#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৫
৪৭.
বৈশাখী কালের আবরণ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। কালবৈশাখী ঝড় আসার পূবার্ভাস! গাছ-গাছালী প্রচন্ড বেগে নড়বড়ে যাচ্ছে। রাত ৩টায় ধুমকা জড়ো হাওয়ায় বাসার জানালায় গাছের ঝোপঝাড় প্রবেশ করার উপক্রম। ইফদিয়ার অতি কষ্টে জানালার দরজা আঁটকে দিল। বাতাসের প্রবলতায় শক্ত কাঁচের জানালায় ঠুং ঠুং শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে। শব্দের প্রতিধ্বনিতে ইফদিয়ার শঙ্কায় ভীতি রুপী হয়ে বিছানায় আঁটসাঁট ভাবে হাটু গেরে বসে পড়ে। শুকনো এক ঢোক গিলে রুমের এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। আকস্মিক এলইডি বাতি নিভে গেল। ভয়তা এবার বেশ জোরোসরো ভাবে লাগছে ইফদিয়ার। আঁধারে সে ভয় পায় এমনটা নয়! কিন্তু নাজমুল এর নোংরামি বদঅভ্যাস তার মনের গহীনে গেঁথে গেছে। যার ফলে আঁধার তিমিরে তার মনে হয় এ বুঝি নাজমুল এসে অশ্লীলতার ছোঁয়া দিবে!
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইফদিয়ার মনের ভীতি কাটানোর জন্যে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে অক্ষিদ্বয় নিমীলিত করে নিল। মানসিক শঙ্কার ভিত্তি দূর করতে মনে মনে দোয়া-দরূদ পাঠ করতে লাগে।
কেননা ভয় দূর করতে প্রথম কাজ হলো, আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)
অতিশিগ্রী ঘুম হানা দিল ইফদিয়ার অক্ষিদ্বয়ে। কাঁথা কাঁধ বরাবর টেনে গভীর নিদ্রামগ্ন হলো।
শ্রেয়িতা সদ্য গোসল সেরে রুম থেকে বেরিয়ে ছিল। তখন ইফদিয়ার গোঙ্গানি শুনে এক পলক দেখতে তার রুমের সামনে আসে। দরজা খোলা ছিল বলে সে আলগা করে দরজা ভিজিয়ে উঁকি মারে রুমে। তখনি তার ননদের ভীতি রুপ দেখে তার খারাপ লাগল। মেয়েটাকে প্রাণবন্ত খিলখিলানো হাসিতে বেশি ফুটন্ত নিষ্পাপ শিশু লাগে। সেখানে বর্তমানের মেয়েটিকে দেখলে মনে হবে তার জীবনে আতঙ্ক ছাড়া কিছু নেই। শ্রেয়িতা ঠোঁট কামড়ে কান্না সংযত করে নিল। আনমনে বলে উঠে।
‘যাবিয়াজ ভাইয়া প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসো। মেয়েটা নইতো হারিয়ে যাবে আতঙ্কের কালো আঁধারে।’
শ্রেয়িতা দরজাটা শক্তভাবে আঁটকে দিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। দু মগ কফি বানিয়ে রুমে প্রবেশ করে। তার নিদ্রা কেটে গেছে বিধায় বেলকনিতে বসে কফি খাবে ভেবে রাখল। এক মগ নিলেও চলতো। কিন্তু ইসমাইল উঠবে কিনা সন্দেহ আছে। তাও তার জন্যেও কফি বানিয়ে নিল। শরীরটা তার আধমরার মত দশা। কারণ মধ্যরাতের শুরুটা তার স্বামীর সঙ্গে রোমাঞ্চকর হয়ে ছিল। এখনো তার স্বামী নিদ্রামগ্ন হতে পারে! সেই শুধু জেগে ছিল বলে ফরজ গোসল করে হাঁটাহাঁটি করছে। যাতে কোনো ভাবে সময়টা পেরিয়ে যাক। ফলে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করবে। রুমের ভেতর কফির মগ নিয়ে প্রবেশ করে। ইসমাইল কে আয়নার সম্মুখে মাথা মুছতে দেখে বুঝতে সক্ষম হলো তার স্বামী সদ্য ফরজ গোসল সেরেছে। কিন্তু এত জলদি সজাগ পাবে ভাবেনি শ্রেয়িতা। ইসমাইল তার স্ত্রীকে দেখে দুষ্টু হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো। শ্রেয়িতার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলে,
‘পরী পুনরায় নেশা ধরিয়ে দিতে চাইছো তাই না!’
শ্রেয়িতা বিস্ময়ী দৃষ্টিতে অক্ষিদ্বয় গোল গোল করে ইসমাইল এর দিকে তাকায়। অবাক সহিত কণ্ঠে বলে,
‘মানে কবে নেশা ধরিয়েছি!’
‘নয় তো কি! আমার এনার্জি শেষ ভেবে কফি খাওয়াচ্ছো। যাতে পুনরায় তোমায় আদরে ভরিয়ে দেয়।’
শ্রেয়িতা ত্রপাট কেঁপে লাজুক কণ্ঠে বলে,
‘যান অসভ্য! আমি কি সাধে আপনার জন্যে কফি এনেছি।’
‘হুম নেশা করার জন্যে এনেছো বুঝি আমি সব।’
‘ধুর।’
শ্রেয়িতা ত্রপাট পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বেলকনিতে চলে আসে। ইসমাইল মৃদু হেসে দিল প্রিয়সীর প্রস্থান করায়। সেও কফির মগ নিয়ে বেলকনিতে আসে। তার পরীর সঙ্গরুপে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকায়। ডান হাতে কফির মগের চুমুক দিচ্ছে। বাঁ হাত খালি থাকায় হাঁশপাশ করছে ইসমাইল। যা শ্রেয়িতা আন্দাজ করতে পেরে স্মিত হেসে নিজেই ইসমাইল এর বাঁ হাতের বাহুডোরায় আবদ্ধ হলো। সেও পরীকে তার বাহুডোরায় পেয়ে মৃদুভাবে চেপে ধরে। শ্রেয়িতা আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
‘যাবিয়াজ ভাইয়াকে আমি বলে দিয়েছি।’
ইসমাইল শুনে ধোঁয়াটে কফির মগটা রেলিং এর উপর ভর দিয়ে রাখে। নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় শীতল অনুভূতি ব্যক্ত করে। তার নিশ্চুপতায় হতাশ হলো শ্রেয়িতা। কেনো না জানি তার খারাপ লাগায় নিক্ষেপ হলো! ইসমাইল ফোঁস করে ক্লান্তিময়ী শ্বাস ছেড়ে শ্রেয়িতার কপালে ঘন চুম্বন দিয়ে বলে,
‘আই বিলিভ তুমি যা করেছো ইফদিয়ার ভালোর জন্যে করেছো। কারণ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেই “ইতি দিন” এর কথা স্মরণ চারণিত হয়।’
‘হুম যাবিয়াজ ভাইয়া খুব কষ্ট পেয়ে ছিল। যা মুখ ফুটে না বললেও বুঝতে পেরে ছিলাম।’
‘পাবে না তো কি! বোনটা আমার কম অপদস্থ করেনি ছেলেটাকে। কিন্তু পরিশেষে দুজনের প্রণয়ের ঘাটতি দেখা দিল। যার মধ্যে কোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস বা আস্থায়। তাদের শুরুটা অপ্রাপ্তিময় হয়েছে তা কি ! আমার বিশ্বাস তাদের শেষটা প্রাপ্তি তৃপ্তিময়ী হবে। দুজনার সেই প্রণয়ঘটিত দগ্ধের যেন এবার সমাপ্তি ঘটুক। সেই প্রত্যাশা আস্থাপন করি।’
শ্রেয়িতা ইসমাইলকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘যাবিয়াজ ভাইয়ার উপর পূর্ণ আস্থা আছে। সে ঠিক তার অপ্সরীকে মানিয়ে নিবে। এখন অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের।’
‘হুম যাবিয়াজ আসবে কবে কিছু বলেছে!’
শ্রেয়িতা তৎক্ষণাৎ মুখ ফুলিয়ে না সূচক মাথা নাড়ে। এতে ইসমাইল মৃদু হেসে পরীর গাল টেনে তার হাত থেকে সন্তোপর্ণে কফির মগটা নিয়ে টেবিলে রাখে। সঙ্গেই কোলে উঠিয়ে নিল পরীকে। শ্রেয়িতা হকচকিয়ে তাকায় ইসমাইল এর মুখপানে। সে সরু দৃষ্টিতে সন্দেহমাখা মুখ করে ইসমাইলকে বলে,
‘আযান দিবে তাও বুঝি তোমার অসভ্যতামি করতে হবে!’
