অস্তিত্বে চাই তোমার ছোঁয়া পর্ব -২০+২১

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#বোনাস_পর্ব

৩৪.
তিয়ানা ক্ষিপ্ত মেজাজে পায়চারী করছে। হাতে ঘড়ি থাকায় পরপর সময় দেখছে। তার থেকে কিছুটা দূরে রকিং চেয়ারে বসে আছে রুহিয়া। তিয়ানাকে রুমের এদিক থেকে ওদিকে বারংবার চলাফেরা করতে দেখে বিরক্তবোধ করল। রুহিয়া রূঢ় কণ্ঠে মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘আবে তিয়ু শুন না কি চিন্তা করছিস। আমার সঙ্গে কোথায় শেয়ার করবি তা নয়! উল্টো নিজের পায়ের তেরোটা বাজাচ্ছিস।’

তিয়ানা উদাসীন দৃষ্টি নিয়ে রুহিয়ার দিকে তাকায়। রুহিয়া দেখে মুখ ফুলানো বাদ দিয়ে গম্ভীর ভাব করে বলে,

‘লুক আমাকে না বললে সমস্যার সমাধান পাবে কেমনে হুম!’

‘বোইন আমার শুন ইফদিয়ার কে ভীষণ মনে পড়ছে।’

রুহিয়া কথাটি শুনে থম মেরে দাঁড়িয়ে যায়। তিয়ানার চৌপাশ ঘুরে দাঁতে কিড়মিড় করে বলে,

‘আরে বলদী একবার বললেই পারতি। ইফদিয়ার আসতে কি বেশিক্ষণ লাগতো!’

‘লাগবে সময় কারণ ইফদিয়ার ভাইয়া যশোরের কেশবপুরে ট্রান্সফার হয়েছেন কাজের সূত্রে। উনাদের আগের বাসা বর্তমানে খালি পড়ে আছে। আর তুই জানিস মনিরামপুরে উনাদের নিজস্ব বাসা আছে। কাজের সূত্রে ভাইয়ার থেকে বাসা তালাবদ্ধ করে যেতে হয়েছে।’

রুহিয়া উন্মাদনার ন্যায় হা করে বলে,

‘আমি স্কুলে গিয়েও এ ব্যাপারে অবগত হলাম না। কিন্তু তুই ঘরে বসে কেমনে কি!’

তিয়ানা হুহু করে হেসে বলে,

‘ইফদিয়ার দোস্ত আমার। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না যথার্থ। তথাপি মোবাইলে প্রতিদিন ভিডিও কল, অডিও কল হয়েই থাকে।’

রুহিয়া শুনে সরু দৃষ্টিপাত নিয়ে এগিয়ে গেল তিয়ানার। যা সে চৈতন্যে ভাবে ধরতেই রুহিয়ার দিকে নজর দিল। তার বোনের কড়া নজর দেখে আমতা আমতা করে বলে,

‘হয়ছে তুই টাকা পেয়ে যাবি। দোস্তের সঙ্গে একটু আধটু বলতে ওই আরকি। তোর ফোনের ব্যালান্স নিয়ে কথা বলছি।’

রুহিয়া মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে পুনরায় চেয়ারে বসে পড়ে। আহত নয়নে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

‘এতদিন ভাবতাম আমার ব্যালেন্স বুঝি সার্ভিস খাইয়া ফালাই। এহন তো দেহি আসল আসামী তুই। আমার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যালেন্স আমারই চোখ ফাঁকি দিয়ে মারিস।’

তিয়ানা অট্টহাসি দিয়ে পেটে হাত রেখে ফুলা মুখ করে বলে,

‘সরি রে বোইন। বেহেন হমু মে বাড়াই কামিনী। বান্ধবীর সঙ্গে একটু আধটু না কথা বললে প্রাণবায়ু উড়াল মারার উপক্রম হয়। যেহেতু আম্মু ফোন ধরতে দেয় না। তাই চুরিচুপে তোরটাই শেষ করা লাগে।’

‘ধুর তোর জ্বালায় আমার টাকা খরচ হয়।’

‘এক কাজ কর খাতায় তোর খরচের হিসাব উঠিয়ে রাখ। সুস্থ হলে শোধে আসলে চুকিয়ে দিবো।’

‘মাইয়া রে ও মাইয়া রে তুই অপরাধী রে,
আমার যত্নে করা ব্যালেন্স দেয় ফিরাইয়া দেয়।’🙂

‘দিবো তোকে কোটিপতি জামাই দিবো রে।’

তিয়ানা বাণীটি রুহিয়ার কান বরাবর ছুঁড়ে মেরে চুপটি করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। রুহিয়া বোনের কথায় চটে গেল। ‘তিয়ুউউউ’ বলে চিৎকার দিল। ওয়াশরুমে রুহিয়ার চিৎকার শুনে দরজায় ভর দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে। বিড়বিড় করে বলে,

‘পাগলী বোন একটা।’

তিয়ানার মতে ইফদিয়ার পর যদি কেউ তিয়ানার সঙ্গে ফাজলামি করতে পারে সে হলো রুহিয়া।লেখিকা তামান্না(আল রাইয়ান)

_______

ইসমাইল প্রথমবার এনজিও ক্যানভাসে পা রেখেছে। এনজিও প্রবেশদ্বারের দুপাশে ফুলের পাপড়ির থলি নিয়ে বরণ করার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের দেখে ইসমাইল দৃঢ় শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নরম করে এগিয়ে গেল। যাবিয়াজ দলের প্রধান মূখ্যকর্তা হওয়ায় ইসমাইল এর সঙ্গে কুশলাদি তারই প্রথম করতে হবে। ইসমাইলকে দেখে যাবিয়াজ এর যেখানে স্বাভাবিক থাকতে হবে। সেখানে তার ভেতরে চলছে সমীহ-আশঙ্কার যুদ্ধ। ঠোঁট কামড়ে মনে মনে ভাবে।

