভরা ছবি দেখেই যেন তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। হঠাৎ তার সহকর্মী ছাদে এসে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ইমান, তোমার জন্য খারাপ সংবাদ আছে। অরুণিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

ইমান কথাটি শুনেই চমকে উঠলো। সে সাথে সাথেই আরাফকে ফোন করলো। কিন্তু আরাফের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। সে এরপর ইমনকে ফোন করলো। ইমন পুরো ঘটনাটি ইমানকে বলতেই ইমান সব বুঝে গেলো। ইমান ইমনের কল কেটে আরেকটা নম্বর ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই ইমান চেঁচিয়ে বলল,
“কি করতে চাইছো তুমি, বাবা? অরুর কিছু হলে আমি তোমাদের কাউকে ছাড়বো না।”

ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে ইমানের বাবা বললেন,
“এটাই হওয়ার ছিল, ইমান। মেয়েটা তো তোমার চেয়ে বেশি অন্য কাউকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাহলে ওর বাঁচা-মরায় তোমার কিইবা আসে যায়?”

“আমি ওকে ভালোবাসি। তাই আমার আসে যায়।”

“ও তোমাকে ভালোবাসে না। আর তোমার ওই মেয়ের নাম মাথা থেকে মুছে ফেলা উচিত।”

ইমান রাগী কন্ঠে বললো,
“অনেক করে ফেলেছো। এবার আর না। আমি সবাইকে তোমাদের কথা জানিয়ে দেবো। তোমরা কারা কারা জড়িত আছো, সবাইকে ধরিয়ে দেবো।”

ওপাশের লোকটি হালকা হাসলেন। তারপর বললেন,
“রক্তের সম্পর্ক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তুমি পারবে না, বাবা। আমি তোমাকে কতো কষ্ট করে বড় করেছি। তুমি তোমার বাবার ক্ষতি করতে পারবে না।”

ইমান কল কেটে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবা নামটা দেখে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে অরুণিকার মায়াবী মুখটা ভেসে উঠলো। সে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। তারপর আহনাফের নম্বরে কল দিলো। আহনাফ কল রিসিভ করতেই ইমান আহনাফকে কিছু বলতে না দিয়েই বলতে লাগলো,
“আমি জানি, আদিল ভাইয়াকে কে মেরেছিল। আমি জানি, আরবান তালুকদারের সাথে কে জড়িত আছে। আমি জানি রহমতুল্লাহ কার কথায় আপনাদের পরিবারের সবাইকে মেরেছিল। আমি এটাও জানি আজ কি হবে। আর অরুণিকা কোথায় থাকতে পারে। আমি সব জানি।”

আহনাফ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমান তাকে সবকিছুই সংক্ষেপে বললো। আহনাফ বলল,
“আমি কাল রাতেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তুমি যে তার ছেলে, এটা ভাবতেও পারি নি। এখন অরুকে কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাই বলো?”

“তাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা ছিল মুরাদপুরে একটা হামলা করাবে। এই হামলার মূল উদ্দেশ্য সাহিল মির্জাকে মেরে ফেলা। তারা ক্ষোভের বশেই অরুণিকাকে মারতে চাইছে। তারা চেয়েছিল অরুণিকার সাথে আরবান তালুকদারের বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে মৈত্রীর সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিতে। যখন জানলো, আমি ওকে ভালোবাসি। তখন আমাকেই বাধ্য করতে লাগলো। ওদের প্ল্যান জানার পর আমি অরুণিকা থেকে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই হয়তো তোমাদের উপর ক্ষোভ থেকেই ওকে মারতে চাইছে। ওরা জানে অরুণিকার কিছু হলে তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে। আহনাফ ভাই, আমার বাবা খুনী, শাহেদ মির্জা খুনী নন। রহমতুল্লাহ তোমাদের ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য শাহেদ মির্জার নাম নিয়েছিল। কারণ শাহেদ মির্জার সাথে রহমতুল্লাহর ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল।”

“জানি, আসল খুনী তো সেই সিকান্দার বস। আদিল ভাইয়াকে সিকান্দার বসই মেরেছিল। তূর্যের বিয়ের দিন সে-ই আদিল ভাইয়ার উপর হামলা করেছিল।”

“ভাইয়া, অরুণিকা হয়তো আরবান তালুকদারের কাছেই জিম্মি, নয়তো মুরাদপুরের আশেপাশে কোথাও তাকে আটকে রেখেছে। বোমটা কখন বার্স্ট হবে আমি জানি না। কিন্তু আজই যেকোনো সময় হতে পারে৷ আমি রাখছি, আমি আমার দিক থেকে সব চেষ্টা করবো।”

ইমান কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তথ্য বের করে, আরবান তালুকদারের ঠিকানা আহনাফকে ই-মেইলে পাঠিয়ে দিলো। মাওশিয়াত আর শতাব্দীকে একা রেখেই ছ’জন তাদের পনেরো বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ও তাদের একমাত্র প্রাণকে বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে পড়লো।

১১৫.

আরবান তালুকদার তন্নির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বন্দুকের ঠা ঠা শব্দ কানে আসতেই আরবান তালুকদারের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। পাশের ড্রয়ার থেকে একটা কালো কোট বের করে তা পরে নিলেন। কোট পরতে পরতে তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিচে আরাফ, ইমন আর তূর্যকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। তারপর আলমারি থেকে কালো গ্লাভস বের করে পরে নিলেন। এরপর ড্রয়ার থেকে একটা কালো মুখোশ বের করলেন। সেটিও মুখে লাগিয়ে তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। নিজেকে দেখে তিনি হাসতে লাগলেন।

সেদিন সময়টা ছিল সন্ধ্যা সাতটা। মৈত্রী ম্যানশনে হঠাৎই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মহল্লায় থাকা সবাই চমকে উঠলো। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ গেলেও মৈত্রী এলাকার রাস্তার হেডলাইটগুলো কখনোই বন্ধ হয় নি। আর আজ হঠাৎ পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে গেল কেন? রহমতুল্লাহর ছেলে রুকন এসে আরবান তালুকদারের সামনে দাঁড়ালো। বাড়ির প্রধান গেইট, ভেতরের গেইট, প্রতিটি বাড়ির সামনের গেইটে ক’জন অস্ত্রধারী পাহারাদার আছে, সব তথ্য দিলো। আরবান তালুকদার পেছনে ইশারা করতেই একটা ছোট ট্রাকের পেছন থেকে ষাট জন মুখোশ আর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নেমে পড়লো। আরবান তালুকদারের হাতের ইশারায় দেরী না করেই ষাট জনই মৈত্রী ম্যানশনের প্রধান গেইট দিয়ে ঢুকেই গুলি চালাতে লাগলো। নিস্তব্ধ অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকাটি যেন মুহূর্তেই ভয়ংকর হয়ে উঠলো। আশেপাশের বাড়িগুলোর দারোয়ানরা গেইট বন্ধ করে দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। আঠারো মিনিটের ব্যবধানে পাহারাদারদের হত্যা করে ষাট জন মুখোশধারী লোক বিভক্ত হয়ে প্রথমে ইমতিয়াজ মাহবুবের বাড়িতে ঢুকলো, তারপর হাকিম আহমেদের বাড়িতে ঢুকে সবাইকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করলো। তারপর আলীম হোসেনের বাড়ি, এরপর আশেপাশে তাদের আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে হামলা চালালো। সবার শেষে আরবান তালুকদার চৌধুরী বাড়িতে ঢুকলেন। ততোক্ষণে আনিস চৌধুরী জানালার ফাঁক দিয়ে কালো কোট পরা আরবান তালুকদারকে দেখে ফেললেন। তবে তিনি জানতেন না, এই লোক আরবান তালুকদার হবে কিনা। কারণ কয়েক মাস আগে তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য একটা বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়ে একটা সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছিল। আর সেখানে সবাইকে মৈত্রী গ্রুপ থেকে কালো কোট দেওয়া হয়েছিল। আর এই কোট শুধু তাদের পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়দেরই থাকার কথা। আর সেই সমাবেশে মুরশিদ জুবাইয়ের উপস্থিত থাকলেও তার কালো কোটটিতে ত্রুটি থাকায় সেটি সমাবেশের আয়োজকের হাতে দিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। আনিস চৌধুরী ভাইকে এই কথা জানাতেই, জুবাইয়ের করিম চৌধুরী সাথে সাথে ফোন দিয়ে মুরশিদ জুবাইয়েরের কাছে সাহায্য চাইলেন। আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশজন অস্ত্রধারী লোক একই সাথে চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে পড়ল। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারের সবার মুখের দিকে না তাকিয়েই তার আদরের কন্যা অরুণিকাকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। ততোক্ষণে আরবান তালুকদার পিস্তল তাক করে আরাফের বাবা আরহাম চৌধুরীর বুকে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। অরুণিকা সাথে সাথেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মেয়েকে রান্নাঘরের কেবিনেটে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি না আসা পর্যন্ত তুমি একটা শব্দও করবে না। এখান থেকে বেরও হবে না।”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা হেলিয়ে দিতেই তিনি কেবিনেটের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর নিজেকে পিলারের আড়ালে রেখে বসার ঘরের টেবিলে রাখা সমাবেশে আসা মেহমানদের তালিকাটি উঠিয়ে নিলেন। কারণ এর মধ্যেই খুনীর নাম থাকবে। আর তখনই তার উপর কেউ গুলি ছুঁড়লো। পিঠে আর হাতে দুইটা গুলি লাগায় জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মাটিতে ঢলে পড়লেন। এরপর ঘরের সবাইকে মেরে ফেলার পর আরবান তালুকদারের লোকেরা এসে যখন বলল, আর কেউ বেঁচে নেই। তখন আরবান তালুকদার মুচকি হেসে বললেন,
“প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দাও। যাতে এদের অস্তিত্বও এই বাড়িতেই মিশে যায়। কারো চিহ্নও যাতে অবশিষ্ট না থাকে।”