‘শোকরিয়া আদায় করো আযান দিবে তাই বাঁচলে। না হলে বুঝিয়ে দিতাম।’
শ্রেয়িতা হে হে করে হেসে উঠল। ইসমাইল তাকে বিছানার কাছে নামিয়ে দিয়ে নিজে গেল পোশাক পরিদান করতে। ফজরের আযানের সময় হয়ে গিয়েছে। দূর দূরান্তের মসজিদ হতে ইমাম সাহেবের খুতবা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মসজিদ হলো মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র।
জর্জ বুশ একটি মসজিদ ভ্রমণ করেছিলেন এবং তারপরেই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন- “ইসলাম একটি শান্তির জায়গা।”
– Wolf Blitzer
এলাকার লোকগণ ধীরেসুস্থে মসজিদ গমনের উদ্দেশ্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কিন্তু ইসমাইল খুব আগে প্রস্তুত হয়ে বাসা হতে প্রস্থান করে। তার মতে,
মসজিদে গমনকারীর প্রতিটি পদক্ষেপে নেকি অর্জন ও গুনাহ মার্জনা হতে থাকে। বাড়তে থাকে তার মর্যাদাও। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি নিজের ঘর থেকে পবিত্রতা অর্জন করে ফরজ নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরের দিকে যায়, তার একটি পদক্ষেপে একটি গুনাহ ক্ষমা করা হয় ও দ্বিতীয় পদক্ষেপে তার একটি মর্যাদা উন্নীত করা হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৫৩)
আগেভাগে মসজিদে গিয়ে নামাজের অপেক্ষায় থাকলে কবুল নামাজের সওয়াব হতে থাকে। কারণ নামাজের অপেক্ষায় বসে থাকা যেন নামাজেই নিমগ্ন থাকার শামিল। নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের জন্য ফেরেশতারাও মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন। (মুসলিম, হাদিস : ১৫৪০)। মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে সকাল-সন্ধ্যায় আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩১)
শ্রেয়িতা গেল ইফদিয়ারকে নামাজ পড়ার জন্যে ডাকতে। কিন্তু ভদ্র মেয়ের সে ডাকার পূর্বেই সজাগ হয়ে নামাজ পড়ার জন্যে ওযু করতে ওয়াশরুমে ঢুকেছে।
শ্রেয়িতা বের হতে নিলে ইফদিয়ার রুমে কারো অবয়ব এর শব্দ পেল। সে শ্রেয়িতা ভেবে মৃদু গলা উঁচিয়ে বলে,
‘ভাবী গরম পানির হিটারটা চালু করে দাও প্লিজ। পানি বেশ ঠান্ডা।’
শ্রেয়িতা মৃদু গলা উঁচিয়ে ‘ওকে দিছি’। গরম পানির হিটারের সুইচ এ প্রেস করে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিল। রুম থেকে প্রস্থান করে শ্বাশুড়ির রুমে যায়। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত একটি বিষয় লক্ষ করে সে। মিসেস জাবিয়া নিজের মুঠোফোনে হাত বুলাচ্ছেন। বারংবার ফোনের স্ক্রিনে কি যেন দেখছেন। তার জানামতে তার শ্বশুড় নেই যাবত ৫ বছর পেড়িয়ে গেছে। গত ৫ বছর পূর্বেই সদর নিষিদ্ধ পল্লীর রাস্তার মোড়ে আহসান সাহেবের লাশ উদ্ধার করে ছিলেন পুলিশেরা। কেমনে, কিভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করে ছিলেন। তার তদন্ত করলে রিপোর্ট মোতাবেক ধারণা করা গেল যে,
রাত বিরাতে প্রচুর মদ গেয়ে পতিতা মেয়েদের সঙ্গে চাহিদা মেটাতেন। হঠাৎ করে উনার হার্ট এ্যাটাক আসে। পতিতা পল্লী থেকে বের হওয়ার রাস্তায়। এসে ডুবে পরার মত রাস্তায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ছিলেন। সেই তখন মারা গিয়ে ছিলেন। ঐদিন কারো চোখে অশ্রু ছিল না। বরঞ্চ এক প্রকার প্রশান্তিপূর্ণ ঘৃণা ছিল। ইসমাইল উনার লাশ দেখে পুলিশকে বলে ছিলেন।
‘বাবা নামের কলঙ্ককে নিজ হাতে দাফন কার্য করার ভাগ্যটা নিতান্তই দুবির্ষহ। সভা পায় না এটি। তবুও মনুষ্যত্ব অন্তভার্গে বহমান হওয়ায় দাফন কার্যে স্পর্শ করব। আপনারা জানাযা পাঠের ব্যবস্থা করে নিন দোয়া করে।’
অফিসার্স মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তখন ইসমাইল,মিসেস জাবিয়া, ইফদিয়ার চেহারায় যে ভাব মূর্তি ফুটে ছিল। তা এমন যে বোঝা বিদায় করতে পারলেই যেন বাঁচি। ইফদিয়ার মনটা বোধ হয় খারাপ ছিল না। তবে খারাপ এর বিষয়টা মৃদু আচ করতে পেরে ছিল শ্রেয়িতা। যে ইফদিয়ার কোনো না কোনো দিক থেকে হলেও এক ভাবে ভালোবেসে ছিল তার বাবা নামক মানবকে। শ্বশুরের মৃত্যুর প্রভাব কারো উপর খুব একটা পড়েনি। তবে ইফদিয়ার গুমচুম ভাব নিয়ে থাকতো। ইসমাইল বুঝতে পেরে ইফদিয়ারকে তিয়ানার সঙ্গে থাকতে পাঠিয়ে ছিল। এতে মেয়েটাও বেশ খিলখিলে হয়ে উঠল। কারণ সঙ্গপূর্ণ বন্ধুত্বের আড্ডাই পারে বিষন্ন মনটাকে খিলখিলিয়ে তুলতে। শ্রেয়িতা দৃঢ় এক শ্বাস ফেলে শ্বাশুড়ির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা ঝেড়ে উঠল। মিসেস জাবিয়া থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি সবেমাত্র নামাজ শেষ করে কুরআন পাঠের জন্যে বিছানায় বসে ছিলেন। কি মনে করে যেন মৃদু দর্শনের জন্যে ফোনটা হাতে নিয়ে ছিলেন। আকস্মিক শ্রেয়িতা বউমাকে সামনে দেখে তিনি চমকে উঠলেন। শ্রেয়িতা আমতা আমতা করে বলে,
‘আমি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করেছি আম্মা!’
‘না না মামুনি আসো। কিছু বলতে এসেছিলে!’
‘জ্বি আম্মা এই নিন আপনার চা-বিস্কুট। আপনি রাতভর ঘুমাননি। হালকা নাস্তা করে ঘুমিয়ে পড়েন।’
‘হে মামুনি তুমি যাও। আর শোন মামুনি ইসমাইল কে মেডিক্যাল থেকে আসার সময় আমার জন্যে নাপা এক্সট্রা আনতে বলিও।’
শ্রেয়িতা ‘জ্বি আম্মা’ বলে রুম থেকে প্রস্থান করল।
৪৮.
এরফান ফেরদৌস মুখোমুখি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। কত বছর পর মুখোমুখি হলো তার হিসাব নেই। মান অভিমান এর পাহাড় যেন বন্ধুদলের মাঝেও সীমাবদ্ধ। দুজন মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো আনজান মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এমন ভাব নিচ্ছে তারা। ফেরদৌস পরিবেশটা শীতল পেয়ে ইমাগ্রেশনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
‘এত বছর পর হঠাৎ দেখা করতে ডাকলি কেন!’
‘আই থিংক তোর মাথার চেকআপ করিয়ে নেওয়া উচিৎ যাবিয়াজ থেকে। আজ সে আসছেও।’
ফেরদৌস মুখ ফুলানো অবস্থায় দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে ধরে বোকার মত মুচকি হাসি দিল। পুনরায় ঠেস মেরে এরফানকে বলে,
‘তিয়ানা আছে নাকি অন্যের বউ হয়ে গেল মামা!’
‘মামা ইয়ে যামানা হে হামারা। লারকিউ কি নেহি! উসে মিরচি লাগে তো মে কেয়া কারুন।’🐸
ফেরদৌস হুট করে হেসে জড়িয়ে ধরে এরফানকে। সেও আবেশে আগলে নিল বন্ধুকে। অজানা স্বল্প অভিমানের জাত যেন মিটে গেল। দুজনের অক্ষিদ্বয় ভিজে এলো। এত দিন পর যে বন্ধুর জড়িয়ে ধরার ছোঁয়া পেয়েছে। ফেরদৌস ঠাস করে এরফান এর পিঠে চাপ্পড় মেরে বলে,
‘এখনো পূর্বের ন্যায় আছিস।’
‘তুইও কই বদলাইলি সেই সিঙ্গেল রয়ে গেলি।’
‘মামা অপমান্স করিস না। 😒
তোর মত চালু নাকি রে যে মেয়েরে ডাকলেই হেতি ধেইধেই কইরা নাইচা আসবো।’
‘তা আর বলতে কি! তুইও তো চকলেট বয়।’
‘হুর মামা কিন্তু যাবিয়াজ কই প্ল্যান টেকঅফ করে ফেলেছে।’
ফেরদৌস মুখ তুলে এপাশ ওপাশ তাকায়। এরফানও সায় দিয়ে খুঁজতে থাকে। ইমাগ্রেশনে মানুষের ভীড় লেগেছে। হয়ত সেখানে আঁটকা পড়েছে ভেবে তারা অপেক্ষায় স্থীর দৃষ্টি রাখল সেখানে। দু’পাঁচেক মিনিট পর ‘হেই গাইস’ বলে কেউ চেঁচিয়ে উঠে।
এরফান ফেরদৌস উৎসাহী দৃষ্টিতে চেঁচানো শব্দের অনুসরণে দৃষ্টি রাখল। দু’চোখের উপর কালো সানগ্লাস এঁটে, গায়ে এপ্রোন এর মত হুডী পরিহিত একজন লোক হাত উঠিয়ে ‘হাই’ দেখাচ্ছে। এরফান-ফেরদৌস এর মুখ যেন হা হয়ে গেল। তারা আচ করতে পারছে না এ কোন যুবককে তারা দেখছে! যার বয়স হয়েছে কিনা বুঝাই যাচ্ছে না। হিতে বিপরীত গড়নের নতুন যুবককে দেখতে পাচ্ছে। ফেরদৌস বেক্কল এর মত প্রশ্ন করে এরফানকে।
‘মামা আমরা বুঝি বুড়া হয়ে গেলাম।’
‘কেন বে তোরা কি আমার আগেই বিয়েশাদি করে বাচ্চার বাপ হয়ে গেছিস!’
এরফান এর প্রতিত্তর করার পূর্বেই যাবিয়াজ সানগ্লাস খুলে এপ্রোনের উপরের পকেটে গুজে রেখে বলে উঠে। ফেরদৌস থতমত খেয়ে বলে,
‘হুর মামা ওসব পরে। পেহলে গালে লাগ যারে দোস্ত।’
যাবিয়াজ কে জড়িয়ে ধরার সঙ্গেই এরফানও ঠাস করে শক্ত করে চেপে ধরে ফেরদৌস আর যাবিয়াজকে। যাবিয়াজ বেচারা ধকল কেটে এসেছে। তার শরীরের উপর মনে হচ্ছে ডজনখানেক আম পেকে বসেছে। এরফানকে আমতা আমতা করে বলে,
‘দোস্ত গে হয়েছিস কবে মানুষের সামনেই বুঝি সব করবি!’
এরফান ঠুস করে ছেড়ে ক্রোধান্বিত মুখ করে তাকায় যাবিয়াজ এর দিকে। সে হাসার অভিনয় করে বলে,
‘না মানে তোরা দুজন অতীতের চেয়েও গুলুমুলু হয়েছিস। মাশাআল্লাহ নাজার না লাগে।’
ফেরদৌস ত্রপাট দৃষ্টিতে মাথা চুলকানোর ভান করে। পরক্ষণে গম্ভীর কণ্ঠে যাবিয়াজ এর হাত মুঠো করে ধরে বলে,
‘দোস্ত তুই ছাড়া সত্যি আড্ডাখানায় মরিচা ধরে গিয়েছে। তুই যদি না আসতে বলতি। তাহলে বোধ হয় কখনো এরফান এর সঙ্গে আমার মিটমাট হতো না। তুই যাওয়ার পর এক পর্যায় তর্কাতর্কির মাধ্যমে বন্ধুমহলে ভাঙ্গন ধরে যায়। মরিচা পড়েছে এ কয়েক বছরে।’
যাবিয়াজ আবেগী দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দুজনের কাঁধে দু হাত রেখে বলে,
‘শুধু মরিচা দূরীকরণের জন্যে নয় বরঞ্চ নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চলে এসেছি।’
ডেভিল স্মাইল যেন যাবিয়াজ এর ঠোঁটে স্পষ্ট দেখতে পেল তারা। অস্পষ্ট ব্যাপার হলেও এটুকু বুঝতে পেরেছে তারা যে, যাবিয়াজ কোনো তালপাকনা মাথার ভেতরে পাকাচ্ছে। যুবক ডেভিল হেসেই বলে,
‘গাইস গায়ের জোর আছে তো!’
এরফান হা হয়ে যায় যাবিয়াজ এর বাণীতে। ফেরদৌস খানিক আন্দাজ করেছে শুদ্ধতার ন্যায় বিবেক দ্বারা। যুবলীগ জুটেছে এমন ভান করে। যেন তারা গুপ্তচরের মত অট্টহাসিতে ফেটে উঠে। এরফান যাবিয়াজ এর কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘বছর পেড়ানোর পর পুনঃপুনঃ গায়ের জোর কতটুকু বুঝতে পারব। আমাদের হাড্ডিটাড্ডি শক্ত আছে কিনা পরীক্ষা করা লাগবে রে মামা কি বলিস!’
