অস্তিত্বে চাই তোমার ছোঁয়া পর্ব -২২+২৩+২৪

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২২

৪০.
এরফান ভার্সিটি ক্যানভাসে ইসমাইল কে রাগান্বিত অবস্থায় হকিস্টিক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। এতে সে ভীষণ ভড়কে গেল। আনমনে ভাবে।

‘ইসমাইল ভাই হকিস্টিক নিয়ে কেন গেল! ভেতরে কি খেলা হচ্ছে!’

‘জান তোমার আইসক্রীম গলে কাপড়ে লেগে এবড়োথেবড়ো হয়ে যাচ্ছে! হেই কোথায় হারালে!’

তিয়ানা খেয়াল করল এরফান এর দৃষ্টি ভার্সিটির প্রবেশদ্বারে। এরফান এর সায় না পেয়ে এতক্ষণে ব্যাপারটা সে বুঝতে সক্ষম হলো। সে এরফানকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সম্মতি ফিরিয়ে আনল। এরফান তিয়ানার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলা কথাটি বলে ফেলে।
তিয়ানা শুনে অবাক হয়ে বলে,

‘ইসমাইল ভাইয়া এখানে কেনো আসবেন! তাও আবার আপনাদের ভার্সিটিতে ঢুকে পড়লেন চলো তো গিয়ে দেখি।’

তিয়ানার কথায় এরফানও রাজি হয়ে গেল। তারা দুজন দুপুরবেলায় প্রতিদিনের মত ঘুরতে বের হয়। একে অপরের সঙ্গে হাত ধরে হাঁটে, আইসক্রীম খাই, সূর্য অস্তমিত হওয়ায় দৃশ্য উপভোগ করে। কিন্তু প্রতিবারের মত আজ এরফান বাইক স্ট্যান্ট করে রেখেছিল ভার্সিটির সামনে। এখানেই তিয়ানাকে অপেক্ষা করতে বলে আইসক্রীম নিতে গিয়ে ছিল। আইসক্রীম এনে একে অপরের সঙ্গে মিষ্টি আলাপন করে। এর মধ্যে ইসমাইল কে রাগান্বিত দেখে ব্যাপারটায় খটকা লাগে তার।

তিয়ানা ভয়ে এরফান এর হাত চেপে ধরে। তাদের সামনে মেঝেতে রক্তের ছড়াছড়ি। এক ছেলের মাথা ফেটেছে তো আরেক ছেলের দাঁত ভেঙ্গে মেঝের উপর পড়ে আছে। দু ছেলেকে বেদাধরক পিঠিয়েছে ইসমাইল। এই দুজন ছেলে অন্য কেউ নয়। বরঞ্চ সেই পূর্বের বখাটে ছেলে দুটো। যারা পূর্বে একবার শ্রেয়িতার সজ্ঞানে ইজ্জত হানি করার চেষ্টা করে ছিল নির্জন পার্কিং প্লেসে। ছেলে দুটো মুখ ফুটিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলে,

‘আ আমাদের মা মাফ করে দেন ভা ভাই।’

ব্যস এটুকু কথার জোরে আরো একবার ছেলে দুটোর পিঠে হকিস্টিক এর বারি বসিয়ে দিল ইসমাইল। ছেলে দুটো কাতরসিক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারালো। এরফান আর তিয়ানা কে দেখে মুটেও ঘাবড়ালো না ইসমাইল। কারণ সে নিজের সিদ্ধান্তে আর কর্মে অটুট। তার জানা আছে যে সে অন্যায়ভাবে ছেলে দুটোকে আহত করে নি। নিদারুণ তারা অন্যায় করেছে। যার পর্যাপ্ত শাস্তি পুলিশ এর আগে সে দিল।
ইসমাইল নিজের কাজ মিটিয়ে হকিস্টিকটি মেঝের উপর সজোরে ছুঁড়ে মারে। নিজের চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড শ্বাস-প্রশ্বাসন চালায়। পা চালিয়ে রুমের মধ্যে কয়েক কদম হেঁটে দাঁড়িয়ে গেল। চোখ খুলতেই তার শরীর অবশ ধরণের প্রাণীতে পূর্ণ হলো। যেন তার শরীরে কোনো প্রকাশ শক্তি নেই। তার চোখযুগলে কিছু দৃশ্য ভেসে আছে। সেগুলো স্মরণ করে পিটপিট করে চেয়ারে অজ্ঞানরত রমণীর দিকে দৃষ্টিকোণ রাখে ইসমাইল। রমণীর বিধ্বস্ত শরীর পরখ করার পূর্বে তার শরীরে নিজের ব্লেজার পরিয়ে দিল যুবক। তিয়ানা এতক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেও। নিজের আপুর বয়সী এক মেয়েকে চেয়ারে দেখে বিচলিত হলো সে। ইসমাইল এর দিকে প্রশ্নময় নয়নে তাকিয়ে তিয়ানা জিজ্ঞাসা করে।

‘ভাইয়া মেয়েটা কে আগে কখনো দেখিনি!’

তিয়ানার প্রশ্নে ইসমাইল জবাব দেওয়ার পূর্বে এরফান সাবলীল ভঙ্গিতে ‘শ্রেয়িতা’ বলে।
তিয়ানা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। বুঝার চেষ্টা করে এরফান মেয়েটিকে চিনে কেমনে! কে হয় সে। বাজে চিন্তা ধারণা আপাত মাথায় পুষতে দিল না তিয়ানা। কারণ ঘটনাটি এমন যে শ্রেয়িতাকে বখাটে দুই ছেলে রেপ করার চেষ্টা করছিল। এরফান হাত মুঠোবদ্ধ করে ফোন বের করে। চট জলদি ফেরদৌস কে পুলিশ নিয়ে ভার্সিটি আসতে বলে।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইসমাইল বিধ্বস্ত রমণীকে সযত্নে কোলে উঠিয়ে নিল। রমণীকে হসপিটালাইজ করার জন্যে বেরিয়ে পড়ে। এরফান আড়চোখে ইসমাইল এর যাওয়ার পানে তাকায়। আনমনে মুচকি হাসি দিল। তিয়ানার হাত আঁকড়ে ধরে ছেলে দুটোর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। যতক্ষণ না পুলিশ তার ধারে কাছে না পৌঁছায়। ইসমাইল যাওয়ার পর তিয়ানা আবেদনসূচক কণ্ঠে বলে,

‘শ্রেয়িতা কে এর সাথে আপনার কি!’

‘যাবিয়াজ,আমি আর ফেরদৌস এর জানের টুকরো বোন। একই বর্ষের তবে অনুষদীয় বিভাগ ভিন্ন।’

‘ওহ কিন্তু জানো একটি বিষয় খেয়াল করেছি।’

‘কি সেটা!’

‘শ্রেয়িআপুর প্রতি ইসমাইল ভাইয়ার চোখে পসেসিভনেস, এক্টিভ কেয়ার ফিল দেখেছি। তোমাদের বন্ধু বা ভাইদের চেয়ে বারো ইসমাইল ভাই বুঝি আপন।’

এরফান মাথা চুলকানোর ভান করে মৃদু হাসি দিল। তৎমধ্যে ফেরদৌস পুলিশ কনস্টেবল নিয়ে ভেতরে আসে। এরফান অফিসার কে দেখে বলে,

‘স্যার বাজে মাল দুটো রেপ করতে উদ্যোগ নিয়ে ছিল। মেয়েকে কিডনাপ করার আগে ধরে ফেলা হয়েছে। প্লিজ অনুগ্রহ করে এরেস্ট করে একশ ঘা করে লাগাইয়েন। বিশেষ করে এদের মেইন পয়েন্টে গরম পানি ঢেলে দিবেন।’

অফিসার শুনে নিজের পুলিশ ইউনিফর্ম এর সঙ্গে পরা টুপিটা হাত দিয়ে ঠিক করে। কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় হাতকড়ি পরাতে আদেশ করে। ইশারা অনুযায়ী কনস্টেবল গিয়ে হাতকড়ি পরিয়ে ছেলে দুটোকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেল। এরফান তপ্ত শ্বাস ফেলে তিয়ানার গালে হাত রেখে বলে,

‘জানো মানুষের মনে কখন শয়তানে কেমন ভাবে বাসা বেঁধে ধর্ষণ এর মত জঘন্য কাজ করতে উদ্দিন করে বলা বাহুল্য। তোমাকে ইসলামী রীতিমত বিয়ে করে আপন করব। মনে রাখবে মানুষের মধ্যে সুদৃষ্টি হলেও কুদৃষ্টি বহমান। হঠাৎ বদলী হয়ে যেতে পারে যে কেউ! আমার কথার মর্ম বুঝবে বলে ধারণা রইল।’

এরফান এর মূল্যবান বাণী শুনে তিয়ানা ঠোঁটে কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে,

‘যথা আজ্ঞে মিয়া সাহেব।’

‘হবেন তো এই মিয়া সাহেব এর বেগাম!’

‘হুম ভেবে দেখব।’

এরফান গাল ভেটকিয়ে বাইক এর দিকে হাঁটা ধরে। তিয়ানা মুখ টিপে হেসে তার পিছে হাঁটা ধরে। ভার্সিটির মধ্যে কান্ড ঘটেছে। তা কেউ জানতে না পারে মত দারোয়ান কে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিল এরফান। বিনিময়ে আজকের ঘটনাটা ধামাচাপা করে দিল। কেননা এতে ভার্সিটির রেপুটিশনের উপর কথা উঠবে। ফলে শ্রেয়িতার চরিত্রের সঙ্গে ভার্সিটির প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীকে খারাপ নজরে দেখার প্রবণতা বেড়ে উঠবে। এই দিকটা ভেবে টাকাটা দিল এরফান। দারোয়ান পূর্বে ছিল না বরঞ্চ সেই পুলিশ এর সঙ্গে কথা বলার সময় অফিসারকে বলে ছিল। অফিসার ভার্সিটি এলে দারোয়ানকে সহ আনতে। এতে জায়গা সহজে বোধগম্য হবে অফিসারের। এরফান থেকে বিদায় নিয়ে দারোয়ান ভার্সিটির দরজা শুদ্ধভাবে তালাবদ্ধ করে দিল। তিয়ানা দূরে বাইকে বসে এরফান এর কার্যাদি পরখ করেছে।
অকস্মাৎ ফোনে কলের শব্দে তিয়ানা ফোনটি নিয়ে কানে ধরে। সালাম দিয়ে ‘কে’ বলে।
কিন্তু ভাবলেশনহীন শব্দ পাওয়ায় ভ্রু কুঁচকে এলো তার। ফোনটা আলগা করে চোখের সামনে দেখে নিল। নাম দেওয়া আছে ‘ছেড়ি’ হঠাৎ মেয়ে। আর এই ছেড়িটাই হলো ইফদিয়ার। যার কল রিসিভ করেছে তিয়ানা। ইফদিয়ার কিছু বলছে না দেখে তিয়ানা মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ছেড়ি কি মা হয়েছিস। মুখ বুজে আছিস কেন হে!’

