#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৭
২৭.
ইফদিয়ার চোখ ফুলে গিয়েছে। কান্নারত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। মিসেস হালিমা কয়েকবার দরজায় এসে কড়া নাড়লেন। কিন্তু ভেতরের পিনপন নিরবতা অনুধাবন করলেন। তিনি দরজায় কড়াঘাত করা থামিয়ে দিলেন। ভীষণ অস্বস্তিকর মনোবল সামলে ড্রয়িং রুমে ফিরে আসলেন। মেয়েটিকে খাবারের সময় চার-পাঁচবার ডেকে ছিল। তথাপি কোনো উত্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে তিনি রুমের দ্বারে গেলেন। ফলাফল নিশ্চুপতায় চলেই আসলেন। বোধ হয় মেয়েটা পরম ঘুমে ঘুমাচ্ছেন ভেবে মিসেস হালিমা স্মিত হাসি দিলেন।
চিন্তিত দম ছেড়ে মিসেস জাবিয়ার রুমে প্রবেশ করলেন। তিনি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছেন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। মিসেস হালিমা টের না পাওয়ার মত আলতো পায়ে হেঁটে আসলেন বিছানার কাছে।
মিসেস জাবিয়া আচ করতে পেরে অর্ধবুজা চোখ উম্মুক্ত করে তাকান। মিসেস হালিমাকে দেখে মৃদু ঠোঁট নেড়ে হাসার চেষ্টা করলেন। তিনি হাতের ইশারায় বসতে বললেন মিসেস হালিমাকে। তিনিও বিনাবাক্যে বসে মালকিনের হাত ধরলেন। সুস্পষ্ট প্রণয়ঘটিত গলায় বলেন,
‘আপা আর কত এনে শুইয়া থাকবেন। যাবত জীবনে বাচ্চারা ওনেরে ছাইড়া মরিয়া হয়ে থাহে। ইফু মামুনি এহনো খানা খাইলো না।’
মিসেস জাবিয়া স্বত্তরে চোখের পাতা স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় পলক ফেললেন। যার অর্থ বুঝা মিসেস হালিমার পক্ষে দুরুহ! ঠোঁট কামড়ে অবুঝের মত নিজের মাথা উপর-নিচ নাড়লেন তিনি। মিসেস জাবিয়া জোরালো শ্বাস ছেড়ে পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে চোখ বুজে নিলেন। মিসেস হালিমা দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে দৃষ্টপাত করলেন। এখন সময়ের কাঁটায় ৪টা বেজেছে। আসরের সময় আরম্ভ হয়েছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ঘড়িতে সময়ের প্রবাহমান গতিতে তিনিও বসে থাকলেন না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে খাবার এনে মিসেস জাবিয়াকে খাওয়ায় দিলেন। সযত্নে ওষুধ সেবন করিয়ে সাদুরে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন মিসেস জাবিয়াকে।
ঘণ্টাখানিক পেড়ানোর পর হতদন্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করে ইসমাইল। সে বাসায় ফিরে এসে মিসেস হালিমাকে দেখল। চিন্তিত দশায় পায়চারী করছেন তিনি। ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে।
‘কাকীমা আপনি কি চিন্তিত কোনো বিষয় নিয়ে!’
মিসেস হালিমা ভেবাচেকা খেয়ে গেলেন। তিনি ইফদিয়ার চিন্তায় বিভোর ছিলেন। রাত পোহালো তাও রুমের দরজা বন্ধ দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন। ইসমাইল যে কবে বাসায় এসে গেল তারও টের পেলেন না মিসেস হালিমা। ইসমাইল নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মেডিক্যাল ইন্ট্রুমেন্টে ব্যবহৃত ব্যাগটি টেবিলের উপর রাখল।
মিসেস হালিমাকে সোফায় বসিয়ে শান্ত ভঙ্গিমায় পুনরায় প্রশ্ন করলেন।
তিনি ইতস্ততবোধক কণ্ঠে জবাব দিলেন।
‘বাবা ইফু মামুনি সেই বিকালে আইসা রুমে ঢুইকা ছিল। এহনো বাইর হই নাই। মনটা বড্ড আনচান করতাছে। একটু গিয়ে ডাক না। মাইয়াটা খানাও খাইলো না।’
ইসমাইল রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
‘কি ইফুপাখি এখনো খাই নি আর রাত হয়ে গেল এখনো রুমে আছে। তুমি এই কথা মাত্র জানাচ্ছো!’
‘মাফ কইরো বাবা। মুই ভাবছি মামুনি ক্লান্ত। কিন্তু এই তো দেহি কোনো কারণে রুম বন্ধ কইরা আছে । দেহো না গিয়া।’
ইসমাইল ফ্রেশ না হয়েই ছুটে এলো বোনের রুমের দরজার সামনে। নিজেকে উত্তেজিত না করে স্বাভাবিক করল ইসমাইল। হাত উচিয়ে দরজায় এক-দুবার কড়া নেড়ে স্বাভাবিক সুরে বলে,
‘ওপেন দ্যা ডোর ইফুপাখি।’
ভেতর থেকে ভাবলেশনহীন আওয়াজ ভেসে আসছে। কোনো মানবের চিহ্নও যেন সেখানে নেই এমন দশা। ইসমাইল ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলে,
‘বোনু পাখি প্লিজ দরজা খুল। কি হয়েছে আমায় বল!’
ইসমাইল চোখ খুলে এবার নিশ্চিত হলো। ভেতরে কোনো অঘটন ঘটেছে। না হলে দরজা বন্ধ করে রাখার মত মেয়ে তার বোন নয়। ভেবেই ইসমাইল সীমিত পরিমাণে পিছিয়ে এলো। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত নিচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে দিল ইফদিয়ার। ইসমাইল থমকে যায়। তার পুতুলের মত বোনটির বিধ্বস্ত মুখখানি ইসমাইলের হৃদয়ে আগুনের মত ধাওয়া করছে। বোনের কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সে উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে কাতর কণ্ঠে বলে,
‘ইফুপাখি কি হয়েছে তোর! কাঁদছিলি কেন এই কি হাল করেছিস মুখের। কেউ কি কিছু করেছে তোর সঙ্গে। প্লিজ বোন মুখ খুল। তোর তোর ভাই আছে না। তোকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে। কেউ কিছু করলে, বললে নিদ্বিধায় বল। তাকে হাতের কাছে এনে পিছে জবাই করে দেব।’
ইসমাইল রাগে ফেটে যাচ্ছে। তার মাথায় যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তার বোনের বিধ্বস্ত চাহনী। ইফদিয়ার মন তখনো বেকাবু হয়ে আছে। ভাইকে কাছে পেয়ে এক পলক চোখ তুলে তাকায় ইফদিয়ার। ইসমাইল এর চোখে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিশর্মা রুপ দেখা দিয়েছে। ভাইয়ের বুক থেকে মাথা আলগা করে সরে এলো ইফদিয়ার। কি ভেবে যেন জট করে ভাইকে চেপে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। এতক্ষণ বুঝি পরম যত্নশীল বুকের অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল সে। তার আপন সত্তার পরিপূরক ভাইয়ের মত ভাই পেয়েছে সে। ভাইকে আঁকড়ে রেখে ফুঁপানো কণ্ঠে বলে,
‘কেন ভাইয়া পৃথিবীতে কেউ বুঝে না কেন ভালোবাসার মূল্য। খুব বেশি ক্ষতি হতো। যদি একটু আগলে নিতো বুকের মাঝাড়ে, যদি না পরম শান্তি পেতে দিতো। ও ভাইয়া বলো না মানুষের মনমানসিকতায় সত্যতা বিচারের মর্মটা কেনো থাকে না।’
ইসমাইল বুঝতে পারছে না তার বোন আজগুবি কথা কেন বলছে। এই আবেগ জড়ানো ব্যক্তগুলি শুধু তখনি একজন মানুষের কাছ থেকে শুনা যায়। যখন মানুষটা নিদারুণ ভালোবাসায় জড়িয়ে হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। তার বোনের সঙ্গেও কি অকস্মাৎ কিছু ঘটেছে!
ভাবতেও কলিজার পানি যেন শুকিয়ে গেল তার। বোনকে আলগা হাতে স্পর্শ করে কাঁধে বাঁ হাত রেখে ডান হাতে চোখের পানি মুছে দিল সে। সন্দেহজনক কণ্ঠে ইসমাইল ইফদিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
‘ইফুপাখি কে সেই ছেলে!’
ইফদিয়ার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিটপিটিয়ে তাকায় ইসমাইল এর দিকে। তার অবুঝ মন জানতো না সে কি করে বসেছে। তার ভাইয়ের সামনে আবেগপূর্ণ মনোভাব উতলে দিয়েছে। ইফদিয়ার নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুকনো ঢোক গিলে। ইসমাইল বোনের চোখে নিশ্চত ভীতি রুপ দেখছে। বোনকে শান্ত করতে অগ্নি ভঙ্গিমা বদলে বলে,
‘সুন্দর করে নাম বল বাকিটা আমি দেখে নিবো।’
‘কিছু না ভাইয়া। আসলে পেট ব্যথা করছিল!’
‘সত্যি বলছিস কেমনে বুঝব। কারণ তুই একটু আগে!’