ফেরদৌস দু আঙুল ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে শিষ বাজিয়ে বলে,
‘এবভিউসলি রাইট!’
যাবিয়াজ ইশারা করে গাড়ির সন্নিকটে যাওয়ার। এরফান সযত্নে তার বন্ধুর ল্যাগেজ হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। তারা গাড়িতে বসে পড়লে; যাবিয়াজ এপ্রোনটা বিমূঢ়ভাবে উম্মুক্ত করে নিল শরীর থেকে। গম্ভীর কণ্ঠাবোধে আক্রোশময়ী দৃষ্টি শক্ত করে বলে,
‘যাবত ক’টা বছরে ইফস্পরীর উপর যে ঝড় বয়ছে। তার দশগুণ ভারি ঘূর্ণিঝড় যদি নাজমুলের উপর না বয়ছে। আমার নাম যাবিয়াজ মেশরাফ না!’
ফোন বের করে নাজমুল এর নাম্বারে কল দিল। তার কোলে বসে আছে শর্টফিট ড্রেসআপে মর্ডান এক রমণী। তার ডান হাতে মদের গ্লাস। সেটি নাজমুল এর ঠোঁটে লাগিয়ে পান করাচ্ছে। বাঁ হাত দিয়ে নাজমুল এর কাঁধ চেপে বসে আছে তারই সন্তোপর্ণে। নাজমুলও রমণীর শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে আর মদ গিলছে। হঠাৎ ফোন আসায় সে বিরক্তবোধক কণ্ঠে ‘চ’ উচ্চারণ করে কলটি রিসিভ করে। যাবিয়াজ সোজা কথায় বলে ফেলে।
‘আই উইল ডিস্টরই ইউর ডেস্টিনি।’
নাজমুল কি বলছে তা শুনার অপেক্ষা না করে যাবিয়াজ কট করে ফোন কেটে দিল।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৬
৪৯.
নায়েম উল্লাহ স্যার কে হঠাৎ চোখের সম্মুখে দেখে চমকে উঠল ইফদিয়ার। এতটা বছর পর তিনি কেনো তার সম্মুখে এসেছেন। তা উপলদ্ধি করতে পারছে না রমণী। তবে বার্ধক্যতার ফলে নায়েম স্যারকে বেশ বয়স্ক মনে হচ্ছে। তিনিও একজন মেয়েবাজ যুবক ছিলেন অতীতে। প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে কত বার যে স্পর্শ করার বাহানা খোঁজতেন। ভাবতেও যেন ইফদিয়ার মেজাজ খিটখিটে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে। নায়েম ইতস্ততঃ বোধক ভাব করে গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ইফদিয়ার। তবুও রমণী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ক্যাফ এর রিজার্ভ করা চেয়ারে বসে ফোন নিয়ে গেঁটে যাচ্ছে। নায়েম ইফদিয়ার সঙ্গে বসার আক্ষেপ ত্যাগ করে নম্র কণ্ঠে বলে,
‘ইফদিয়ার জানি আমি যা করেছি। তা বেশ ঘৃণাজনক। তবুও বলব অতীতের ঘটনা ভুলে মাফ করে দিও।’
ইফদিয়ার শুনে অবাক হলেও ভাবমূর্তিতে প্রকাশ করল না। নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় এটিটিউট ওয়ালা ভাব মুখভঙ্গিতে ফুটিয়ে রাখে। নায়েম প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে পুনরায় আকৃষ্টময়ী দৃষ্টিতে বলে,
‘আমার সম্পর্কের ভাতিজা তোমাকে পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করতে রাজি হলে উপকৃত হতাম।’
ইফদিয়ার হতবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নায়েম স্যার এর উপর। স্যার এর উক্ত বাণীর মমার্থ না বুঝতে পেরে রক্তিম ক্রোধময় কণ্ঠে প্রশ্নতুর করে উঠে।
‘মানে কি! আপনি কি আমার কাছে সম্বধন নিয়ে এসেছেন।’
‘ধরে নাও তাই বৈকি!’
‘তাহলে সেই মহামান্য ব্যক্তি কে!’
‘নিশ্চয় পরিচিত সে। এই এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল। সম্পর্কে আমি তার চাচা হয়।’
ইফদিয়ার আক্রোশে দাঁতে দাঁত চেপে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। সোজাসাপ্টা জবাবে ‘না’ বলে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে যেই প্রস্থান নিতে গেল। ওমনি নায়েম ইফদিয়ার হাত ধরে থামিয়ে দিল। রমণীর রাগের সীমা পেড়িয়ে গেল। এমনকি নায়েমও তার সীমানা লঙ্গন করে ফেলল। উচিৎ শিক্ষা দিতে ইফদিয়ার পিছু মোড়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল নায়েম এর গালে। ইতিমধ্যে তার কলিজায় যেন পানি এসে গেল। কত বছরের পুরুনো শোধবদ করতে পারল যেন সে! নায়েম কটমট দৃষ্টিতে ইফদিয়ার দিকে চেয়ে বলে,
‘তোর সাহস কেমনে হলো আমাকে চড় মারার!’
‘বেশ করেছি। তুই আর তোর ভাতিজা। ছেলে যেমন চাচাও তেমন। মেয়েবাজি তোদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। কি ভাবিস কি তুই! সম্মান দিতাম বলে মাথায় চেপে বসবি। শোন সময়টা অতীত নয় যে, তুই স্পর্শ করবি আর আমি মুখ বুজে সহ্য করে নেবো। দিজ ইজ প্রেজেন্ট টাইমিং। এই চড়টা মনে রাখিস! অতীতের কড়া প্রতিশোধ আদায় করে নিলাম। আরে আমি ভেবে ছিলাম তুই মরে গিয়েছিস। কিন্তু না তোর মত তোর ভাতিজাও জুটছে।
আরে আমি তো ভুলেই গেছি! তোরা যে এক গোয়ালের গরু। শোন ফাদার তোদের দেখলে জুতাপিঠা করতে বাধ্য হবো মাইন্ড ইট!’
নায়েম কে ব্যকুল ভাবে তোয়াক্কা না করে ইফদিয়ার সোজা ক্যাফ হতে বেরিয়ে গেল।
আজ সরকারি ছুটির দিকে ইফদিয়ার তিয়ানার সঙ্গে শপিংমল এর ক্যাফে দেখা করতে এসেছিল। তিয়ানাকে আসার পূর্বে বলে রেখেছিল। কিন্তু এসে তারই মেজাজ চটে গেল। অতীতের নায়েম স্যারকে অসৎ প্রস্তাবে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে সে। কিন্তু তিয়ানার সঙ্গে কথা আর হলো না। রাস্তার ফুটপাতে ভাবনা ঝেড়ে নিল মাথা থেকে ইফদিয়ার।
একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। এ মুহূর্তে তার বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। বুক চেপে দৃঢ় শ্বাস ফেলল। যতই বাঘের মুখে চিৎকার করুক না কেনো! পুরুষ মানুষের সম্মুখে নারীর শক্তি দুরুহ। আল্লাহর নাম স্মরণ করে ইফদিয়ার ব্যাগ থেকে ফোনটা হাতে নিল। ফোনের বাটন প্রেস করার সঙ্গেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে যাবিয়াজ এর গুমোট মুখশ্রী। সেটি দেখে ফিক করে হেসে ফেলে সে। অতীতে যাবিয়াজ এর মুখভঙ্গি ছিল গুমোট। আদৌ কি গুমোট প্রকৃতির রয়ে গেল মানুষটা! নাকি পরিবর্তনশীলতা তার মুখশ্রীতেও ফুটে উঠেছে। ইশ! না জানি কেমন জীবনযাত্রায় চলছে সে।
ইফদিয়ার আনমনে ভেবে রিকশার হ্যান্ডেল চেপে ধরে। মনের কৌঠায় একটি আশা রয়ে যায়।অতীতের প্রণয়ক্রীড়া দগ্ধ হলেও ভবিষ্যৎ স্মরণীয় হতে পারে প্রণয়কাব্যে।
বাসার প্রবেশদ্বারে পৌছে রিকশা ভাইকে ৩০টাকা দিয়ে নেমে পড়ে। বাসায় প্রবেশ করেই কোনো দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা রুমের দিকে হাঁটা ধরে। যাওয়ার পূর্বে মিটমিটি হাসির শব্দ অনুসরণ করে দেখে তার শ্রেয়িতা ভাবি মিটমিটিয়ে হাসছে। এবং তাকেই অনুধাবন করে চলেছে। ইফদিয়ার ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে। পুরু ড্রয়িং রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে শ্রেয়িতা ভাবী ছাড়া কেউ নেই। ইফদিয়ার ভাবল ভাইয়ের কথা ভেবে বোধ হয় ভাবী হাসছে! মনের ভ্রম ঝেড়ে রুমে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার পরিপাটি পোশাক পরিহিত অবস্থায় নামাজের নিয়ত করে দাঁড়িয়ে যায়।
নামাজ শেষ হতে না হতেই বাসার ইলেকট্রিসি চলে যায়। যেহেতু রুমের মধ্যে পর্দা টাঙানো ছিল বিধায় রুমটা আঁধারে নিমিত্ত হলো। ইফদিয়ার হিজাব খুলে সযত্নে হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে রাখল। পর্দায় হাত দেওয়ার পূর্বেই হঠাৎ কেউ তার হাত চেপে ধরে। হেঁচকা টেনে ধরে শক্ত কোমল দড়ি দ্বারা হাত বেঁধে দিল। ইফদিয়ার ভয়ে জমে গেল।
মুখ ফুসকে ‘ভাইয়া’ বলে চেঁচিয়ে উঠার প্রয়াস করে। পরন্তু সম্ভব হলো না। তাকে হরণ করার ন্যায় কেউ হাত-মুখ বেঁধে দিল। ক্লান্ত হয়নি অদ্ভুত অবয়বটি। সে পুনরায় ইফদিয়ার কে চেয়ারে বসিয়ে শরীরের উপরও দড়ির প্রয়োগ করে। ভয়ে নিমীলিত হওয়া চুক্ষদ্বয় যেন ভিজে এলো ইফদিয়ার। চুক্ষদ্বয় উম্মুক্ত করেও কোনো মানবের ছাঁয়াও দেখতে পাচ্ছে না। রুমটা গুমোটপূর্ণ অন্ধকারে ছড়িয়ে আছে। জানালাটা নিতান্ত ছোট হওয়ায় আলো ক্রমশ সরু ভাবে প্রবেশ করছে রুমের অন্তে। বর্তমানে রোদময় রশ্নির অংশখানিকও চোখের পলকে পড়ছে না। কান্না সংবরণ করার প্রয়াস করেও পারেনি ইফদিয়ার। ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটি চুপছে যাওয়া মুখ করে বাঁকা হাসি দিল। অস্পষ্ট কণ্ঠে গোঙানির শব্দ বের করে প্রশ্ন করে ইফদিয়ারকে।
‘তিমিরাচ্ছন্ন রুমে তোমার সঙ্গে অঘটন ঘটালে কেমন হবে!’