ব্যস খিলখিলানো মিষ্টি হাসির শব্দ গুঞ্জন হলো ফোনের বিপরীত পাশ থেকে। ইফদিয়ার সরু দৃষ্টিতে তার সম্মুখে থাকা সাদা দেওয়ালে তাকিয়ে আছে। তীরন্দাজ এর মত হাতে তীর নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো বোর্ডে নিক্ষেপণ করে। তিয়ানা শুনতে পেরে অবাক হয়ে বলে,

‘বাহ্! তীরন্দাজ হয়েছিস কবে থেকে।’

‘আজ থেকে তোর সঙ্গে ব্লুথ এ কথা বলতে বলতে।’

‘আমাকেও শিখাইয়া দিস।’

‘বললেই হলো।’

তিয়ানা ভেটকিয়ে ভাব নিল। পক্ষান্তরে হেসে বলে,

‘আচ্ছা দোস্ত কবে আসবি বল।’

‘তুই জানিস কেনো কল দিছি আমি।’

‘অবভিউয়াসলি তোর ভাইয়া বলে ছিল। আমার বাসায় রুম খালি আছে অনেক। তোর পুরু গোষ্ঠিসহ থাকলেও বুঝি রুম শেষ হবে না।’

‘হই ঢপবাজি। আমি আসব লাইক এইতো কাল বা পরশু।’

‘ওকে সি ইউ টুমোরো দোস্ত। আল্লাহ হাফেজ। আসসালামুয়ালাইকুম।’

‘আল্লাহ হাফেজ ওয়ালাইকুমাসালাম।’

৪১.

যাবিয়াজ ব্যাগ গুছাচ্ছে। রবিউল সাহেব উদাসীন হয়ে বসে আছেন। তিনি ছেলের কার্যাদি অনুভব করছেন। ইতিমধ্যে ফ্লাইট এর টিকেট বুক করে ফেলেছে যাবিয়াজ। আজ রাত ১টায় তাদের ফ্লাইট। রবিউল সাহেব ভ্রু কুঁচকে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘বাবা তুই কি সিরিয়াসলি চলে যাবার জন্যে রেডি হচ্ছিস।’

যাবিয়াজ শুনে কিছু বলেনি। তার বাবার ব্যাগটা গুছিয়ে ধপ করে উনার পাশে বসে। উনার হাত নিজের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে বলে,

‘তোমার জন্যে যাবো। এটা আমার প্রধান দায়িত্ব সন্তান হিসেবে।’

রবিউল সাহেব এবার যেন জেদ নিয়ে বলেন,

‘আমার আমার বলে তিনবছর এর জন্যে চলে যাবার ডিসিশন কেন নিচ্ছিস।’

যাবিয়াজ তপ্ত এক শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘তার মানে জেনে গেলে যে আমি তিনবছর এর জন্যে সেখানে সিফ্ট করাচ্ছি।’

রবিউল সাহেব অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যাবিয়াজ মৃদু হেসে বলে,

‘খাবার রান্না করে রেখেছি ড্যাড। খেতে আসো।’

দুপুরের খাবারের পর্ব চুকিয়ে যাবিয়াজ তার বাবাকে ধরে রুমে নিয়ে যায়। যাতে রাতে হাঁটতে অসুবিধা না হয়। এই সময় একটু রেস্ট নিলে উনার শরীর ভালো লাগবে। বাবাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে চলে যেতে গেলে রবিউল সাহেব হাত ধরে ফেলেন। একটু আহ্লাদী কণ্ঠে আবদার করেন।

‘ইফদিয়ার মামুনির সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।’

যাবিয়াজ থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। তার ক্ষত মনটি ‘ইফদিয়ার’ নামক রমণীকে না দেখে বিষাদে ভরপুর হয়ে আছে। সে জানে না কিভাবে তার বাবাকে বিগত কয়েকদিনের ঘটনা কেমনে বলবে। বললে বুঝি হার্ট এ সমস্যা হলে! এমন রিস্ক সে নিতে পারবে না। ঢোক গিলে শান্ত ভঙ্গিমায় বলে,

‘হুম কালকে নিয়ে আসব।’

‘সত্যি বাবা!’

‘হ্যা পাক্কা প্রমিজ ড্যাড।’

রবিউল সাহেব ছেলের হাত টেনে ধরে হালকা ঝুঁকিয়ে আনেন। ছেলের কপালে আদুরে পরশ হিসেবে চুমু একেঁ দিয়ে বলেন,

‘ইফদিয়ার মামুনিকে আমার খুব পছন্দ তোর বউ হিসেবে।’

যাবিয়াজ আনমনে হেসে ড্যাড এর চুলে বিলি কেটে দিল। কাঁথা বুক অব্দি টেনে ড্যাডকে পরিপাটি করে রেখে বেরিয়ে গেল। এখনো আসরের আযান দেয়নি। তাই সে ভাবল একবার সবার সঙ্গে কফিশপে দেখা করে নিবে। ফোন বের করে এরফান কে বলে।

‘দোস্ত রাকতিয়ার কফিশপে চলে আয় শ্রেয়িতা ফেরদৌসকে নিয়ে।’

এরফান শুনে শ্রেয়িতার কথা বলার আগে কল ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। তিয়ানা কে সবেমাত্র বাসায় পৌঁছে দিয়ে হোস্টেলে এসেছে এরফান। শ্রেয়িতার সঙ্গে হসপিটালে দেখা করতে যেতে চাইছিল। কিন্তু যাবিয়াজ এর কথা শুনে সর্বপ্রথম ফেরদৌস কে কল করে আসতে বলে। সে সময় ফেরদৌস পুলিশের সঙ্গেই চলে গেছিল। হোস্টেলে আসেনি। তাই এখন আসতে বলল।

কিছুক্ষণ পর….

যাবিয়াজ পূর্ব থেকেই টেবিল রিজার্ভ করে বসে আছে। তার বন্ধু-বান্ধব এখনো আসেনি। সে বসে ফোন স্ক্রুলিং করতে থাকে। ফোন এর মধ্যে ফেসবুক এর ভিডিও দেখছিল ডাটা অন করে। কি মনে করে নিউজফিড একবার স্ক্রুল করল। একদম প্রথমেই চলে এলো ইফদিয়ার আইডির লিংক। উপরে লিখা ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ফ্রেন্ড হার !’

যাবিয়াজ যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেল এমন দশা। তড়িঘড়ি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু পরমুর্হুতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট কেটে দিল ইফদিয়ার। ক্রোধ যেন যাবিয়াজ এর মাথায় উঠে গেল। বিড়বিড় করে বলে,

‘উড়নচন্ডী অপ্সরীমনি। নিজেকে ভাবওয়ালী বানিয়ে ঘুরছো। ঘুরো যত ঘুরার তত ঘুরো। যেদিন তোমায় নিজের করব সেদিন সব সুদ আমলে নিবো।’

দাঁতে দাঁত চেপে ইফদিয়ার আইডিতে ঢুকে। কি ভেবে যেন বাঁকা হাসি দিল যাবিয়াজ। আনমনে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলে,

‘হ্যাকিং ইজ দ্যা বেস্ট অপশন টু হ্যারাস ইউ।’

ইফদিয়ার আইডি এখনিই হ্যাক করতে চেয়ে করল না। কেননা এখন সময় কম। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে তার ড্যাড এর অপারেশন শুদ্ধভাবে হওয়ার পর করবে ভেবে নিল। কারণ এখন সে কনসেনট্রেন্ড করছে তার ড্যাড এর অপারেশন এর ব্যাপারটাই। একবার অপারেশন হয়ে গেলে তার ড্যাড নিজের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। ভাবতেও যেন যাবিয়াজ এর বুকটা ধুকপুক করে খুশিতে নেচে উঠে। নিজের মধ্যে ধ্যানমগ্ন থাকায় হঠাৎ একজন রমণীর খিলখিলানির হাসি শুনতে পেল। শুনতেই যেন যাবিয়াজ এর মনে হলো হাসিটা ‘ইফদিয়ার’। পিছে ঘুরে দেখে কেউ নেই। মনের ভ্রমটা আজকাল মেয়েটির প্রতিই হয়। মুচকি হেসে ফোন স্ক্রল করে।

৪২.

আয়েশা মেয়েটি কে উদাসীন দেখে তার বাবা জাব্বার কাছে ডাকেন। মেয়েটি ধীরস্থির পায়ে হেঁটে এলো বাবার কাছে। জাব্বার মেয়েকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।

‘আমার মেয়েটার মুখ ফুলিয়ে রয়েছে কেনো হুম!’