‘আল্লাহ আগে কেন সৎবুদ্ধি দান করো নি। ইসমাইল যে আমার বড়শালা হয়। আগে জানলে কখনো ইফদিয়ার কে দূরে ঠেলে দিতাম না। শেহ যাবিয়াজ তোর মত বলদ আসলেই কেউ নেই। ইসমাইল ভাই যদি আমাকে চিনে ফেলে! ওয়েট ইফদিয়ার কি আমার ব্যাপারে তার ভাইকে জ্ঞানতত্ত্ব দিয়েছে।’

এবার নিজের মনে কথাগুলো আউলে ভীষণ আতঙ্কে উঠল যাবিয়াজ। সে মনের কথা মনে বলেছে যেন নিজেকে শক্ত করে স্বাভাবিক রাখতে পারে মতন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে শক্ত কম উল্টো আশঙ্কায় কেঁদে ফেলার মত অবস্থা।

এনজিও ক্যানভাসের মেয়েরা ইসমাইলকে দেখে হৈচৈ শুরু করে দিল। কারণ ছেলেটা দেখতে, শুনতে কোনোভাবেও মন্দ নয়। বরঞ্চ নজর কাড়ার মত রুপ তার। পুরুই চকলেট বয় লাগছে ছেলেটিকে। মেয়েরা ইসমাইল কে দেখে সামনে এগিয়ে যায় অটোগ্রাফ নিতে। এতে বেচারা ইসমাইল এর নাজেহাল অবস্থা। এতগুলো মেয়েকে হাত দিয়ে ঠেলতে তার রুচিতে বাঁধছে। নিজেকে শক্ত রেখে নম্র কণ্ঠে সকল মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আপনারা নিশ্চিতে অটোগ্রাফ পাবেন। তবে পরে আমি এখানেই আছি আপনাদের ট্রেনিং দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে ক্যানভাসে এসেছি।’

ভার্সিটির হেডমাস্টার আর জগৎ শন্দ্রনাথ সরলতায় ক্যানভাসের হল রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উনারা জানালা থেকে ইসমাইল এর গাড়ি দেখে অবগত হলেন। ক্যানভাসের প্রবেশদ্বারে ভীড় দেখে জগৎ শন্দ্রনাথ তার পুত্র সেনগুপ্ত কে আদেশ করেন।

‘সেনবাবা মাইক নিয়ে ভীড় কমানোর ব্যবস্থা করো। ইসমাইল বাবার ভীড়, ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি একদম অপছন্দের। কোনো না আবার ক্রোধান্বিত হয়ে ফিরে যায়। শিগগিরি যাও।’

সেন আর রৌশ হলো জগৎ শন্দ্রনাথ এর ছেলে। তারা দুজন বাবার সঙ্গে এনজিও পরিচালনা করে। এরা দুজনই হলো শ্রেয়িতার ভাই। সেন তার বাবার আদেশ মোতাবেক মাইক নিয়ে উচ্চ শব্দে বলে উঠে।

‘সবাই দূরে সরে আসো। না হলে কঠিন শাস্তি দিতে বাধ্য হবো।’

ছেলেমেয়েরা উল্লাসী মনোভাব তখনি ধুর করে ফেলল মন থেকে। এক নাগাড়ে পিছে সরে আসে ইসমাইল এর কাছ থেকে। সে যেন এবার অক্সিজেন নেওয়ার ব্যবধান পেল। মেয়েরা যেন তার শরীরের পাশ ঘেঁষে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে উতলে পড়ে ছিল। যাবিয়াজ এর কাছে দৃশ্যটি মজার লেগেছে। ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে এরফান আর ফেরদৌস একই দৃশ্যপটে হাসি নিয়ন্ত্রণে মুখে হাত দিয়ে রাখে।
ইসমাইল নিজের শার্টের বাহুর ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে এলো ছাত্রদের সন্নিকটে। ইতিমধ্যে যাবিয়াজ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বুকটাও লাফানো শুরু করে দিয়েছে। ইসমাইল তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। দুজনের স্থীর চাহনী একে অপরের দিকে আবদ্ধ। কাঁধ থেকে কাঁধ বরাবর একই ভঙ্গিতে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিকোণ যেন তাদের মাঝে আবদ্ধ। ইসমাইল নিজ উদ্দিনে হাত এগিয়ে আহ্লাদময় কণ্ঠে বলে,

‘আসসালামুয়ালাইকুম আমি ইসমাইল বুহিয়ান। আপনি নিশ্চয় যাবিয়াজ মেশরাফ!’

যাবিয়াজ ক্ষণপরে দৃষ্টি সরিয়ে ইসমাইল এর হাতের দিকে রাখে। মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে বলে,

‘বড় শালাবাবুকে বউ এর নাগর বলে কত না অপদস্থ করেছি। সেই শালার সঙ্গে ছাত্রের মত হাত মিলাবো। ভবিষ্যৎ এ এই হাত ছোঁয়ে তারই বোনের হাত চাইতে কেমনে যাবো! যেদিন আমার সম্পর্কে জ্ঞানপূর্ণ হবে। সেদিন এই হাতজোড়া দিয়ে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করবে না শালাবাবু।’

মনের কথাগুলি ভেবেই ক্ষীণ কাঠিন্যতা যাবিয়াজ এর মনবৃত্তিকে ক্ষিপ্রতায় ঘিরে ধরেছে। একরাশ আশঙ্কাকে ক্ষণিক সময়ের জন্যে দূরে ঠেলে যাবিয়াজ শুকনো হাসি দিয়ে হাত মিলায়। ঠোঁট নাড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম জ্বী স্যার আমিই যাবিয়াজ। আপনার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগকৃত।’