ইফদিয়ার কানে অবয়বের উক্ত বাণীটি কর্ণপাত হতেই কপাট কেঁপে উঠল। ভীতি-আতঙ্কতার মাত্রা তেজ হয়ে গেল তার মনে। শরীর প্রচন্ডবেগে কাঁপতে আরম্ভ করে ইফদিয়ার। ঠোঁটের উপর কাপড় বাঁধানো থাকায় কণ্ঠাবোধ প্রকাশ করতে পারছে না। অবয়ব বুঝেও না বুঝার ভান করে অন্য একটি চেয়ার টেনে ইফদিয়ার মুখোমুখি বসল। আলোর রশ্নি রুমের অন্তে না থাকার সুবিধার্থে অবয়ব রমণীর কোমল গালে হাতের ছোঁয়া দিল। বরফপিন্ডের মত জমে গেল রমণী। শরীরের কাঁপুনিতে যেন কেউ বরফ বসিয়ে শীতল করে দিয়েছে এমন মনে হচ্ছে ইফদিয়ার। অবয়ব নেশাক্ত দৃষ্টিকোণে রমণীর গালে ছোঁয়া দিতে থেকে বলে,
‘একটি কাগজে সই করতে হবে। তাহলেই ছাড়া পাবে!’
ইফদিয়ার অবয়ব এর পক্ষান্তরে জবাবদিহির ন্যায় গোঙানি দিল। মুখের বাঁধন খুলার জন্যেই মূলত গোঙানির শব্দ করছে সে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
অবয়বটি পুনঃপুনঃ ভাব নিয়ে কাপড়টা সরিয়ে দিল রমণীর ওষ্ঠজোড়ের মধ্য হতে। রমণী ঢোক গিলে শুকনো ওষ্ঠজোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিল। অবয়বকে দেখার প্রচেষ্টায় অক্ষিদ্বয় নিম্র সূক্ষ্ম করে নিল। তবে ব্যর্থ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যে মানবের রুপ দেখতে সক্ষম হলো না সে। অবয়ব এর প্রশ্নের প্রতিত্তরে জিজ্ঞেস করে।
‘কি কিসের কাগজ! কে আপনি অপরিচিত হয়ে আমার রুমে কি করছেন।’
অবয়ব বিরক্তবোধ কণ্ঠে বলে,
‘কত কথা বলো তুমি। আই জাস্ট আক্স ডু ইউ সাইন দ্যা পেপার অর নট! ইফ নট দেন আই উইল ফিনিশ ইউ।’
ইফদিয়ার কাছে অবয়ব এর কণ্ঠস্বর বেশখানিক পরিচিত মনে হলো। কিছুক্ষণ পূর্বেও অবয়ব এর কণ্ঠস্বরে খাপছাড়া ভাব ছিল। কিন্তু বর্তমানে গাম্ভীর্যভরা গলার স্বরের ধ্বনি শুনে অন্য এক পরিচিত যুবক এর সঙ্গে অবয়বকে মেলানোর চেষ্টা করে। বোকার মত চেহারা করে ইনোসেন্ট বাচ্চার ন্যায় বলে,
‘আপনাকে কি চিনি!’
অবয়ব এর চেহারার প্রতিক্রিয়া ইফদিয়ার দৃষ্টিগোচর হলো না। অথচ অবয়ব রমণীর চুক্ষগোচরে শয়তানি হাসি ঠোঁটের ফাঁকে বজায় রেখে বলে,
‘দ্বি প্রশ্নতুর হওয়া আমার পছন্দ নয়। এই কাগজে সই করে দাও।’
অবয়ব একটি কাগজ এগিয়ে দিল ইফদিয়ার মুখোমুখি। রশ্নিহীনতায় রমণী কাগজের মধ্যে থাকা শিরোনাম লক্ষ করতে পারছে না। এবং অবয়বকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহসও পাচ্ছে না। অস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ন্যায় পুনরায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইফদিয়ার। আহ্লাদী কণ্ঠে ‘ভাইয়া’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে লাগে। পরন্তু শব্দ রুম ভেদ করার পূর্বেই অবয়ব মুখ চেপে ধরে তার। রক্তিম চুক্ষদ্বয় দ্বারা ইফদিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। অত্যধিক রাগমিশ্রিত গলায় শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘গলায় হাত রেখেছি। চেঁচানোর চেষ্টা করলেই চেপে জিহ্বা বেরিয়ে আনব। জাষ্ট সাইন দ্যা পেপার।’
ইফদিয়ার পুনরাবৃত্তি দুঃসাহস করেনি। অবয়ব এর কথার প্রেক্ষিতে কাগজে বাঁধনরত ডান হাত দিয়ে কাগজে সই দিল। অবয়ব চট করে কাগজটি হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। দাঁত কেলানোর মত প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে সে। রমণীর দিকে স্থীর দৃষ্টি রেখে বলে,
‘বিয়ের সময় কন্যার ‘কবুল’ বলার কারণ কি জানো!’
ইফদিয়ার ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ কপালে ফেলে বলে,
‘তা যে বিয়ে করছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আমাকে করছেন কেন আজিব!’
‘আই সে জাস্ট গিভ মি আন্সার।’
ইফদিয়ার আক্রোশ জমাচ্ছে অবয়বের প্রতি। অজানা অপরিচিত মানব কিনা ইচ্ছাকৃতভাবে তার সঙ্গে খেলা খেলছে। এটা সে মানতে নারাজ। চেঁচিয়ে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা করেও যখন দেখল লাভ হচ্ছে না। তখন বাধ্য হয়েই নম্র কণ্ঠে বলে,
‘তিন কবুল বলতে হয়।’
‘দেন সে দ্যা থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডস।’
‘মানে কি আবোলতাবোল বকছেন!’
অবয়ব যেন আক্রোশে গাল চেপে ধরে ইফদিয়ার। রমণী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে অবয়ব এর চুক্ষদ্বয় দেখতে সক্ষম হলো। কেননা রুমের মধ্যে দরজার নিচ অংশ হতে খানিক রশ্নি প্রবেশ করছে। সেই সুবিধার্থে অবয়ব এর বাদামী চোখের মণি স্পষ্ট দৃষ্টিকটু হচ্ছে ইফদিয়ার চুক্ষে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
‘কি কি করছেন গা গাল ছাড় ছাড়ুন।’
‘কবুল বলো!’
‘মামার বাড়ির আবদার পাইছেন।’
‘দুধকলা খাওয়ানোর পূর্বে বলবে নাকি গলা চেপে মেরে ফেলব।’
‘মেরে ফেলুন তাও আপনাকে কবুল বলব না। আমি শুধু যাবিয়াজকেই কবুল বলব।’
অবয়ব শুনেছে কিনা বোধগম্য হলো না ইফদিয়ার। অবয়ব দিব্য একপাক্ষিক ধ্যানে রমণীর দিকে দৃষ্টিকোণ ফেলে রেখেছে। রমণী ভাবছে হয়ত তার কথার অাসর হয়েছে অবয়ব এর উপর। কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে ওষ্ঠে ওষ্ঠের দূরত্ব গুছিয়ে নিল অবয়ব। তার এহেন কান্ডে রমণীর গা চিমচিমাট পূর্ণ শীতলী কণায় পূর্ণ হলো। তার ওষ্ঠ অন্য কোনো পর পুরুষ এর ওষ্ঠে মিলেছে। তা ভাবতেই রমণীর ভীষণ কান্না পেল। মনের গহীন থেকে ‘যাবিয়াজ’ কে চিৎকার করে ডাকছে। কিন্তু অসভ্য অবয়ব যেন স্বাদতুর নেশায় ডুবেছে। যাবত কয়েক মিনিট পর রমণীর ওষ্ঠ ছেড়ে তার গলায় ওষ্ঠের ছোঁয়া দিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ল অবয়ব। ইফদিয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস এর সঞ্চালন দ্রুতবেগে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সে তার প্রাণআয়ু ফিরে পেল! অবয়ব পুনরায় নেশাক্ত কণ্ঠে বুদঁ হয়ে বলে,
‘কবুল বলে উদ্ধার করো নিজেকে। না হয় বাঘের খাঁচায় নিজেকে বিলিয়ে দাও।’
অবয়ব এর বাণীতে ইফদিয়ার ছলছল দৃষ্টিতে অস্পন্দিত কণ্ঠে বলে,
‘ভালোবাসি শুধু যাবিয়াজকে।’
অবয়ব দৃঢ় বিরক্তবোধ হয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পকেটের মধ্যে হাত গুঁজে রমণীর ছলছল কাতর মুখপানে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে,
‘কবুল বলো না হলে আমার এক ফোন কলে তোমার যাবিয়াজ এর প্রাণপাখি উড়ান দিবে।’
চমকিত দৃষ্টিতে শরীরের লোমহর্ষক কাটা দিয়ে দাঁড়ায় ইফদিয়ার। এতক্ষণ নিজেকে ধাতস্থ করে রাখলেও অবয়ব এর ভয়ানক প্রস্তাবে তার প্রিয় মানুষ এর ক্ষতি নিহিত। সে কেমনে নিজ স্বার্থে বিলিয়ে দিবে ‘যাবিয়াজ’ নামক মানুষটিকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। আনমনে তিন ‘কবুল’ বলে ফেলে ইফদিয়ার। তার ‘কবুল’ শব্দটি তিন বার পূর্ণ হতেই ইলেকট্রিসিটি ফিরে এলো। রুম আলোকিত হয়ে উঠে। তৎক্ষণাৎ ইফদিয়ার চুক্ষদ্বয় নিমীলিত করে নিল। আলোর আকস্মিক ঝিলিক চুক্ষদ্বয় সহ্য করতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ড বাদে পিটপিট করে চুক্ষদ্বয় উম্মুক্ত করতেই চুক্ষ চড়কগাছ হলো। তার সামনে তারই দিকে মুগ্ধ মোহনীয় দৃষ্টিকোণে চেয়ে আছে যাবিয়াজ। ইফদিয়ার অবাকের শীর্ষে পৌঁছার উপক্রম! আদৌ তার প্রিয় মানুষটি সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে! নাকি এটি কোনো প্রকার দৃষ্টিভ্রম। যাবিয়াজ ইফদিয়ার মনবল বুঝতে পেরে মোহময় কণ্ঠে ‘ইফস্পরী’ শব্দে রমণীর নাম উচ্চারণ করে। ইফদিয়ার কর্ণে নামটি কর্ণপাত হতেই তার ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গোলাকৃতির মত হা হয়ে যায়। তখনি কাশির শব্দ বের করে রুমে প্রবেশ করে ইসমাইল। রমণী নিজ ভাইকে হাস্যমুখশ্রীতে দেখে অবাক। সে এসে যাবিয়াজ এর কাঁধে হাত রেখে গর্ব সহিত মনোভূতি নিয়ে বলে,
‘কংগ্রেচ ব্রো।’
‘থ্যাংকস ব্রো। আজ থেকে আপনি শালাবাবু হয়ে গেলেন।’
‘নট এ টল।’
ইফদিয়ার বোকার মত চেয়ে আছে।
৫০.