‘কিছু না ড্যাড। যাবিয়াজ কে মিস করছি।’

জাব্বার আয়েশার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে পূর্বেই। কিন্তু এখন শুধু নিশ্চিত হওয়ার জন্যে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি চান না যাবিয়াজ মেয়ের স্বামী হোক। কারণ যাবিয়াজ কে দেখলে বুঝা যায় তার মনের কৌটায় উনার মেয়ের প্রতি কোনো প্রকার অনুভূতি নেই। তাই তো যেদিন যাবিয়াজ এনজিও থেকে নিজ বাসায় ফিরে এলো। ঐসময় উনার মেয়েকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না। এমন এক ভাব নিয়ে মেয়ের সামনে চলছিল যেন আয়েশা নামের কেউ বাসায় নেই। তিনি মেয়েকে অত্যধিক ভালোবাসেন। ফলে যাবিয়াজ ফিরে আসায় তিনি পরিবারসহ নিজ বাসস্থানে চলে আসেন। আসার সময় আয়েশা তার বাবার কাছে আকুতি মিনতি করেছিল। যেন যাবিয়াজ কে তার স্বামী বানিয়ে দিক। কিন্তু জাব্বার নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন। মেয়ের মনকে সায় না দিয়ে নিজের বন্ধু আর বন্ধুর ছেলের সামনে হাসিমুখে চলে গেলেন।
পূর্বের কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জাব্বার এর অন্তরাল হতে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বিলি কেটে বলেন,

‘জানিস আজ তোর ফুপাতো ভাই আসতেছে।’

আয়েশা কথাটি শুনে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। জাব্বার মুচকি হাসেন। আয়েশা বলে,

‘কবে কখন!’

‘আজ রাতেই আসবে।’

‘ওহ আমি গিয়ে রেডি হয়। পকেট লুটবো।’

জাব্বার মাথা নেড়ে যাইতে ইশারা করেন। আয়েশা নেচে নেচে রুমে চলে যায়।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৩

৪২.
যাবত ৭ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে এলো শ্রেয়িতার। পাশে উদগ্রীব ধাতস্থ হয়ে রমণীর এক হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে ইসমাইল। নিভু দৃষ্টিতে যুবকের দিকে পরখ করল শ্রেয়িতা। অস্পষ্ট কাতর কণ্ঠে বলে,

‘ও ওই।’

‘হুসস কোনো কথা নয়।’

ইসমাইল এর দৃঢ়স্থ জবাব। যেন এই মুহূর্তে রমণীর কোনো কথা কাম্য নয়। শ্রেয়িতা শরীরও দূর্বল অনুভব করছে। আলগা হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কাঁধ বরাবর তীব্র ব্যথা অনুভব করে। মৃদু চিৎকার মুখ ফুসকে বেরিয়ে আসে তার ‘আহ’। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইসমাইল উত্তেজিত হয়ে শ্রেয়িতাকে শুয়ে দিল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রগরগে ভাব ধরে বলে,

‘কি চাই আমাকে বলো নিজের মত করতে যাও কেন! বেশি বুঝদার হয়ে গেছো!’

ইসমাইল এর ককর্শভরা গলায় শ্রেয়িতা ভয়ে ঢোক গিলল। শান্তভাবে শুয়ে রইল। অস্পষ্ট সুরে ‘পানি খাব’ বলে। ইসমাইল সযত্নে উঠে গ্লাসে পানি ঢেলে শ্রেয়িতার মুখে ধরে। রমণী পানি পান করে চুক্ষদ্বয় বুজে নিল। ইসমাইল খেয়াল করে রমণী পুনরায় নিদ্রায় মতঁ হয়ে পড়েছে। রমণীর মাথার চুলে বিলি কেটে সন্তোপর্নে প্রস্থান করে কেবিন থেকে। ডক্টর এর চেম্বারে গিয়ে দরজায় কড়া নারে। ডক্টর মিসেস টিয়া শ্রেয়িতার রিপোর্ট চেক করছিল। দরজায় শব্দ হওয়ায় তিনি সৌজন্যে ‘আসতে’ বললেন কাঙ্ক্ষিত মানুষকে। ইসমাইল ভেতরে এসে বসে। ডক্টর টিয়া চশমা ঠিক করে রিপোর্টগুলো গুছিয়ে ফাইলে রাখে। ফাইলটি ইসমাইল এর দিকে এগিয়ে দিলেন। ইসমাইল নিয়ে ডক্টর টিয়াকে কিছু বলবে। তার পূর্বেই তিনি বলেন,

‘পেশেন্ট পিজিক্যালি এন্ড ইমোশানালি উইক হয়ে পড়েছে। ট্রমার উপর ভর করছে পেশেন্ট। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে যথেষ্ঠ খেয়ালখুশির দিকে নজর রাখতে হবে। পরিবেশ বদলী করলে আরো বেটার। বাই দ্যা ওয়ে পেশেন্ট আপনার কি হয়!’

ইসমাইল এতক্ষণ ডক্টর টিয়ার পরামর্শ শুনে যাচ্ছিল। আকস্মিক শ্রেয়িতার আপনত্ব হওয়ার প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে গলা ঝেড়ে বলে,

‘ফিয়ন্সে।’

‘ওহ কংগ্রেস মিস্টার ইসমাইল। আপনি নিজেও ডক্টর। ট্রিটমেন্ট আপনি করেননি কেনো!’

ইসমাইল হতাশার দৃষ্টিতে ডক্টর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ম্যাম আমি উচ্চপদস্থ ডক্টর হলেও প্রিয় আবেগ লুকিয়ে আছে অন্তরালে। ভেতরের পেশেন্ট প্রিয় একজন। নিজ হাতে ট্রিটমেন্ট কখনো করতে পারতাম না। বরঞ্চ তাকে যখন স্ক্যাচারে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। লেগেছিল আমার হাত বেকাবু হয়ে পড়েছে। মাথাটা ঝিমিয়ে অবশ হবার উপক্রম।’

ডক্টর টিয়া শান্ত্বনা স্বরুপ দৃঢ়স্থ কণ্ঠে বলেন,

‘ডোন্ট ওয়ারি মাই সান। সি উইল বি ফাইন। টেক কেয়ার।’

ইসমাইল মাথা নেড়ে ফাইলটি নিয়ে পুনরায় শ্রেয়িতার কেবিনে আসে। কিন্তু এসে চমকে গেল। লক্ষ্মীনা মেয়ের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ইফদিয়ার হতবম্ভ দৃষ্টিতে তার শ্রেয়িপ্পি দিকে চেয়ে আছে। শ্রেয়িতা কিভাবে মাকে সামলাবে ভেবে পাচ্ছে না। সে তো এই ভেবে অবাক উনাদের কে এই খবর দিল! ইসমাইল আনমনে ভাবে।

‘শ্রেয়িতার পরিবারকে কে অবগত করল!’

পরক্ষণে এরফান এর কথা তার মাথায় আসে। তার সঙ্গে তিয়ানাকেও সে লক্ষ করে ছিল। কিন্তু সে মুহূর্তে শ্রেয়িতার চেয়ে জরুরি চিন্তাধারা অন্য কিছু ছিল না তার কাছে। তাদের মধ্যকার কথা বের করার সময় পায়নি ইসমাইল। সন্তোপর্নে শ্রেয়িতাকে হসপিটাইলাইজড করেছিল। এর মধ্যে শ্রেয়িতার ট্রিটমেন্ট সুন্দরভাবে হয়ে যাওয়ায় কেবিনে সিফ্ট করে ছিল রমণীকে। ৭ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরবে বলে জানিয়ে গিয়ে ছিল ডক্টর টিয়া। এটুকু সময়ে ইসমাইল ৩ ঘণ্টা এনজিও ক্যানভাসে ক্লাস করিয়ে ছিল। বাকি ৪ ঘণ্টা শ্রেয়িতার সঙ্গে কাটায়। লক্ষ্মীনা আন্টির ডাকে সম্মতি ফিরে ইসমাইল এর। সে ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে ছিল। তিনি ইসমাইল এর হাত আঁকড়ে ধরে ক্রন্দনরত গলায় বলেন,

‘মেয়ের সঙ্গে কি হয়ে ছিল বাবা! জানো না দেবী না থাকলে আজ আমার মা হারিয়ে যেতো।’

ইসমাইল স্মরণে ‘ইয়া রব্বি তুমি মহান’ বলে। আন্টির কথায় সে আশ্বস্ত করে বলে,

‘কিছু হয়নি আন্টি ছোটখাট রিকশা এক্সিডেন্ট।’

লক্ষ্মীনা মেয়ের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে এক পলক ফেলে ইসমাইল এর দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলেন,

‘মেয়ে হীনা দেবী আমার ঘরে মুসলিম মেয়ে দিলেন। এতে আমার দ্বিধা নেই। তাকে কখনো সনাতন ধর্মের পূজারী হতেও আশ্বাস দেয়নি। বরঞ্চ নিজ সন্তোপর্নে সে নিজের ধর্মে চলেছে। জানো বাবা আমার গর্ভ থেকে কখনো কন্যা সন্তান হবার নয়। পুত্র আছে তবুও একটা কন্যা সন্তান এর জ্বালা বেশ পুড়াতো। একদিন বাচ্চা কন্যাটিকে দত্তক নিলাম। নেওয়ার আগে জানতে পারলাম বাচ্চা কন্যাটি মুসলিম। আমি আর উনি খুশিমনে নিতে চাইলেও পুত্ররা নারাজ। তারা হেয় করতে আরম্ভ করে। আজও পুত্র দুটো কন্যাকে পছন্দ করে না তার ধর্মের জন্যে। তবুও বোন রুপী হওয়ায় অবহেলা করে না বোনের প্রতি গুপ্ত প্রণয় ব্যক্ত করে।’

ইসমাইল লক্ষ্মীনা আন্টির মুখে আসল কারণটা শুনে শান্ত স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল। ইফদিয়ার আড়ালে শুনে নিল। আনমনে মুচকি হাসি দিল। যে হাসিতে ছিল তৃপ্তিকর হাসি। দুজনার প্রণয়ের ইতি ঘটবে না সে ভিত্তিতে। ইসমাইল আন্টির আঁকড়ে ধরা হাত দুহাতে আবদ্ধ করে আবদারের সহিতে বলে,

‘আমি আপনার মেয়েকে চাই। নিজের অর্ধাঙ্গীনি রুপে।’

লক্ষ্মীনা বেজায় খুশি। তিনি চাইতেন কন্যার জন্যে ইসমাইল এর মত সঙ্গী। এ যেন রোদেলা দুপুরে কাঠখোড় না পুড়িয়ে রত্ন পাওয়া গেল। শ্রেয়িতা লজ্জায় বাঁ হাতের কনুই চুক্ষদ্বয়ে রেখে ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত করে রেখাময় হাসি দিল। ইফদিয়ার তার হবু ভাবীকে ব্যঙ্গ করে বলে,

‘এখনি বুঝি লজ্জা পাচ্ছো ভাবী। কিছু লজ্জা বাসর রাতের জন্যে বাকি রেখো।’

এবার যেন শ্রেয়িতার গালে লাল বর্ণালীপূর্ণ রক্তিম আভা ফুটে উঠল। ইসমাইল আবেগী নজরে চেয়ে আছে রমণীর দিকে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন সে মনের গহীনে বেঁধেছিল সেটাই যে পূর্ণ হতে চলেছে। ভাবতেও যেন তার মনটা খুশিতে নেচে উঠতে চায়। ইফদিয়ার তার ভাইয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে মনে। সেই সঙ্গে যাবিয়াজ এর একপলক দেখার কামনা জাগে। লক্ষ্মীনা মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলেন,

‘মা-গো সামনে দূর্গাপূজা। এরপর তোদের বিয়ের দিন ফিক্স করে নিলাম।’

ইফদিয়ার দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘সত্যি আন্টি!’