সেই রাতের দৃশ্যটি ভাবতে ভাবতেই আরবান তালুকদার নিজের পিস্তলে গুলি ভর্তি করতে লাগলেন, আর মনে মনে বললেন,
“সেদিন যাদের মারতে পারি নি আজ তাদের মেরে আমার রক্ত ঠান্ডা করবো।”

তূর্য ধাক্কা দিয়ে আরবান তালুকদারের রুমের দরজা খুলতেই আরবান তালুকদার তার পিস্তলের প্রথম বুলেটটি তূর্যের দিকে ছুঁড়লো। বুলেটটি সোজা তূর্যের কাঁধে এসে লাগলো। তূর্য দরজার কাছেই ধপ করে বসে পড়লো। আরাফ আর ইমন তূর্যকে এভাবে ঢলে পড়তে দেখেই তার দিকে দৌঁড়ে এলো। ততক্ষণে আরবান তালুকদারের কিছু লোক এসে ইমন আর আরাফকে মারতে লাগলো। আরাফ তূর্যের অবস্থা দেখে নিজের সব শক্তি দিয়ে লোকগুলোকে মারলো। আরবান তালুকদার তূর্যের পায়ে আরেকটা গুলি ছুঁড়লেন। তূর্য পা ধরে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ইমন আরবানের লোকগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তূর্যকে টেনে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। আরবান তালুকদার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ইমনের দিকে পিস্তল তাক করলেন। ইমন তূর্যকে ধরে একপাশে বসে আছে। সে স্থির দৃষ্টিতে আরবান তালুকদারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনই আরাফ পেছন থেকে এসে আরবান তালুকদারের পিঠে ছুরি চালিয়ে দিলো। ঠিক যেভাবে রহমতুল্লাহ আহনাফের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছিল সেভাবেই। আরবান তালুকদার দুর্বল হয়ে পড়তেই ইমন উঠে তার হাত থেকে পিস্তলটি কেঁড়ে নিলো। আর তার মুখের মুখোশটা টেনে খুলে ফেললো। আরবান তালুকদার দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। আরাফ আরবান তালুকদারের পিস্তলটি হাতে নিয়ে বলল,
“অনেক হয়েছে, আর না।”

আরবান তালুকদার কাঁপা গলায় বললেন,
“তুমি আমাকে মারবে, আরাফ? তোমার মামাক মারবে?”

আরাফ গর্জন করে বলে উঠলো,
“আপনি আমার পুরো পরিবারকে খুন করেছিলেন।”

“কারণ আছে। কারণ তোমার মা। তোমার বাবা, তোমার দাদা-দাদি, তোমার পুরো পরিবার তোমার মাকে হত্যা করেছিল। তন্নি আমাকে চিঠি লিখেছিল।”

“ভুল, আপনি ভুল বুঝেছিলেন। সংসারে অনেক ঝামেলা হয়৷ মা সেই ফ্রাস্টেশন থেকেই তার ভাইকে চিঠি লিখেছিল, আর বলেছিল, তাকে একটু দেখতে আসতে। আমার জন্মের পর মা অসুস্থ হয়ে যায়। মাকে কেউ সন্তান নিতে বাধ্য করে নি। মেজো বাবার দুই দুইটা ছেলে হয়েছিল। তারপরও মা সন্তান নিতে পারছিল না। তবুও এই নিয়ে কারো কোনো আফসোস ছিলো না। এমনকি মেজ বাবা আর মেজ মা জিসান ভাইয়াকে দত্তক হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু মা নিজের ছেলে চেয়েছিলেন। নিজের ইচ্ছায়, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। কেউ তাকে মারে নি। কেউ মাকে কষ্ট দেয় নি। এটা শুধু কিছু সময়ের আক্ষেপ ছিল। আর সেই আক্ষেপ থেকে আপনি এতোগুলো মানুষকে খুন করেছেন? অরুর বাবা-মা, ভাইদের মেরেছেন, আহনাফের বাবা-মাকে মেরেছেন, ছোট আব্বার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, মৈত্রীদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুন করেছেন। সেই রাতে আশি জন লোক খুন হয়েছিল। আপনি বাড়ির কাজের লোকদেরও রেহাই দেন নি। আপনি তো মানুষ না। আপনি তো একটা পশু।”

আরবান তালুকদার হাসতে হাসতে বললেন,
“মেরেছি, বেশ করেছি। আমি নিজ হাতে তোর বাবাকে মেরেছি। তোর দাদার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছি। তোর ছোট আব্বার ছেলে দিশানের গলাটা কেটে তোর দাদির কোলে দিয়ে এসেছি। তার তো নাতির অনেক শখ! তোকেও মেরে ফেলতাম। কিন্তু তুই ছিলি না। যখন জানলাম তুই বেঁচে আছিস, তখন ভাবলাম, তোকে পরে মারবো। আগে যারা মরেছে তাদের তো মিটিয়ে দেই। তারপর তোদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেই, আর সেই রাতেই তোর পুরো পরিবারকে আমি ধোঁয়ার সাথে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম।”

আরাফের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে একে একে সব গুলি ছুঁড়ে আরবান তালুকদারের বুকটা ঝাঁঝরা করে দিলো। এতেও সে শান্ত হলো না। সে আরবান তালুকদারের নিথর শরীরটা টেনে এনে মেঝে থেকে ছুরিটা হাতে নিলো। তারপর একটার পর একটা আঘাত করতে লাগলো। আরাফকে এই মুহূর্তে উন্মাদের মতো লাগছে। সে চিৎকার করে কাঁদছে। ইমন তাকে টেনে সরিয়ে আনলো আর তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শান্ত হো আরাফ। শান্ত হো। লোকটা মারা গেছে। এখন তূর্যের অবস্থা খারাপ। আমাদের ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”

আরাফের হুঁশ ফিরতেই সে তূর্যের দিকে ছুটে গেলো। ইমন আর আরাফ তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিচে নামলো। আরাফ গাড়িতে উঠেই আরবান তালুকদারের ব্যাপারে সব কিছুই মুরশিদ জুবাইয়েরকে জানাল। মুরশিদ জুবাইয়ের তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
“আমি সব ব্যবস্থা করব। আরবান তালুকদারের হত্যাকে আমি দুর্ঘটনার নাম দিয়ে দেবো। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না, আরাফ। হত্যার বদলে হত্যা। এটাই ন্যায় বিচার।”

১১৬.