‘ওগুলো স্বয়ং সাজানো এক্টিং করছিলাম। আসলে নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কেউ রেগিং দিলে একই রুপে এক্ট করব ব্যস।’
নিচু গলায় শেষের কথাগুলো বলে। ইসমাইল ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দেহটা গাড় করে দু হাত বুকের উপর গুজে বলে,
‘তাহলে কান্না করছিস কেন! এক্টিং এ রিয়েলিটি টেয়ারর্স বেমানান।’
‘উফ ভাইয়া আমার পেট ব্যথা করছে। ও কাকীমা খেতে দাও আর ন্যাপা এনে দিও।’
ইসমাইল এর বুকের জ্বালা শান্তি পেলেও বোনের হঠাৎ বিধ্বস্ত রুপের পরিবর্তনে খটকা লাগছে। আসলে কি তার বোনের জীবনে কেউ ছিল নাকি আছে! ভেবেও কুল কিনারা পাচ্ছে না ইসমাইল। ইফদিয়ার রুমের ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। পেটে সত্যি তার ব্যথা করছিল। ইসমাইল আন্দাজ করেছে তার বোনের কেনো পেট ব্যথা করছে। তাই সময় অতিবাহিত না করে নিজ রুমে চলে গেল। মিসেস হালিমা প্রথমে কিছু বুঝলেন না ইফদিয়ার অকস্মাৎ কান্না করা। কিন্তু পরিবেশ শান্ত হওয়ায় তিনিও প্রশান্তি লাভ করলেন।
মিসেস হালিমা ইফদিয়ার রুমে খাবার নিয়ে এলেন। বিছানার চাদরে সীমিত পরিমাণ রক্তের ফুটা লক্ষ করে চমকালেন। মনে মনে আউলে নিলেন।
‘আল্লাহ মাইয়া কি হাত কাটলো নি! কিতা হইলো গো মামুনির। জানতে হইবো।’
ইফদিয়ার সদ্য গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো। ঢিলেঢালা প্লাজু আর একটি বারবিকিউ রঙের টিশার্ট পড়েছে। বিছানার দিকে তার নজর আঁটকে গেল। রক্ত দেখে লজ্জায় মাথা নুয়ে নিল। আজ তার পিরিয়ডের ডেট ছিল আচ করতে পারিনি। ঘুমের মধ্যে কখন শুরু হলো সেটাও জানতে পারল না। উঠে দেখে রাত হয়ে গেছে আর এই দশা। তার উপর বাহির থেকে ভাইয়ের চিন্তিত কণ্ঠ দুটানায় পড়ে গিয়ে ছিল। বিছানার চাঁদর মোড়ে দিল আর গায়ে ফুতয়া জড়িয়ে নিল। যাতে ভাইয়ের সামনে লজ্জিত না হতে হয়। বুদ্ধি কাটিয়ে কাজ করলেও কাকীমার সামনে ত্রপাটে কেঁপে উঠল। মিসেস হালিমা সরু দৃষ্টিতে ইফদিয়ার লাজুক অবস্থা পরখ করছেন। পরক্ষণে রক্তগুলো কিসের বুঝতে পেরে অনুচিন্তা ছেড়ে বলেন,
‘শোন মামুনি খাবার রাইখা যাইতাছি। চাঁদর মুই ধুইয়া দিমু। তুই খাবার খাইয়া নতুন চাঁদর বিছাইয়া শুইয়া থাক। পেটে জোর কাটাইস না ব্যথা করব।’
ইফদিয়ার মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মিসেস হালিমা পুরুনো চাঁদর উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। ইফদিয়ার হাঁফ শ্বাস ছেড়ে দরজা ভিজিয়ে দিল। পড়ার টেবিলের কাছে এসে ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখে নিল কোন দিন শুরু হয়েছে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে। তারিখ দেখে অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ইশ! পুরু পাঁচদিন কেমনে কাটাবো। যে গণহারে দুদিন ব্যথা করে। আল্লাহ এত কষ্ট কেন হয় এই পিরিয়ডে। ধুর ভাল্লাগে না।’
অসহ্য হয়ে সোফার উপর বসে পড়ে। তলপেটে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছে। পিরিয়ড শুরু হলে প্রথমদিন ব্যথা করবে এটাই স্বাভাবিক। সোফায় গা হেলিয়ে দিয়ে ভাবে।
‘সহস্র ব্যথাও দূর হত একটুখানি আপনার #ছোঁয়া-তে। অস্তিত্বের নিমীলিত নয়নে কেনো আপনার পায়ের রেখা মাটিতে দেখি! কেনো পায় আপনার পায়ের ছোঁয়া মাটিতে! কেনো অক্ষি উম্মুক্ত করিলে আপনার মুখশ্রী দেখার ব্যকুলতা ঘিরে ধরে। বলিবেন কি করিলে পাবো আপনায়!
কি করিলে ছোঁয়া হবে আমাদের অস্তিত্বের মিলনপূর্ণ রাত্রিতে। আপনি আসিবেন কি কখনো ফিরে আমার #অস্তিত্বে। চাই শুধু আপনারি ছোঁয়া।’
চোখদ্বয় বুজতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে স্বচ্ছ অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। খাবারের ঘ্রাণ আসছে তাও মুখে পুরতে মন সায় দিচ্ছে না ইফদিয়ার। তবুও তলপেটের দরুণ যন্ত্রণা আর খিদার পীড়নে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে খেতে লাগল।
২৮.
মধ্য রাতের তারাকার বিলাস কতটা সুন্দর তা ধারণক্ষমতাহীন সকলের কাছে। কিন্তু এক রাত জাগা পাখি জানে অমাবস্যার রাত কতটা না বিলাসবহুল হয়। যাবিয়াজ হোস্টেলে রুমের বেলকনিতে কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধোঁয়া উঠা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে এক ধ্যানে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে যাবিয়াজ। আজ তার মন না বিষাদ, না বিষন্ন কিন্তু প্রিয় মানুষের মনের ক্ষতিগ্রস্থে নিহত হয়েছে মনের কেন্দ্রীয় অনুভূতিগুলো। ‘রাত পোহালে কষ্ট বাড়ে’ এর মর্ম উপলদ্ধি যাবিয়াজের মনে দৃঢ়ভাবে নাড়া দিচ্ছে।
আকাশে দুটি পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের গায়ে ঘন ছাই রঙের মধ্যে কালশিরা দাগকাটা রঙের মিশ্রণ, পাখাগুলো উম্মুক্ত করে দুজন একসঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড় আকাশের দিকে দূর দূরান্তে তারা উড়ন্ত পাখি।
এশারের নামাজ পড়ে যাবিয়াজ রুমে প্রবেশ করে নি। দিবাভাগে কম্পিউটারে প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছে। বিকালের দিকে দু-তিন রোগীর চেকআপ করে হাত-পায়ের ভীষণ ধকল গেল। রাতে বন্ধুগণের সঙ্গে বাহিরে হেঁটে গল্পকথনে ব্যস্ত ছিল।
তিনবন্ধু ক্লান্ত হয়ে নামাজের পরিশেষে রুমে আসে। দু’বন্ধু নিদ্রামগ্ন হলেও যাবিয়াজ পারিনি নিদ্রায় চোখ বুজতে। চোখ বুজলেই যে ইফদিয়ার ছলছল দৃষ্টি চোখের পরশে ভেসে উঠে। তখনি হৃদপিন্ডের মাঝাড়ে ‘ইফদিয়ার’ নামক মানুষটির চাপা কষ্টের বাড় ধরা দেয়। তবুও এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য সব লন্ডভন্ড করে দিল। মনের গহীনে কখনো কখনো ইফদিয়ার বলা কথাগুলি সত্য মনে হয়। আনমনে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
‘রাত যত অন্ধকার হয়, তারাগুলো
আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
দুঃখ আরো গভীর হয়, সৃষ্টিকর্তা
আরো কাছাকাছি থাকে।
ওহে অপ্সরী কেনো করিলাম তোমার হৃদয়ে আঘাত!
জানিলে তুমি ক্ষত হবে শতবার।
তুমি আমার রাত। যে রাত মানে গভীর নেশা,
স্বপ্ন দেখার আশা। লুকিয়ে থাকা উষ্ণ ভালোবাসা উতলে আসার আকাঙ্ক্ষা ।
ওহে অপ্সরীমনি তুমি আমার সেই রাত, যে রাতে চোখ বুজলে স্মৃতির মোড়ক খেলা করে।’
দৃঢ় শ্বাসে খেয়াল করে কফির মগে কফি একদম নিম্র তলায় এসে পড়েছে। গরম ধোঁয়াটে ভাব চলে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কফির মগটা বেলকনিতে থাকা ট্রি টেবিলের উপর রেখে দিল। দু’বন্ধু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। যার শব্দ বেলকনিতে সহ আসছে। যাবিয়াজ শুনে স্মিত হেসে পুনরায় দৃষ্টি আকাশের দিকে মেলে দিল।
প্রতিটা মানুষ নিজের মনের কথন দু’স্থানে ব্যক্ত করে। প্রথমস্থান হলো প্রিয় আল্লাহর দরবারে জায়নামাজে কান্নারত অবস্থায়।
দ্বিতীয় স্থান হলো দিবা-রাত্রির স্থলে একমনে আসমানের দিকে চোখ রেখে মনের অব্যক্ত কথাগুলি স্মরণ করা।
ভাবনার পীড়ন কেটে যাবিয়াজ শক্তমনে রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় গা হেলিয়ে নিদ্রামগ্ন হওয়ায় প্রয়াস করে।
চলবে…..
অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৮
২৯.