‘হ্যাঁ মা!’

‘ভাইয়া রেডি হয়ে নাও। দূর্গাপূজা শেষে তোমাদের বিয়ে ইয়াহু।’

‘হে রে বোইন এবার বুঝি রেডি হতেই হবে। আর দেরি করা যাবে না।’

শ্রেয়িতা মুখ ভেটকিয়ে লাজুক হাসে। যা ইসমাইল এর নজর এড়ালো না। ইফদিয়ার তার ভাইকে কিছুক্ষণের জন্যে বাসায় পাঠিয়ে দিল। অনেকক্ষণ যাবত তার ভাই কাজে কাজ করেই যাচ্ছিল। এখন না হয় বিশ্রাম নিক। সে তো আছেই শ্রেয়িতার খেয়াল রাখতে। ইসমাইল এর বাহু চেপে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে আনে ইফদিয়ার। সে বেচারা হতবাক হয়ে বলে,

‘বোইন পিঠবি নাকি ওমনী বের করে আনলি কেন!’

‘পিঠাইনো দরকার। বাসায় যাবে না আপুর খবর দেবে না। সবকিছুর ফয়সালা বুঝি তুমি নিয়ে রাখছো। এবার আমার কথা শোনো। যদি না মানছো বিশ্বাস করো। এই কাঁচের জানালা দিয়া ধাক্কা মারব। একদম ছয় ফিট নিচে গিয়ে মরবে।’

‘হই বোইন কউ কি বলবি!’

‘বাসায় যা খাবার খা আর কিছুক্ষণ ঘুমা। চোখের আর মাথার দিকে খেয়াল রাখো না যতসব!’

ইসমাইল মেলা সত্ত্বেও মানাতে পারল না ইফদিয়ার কে। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট রইল। অতঃপর বাধ্য হয়ে ইসমাইল শ্রেয়িতার সঙ্গে পাঁচ সেকেন্ড এর মত কথা বলে রওনা দিল। যাওয়ার আগে বোনকে ‘খেয়াল রাখিস নিজের’ বলে চলে যায়। ইফদিয়ার কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে। সেখানে ইতিমধ্যে ডক্টর টিয়া এসে শ্রেয়িতার শরীর এর কন্ডিশন চেক করছেন। ইফদিয়ার আলতো কণ্ঠে বলে,

‘ডক্টর এনি সিরিয়াস কন্ডিশন!’

‘নো পিট্রি গার্ল। ইটস সিম্পল। আই থিংক উই উইল ডিসচার্জ হার ভেরি সুন।’

লক্ষ্মীনা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে কথাটি শুনে খুশি হলেন। কিছুক্ষণ আগে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গিয়ে ছিলেন তিনি। সে সময়ে ইসমাইলও দেখা করে চলে গিয়ে ছিল। ইফদিয়ার আন্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আন্টি আমরা তৈরি হয়ে নিলে ভালো হবে। আপুর জন্যে ড্রেস এনেছি।’

‘ভালো করেছো মা। তুমি শ্রেয়িতাকে তৈরি করে রাখো। আমি পুত্রদের জানিয়ে দিচ্ছি আসতে।’

লক্ষ্মীনা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইফদিয়ার শ্রেয়িতাকে ধরে হসপিটালের নীল পোশাক সরিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দিল। এতে কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করল ইফদিয়ার। কারণ শ্রেয়িতার কাঁধে-গলায়-ঘাড়ে নখের আচড় এর দাগ , ঠোঁটের কোণায় কাটা দাগ। এই দাগগুলোর অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। যেটি হলো জোরকৃতভাবে ধর্ষণ। ঢোক গিলে ইফদিয়ার ভাবে একবার জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু মানসিক পরিস্থিতি একটু আমলে আসায় ব্যক্ত করল না। তার ভাই থেকে শুনে নিবে বলে ভেবে রাখল। অথচ যখন এরফান ভাই তাকে কল করে ছিল। তখন এরফান বলে ছিল ‘শ্রেয়িতা মেডিক্যালে। এক্সিডেন্ট করেছে সেখানে ইসমাইল ভাই আছে। আন্টিসহ তুমিও যাও।’

একটু কথায় কল কেটে দিল। বিস্তারিত না বলায় সামান্য ক্রোধ হয়ে ছিল ইফদিয়ার। তার পুনরায় অবাকও লাগল যে এরফান অপরিচিত হলেও ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আন্টিসহ সে মেডিক্যাল পৌঁছে যায়। রিসেপশন থেকে কেবিন নং জেনে তড়িঘড়ি রওনা দেয়। কেবিন এর সামনে ভাইকে দেখে স্বস্তি মিলে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে ইফদিয়ার হাস্যজ্জ্বল মুখ করে শ্রেয়িতাকে তৈরি করে নিয়ে গেল।

১ ঘণ্টা পর বাসায় পৌঁছে যায় সবাই। সেন আর রৌশ ভেতরে থাকায় ইফদিয়ার নিজের বোরকা, নেকাপ শুদ্ধভাবে টেনে ঠিক করে ফেলল। তারা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এক নজর ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যায়। ইফদিয়ার বুকের উপর হাত রেখে জোরাল শ্বাস ছাড়ে। শ্রেয়িতাকে আন্টি নিজ রুমে নিয়ে যায়। সে তার মায়ের রুমে গিয়ে দেখে তার মা হাতড়িয়ে কি যেন খুঁজছেন।
ইফদিয়ার ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিজিয়ে বলে উঠে।

‘আম্মা কি খুঁজছো!’

মিসেস জাবিয়া অনেকটা সুস্থ আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছেন। মেয়ের কণ্ঠ শুনে তিনি ফিরে তাকান। ঠোঁটের ফাঁকে স্মিতপূর্ণ হাসি টেনে বলেন,

‘ফোনটা পাচ্ছি না। একটু দে তোর আপন একজনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। অনেক দিন তো হলো কথা হয়না।’

ইফদিয়ার অবাক এতদিন তার আপন জন বলতে তার মা, কাকীমা, ইসমাইল আর কেউ নয় জানে। এখন নতুন আপনজন কোথার থেকে উদয় হলো সেটাই বুঝতে পারছে না সে। তাও মায়ের কথার বিপরীতে গিয়ে বলে,

‘ঠিকাছে এত খুঁজছো কেনো ! আমার ফোন নিয়ে বলো।’

মিসেস জাবিয়া ফোনটা নিয়ে ফোন নং এ ডায়ল করে। ইতিমধ্যে রিং হচ্ছে। তিনি ইফদিয়ার সামনে কথা বলতে জড়তায় ভোগচ্ছেন। তাই চুপ করে রইলেন। কলটা অপরপাশের ব্যক্তি ঠিকই ধরেছে। ইফদিয়ার অজানা যে কলটি আজও রিসিভ হয়েছে কিনা। কারণ তার মা বোবার মত মূর্তি বনে আছে। দু’পাঁচেক মিনিট পর তিনি কল কেটে ইফদিয়ার কে দিল। আনমনে বলে,

‘দূরে যাবে রে।’

‘মানে!’

মিসেস জাবিয়ার সম্মতি ফিরলে তিনি ‘কিছু না’ বলে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়লেন। কিন্তু মেয়েকে কিভাবে জানাবেন! ইফদিয়ার তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

‘মা আগামী দশমী দিন দূর্গাপূজা চলবে! লক্ষ্মীনা আন্টি ভাইয়া আর ভাবীর বিয়ের দিন ফিক্সড করেছে একাদশ দিনে। মানে পূজার শেষে। ইসলামিক বিধিবিধান অনুযায়ী বিয়েটা হবে।’

‘তার মানে নিজ গৃহে এখন বউমাকে উঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘হু মা তুমি কি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরবে। আমার কলেজ স্টার্ট হবে তিন মাস পর।’

‘একমাত্র ছেলে জাকজমকভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে বিয়েটা করাবো।’

‘ওকে আমি গিয়ে ভাইকে বলি।’

‘না তুই যা আমিই কথা বলব।’

ইফদিয়ার ‘না’ করেনি। সে উঠে যায়। নিজ রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ ফোনের মেসেজ ঠুং ভাইব্রেইট হয়ে উঠে। মেসেজে এরফান ভাই এর আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।

‘শোনো বোন আজকে রাত ৯টায় রাকতিয়া ক্যাফে চলে এসো।’

ইফদিয়ার একপলক দেখে চোখ বুজে নিল। বুজতেই অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুসিক্ত হলো। যার অবদান শুধু যাবিয়াজ নামক যুবকের। আজও বড্ড পুড়ায়। কিন্তু আজকের দিনটায় পীড়নটা যেন সীমাহীন মনে হচ্ছে তার। অকারণে পুড়ছে হৃদয়টা। না জানি সামনে কি অপেক্ষা করছে!

৪৩.