প্রায় দুই ঘন্টা ধরে মুরাদপুরের অলিগলি ছুঁটছে তাহমিদ, ইভান আর আহনাফ। বোম ঠিক কোথায় রাখা হয়েছে এ নিয়েও সবাই সন্দেহে আছে। নিরাপত্তা বাহিনী এসে তাদের যন্ত্র দিয়ে পুরো জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়েছে। কিন্তু কোথাও কিছুই পাওয়া যায় নি। সবাই ব্যাপারটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত মুরাদপুরের আশেপাশের সব রাস্তা বন্ধ। এমন জায়গা বন্ধ রাখলে পুরো শহরের চলাচল খানিকটা স্থবির হয়ে যাবেই। বারোটার পর আবার সব স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগলো। মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর কথা শুনতে আগ্রহী নয়। এলাকাটা এতো বড়ও নয় যে বোম রাখলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে আহনাফদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ইমানকে বিশ্বাস করবে কি করবে না সেই দ্বন্ধে ভুগছে তিনজন। তাহমিদের পা’টা অসম্ভব ব্যথা করছে, ইভানের চোখ জ্বালা করছে, আহনাফের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। তাদের তিনজনেরই রোদের তাপে পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে৷ গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবুও তাদের একটু পানি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে অরুণিকাকে পেলেই যেন সব তৃষ্ণা মিটবে। এদিকে তূর্যকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে সবটা জানাতেই মাওশিয়াত তাড়াতাড়ি উপমাকে তূর্যের খবর দিলো। উপমা সব শুনে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে পৌঁছালো। সে তূর্যের জন্য কাঁদছে তো কাঁদছেই। ইমন তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত। এদিকে আরাফ পাথরের মতো বসে আছে। সে নিজের হাতে কোনো মানুষকে খুন করেছে। তাই তার নিজেকেই কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছে। ইমন আরাফের দিকে একনজর তাকিয়ে উপমাকে ধমক দিয়ে বলল,
“এতোদিন তো আমার বন্ধুর খবর নাও নি। এখন এসে এসব ন্যাকামো করছো কেন? চুপ করে বসে থাকো। নয়তো ধাক্কা দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেবো। আসছে বউগিরি দেখাতে!”

উপমা ইমনের কথায় নির্বাক হয়ে গেলো। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে ধপ করে হাসপাতালের বেঞ্চে বসে পড়লো। মুহূর্তেই তূর্যের শুকনো মুখটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কতোবার তার অফিসের সামনে গিয়ে তূর্য দাঁড়িয়েছিল, কতোবার তার বাড়ির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চেয়েছিল, তূর্য শুধু একটাবার সুযোগ চেয়েছিল। কিন্তু উপমা একটুও সাড়া দেয় নি। উপমা দুই হাত উঠিয়ে মনে মনে বলল,
“আল্লাহ, আমাকে একটা শেষ সুযোগ দাও। আমি তূর্যকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি ওকে আর কষ্ট দেবো না। ওকে আর দূরে সরিয়ে দেবো না। আল্লাহ, প্লিজ ওকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দাও। প্লিজ আল্লাহ। তূর্য সুস্থ হলে আমি টানা ত্রিশটা রোজা রাখবো। এতোদিন যতো টাকা জমিয়েছি সব দান করে দেবো। তূর্যকে সুস্থ করে দাও, আল্লাহ।”

এদিকে ‘টুইংকেল হাউজ’ এর বাড়ির দরজার সামনে চার-পাঁচজন মুখোশধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাওশিয়াত দরজার পীপহোল দিয়ে লোকগুলোকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। সে শতাব্দীকে নিয়ে বসার ঘরে চলে এলো। বসার ঘরের পাশেই, একটা রুম আছে, তারা সেখানে চলে গেলো। শতাব্দীকে হুইলচেয়ার থেকে নামিয়ে এক কোণায় বসিয়ে জিনিসপত্র দিয়ে তাকে ঢেকে দিলো। তারপর সে নিজেও একটা কেবিনেটে ঢুকে বসে রইলো। মাওশিয়াত সন্তানসম্ভবা। এর মধ্যে সে লোকগুলোর সাথে মারপিট করতে পারবে না। যদিও সে জুডো বিদ্যায় পারদর্শী। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের সন্তানের জন্য কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সে ইমনকেও জানাতে চাচ্ছে না, যদি ইমন এখানে এসে কোনো বিপদে পড়ে? হঠাৎ বাইরে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেলো। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠলো। মাওশিয়াত ধীরে ধীরে ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভারটা উঠাতেই রিয়াজুর রহমানের কন্ঠ শুনে থমকে গেলো। রিয়াজুর রহমান বললেন, “হ্যালো, হ্যালো।”

মাওশিয়াত কাঁপা কন্ঠে বলল, “হ্যালো।”

“কে বলছেন? মিসেস ইমন মাহবুব?”

“জ্বি।”

“আমি রিয়াজুর রহমান। আপনাদের বাসার বাইরে কিছু হামলাকারী ছিল। ওদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দরজা খুলুন। আমি আর শাহবাজ খান বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”

মাওশিয়াত সাহস নিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই দেখলো কিছু পুলিশ সদস্যকে সাথে নিয়েই শাহবাজ খান আর রিয়াজুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ভেতরে ঢুকে শতাব্দীকে বের করে আনলো। বাড়ির গেইটে ভালোভাবে তালা লাগিয়ে মাওশিয়াত ইমনকে বলল সে শতাব্দীকে নিয়ে রিয়াজুর রহমানের বাড়িতে যাচ্ছে। ইমন অনুমতি দিতেই সে চলে গেলো। রিয়াজুর রহমানের বাসায় এসেই মাওশিয়াত বলল,
“কাল রাতে মুন্সী আংকেলের পরিবাররা আপনার সাথেই এসেছিল। ওরা কোথায়?”

রিয়াজুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“ওরা আমার নতুন বাড়িতে। এটা আমার নিজের বাড়ি। ভেতরে আমার মা আছেন।”

মাওশিয়াত শতাব্দীকে নিয়ে রিয়াজুর রহমানের মায়ের ঘরে এলো। সে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে কাকে বিশ্বাস করবে, বুঝতে পারছে না। তাই রিয়াজুর রহমান তার পরিচিত এক বোনকে বাসায় আসতে বললেন। মাওশিয়াত যেহেতু সন্তানসম্ভবা তার এখন মনটা স্থির থাকা উচিত। তার বয়সী কোনো মেয়ে যদি তার আশেপাশে থাকে, তাহলে সে মানসিকভাবে শান্ত থাকবে। এদিকে সে কিছুক্ষণ পর পর ইমনের সাথে কথা বলছে। ইমন ঠিক আছে কিনা কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করছে। একদিকে তূর্যের অপারেশন চলছে, অন্যদিকে আরাফ পাথরের মতো বসে আছে। ইমন সব ফেলে তো আর মাওশিয়াতের কাছে আসতে পারবে না। তাই সে মাওশিয়াতকে আশ্বস্ত করে বললো, সে তাড়াতাড়ি ফিরবে।

প্রায় আড়াই ঘন্টার মধ্যে ইমান শহরে পৌঁছালো। শহরে এসেই তার সহকর্মী থেকে সে সব খবর নিয়ে নিলো। ইমান বুঝতে পারলো, তার বাবা এখানে একটা চালাকি করেছে। তাই সে আহনাফকে একটা মেসেজ দিয়ে মুরাদপুরের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘুরালো।
এদিকে আহনাফ একটা বাড়ির সামনে তার বাইকটা থামালো। বাইক থেকে নেমে সে ধীর পায়ে বাড়িটিতে ঢুকলো।
রান্নাঘর থেকে পানি খেতে খেতে বেরিয়ে এলো ইশমাম মুন্সী। ইশমাম আহনাফকে দেখে চমকে উঠলো। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহনাফ, তুমি এখানে?”

“আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনার একটা সাহায্য লাগবে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। কি সাহায্য লাগবে, বলো?”

“অরুণিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কি বলতে পারবেন ও কোথায় আছে?”

ইশমাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“আমি কিভাবে বলবো?”

“সেটাই তো। কিন্তু আমার যতোদূর ধারণা আপনি না জানলেও সিকান্দার বস সব জানবে।”

ইশমাম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই সোফার কোণা থেকে একটা পিস্তল বের করে আহনাফের সামনে ধরার আগেই আহনাফ তার বুকে সজোরে একটা লাথি মারলো। ইশমাম ছিটকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। আহনাফ ইমানের সহকর্মীদের ইশারায় বলল, দরজা বেঁধে দিতে। তারপর সে ইশমামের পিস্তলটি পা দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে ইশমামের সামনে বসে পড়লো। ইশমাম ভীত চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলল,
“আমার অরু কোথায়?”