এরফান চুরিচুপে ফেরদৌসকে টেনেটুনে বেলকনিতে নিয়ে এলো। ফেরদৌস দেখে চেঁচাতে চাইলে এরফান তর্জনী আঙুল দেখিয়ে একটু চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে। ফেরদৌস দোস্তের কথা মত চুপ রইল। বেলকনিতে আনার পর এরফান ফেরদৌসকে কেন্দ্র করে রহস্যময়ী কণ্ঠে বলে,
‘দেখ যাবিয়াজ আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছে। তার মুখমন্ডল অনুধাবন করেছিস। আগের চঞ্চল ছেলেটি অত্যন্ত গাম্ভীর্যে পরিণত হয়েছে।’
ফেরদৌস নিজেও ক’দিনে লক্ষ করেছে যাবিয়াজ পরিবতনশীলতা। যে ছেলে সব বিষয়ে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করে মনমাতানো হাসি দিতো। সে ছেলে এখন খুঁত খুঁজে পৈশাচিক হাসি দেয়। এরফানকে নিজের মত গাড় সন্দেহে পুষতে ফেরদৌস আক্ষেপময়ী কণ্ঠে বলে,
‘দোস্ত ইফদিয়ার সঙ্গে কিছু হয়েছে!’
এরফানের মস্তিষ্ক খেলে উঠে ‘ইফদিয়ার’ নামটি ফেরদৌসে মুখে শুনার সঙ্গেই। মেয়েটির সঙ্গতা ক’দিনে পরখ করেনি যাবিয়াজের মাঝে। কোনো এক প্রকার শিরঃপীড়াময় ছেদ ঘটেছে দুজনের মাঝে। ফেরদৌসের সম্মুখীন মাথা নেড়ে বলে,
‘সিউরিটি দিতে না পারলেও গ্যারান্টি দিতে পারি ইফদিয়ার সঙ্গে নিশ্চিত যাবিয়াজ কোনো না কোনো তুলকালাম বাজিয়েছে।’
ফেরদৌস উদাসীন ভঙ্গিমায় বলে,
‘মেয়েটি মেলা ভালো ছিল। যাবিয়াজ এর নিঃসঙ্গ দুশ্চিন্তাময়ী জীবনে আলোর প্রদীপশিখা হতে পারতো। না জানি উদ্ভট বালকে কি কান্ড ঘটিয়েছে।’
‘শ্রেয়িতাকে জিজ্ঞেস করি। সে বলেছিল না, ইফদিয়ার আর তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। নিশ্চয় ইফদিয়ার কষ্ট পেলে শ্রেয়িতার কাছে শেয়ার করবে। আফটার অল শ্রেয়িতা আমাদের ক্লুজ ফ্রেন্ড। ইফদিয়ার নিজেও দেখেছে কয়েকবার।’
ফেরদৌসের মনের গহীনে আশার আলো ঝিকঝিক করে জ্বলে উঠে। এরফানকে উত্তেজিত গলায় বলে,
‘শোন দোয়া কর শ্রেয়িতার মুখ থেকে যেন শুভ বাক্য উতলে পড়ে।’
এরফান প্রত্যত্তুরে জবাব দিল না। শুধু ফেরদৌস এর দিকে করুণ চাহনী নিক্ষেপ করেছে। যার মর্ম হলো ভাই তোর দোয়া যেন কবুল হোক। শ্রেয়িতার নামক নাম্বারে চাপ দিয়ে ফোন ডায়ল করে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কাছে কল যাচ্ছে না বলে জানান দিচ্ছে সার্ভিস সেন্টার থেকে। এরফান হতাশ হয়ে ফোঁস করে উঠে। ফেরদৌস বন্ধুর অসহায়ত্ব দেখে বলে,
‘কি শ্রেয়িতা কিছু বলেছে।’
‘কি বলবে কলই যাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে সে রাগ করেছে আমাদের ইগনোরনেস এ।’
ফেরদৌস কপাল চাপ্পড়ে ব্যবলাকান্তের ন্যায় মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
‘দোস্তানি রাগে বোল্ড হয়েছে আইম সিউর। কারণ কালকের দিন পেড়িয়ে আজকের দিন আরম্ভ হতে হতে প্রায় শেষের দিকে। এখনো রাগ ভাঙ্গায়নি শ্রেয়িতার।’
পরক্ষণে এরফানের মাথায় বুদ্ধি এলো। সে শয়তানি হেসে ফেরদৌসের কানে ফিসফিস করে পুরু শয়তানি বুদ্ধির পদ্ধতি ঢেলে দিল। ফেরদৌস শুনে হতম্ভব হয়ে গেল। অবাককর দৃষ্টি নিয়ে এরফানের দিকে তাকায়। কাঁপা গলায় বলে,
‘এরফান তুই উল্টা ফাঁসিয়ে দিবি।’
‘দোস্তানির রাগ ভাঙ্গানোর মূখ্যকর্ম এটা।’
ফেরদৌস নিরবচ্ছিন্ন ভঙ্গিতে চুপ করে রইল। এরফান ফোনের দিকে কললিস্ট চেক করে। চেক করতে করতে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির নাম্বার না পাওয়ায় উওেজনাময় গলায় বলে,
‘হায় রে কোনো ভাবে কি হারায় ফেলছি নাম্বারটা!’
পুনরায় কললিস্টের একদম শেষে নাম্বারটি পেয়ে সূক্ষ্ম হাসি উপহার দিল ফেরদৌসকে। ইশারায় বলে ‘পেয়েছি’। ফেরদৌস মৃদু হেসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘গুড’ বুঝায়। এরফান কলে চাপ দিতেই রিং হতে লাগে। কয়েক সেকেন্ড পরই কল উঠায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। সে তাকে ভিন্নভাবে কথাগুলো পূর্ণবাক্যে বানিয়ে সাজিয়ে উপস্থাপন করে দিল। শেষ বাক্যে এইও বলে উঠে।
‘হ্যা অবশ্য আপনি তাকে ভালো করে চিনেন। ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার হোয়াইটসআপে।’
কল কেটে হোয়াইটআপে এড করে নিল মানুষটিকে। তার আইডিতে শ্রেয়িতার ছবি পাঠিয়ে দু’সেকেন্ড এর বেশি রাখল না। ফটাফট আনসেন্ড করে দিল। অপর মানুষটি খানিক বাদে করে ছোট একটি মেসেজ করে। যা দেখে এরফান মুখ ভেটকিয়ে বলে,
‘বাহ রে ঢং দেখো। বান্দরের লজ্জার ইমুজির সঙ্গে বার্তা পাঠিয়েছে। ‘দেখে নিব আমি’। লিখাটা লিখে কি নিজেকে শাহরুখ খান ভাবে সে। ধুর আজাইরা!’
ফেরদৌস সবটা শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে। শেষে এরফানের বিরক্তিসূচক চাহনীতে বিড়বিড়ানো কথনগুলো শুনে ফেলে। নিজের হাসি গম্ভীর পরিস্থিতিতে সংযত করে এরফান এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা ঝেড়ে উঠে।
এরফান সেই মানুষটিকে ‘ওকে’ বলে চ্যাট করা অফ করে দিল। ফেরদৌস এর দৃষ্টি আকর্ষণে মতঁ হয়ে এরফান আহ্লাদী গলায় বলে,
‘দেখিস শ্রেয়িতা ধামাকাদার উপহার পাইবো। নিজ হাতে নিয়া যাবো উপহারটা। আমার গ্যারান্টি খুশিতে আকাশে উড়াল দেওয়ার মত দশা হবে।’
এরফান আর ফেরদৌস শ্রেয়িতার রাগ ভাঙ্গানোর পদ্ধতি অবলম্বন করার কৌশল খুঁজার চেষ্টা করছে। অতএব তাদের এক বন্ধু যে ঠিক অন্য কাউকে অপদস্থ করতে ভোরবেলায় বেড়িয়ে গেল। তার কোনো প্রকার অনুচিন্তাও নেই তাদের ধারণায়। জানলে হয় তো রেশারেশি ঘটবে ‘বন্ধুত্ব’ নামক সম্পর্কের মাঝে। যার বিন্দুমাত্র সহ্য করার ক্ষমতা নাই যাবিয়াজ এর। হোস্টেলে বায়োজেনেটিক প্রোগাম সভার আয়োজন বসবে বিকাল বেলায়। সাইরেন বাজিয়ে একটি লোক সব ছাত্র-ছাত্রীকে অবহিত করছেন। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ক্যানভাসে অবস্থিত উঁচু করে অঙ্কন করা পিরামিড এর চিত্রাঙ্কনের পশ্চাতে। ক্যানভাসে কোনো প্রকার দর্শনীয় স্থান না থাকলেও রয়েছে বিশেষ স্থাপত্যের আবিজাত্য। যার অভিভূত উৎস কোনো বিশেষ চিত্রশিল্পীর চমৎকার হাতের ছোঁয়া। ক্যানভাসের প্রতিটা দেওয়ালে খোদাই করা হয়েছে উচুমানসম্পন্ন চিত্রাঙ্কন। যা দেখলে বোঝা সক্ষম যে চিত্রগুলো খোদাই করতে সুস্পষ্টভাবে দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ সময়ের প্রয়োজন হয়ে ছিল। যার পরিমাণ সীমিত নয় বরঞ্চ দীর্ঘ সময় বলা যায়।
এরফান হোস্টেলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফেরদৌস এর সঙ্গে আভিজাত্যপূর্ণের প্রশংসামুখর হলো। রুমের মধ্যে বেল বাজায় এরফান ভেতরে এলো। গায়ে রয়েছে মোলাটে রঙের টিশার্ট আর ঢিলেঢালা কালশিটে রঙের হাটু অব্দি প্যান্ট। দরজা খুলে দেখে হোস্টেলের কর্মচারী হাতে নাস্তার ট্রে বহন করে এনেছে। সাদরে ট্রে নিজ হাতে বহন করে নিল এরফান। পকেট থেকে ১০০টাকার একটি নোট বের করে ধরিয়ে দিল কর্মচারীর হাতে। উক্ত লোকটি আনন্দপূর্ণ নয়নে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এরফান থেকে বিদায় নিল।
বেলকনিতে পুনরায় এসে ট্রে টেবিলের উপর রেখে ফেরদৌস কে পানাহার গ্রহণ করতে ইশারা করে। মৃদু হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলিয়ে গ্রিন ট্রি-র মগ হাতে নিয়ে মগে চুমুক দিল। তিনটি মগের দুটি তারা নিলেও একটি রয়ে গেল ধোয়াঁটে প্রভাব ছড়ানোর ব্যস্ততায়। যে মগটি ছিল তাদের বন্ধু যাবিয়াজ এর। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৩০.