ইসমাইল ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে যাবিয়াজ কে বলে,

‘হুম আমার সঙ্গে কেবিনে এসো।’

যাবিয়াজ এর সঙ্গে থাকা এরফান ফেরদৌস একে একে সকলে স্বাগত শুভপূর্ণ করায় ঝেঁকে ধরে। ইসমাইল এবার শান্তিভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলে নিজ কেবিনে এলো। জগৎ শন্দ্রনাথ স্বয়ং কেবিনটি তৈরি করেছেন ইসমাইল এর জন্যে। দরজার বাহিরে নেইমপ্লেট দেওয়া ‘ইসমাইল বুহিয়ান’। ইসমাইল নিজের প্রাপ্তি সর্বাঙ্গে দেখতে পাচ্ছে। যে ইসমাইল একসময় এতিম বলে পাত্তাহীন ছিল। সে ইসমাইল আজ মানুষের মুখরচিত হয়ে বেড়ায়। অদ্ভুত দুনিয়ার নিয়মনীতি! তাচ্ছিল্যের হাসি দিল ইসমাইল।
কেবিনে ঢুকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। তার সঙ্গে পিছু এসেছে যাবিয়াজ, এরফান আর ফেরদৌস। অন্যদের আসা বারণ করে দিয়েছে জগৎ শন্দ্রনাথ। ইসমাইল কে চোখ বুজা অবস্থায় দেখে যাবিয়াজ গলা খাঁকড়ি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস করে। ইসমাইল চোখ উম্মুক্ত করে তিনজন ব্যক্তির দিকে চোখের নজর রাখে।
খুঁতখুঁতে মন নিয়ে মুচকি হেসে এরফানকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করে।

‘সো ব্রো তুমি পরিচয়টা দাও। তার পর তুমিও দিও। এন্ড সরি তুমি সম্বোধন করায়। বয়সে দরুণ ছোট। তদনুযায়ী তোমাদের তুমি করে ডাকলে আই হোপ নট হেভ এনি প্রব্লেম!’

‘নো স্যার উই উইল রেসপেক্ট ইউর টকিং। আমি এরফান হোসেন আর এই আমাদের আরেক বন্ধু ফেরদৌস শেখ।’

এরফানের কথার বিপরীত প্রতিক্রিয়া নিয়ে যাবিয়াজ সুপ্ত কণ্ঠে বলে,

‘স্যার উই থ্রি আর হাইয়ার্ড ফর ইউ স্যার।’

ইসমাইল শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘ডোন্ট কল মি স্যার। বয়স ম্যাটার না মন ভালো আর সায় দিলে তুমি-তুই করে কথা বলাটা ব্যাপার না। সবচেয়ে বড় কথা বন্ধুত্ব।
‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি তোমাদের তিনজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ রুপে জড়িত। কেউ কাউকে দুঃখ ভাগাভাগি করে যেমন থাকো না তেমনি সুখ পেলে সেটা নিয়ে সেলেব্রেশন করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু জানো তোমাদের তথ্য স্টাডি করতে গিয়ে কি জেনেছি!’

ফেরদৌস ভীতি মুখর দৃষ্টিতে ইসমাইল কে দেখে বলে,

‘কি জানলেন!’

‘জানছি যে তোমরা বিপদেও একে অপরের সঙ্গ ছাড়ো না। এমন বন্ধুত্ব পাওয়া দুরুহ সমাজে। এখন তো কে কাকে মেরেধরে স্বার্থ হাসিল করবে তার পিছেই পড়ে থাকে।’

যাবিয়াজ,এরফান আর ফেরদৌস একে অপরের দিকে বিস্ময়ময়ী হয়ে তাকাচ্ছে। তাদের মনে প্রশ্নের সঞ্চার মগজ ফেটে যাওয়ার প্রারম্ভে অবস্থান করছে। যাবিয়াজ এর মনে একটি বুদ্ধি চলে এলো। সে ইতস্ততঃ বোধ কাটিয়ে চট করে একটি প্রস্তাব রাখে ইসমাইল এর সামনে। কেবিনে থাকা চারজনের মধ্যে তিনজনের মুখে বিস্ময় চেহারা ফুটে উঠল। ইসমাইল বাদে দুজনের মুখ যেন হ্যাবলার মত হয়ে গেল। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে। তারা অসময়ে মুখ উতলে বলতে চাচ্ছে।

‘কি ভূতের মুখে রাম নাম! সূর্য পশ্চিমে আকাশে উঠেছে।’

এমনি সব আবুল-তাবুল বকার মত মুখ করে আছে এরফান আর ফেরদৌস। ইসমাইল গম্ভীর চাহনি পাল্টে হাসিমুখে বলে,

‘ওকে তোরাই আজ থেকে আমার আপন বন্ধু।’

যাবিয়াজ যেন মেঘ না চাইতেও জল পেয়ে গেল। ইসমাইল এর চুক্ষগোচরে শয়তানি হাসি দিয়ে ইফদিয়ার নামটি স্মরণ করে বলে,

‘অপ্সরীমনির পর্বত সমমাত্রিক অভিমানে ভাঙ্গন ধরাতে সময় লাগবে। কাঠখোট্টা সহ্য করতে হবে। যেহেতু আমিই দোষী সেহেতু শাস্তি পেয়ে উসুলও করব অপ্সরীমনি। কিন্তু একপাক্ষিক বিয়ের জন্যে জব্দ করে নেবো তোমার প্রাণপণ ভাইরে।’

ইসমাইল খুশি হলো তিনজনের আদিক্ষেতা আর ব্যক্তিত্ববোধের উপর। সে মূলত কাজে মনযোগ দেওয়ার জন্যে তিনজনকে যাওয়ার পরামর্শ দিল। যাওয়ার আগে যাবিয়াজকে ডাক দিল ইসমাইল। পুনরায় তার সামনে এলে ইসমাইল বলে,