“আমি কিভাবে জানবো, আহনাফ? তুমি আমাকে কেন মারতে চাইছো?”

“ইমান আমাকে সব বলে দিয়েছে। আদিল ভাইয়াকে তুই খুন করেছিস। নিজেকে তৈমুর হিসেবে পরিচয় দিয়েছিস। আর তোর বাবা শাহবাজ খানের পরিচয়ে এতোদিন এতো অন্যায় করেছে! আর গতকাল সিকান্দার বসের পরিচয় দিয়ে আমার কাজটা তো তুই আরো সহজ করে দিয়েছিলি৷ সিকান্দার বস নামের কেউই নেই। এটা তোর ছদ্মনাম। সাবা মির্জার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার নাম সিকদার শেখ। কলকাতায় আমি তার কোম্পানিতেই কাজ করতাম। ইশ! কিভাবে ফেঁসে গেলি তুই, তাই না? তুই যেই ফেইক ডাটা অনলাইনে ছেড়েছিস, ভুল করে ওখানের একটা ডাটায় তোর হ্যাকার তারিখ চেঞ্জ কর‍তে ভুলে গিয়েছিল। আর ওই তারিখ দেখেই বুঝলাম, সিকান্দার বসের কোনো অস্তিত্বই নেই। এই নামটা তো নতুন করে অনলাইনে এসেছে। আমি আরো ভাবছি, আগে পিছে দুই বছর আগের ছবি। মধ্যের ছবিটা ওয়ান ডে এগো কিভাবে সম্ভব? বাহ, হ্যাকারও রেখেছিস, তাই না? তুই তো মাস্টারমাইন্ড। গতকাল নিজেদের উপরই মিথ্যে হামলা করে কি চমৎকার ভাবে আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করতে চেয়েছিলি। আর এদিকে আমাদের সবার ফোনের সব ডাটা নিজের কাছে রেখেছিস। যখন আমরা বুঝে গেছি, তখন আরবান তালুকদারকে আমাদের বাসায় পাঠিয়েছিস। আমাদের লাইব্রেরির সিসিটিভি ফুটেজ পর্যন্ত ডিলিট করিয়ে দিয়েছিস। ইন্টারেস্টিং।”

ইশমাম মুন্সী ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এখানে আমার কোনো হাত নেই। আমি সব বাবার কথায় করেছিলাম। বাবারই মৈত্রীদের সাথে শত্রুতা ছিল। বাবা মৈত্রীদের খুন করিয়েছিল। আমি তো শুধু তার কথামতো কাজ করেছি। আদিল মধ্যে দিয়ে সব জেনে গিয়েছিল, তাই ওকে মেরে ফেলেছিলাম। ইমানও সব জেনে ফেলেছিল। কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে নি। ও অনেক ইমোশনাল ছেলে। বাবার অন্ধভক্ত। আমি তো ভাবতেই পারছি না, ও তোমাদের সব বলে দিয়েছে।”

“এখন বল, অরু কোথায়?”

ইশমাম আহনাফকে তাদের পরিকল্পনা আর অরুণিকাকে কোথায় রেখেছে সব জানালো। সব শুনে আহনাফ উঠে আসতে যাবে তখনই ইশমাম তার উপর হামলা করলো। আহনাফ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে তার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের পিস্তল বের করে ইশমামের উপর গুলি চালিয়ে দিলো। এরপর সে ইশমামের সামনে বসে তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে রিভলভারে আরেকটা চাপ দিলো। ইশমামের কপাল ফুঁড়ে বুলেটটি সামনের দেয়ালে এসে আটকালো। আহনাফ বাঁকা হেসে বলল,
“বলেছিলাম, আমি কাউকে ছাড়বো না। এখন মিস্টার সুলতান মুন্সী, শুধু তুমি এক জীব বাকি আছো। এরপর যুদ্ধ শেষ।”

চলবে–

(বেচারা আরাফ কিভাবে পোলের মধ্যে ভোট পেলো, সেটাই ভাবছি। আপনারা আরাফকে একটুও বিশ্বাস করতে পারলেন না? হায় হায়! আর যে আসল খুনী, তাকে কেউ ভোটই দিলো না।)#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৭১||

১১৭.
ইশমামের লোকেরা তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করতেই সুলতান মুন্সীর ক্ষোভ আরো বেড়ে গেলো৷ আহনাফ দু’জন লোকের সাথে এসে ইশমামকে মেরে ফেলেছে। সুলতান মুন্সী এই কথা জানার পর তার রাগ আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি তার লোককে ফোন দিয়ে বললেন,
“এরা ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ওই মেয়েকে মেরে ফেলো। আর কাজটা তাড়াতাড়ি হওয়া চাই।”

সুলতান মুন্সী ফোন রাখতেই তার ফোনে ইমানের কল এলো। ইমানের নম্বর দেখতেই সুলতান মুন্সী কঠিন সুরে বললেন,
“এখন কেন ফোন করেছো? আহনাফ তোমার বড় ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর তুমি….”

ইমান তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিই আহনাফ ভাইকে বড় ভাইয়ার ঠিকানা দিয়েছিলাম।”

সুলতান মুন্সী অবাক হয়ে বললেন,
“মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“এতোদিন মাথা ঠিক ছিল না। যখন থেকে তোমার কুকর্ম সম্পর্কে জেনেছি, আমার মাথাটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের আমি নিজের আইডল ভাবতাম, তারাই যদি এতো খারাপ হয়, তাহলে আমি তো কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়ছি না। তাই এখন মাথা ঠিক করে, নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে নেমেছি।”

“নেমেছি মানে? কোথায় তুমি এখন? তুমি তো রাঙামাটি গিয়েছিলে।”

“মুরাদপুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

সুলতান মুন্সী ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

“হ্যাঁ, পাগল তো হয়েই গেছি। যার বাবা খুনী, সেই মানুষ কিভাবে সুস্থ থাকবে? আমি অরুণিকাকে ভালোবাসতাম৷ তুমি আমার কাছ থেকে আমার ভালোবাসাই কেঁড়ে নিয়েছো।”

“ওই মেয়ে তোমাকে ভালোই বাসে না।”

“ভালোবাসতো। কিন্তু আমি খুব দেরী করে ফেলেছি। আর তুমিই বলো, আমার বাবা আমার ভালোবাসার মানুষটার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছে। আমি সেই মেয়েকে কিভাবে নিজের করে নেওয়ার সাহস পাবো? অরুণিকা যদি কখনো জানতে পারে, আমি তার বাবা-মার খুনীর সন্তান, ও আমাকে ঘৃণা করবে। তাই অন্তত আজ নিজেকে আমি ইমান মুন্সীর পরিবর্তে ইমান হিসেবে পরিচয় দিতে চাই। তুমি প্রতিশোধের কারণে এতো অন্ধ হয়ে গেছো যে সব হারিয়ে ফেলেছো। আর আজ আমাকেও হারাবে। আমি অরুণিকা আর সাহিল মির্জাকে বাঁচাবো। তুমি আমাকে বাঁচাতে চাইলে এই হামলাটা আটকাবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।”

ইমান কল কেটে দিল। সুলতান মুন্সী ছেলের কথা শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার লোকের নম্বরে কল দিতে যাবেন, তখনই শাহবাজ খান আর তার সাথে সাত-আটজন পুলিশ অফিসার এসে তাকে গ্রেফতার করল। সকালে উঠেই তিনি তার ছেলে ইশমামের সাথে রিয়াজুর রহমানের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান৷ তার বাড়ির বাকি সদস্যদের পুলিশ কাস্টাডিতে রাখা হয়েছে।
এদিকে সুলতান মুন্সী জরুরি কল করবেন বলে চেঁচাতে লাগলেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানেই তুললো না। তার ফোনটাও ছিনিয়ে নেওয়া হলো। সুলতান মুন্সী পাগলের মতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বয়স বেশি হওয়ায় পুত্রের চিন্তায় তার মস্তিষ্ক বিকার ঘটেছে। তিনি ঠিকভাবে একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে পারছেন না। ‘ইমান, ইমান, ফোন দাও, আমার ছেলে, বাঁচাও ওকে।’ এসব শব্দই ভাঙা ভাঙা ভাবে উচ্চারণ করছেন।