কলেজ জীবনের গন্ডি পেড়িয়ে ওয়াসিবও ভার্সিটি পদে উত্তীর্ণ হয়েছে। বলতে গেলে এক পর্যায় ইফদিয়ার অতীত এর সঙ্গে জড়িত ছিল ‘ওয়াসিব’ নামক মানব। দু’বান্ধবী অবশ্য বোকা ছেলেটিকে চিনতো ক্লাস করার সুবিধার্থে।
কিন্তু কখনো আচ করতে পারিনি উক্ত মানবের হৃদয়ের এক তরফা ভালোবাসা। যা ছিল ইফদিয়ার মনের আড়ালে। ওয়াসিব কে তিয়ানা আর ইফদিয়ার মিলে বোকা বানিয়ে ছিল সিট বরাদ্দ রাখার জন্যে। আজও সেই কথা মনে পড়তেই মৃদু হেসে ফেলে তিয়ানা। সে ক্যাফে এসেছিল ইফদিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু নিয়তি! ইফদিয়ার পরিবর্তে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিল ওয়াসিবকে।
ক্যাফ এ এসে ইফদিয়ারকে পেল না। এতে একপক্ষে তার ক্রোধ হলেও ওয়াসিব এর সঙ্গে পুনরায় দেখা মিলার ফলে ভালো লাগা ছেয়ে গেল তিয়ানার মনে। ওয়াসিব সানগ্লাস খুলে সম্মুখে থাকা রমণীকে দেখে। সে ক্যাফে এসেছিল তার ভাইকে নিয়ে অফিস এর ডিল সম্পন্ন করতে। তার ভাই এখনো ক্যাফে আসেনি। সে বলেছিল আসবে! তারই অপেক্ষায় অপেক্ষারত ছিল। কিন্তু তিয়ানা কে দেখে পুরুনো বেলার কথা স্মরণে এলো। মৃদু হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলিয়ে তিয়ানাকে বসতে অনুরোধ করল।
তিয়ানা এসে বসে বলে,
‘হোয়াইট এ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ ইয়ার!’
‘সেম হেয়ার। তুই আসলি আর সে আসেনি!’
তিয়ানা ব্যাপার বুঝতে পেরে তার অপেক্ষার কথা খুলে বলে ওয়াসিবকে। সে শুনে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ বসে রইল। পরক্ষণে মৃদু আলাপে খোঁজখবর নিয়ে তিয়ানা উঠে পড়ে। ওয়াসিব ভাবান্তর মুখে তিয়ানাকে বলে,
‘ইফদিয়ার কি জীবনে কাউকে ভালোবেসে ছিল!’
তিয়ানা ওয়াসিব এর দিকে তাকায়। কথাটি শুনে মুচকি হাসি দিল। যার উত্তর ইতিবাচক বুঝায়। ওয়াসিব নিজের ভাষ্যমতে মনের ধারণায় গেঁথে রাখা ‘ইফদিয়ার’ নামক রমণীকে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। হয়ত সম্ভব না মুছা তবুও জীবনে মুভ অন না করে থেমে থাকলে ক্ষতিটা নিজেরই হবে। তিয়ানাকে ‘আল্লাহ হাফেজ’ জানিয়ে উঠে পড়ে। ফোনের মধ্যে ওরাইবকে মেসেজ পাঠিয়ে বলে বাহিরে অপেক্ষা করতে। ওরাইবকে ক্যাফকে প্রবেশ করতে দেখেই উক্ত মেসেজটি করে। তিয়ানা এক পলক ওয়াসিব এর যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিজেও রওনা দিল। উদ্দেশ্য বান্ধবীর বাসা।
ওরাইব এর সঙ্গে ওয়াসিব কবীর বাসায় চলে আসে। কবীর বাসা হঠাৎ ওয়াসিব কবীর এর নিজ বাবার বাসস্থানে। অফিস এর ডিল অফিসেই সম্পন্ন করে এসেছে তারা।
কিন্তু বাসায় এসে যে কান্ড ঘটবে সেটা কে জানতো!
ওরাইব চুপছে যাওয়া মুখ করে তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারই পাশে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াসিব শিষ বাজিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাসার মধ্যে কোনো সার্কাস চলছে। তাদের বাবা জনাব ওবায়দুল কবীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,
‘ওয়াসিব তোমাকে নিয়ে আর পারি না। এতো বদমেজাজী কাজ কেউ করে। আজ যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যেত।’
‘ওহ ড্যাড আমি কি আর জানতাম ছেলেটা আমার মুখের উপর সিগরেট ফুঁকবে। জানলে ওখানেই ঘুষি মেরে দিতাম।’
ওবায়দুল অসহায় দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান। এমনে সিগরেট খাওয়া ছেলেটাকে মেরে আধমরা করেছে। তার উপর ছেলে বলে কিনা আরেক ঘুষি মারবে। ওবায়দুল এর নাজেহাল চেহারা দেখে উনার স্ত্রীর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ছেলেরা দুষ্টু প্রকৃতির হয়েছে একদম নিজের বাবার মত। ওবায়দুল হাত দেখিয়ে বলে,
‘বাপ তুই গিয়া মাফ চেয়ে আস। না হলে তোর উপর কেস ঠুকবে।’
‘কি কেস ঠুকবে এতো সাহস তাহলে আমিও সিগরেট ফুঁকবার উপর ঘোর নন্দিত অপরাধের দ্বায়ে কেস মারব।’
ওরাইব অঢের কষ্টে নিজের হাসি চেপে ধরেছে। তার ভাইয়ের বলা যুক্তিগুলি যে হাস্যকর লাগছে।
ওয়াসিব এর কথা শুনে যেন মাথা ঘুরে উঠল ওবায়দুল সাহেব এর। কালই সবাইকে ইউকে যেতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে চান না কোনো গন্ডগোল হওয়ার। ওয়াসিব বাবার মনের কথা আন্দাজ করে ছেলেটার কাছে মাফ চেয়ে নিল। যে ক্ষতি করেছে তার পূরণ হিসেবে টাকা শোধ করে দিল। ওবায়দুল সাহেব দৃঢ় শ্বাস ফেলে বলে,
‘আসরের নামাজ এর পর রেডি হয়ে নিও তোমরা। ফ্লাইট কিন্তু ৭টায়।’
পরিবারের সদস্যগণ প্রস্তাব মেনে নিজ রুমে চলে যায়। ওরাইব তার ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকায়। সে তার ভাইয়ের মনের কথা জানে। সে তিয়ানাকে দেখে ছিল। বিধায় প্রশ্নের সম্মুখীন করে ভাইকে দ্বিধায় অপদস্থ করতে চায়নি। হয়ত নেতিবাচক জবাবের সম্মুখীন হয়েছে তার ভাইটা। যা ভাইয়ের চেহারা দেখে বুঝল ওরাইব। ঠোঁট কামড়ে আনমনে বলে,
‘ইউকে ফিরে যায়। হয়ত ভবিষ্যৎ সেখানে আবদ্ধ।’
ওয়াসিব সুট বুট পরিহিত রুপে বসে পড়ে সোফায়। ওরাইব কে এতক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সন্দেহ প্রবণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।
‘ওরাইব দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভাই! যা রেডি হয়ে নে।’
ওয়াসিব এর কণ্ঠস্বরে সম্মতি ফিরে পেল ওরাইব। তার ভাইয়ের চিন্তায় বিভোর ছিল। যে সময়ের গতিবেগে এর দিকে হুঁশ ছিল না তার। দ্বিমত পোষণ না করে সে সোজা রুমে চলে যায়। ওয়াসিব পুনরায় মাথা ঘামায় না।
_________
তিয়ানা ইফদিয়ার বাসায় এসে জটকা খেল। তাও আবার জটকা স্বরুপ বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন চলছে ইফদিয়ার বাসায়। একদিনে আয়োজন হচ্ছে তা হজম হচ্ছে না তার। শ্রেয়িতা থেকে জানতে পেরেছে ইফদিয়ার আর যাবিয়াজ এর কোর্ট ম্যারেজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে ঘরোয়াভাবে সম্পূর্ণ হলো তাদের বিবাহ। কাল বউভাত এর অনুষ্ঠান জাঁকজমকভাবে করে এলাকার লোকদের আমন্ত্রিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখল সকলে। ইফদিয়ার চুপছে যাওয়া মুখ করে বোরকা পরিহিত রুপে সোফায় বসে আছে। সাধারণভাবে রুমটা আলোকিত করে সাজানো হয়েছে। তথাপি ব্যবস্থা করে রেখেছিল ইসমাইল। তিয়ানাকে দেখে উচ্চস্বরে হাসি দিয়ে ডাকে সে। তিয়ানা রোবটের ন্যায় হেঁটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। ইফদিয়ার দিকে ভাবমূর্তি দৃষ্টিতে তাকায়। বেচারী ইফদিয়ার না পারছে সইতে, না পারছে হাঙ্গামা করতে। তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে, এ বিয়ে মানি না আমি। কিন্তু তার ভাইকে আনন্দিত দেখে সেই চিৎকার গলায় দমিয়ে নিল। তারই পাশে যাবিয়াজ মনমুগ্ধ মন্ত্রে তার ইফস্পরীর মুখপানে চেয়ে আছে। তার সম্মুখে জনবৃন্দ দাঁড়িয়ে আছে তার ব্যাপারে তোয়াক্কা না করে ইফস্পরীকেই দেখে চলেছে। তিয়ানা মৃদু কেশে যাবিয়াজ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতঃপর যাবিয়াজ স্বাভাবিক চুক্ষ নিক্ষেপ করে । তিয়ানা শয়তানি চাহনী এঁটে বলে,
‘জিজু মুনাফা দিয়ে দেন তাহলে দরজা ধরব না।’
ইফদিয়ার হতবম্ভ নয়নে তার বান্ধবীর দিকে তাকায়। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কটমট দৃষ্টিতে খেয়ে ফেলার মত মুখ করে নিল। তিয়ানা বোকা হাসি দিয়ে বলে,
‘আরে দোস্ত চেঁতিস কেন! তোর প্রিয় মানুষরে পেলি। বাসর করবি না বুঝি।’
কথাটি ইফদিয়ার কর্ণপাত হতেই কান গরম হয়ে গেল। ত্রপাট দৃষ্টিনত করে ফেলে। তখনি রবিউল সাহেব এর আগমন হলো। তিনি সচক্ষে লাঠি হীন হেঁটে আসলেন। ইফদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘আহ বউমা হয়ে হিরা রুপী মেয়ে পাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার নালায়েক বেটার সুবদ্ধি হলো বটে।’
‘উফ ড্যাড সম্মানের বিরিয়ানী বানিও না।’
রবিউল সাহেব মিষ্টি বিতরণ করলেন ছেলের বিয়ের সুবাদে। আনন্দদায়ক পরিবেশে সকলে মেঁতে উঠেছে। শুভ দিন উপলক্ষে ফিরে এসেছে বন্ধুমহলে সেই স্মৃতি টানাপড়নের বন্ধুগণ।
ইফদিয়ার চোখ ভরে এলো। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে ইসমাইল-শ্রেয়িতা-ইসরাইব(তাদের ছেলে) , এরফান-তিয়ানা , রুহিয়া ও তার হবু স্বামী এবং ফেরদৌস। যাবিয়াজ তার স্ত্রীর মনের অবস্থা লক্ষ করে দুষ্টু মনে হেসে প্রশ্ন করে।
‘ফিরে চাও কি পুরুনো সঙ্গের মিলনমেলা!’