‘তোমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্লাস কখন! লেকচার দিয়ে তারপর না হয় ল্যাবে বায়োজেনেটিক প্রক্রিয়া শিখাতে পারব।’

যাবিয়াজ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে কাগজ বের করে। তার পকেটে রুটিন এর কাগজ সবসময় থাকে। যেনো কেউ যদি ক্লাস সমেত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তখন যেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কথার জবাব দিতে পারে মত। কাগজটি দেখে যাবিয়াজ বলে,

‘তোর লেকচার ক্লাস দুপুরের পর, প্রশিক্ষণ ক্লাস দিনের ৪টা ৩০ মিনিট এ। ল্যাব ভ্রমণ করে প্রশিক্ষণ ক্রিয়াকলাপ দেখাতে চাইলে রাতের ৯টায় এনজিও তে উপস্থিত থাকতে হবে।’

ইসমাইল শুনে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

‘ওহ পেশেন্ট এর কি খবর কত হারে সুস্থ-অসুস্থ হয়ে এসেছেন, গিয়েছেন!’

‘এখন অব্দি ৪০% সুস্থ হয়ে রোগী নিজ বাসায় ফিরেছে। আর এসময়ে আরো ৬০% অসুস্থতার খাতায় নাম রয়ে গেছে রোগীর।’

ইসমাইল ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে ছেড়ে আহত কণ্ঠে বলে,

‘তোরা ছাত্ররা সব সামলাতে পারছিস তো!’

যাবিয়াজ আশ্বস্ত কণ্ঠে ইসমাইল কে বলে,

‘ডোন্ট ওয়ারি উই ক্যান সি ইট!’

ইসমাইল আর ঘাঁটলো না। জরুরি তলবের সমাধান মিটাতে লেপটপ নিয়ে তার নিজের মেডিক্যাল এর কাজ সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হলো।
যাবিয়াজ,এরফান আর ফেরদৌস এক সঙ্গে বসে আছে। এরই মাঝে ফেরদৌস গম্ভীর ভাবে লক্ষ করছে যাবিয়াজকে। ছেলেটা যেমন মনমরা হয়ে আছে তেমন অগোছালো খাপছাড়া ভাব নিয়ে বসে আছে। এর মানে কি ইফদিয়ার ছাড়া সে শূন্যতা অনুভব করছে! নিজের মনের প্রশ্নকে আর দমাতে না পেরে কৌতূহলী হয়ে ফেরদৌস জিজ্ঞেস করে।

‘যাবিয়াজ শুন সিরিয়াসলি বল কি সমস্যা হয়েছে তোর! কেন চুপচাপ অগোছালো হয়ে পড়লি।’

যাবিয়াজ পূর্বের ভঙ্গিতে টেবিলের দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে। তিনজন ক্যান্টিনের এক টেবিলে বসে অাছে। চৌপাশে মানুষের গুণাগণ অঢের। তাদের কথোপকথন যাবিয়াজ এর কান অব্দি পৌঁছালেও তার নিজের মনের অনুশোচনার কথন কিভাবে ইফদিয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছাবে!
আজও কি মেয়েটা তার অনুশোচনার ফলস্বরুপ ক্ষমা দিবে!
ফেরদৌস কি জিজ্ঞেস করেছে। তা যাবিয়াজ শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না সে। এরফান ভ্রু কুঁচকে হাতের স্পর্শে হালকা করে যাবিয়াজ এর বাহুতে নাড়া দিল। যুবক তৎক্ষণাৎ সম্মতি ফিরে পায়। আমতা আমতা করে চৌপাশে নজর বুলানোর ভান করে বলে,

‘কেনো তোদের কি মনে হয় আমি খাপছাড়া দিন পার করছি!’

‘মনে হয় না ডারেক্ট গ্যারান্টি দিতে পারি। আরে আগে যে ছেলেকে দেখলে আমাদের রসিকতা করতে মন চাইতো সে ছেলেকে দেখলে এখন দেবদাস নাম ছাড়া ডাকতে মন চাই না।’

‘উফ দোস্ত আমার মাথা শেষ হয়ে যাবে। পারছি না আর গোপনে সহ্য করতে।’

এরফান গম্ভীরতা ছেড়ে শান্ত্বনাময় কণ্ঠে যাবিয়াজ এর পিঠে হাতের স্পর্শ দিয়ে বলে,

‘শোন আমরা তোর ছোটবেলার বন্ধু। শেয়ার কর যদি সমাধান দিতে পারি।’

যাবিয়াজ দৃঢ় এক আহতময় শ্বাস ছেড়ে তার বন্ধুদের কাছে ইফদিয়ার সাথে বিগত কয়েক মাসের বিচ্ছেদ হওয়া, কেনো হলো, পরিশিষ্টে জানার পর অনুশোচনার কথা ব্যক্ত করলো। এরফান এর হাত আপনাআপনি মাথায় চলে যায়। ফেরদৌস ঢোক গিলে বলে,

‘তুই যার লগে যার জন্যে এত বাজে ব্যবহার করলি। বর্তমানে সেই আমাদের হেডমাস্টার এর পদে আছে। শালা আগে ভালো করে জেনে নিবি তো। না জেনে কাজ তোকে কে করতে বলল!’