ফেরদৌস এর পাশে এরফান বসে আছে। দুজনই গম্ভীর দৃষ্টিতে যাবিয়াজ এর দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই শ্রেয়িতার কথা জানিয়ে ছিল। এতে রাগ মাথায় চড়ার পূর্বেই এরফান বলে দিল যে, ইসমাইল ভাই সামলে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ছেলে দুটোকে বেধড়ক আঘাত করেছে।
এতে শান্ত হয় যাবিয়াজ এর প্রাণ। যত হোক বোনপ্রিয় মেয়ে শ্রেয়িতা। তাদের বান্ধবী কম বোন বেশি সে। একটুখানি আচ যেন সে পেলে তাদের শরীরে লাগে এমন হয়। এখন বোনের জীবনে সঙ্গপণতায় কেউ জায়গা করার মত এসেছে। তাও আবার যোগ্য একজন মানুষ। ফলে যাবিয়াজ এর আর কোনো চিন্তা নেই। নিদ্বিধায় সে বলে দিল।

‘ইসমাইল ইজ পার্ফেক্ট ফর শ্রেয়িতা।’

‘হুম বায় দ্যা ওয়ে সি এন্জ ইফদিয়ার উইল কাম ইন টু নাইন পিএম।’

যাবিয়াজ শুনে মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে ‘হুম’ বলে। ফেরদৌস দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে রাগমিশ্রিত গলায় বলে,

‘তুই আমাদের দোস্ত মানিস!’

যাবিয়াজ বোকামার্কা হাসি দিয়ে বলে,

‘কেনো আমি বুঝি না মানার ট্যাগমা কপালে নিয়ে বেড়াচ্ছি!’

‘তাহলে ছেড়ে যেতে এক সেকেন্ড এর জন্যে হলেও ভাবতি। যাবি বুঝলাম একমাস দুমাস হলেও চলতো। যাবি তাও তিনবছর। লাইক সিরিয়াসলি!’

‘দেখ দোস্ত। বাবার ব্যাপারে তোরা জানিস। এন্ড আইম অলওয়েজ সিরিয়াস টু মাই ফাদার কন্ডিশন।’

‘তাও সময় কমানো যায় না।’

‘না।’

যাবিয়াজ এর একরোখা জবাব। এরফান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন বিরক্তবোধ করে বলে,

‘কেন ঐ মেয়ের জন্যেই গিয়ে থাকবি তিনবছর। আর আমাদের!’

‘তোরা যথেষ্ট এডাল্ট এন্ড হার্ডওয়ার্কার। আমার অনুপস্থিতিতে অবশ্যই তোরা এখানকার সব সামলাবি। নিজেদের ক্যারিয়ারও গড়তে পারবি।’

‘রাতে চলে আসিস। শেষবার দেখা করে যাবি।’

‘ওটা আর বলতে কি! তাকে এক নজর না দেখে কেমনে পাড়ি দিবো অজানা দেশে।’

যাবিয়াজ সে সময়ের মত ইতি টেনে কফিশপ হতে চলে যায়। গাড়িতে বসে ইঞ্চিন চালু করে। প্রথমে ভাবে একবার ইফদিয়ার কে অনুরোধ করবে বাবার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু নিজের ইগোটাও মাঝখানে চলে আসে তার। ইগোর ব্যাপারটা বুঝে চুপ হয়ে যায়। নিজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছানোর ব্যকুলতা মনমাঝাড়ে আঁটে। রুমে এসে যাবিয়াজ তার ফোন নিয়ে কল দিল ইসমাইল কে।

ইসমাইল সবেমাত্র ফ্রেশ হয়েছে। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। ফোন আসায় কলটি কানে ধরে সালাম দিল। যাবিয়াজ সালামের জবাব দিয়ে বলে,

‘ভাইয়া আমি এসিস্ট্যান্ট পদ থেকে রিটায়ার হতে চাই। আমার বাবার চোখের অপারেশন।’

বিস্তারিত জানায় উক্ত ব্যাপারে। ফলে ইসমাইল রাজি হয়ে যায়। যাবিয়াজ কল রেখে আনমনে বলে,

‘আরেক দায়িত্বও শেষ। শুধু বাকি তুমিই ইফদিমনি।’

রাত ৯টা…

রাকতিয়া ক্যাফটা আজ পরিপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে। এটি পাবলিক রেস্টুরেন্ট। এখানে দূর্গাপূজা উপলক্ষে ফেরি লাইটস ইউজ করা হয়েছে। মরিচবাতির আলোতে রংধুনর বর্ণালী ছড়িয়ে পড়ছে। কেউই ভাবেনি আজকের ক্যাফ এতটা সৌন্দর্যের প্রকাশন হবে। যাবিয়াজ, এরফান, ফেরদৌস, তিয়ানা, ইফদিয়ার, ইসমাইল, শ্রেয়িতা চলে এসেছে।
তারা চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্যাফটা লক্ষ করে। তখনি সাবলীল কণ্ঠে একজন পুরুষ এসে তাদের টেবিলে বসার অনুরোধ জানায়। তার কথা মত ইসমাইল এক জানালার পাশের টেবিলে সবাইকে বসতে বলে। আজকের খাবারের খরচটা সে দিতে চায় বলে জানায়। এতে আর কেউ আপত্তি করেনি। শ্রেয়িতা তাদের কে নিজের আর ইসমাইল এর বিয়ের কথা জানায়। এ কথা শুনার পর যতটা না সবাই খুশি হয়ে ছিল তার চেয়ে বরং দুঃখটা এখন বেশি হচ্ছে যাবিয়াজ এর চলে যাওয়ার কথা শুনে। ইফদিয়ার যখন শুনে তখন তার শরীর অবশ মূর্তি হয়ে গিয়ে ছিল। বসেই ছিল মুখ তুলে একপলকও ফেলেনি যাবিয়াজ এর দিকে। মূর্তি রুপী হয়েও কান্না আঁটকে রেখে বারংবার ঢোক গিলছিল। এই বুঝি মিথ্যে বানোয়াট কথা বলেছে বলে মজা করে উঠবে যাবিয়াজ। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে যাবিয়াজ বলে,

‘রাতের ১টায় ফ্লাইট। তাই ভেবেছি চলে যাচ্ছি তোদের সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। এতে ক্ষতি কয়!’

ইফদিয়ার খুব করে বলতে ইচ্ছে ছিল। যেন সে তাকে না রেখে চলে যায়। একবার তার মনের কথাটা বলার জন্যে জিজ্ঞাসা করুক!
যাবিয়াজ ইফদিয়ার কে চুপ দেখে কষ্ট পেল। তাও বেহায়ার মত ধরা চাপা গলায় প্রশ্ন করে।

‘তুমি খুশি রাইট আমি চলে যাচ্ছি বলে!’

ইফদিয়ার মনটা ক্ষেপে উঠে। কেউ যদি উওপ্ত আগুনে ঘি ঢেলে আগুনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাহলে আগুন তো বাড়বেই। সেখানে যাবিয়াজ এর প্রশ্নটা যেন ছিল ব্যঙ্গ করার মত। যেন সে তাকে ঠেস মেরে কথাটি বলেছে।
অন্যদিকে, যাবিয়াজ মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে। যেন একবার ইফদিয়ার না বলে উঠুক। সেই নেগেটিভ উত্তরটি যত চিল্লিয়েই হোক না কেনো তাও যেন বলে উঠুক। কিন্তু তাদের মনকামনার প্রতিক্রিয়া বিপরীত দিকে মোড় নিল।
ইফদিয়ার ক্ষেপানো গলায় সোজাসুজি বলে,

‘যতসব ন্যাকামো যাবেন তো চলে যান না। নাকি এখনো সিনক্রিয়েক্ট করার জন্যে বসে আছেন!’

ব্যস এটুকু যথেষ্ঠ হয়ে গেল যাবিয়াজ এর হাসিখুশি মুখে কালো মেঘের ছায়া নামিয়ে দিতে। হাসিটাও মিলিয়ে যায় মেঘের অন্তরালে। মলিন বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠে। শ্রেয়িতা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলবে। তার আগেই যাবিয়াজ তার হাত আঁকড়ে ধরে মাথাটা ‘না’সূচক নাড়ে। এতে শ্রেয়িতা দমে যায়। কিন্তু ইসমাইল আজকের বোনের করা ব্যবহারে ক্ষোপ প্রকাশ করল। কোনো মানুষ যদি সফরে যায় তার সঙ্গে ভদ্রভাবে কাতিরতা ফেস করতে হয়। আপ্যয়নে কমতি রাখা যায় না। সেখানে সফরযাত্রীকেই তার বোন কটুভাবে কথা শুনিয়ে দিল। ইসমাইল রেগে জিজ্ঞাসা করে।

‘বোন তোর সব ব্যাপার মানলেও আজকেরটা মানলাম না। যাবিয়াজ চলে যাবে। তাও তোর রাগ এতটা যে সফরযাত্রীর সঙ্গে মৌনতার পরিবর্তে রুক্ষতা প্রকাশ করলি।’

ইফদিয়ার নিরবে নেকাপের আড়ালে চোখের পানি ফেলে। মাথা নিচু করে দৃষ্টি মেঝের দিকে করে রেখেছে। যাবিয়াজ কাঁপান্বিত হয়ে আমতা আমতা করে হেসে বলে,

‘ওকে গাইস আজকে আমার এখানে খাওয়া হবে না। তোমরা খেয়ে নাও। আমার বের হতে হবে।’

সবাই ঠিক বুঝতে পেরেছে কেনো যাবিয়াজ চলে যাচ্ছে। এতে যে ইফদিয়ারও অবগত। তবুও তার মন কাঁদছে যাবিয়াজ এর চলে যাওয়াটা সে নিতে পারছে না। কিন্তু হায় ইগো! চুপ করিয়ে রেখেছে।
যাবিয়াজ চলে যায়। ইফদিয়ার দৃষ্টি উঠিয়ে সে দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হচ্ছে কলিজাটা বোধ হয় বেরিয়ে ঐ মানব হৃদয়ের সঙ্গেই চলে গিয়েছে। হয়তো আর ফিরে পাবে না।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৪