এদিকে অরুণিকার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে অন্ধকার পরিবেশে আবিষ্কার করলো। সে হাতে ভর দিয়ে উঠতেই মাথায় আঘাত পেলো। মাথায় হাত দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ছোট একটা জায়গায় সে আটকে আছে। ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝলো, সে কোনো গাড়ির ডিকিতে আটকে আছে। মনে হচ্ছে গাড়িটা ধীর গতিতেই চলছে। মাঝে মাঝে থামছে, আবার হর্ণও দিচ্ছে। অরুণিকা ডিকিতে জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো। সে কোনোভাবেই তার পা’টা নাড়াতে পারছে না। এদিকে গরমে তার মাথাটাও ঝিনঝিন করছে। এই মুহূর্তে তার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ড এখানে থাকলে সে মারা যাবে৷ অরুণিকা নিজের সব শক্তি দিয়ে গাড়িতে জোরে আঘাত করলো। গাড়িটাও কিছুক্ষণ পর থেমে গেলো। অরুণিকা বুঝতে পেরে ডিকির দরজায় বার-বার ধাক্কা দিতে লাগলো। হঠাৎ ডিকিটা খুলে গেলো। অরুণিকার চোখে আলো পড়তেই সে নিজেকে বের করার জন্য একটা হাত বের করে দিলো।
তার সামনে একটা অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কে? গাড়ির ডিকিতে কি করছো?”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমাকে কিছু লোক বাসা থেকে তুলে এনেছে। আমি আমার বাসায় যাবো।”

লোকটা অরুণিকার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে বুঝলো, মেয়েটা আসলেই বিপদে পড়েছে। কিন্তু তার গাড়ির ডিকিতে এই মেয়ে কিভাবে এলো? লোকটা অরুণিকাকে ধরে গাড়ির ডিকি থেকে নামালো। অরুণিকা ঝাপসা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে কোনো এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে অনেকগুলো গাড়ি। অরুণিকা বলল,
“আমি এখন কোথায়?”

“এটা মুরাদপুর।”

অরুণিকা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রাস্তায় প্রচুর জ্যাম পড়েছে। লোকটা বলল,
“তুমি বাসায় ফোন করবে?”

অরুণিকা গাড়ি ধরে হালকা এগিয়ে গেলো। গাড়ি, রিক্সা, সিন.এন.জিতে পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার এসব দেখে আরো মাথা ঘুরাচ্ছে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আরাফকে ফোন দেবো।”

অরুণিকা ফোন নিয়ে কোনোভাবে আরাফের নম্বরে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আর কারো নম্বর তার মুখস্থ নেই। তবে নিজের আর বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা তার মুখস্থ ছিল। সে প্রথমে টেলিফোন নম্বরে কল দিলো। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। তারপর নিজের নম্বরেই কল দিলো। সেটাও কেউ ধরছে না। হতাশ হয়ে অরুণিকা বলল,
“আমি বাসায় যাবো। আমার বাসা হালিশহর।”

লোকটা ভালো মানুষ। তিনি অরুণিকাকে রাস্তার অন্য পাশে নিয়ে এলেন। তিনি ভাবছেন, এই অবস্থায় মেয়েটাকে তার বাসায় নামিয়ে দেওয়ায় উচিত হবে। কিন্তু এই জ্যামের মধ্যে তিনি গাড়িটাও ঘুরাতে পারছেন না। আবার অরুণিকাকে একলাও ছাড়তে চাচ্ছেন না। তাই তিনি ভাবলেন তাকে থানায় নিয়ে যাবেন। পাশেই থানা আছে। আবার ভাবছেন, গাড়িটা মধ্য রাস্তায় রেখে থানায় গেলে, আবার তার গাড়ির জন্যই জ্যাম বাঁধবে।

এদিকে ইভান আর তাহমিদ হাঁটতে হাঁটতে আবার মুরাদপুরে ঢুকলো। রাস্তার একপাশে তাহমিদ, অন্যপাশে ইভান হাঁটছে। তাহমিদ আর হাঁটতে পারছে না। তার রাগে পা’দুটি কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তবুও সে থামছে না। অরুণিকাকে না পেলে সে শান্তি পাবে না। ইভানেরও ধৈর্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সে এবার কেঁদেই দিলো। হঠাৎ অরুণিকা রাস্তার ওপাশে তাহমিদকে হাঁটতে দেখে প্রাণ ফিরে পেলো। সে লোকটাকে বলল,
“ওই তো তাহমিদ, ওই তো, দেখো।”

লোকটা তাহমিদকে দেখার আগেই অরুণিকা চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,
“তাহমিদ, তাহমিদ, আমি এখানে।”

তাহমিদের নাম শুনে ইভান চমকে উঠলো। মনে মনে বলল, “এটা তো অরুণিকার কন্ঠ।”

সে এলোমেলো ভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে পেছনে হাঁটতে লাগলো। কয়েক পা বাড়াতেই দেখলো অরুণিকা তার সামনেই। অরুণিকা ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তার ওপাড়ে হাঁটতে থাকা তাহমিদের দিকে ছুটার জন্য পা বাড়াতেই ফুটপাতের উপর দিকে নিচে পড়ে গেলো। আর এদিকে ইভান অরুণিকাকে দেখে দৌঁড়ে তার দিকে ছুটে এলো। অরুণিকাকে নিচে পড়ে যেতে দেখে তার পাশে থাকা লোকটা, আর একজন রিক্সা চালক এগিয়ে এলেন। ইভানও ততোক্ষণে অরুণিকার কাছে চলে এসেছে। ইভানকে দেখে অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সে শক্ত করে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ইভানও অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। তারপর অরুণিকাকে দাঁড় করালো। লোকটা বলল,
“আপনি ওর আত্মীয় হোন?”

ইভান কাঁপা কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, ও আমার বোন। আমার প্রাণ।”

“ওহ আচ্ছা, ও আমার গাড়ির ডিকিতেই আটকে ছিল। বুঝলাম না, ও আমার গাড়িতে কিভাবে এলো।”

ইভান লোকটার কথা কিছুই শুনছে না। মাথা হেলিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে অরুণিকাকে কোলে নিয়ে ফুটপাতের উপর উঠে গেলো। তারপর অরুণিকাকে শক্ত করে ধরে রেখে তাহমিদকে ফোন করে খবরটা জানালো। তাহমিদ তাড়াতাড়ি রাস্তা পার করে অরুণিকাকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলো। ইভান আর তাহমিদ যেন তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দু’জনই একে অপরকে ঝাপটে ধরলো। অরুণিকা দুর্বল শরীর নিয়ে ইভানের শার্ট খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে দেখলো অরুণিকার পায়ে রক্তের দাগ। সে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“পায়ে ব্যথা পেয়েছো?”

অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ওরা আমায় অনেক মেরেছে। বেল্ট দিয়ে মেরেছে। বড় একটা লোহা দিয়েও মেরেছে।”

ইভান অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে কোলে উঠালো। তারপর তাহমিদের এক হাত নিজের কাঁধে উঠিয়ে বলল,
“আমার উপর ভার দিয়েই চল। সামনে জ্যাম নেই। ওখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে যাবো।”

তাহমিদ ততোক্ষণে অরুণিকাকে পাওয়ার খবর ইমনকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। আরাফ অরুণিকাকে খোঁজার জন্য বের হতে যাবে, তখনই ইমন আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“অরুণিকাকে পাওয়া গেছে। ওকে এখানেই আনছে।”

আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ও ঠিক আছে তো?”

“জ্ঞান আছে বললো। আর বেশিকিছু তো বলে নি। এখানে আনছে মানে আঘাত তো পেয়েছেই। আচ্ছা, আমি আহনাফকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছি।”

এদিকে ইমান মুরাদপুরের রাস্তার সামনে পেছনে চারটা গাড়ি বাঁকাভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝলো, তার বাবা ইচ্ছে করে এই গাড়িগুলো চারদিকে থেকে দাঁড় করিয়ে রাস্তা আটকে দিয়েছে। এই ভীড়ের মধ্যেই হয়তো কোনো গাড়িতে বোম রাখা আছে। তাই সে সামনে থেকেই প্রতিটা গাড়ির সামনে এসে বলতে লাগলো,
“গাড়ি থেকে নামতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোম বার্স্ট হবে।”

অনেকেই ইমানের কথা শুনে ভয়ে গাড়ি ফেলেই নামে যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষজনকে গাড়ি ফেলে দূরে যেতে দেখে বাকিরাও না বুঝে গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলো। এরইমধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এদিকে ইমান কোনোভাবেই সাহিলের গাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। সে মনে মনে ভাবলো,
“গাড়ি যদি ফ্লাইওভারে থাকে?”