যাবিয়াজ করুণ চোখে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো মত মুখ করে বলে,

‘দোস্ত বিশ্বাস কর ইফদিয়ার কে অন্য ছেলের সঙ্গে দেখে রাগ উঠছিল। তাই ছেলেটা কে জিজ্ঞেস করার কথাও মাথায় আসে নি। তখন শুধু ভালোলাগা মানুষটির প্রতি ভালোবাসা হওয়ার পরিণতি যে, হারানোর হবে তা মানতে পার ছিলাম না। তুই জানিস আমি বিয়ের আগ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম নামক অবৈধ সম্পর্কে জড়িত হয়নি। কেনো হয় নি বলতে পারিস! পারবি না কারণ একটাই আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে পরিপূর্ণ ভালোবাসতে চাই। এটা ঠিক ইফদিয়ার প্রতি আমার সুপ্ত এক ভালোবাসাময় অনুভূতি আছে। সেটা নিশ্চিত প্রকাশ্যে নয় অন্তরালে আবদ্ধ রাখতাম। যদি উম্মুক্ত করার সাধ্য বা অধিকারবোধ থাকতো তাহলে কখনো ইফদিয়ার কে নিজ থেকে অবিশ্বাস বা হারানোর ভয় থাকতো না। তাকে নিজ থেকে দূর রাখার প্রধান কারণটাই হলো প্রেম নামক অবৈধ সম্পর্কে জড়িত না হওয়া। হয়ত দূর থেকে গুপ্ত প্রেমিক হয়ে থাকতাম। তাও ভালোই লাগতো। এক তরফা ভালোবাসার ন্যায় মনে হতো নিজের ভালোবাসাকে। এই জানার সত্ত্বেও যে অপর মানুষটি আমায় ভীষণ ভালোবাসে।’

যাবিয়াজ মনের কোণায় পুরু বর্ণনা চুপিয়ে রেখে ছিল কে জানতো! এরফান আর ফেরদৌস যেন কথার বলার কোনো ভাষা বা যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। আজকারের যুগে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড সহজে হওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। সেখানে এই যুবক কোন মাটি দিয়ে গড়া! যে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও পা দিয়ে মাটিচাপা দিল। তবে হ্যাঁ এরফান বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। সে মুচকি হেসে যাবিয়াজের পিঠে চাপ্পড় দিয়ে বলে,

‘সাব্বাস তোর মত প্রেমিক পুরুষ শত খুঁজলেও পাওয়া দুরুহ।’

‘না রে প্রেমিক নয়। একজন আর্দশ স্বামী হতে চাই। তার আগে প্রেয়সীর সমমানীয় অভিমানকে টুকরো করে সাধারণ মৌলতে পরিণত করতে হবে।’

ফেরদৌস কৌতুকপ্রদ মনোভাব নিয়ে ঠাট্টার সুরে বলে,

‘তুই রাসায়নিক সাম্যবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুকে কি সংযোজন বিক্রিয়ায় ভাঙ্গবি নাকি বিয়োজন বিক্রিয়ায়!’

যাবিয়াজ শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,

‘না সংযোজন, না বিয়োজন অনলি প্রতিস্থাপন। কারণ তোদের মত গাধারাই সম-বিয়ো করবি। আর আমি প্রতিস্থাপন করব। এতে অধিক সক্রিয় মৌল আমি হলে কম সক্রিয় মৌল হলো ইফদিয়ার।’

এরফান ভ্রু কুঁচকে যাবিয়াজ এর বিপক্ষে হয়ে বলে,

‘তাহলে সংযোজন আর বিয়োজন কি গলদ কাম করল!’

‘সংযোজন বিয়োজন রে গুলি মার। সংযোজন করলে তৃতীয় মানুষ এসে নাক,হাত-পা গলাবে। জানোস না সংযোজন এর ব্যাখা!
দুই বা ততোধিক মৌল যুক্ত হয়ে নতুন যৌগ গঠণ করে তাকে সংযোজন বিক্রিয়া বলে। আ আমি ভাই রিস্ক নিতে পারব না। সংযোজন বিয়ের পর ইফদিয়ার সঙ্গে বিক্রিয়া করব। তখন তোরা ভাগ্নি বা ভাতিজা হিসেবে নতুন মৌল পাবি সিম্পল। তাই আমার ধারণা অনুযায়ী সংযোজন বিক্রিয়া বিয়ের পর।’

‘তো বিয়োজন কি দোষ করছে!’

ফেরদৌস এর কথায় চটে গিয়ে যাবিয়াজ বলে,

‘ওই হালার বিয়োজন এর একটা দিয়ে কুলাই না। ওর তো হাজারটা লাগে। কারণ ওর মৌল ভেঙ্গে একাধিক সরলতম মৌলে পরিণত হয়। পারব না এই হালা রে নিতে। বেচারী আমার ইফদিয়ার কি দোষ ওরে ভাগ করে একাধিক মাইয়া নিয়ে কি করব! যদি ওরেই না পায়। আমার শখও নাই বটে হাজার মেয়ের পিছু নেওয়ার। এবার নিছু নিলে শুধু জীবনসঙ্গিনীর নিবো।’

‘তার মানে তুই শেষমেষ প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় নতুন মৌল রুপে পথযাত্রায় অভিমানের পাহাড় ভাঙ্গতে লেগে পড়বি।’

যাবিয়াজ প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসি দিল। এরফান আর ফেরদৌস একে অপরের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করে হাসল। যাবিয়াজকে ইসমাইল ডাক দেওয়ায় সে উঠে চলে যায়।

৩৫.