শ্রেয়িতা হতবাক দৃষ্টিকোণ এঁটে রাখল ড্রয়িং রুমের সোফা সেটের দিকে। তার দৃষ্টি আদৌ শুদ্ধ নাকি অশুদ্ধ দৃশ্য দেখাচ্ছে। বুঝা দ্বায় হয়ে পড়ল শ্রেয়িতার! শুকনো দৃষ্টিতে ডান দিকের সোফায় বসে থাকা ভদ্র মহিলা আর ভদ্র পুরুষ এর দিকে মুখ করে তাকায়। উনারা কি সানন্দে কথোপকথন করছেন বাঁ দিকের সোফা সেটে বসারত মানুষদের সঙ্গে। বাঁ দিকের এক তালায় চোরের মত দেওয়ালের পিছে লুকিয়ে আছে শ্রেয়িতা। পরমুর্হুতে নিচে বসা মানুষটির সামনে যেতে চায় না। কোনোভাবে তার সামনে থেকে উধাও হতে পারলেই যেন বাঁচে।
শ্রেয়িতা নিজেকে নিজেই বলে,
‘তাই বলি মানুষের সঙ্গে প্যাচাঁল বাড়াতে নেই। তাহলে প্যাচাঁল বিবাহ অব্দি চলে যায়। না রে বাবাহ এই গুমোট মানুষরে বিয়ে বাপের জীবনে জম্মালেও করতাম না।’
নিজেকে সাহসী সাভ্যস্ত করে ধীরস্থীর পায়ে নিজ রুমে প্রবেশ করে শ্রেয়িতা। কাবার্ড থেকে খয়েরী রঙের ফুলের সমাবেশে অবরোধদ্ধ ফুল হাতা টিশার্ট আর সটানপূর্ণ কচমচে গুমোট ছাই রঙের প্লাজু বের করে পরে নিল। আয়নার সামনে এসে চুল আচঁরে মাঝারি আকৃতির ক্লিপ মেরে চুলগুলো ডানপাশে ঝুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল। সোফায় বসা ভদ্র যুবকটি জনাব জগৎ শন্দ্রনাথ কে বলে,
‘ধন্যবাদ আঙ্কেল সঙ্গে ভীষণ দুঃখিত রাতে না আসার জন্যে। গভীর রাত হয়ে পরায় আর বের হলাম না। ঠিক ভোরবেলায় সকলকে নিয়ে রওনা হলাম। বাই দ্যা ওয়ে কত দিনের ট্রেনিং এ শিক্ষকতার কাজ করতে হবে আমায়!’
‘এই ধরো এক-দু সপ্তাহ। আর তুমি চাইলে তোমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট রাখতে পারো। যে তোমাকে প্রোগাম লিস্ট,নাম লিস্ট,প্রোগাম আয়োজনে সহায়তা করবে।’
ভদ্র ছেলেটি খানিকক্ষণ ভেবে মৃদু হেসে বলে,
‘জ্বি আঙ্কেল এমন যোগ্য ছাত্র হলে ভালো হয়।’
‘ইসমাইল বাবা আমার মতে যাবিয়াজ কে নিতে পারো এসিস্ট্যান্ট রুপে। সে হলো বায়োজেনিটিক বিভাগের ছাত্র। কিন্তু তার মূখ্য বিভাগই প্রকৌশল আর প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ক। বায়োজেনেটিক বিভাগের উপর চর্চা অনুকরণ করতে চাই। বিধায় আমিও বারণ করেনি। সে যেমন মেধাবী তেমন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন।’
ভদ্র ছেলেটি অর্থাৎ ইসমাইল সম্মতি দিল। যার অর্থ হলো সে যাবিয়াজ কে এসিস্ট্যান্ট স্বরুপ ট্রেড করবে।
ইসমাইল শন্দ্রনাথ সাহেবের বাড়িতে এলো যখন যোহরের আযান শেষ হলো। সে সময় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল শ্রেয়িতা। কলিংবেল বাজলেও জাগেনি সে। স্বয়ং তার মা গিয়ে আপ্যয়ন করে ইসমাইল, তার বোন,কাকী আর মাকে। ভদ্র মহিলাটি ইসমাইল এর মত সুর্দশন যুবককে দেখে অত্যধিক খুশি হলেন। তিনি সুশ্রী যুবক হিসেবে দেবীর কাছে আগন্তক এর মত যুবক চেয়ে ছিলেন মেয়ের জীবনসঙ্গি হিসেবে।
পরন্তু মুসলিম নামটি শুনে ভদ্র মহিলাটির মুখে কালো আঁধার ছড়িয়ে গেল। জগৎ শন্দ্রনাথ এর স্ত্রী অর্থাৎ ভদ্র মহিলাটির মুখমন্ডল পাংশুটে হয়ে পড়ে। তিনি ভেবেছিলেন এই বুঝি মেয়ের জীবনসঙ্গী স্বয়ং দেবী উনার বাসায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু নিতান্তই যে উনার ভুল ধারণা ছিল। এমন কি জগৎ শন্দ্রনাথও ইসমাইল এর বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের অবগত করেননি। ভদ্র মহিলাটি ইসমাইল এর চুক্ষগোচরে খোঁচা দিলেন জগৎ শন্দ্রনাথ এর বাহুতে। তিনি পাত্তা না দেওয়ায় বারংবার উনার স্ত্রী খোঁচা দেওয়ায় বিরক্তবোধ করলেন। ইসমাইল কে অপেক্ষা করতে বলে স্ত্রীর সঙ্গে রুমে গেলেন। ভদ্র মহিলার হিংস্র চাহনী লক্ষ করে জগৎ শন্দ্রনাথ বুঝতে সক্ষম হলেন আসলে ঘটনা কি!
তিনি স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে আদুরে গলায় বলেন,
‘ইসমাইল মুসলিম ঘরের পুত্র। কিন্তু এতে তার ধর্মের প্রতি আমার কোনো রকম হেয় নেই। আমি তাকে স্নেহ করি নিজ সন্তানের মত অনুধাবন করি। তার প্রশিক্ষক পদটি ক্যানভাসে পড়ল। সেখানকার শিক্ষকগণ নিজেকে সৌভাগ্যভান বলছিল। কারণ ইসমাইল এর মত খ্যাতনামা ডাক্তার তাদের ক্যানভাসে প্রশিক্ষক রুপে প্রবেশ করবেন বলে। তথাপি ইসমাইল নতুন শহরে একদিনে বাসা ভাড়া কেমনে পাবে! সেজন্যে নিজ বাসায় আসতে অনুরোধ করে ছিলাম আমি। শুনো লক্ষ্মীনা কোনো প্রকার ঈর্ষা-বিদ্বেষ ছাড়া মেহমানদের সামনে মনমাতানো ব্যবহার উপস্থাপন করবেন। আমায় নিরাশ করবে না বলে আশা রাখি।’
লক্ষ্মীনা উত্তরের বিনিময়ে মুচকি হাসি উপহার দিলেন। জগৎ শন্দ্রনাথ স্ত্রীর হাসির অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি জানেন উনার স্ত্রী সবর্দা কোমল সরল প্রকৃতির। মেহমানদের প্রবেশে তাদের ধর্মে মঙ্গল মান্য করা হয়। ফলে লক্ষ্মীনা মেহমানদের যত্ন নিতে আরম্ভ করলেন।
লক্ষ্মীনা ইফদিয়ারকে নেকাপে দেখে বলে,
‘মামুনি নেকাপ একটু সংযত করো। তোমার মুখখানি দেখতে পাচ্ছি না।’
ইফদিয়ার কথাটি শুনে অস্বস্তিবোধ করে। তার সামনে আর্দশ পরিচিত শন্দ্রনাথ বসে আছেন। এমনকি পিছে দুজন ২০-২১ বছরের যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তারা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে যেন ইফদিয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছিল। ইসমাইল বোনের অস্বস্তিদায়ক দশা বুঝে মিসেস শন্দ্রনাথকে সৌজন্যে বলে,
‘দুঃখিত আন্টি আমাদের মুসলিম ধর্মে মেয়েদের পর-পুরুষদের সামনে মুখ দেখানো জায়েজ নয়।’
লক্ষ্মীনা শুনে মুখ ফিরিয়ে পিছে তাকালেন। ডাইনিং টেবিলে উনার দু’ছেলে দাঁড়িয়ে বরাবর মুখ ইফদিয়ার দিকে করে রেখেছে। যা দেখে তেঁতে উঠলেন তিনি। ছেলেদের কাছে গিয়ে কড়া কণ্ঠে আদেশ করলেন।
‘তোমাদের অফিস নেই। যাও এখনি।’
যুবক দুজন পরপর নিজেদের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। লক্ষ্মীনা ফিরে এসে পুনরায় ইফদিয়ার পাশে বসে। তিনি জগৎ শন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘মেয়ের মুখ তুমিও দেখতে পারবে!’
