অষ্টপ্রহরে পেয়েছি তোমায় পর্ব -১৮

#অষ্টপ্রহরে_পেয়েছি_তোমায়🥀
#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৮

আজকে আমাদের বিয়ে।সকাল থেকে আয়াজের খবর নেই কি যে করছেন উনি।সাজানো শেষ হয়ে গিয়েছে।আমাকে এখন উনার কাছে নিয়ে যাবে হয়তো।ফারিন আরশি এসে আমাকে নিয়ে বাগানে আসলো।আমার মাথায় বড় ঘোমটা দেওয়া।আমাকে এনে বসিয়ে দিল ছোট একটা স্টেজের উপর।ফুল দিয়ে ঢাকা ওপর পাশে মনে হয় আয়াজ আছেন।আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।আমি আর আয়াজ এখন বসে আছি পাশাপাশি।আমাদের কাপল পিক তোলা শুরু করল ফটোগ্রাফার।অনেক পিক তুলেছি।আম্মু আব্বু আজকেই চলে যাবেন।খারাপ লাগছে আমার প্রচুর।

আমাকে সবাই মিলে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে।আগেরবার ভয়ে ছিলাম।এখন ভয় হচ্ছে না।আমি যে মানুষটাকে ভালোবাসি।অনেক রাত হয়ে গেলো আয়াজ তবুও আসলেন না।আমার এখন ভয় হচ্ছে।আমি তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসলাম।সবাই ড্রইংরুমে আছে।

আমাকে দেখে মামনি বললেন,,,
“তুমি নিচে নামলে কেনো ইশা!উপরে যাও আয়াজ এখনই চলে আসবে”

আমি উপরে গেলাম না।নিজের ফোনটা নিয়েই বের হয়েছিলাম।আয়াজকে ফোন দিলাম।রিং হচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে উনি ফোন তুলছেন না।

আমি মামনির কাছে গিয়ে বললাম,,,”মামনি উনি বাড়ি থেকে কখন বের হয়েছেন”

মামনি চিন্তিত গলায় বললেন,,,”এইতো তোমাদের বিয়ে শেষ হওয়ার পর ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল।তারপরই ওর নাকি একটা কল আসে আর ওকে বাড়ি থেকে বের হতে হয়”

হুট করে আমার ফোনে কল আসল।আমি আয়াজ ভেবে নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে বললাম,,”আয়াজ আপনি কোথায়?”

“আমি আয়াজ নই আমি এখানকার ওসি বলছি।এখানে একটা এ*ক্সি*ডে*ন হয়েছে।আপনারা চলে আসুন।”

কথাটা শোনার সাথে সাথে মাথাটা ঘুরে উঠল।আয়াজের এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে।সবাই বলছে কি হয়েছে কিন্তু আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।মনে নেই তারপরে কিছু যখন জ্ঞা*ন ফিরল তখন আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি।আয়াজের কথা মনে পড়তেই আয়াজ বলে চিৎকার করলাম।

বাইরে থেকে সবাই ছুটে আসল।আমি তো আয়াজকে দেখতে পাচ্ছি না।
আমি বললাম,,,,”আয়াজ কই আমি ওর কাছে যাবো আমাকে আয়াজের কাছে নিয়ে চলুন”

সবাই চুপ করে আছে।আরশি ফারিন ভাইয়ারা সবাই কাঁদছে। আমি কষ্ট করে উঠে দাড়ালাম।মামনির কাছে গিয়ে বললাম,,”,ও ও মামনি আয়াজ এখনো আসেনি।আমার অসুস্থতার কথা শুনেও আসেনি!উনি আমায় একটু ও ভালোবাসেন না মামনি সেজন্যই তো আসেনি বলো”

মামনিও কাঁদছে।মামনি আমায় জড়িয়ে ধরে বলে,,,,”তোর আয়াজ আর আসবে নারে মা ও আমাদের ছেড়ে একেবারে চলে গেছে ও আর কোনো দিন আসবে না”

“না না এটা হতে পারে না উনি আমায় ছেড়ে যেতে পারে না।আমার যে ওনার সাথে এখনো কতোগুলো বছর কাটানো বাকি তোমরা সবাই মিথ্যা কথা বলছো উনি তো আসবেন”