এরফান আর ফেরদৌস দাঁড়িয়ে যায়। এরফান এর ফোনে কল এসেছে। সে কল রিসিভ করে কানে ধরে।

‘ওহ আপনি এসেছেন ওয়েট করেন আসছি আমরা।’

ফেরদৌস বন্ধুর চাহনি লক্ষ করে বলে,

‘যাক এবার বুঝি শ্রেয়িতার মানও ভাঙ্গানো যাবে। ওরে কল দিয়ে বল কেশবপুর রাকতিয়া কফিশপে এ আসতে।’

এরফান কথামত শ্রেয়িতা কে কল দিয়ে কফিশপে আসতে বলে ফটাফট কল কেটে দিল। অপরপাশে, শ্রেয়িতা শুনে বোকা বনে গেল। হঠাৎ তাকেই বা কফিশপে কেনো ডাকল! তার তো মাথা গরম করা উচিৎ এই ফাজিলদের উপরে। কিন্তু এই কি! উল্টা ওরাই মেজাজ দেখায় তাকে।
নাক-মুখ ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘ফাজিলের দলের মন্দঘোষ।’

শ্রেয়িতা কফিশপে এসে বসে আছে। টেবিলটি সে কিছুক্ষণের জন্যে রিজার্ভ করে নিল। দু-তিন সেকেন্ড পর শ্রেয়িতার চোখে কেউ হাত রেখে বলে,

‘দোস্তানি কউ আমরা কেডা!’

‘ফাজিলের অাবার নতুন নামকরণ কেমনে করি!’

এরফান হাত সরিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ফেরদৌসও এসেছে সঙ্গে নতুন একজন। তাকে দেখে যেন শ্রেয়িতার মুখ হা হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দেখামাত্র টাস্কি খাওয়া যাকে বলে। তেমনটাই বোধ হয় সে খেল। এরফান দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘কেমন লাগল মেহনাত স্যারকে নিয়ে আসার সারপ্রাইজ!’

শ্রেয়িতা অবাক হয়ে বলে,

‘মানে!’

‘মানে হলো তোর রাগ ভাঙ্গাতে আজ নতুন সূত্র প্রয়োগ করেছি। তোকে বিয়ের জন্যে স্যারকে রাজি করে ফেলেছি। উনিও নিঃসন্দেহে রাজি হয়েছেন। তুই এমনিই স্যারের উপর ক্রাশ খেয়ে বাঁচতি। এবার আজীবন স্যারের জীবন নিমপাতা বানানোর জন্যে প্রস্তুতি নিবি।’

শ্রেয়িতা অবাক হলো। এবার যেন তার মেজাজ টুঙ্গে উঠে। সে মেহনাত স্যার কে দেখে সৌজন্যে সালাম দিল। সেই সঙ্গে আহত কণ্ঠে বলে,

‘সরি স্যার আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। আমার যতটুকু ভাবনা আপনি কারো উপর নিজের অধিকার হস্তক্ষেপ করেন না।’

মেহনাত এতক্ষণ গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে ছিল। শ্রেয়িতা কে সে নিজের ছাত্রীর মত দেখে শুদ্ধ কথা। তবে তার বন্ধুদের কথায় রাজি হয়ে ছিল। এর বিশেষ কারণ হলো শ্রেয়িতাকে ছাত্রীর নজরে দেখলেও রমণীর ব্যক্তিত্ব আর গুণাবলি নজর কাড়ার মত ছিল। যা মুগ্ধ করে তুলতো মেহনাত কে। কিন্তু কোনো দিনও চাইনি কারো মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। শ্রেয়িতা নিজ মুখে যেহেতু বিয়েটা করতে অস্বীকার করেছে সেহেতু তারও কর্তব্য রমণীর কথাকে সম্মান দেওয়া। সে মুচকি হেসে উৎফুল্ল দৃষ্টি নিয়ে বলে,

‘থ্যাংকস এন্ড বি বিলিভ ইউর সেল্ফ।’

শ্রেয়িতা বুঝতে পেরেছে স্যার তাকে কেনো এই কথাটি বলল। কোথাও না কোথাও মেহনাত স্যারও আন্দাজ করতে পেরেছেন যে শ্রেয়িতার মনজুড়ে অন্য কারো বাসস্থান। সেখানে সে কি করে নিজের নাম বসাবে! ভেবেই যেন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মেহনাত স্যার তাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে চলে যায়।
এরফান রাগি ভাব নিয়ে বলে,

‘করলা তুই। মতোর জন্যে মেহনাত স্যার কে গ্রামের থেকে আসতে বললাম। কলে তোর সম্পর্কে ভালো গুণগত গান গেয়ে গলা ফাটিয়ে দিলাম। আর তুই এক নিমিশেষে বিয়ে করার প্রস্তাবকে পিষে ফেললি। নট ফেয়ার দোস্তানি।’

শ্রেয়িতা দু ভাইয়ের মত বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ইটস ওকে তবে তোদের দুলাভাই অন্য কেউ হবে। আর সেটা আমার পছন্দমত। যার পুরু কারেক্টার এন্ড লুক ডিফারেন্ট।’

এটিটিউট ওয়ালা লুক করে রমণী বলার পর ফেরদৌস হে হে করে হেসে বলে,

‘তোর ডিফারেন্ট জামাই বুঝি বুড়া মেদওয়ালা। এমন কাউরে পছন্দ হয়ছে বললেই পারতি। আমরা আর কষ্ট করে মেহনাত স্যারের মত হ্যান্ডসাম বয় খুঁজতাম না। যাক তুই নিজেই বুড়া পছন্দ করলি আমাদের মাথার উপর থেকে বোঝা নামছে।’

শ্রেয়িতা ফেরদৌসের গাল জোরে টান দিয়ে ক্রোধে ফোঁস করে বলে,

‘ওই সে বুড়া না হ্যান্ডসাম বয়। তবে বিচ্ছেদ আছে বড়।’

এরফান মুচকি হেসে বলে,

‘ঐ বিচ্ছেদটা অনির্দিষ্ট।’

শ্রেয়িতার মুখমন্ডলের রঙ পাল্টে গেল মুহুর্তে। ছলছল দৃষ্টিতে এরফান এর দিকে তাকায়। এরফান বেশ আন্দাজ করতে পেরেছে শ্রেয়িতা কোন বিচ্ছেদ এর কথা বলেছে। ফেরদৌস শ্রেয়িতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘দোস্তানি বিল্লিকে কান্নায় নয় হাসিতে মানায়।’