এই মুহূর্তে ফ্লাইওভারের গাড়িগুলো থামানোর মতো সুযোগ নেই। কারণ যেখানে সবাই এই খবরকে গুজব ভেবে আবার রাস্তায় নেমে পড়েছে, সেখানে ব্যস্ত গাড়িগুলো থামাতে গেলে আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। হঠাৎ ইমান খেয়াল করলো একটা গাড়িকে ঘিরে সাত-আটজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ইমান দৌঁড়ে সেদিকে গিয়েই দেখলো গাড়িতে সাহিল মির্জা বসে আছে। ইমানকে দেখে সে ইশারায় বলল, রাস্তায় এতো হট্টগোল কেন?

ইমান বলল,
“আপনাকে মারার জন্য সুলতান মুন্সী এখানে আশেপাশে কোথাও বোম রেখেছেন।”

এই কথা শুনেই সাহিল মির্জা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এলো। ইমান বলল,
“আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালান।”

ইমানের কথায় বেশ জোর ছিল। তাই সাহিল মির্জা এই আগন্তুক ছেলের কথায় বিশ্বাস করে দৌঁড়াতে লাগলো। ইমান আশেপাশের গাড়িতে বসে থাকা সবাইকে বের হওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। হঠাৎ ইমান দাঁড়িয়ে গেলো। মুরাদপুরের আশেপাশে অনেকগুলো দোকান আছে, সেখানেও মানুষ আছে। তাদের কিভাবে বাঁচাবে সে? তার কেন যেন মনে হচ্ছে সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অরুণিকাকে কি পাওয়া গেছে? ও এখন কোথায়? এসব প্রশ্নই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার শরীরটাও বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আই লাভ ইউ, অরুণিকা। তুমি ভালো থাকলেই, আমি ভালো থাকবো। আমি হয়তো তোমাকে নিজের করে পাবো না। কিন্তু আমার মনে তুমি সবসময় থাকবে।”

বিকট শব্দ তুলে মুরাদপুরে একটা বিস্ফোরণ হলো। এই বিস্ফোরণে আশেপাশের এলাকা কেঁপে উঠলো। ফ্লাইওভারে বড় একটা ফাঁটল ধরলো। মুহূর্তেই আরেকটা বিস্ফোরণ হলো। ইভান আর তাহমিদ গাড়িতে উঠেই থমকে গেলো। ইভান তাড়াতাড়ি সি.এন.জি থেকে নেমে দেখলো পেছনের পুরো শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, ফ্লাইওভারটা হয়তো এবার ভেঙে পড়বে। ইভান অরুণিকাকে সি.এন.জি থেকে নামিয়ে তাহমিদকে টেনে নামালো। সি.এন.জি ড্রাইভারও গাড়িতে থেকে নেমে ফ্লাইওভার থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন। কাউকে সতর্ক করার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না। মুহূর্তের মধ্যেই ফ্লাইওভারটি নিচে ধসে পড়লো। যারা সময়ের আগে সরে এসেছে তারা বেঁচে গেছে। আর যারা পারে নি, তারা ফ্লাইওভারের নিচেই চাপা পড়েছে।
শহর জুড়ে মানুষের মধ্যে আতংক ভীড় করতে লাগলো। গুজবটা যে মিথ্যে ছিল না, তা সবাই বুঝে গেছে। ইভান কিছুদূর গিয়ে আরেকটা সি.এন.জি ভাড়া করে অরুণিকা আর তাহমিদকে উঠালো। সি.এন.জিতে উঠেই সে আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ কল ধরতেই সে দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। আহনাফ বলল,
“তোরা কোথায় এখন? তাহমিদের মেসেজ দেখেছি। অরু কোথায়? ভালো আছো ও?”

“আসছি আমরা। তূর্যের কি অবস্থা?”

“ডাক্তাররা কিছুই জানাচ্ছে না। আমি একটু আগেই এখানে এসেছি। ডাক্তাররা শুধু বললো রক্ত লাগবে। আমরা এখন রক্ত জোগাড় করার চেষ্টা করছি।”

“বোমটা বার্স্ট হয়েছে। মনে হচ্ছে অনেক মানুষ মারা যাবে।”

আহনাফ স্থির হয়ে গেলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ইমানকে ফোন করেছিস? ও তো ওদিকেই ছিলো।”

ইমানের কথা পড়তেই ইভান তাড়াতাড়ি ফোন কেটে ইমানকে কল করলো। কিন্তু কল দিতেই শুনছে, কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাহমিদ বলল, “কি হয়েছে?”

“ইমানের ফোন বন্ধ।”

অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে ইভানের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা ইমানের নম্বরটির দিকেই তাকিয়ে রইলো।

১১৮.

দগ্ধ শরীর নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে সাহিল মির্জা। কোনোভাবে পাশ ফিরে দেখলো, রাস্তায় থাকা গাড়িগুলোতে আগুন ধরেছে। ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে মানুষের লাশ পড়ে আছে। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগুতেই আবার মাটিতে পড়ে গেলো। তখনই সে কিছু মানুষের কন্ঠের স্বর শুনতে পেলো। সাহিল মির্জা চোখ খুলতে পারছে না। কিছু লোক যে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। তার মুখটা ঝলসে গেছে, তাই বোঝার উপায় নেই, সে সাহিল মির্জা নাকি অন্য কেউ। খুব জোর নিয়েই সে কাঁপা কন্ঠে তার পাশে থাকা মানুষটিকে একটা নম্বর বলতে লাগলো। লোকটা বুঝলো কিনা সে জানে না। অনেকক্ষণ পরই তার জ্ঞান ফিরলো। সে শরীর নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে ভেতরের সব কিছুই ঝলসে গেছে। পাশ ফিরে একজন নার্সকে দেখে সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার সাথে দেখা করতে কি কেউ এসেছে?”

নার্স তার পাশে এসে বলল,
“মিস্টার সাহিল মির্জা, আপনার পুরো পরিবার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

সাহিল এটা শুনে হালকা হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“রাহিকে একটু দেখবো।”

নার্স সাহিলের কথা শুনে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে রাহিকে ডেকে আনলো। রাহি ভেতরে এসে সাহিলকে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সাহিল রাহির বেড়ে উঠা গর্ভের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাচ্চাটা হয়তো আর আমার দেখা হবে না।”

রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার কিচ্ছু হবে না।”

“তুমি ঠিক বলেছিলে, রাহি। আমার কাজটা একদিন আমাকে ডুবিয়ে দেবে। আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাই নি। তোমার সাথে, আমাদের বাবুর সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আমার বাচ্চাটা কি আমাকে বাবা ডাকবে না, রাহি?”