ইফদিয়ার চমকিত দৃষ্টিতে তাকায় যাবিয়াজ এর পানে। সে যে তার মনের কথা উপলদ্ধি করবে ভাবতে পারিনি। তাদের বন্ধুগণের সঙ্গতা ফিরে পাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে যাবিয়াজকে ছলছল নয়নে জড়িয়ে ধরে। সকলে দৃষ্টি সমবেত করে মুচকি মুচকি হাসি দিতে আরম্ভ করে। ইফদিয়ার যুবককে ছেড়ে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে মেঁতে উঠল।
কিন্তু সীমাহীন খুশির অন্তে কেউ যে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সদ্য বিবাহিত দম্পতির দিকে চেয়ে আছে তা কারোর ধারণা নেই। সেই তীক্ষ্ম দৃষ্টির মালিক দূরান্তে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
‘তোদের দাম্পত্য জীবনের শেষ দেখে ছাড়ব।’
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৭
৫১.
যাবিয়াজকে নিজের বর রুপে দেখতে পাবে ভাবতেও যেন ইফদিয়ার বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। কত বছরের সাধনা ছিল প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার! যে মানুষটিকে বিনা স্বার্থে মন দিয়ে ফেলে ছিল কিশোরী বয়সে। আজ সে তারই অর্ধাঙ্গীনি। তৃপ্তিকর হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠে ইফদিয়ার। হাত কুঁচলাতে থেকে বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। এখনো রুমে আসেনি যাবিয়াজ। অথচ তার বন্ধুগণ তাকে রুমে এনে বসিয়ে গেল। শ্রেয়িতা ছিল কিন্তু পুনঃপুনঃ লজ্জায় ফেলছিল ইফদিয়ারকে। আকাশ পাতাল ত্রপাট পরিবেশ সৃষ্টিতে শ্রেয়িতা বুঁদ হয়ে আটার মত চিপকে ছিল ইফদিয়ার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগে শ্রেয়িতা রুম থেকে প্রস্থান করেছে। কেননা সে বেশ ভালো ভাবে লজ্জাবতী সদ্যবধূ কে পর্যবেক্ষণ করেছে। বিধায় দরজা আঁটকে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল। উদ্দেশ্য যাবিয়াজ এর থেকে পাওনা হাসিল করা। কম কষ্ট করেনি সে। পাঁচ বছরে ইফদিয়ার প্রতিটা কর্মকান্ড সম্পর্কে ক্ষণে ক্ষণে অবগত করেছে যাবিয়াজকে। এর বিশাল মুনাফা অাবশ্যিক বটে। শ্রেয়িতা খেয়াল করে কয়েকজন কাজিন এগিয়ে আসছে। তারা এসে শ্রেয়িতাকে ‘ভাবী’ সমব্ধন করে প্রশ্ন করে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
‘ভাবী আপনি কি দরজা ধরতে দাঁড়িয়ে আছেন!’
শ্রেয়িতা চোখ টিপ মারে। যার উত্তর ‘হ্যাঁ’। কাজিনগুলো ফিক করে হেসে ‘গুড কন্টিনিউ ভাবী’ বলে প্রস্থান করে। যাবিয়াজ এর অপেক্ষায় এখন দু মানব জেগে আছে। শ্রেয়িতা মুনাফা শোধের দ্বায়ে অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে ইফদিয়ার কাছে আজ যে তার বাসর রাত এ নিয়ে সে ভীষণ ভাবান্তর। কোনো ভাবেও হিসেব মেলাতে পারছে না। কেমনে হলো সব! তার ধারণা মোতাবেক যাবিয়াজ অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। এবং তার আসার সম্ভাবনা নিতান্তই দুরুহ ছিল। তাহলে আকস্মিক আসার কারণ!
পরক্ষণে কি ভেবে যেন চট করে দাঁড়িয়ে গেল বিছানা হতে। মাথায় এক হাত চেপে তার ঠোঁট আপনাপনি হা হয়ে গেল। মনের মধ্যে উদয় হলো সদ্য জাগ্রত একটি নতুন প্রশ্ন। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে।
‘আব্বা কি চোখে দেখতে পারছেন! উনি লাঠিহীন হাঁটলেন কি করে। হায় আল্লাহ! আমি আনন্দে এতটা মগ্ন ছিলাম। আব্বার দিকে ধ্যানই দিলাম না। যাবিয়াজ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।’
শ্রেয়িতা হাতে পরিহিত ঘড়ির দিকে সময় দেখে নিল। রাতের ১০টা বেজেছে। ঘড়ির কাটা সশব্দে নিজ গতিতে আগাচ্ছে। আনমনে ঠোঁট কামড়ে বলে উঠে।
‘ধুর ছাতা যাবিয়াজকে আনা হবে ১২টায়। এখন থেকে দাঁড়িয়ে পায়ের ব্যথা তুলছি কেন আমি!’
শ্রেয়িতা কটমট ক্রোধ প্রকাশ করল নিজের উপর। স্বয়ংপূর্ণ হয়ে যাবিয়াজ এর দরজার সামনে থেকে সরে গেল। বর্তমানে পরিবারের সকলে অবস্থান করছে যাবিয়াজ এর বাড়িতে। যা দেখতে সৌন্দর্যের রঙিনে রাঙানো। যাবিয়াজ কোর্ট ম্যারেজ করলেও রবিউল সাহেব বাসাকে সাজিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। নিজ ছেলের চেহারার দিকে তাকান তিনি। ইফদিয়ার কে ঘোমটা দিয়ে বহু পূর্বেই যাবিয়াজ এর রুমে নিয়ে গিয়েছে তার বন্ধুগণ। এ মুহুর্তে বাসায় ড্রয়িং রুমে যাবিয়াজ সহ বুজূর্গগণ বসে আছেন। কিন্তু যাবিয়াজ এর কাছে মুহূর্তটা বিরক্তময়ী লাগছে। সে ফোঁস করে তপ্ত এক শ্বাস ফেলে অন্তরালে। এরফান তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবিয়াজ এর কান বরাবর ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘বউরে ছাড়া বুঝি তর সইছে না!’
‘হারামী কত বছর পর বউ বানাইছি খবর আছে। তুই ছেড়া বহু আগেই বিড়াল মেরে ফেলেছিস তাই বুঝি আমাকে চেঁতাস।’
এরফান শয়তানি হাসি দিয়ে সরু দৃষ্টিতে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তা আর বলতে কি! আমার বিয়ে হয়ে বেঁচে গেছি। না হলে তোদের পঁচানো সহ্য করতে হতো।’
যাবিয়াজ কটমট দৃষ্টিতে এক পলক এরফান এর দিকে তাকায়। তার চাহনী দেখে এরফান মুখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সে জানে তার বন্ধুর মারাত্মক চাহনীর অর্থ হলো ‘একবার তোকে একা পাই বুঝাব কত ধানে কত মই।’
পরন্তু সময়টা তার বন্ধুকে জ্বালানোর ফলে সেও সময়টা বিফলে যেতে দিতে চায় না। যাবিয়াজকে আঁটকে রেখেছে বুজূর্গদের সঙ্গে। এমনকি তার ডানে বামে দুপাশেই চাপাচাপী করে বসিয়ে রাখা হয়েছে রবিউল সাহেব আর জাব্বার সাহেবকে। যাবিয়াজ এর ইচ্ছে করছে সোজা রুমে চলে যেতে। তবুও ভদ্রতার কাতিরে পা-কে আঁটকা রেখেছে। সে চোখ দিকে কাঙ্ক্ষিত বোনকে খুঁজছে। যাতে তাকে এই বিরক্তির আপদ্গ্রস্ত সময় থেকে বের করতে সফল হোক!
ইসমাইল তার পরিচিত ডাক্তার কলিগদের সঙ্গে কথা বলছে। তার পাশে এসে মুখ ফুলানো দশায় দাঁড়িয়ে যায় শ্রেয়িতা। সে আপাদমস্তক বোরকা পরে ঢেকে রেখেছে। যেহেতু এখন সে মুসলিম ঘরের বউ হয়। সেহেতু তার উচিৎ স্বামীর আমানত রক্ষার্থে নিজেকে পর্দায় আবৃত রাখা। ইসমাইল অবশ্য আদরী বাণীতে আদেশ করেছিল বোরকা পরতে। এ নিয়ে শ্রেয়িতার আক্ষেপ নেই। সে খুশিমনে রাজি। তাই তো যাবিয়াজ এর বাসায় বোরকা পরে এসেছে। ইসমাইল তার স্ত্রীর মুখভঙ্গি উদাসীন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
নিজ কলিগদের কাছে ‘এক্সকিউজ মি প্লিজ’ বলে দূর জায়গায় সরে আসে স্ত্রীর বাহু টেনে। শ্রেয়িতার নেকাপের উপর গালে হাত রেখে আদুরী কণ্ঠে বলে,
‘বউর বুঝি ক্লান্ত লাগছে!’
শ্রেয়িতা চট করে উত্তর দিল ‘না না’। শুনে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ইসমাইল পুনরায় শুধায়।
‘তাহলে কি হয়েছে উদ্বাস কেন লাগছে তোমায়!’
‘আসলে ১২টা না বাজা অব্দি যাবিয়াজ এর কাছে মুনাফা নিতে পারব না।’
শুনে হা করে তাকায় ইসমাইল। তার বিয়েতেও এই মেয়েটা মুনাফা নেওয়ার ফন্দিবাজী করে ছিল। এতে বেচারা ইসমাইল কে দেনমোহরের স্বাক্ষরিত করে দিতে হয়েছিল। এটি তার বিয়ের সময় কাবিননামায় আবশ্যকীয় ছিল। সেই কাবিননামায় দেনমোহর এর কাগজপত্র সযত্নে নিজ স্ত্রীর হাতে সর্পে দিয়ে ছিল সে। পক্ষান্তরে তাদের জীবনের পথযাত্রা আরম্ভ হলো নতুন দিগন্ত নিয়ে। তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা রুপেই এলো ইসরাইব।
ইসমাইল কে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে শ্রেয়িতা বোকার মত হাসি দিয়ে চুপিসারে চলে গেল। অথচ ইসমাইল ঘোর কেটে শ্রেয়িতার যাওয়া দেখে মুচকি হাসি দিল।
ঠিক রাতের ১২টা বেজে গেল। মধ্যরাত এর গতি আরম্ভ হয়েছে। ইফদিয়ার হৃদপিন্ডে ধড়াস ধড়াস করে মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতির উদয় হলো। কিছুক্ষণ পূর্বেই শ্রেয়িতা রাতের খাবার খাওয়ে গেল। এখন তার বর অর্থাৎ যাবিয়াজ এর আগমনের সময়। ইফদিয়ার দরজার সামনে পায়চারী করছে। তাৎক্ষণিক সময়টা চলে এলো। দরজার বর্হিভাগ হতে হৈহুল্লোড় এর প্রতিধ্বনি আলোড়িত হলো। ইফদিয়ার বুঝতে বাকি রইল না যে যাবিয়াজ এর আগমন ঘটতে চলেছে। রমণী ঠোঁট কামড়ে তড়িঘড়ি বিছানার মাঝে বসে পড়ল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আগমনের পথ গণনা করছে। হাতজোড়া একত্রিত করে কুঁচলে যাচ্ছে। কটকট শব্দে দরজা খুলার পর ইফদিয়ার ঘোমটার আড়াল হতে দেখার প্রতিক্রিয়া করে। সে বোরকা খুলে ফেলেছে বহু আগে। এখন সদ্য জর্জেট শাড়িতে বধূ সেজে বসে আছে। তার পরণের জর্জেট শাড়ির আঁচলের ঘোমটা থেকে মানুষটিকে দেখার প্রয়াস করে চলেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে সক্ষম হলো। সদ্য বিছানা হতে পা ফেলে যাবিয়াজ এর মুখোমুখি এসে পা ধরতে নিল। তৎক্ষণাৎ যুবক রমণীর কাঁধ চেপে ধরে থামিয়ে দিল। পরক্ষণে ইফদিয়ার কলিজা শুকিয়ে গেল। বছরক্ষণের জমানো অভিমানী মনটা বড্ড আনচান করে উঠল। যাবিয়াজ রমণীর মাথা বুক বরাবর চেপে ধরে আদুরী গলায় বলে,
‘অভিমান হচ্ছে কি!’
ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল ইফদিয়ার যাবিয়াজকে। রমণীর ঘোমটা সরে গেল যুবকের পাঞ্জাবীর হাতার বোতামে লেগে। ইফদিয়ার মুখটা অন্যদিক ফিরিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,
‘ভুল করেছি বিধায় মাফ করে ফিরে আসতে পারতেন। তা নয় বিপরীতে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দরদ উতলে পড়ছে।’
যাবিয়াজ এর কর্ণধারে ইফদিয়ার অভিমানী ব্যক্ত পৌঁছিয়েছে কিনা জানা নেই রমণীর। কিন্তু যুবকের ভাবমূর্তিতে দুষ্টুমি লক্ষ করে ইতস্তত বোধ করছে ইফদিয়ার। ভ্রু বাঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,
‘অসভ্য দৃ দৃষ্টি নামান। ওম ওমনে তাক তাকিয়ে আছেন কেন!’
যাবিয়াজ দুহাত বুকের উপর গুঁজে বলে,
‘তোঁতলানো কবে থেকে শুরু করলে!’
চটে গিয়ে ইফদিয়ার বলে,
‘আপনার কি!’
যাবিয়াজ এর কাছে তার বিবাহিত বউ কে অত্যন্ত অর্ধাঙ্গীনি পূর্ণ লাগছে। কেননা তার বউটা অভিমান করেছে শুদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু বউ এর ঠোঁট এর অন্তরাল হতে বেরিয়ে আসা কণ্ঠধারে ‘আপনি’ ডাক শুনতে বেশ লাগছে তার। সে এক দু কদম পেড়িয়ে এগিয়ে গেল ইফদিয়ার দিকে। রমণী যুবকের এগিয়ে আসা দেখে ঘোরের ন্যায় পিছিয়ে যেতে লাগে। যাবিয়াজ এর দৃষ্টিকোণে নেশা মোহের ঘুরপেঁচ চলছে। এক প্রকার বিমোহিত করার মত সেই দৃষ্টি। যাতে আকৃষ্ট হয়ে ইফদিয়ার নিজেকে সর্পে দিতে বাধ্য। ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিল রমণী। অস্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
‘প্লিজ সম পরিমাণ অভিমানে উদয় হওয়া প্রশ্নের জবাবদিহিতা চাই।’
থেমে গেল যাবিয়াজ এর কদম। শান্ত দৃষ্টিগোচরে ইফদিয়ার প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্যে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। অপ্রকট শ্বাস নিয়ে ইফদিয়ার প্রশ্নের জবাবে বলতে আরম্ভ করে।
‘তোমার উপর স্বল্প পরিমাণও অভিযোগ নেই ইফস্পরী। তুমি আমায় যোগ্যবাদী হয়ে শাস্তি দিয়েছো। হে আমি মানি বিদেশ পাড়ি জমানোর আগে রাগ হয়েছিল তোমার উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো এক তুমি বিহীন আমি মানুষটা নিরব গম্ভীরে পুষকৃত হলাম। ড্যাড কে চোখের অপারেশন করাতে গিয়ে ছিলাম মূলত অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ডক্টর লিও. ড্যাডের অপারেশনে পারদর্শী ছিলেন। সেই মেডিক্যাল এ ড্যাড এর জন্যে আই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করানোর ব্যবস্থা নিলাম। মৃত্যু একজন রোগীর সঙ্গে ড্যাডের ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ হওয়ায় তার চোখজোড়া নেওয়ার উদ্যোগ নিলাম। রোগীর পরিবার কে পরমার্শ আর ড্যাড এর অচলাবস্থার কথা জানায়। আল্লাহর রহমতে রোগীর পরিবারের সদস্যগণ হৃদয়পূর্ণ হওয়ায় আমার প্রস্তাবে নিকুচি করেন নি। স্বাদরে মৃত্যু রোগীর চোখজোড়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে অপারেশন এর ব্যবস্থা নেওয়া হলো। পুরু তিনদিন লাগে ড্যাড এর সুস্থতা অর্জন করতে। কেননা ড্যাডের বয়স অনুযায়ী অপারেশন করা
ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ড্যাড নিজের জীবনে অন্ধত্ব বহন করেন কঠিন এক পরিস্থিতির সম্মুখীনে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ড্যাড সুস্থ হলেন তবে শরীরটা বেকায়দায় দূর্বলতা অনুভব করলেন। বাসায় এনে ড্যাড কে প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখার জন্যে নার্স এনেছিলাম তিনজন। ড্যাড এর বিলোপ অসুস্থতার জন্যে বিদেশে এলেও যেন কোনো না কোনো দিকে তোমার শূন্যতা বড্ড পুড়াতো। তবুও তোমার করা কর্মে আমি ঠিক শাস্তি দেওয়ার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করি। অস্ট্রেলিয়ায় নিজের স্টাডি কমপ্লিট করি। ডক্টরি পেশায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলাম। কিন্তু আমি ডক্টর হলাম বায়োজেনেটিক প্রোগ্রামের সুবিধার্থে। ভিন্ন জেনেটিক সদস্যপট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার অভিক্ষতা নিয়ে অধ্যক্ষ হতে সফল হলাম। ভিন্ন ভিন্ন শহরে আমার প্রোগ্রামিং বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশ এর খবরাখবরে এর পর্যাপ্ত কথা ছড়িয়ে আছে। তবুও তৃপ্তি মিলল না। অন্যথায় আমি বিভাগীয় অনুষদে ছিলাম প্রকৌশল প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোগে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম প্রযুক্তিবিদ্যার আলোকে ভার্চুয়াল এ কর্মঠ হবো। যেই ভাবা সেই কাজ আরম্ভ করে দিলাম। ভার্চুয়ালি প্রযুক্তিসেবা প্রদানের আয়ত্তে ছিলাম আমি। দু’দিকে নজরদারি ছিল আমার। তাই বলে এই ভেবো না তোমার খোঁজ রাখিনী। বরঞ্চ আমার তৃতীয় চুক্ষ সবর্দা তোমার উপর আঁটকে ছিল। কোথায় কি হচ্ছে কে তোমায় উ্যক্ত করেছে। পই পই হিসাব আমার মাইন্ডব্লোয়িং ব্রেনে সেভ করে রেখেছি। তবে এই মুহূর্তে ব্রেনের মধ্যে প্রেম নামক ফাইল আপলোড হওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সো আমি আর দেরি করতে চায় না। পুরু পাঁচটা বছর কম কষ্ট দাও নি। এবার পুষে নিবো আদরে আদরে গলিয়ে দিবো তোমার অভিমানী মনটা।’
কথার ছলে ইফদিয়ার কে কোলে উঠিয়ে নিল যাবিয়াজ। বেচারীর বিষয়টা বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই যুবকের নেশাক্ত মোহে ভীতি রুপ ধারণ করল সে। যাবিয়াজ কে শেষ একটি প্রশ্ন করে মনকে শান্ত্বনা দিতে চাইল ইফদিয়ার। আমতা আমতা করে বলে,
‘আ আরেকটি প্র প্রশ্ন!’
যাবিয়াজ ভ্রু কিঞ্চিৎ নেড়ে তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,
‘বাসর করার থেকে বাঁচবে না মনে রেখো। অনলি এক সেকেন্ড আক্স ফাস্ট।’
‘আপনার আসার সম্ভাবনা ছিল না। নয়বা আসলেন যে!’
যাবিয়াজ রমণীর লাল রঙে রাঙা ঠোঁটযুগলে দৃষ্টিকোণ ফেলে বাঁকা হেসে বলে,
‘বউকে ছাড়া সইছিল না আর। যদি তোমার কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। তবে মনের তৃপ্তি মিলতো না। শুধু মোহ আবেগ সৃষ্টি হওয়ায় তোমায় কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হতো। যেটি নিতান্ত নেতিবাচক বলে আমি মনে করি।ফলে পাঁচটা বছর প্রবীর সাধনার পর তোমায় পরিপূর্ণ যুবতী রুপে গ্রহণ করলাম। ভেবে ছিলাম তিনবছর পর আসব। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলে পাঁচ বছর পর এলাম। কিশোর জীবনটা সকলের কাছে আবেগীয় হয়। তখন প্রেম করে অসৎ পথ বেছে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠে। হ্যা আমি চাইলেই তোমায় বিয়ে করে নিজের ব্যক্তিগত মনোসম্পত্তি বানিয়ে নিতাম। তবে চায়নি মূলত তোমার পড়াশুনার ঘাটতি পূরণে।
সংসার এর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটাকে কখনো ছোয়া কিংবা ধরা যায় না, তাকে শুধুই হৃদয় দ্বারা অনুভব করা যায়।
সুতরাং আমার সিদ্ধান্ত অটুট বলে মনে করি।চোখের বিনিময়ে চোখ এর এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পুরো সংসারকেই অন্ধ হয়ে থাকতে হয়।’
যাবিয়াজ দম আঁটকানোর ন্যায় তৃপ্তি সহকারে শ্বাস ছাড়ে। এতদিনের জমাটবদ্ধ হওয়া গুপ্ত কথন ব্যক্ত করতে পেরেছে সে প্রেয়সীর নিকট। ইফদিয়ার গম্ভীর ভঙ্গিমায় যাবিয়াজ এর বুকে মাথা দিয়ে রইল। কোনো কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে যুবক অধর্য্য সহিত কণ্ঠে বলে,
‘বোবা হয়ে গেলা নাকি!’