তিনজন একে অপরের সঙ্গে সময় কাটাতে লাগে। কফি অর্ডার করে ‘সেই বিকেলের আড্ডা’ র মত মগ্ন হলো।

_______

ইসমাইল এর কেবিনে নক করে যাবিয়াজ। ইসমাইল গম্ভীর কণ্ঠে ভেতরে আসতে বলে। যাবিয়াজ ভেতরে প্রবেশ করে দেখে চেয়ারে একজন কিশোরী মেয়ে বসে আছে। বোরকা পরিহিত থাকায় বুঝা মুশকিল মেয়েটি কে!
যাবিয়াজ এর পায়ের শব্দ শুনে মেয়েটি চোখ ফিরিয়ে দেখে। দুজনের একই ভাবে চোখাচোখি হওয়ায় এক ধরনের ধুমকা হাওয়া দুজনের হৃদপিন্ডে বয়ে গেল। সেই একই চাহনি,একজনের চোখে ঘৃণা তো এখন অন্যজনের চোখে ঘৃণাকে নেশাক্ত ভালোবাসায় পরিণত করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভেসে উঠেছে। ইফদিয়ার ভাবতেও পারে নি তার ভাই ইসমাইল এর এসিস্ট্যান্ট যাবিয়াজ। কেননা তার ভাইয়ের ভাষ্যমতে উনার এসিস্ট্যান্ট এর নাম মেশরাফ। ইফদিয়ার কাছে এখন পুরু হিসাব মিলে গেল। তার ভাই যে মেশরাফ এর কথা বলল সে মেশরাফই হলো যাবিয়াজ মেশরাফ। কথাগুলো ভাবছে সঙ্গে আক্রোশে ফুলে উঠছে ইফদিয়ার। নেকাপের বর্হিভাগে থাকা কপালের উপর হাত রেখে চুপ করে রইল। ইসমাইল খেয়াল করে দেখে যাবিয়াজ চুপ করে স্থির দৃষ্টিপাতে কিছু একটা ভাবছে। সে শান্ত ভঙ্গিতে যাবিয়াজকে বলে,

‘কোনো সমস্যা আছে যাবিয়াজ!’

যাবিয়াজ এর সঙ্গে ইফদিয়ার হুঁশ ফিরে। তারা দুজন দুজনের মতিগতি আর অনুশোচনাময় ভাবনায় ধ্যানরত ছিল। ইসমাইল এর কথায় যাবিয়াজ হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘না ভাই এমনি তুই ডাকছিলি বলে এলাম।’

‘ওহ হ্যা শোন এই হলো আমার বোন ইফদিয়ার বুহিয়ান। ওকে একটু কেশবপরের রঞ্জিতমলে ছেড়ে আয়। হেই রিকশা পাচ্ছে না। তোর কাছে বাইক আছে না যা দিয়ে আয়।’

ইফদিয়ার তৎক্ষণাৎ ‘না’ বলে দাঁড়িয়ে যায়। যাবিয়াজ কথা বলার সুযোগটা পেয়েও যেন নিমিশেষে হারিয়ে ফেলল। ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কেনো!’

ইফদিয়ার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে যাবিয়াজ এর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ভাইয়া যার তার সাথে সঙ্গ দিতে নেই। বলা তো যায় না পাগলা কুকুর কখন না কখন আক্রমণ করে বসে। অবশ্য তারা পাগল বলে যাকে তাকে কামড়ে ফেলে। সামান্য হৃদয় বলতে তাদের নেই যতসব!’

ইফদিয়ার নিজ দায়িত্বে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ইসমাইল হতবম্ভ হয়ে গেল। তার বোন তার এসিস্ট্যান্ট কে হাবিজাবি বলে নিচু দেখিয়েছে। বুঝতে পেরে ইফদিয়ার কে চেঁচিয়ে ডাক দেয়। কিন্তু ইফদিয়ার দুই পায়ে হেঁটে চলে যায়। সে থামতে চাই না থামলে বুঝি আবেগীয় চাপা কষ্ট অশ্রুসিক্ত হবে। ইসমাইল বোনের পক্ষ থেকে যাবিয়াজকে অনুরোধীয় কণ্ঠে বলে,

‘ভাই শোন মন খারাপ করিস না। আমার বোন যেমনভাবে কথা বলেছে সে মন থেকে এমন নয়। কিন্তু আজ কেনো জানি এমনটা বলল বুঝতে পারলাম না। বোনের হয়ে আমি সরি।’

যাবিয়াজ অস্থিরতা কাটিয়ে ইসমাইলকে আশ্বস্ত করে বলে,

‘ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দিস না দোস্ত। কোনো একদিন তোর কাছেই না হয় লজ্জিত হয়ে পড়ি।’

ইসমাইল যাবিয়াজ এর কথাটি শুনে বলে,

‘বুঝলাম না কি বললি!’

‘আব না বাদ দেয়। তুই বল আর কিছু লাগবে!’