“ডাকবে। তুমি সুস্থ হও। তারপর আমরা ওকে বাবা ডাকা শেখাবো।”

“মনে হচ্ছে না আমি সুস্থ হবো। ভেতরে অনেক জ্বালা করছে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমাকে সুখ দিতে পারি নি। রাহি, মনে কোনো কষ্ট রেখো না। হয়তো আমার জোরাজুরিতেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছো, কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। এখনো ভালোবাসি।”

রাহি সাহিলের ঝলসের যাওয়া হাতটা ধরে বলল,
“আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম৷ এখনো ভালোবাসি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অনেক অবহেলা করেছি। কিন্তু সাহিল, আমি তোমাকেই ভালোবাসি, বিশ্বাস করো।”

“বিশ্বাস করতে চাই। তুমি তো আমারই। কিন্তু তোমার মনটাও যদি আমারই হতো।”

রাহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সে আর কথা বলতে পারছে না। সে সাহিলকে ভালোবাসলেও ক্ষণিকের জন্য আরাফের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সে সাহিলকে ছাড়তে চায় নি। সে চেয়েছিল, সাহিল আরাফের মতো হয়ে যাক। কিন্তু কারো ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা তো সম্ভব না। রাহির এই মুহূর্তে নিজেকে কীট মনে হচ্ছে। সে সাহিলের হাতে চুমু খেয়ে বলল,
“আমাদের বাচ্চাটা সাহিল মির্জার পরিচয়েই বড় হবে। ডাক্তার তো বলেছে ছেলে হতে পারে। আমাদের বাবুর নাম সায়িম মির্জা রাখবো, ঠিক আছে? সে বাবার মতোই অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে। তোমাকেও আমার পাশে থাকতে হবে, সাহিল। আমি তো ব্যবসার কিছুই বুঝি না। তুমি তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে দেবে।”

রাহি কথা বলেই যাচ্ছে। নার্স এসে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার ভালোভাবে চেক করে রাহিকে বলল,
“উনি আর বেঁচে নেই। দুঃখিত।”

রাহি কথাটি শুনে থমকে গেলো। সে নির্বাক হয়ে সাহিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর শাহেদ মির্জা, তার প্রাক্তন স্ত্রী রুমি, সানায়া, সাবা সবাই ভেতরে ঢুকলো। শাহেদ মির্জা ছেলেকে দেখে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। রুমি ছেলের পাশে বসে কাঁদছেন। সাবা আর সানায়া একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রাহি সাহিলের হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
“আমি আসলেই তোমার যোগ্য ছিলাম না, সাহিল। তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারি নি। আল্লাহ, আমার উপর ক্ষিপ্ত। আমাকে তো একটা সুযোগও দেন নি। আমার সাহিলকেই নিয়ে গেছেন। এখন আমি ছেলেটাকে একা কিভাবে বড় করবো?”

শাহেদ মির্জা রাহির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমরা সবাই আছি। তোমার শাশুড়ী তো তোমার সাথেই আছে। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি, আল্লাহ সেই ফলস্বরূপ আমার ছেলেটাকে জান্নাত নসিব করুক। সে যেমনই হোক, তার বাবা-মাকে কখনো কষ্ট দেই নি। আমি রুমির সাথে এতো অন্যায় করেছি, তবুও আমার ছেলে তার বাবা-মা দু’জনকেই সম্মান করেছে। কাউকে একটুও কষ্ট দেই নি। মানুষ হিসেবেও আমার ছেলেটা খারাপ ছিল না। তবুও যা ভুল হয়েছিল, আল্লাহ ওকে মাফ করুক।”

সানায়া কেবিন থেকে বের হয়ে একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইলো। ইভান সানায়াকে দেখে তার পাশে বসে বলল, “তুমি এখানে?”

সানায়া ইভানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ইভান চিন্তিত কন্ঠে বলল, “সব ঠিক আছে তো?”

সানায়া এবার কেঁদে উঠলো। ইভান সানায়ার হাতটা আলতো হাতে স্পর্শ করলো। সানায়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভাইয়া আর নেই।”

এমন কথা শুনে ইভানের খুব খারাপ লাগলো। সানায়া ইভানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার তো এখন ভালো লাগছে, তাই না?”

ইভান বলল,
“আমরা ভুলের মধ্যেই এতো বছর পার করেছি, সানায়া। এতো বছর তোমার বাবা আর ভাইকে খুনি মনে করে এসেছি। আসল খুনি তো সুলতান মুন্সী।”

সানায়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আর সাবা আপু সেই ঘরে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিল।”

শাহেদ মির্জা বের হয়ে ইভানকে সানায়ার সাথে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ইভানও তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো৷ কিছুক্ষণ পর তিনি ইভানকে পাশ কেটে চলে গেলেন।

এদিকে অরুণিকা আর তাহমিদকেও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তূর্যের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করে আহনাফ অরুণিকার সাথে দেখা করতে কেবিনে ঢুকলো। অরুণিকার পাশে আরাফ আর ইমন বসে ছিল। আহনাফকে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। আরাফ ইমনকে ইশারায় বাইরে যেতে বললো। ইমন আর আরাফ বেরিয়ে গেলো। তারা বেরুতেই আহনাফ অরুণিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকার পুরো শরীরে ব্যথা৷ তবুও সে কোনো শব্দ করলো না। কেন যেন আহনাফের জড়িয়ে ধরাতেই তার মনের অস্থিরতা কেটে গেলো। আহনাফ অরুণিকার গালে আর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তার হাতটা শক্ত করে ধরে হাতে ভালোবাসার স্পর্শ দিলো। হঠাৎ আহনাফের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে অরুণিকার হাতে পড়লো। অরুণিকা আহনাফের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার কিছু হয়ে গেলে, তুমি কি কাঁদতে।”

আহনাফ অরুণিকার এক হাত ধরে অন্য হাতে অরুণিকার সামনে আসা চুলগুলোতে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,
“জানি না কি করতাম, কিন্তু এই কয়েক ঘন্টা আমার উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে, তা আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি এটা বুঝে গেছি, তুমি আমার খুব শখের মানুষ। যেই শখ হারিয়ে গেলে, মানুষ পাগল হয়ে যায়।”

অরুণিকা আহনাফের হাত নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“আবার একটু জড়িয়ে ধরবে?”

আহনাফ মুচকি হেসে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা বলল,
“একটু আস্তে ধরো। আমার পিঠে অনেক ব্যথা।”

আহনাফ আলতো হাতেই অরুণিকার পিঠে হাত রাখলো। অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। কয়েক ঘন্টা পর সে আহনাফের বুকেই শান্তি খুঁজে পেয়েছে।

এদিকে শাহবাজ খান অরুণিকাকে দেখতে এসে আহনাফের বুকে অরুণিকাকে দেখে মুচকি হাসলেন। তিনি আবার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আরাফকে বললেন,
“তুমি ঠিক বলেছো। অরুর জন্য আহনাফের চেয়ে ভালো ছেলে হবে না। তবে আমার ওকে তেমন ভদ্র মনে হয় নি, তাই আমি এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।”

আরাফ বলল,
“আংকেল, আমরা ভাবতাম, আপনিই খুনি ছিলেন। সব প্রমাণ আপনার বিরুদ্ধে ছিল। পরে জানলাম সুলতান মুন্সী আপনার নাম ব্যবহার করেই এতো কিছু করেছে। আহনাফের রাগটা তো স্বাভাবিক, এমনই হওয়ার ছিল। তবে ও আসলেই একটু রাগী মেজাজের, কিন্তু ওর মনটা অনেক ভালো।”

শাহবাজ খান তার সামনে শাহেদ মির্জাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন। সাহিলের মৃত্যুতে তিনি স্ত্রী-কন্যাদের সামনে না কাঁদলেও আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। শাহবাজ খান তার কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“সুলতান মুন্সীই এই কাজ করেছে। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মৈত্রীদেরও সে-ই হত্যা করিয়েছিল। তার সাথে আরবান তালুকদার ও রহমতুল্লাহ জড়িত ছিল।”

শাহেদ মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“রহমত এই কাজ করেছে? মৈত্রীরা তো তাকে আশ্রয় দিয়েছিল!”

“বেইমান লোকেদের আশ্রয় দেওয়ায় তাদের ভুল হয়েছিল। এসব মানুষের জন্য বিশ্বাস শব্দটাও আজকাল খুব হালকা হয়ে গেছে।”

“আমার ছেলেকে মেরে মুন্সী আর রহমত প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। ওদের শাস্তি পেতে হবে। খুব কড়া শাস্তি।”

আহত-নিহত কোনো মানুষের ভীড়েই ইমানকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। উদ্ধার কর্মীরা তাদের উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সুলতান মুন্সী পাগলের প্রলাপ বকছেন। বারবার বলছেন তার ইমানকে একটু দেখলেই হবে। কিন্তু ইমানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। এদিকে মুরশিদ জুবাইয়ের এসে তাহমিদকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। নিজের মামার পরিবারের সবার সাথে দেখা করে তাহমিদের অনেক ভালোই লাগলো। মামী তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। তাহমিদ মামীর হাত ধরে বলল,
“এতোদিন পর মনে হচ্ছে শান্তিতে কিছু খাচ্ছি।”

মামী মুচকি হাসলেন। তাহমিদ মাওশিয়াতকে ফোন করলো। ভিডিও কলে শতাব্দীকে দেখলো। এতোক্ষণ শতাব্দীর মনটা ছটফট করছিল। সে তাহমিদকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলো। এরপর মাওশিয়াত বলল,
“ইমন আমাদের নিতে আসবে না?”