জগৎ শন্দ্রনাথ মাথা নাবোধক নেড়ে বাহিরে চলে যান। ক্যানভাসে জরুরি কাজ আছে সেটা সেরেই বাসায় ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ইসমাইল পর-পুরুষ কাউকে না দেখে ইফদিয়ার কে আশ্বস্ত করল নেকাপ খুলতে।
ইফদিয়ার নিজেও চোরাচুখে পরখ করে ধীরস্থে নেকাপ উঠিয়ে মাথার পিছে ফেলল। লক্ষ্মীনার চোখ যেন আঁটকে গেল রমণীর উপর। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর রুপে বসে আছে মনে হলো লক্ষ্মীনার। তিনি ইফদিয়ার থুতনীতে হাত রেখে প্রশংসাময়ী কণ্ঠে বলেন,
‘তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার ভাষা নেই।’
ইফদিয়ার সৌজন্যেমূলক হাসি দিয়ে বলে,
‘আন্টি আমাদের ধর্ম অনুযায়ী কারো প্রশংসা করলেন ‘মাশাআল্লাহ’ বলতে হয়। আপনি যদি…।’
ইফদিয়ার শুকনো ঢোক গিলল। সে ভাবে এই বুঝি আন্টি রেগে গেল না তো। কিন্তু তার ধারণাকে পুরুপুরি ভুল প্রমাণিত করে লক্ষ্মীনা ‘মাশাআল্লাহ’ বলেন। তিনি উঠে ইফদিয়ারকে বলেন,
‘তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে রুমে থাকতে পারবে। একমিনিট মেয়েকে ডাক দেয়। শ্রেয়িতা…।’
গলা চেঁচিয়ে লক্ষ্মীনা শ্রেয়িতার নাম উচ্চারণ করে। যা শুনে ইসমাইল এর বুকপিন্ড ধুক করে উঠল। এলোথেরাপি হাতুড়ি যেন কেউ বুকের গহীনে পিঠাচ্ছে। নামটি যে তার পরীর সেটা বুঝতে সমস্যা হলো না তার। ইফদিয়ার রীতিমত অবাক। সে একপলক ভাইয়ের দিকে তাকায়। ইসমাইল গম্ভীর দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ইফদিয়ার মনের কোণে বিষন্নতা ছাপ পুনরায় উঁকিঝুঁকি মারতে লাগে। কারণ সে ভেবেছিল কোনোভাবে যদি শ্রেয়িতাকে ভাবি বানানো যায়। ইফদিয়ার নিজে ভাবনাকে নিমিশেষে মাটিচাপা দিল। যা সম্ভবপর নয়। তার ভাই আর শ্রেয়িপ্পির মাঝে রয়েছে ‘ধর্মের দেয়াল’। পরবর্তী সময় আর কি কি ক্ষুণ্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন করেন একমাত্র আল্লাহ। তা নিতে একমাত্র তিনি অবহিত। ইফদিয়ার অন্তরাল হতে দীর্ঘ চাপা কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে এলো।
শ্রেয়িতা ডাক শুনে ইতস্ততঃ বোধ কাটিয়ে পা টিপে ড্রয়িং রুমে এলো। তার বেহায়া মন না চাইতেও চোখ গিয়ে আঁটকায় ইসমাইল এর দিকে। যুবকটাকে আজ শুধু সুদর্শন নয় বরং অত্যধিক আকর্ষণীয় লাগছে। পরণে ফুল হাতা কালো রঙের শার্ট, যার উপরের দু’বোতাম উম্মুক্ত করা,ছাই রঙের প্যান্ট,হাতে কালো রঙের ঘড়ি,গম্ভীর মুখশ্রী হলেও যুবককে খারাপ দেখাচ্ছে না, মাথার চুলগুলি তেল দিয়ে একপাশে জড়িত করে রেখেছে। শ্রেয়িতার চোখের পলক পড়াও যেন বন্ধ হয়ে গেল। পরক্ষণে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শ্রেয়িতার দিকে এক সেকেন্ডের জন্যেও মুখ তুলে তাকায়নি ইসমাইল।
লক্ষ্মীনার ডাকে সম্মতি ফিরে শ্রেয়িতার। তিনি ইফদিয়ার কে পরিচিত করাতে চাইলে শ্রেয়িতা স্বেচ্ছায় বলে।
‘মম ইফদিয়ার আমার পূর্বপরিচিত সো ডোন্ট ওয়ারি।’
লক্ষ্মীনা মুচকি হেসে ইফদিয়ারকে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। শ্রেয়িতা ইফদিয়ারকে রুমের ভেতরে গেল ঠিকি তবু মনের দ্বারপ্রান্তে হার মেনে পুনরায় ইসমাইল এর দিকে দৃষ্টি রাখে। ইসমাইল দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনার থেকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শ্রেয়িতার চুক্ষদ্বয়ে পানি জমে এলো। নিজের মনকে বুঝিয়ে ইফদিয়ার কাছে গেল।
ইসমাইল ক্যানভাসে না গিয়ে নির্জন পার্কের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। সূক্ষ্ম ধ্যানে ঘন উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের দিকে দৃষ্টিকোণ রাখে। তার মনের অন্তরালে ‘আমার ভীনদেশী তারা’ গানটি স্মরণীয় হয়ে উঠে। সে নিজেও গেয়ে ফেলে।
~’আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরি আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথা কানে
তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানে
তোমার গায় লাগেনা ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে।
আমার রাতজাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ি।
আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী।’
ইসমাইল খালি গলায় গান গেয়েছে নিজের মনপ্রাণকে প্রশান্ত করতে। পরন্তু সেই মনের তিমিরে রংধুন যেন আজ ফিকে পড়ে গেল। হৃদয়ের ধুকপুক কে সে চাইলেও থামাতে পারে নি। মুখ ফুসকে বলে ফেলে,
‘পরী তুমি আমার সেই ভীনদেশী তারা। যার প্রতি নেশাক্ত হতে পারি তবুও তার #অস্তিত্বে_ছোঁয়া যেন বারণ।’
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৯
৩১.
শ্রেয়িতা বাহিরে যেতে চেয়েও পারল না। ব্যাগটা পূর্বের জায়গায় রেখে ইফদিয়ার পাশে ধপ করে বসে পড়ে। ইফদিয়ার মনটা ব্যকুল হয়ে আছে তার ভাইয়ের চিন্তায়। কারণ সে ভাইয়ের চোখে সূক্ষ্ম ভালোলাগা দেখেছে শ্রেয়িপ্পির প্রতি। তবে কি তার মত ভাইও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগে জড়িয়ে যাবে। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে। খেয়াল করে দেখে তার কাঁধে নরম তুলতুলে হাত রেখেছে শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার সংকোচতা কাটিয়ে সহজ করার জন্যে শ্রেয়িতা গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইফদিয়ার কে স্বাচ্ছন্দ্যে বলে,
‘বোরকা নেকাপ হিজাব খুলে ফেলো ইজি হউ। ভাইয়েরা রুম অব্দি প্রবেশ করবে না। যতই হোক তোমরা আমার ধর্মালম্বী বলে কথা!’
ইফদিয়ার সটানপূর্ণ অক্ষি নিয়ে শ্রেয়িতার দিকে ফাটাফাটা বিবেকে তাকায়। তার বিবেকে শ্রেয়িতার শেষাক্ত বাক্যটির অর্থ খুঁজতে ব্যস্ত। শ্রেয়িতা ব্যঙ্গময়ী দৃষ্টিতে দেখে ইফদিয়ার কেমন হ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে। বেচারী নিজেও জানে না তার সঙ্গে কি হচ্ছে! শ্রেয়িতা ত্রপাট দৃষ্টিতে লাজুক কণ্ঠে বলে,
‘ওমনে দেখে কি নজর দিচ্ছো বালিকে!’
ইফদিয়ার থতমত খেয়ে গেল। দৃষ্টি নত করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘আপু তুমি হয়ত ভুলে আমাদের ধর্মকে নিজের ধর্ম বলেছো।’
কথাটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিল শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিল সে। যার একটুখানি আচও অবুঝ ইফদিয়ার করতে পারিনি। শ্রেয়িতা ইফদিয়ারকে বিশ্রাম নিতে বলে রুম হতে প্রস্থান করে। ড্রয়িং রুমে সোফায় লক্ষ্মীনা বসে ছিলেন। শ্রেয়িতা ধ্যান করে দেখে লক্ষ্মীনা কথোপকথন করছেন মিসেস হালিমার সঙ্গে। উনার পাশে ইসমাইল এর মা নিরবচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছেন। ইফদিয়ার থেকে শুনেছিল তার মা এখনো প্যারালাইজড রোগী। শ্রেয়িতা গিয়ে মিসেস হালিমাকে সৌজন্যে বলে,
‘কাকীমা সরি ডাকতে পারি!’
‘হই মামুনি ডাহো।’
‘আমি কি আন্টিকে রুমে নিয়ে যেতে পারি।’
‘তা আর বলতে কি!’