৪৪.
অতৃপ্ত মন শান্ত হয় না প্রিয়সীর স্পর্ধায়। তাকে হিনা শরীরটা অসাড় মনে হয়। আকাশে যেন ঘন মেঘ রয়েই যায়। এই মেঘের অন্তরালে যদি রোমাঞ্চকর বর্ষণ আরম্ভ হতো। তাহলে জননীর বুকে বয়তে শুরু করতো সুখের সমাধি। প্রিয়সীর বুক মাঝারে লুকিয়ে দুষ্টু বিলাপ করতে চাওয়া হলো প্রতিটা প্রেমিক পুরুষের চিরন্তর আকাঙ্ক্ষা। প্রিয়সীর মান্য অভিমানী চেহারায় রক্তজবার আভাস ফুটে উঠে। মনে হয় যেন সদ্য রক্তে ভিজা গাল দুটো বিমোহিত করে চলেছে। এই বুঝি পাগলা প্রেমিক কবির ন্যায় আচরণ করবে যাবিয়াজ।
সে অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতনামা মেডিক্যাল এ অবস্থান করছে। নিজের চেম্বারে জানালার দিকে মুখ করে রকিং চেয়ারে ভর ছেড়ে বসে আছে। চুক্ষদ্বয়ের চাহনী জানালার বর্হিভাগে থাকা বিশাল খোলা আসমানে। উজ্জ্বল নীল রঙে রাঙানো রয়েছে উম্মুক্ত আসমানটি। আসমান এর দিকে তাকিয়ে যাবিয়াজ ভেবে চলেছে প্রিয় অপ্সরীর বিষয়প্রাণ। সে মনমাতালে আঁকা রঙিন মনছবিতে যুবতীর মুখপানে চেয়ে তার প্রেক্ষিতে বলে,

‘পাঁচ বছর যে কেমনে চোখের পলকে কেটে গেল। বুঝতেই পারছি না ইফদিস্পরী। আহ আর কত নামে তোমায় আখ্যায়িত করব বলো! তুমি কোনটা শুনতে পছন্দ করবে। ইফদিমনী নাকি অপ্সরীমনী নাকি ইফস্পরী। নামে তো সমস্যা নাই। কিন্তু এবার জ্বালানোর সময় আমার ঘনিয়ে আসছে ইফস্পরী। অনেক তো আমায় জ্বালালে। এবার আমার ভয়ানক পীড়ন জ্বালা সহ্য করতে প্রস্তুত হয়! মধুময়ী অত্যাচারী পীড়নের ভোগান্তি করতে আসছি আমি।’

রকিং চেয়ার কে যাবিয়াজ নিজের শরীরের ভর দিয়ে পুনরায় দুলতে ধাক্কা দিল। এতে রকিং চেয়ারটি প্রসারিত হয়ে পূর্বের ন্যায় সামনে পিছনে দুলতে আরম্ভ করে। তার হাল যেন বেহাল। শান্ত মুখশ্রীতে রাজ্যের ক্লান্ত ভর করেছে। এর উপর প্রিয়সীর করা মানসিক অত্যাচারগুলো অসহনীয় হয়ে উঠেছে তার নিকট। সান্নিধ্য পেতে চাই তার প্রিয়সীর। প্রিয়সীর প্রতিটা ছোঁয়া যেন অনুভব করতে চাই সে গভীরভাবে। যাবিয়াজ চোখ বুজে দুলা থামিয়ে দিল। হাত দিয়ে কাঁচের কিউব বক্সটি শক্ত করে চেপে ধরে সে। নিজের কলার সটান করে দাঁড়িয়ে যায়। তার সম্মুখে থাকা দরজা খুলে কিছু দূর হেঁটে একটি কাঁচের দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সেটি খুলেই দেখল ভেতরে রয়েছে বিশাল আকৃতির টেবিল। তার চৌপাশে ১০-১৫টি চেয়ারে কয়েকজন ফরেইন ক্লাইন্ট বসে রয়েছে।
পাওয়ার ফুল চোখের চশমা পরিদান করে যাবিয়াজ। এগিয়ে এসে তার নিজের আসনে বসল। তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মর্ডান পোশাক পরিহিত এক ২৩ বছরের রমণী। সে যাবিয়াজকে দেখে আবেদনময়ী হাসি উপহার দিল। যার প্রভাব মুটেও পড়েনি যুবকের উপর। হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ছু মেরে রমণীর হাত থেকে রিপোর্ট ছিনিয়ে নিল যাবিয়াজ। রমণীর মুখখানি যেন মুহূর্তেই ফাটা বেলুনের ন্যায় হা হয়ে গেল। কোথায় ভাবল যাবিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে ফিট খেয়ে পড়বে! তা আর হলো কই! রমণী ক্রোধে এক প্রকার ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।
যাবিয়াজ রিপোর্টটি পুরুপুরি চোখ বুলিয়ে নিল। সযত্নে টেবিলের উপর রিপোর্টটি রেখে দর্শকবৃন্দের দিকে পরখ করে। ফরেইনার ক্লাইন্টস তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। যাবিয়াজ চোখের চশমা খুলে টেবিলে রেখে দু’হাত উচু করার মত প্রসারিত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

‘মাই প্রোগ্রেস রিপোর্ট নেভার ব্রেক ডাউন! এগেইন আওয়ার বায়োজেনেটিক্যাল প্রোগ্রেস গিভেন।’

রমণী অবাক দৃষ্টিতে যাবিয়াজ এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘কিন্তু ডক্টর যদি প্রব্লেম হয়!’

‘নট এট এল শায়েনা। বায়োজেনেটিক প্রোগ্রেস নিয়ে আমি তিনবছর ধরে চর্চা করে চলেছি। এবার চর্চার ফলাফল দেখব। আই বিলিভ প্রোগ্রেস রিপোর্ট ভঙ্গন ধরবে না। ভঙ্গন ধরার কোনো পথই রাখব না।’

শায়েনা নামক মেয়েটি চুপছে যাওয়া মুখ করে নিল। সে নামে মাত্র এসিস্ট্যান্ট যাবিয়াজ এর।
শায়েনার মুখভঙ্গি দেখে যাবিয়াজ এর সন্দেহ হলো। মনভ্রান্তে খটকা লাগে তার। তবুও তাৎক্ষণিক সময়ে মনের সন্দেহটা প্রকাশ করল না। জমাট রাখল নিজের মনের অধীনে। যাবিয়াজ এর কথায় ক্লাইন্টস একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সবাই রাজি হলেও একজন সাহস করে বলে উঠে।

‘বাট স্যার আই ওয়ান্ট টু সি দ্যা প্রোগ্রেস রিপোর্ট এগেইন।’

ক্লাইন্ট এর কথায় যাবিয়াজ মুচকি হেসে নিজ আসনে বসা অবস্থায় হাতের ইশারায় শায়েনা কে কিছু ইঙ্গিত করে। শায়েনা দেখে বুঝতে পারল। যাবিয়াজ তাকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর চালু করতে বলেছে! সে দক্ষিণ দিকের কোণায় গিয়ে ছোট বর্গাকৃতির টেবিলে রাখা প্রজেক্টর এ প্রেস করে। সঙ্গে সঙ্গে এলইডি লাইট বন্ধ হয়ে গেল। জ্বলে উঠল নীল রঙের ড্রিম বাতি। কেবিনটাও নিভু আলোকিত হয়ে উঠে। শায়েনা এবার ল্যাপটপ স্ক্রিনের রিপোর্ট লেখা ফাইলটিতে প্রেস করে। রিপোর্টটি অটোমেটিক্যালি চালু হয়ে প্রদর্শিত হতে আরম্ভ করে। মাল্টিমিডিয়ার আধুনিক প্রদর্শনতায় উক্ত ক্লাইন্ট খুশি হলো। সে হাসিমুখে বলে,

‘থ্যাংকস ইটস রেয়ালি নাইচ।’

যাবিয়াজ শুনে ‘ওয়েলকাম’ বলে দাঁড়িয়ে যায়। আজকের মিটিং আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে তা বুঝতে পেরে সসম্মানে প্রস্থান করে। একে একে ক্লাইন্টসও প্রস্থান করে চেম্বার হতে। যাবিয়াজ সদর মেডিক্যাল এর দরজা পেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। শায়েনা মেয়েটি ছুটে এসে যাবিয়াজ এর গাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। হাঁপাতে থেকে আমতা আমতা করে বলে,

‘স্যার আপনি কি আমায় বাসা অব্দি পৌঁছে দেবেন!’

যাবিয়াজ এর বিরক্ত লাগে তার এই এসিস্ট্যান্ট শায়েনা কে। তার কাছে বিরক্তির মূল কারণটি হলো শায়েনার ন্যাকামি করা, অত্যধিক রঙলিলার বাহানা তৈরি করা। তবুও রাস্তার মোড়ে থাকায় কোনো প্রকার তামাশা যাবিয়াজ চাই না। ভদ্রতার কাতিরে সে হাসার অভিনয় করে ভেতরে বসতে বলে। শায়েনা যেন অতি খুশিতে পাগল হবার উপক্রম। যাবিয়াজ তাকে বসতে বলেছে দেখে জট করে কোমর বাঁকিয়ে উঠে বসে। শায়েনা টু শব্দ করার পূর্বেই গাড়ির ইঞ্চিন চালু করে ফেলে যাবিয়াজ। গাড়ির গতি আরম্ভ হয়ে যাওয়ায় শায়েনা জানালার বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার মনে চলছে শয়তানি কারবার। সে চাইলে নিজেই বাসায় যেতে পারতো। তবুও যাবিয়াজ কে একা যেতে দেখে নিজের লোভাতুর ইচ্ছে দমাতে পারিনি। তার বসের সঙ্গে একলা গাড়িতে করে বাসায় যাবার নাম করে উঠে পড়েছে। শায়েনার বাসার রাস্তায় পৌঁছাতে দু’ঘণ্টা লাগবে। গাড়ি অনেকটা দূরে চলে আসলে শায়েনা ইচ্ছাকৃতভাবে তার হাতের স্পর্শ যাবিয়াজ এর কাঁধ বরাবর দিল। যুবক তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলার পূর্বেই হাত সরিয়ে নেই। যাতে কোনো তর্ক না করতে পারে। পুনরায় শায়েনা হাতটা তার বসের হাতের উপর মৃদু স্পর্শে ভরিয়ে দিল। যাবিয়াজ এর শরীর ক্রোধে কাঁপতে থাকে। শায়েনা তার বসের অস্বাভাবিক কাঁপুনিতে ভাবছে উনার শরীরে যৌন চাহিদা মেটানোর স্পর্ধা জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু বোকা মেয়েটা জানেই না যাবিয়াজ এর রাগটা ঠিক কিসের!
এই রাগটা যে আগুনে পুড়ার মত সেটা কিছুক্ষণ পরই যাবিয়াজ শায়েনাকে বুঝিয়ে দিবে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
এখনো সময় অবহিত থাকায় সে ভাবছে কিভাবে গাড়ির থেকে শায়েনা নামক আপদ কে বিদায় করা যায়। গাড়ির স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরেই মুভমেন্ট করছে যাবিয়াজ। আনমনে রাস্তায় দৃষ্টি রেখে বাঁকা হেসে ভাবে।