তাহমিদ বলল,
“হ্যাঁ, আহনাফ অরুণিকাকে বাসায় নিয়ে গেছে। ইমনও ওদিক থেকে এসে তোমাদের নিয়ে যাবে।”

“তূর্যের এখন কি অবস্থা?”

“ভালো। ডাক্তার বলেছে আশংকামুক্ত। রিলিজ দিতে সময় লাগবে। ইভান আর আরাফ ওখানেই আছে।”

তূর্যের জ্ঞান ফিরতেই উপমাকে পাশে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠলো। উপমা তূর্যের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার পাশে আছি, তূর্য।”

তূর্য কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। সে শুধু “হুম” শব্দ করলো। উপমা আবার বলল,
“আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। এখন থেকে সবসময় তোমার পাশে থাকবো।”

তূর্য মুচকি হাসলো। উপমার বাবা-মা কেবিনে এসে তূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিসেস জুলেখা বললেন,
“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তিনি আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে, বাবা। আমরা তোমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছি।”

এদিকে এক সপ্তাহের মধ্যেই উদ্ধার কাজ শেষ হলো। ইমানকে আর পাওয়া গেলো না। অনেকের বিচ্ছিন্ন হাত-পা পাওয়া গেছে। কিন্তু ইমান বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে এটা শুধু প্রশ্নই থেকে গেলো। সুলতান মুন্সী তার পাপ স্বীকার করেছেন। সুলতান মুন্সী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একে একে সব বলতে লাগলেন,
“আমিই খুনী। আমি মৈত্রীদের হত্যা করিয়েছিলাম। আমাকে সাহায্য করেছিল, আরবান তালুকদার আর রহমতুল্লাহ। আমার ছোট ভাই সেজান, মৈত্রীদের মেয়েকে ভালোবাসতো। মেয়েটার নাম আরূপা ছিল। আমরা গরিব ছিলাম, তাই তারা তাদের মেয়েকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে না দিয়ে বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমানের সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরূপা সেজানকে খুব ভালোবাসতো, তাই সে আত্মহত্যা করে ফেলে। আর ওর মৃত্যুর জন্য মৈত্রীরা আমার ভাইকে দায়ী করে। তাকে গ্রেফতার করিয়ে মারধর করে। তারপর একদিন তাকে মৈত্রী ম্যানশনে নিয়ে যায়। সেখানেও অনেক অপমান করে। আমার ভাইটা অনেক আবেগী ছিল। এসব সহ্য করতে না পেরে সেও আত্মহত্যা করে ফেলে। মৈত্রীদের এতো ক্ষমতা ছিল যে আমার ভাইয়ের লাশটাও আমাকে ধর‍তে দেয় নি। তাই আমি মৈত্রীদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর আরবানের সাথে মিলে এই কাজ করেছি।”

রহমতুল্লাহও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন,
“অনেক বছর আগে আমি মির্জাদের সাথে কাজ করতাম। কিন্তু তারা আমার উপর মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে, আমাকে বের করে দেয়। আমি অনেক সম্মান নিয়ে চলতাম। মির্জা সাহেবের এমন অভিযোগের জন্য আমি অনেক অপমানিত হয়েছিলাম। আমার ছেলে অসুস্থ ছিল। আমার মা অসুস্থ ছিল। তারা আমার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। শাহেদ মির্জা আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল। তখনই মৈত্রী কোম্পানির আলিম হোসেন আমাকে সাহায্য করেছিলেন। ওদের কোম্পানিতে কাজ দিয়েছেন। ওদের কোম্পানির কাজ একটু ব্যতিক্রম ছিল। আমি বুঝতে পারতাম না। এরপর আমার কারণে ওদের লস হয়ে যায়। তাই ওরা আমাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু মাসে মাসে টাকা দিতো। এদিকে আরবান তালুকদারের সাথে আরহাম চৌধুরীর ঝামেলা ছিল। উনি চৌধুরীদের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজছিলেন, আর তিনিই আমাকে একটা অফার দেন। আমি প্রথমে খুনের ব্যাপারে জানতাম না। শুরুতে চৌধুরীদের উপর নজর রাখার কাজ পেয়েছিলাম। আরবান তালুকদার অনেক টাকা অফার করেছিলেন। তাই আমি লোভ সামলাতে না পেরে রাজি হয়ে যায়। আমি জানতাম জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর সাথে মুরশিদ সাহেবের অনেক ওঠাবসা হয়। তাই আমি মুরশিদ সাহেবেরও প্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। তারপর সেই রাতের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হলো।”

সুলতান আবার মুন্সী বললেন,
“আমি সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। পরে জানলাম, ওদের ছয় জন ছেলে আর একটা মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। মুরশিদ জুবাইয়ের সেদিন রহমতুল্লাহর মাধ্যমে তাদের সিলেট পাঠিয়ে দেন। আমি যখন জানলাম, ওখানে গিয়ে ওদের মারতে চেয়েছিলাম। কারণ ওরা সবাই মরলেই আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পেতো। কিন্তু আরবান ওদের মারতে দেয় নি। রহমতুল্লাহও চেয়েছিল, ওদের বাঁচিয়ে রাখতে। এদের দিয়েই মির্জাদের হত্যা করাতে৷ কারণ মিডিয়া মির্জাদের নিয়েই গুজব ছড়িয়েছিল। আরবান যখন জানলো, অরুণিকার নামে অর্ধেক সম্পত্তি লেখা আছে, সে চাইছিল মেয়েটা বড় হলেই ওকে নিজের ছেলের বউ বানিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেবে।”

এবার রহমতুল্লাহ বললেন,
“এরপর মুরশিদ সাহেবের কথায় আমি তাদের কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু ইচ্ছা করে আমার ভাইয়ের পাশেই তাদের বাসা ঠিক করে দেই, যাতে সালেহ ওদের উপর নজর রাখতে পারে। সালেহ জানতো না আমি খুনের সাথে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না, এটা ও জানতো। এরা ছ’জনই আমার ভাইকে অনেক সম্মান করতো। আমার ভাইয়ের স্ত্রী সুরাইয়া নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো ওদের। অরুণিকা তো তার খুব প্রিয় ছিল। সুরাইয়া যখন সব জানলো, সালেহ আমাকে আর সাহায্য করতে চাইছিল না। তখন রাহেলাকে মাওশিয়াতের বাসায় কাজের লোক হিসেবে পাঠিয়ে ওদের সব তথ্য নিয়েছিলাম।”

এবার সুলতান মুন্সী বললেন,
“আমার বড় ছেলে ইশমাম সাবাকে ভালোবাসতো। শাহেদ মির্জার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর সে আমাদের উল্টোপাল্টা শুনিয়ে দিলো। এই দেশে ক্ষমতার খুব দাম। তাই এই ক্ষমতা দিয়েই ওদের শেষ করে দিতে চেয়েছি। তাই সাহিল মির্জাকে মারার জন্য, মির্জা গ্রুপকে ধ্বংস করার জন্য এই পরিকল্পনা করেছিলাম। ভেবেছি এই হামলার জন্য মৈত্রী সন্তানকদের ফাঁসিয়ে দেবো। কারণ ওরাই মির্জাদের আসল শত্রু। কিন্তু এর আগেই আমার ছেলে ইমান আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”

ইমানের কথা উঠতেই সুলতান মুন্সী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পনেরো বছর আগের গণহত্যা, আর পনেরো বছর পর আবার এতোগুলো মানুষকে হত্যার জন্য সুলতান মুন্সী আর রহমতুল্লাহর ফাঁসির রায় হলো। রায় হওয়ার পর ছ’জনই কোর্ট থেকে বের হয়ে এলো। শাহেদ মির্জা তাদের দেখে পুরোনো রেষারেষির জন্য ক্ষমা চাইলেন। শাহবাজ খান মির্জা সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
“আপনার এখন ছ’জন ছেলে আছে। নিজেকে একা ভাববেন না। সাহিল যেখানেই আছে, ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ।”

চলবে–

(আগামীকাল শেষ পর্ব আসবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here