লক্ষ্মীনা মিসেস হালিমাকে মাঝ কথায় থামিয়ে শ্রেয়িতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তুমি নিয়ে যাও মামুনি।’
মিসেস হালিমা শান্ত নয়নে পরখ করলেন মিসেস শ্রন্দনাথের দিকে। তিনি ইশারা করে আশ্বস্ত করলেন বিষয়টি। মিসেস হালিমাও চিন্তাহীন গল্পে মনযোগ দিল। ইফদিয়ার রুম থেকে ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছে। আনমনে শ্রেয়িতার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কেনো তুমি আমাদের ধর্মের হলে না! সনাতন ধর্মের হওয়ায় মুখ ফুটিয়ে বলতে পারি না ভাইয়ার কথা।’
উদাসীন মনকে চেপে রেখে দরজা ভিজিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। ফোন বের করে দেখে রুহিয়ার মিস কল। মেয়েটির সঙ্গে বোর্ড পরীক্ষার পর আর কথা হয়নি। না জানি কতটা না চিন্তিত ছিল! ভেবেই যেন ইফদিয়ার ফোন দিল রুহিয়াকে।
রুহিয়া তিয়ানার রুমের পাশে থাকে। তাদের কাজিনদের রুম পাশাপাশি হওয়ায় বোনকে খেয়াল রাখতে রুহিয়ার সমস্যা হয় না। দুপুরের লাঞ্চ টাইম আরম্ভ হয়েছে। ডাইনিং টেবিলে রুহিয়ার মা চেঁচিয়ে ডাকেন মেয়েকে। কেননা সকাল থেকে এখনো উপোষ ঘুরছে মেয়েটি। রুহিয়ার মা ভীষণ চিন্তিত থাকেন মেয়েকে নিয়ে। এমনি শুকনো গড়নের শরীর তার। এর উপর উপোষ থেকে দূর্বলতা আঁকড়ে ধরার ধান্দা পুষচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। পুনরায় মেয়েকে গলা চেঁচিয়ে খেতে ডাকলেন। রুহিয়া না পেরে খেতে গেল। মায়ের কাছে গিয়ে অনুনয়ী কণ্ঠে বলে,
‘মা আসর পেরিয়ে যাবে। নামাজ শেষ করে খাবো।’
রুহিয়ার মা করুণ কণ্ঠে বলেন,
‘একটু খেয়ে নে তারপর।’
তিনি নিজ হাতে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিলেন। রুমে তিয়ানার পাশে বসে আছে তিয়ানার মা। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। তিয়ানার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে। শরীরে যতটা গোটা করে চিকেনপক্স উঠে ছিল। এখন তার চেয়ে কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে শরীরের কয়টা জায়গায় চিকেনপক্স এর দাগ সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তিয়ানার দিকে ঘন পল্লব ফেলে তিয়ানার মা জিজ্ঞেস করেন।
‘ফোসকার দাগ কেনো!’
‘খুব চুলকা ছিল। সংযত করতে পারিনি।’
‘সুস্থ হয়ে যাবি মামুনি ইন শা আল্লাহ। খুব জ্বলছে কি!’
‘উঁহুম চুলকায় ঘুমালে ভীষণ যন্ত্রণা করে শরীরে।’
‘একটু ধর্য্য রাখ এখন খুব দেখা যাচ্ছে না শরীরে। লাল লাল ফোসকার প্রাদুর্ভাব ক্রমশ কমে এসেছে। নে অরেঞ্জ জুস খেয়ে নে।’
‘না আম্মু এসব হেল্থি ফ্রুটস খেতে ইচ্ছে করছে না। দিনকে দিন মুখের রুচিবোধ কমে যাচ্ছে। যথেষ্ট পরিমাণে ফল,শাকসবজি খাওয়ায়ছো। এবার ফুসকা এনে দাও না।’
‘এক চড় লাগাবো। ফুসকা তেলজাতীয় খাবার। খেলে যে ফোসকার জ্বালাতন বাড়বে সেটা জানিস!’
তিয়ানা কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিচু গলায় বলে,
‘যাও তুমি খাবো না কিছু আমি।’
তিয়ানার মা চেষ্টা করলেন তবুও তিয়ানা অসুস্থ দশায়ও নাছোড়বান্দা। মান্য করল না তার মাও চুপ করে চলে গেলেন।
৩২.
রুহিয়া জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের মধ্যে লাগাতার কল করে চলেছে। কিন্তু ইফদিয়ার ফোনে রিং হচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে রুহিয়া আনমনে বলে,
‘ইশ! এতদিন আমি ফোন দিয়েও পায় নি। আজ ওই নিজ থেকে দিল আর আমায় পায় নি। ফাঁটা কপাল রে বোন।’
রাত পোহালো শহরে ছেয়ে গেল নির্জনতা। পাখির কলকাকলী নিশ্চুপে নিমীলিত হলো। শুনা যেতে লাগে পেঁচার মুখের ক্ষীণ শব্দ। নিশাচর প্রাণী গাছের ডালে বসে বড় বড় অক্ষি ফেলে শহর পর্যবেক্ষণ করছে। তার মত নিশাচর হওয়ার অনুপ্ররেণা পাচ্ছে তিয়ানা। শরীরের জ্বালাতন মানসিকতাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও শান্তির স্বচ্ছতা বহমান। দীর্ঘ কয়েকমাস শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে। শুধু মাত্র ছোঁয়াচে রোগের কারণে। রোগটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের গহীনে বিদ্যমান। তবুও যেন রোগটি তাকে ছাড়ছে না। তিয়ানা মুখ ফুলিয়ে শুয়ে আছে। তার পেটে ইদুঁরের প্রাদুর্ভাব না হলেও গলায় পিপাসার্ত অনুভব করছে। তার মা ড্রয়ারের উপর অরেঞ্জ,ম্যানগো,বাটার-দুধ,সুপ রেখে ছিলেন। তার মুখে নিতে গা গলিয়ে আসছে। যাবত কয়েকমাস এসব খেয়ে যেন তার রুচিহীন মনে হচ্ছে। অন্যকিছু খাওয়ার কামনা মনে জেগেছে। হায় আপসোস! কোনো প্রেমিক পুরুষ নেই যে কিনা রাতের আঁধারে এসে বলবে, প্রিয়তমা দেখো তুমি চেয়ে ছিলে আমায়, চলে এলাম তোমার প্রাঙ্গণে। মনের ভাবনাকে কষ্ট করে ধামাচাপা দিল তিয়ানা। সে জানে তার জীবনে প্রেমিক পুরুষ বলতে কেউ নেই।
চট করে সজাগ হলো তার মস্তিষ্কের কোষগুলো। অকস্মাৎ ‘এরফান’ নামটি মনের কোণায় উচ্চারিত হয়ে উঠে। বিড়বিড়িয়ে অনুনয় কণ্ঠে বলে,
‘এরফান মানুষটি কোথায়! তাকে দেখিনা কতদিন কিন্তু লাগে সে আছে আশপাশ জুড়ে। আচ্ছা মানুষটার কি বিয়ে হয়ে গেছে। সে কি জানে আমি অসুস্থ!’
হৃদপিন্ডের ভালোলাগাটা নিমিশেষে বিষাদে রুপ নিল তিয়ানার। কারণ এরফান মানুষটির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল ক্ষুণ্ণ সময়ের। দীর্ঘস্থায়িত্ব বহন করার মত সময় নিয়তি তাদের দেয়নি। হয়ত মানুষটি এখন অন্য কারো। ভাবতেও যেন তিয়ানার অক্ষিপল্লবে নোনাজল ভীড় করে। মানুষটিকে ভালো না বাসলেও একটুখানি ভালোলাগা তৈরি হয়ে ছিল। তার স্বভাব, ব্যক্তিত্ব যেন রসিকতার মাঝে নেশাক্ত চাহনী ব্যক্ত করতো। তিয়ানা পুরুনো দিনের কথা স্মরণ করছিল।
তখনি রুমের দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। তিয়ানার রুমটা ছিল অন্ধকারাবৃত। কারো পায়ের কচকচানো শব্দে তিয়ানা ভাবে বোধ হয় তার মা এসেছে। মুখ না ফিরিয়ে মিহি গলায় বলে,
‘আম্মু প্লিজ যাও ডিস্টার্ব করো না। কিছু খেতে মন চাচ্ছে না। বিশেষ করে খাবার ড্রয়ারে সজ্জিত আছে। পরে খেয়ে নিবো।’
অন্যথায় ভাবলেশন রয়ে গেল আগুন্তুক এর পায়ের শব্দ। থেমে যায় পাজোড়া। তবুও সটান দাঁড়িয়ে রইল তিয়ানার বিছানার পাশে। তিয়ানার কথা শুনে উল্টো পায়ে হেঁটে দরজাটা শক্ত করে বেঁধে ছিটকিনি মেরে দিল। আকস্মিক ছিটকিনির শব্দে তিয়ানা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অাঁধারে মানুষটিকে স্পষ্ট দেখতে পারছে না তিয়ানা। অস্পষ্ট কণ্ঠে ভীতি মুখে প্রশ্ন ছুড়ে মারে আগুন্তুকের দিকে।
‘কে কে আপনি আ আর আমার রুমে কে কেনো এসেছেন!’
তবুও আগুন্তুকের পা থামল না সে স্বেচ্ছায় বিছানার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তিয়ানা মুখটা আগুন্তুক এর দিকে করে। অন্ধকারাবৃতে আগুন্তুক এর নয়নজোড়া প্রসারিত হয়েছে।তার চোখের মধ্যে অজানা আসক্তি অনুধাবন করতে পারছে তিয়ানা। নজর চেয়েও সরাতে পারছে না সে। আগুন্তুক এর চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া টেবিল লাইটের সুইচে রাখার চেষ্টা করে তিয়ানা। যেই সুইচবোর্ডে চাপ দিতে গেল তখনি আগুন্তুক লোকটি খিঁচে ধরে তিয়ানার হাত। কিন্তু আগুন্তুক নিজের অজান্তে তিয়ানার হাতের উল্টোপিঠ চেপে ধরেছে। যার ফলে তিয়ানার হাতের উল্টোপিঠে চিকেনপক্স এর ফোসকা ফেটে যায়। অল্প পরিমাণে পানি হাতের উল্টোপিঠে ভরে যায়। আগুন্তুক লোকটি দেখে ছলছল দৃষ্টিপাত তিয়ানার হাতের দিকে রাখে। অস্পষ্ট নজরে আহত কণ্ঠে আগুন্তুক বলে,
‘বেশি ব্যথা করছে ওয়েট মলম এনেছি। চুলকানি কমে যাবে।’
তিয়ানার কাছে কণ্ঠটা যেন চিরপরিচিত মনে হলো। সে এক ধ্যানে আগুন্তুক এর চেহারা দেখার চেষ্টা করে। ডান হাত আগুন্তুক এর গ্লাভস পরিহিত হাতে আবদ্ধ থাকায়। তিয়ানা বাঁ হাত দিয়ে আগুন্তুক এর মুখ স্পর্শ করে। তার মুখে মাস্ক বুঝতে পেরে তিয়ানা। চিহ্নিত করার প্রয়াসে ঢোক গিলে বলে,
‘এরফান আ আপনি নয় নয়তো!’