আমি আব্বুর কাছে গেলাম,,,”আব্বু দেখো ওরা সবাই মিথ্যা বলছে।তুমি তো সত্যি কথা বলো তাই না আব্বু বলো না আব্বু আয়াজের কিছু হয়নি”

আব্বুও আমায় জড়িয়ে ধরলেন।আব্বুর চোখেও পানি।আব্বু বললেন,,,”মারে ওরা সবাই ঠিকই বলছে”

আমি এবার শান্ত হয়ে গেলাম।আমার গায়ে এখনো সেই বিয়ের কালো লেহেঙ্গাটা। আমি ধুপ করে নিচে বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর সবাইকে বললাম,,,”আমি আয়াজকে দেখতে চাই”

মামনি বললেন,,,”আয়াজের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।পুলিশ তদন্ত করছেন”

আমি বললাম,,,,”কিভাবে এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে”

রাদ ভাইয়া বলতে লাগলেন,,,,”আয়াজ নাকি বেখেয়ালি ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল।সামনে থেকে ট্রাক আসছিল ট্রাকের ব্রেক ফেইল ছিল দুটো গাড়ি ধাক্কা খায় অনেক জোড়ে।পাশেই নদী ছিল আয়াজের গাড়িটা সেই নদীতে পড়ে যায়।পুলিশ খোঁজ চালাচ্ছে এখনো”
|
|
ওই ঘটনার আজ দুইদিন হতে চলল।আমি রুম থেকে বের হয়নি।রুমেই ছিলাম এই দুইদিন।খেতেও ভালো লাগে না মামনি এসে জোড় করে খাইয়ে দিয়ে যায়।আয়াজের প্রতি এই দুইদিনে হাজার হাজর অভিযোগ করেছি।দমবন্ধ হয়ে আসছে ওনাকে ছাড়া কি করে থাকবো আমি।আয়াজের ছবি নিয়ে বসে আছি।আজি পেয়েছি আমার আর উনার বিয়ের ছবি গুলো।

উনি কোথায়!আমার যে মৃত্যু যন্ত্রণা সমান কষ্ট।যখন ছেড়েই যাবেন তাহলে আমার জীবনে কেনো এসেছিলেন উনি।

“ভাবি ভাবি দরজা খুলো”

আরশি দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে।চোখ মুছে দরজা খুললাম।ও আমাকে টেনে নিচে নিয়ে আসল।সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ।মামনি কাঁদছে।আমি সাদা কাপড়টা মুখ থেকে সরালাম।চিৎকার করে সরে আসলাম।

“এটা কেককক”

“আয়াজ”

শশুড় বাবার কথায় আমি চিৎকার করে বললাম,,,,
“এই লোকটা কখনই আয়াজ হতে পারে না।উনি আসবেন!আমার কাছে যে উনাকে ফিরতেই হবে”

সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছেন লাশটা আয়াজের আমি বিশ্বাস করি না।উনি আমাকে ছেড়ে যাননি।লাশটার মুখ থেতলানো আমি ভয় পেয়েছিলাম।লাশটাকে কবর দিয়ে আসল।আমার এখন আর কান্না পাচ্ছে না।নিজেকে শক্ত করলাম।কাঁদবো না আর।কাঁদলেও উনি ফিরবেন না।

মামনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।আমি বললাম,,,”মামনি আর কেঁদো না অসুস্থ হয়ে পড়বে তো”

“তোর কি কষ্ট হচ্ছে না মা আর কখনো আয়াজকে দেখতে পারবি না তো”

আমি মলিন হেসে বললাম,,,”কষ্টর কথা বাদ দাও মামনি।আমি জানি উনি একদিন ফিরবেন।এটা আমার বিশ্বাস”

“দেখলি তো আয়াজের লাশ তার পরেও কিভাবে”

“মামনি লাশটার কিন্তু মুখ বোঝা যাচ্ছিল না,শুধু হাইট আর বাদ বাকি সব মিলেছে।তাতে কি মামনি আয়াজের মতো হাইটের অনেকই আছেন।আমি সারাজীবন ওনার জন্য অপেক্ষা করে যাবো”

মামনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আবারও কাঁদতে লাগলেন।আমি মামনিকে ধরে রুমে দিয়ে আসলাম।এখন নিজের রুমে চলে আসলাম।সম্পূর্ণ রুম ভর্তি আমার আর আয়াজের ছবি।সেগুলো দেখেই রাত পার করলাম।ঘুম আসে না যে উনাকে ছাড়া। আয়াজের বুকে মাথা না রাখলে ঘুম আসে না।
|
|
সকালে ফ্রেশ হয়ে আমি নাস্তা বানাতে গেলাম।সবাই চলে গিয়েছে।বাকি আছে শুধু আব্বু-আম্মু আর বড় ফুফিরা।আমি সবার জন্য নাস্তা বানালাম।রুমে যেতে ইচ্ছা করে না।রাতে আয়াজের স্মৃতিগুলো আমাকে ঘুমাতে দেয় না।আমি বাগানে চলে আসলাম।কত মজাই না করেছি এই বাগানে।দোলনায় বসে আয়াজের কথা মনে করছিলাম।কখন যে চোখ থেকে পানি বের হয়ো গিয়েছি খেয়াল করিনি।আরশির ডাকে ঘোর কাটল।

চোখ মুছে হাসি মুখে ওর দিকে তাকালাম।আরশি বললো,,,”তুমি কাঁদছিলে ভাবি”

“না না আরশি কাঁদবো কেনো!আমি তো তোমাদের মতো বোকা না যে একটা ডেড বডি দেখে ভাববো আয়াজ মারা গেছেন।মোটেও না উনি আসবেন।উনাকে যে ফিরতে হবে আমার জন্য”

ফিরলেই ভালো। চলো ভাবি সবাই এখনই নিচে নামবে।আমি আর আরশি ভেতরে চলে আসলাম।সবাই খাবার টেবিলে বসে পড়লেন।আমি সবাইকে হাসি মুখে খাবার বেড়ে দিলাম।সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

আমি হাসি মুখে বললাম,,,
“সবাই না খেয়ে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?”

সবাই আমার কথা শুনে খেতে লাগলো।আমিও বসে খেয়ে নিলাম।খাওয়া শেষে সবাই ড্রইংরুমে বসে আলোচনা করছে আমি কোথায় থাকবো।দাদু বললেন,,,”নাতবউ তুই তো বিধবা এখন কি এমন লাল রং পড়া মানায়”

“দাদু তোমাদের ভুল হচ্ছে আমি বিধবা না আয়াজ এখনো বেঁচে আছেন আর একদিন আমার কাছে আসবেন”

আব্বু বললেন,,,”আয়াজ বেঁচে নেই এটা যত তাড়াতাড়ি মানবে তোমার জন্য ততই ভালো”

আমি চিৎকার করে বললাম,,,”বললাম না আয়াজ বেঁচে আছে উনি ফিরে আসবেন একদিন না একদিন”

মামনি আমায় জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন।শশুড় বাবা আমায় জিজ্ঞেস করলেন,,,!ইশা মামনি তুমি কোথায় থাকতে চাও এখানে নাকি তোমার আব্বুর বাসায়”

“শশুড় বাবা আমি বিবাহিত তাই আমি আমার শশুড় বাড়িই থাকবো তাই না”

সবাই আমার সাথে কথা বলে বুঝলো যে আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই আমি এখান থেকে নড়বো না।আম্মু আব্বু চলে গেছেন অনেক সময় হলো।আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন আমি স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।অতি কষ্ট আমায় পাথর বানিয়ে দিয়েছে।

আয়াজকে ছাড়া একটা মাস কেটে গেছে।শশুড় বাবা আমাকে এখানের কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে।আমি কলেজে যাই আসি এটাই আমার প্রতিদিনের কাজ।আয়াজকে ছাড়া থাকতে হচ্ছে আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।আমার কপালে আসলেই সুখ সয্য হয় না।
|
|
পাঁচ বছর পর,,,,,,

দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর হয়ে গেলো।পাঁচটা বছর আয়াজকে ছাড়া কাটিয়েছি।আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী আর আমার কাছ থেকে আয়াজের হারিয়ে যাওয়ার দিন।আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,
আয়াজ শুনতে পাচ্ছেন,আমি জানি আপনি বেঁচে আছেন।একই আকাশের নিচেই আছি আমরা। আপনাকে ছাড়া পাঁচবছর পূর্ন হলো আজ।ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে ভীষণ। আপনি জানেন ওরা আমায় আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আপনি ছাড়া যে এই ইশাকে আর কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।আমি ওখান থেকে চলে এসেছি আজ তিনবছর।এই ফ্লাটে থাকি আমি।আপনার আর আমার স্মৃতি দিয়ে ভরা এই ফ্লাট এখান থাকলে আপনাকে অনুভব করতে পারি।ফ্লাটের সবকিছু সেই আগের মতোই আছে।জানেন আয়াজ আমি এখন আর আগের মতো দুষ্টমি করি না অনেক বড় হয়ে গেছি।সেই ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েটি আজ ২১ বছরের যুবতীতে পরিনত হয়েছে।আপনাকে প্রচুর মিস করি আয়াজ।কবে আসবেন আপনি।আপনার উপর যে আমার পাহাড় সমান অভিমান আর অভিযোগ জমে আছে।আচ্ছা আমিই কি ভুল ধারনা নিয়ে বেঁচে আছি।আপনি সত্যিই কি বেঁচে নেই।কিন্তু আমার মন যে মানে না আপনি মারা গিয়েছেন।বিষয়টা ভাবতেই নিজেকেই গালি দেই।আপনি বেঁচে আছেন আমার মন সব সময় তাই বলে।আচ্ছা আপনি না আমায় আরো আগে থেকে ভালোবাসতেন তাহলে আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকছেন।এক দিন নয় একমাস নয় পুরো পাঁচটা বছর কিভাবে থাকছেন।আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললাম।জানি আয়াজ শুনবেন না তবুও বলছি।চোখের পানি মুছে শুয়ে পড়লাম।পাঁচটা বছরে কতগুলো রাত ঠিকমতো ঘুমিয়েছি তাও জানি না। সারা রাত আয়াজের কথা চিন্তা করতে করতে কেটে যায়।
|
|

রেডি হয়ে ভার্সিটি চলে আসলাম।এখানে আমার অনেক ফ্রেন্ড আছে।যারা আমায় এতোদিন আগলে দেখেছে।আমার পাঁচ ফ্রেন্ড ফিয়া,ফায়াজ,সানজানা,সাথি,তামিম এরা আমাকে নিজের বোনের মতো আগলে রেখেছে।আমাকে কখনো একা অনুভব করতে দেয় না।ভালো আছি বেশ কিন্তু তার শূন্যতা যে সে ছাড়া কেউ পূরন করতে পারবে না।

ভার্সিটিতে ঢুকতেই সব কয়টা আমাকে ঘিরে ধরল।ওরা সবই জানে।আজকে ওরা আমাকে একা ছাড়বে না সেটা খুব ভালো করেই জানি।আজকে ১২ টার আগে একটাও কাছ ছাড়া করবে না আমাকে।দুইটা ক্লাস করে বের হয়ে আসলাম।আজকে সারাদিন ঘুরবো।সারাটাদিন ওদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কেটে গেলো।রাত নয়টায় ফায়াজ আর তামিম আমাদের আমার বাসায় ড্রপ করে দিয়ে চলে গেলো।

আমি,সানজানা,সাথি আর হিয়া আমাদের ফ্লাটে চলে আসলাম।আমি ওদের ফ্রেশ হতে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হতে আসলাম।ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে আসলাম।সবাই মিলে ভুতের মুভি দেখবো বলে।মুভি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলাম।ওদের ডেকে দিয়েছি।আজকে ভার্সিটিতে কেউ যাবো না।আজকে আমি একটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যাবো।এতোদিন শশুড় বাবা টাকা দিতেন।ভাবছি চাকরিটা হলে আর নিবোনা।

১০টা থেকে ইন্টারভিউ শুরু।ওরা তিনজন আমাকে একটা কালো শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিল হালকা।আমি সাজতে চাইনি কিন্তু ওরা জোড় করে সাজিয়ে দিয়েছে।

চলবে,,,,,?

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here