কিন্তু যুবক এর ধর্য্যহীনতাকে বিচ্ছেদ টেনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইফদিয়ার। এখনো যাবিয়াজ এর কোলে অবস্থান করছে রমণী। ফুঁপিয়ে ক্রন্দনরত রমণীকে আঁটকাল না যুবক। কাঁদতে দিল প্রিয় ইফস্পরীকে। কম কষ্ট পায়নি। বছরখানিক পেড়িয়ে সাধনার সুফলতা পেয়েছে দু’মানবের অন্তরস্থে। ইফদিয়ার কান্নারত দশায় হিঁচকি তুলে ফুঁপানো কণ্ঠে বলে,
‘আগলে নিন আমায়। যেন ছেড়ে যাওয়ার কোনো পন্থা না থাকে। গুছিয়ে দিন তুমি-আমি নামক মধ্যকার ভিত্তি।’
ক্রন্দনরত রমণীর বিমোহিত কণ্ঠধারাই যথেষ্ঠ হলো যুবকের হৃদয়ে স্পর্শীকাতর ঝংকার তুলতে।
যাবিয়াজ মুচকি হেসে ইফস্পরীর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘প্রথমে আসো নামাজ কায়েম করে ফেলি। তাহলেই শুভ কাজ অত্যধিক সুখকর হবে।’
ইফদিয়ার লাজুক দৃষ্টিতে নামানোর জন্যে ইশারা করে। যুবক তার ইফস্পরীকে ওয়াশরুমের সামনে নামিয়ে দিল। রমণী ওযু করে এসে দেখে যাবিয়াজ পক্ষান্তরে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জায়নামাজে। সেও মুচকিও হেসে যুবকের সঙ্গে নামাজ কায়েম করে উঠে দাঁড়ায়। ধীরস্থিরে পা ফেলবে তার পূর্বেই পুনরায় কোলে উঠিয়ে নিল যাবিয়াজ। এবার যেন ইফদিয়ার নিরব দৃষ্টিতে মোহনীয় ভাব প্রকাশ করে। যাতে মুগ্ধ নেশাতুর হয়ে ডুবে যেতে যাবিয়াজ এগিয়ে গেল পরিপাটি বিছানায়। ইফদিয়ারকে বালিশের মাঝে শুয়ে দিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
‘তোমার সর্বান্তে আমার অধিকার পূর্ণতা পাবে। তোমার প্রতিটা ক্ষতচিহ্নে লাগাম দেবো আমি। সেই ক্ষত সৃষ্টিকারী মানবের শরীরে ক্ষতের তর্কমা লাগিয়ে দিব।’
ইফদিয়ার ভ্রু কুঁচকে যাবিয়াজ এর শেষাক্ত উক্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে উদ্যোগ নিতে চাইল। তবে সেটা যাবিয়াজ সফল হতে দিল না। সে নিয়ে গেল তার ইফস্পরী কে সুখানুভূতির রাজ্যে। অন্দরের আদিম খেলায় মগ্ন হলো দুটো প্রাণপাখি।
৫২.
এরফান সোফায় অর্ধক্লান্ত অবস্থায় গা হেলিয়ে দিল। তার বন্ধুর প্রিয় বন্ধু হওয়ায় বিয়ের সরঞ্জাম আয়োজনের তদারকি করছে সে। কাল বউভাত হওয়ায় সকল সদস্যগণের মাঝে তীব্র আনন্দের উত্তেজনা। ইসমাইল এর খুশি দেখে কে!
তার বোন যে খুব স্বাদরে সৎ ধনাঢ্য এক পরিবারের সদস্য হয়েছে। তা বিশ্বাস করতে যেন তার মন বড্ড বাঁধছে তাকে। পরন্তু স্বপ্ন ভেবে ভুল করলে তো চলবে না।
শ্রেয়িতার ডাকে ইসমাইল এর ধ্যান ভাঙ্গে। ঘুম ঘুম চেহারা নিয়ে ঢুলছে সে। সবার অবস্থা প্রায় ঘুমন্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসমাইল শ্রেয়িতাকে নিজের বাহুডোরায় আঁটকে রেখে এরফান-তিয়ানা-রুহিয়া আর তার হবু স্বামীকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে রুমে পাঠিয়ে দিল। রবিউল সাহেব যখন দেখলেন পরিবেশটা নির্জন হলো। তিনি নিঃশব্দে হেঁটে ড্রয়িং রুমের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইসমাইল শ্রেয়িতা কে কোলে করে শুয়ে দিল। তার ঘুমকাতুরে বউ শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। বউ এর বুক অব্দি কাঁথা টেনে রুম থেকে প্রস্থান নিল ইসমাইল।
যেহেতু রবিউল সাহেব এর প্রচন্ড আবদার করে ছিলেন ইসমাইল এর পরিবার কে বাসায় না ফিরতে। একদম যেন বউভাত এর অনুষ্ঠান এর পর যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। সেহেতু সম্মানীয় কণ্ঠে ‘জ্বী সমস্যা নেই’ বলে জবাব দিয়ে ছিল ইসমাইল। ড্রয়িং রুমে এক পলক ফেলে প্রস্থান নিতে গেলে ইসমাইল এর নজর পড়ে জানালার ধারে। সেখানে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন রবিউল সাহেব। এখন রাতের ২টা বেজে চলেছে। তবুও তিনি সজাগ রইলেন। ব্যাপারটা মন্দ লাগল ইসমাইল এর। সে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে গেল রবিউল সাহেব এর পাশে। তিনি আচ করতে পারলেন যে মানুষটা কে হতে পারে! মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেন।
‘তোমরা এসেছ তোমাদের বাসার মুরব্বিগণ আসেননি কেনো!’
ইসমাইল এর মুখখানি কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে ইতস্ততঃ ময়ী কণ্ঠে বলে,
‘আঙ্কেল আম্মু কয়েকদিনের জন্যে চাঁদপুরে গিয়েছেন। সেখানে আম্মুর বিঘা জমি ছিল। সেগুলোর মধ্যে বাড়ির খনন এর কাজ আরম্ভ করতে।’
রবিউল সাহেব শুনে বলেন,
‘ওহ কবে আসবেন তিনি!’
‘দু’সপ্তাহখানিক লাগতে পারে।’
‘কবে গেলেন!’
‘এইতো আঙ্কেল ৫ দিন পূর্ণ হলো গিয়েছেন। অথচ আজকে ইফদিয়ার বিয়ে সেটাও জানতে পারেনি। আম্মুর ফোন বন্ধ ছিল। তথাপি কাজে আটঁকা পড়েছেন মনে হলো।’
রবিউল সাহেব ফোঁস করে নিশ্চুপে শ্বাস ছাড়লেন। ইসমাইল বারতি কথা প্রত্যাখ্যান করে আঙ্কেলকে ঘুমানোর পরামর্শ দিলেন। তিনিও নাকোচ করলেন না রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
_______
সকাল ৯টা…
প্রসিদ্ধ শীতল হাওয়া রুমের অন্তে প্রবেশ করছে। পর্দা শীতল উম্মুক্ত হাওয়াকে দমাতে না পেড়ে নড়েচড়ে উঠছে। দীর্ঘ প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে যাবিয়াজ ঘুমন্ত চোখজোড়া স্থীরভাবে উম্মুক্ত করে। বুকের উপর কারো গরম নিঃশ্বাস পেয়ে নিষ্পলক চাহনী নিক্ষেপ করে। দেখে তার প্রিয় ইফস্পরী পরম আদুরে চাহনীতে ঘুমিয়ে আছে। তাদের শরীর ঢেকে রয়েছে সাদা রঙের চাদরে। যাবিয়াজ ভোর বেলার নিষ্প্রতিভে ইফস্পরীর নিষ্পাপ মুখশ্রীতে চুম্বনের ছোঁয়া দিল। গালের এক পাশে হাতের ছোঁয়া দিয়ে স্লাইড করে নেশাক্ত কণ্ঠে বলে,
‘আজ পরিপূর্ণ হলো আমাদের দূরত্বের মোচন। তোমার মনে আচর পাওয়া প্রতিটি খন্ডে নিজের ছোঁয়া বর্ষিত করেছি। চিন্তা করো না মূল্য শোধ ঠিকই পূরণ করে নিব তার থেকে।’
যাবিয়াজ এর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। গুপ্ত ক্রোধ নিজের মাঝে চেপে নিল। ইফদিয়ার সঙ্গে করা অন্যায়কারীকে সে ছাড় দেবার পাত্র নয়। সে দেখে ছিল বিয়ের দিন নাজমুল কে সকলের অগোচরে পরিচিত মানুষদের মাঝে মুখোশধারী বেশে। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। কেননা সে চায়নি আনন্দদায়ক পরিবেশটা বেদনাময় হোক! ফলে এরফানকে ডেকে উক্ত ব্যাপারে অবহিত করে। যার কারণে সে চোখে চোখে রেখেছিল নাজমুলকে।
নাজমুল বাসা হতে বিদায় না হওয়া অব্দি এরফান স্বচক্ষে নজরদারি চালিয়ে ছিল। যাবিয়াজ দৃঢ় এক শ্বাস নিয়ে ভাবনার ছেদ ঘটালো। রমণী নিভু নিভু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যুবক এর উপর। নম্রতায় প্রেমময়ী শিরঃদাড়া বয়ে গেল পুরু শরীরে। আজ থেকে যে সে পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত হলো। তার দেহমন সাক্ষি যে, এই পৃথিবীতে তার স্বামীই তার সর্বাঙ্গে নিজের অধিকারের সিলমোহর দিয়েছে। লাজুক হেসে উঠার প্রয়াস করায় কাঁথা সরে গেল রমণীর পিঠ থেকে। যাবিয়াজ এর চোখে ইফদিয়ার শ্যামবর্ণী পিঠের উজ্জ্বলতা দেখে পুনরায় আসক্তি জম্মালো। আবেদনময়ী দৃশ্যটি সহে নিতে পারেনি। হেঁচকা টান মেরে রমণীর মাঝে মেঁতে উঠল। নাকচ করেনি ইফদিয়ার। স্বামীর পূর্ণ অধিকার পূরণে সাড়া দিল।
কয়েকঘণ্টা হয়ে গেল শ্রেয়িতাকে সম্মুখে দেখেনি ইসমাইল। বউটা যে কোথায় গায়েব হলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। শ্রেয়িতা হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করে। ইসমাইল চট করে তেজী কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
‘কি করছিলে কোথায় চলে গিয়ে ছিলে!’
‘উফ বলিও না যাবিয়াজ ভাই থেকে ৫০,০০০ টাকা লুটে নিলাম।’
ইসমাইল এর কান ছানাবড়া। সে বিস্ময়ময়ী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।
‘হোয়াইট দ্যা ফুসফুস! আমি কি তোমায় কম খাওয়ায়। যে ভাইয়ের থেকে ওত টাকা লুটে নিলা।’
‘এ্যা বোনের দিব্য হক আছে টাকা লুটার। তো তুমি চুপ থাকো।’
‘আচ্ছা থাকব না। চলো রোমান্স করি।’
‘অসভ্য যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। ইসরাইব কে খাওয়াতে হবে।’
‘যথা আজ্ঞে বেগমসাহেবা।’
ফিক করে হেসে দিল শ্রেয়িতা। ইসমাইল সন্তোপর্ণে হুট করে আলতো পরশ এঁকে দিল পরীর ওষ্ঠে। শ্রেয়িতা মৃদু রাগ করার ভান করে বকতে নিলে ভৌদৌড় দিল ইসমাইল।
চলবে……