আগুন্তুক মুচকি হাসল। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে সে। তিয়ানার শ্রবণন্দ্রিয়ে অনুভব করে আগুন্তুকের হাসিটা আর ফোঁস করে উঠে ফুঁপানোটা। তিয়ানা বোকার মত চোখ করে চেয়ে আছে। আগুন্তুক এবার নিজে টেবিল লাইটের সুইচে চাপ দিল। পুরু রুমটা নিভু পরিমাণে জ্বলে উঠে নীল রঙের ডিম বাতিতে। তিয়ানা খেয়াল করে আগুন্তুক এর মুখে মাস্ক আর চোখজোড়া উম্মুক্ত নেশায় ভরে আসে। যার পূর্ণ দৃষ্টিপাত তার উপর। আগুন্তুক ফিসফিস কণ্ঠে বলে,
‘চিন্তে করো না। তোমায় ছাড়া চিরকুমার থাকতে রাজি। কিন্তু তোমায় পেলে বরপ্রেমিক হয়ে প্রেমগাথা রচিত করতে পিছপা হবো না।’
তিয়ানার বুক কেঁপে উঠে। আগুন্তুক যে এরফান এবার নিশ্চিত হয়ে গেল। সে খানিক পিছিয়ে গেল। এরফান স্মিত হেসে তিয়ানার পাশে হাটুগেড়ে বসে।
আহত দৃষ্টিতে এরফান কান্নাময় কণ্ঠে বলে,
‘তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকারবোধ নেই। তবে শিগ্রই সেই অধিকার হাসিল করতে ওতপ্রোত হবো।’
তিয়ানা অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে বোকার মত প্রশ্ন করে।
‘কিসের অধিকার!’
এরফান দুষ্টু হেসে বলে,
‘আদর করার।’
তিয়ানা বিস্ফোরিত চোখে এরফান এর দিকে তাকায়। চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। এরফান অট্টহাসি দিয়ে বলে,
‘আদর পরে এই নাও তোমার জন্যে সুস্বাদু লাচ্ছি।’
লাচ্ছি পান করার সম্পর্কে তিয়ানার ধারণা নেই। নাক ছিটকানো ভান করে ইয়াকি করে বলে,
‘পচাঁ লাগছে কেনো!’
এরফান ইশারায় খেতে বলে। তিয়ানা চোখ নিমীলিত করে ঠান্ডা লাচ্ছি পান করে। করার পর যেন শরীরের শিরা উপশিরায় ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। পিপাসাও যেন মিটে গেল তিয়ানার। চোখ উম্মুক্ত করার পর খেয়াল করে এরফান নেই। তার ছোট চিরকুট রেখে গেল। তিয়ানা সেটি খুলে পড়ে।
‘তৃষ্ণার্থ প্রেয়সী নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ুন।’
হেসে দিল তিয়ানা। যে হাসি ছিল প্রাণবন্ত।
দূর থেকে সেই হাসি দেখে এরফান এর হৃদয়ও যেন প্রাণচঞ্চলতা পেয়ে গেল। তিয়ানার অসুস্থতা শুনার পর অস্থীর হয়ে পড়ে ছিল সে। রাত-বিরাতে অসুস্থতা কমেছে কিনা পরখ করা ছিল তার নিত্য রুটিন। অবশ্য এ বিষয়ে তার বন্ধুগণের ধারণা নেই। এরফান হেলমেট পরে বাইক চালু করে চলে যায়।
৩৩.
যাবিয়াজ মাথায় হাত চেপে বসে আছে। সে আজ বাসায় ফিরেছে। ক্যানভাস থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। তার বাবাকে সুখবর দিতে যে তারা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারবে। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার থেকে অনুমতি পেয়েছে। ডক্টর লিও যাবিয়াজকে আশ্বস্ত করেছে তার বাবার সুস্থতার।
যখন সে তার বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিষয়ে আলাপ করছিল। তখন বাসার ডোরবেল বেজে উঠে। যাবিয়াজ সদায়িত্বে দরজা খুলে দেখে ক্যানভাসের কর্মচারী এসেছে। হাতে তার একজোড়া ফাইল।
যাবিয়াজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে।
‘এই ফাইল!’
‘জগৎ শন্দ্রনাথ পাঠিয়েছেন। আপনাকে খ্যাতনামা ডাক্তার বাবুর এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করা হয়েছে। সে জন্যে ডাক্তার বাবুর তথ্য ফাইল দেখতে বলেছেন।’
যাবিয়াজ মুখ গোল করে ‘ওহ’ বলে ফাইলটি নিয়ে বিদায় জানায় কর্মচারীকে। সে রুমে ফাইলটি রেখে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ড্যাড সামনের সপ্তাহের রবিবারে টিকেট বুক করেছি। অনুরোধে তোমার অপারেশন ডেইট পিছিয়েছি। যেহেতু আমি ক্যানভাসে দায়িত্বরত আছি। সেহেতু সেখানের দায়িত্ব জলদি শেষ করার চেষ্টা করব।’
রবিউল সাহেব মুচকি হেসে বলেন,
‘তোর সুবিধামত গেলে যাব।’
কি মনে করে যেন তিনি যাবিয়াজকে পুনরায় বলেন,
‘ওই যাবিয়াজ তোর কোনো স্টুডেন্ট আছে!’
বাবার মুখে কথাটি শুনে বিস্মিত হলো সে। বিস্মিত কণ্ঠে যাবিয়াজ বলে,
‘ড্যাড আমি নিজেই এখনো ছাত্র। সেখানে আমার ছাত্রী থাকবে কেমনে!’
রবিউল সাহেব সন্দেহ প্রবণ দৃষ্টান্ত নিয়ে বলেন,
‘তাহলে ইফদিয়ার মেয়েটা কে!’
যাবিয়াজ ঘাবড়ে গেল। কিন্তু পুনরায় বিস্মিত হলো মেয়েটির নাম তার বাবার মুখে শুনে। কোনো ভাবে মেয়েটি তার বাবাকে সবকিছু বলে দেয় নি তো। ঢোক গিলে সে শান্ত গলায় বলে,
‘ওর সঙ্গে অপরিচিত্ব সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।’
রবিউল সাহেব ছেলের তীক্ষ্ম খিটখিটে কথায় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে। তিনি স্মিত হাসি দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
‘তোকে বলতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। মেয়েটি বাসায় এসেছিল। আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল।’
যাবিয়াজ বিস্তারিত চোখে বাবাকে আঁকড়ে ধরে উত্তেজক কণ্ঠে বলে,
‘কি হয়েছিল তোমার ওই মেয়েটা কি করেছে তোমায়!’
রবিউল সাহেব আকস্মিক আক্রমণে ধমকে দিলেন ছেলেকে। তাকে পুরু ঘটনা খুলে বলার পর যাবিয়াজ কিছুটা অনুতপ্ত হলো। বাবাকে রুমে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।
কিন্তু ফাইলটি ঘাঁটতে গিয়ে আসল সত্যতা তার চোখে ধরা দিল। ধপ করে বিছানায় বসে। আনমনে অনুশোচনাময় কণ্ঠে বলে,
‘তবে কি আর ক্ষমা পাবো না।’
যাবিয়াজ উক্ত কথা বলার কারণ হলো ফাইলটি।
নতুন ডাক্তার এর তথ্য দেখার আগে ছবিটিকে দেখে চমকে গেল। কারণ ছবিটি হলো ইসমাইল এর। আর এই ছবির মালিককেই ঐদিন ইফদিয়ার সঙ্গে সিএনজিতে বসতে দেখেছিল সে। ঐদিন গাড়িটি ছিল তার। ছেলেটিকে দেখে তার মনে অজানা ভয় গ্রাস করে। একে একে পুরু ফাইল দেখে এক লাইনে এসে তার চোখ আঁটকে গেল। লাইনটি ছিল এরকম।
‘পরিবার- মা মিসেস জাবিয়া খাতুন, কাকীমা মিসেস হালিমা বেগম আর বোন মিস ইফদিয়ার বুহিয়ান।
‘ইফদিয়ার বুহিয়ান’ নামটি পড়ার পর যাবিয়াজ এর বুঝতে বাকি রইল না। সে কত বড় ভুল করে বসেছে। ঢোক গিলে পণ করল সে। যত হোক ইফদিয়ার সঙ্গে তার কথা বলতে হবে। সিদ্ধান্তে টান নিয়ে নিদ্রার ব্যবস্থা করল। তার ভেতরের হৃদপিন্ড অতিরিক্ত পরিমাণে লাফাচ্ছে। ইফদিয়ার কে আজও দেখেছিল ফজরের নামাজের পর। তখনো যা নয় তা হলে অপদস্থ করে ছিল মেয়েটিকে।
ফজরের শেষাক্ত সময়ের ঘটনা…
ইফদিয়ার তলপেট ব্যথা করছিল।
ফলে একটি ন্যাপা এক্সট্রা খেয়ে ছিল। যাতে তলপেটের যন্ত্রণায় জ্বর না আসে।
বালিশে মাথা রেখে প্রশান্ত পাওয়ার জন্যে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকের উপর ফুঁ দিল। চোখজোড়া নিমীলিত করার পূর্বেই দরজায় ক্ষুণ্ণ পরিমাণে কটকট শব্দ হলো।
ইফদিয়ার ব্যর্থিত হয়ে দরজা খুলে দেখে ইসমাইল এসেছে। ভ্রু কুঁচকে ভাইকে জিজ্ঞাসা করে।
‘কিছু লাগবে ভাইয়া!’