‘ইশ! আমার এসিস্ট্যান্টটা এত ইডিয়ট কেন বুঝি না। নোংরা ইচ্ছে পোষণ করার জন্যেই আমার পাশে বসেছে। এর জন্যে কিছুটা সুফল দিতেই পারি আমি।’

যাবিয়াজ নিজেই শয়তানি হাসি দিয়ে গাড়িটা ইচ্ছেকৃতভাবে অন্য রাস্তায় নিল। সেখানের একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল। শায়েনা ভ্রু কুঁচকে শপিংমলের দিকে তাকায়। যাবিয়াজ এর দিকে প্রশ্নতুর চাহনী নিয়ে বলে,

‘আমরা এখানে কেনো এসেছি!’

‘আমার শপিং এ যেতে হচ্ছে। তাই তোমাকে দায়িত্ব দেবো পূরণ করবে। ইটস মাই অর্ডার!’

শায়েনা দৃষ্টি নত করে বলে,

‘ওকে বাট অর্ডারটা কি!’

যাবিয়াজ বলে ‘চুপ করে বাসায় না পৌঁছা অব্দি চোখের মধ্যে কাপড়টি বেঁধে রাখবে। তোমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হবে, যা করা হবে কথার খেলাফ হতে পারবে না। না হলে চাকরী থেকে বরখাস্ত করে দেবো।’

‘নো নো স্যার আই উইল রেসফেক্ট ইউর অর্ডার!’

যাবিয়াজ একটি কাপড় এগিয়ে দিল শায়েনার নিকট। শায়েনা সেটি পরে ফেললে যাবিয়াজ নিশ্চুপে গাড়ি থেকে বের হলো। তার সামনে চলে আসে একটি মেয়ে। যে কিনা একজন লেস*****। তাকে যাবিয়াজ এর দোস্ত এরফান পাঠিয়েছে বাইক করে। কেননা যাবিয়াজ গাড়ি চলাকালীন এরফানকে আপদ সম্পর্কে অবহিত স্বরুপ মেসেজ করে। এরফান দুষ্টু হেসে ‘ডান’ বলে একটি ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। সেই ঠিকানা অব্দি এসে এবার মেয়েটিকে ইশারায় বুঝায় বসা মেয়েটিই আসল।
লেস**** টাইপ মেয়েটি গাড়িতে বসে পড়ে। তার সঙ্গে আনা বাইকে বসে হেলমেট পরিদান করে যাবিয়াজ। গাড়ি চলে যেতেই সে ফিচেল হেসে বলে,

‘নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলে মিস শায়েনা।’

যাবিয়াজ বাইক চালু করে নিজের বাসার পথে রওনা দিল।

৪৫.

পরিবর্তনশীলতা পৃথিবীর বিবর্তনের সূত্রে ছিল, আছে আর রইবে। এক প্রজম্মের পর অন্য প্রজম্মের আবির্ভাব হয়। বছর পেরিয়ে যায়। ইসমাইল আর শ্রেয়িতার সম্পর্কটাও গাড় হলো। দুজনের সম্পর্কটা গাড় হওয়ার পেছনের মূল ভিত্তি হলো ইসরাইব। যার মাত্র চার বছর বয়স। ছেলেটা বাবা পাগল। ইসমাইল ক্লান্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করে। তার মা মিসেস জাবিয়া চশমা এঁটে খবরাখবর পড়ছেন। উনার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল শ্রেয়িতা। হাতে ট্রের মধ্যে ঠান্ডা পানীয় গ্লাস। মিসেস জাবিয়া ইসমাইলকে দেখে মুচকি হাসি দিলেন। ইসমাইল এসে মুখ-হাত-পা ধুয়ে সোফায় গা হেলিয়ে দিল। মাকে সালাম করে প্রিয়সীকেও সালাম দিল সে। শ্রেয়িতা লাজুক কণ্ঠে সালামের উত্তর দিল। এগিয়ে দিল লেবুর ঠান্ডা শরবতের গ্লাসটি ইসমাইল এর দিকে। সে আড়চোখে প্রিয়সীকে চোখ টিপ মারে। এতে বেচারী শ্রেয়িতা শ্বাশুড়ির সম্মুখে ত্রপাটে দৃষ্টি নত করে নিল। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে মৃদু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। ইসমাইল শরবত পান করছিল। তখনি
‘আব্বা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে ইসরাইব।
লেবুর শরবত যা পান করছিল তার অর্ধভাগ মুখ ফুসকে পড়ে যায় ইসমাইল এর। মুখ ফুসকে পড়ায় মিসেস জাবিয়া তড়িঘড়ি ইসমাইল কে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলেন। ইসমাইল সহ তিনিও মাথা ঘুরিয়ে পিছে তাকান।
ইসরাইব দৌড়ে এসে বলে,

‘আব্বা ফুপ্পিকে বলাটে পোলারা আততে দেয় না।’

ইসরাইব এর আদু কণ্ঠে বলা কথাটি কর্ণপাত হতেই ইসমাইল এর মাথায় ধপ করে আগুন লেগে গেল। তার প্রিয় বোনের শরীরে সামান্য আচ সহ্য করতে পারে না সে। সেখানে বখাটে ছেলের কিনা সাহস কত বড় হাত ধরার!
ইসমাইল দ্রুত গতিতে বাহিরে এসে যে দৃশ্যটি দেখে। সজোরে লাঠিচার্জ আরম্ভ করে। তার দরজার পাশে রাখা লাঠিটা দিয়ে ইফদিয়ার কে যে স্পর্শ করেছে। তার হাতে কড়াঘাত করতে আরম্ভ করে। ইফদিয়ার ভীতি মনে তার মায়ের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ইসমাইল লাঠিচার্জ করা অবস্থায় ক্রোধান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বলে,

‘পুনরায় আমার বোনের দিকে নজর দিবি। সব কটার গলা কেটে নদীতে ফেলব।’

‘আরে যা তো। তোর বোনকে চাই মানে চাই। ওকে বিয়ের পীরিতে বসাব দেখিস!’

‘তোর মত হারামজাদার সঙ্গে জীবনেও বসতে দেব না।’

ইসমাইল লাঠিটা ফেলে দিল। সে গিয়ে ছেলেটার মুখের উপর দরজা বেঁধে দিল। ইফদিয়ার ভাইকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। ভাইও কি করবে! কম চেষ্টা করেনি বখাটে নাজমুল এর কড়া শাস্তির জন্যে। কিন্তু পারিনি চেয়ারম্যান সাহেব এর দন্ডায়মান আসনের ফলে। ইসমাইল ইফদিয়ার গাল আঁকড়ে ধরে অস্পষ্ট কণ্ঠে ‘হুশ থাম’ বলে।
শান্ত হতে বলে সে। তাও যেন রমণীর কান্না থামে না। ইসমাইল তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘চিন্তা করিস না সে চলে আসবে। তোর জন্যে হলেও সব বিপদের মোকাবেলা করতে সে আসবে।’

‘আসবে না ভাইয়া। দোষটা নিতান্তই যে আমার। আমার দোষেই সে বদলে গেল, চলে গেল নিজের অপ্সরীমনীকে ছেড়ে। আমি খুব নিষ্ঠুর ভাইয়া। পারিনি তার যোগ্য ভালোবাসার দাবিদার হতে।’

ইফদিয়ার ভাইকে ছেড়ে রুমে প্রবেশ করে। দরজা আঁটকে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শ্রেয়িতা চেয়ে আছে দরজার দিকে। ইসমাইল এর দিকে এক নিষ্পলক চাহনী নিয়ে তাকায়। নিজের মনকে দৃঢ়স্থ করে সিদ্ধান্ত নিল সে আজ পুরু ঘটনার খোলাসা করে দিবে যাবিয়াজ এর কাছে। ঠোঁট কামড়ে ভেবে নিল মধ্যরাতে কল দিবে তাকে শ্রেয়িতা। ইসমাইল এর কাছে গিয়ে ফ্রেশ হতে ইশারা করে সে। ইসমাইলও দ্বিমত পোষণ করেনি। শরীরের কাঠুনি কেটেছে পুরুদিন। মেডিক্যাল, এনজিও ক্যানভাস এখনো এর মাঝে সীমাবদ্ধ কাজের ব্যস্ততা।