‘না তবে শুন। আজ ভোরে আমার এক আঙ্কেলের বাসায় যাব। কয়েকদিন সেখানে থাকতে হবে। রেডি হতে বললে হয়ে নিস।’
ইফদিয়ার মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে জানে তার ভাই দায়িত্বভার নিয়ে মা-কাকীমাকেও বলেছে কথাটি। ফজরের সময়ে ঘুমটা নিমূল্যে ভেঙ্গে যায় ইফদিয়ার। উঠে দেখে পুরু ঘরটা নিস্তদ্ধ। কারণ পরম আয়েশে সকলে নিদ্রামগ্ন। শুধু তারই নিদ্রাভঙ্গন ঘটেছে। সঙ্গে শুরু হলো পেটের যন্ত্রণা। ঘুমালে যেন যন্ত্রণার ছিঁটেফোটাও অনুভব হয় না। কিন্তু সজাগ হলেই আরম্ভ হয় ব্যথা। ইফদিয়ার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস ফজরের দিকে ঘুম ভাঙ্গার। তেমনি আজও ব্যতিক্রম হলো না। তবে তার নামাজ নেই। সে ভাবল একটু বাহিরের গলিতে হাঁটলে মন্দ হয় না।
ইফদিয়ার নিজের ভাবনাকে আঁকড়ে বোরকা পরে আর উড়না ঘোমটার মত মাথায় দিয়ে নিশব্দে বের হলো। দরজাটা আলগা করে বন্ধ করে চাবি নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। গলির বাহিরে একটি পার্ক আছে। যেখানে ফজরের পর মানুষ হাঁটাহাঁটি করে। পূর্বেও এ পার্কে সে এসেছিল। আজও এসেছে প্রশান্তি লাভের আশায়।
অলংকৃত হয়ে ভোরাবৃত আকাশে তারারা ঝিকিমিকি পোকার ন্যায় জ্বলছে। কবির মত করে ইফদিয়ার মনমাতানো কণ্ঠে আবৃত্ত করে উঠে।
‘রাত জাগা পাখি হয়ে যাওয়ার কথা ভাবি
এই মনে একা একা আপনার ছবি আকিঁ
জোৎস্নার নীল আলো আপনার চোখে ভাসে
প্রিয় হয়ে থাকবেন কি চিরঞ্জীব!
ভোরের প্রথম সোনালী আলো
স্বপ্ন নতুন জাগিয়ে গেলো।
শিশির ভেজা ঘাসের পাতায়
আপনার হাতের আলতো ছোঁয়ায়
ফুটলো সকাল,কাটলো রাত
তাই মিষ্টি মুখে প্রিয় মানবকে জানাতে মন চাই
সুপ্রভাত প্রিয়।’
হঠাৎ তালির শব্দে চমকে গেল ইফদিয়ার। সীমিত পরিমাণে তালি বাজিয়েছে যুবকটি। ইফদিয়ার চোখে পূর্বের স্মৃতির ন্যায় স্বচ্ছ অশ্রুজল চলে এলো। প্রিয় মানুষের চোখে ঘৃণা কোনো প্রেয়সী সহ্য করতে পারে না। ইফদিয়ারও পারছে না। সে জানে সত্য বললেও যাবিয়াজ বিশ্বাস করবে না। যুবকটি অন্য কেউ নয় যাবিয়াজ। তার চোখ-মুখে রাগান্বিত আভা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইফদিয়ার বুঝতে অক্ষম কেনো সে এত রেগে আছে!
যাবিয়াজ পাশে এসে কর্কটক্রান্তি মোড়ে গলা চেঁচিয়ে বলে,
‘নাগরের জন্যে বুঝি বেশি দরদ উতলে পড়ছে। আহা কি টুরু লাভ! তো কোন নাগরের সঙ্গে দেখা করতে সাঁঝসকালে চলে এলে। আগেরটা বুঝি সুখ কম দিয়েছে।’
ইফদিয়ার চরম আক্রোশে ফুলে উঠে। একে তলপেটের ব্যথা তার উপর যাবিয়াজ এর নোংরা বাজে কথায় তার মনটা রুক্ষতায় ছেঁয়ে গেল ইফদিয়ার। কষিয়ে যাবিয়াজ এর গাল বরাবর বসিয়ে দিল নরম হাতের তীক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ চড়। অমার্জিত কথার উচিৎ জবাব দিতে রুক্ষ মেজাজে ইফদিয়ার যাবিয়াজ এর কলার চেপে ধরে বলে,
‘আপনার মত নিচু মনের মানুষ কে ঘৃণা করি বুঝছেন। কি ভাবেন হে শুধু আপনার অনুভূতি আছে! আগে বেহায়া ছিলাম বলে শুধু আপনার পিছে ঘুরতাম। তবে এখন সেই বেহায়ার ছিঁটেফোটাও আর দেখবেন না। সত্য কি বিচার করে দেখার পর অনুশোচনা ভোগবেন। সেদিন চাইলেও আমি ফিরব না নেভার।’
চৌপাশে মানুষের চলাচল কম হওয়ায় কেউ টের পেল না। যাবিয়াজ এর কাছে ইফদিয়ার তীক্ষ্ম কথাগুলি তার বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মেজাজ বিগড়ে চুরমার করে দিয়েছে। সে রক্তিম আভা নিয়ে ইফদিয়ার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলে,
‘তোর সাহস কেমনে হয় যাবিয়াজ মেশরাফ এর গালে চড় মারার। এর শোধ দেখ কেমনে দেয়।’
যাবিয়াজ ইফদিয়ারকে টেনে ইচ্ছাকৃতভাবে পঁচা নর্দমায় ফেলে দিল। যেহেতু নর্দমায় পানি কম ছিল। সেহেতু ইফদিয়ার ডুবে যায়নি। তবুও তার শরীর উৎকট দুর্গন্ধময় হয়ে গেল। ফলে ইফদিয়ার নিজেই নাক ছিটকে ঘৃণ্য নয়নে যাবিয়াজ এর দিকে তাকায়। সে ইফদিয়ার সম্মুখে হাটুগেড়ে বসে বাঁকা হেসে বলে,
‘বলেছিলাম কোনো একদিন তোমায় পঁচা ডোবায় চুবাবো। তবে পুরুপুরি না চুবালেও তুমি নিজেই চুপছে গেলে নর্দমার পানিতে। যাক শোধ পূর্ণ হলো ইফদিয়ার ডার্লিং। আজীবন মনে রাখবে আমাকে দেওয়া চড়ের শাস্তি।’
ইফদিয়ারকে ফেলে যাবিয়াজ তীক্ষ্ম মেজাজ শান্ত করে চলে যায়। ছোট অবুঝ মেয়েটির মন যে কত পরিমাণে ক্ষত হলো সেটা কেউ জানে না। ইফদিয়ার পরণের জামা নর্দমার পানিতে ভিজে চুপছে গেল। কোনো মতে মানুষের চুক্ষগোচরে গলির ভেতরে চলে এলো। আসার পথে একটি টিউবওয়েল পেয়ে ছিল। সেখান থেকে নিজের শরীর থেকে নর্দমার ময়লা পানি ছাড়িয়ে বাসায় চলে আসে। পরিচ্ছন্ন হয়ে ভেজা পোশাক ধুয়ে শুকাতে দিল। ঘরের সবাই ঘুমন্ত থাকায় কেউ পরখ করেনি ইফদিয়ারকে। শক্ত মনে সে শুয়ে পড়ে। কারণ ঘণ্টাখানিক পরে তার ভাইয়ের কথামত রেডি হতে হবে। চোখ বুজলো ঠিকি কিন্তু চোখের কোণা বেয়ে বেদনার অশ্রুসিক্ত হলো।
বর্তমান….
যাবিয়াজ ঘুমানোর তীব্র চেষ্টা করে গেল। তবুও ঘুম হানা দিচ্ছে না। অথচ একরাশ দ্বিধা, অনুশোচনা তার মধ্যে জোড়ে বসেছে। ভয়-ভীতি আজ তার মনের গহীনে জোড়া বেঁধেছে। প্রিয় মানুষের কথার উপর বিশ্বাস না করে চোখে দেখা বিষয়ে বিশ্বাস করে নিল সে। মনের কোণায় প্রথমবার যাবিয়াজ বলে উঠে।
‘চোখের দেখা সব সময় সত্যি হয় না,
আর যা দেখা যায় না তা মিথ্যা হয় না।
জীবনে অনেক সত্য আছে যা চোখের
আড়ালে থাকে,
কিছু সত্য অনুভব করে বুঝতে হয়!
তবুও অবুঝ মন বোঝেও না বোঝার ভান করে।
হয়তো এটাই নিয়তি।’
যাবিয়াজ এর মনের রক্তক্ষরণ হবার উপক্রম। না জানি কালকের ভোর তার জীবনে কোন দিক বয়ে আনে।
চলবে….
(