রাস্তার মোড়ে চায়ের টংবাজারে বেঞ্চের মধ্যে ক্লান্ত আহত শরীর নিয়ে বসে আছে নাজমুল। কিছুক্ষণ আগে মেডিক্যাল থেকে ড্রেসিং করে এসেছে সে। এই বখাটে ছেলেটাই ইফদিয়ারকে পাওয়ার কামনায় তার পিছে ঘুরঘুর করে। প্রতিবার ইফদিয়ার কে ভার্সিটির সামনে উ্যক্ত করা হলো নাজমুল এর নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। কিন্তু সফল হয়না অনেকবার ইসমাইল থাকায় ইফদিয়ার দ্বারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না নাজমুল। তখন সময়ে ছাড় পেয়ে যায় ইফদিয়ার। তবে যখনি ইসমাইল থাকতো না তখনি ইভটিজিং এর মত হয়রানির সম্মুখীন হতে হতো ইফদিয়ার কে। নাজমুল যেন তার পিছে মজনুর ন্যায় ঘুরে, উ্যক্ত করে, নোংরাভাবে স্পর্শ করে। ইফদিয়ার মুখ ফুটে সব কথা তার ভাইকে বলতে চেয়েও পারে না। কারণ তার ভাই মেডিক্যাল-এনজিও ক্যানভাসের কর্মে ব্যতিব্যস্ত থাকে। ফলে প্রচুর কাঠুনি কেটে রেহাই পায় তার ভাইটা। ইফদিয়ার ভাইয়ের কর্মের ব্যস্ততা, অধ্যবসায় বুঝতে পারে বলে চুপ থাকে। নাজমুল যেন এতেই আরো সুযোগ পায়। আজ তো গজব হতে চলে ছিল ইফদিয়ার জীবনে। কিন্তু এহেন মুহূর্তে ইসরাইব তার বাবা অর্থাৎ ইসমাইল কে বলে ফেলে। ইফদিয়ার ইসরাইব কে সঙ্গে নিয়ে ভার্সিটি এসেছিল। অতঃপর তাকে সঙ্গ নিয়েই বাসার পথে হাঁটা ধরে ছিল ইফদিয়ার। ইসরাইবকে আইসক্রীম কিনে দিয়ে যেই বাসায় প্রবেশ করবে। তেমনি সেখানে নাজমুল এসে ইফদিয়ার বোরকা ধরে টানাটানি করে। ইফদিয়ার যেন সন্ত্রাসীর হাতে ধরা পড়েছে মনে হলো। তার চুক্ষদ্বয়ে অশ্রুর ঘূর্ণিপাত আরম্ভ হলো। আকুতির কণ্ঠে নাজমুল কে ‘ছাড়তে’ বলে ছিল। অন্যথায় নাজমুল তাকে নোংরামির দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলে,

‘ঠোঁটে ঠোঁটে চুমু দিয়া বাসায় যেতে পারবে।’

ইফদিয়ার ঘৃণায় নাক ছিটকায়। এর পর ইসমাইল এসে নাজমুল কে বেধড়ক পিঠায়।

নাজমুল হলো চেয়ারম্যান এর ছেলে। তার সঙ্গে এলাকার লোকেরা ভয়ে কথা বলতে পারে না। মেয়েরা রীতিমত তার হাতে ইভটিজিং এর শিকার। ক্ষুধার্ত হায়েনার ন্যায় মেয়েদের ব্যবহার করে সে। এতো গত সপ্তাহের শনিবারে রাত ৯টায় এক ধর্ষিতার লাশ পাওয়া গিয়ে ছিল। লাশটি ছিল সদ্য ১৮ বছরে পা দেওয়া এক যুবতীর।
তাকে ধর্ষণ করে ছিল নাজমুল। তার শারীরিক নিযার্তনের পীড়ন অসহ্য হওয়ায় মৃত্যু বরণ করে সেই যুবতী।
নাজমুল রাতের আধাঁরে নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কে শরীরের চাহিদার জন্যে ব্যবহৃত করলেও রাস্তাঘাটে কচি শরীরের গড়নের মেয়ে পেলেই শিকার করে ফেলে। কিন্তু তার জঘন্য কাজে যে কত মেয়েদের জীবনহানি হলো। তার হিসাব নেই। এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ রুক্ষ মেজাজে তেঁতে উঠলেও চেয়ারম্যান এর ক্ষমতার দ্বায়ে মুখ খুলতে পারেনি। নাজমুল এর উপর আরোপ হওয়া শত ফাইল-কেস নাজমুল এর বাবা সরিয়ে ফেলেছে ক্ষমতার মাধ্যমে।
তার বাবার ক্ষমতার উপর ভর করেই সে ইফদিয়ার পিছে লেগেছে। তার মনের বাসনা পূরণ করার জন্যেই সে ঘুরঘুর করছে। ইফদিয়ার কে তার মত লালসার চোখে কামনা জেগে ছিল একটি ভুলের কারণে। ভুলটি ছিল দ্বিপাক্ষিক। অর্থাৎ ইফদিয়ার যেহেতু বোরকা পরিহিত আর আর্দশ ইসলামিক নারী রুপে বাসার বাহিরে যেতো। সেহেতু তার পিছে বখাটে ছেলে পরার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু নাজমুল এর মত গুন্ডা বখাটে পিছে পড়েছে। একবার ইফদিয়ার ইসরাইব এর সাথে পার্কে ঘুরতে এসে ছিল। তখন ভুলবশত ইসরাইব এর সঙ্গে খেলাখেলিতে ইফদিয়ার নেকাপ খুলে গিয়ে ছিল। সেই পার্কে নাজমুল তার দলবল নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এবং অন্যান্য মেয়েদের উ্যক্ত নোংরা বাজে ব্যবহার করছিল। ইফদিয়ার কে দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। কারণ সে বোরকা পড়ে ছিল। আকস্মিক ইফদিয়ার মুখ দেখে ফেলে একমাত্র শয়তান নাজমুল এর চোখজোড়া। সেই থেকে তার মুখে লাভার মত উচ্চারিত হয় ইফদিয়ার নাম। প্রতিবার তার কাছে গিয়ে লাঞ্চিত হয়েও বেহায়ার সীমা পাড় করে ফেলে নাজমুল। ইতিমধ্যে সে তার বাবার কাছে ইফদিয়ার এর তথ্য পাঠায়। সেই সঙ্গে এ কথাও বলে যে,

‘আব্বা মাইয়াটারে বেডে শুয়া চাই। হের লাইগা বিয়া দাও মোর।’

চেয়ারম্যান সাহেবও দাঁত কেলিয়ে বলেন,

‘উলে আমার পুত্র। তুই চাইলি আর আমি দিবো না তা হবে। এই মাইয়াকে তোর বউ বানাইয়া আনমু নে।’

নাজমুল শয়তানি হাসি হেসেছিল সে দিন মনে মনে। তার ইচ্ছে পূরণ হলেই কিসের বউ, কিসের বিয়ে এমন ব্যাপারটা ঘটবে। তা চিরন্তন অজানা নয় সকলের।

৪৬.

রাত ৯টা শ্রেয়িতা ইসমাইল এর উম্মুক্ত বুকে শুয়ে আছে। ইসমাইল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু নিদ্র নেই শ্রেয়িতার অক্ষিজোড়ায়। মাথা উঠিয়ে এক পলক ইসমাইল এর দিকে তাকায়। পরক্ষণে যাবিয়াজ ভাইয়ের কথা ভেবে ধীরস্থীরে নিজের বুকে চাদর পেঁচিয়ে উঠে বসে সে। বিছানার পাশে হাতড়িয়ে তার পোশাক খুঁজে। পেয়েও গেল। গায়ে জড়িয়ে শব্দহীন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। বেলকনির দরজা খুলে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে যাবিয়াজ কে কল দিল। পর পর তিনবার রিং পড়লেও যেন ধরেনি সে। হতাশ হলো শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার কথা বলবে ভেবেছিল আর হলো কি!
ফোনটা বেলকনির টেবিলে রেখে আকাশপানে তাকায়। আজ অগণিত তারা আকাশে ভেসে উঠেছে। সব তারার উজ্জ্বলতা ঝিকিমিকি রুপে সোভা পেয়েছে।
সে ভাবে পুরোনো ইতি দিনের কথা। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই আড্ডাটা আর নাই রে! 🙂

যেখানে বন্ধুমহলের হাসির প্রাণ ছিল এরফান, ফেরদৌস আর বলদ রুপী ছন্দবেশ যাবিয়াজ। সেই হাসির খোড়াক-প্রাণ মিলিয়ে গেল তারার মাঝে। কে, কোথায় আছে আজও অজানা শ্রেয়িতার।
কেননা যাবিয়াজ এর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার দিন ছিল বন্ধুমহলের ইতির দিন। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল বন্ধুগণ। অসহায় সঙ্গহীন কি! সেটা বুঝিয়ে দিয়ে ছিল ইফদিয়ার কে তারা। এরফান আর ফেরদৌস যাবিয়াজ এর যাওয়া সহ্য করতে পারিনি। তার যাওয়ার পিছনে দোষী সাব্যস্ত করে ছিল ইফদিয়ার কে। রমণী যেন ক্ষত বিক্ষত হওয়া মনে সবার কাছে মাফ চাই। কিন্তু তারা মাফ করেনি। ফলে সঙ্গহীন, মানসিকভাবে নিপীড়িত হলো ইফদিয়ার। শ্রেয়িতার অক্ষিদ্বয় হতে দু’তিন ফুট অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। পুরোনো সেই ‘ইতি দিনের’ কথা স্মরণ করে।
তাৎক্ষণিক ভাবে মিরাক্কেল হলো! যাবিয়াজ নিজ সন্তোপর্ণে কল দিল। শ্রেয়িতার মুখে ফুটে উঠে হাসির ঝিলিক। ফোন কানে ধরে উত্তেজিত খুশির চটে বলে,

‘ভাই তুই আছিস! তোর কল পেয়ে সত্যি মনটা নেচে উঠেছে। কবে আসবি সব বিগড়ে যাচ্ছে রে ইয়ার।’

যাবিয়াজ বিছানায় শুয়া অবস্থায় স্থীর চাহনী তার উপরের দিকে রাখে। তার দৃষ্টিতে থাকা সম্মুখীন চাহনীতে রয়েছে ইফদিয়ার প্রাণবন্ত হাসির ছবি। ঠোঁট প্রসারিত করে বাঁকা হাসির ন্যায় বলে,

‘দোস্তানি রিলেক্স মুড অন করে ফেল। এভরিথিংক উইল বি ফাইন। কজ আইম ব্যাক।’

চলবে……
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here