ইসমাইল ভেবে বলে,

‘আপাতত না।’

যাবিয়াজ অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়ে। দুপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে ইফদিয়ার চিহ্ন, ঘ্রাণটুকু শিরশ্ছেদে নিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তৃষ্ণার্ত চোখের ভাষা কে বুঝবে! হ্যাঁ সে শাস্তির যোগ্য! আজ ইফদিয়ার তার ভাইয়ের সামনে যাবিয়াজকে অপদস্থ করেছে। যেমনটা একবার যাবিয়াজ করেছিল। তফাৎ ছিল যাবিয়াজ অপরিচিত মানুষদের সামনে ইফদিয়ারকে বাজে চরিত্র এর উপাধি দিয়ে ছিল। আর ইফদিয়ার নিজের ভাইয়ের সামনে যাবিয়াজকে পাগল কুকুর নামে উপাধি দিল।
যাবিয়াজ আনমনে ভেবেই নিল। যে কালেই হোক যত জম্মেই হোক শাস্তি ভোগ করে হলেও তোমাকে নিজের আপন করার ওয়াদা রইল অপ্সরীমনি।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২০

৩৬.
দুই দিন পর…

রাত ৯টা ইসমাইল তার বোন ইফদিয়ার কে ধরে গাড়ি থেকে বের হলো। তাদের দিকে স্থীর অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যাবিয়াজ। এশারের নামাজের পর পর রওনা হয়ে ছিল ইসমাইল গাড়ি নিয়ে। বোনকে সঙ্গে আনার বিশেষ কারণ হলো তাকে খুশি করা। মেয়েটার চেহারায় কেনো যেন চঞ্চলতা নিভে গিয়েছে। একদম স্বচ্ছল নারীর মত গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। কথাবার্তায় আগের মত পটুরতা লক্ষ হয় না। সে ভাবে বোধ হয় পরিবেশ বদলির কারণে বোনটা নেতিয়ে পড়েছে।
ইসমাইল আর এনজিও ক্যানভাসের সদস্যগণ এসেছে গৌরীঘোনা ইউনিয়নে ভর্তের দেউল এ (ভরত রাজার দেউল)।

ইসমাইল এর পিছু নিয়ে বাকিরা প্রবেশ করে। ইফদিয়ার গরম লাগছে। রাত হয়েছে তবুও বাতাসের আভাসও যেন চিহ্নিতহীন। বোরকার অন্তরালে অস্থীর অবস্থা। গলা শুকাতে আরম্ভ করেছে। ইসমাইল বোনকে দেখে বলে,

‘বোইন গরম লাগলে বল এসির ব্যবস্থা করি।’

‘না ভাইয়া কিছুক্ষণ পর চলেই যাব। এখন না হয় হাঁটি।’

ইসমাইল আর ইফদিয়ার একসঙ্গে গৌরীঘোনা ইউনিয়ন এর ফুটপাতে ধীরস্থির করে হাঁটছে। ইসমাইল হাতজোড়া পিছনে একত্রিত করে মোড়ে রেখেছে। ইফদিয়ার মনে শ্রেয়িতার কথা চলছে। সে উল্লাসী গলায় ইসমাইল কে বলে,

‘ভাই শোন না শ্রেয়িতা আপুকে কি দেখতে সনাতন ধর্মের মনে হয়!’

ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে সরু দৃষ্টপাত করে বলে,

‘হঠাৎ এ প্রশ্ন!’

‘আসলে আপুর কথাবার্তা, মুখের হাবভাব দেখে মুসলিম এর সদাচরণের পূবার্ভাস পায়।’

ইসমাইল চমকিত নয়নে ইফদিয়ার দিকে তাকায়। তার মনেও অনেকটা সময় শ্রেয়িতা নামক মেয়ে মানুষটিকে রহস্যময়ী লাগে। সে যা প্রকাশ্য করছে ভেতরে সে তা মুটেও নয়। ইসমাইলকে চুপ থাকতে দেখে ইফদিয়ার কৌতূহল দমাতে না পেরে বলে,

‘বলছো না যে!’

‘দেখ বোইন আমি এ সম্পর্কে কথা বলতে চায় না। বি ফরগেট দিজ টুপিক। দিজ ইজ জাস্ট রিডিকিউলাস!’

ইফদিয়ার মুখ ভেটকিয়ে মনে মনে হতাশ হয়ে বলে,

‘রিডিকিউলাস নাকি লাভকিউলাস খুব ভালোই বুঝি।’

ইসমাইল বোনকে বেঞ্চের মধ্যে বসার আদেশ করে বাদাম কিনতে গেল। বোরকার নেকাপ উঠিয়ে প্রাকৃতিক হাওয়া অনুভব করতে নিজেকে দাতস্থ করল সে। কিন্তু বাতাসের মধ্যে আকস্মিক কড়া পারফিউম এর ঘ্রাণ ঘ্রাণশক্তির মাধ্যমে অনুভব করে সে। চোখ বুজা অবস্থায় অনুভব করলেও এখন চোখ খুলতে বাধ্য হলো। চোখ উম্মুক্ত করতেই দেখে যাবিয়াজ একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার মানুষটার লজ্জা বলতে কিছু নেই! সে ইফদিয়ার খুব নৈকট্যে অর্জনের লক্ষ্যে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তার পা থেকে যাবিয়াজ এর দাঁড়ানো জায়গার ব্যবধান খুব বেশি নয়। মানুষ দেখলে ভাববে এই বুঝি, স্বামী স্ত্রীর উড়না বা হিজাব ঠিক করে দিচ্ছে! ইফদিয়ার ঘৃণ্য নজরে যাবিয়াজ এর চোখ বরাবর চোখ রাখে। যাবিয়াজ এর সহ্য হচ্ছে না প্রিয় মানুষের ঘৃণ্য নজরদারি। এই ডাগর চোখের নয়নে সে তার প্রতি অমায়িক ভালোবাসা দেখতে চেয়ে ছিল। সেই চোখে আজ একরাশ ঘৃণা শুধু মাত্র তারই ভুলের কারণে।
যাবিয়াজ ঢোক গিলে এক পলক ইফদিয়ার কে আপাদমস্তক দেখে নিল। আহ্লাদী কণ্ঠে হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আব অপ্সরীমনি একা বসে কেনো আছো!’

ইফদিয়ার জবাব দিল না। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভাবলেশনপূর্ণ ভাব নিয়ে গেম খেলতে মগ্ন হলো। যাবিয়াজ পুনরায় চেষ্টা করে বলে,

‘অপ্সরীমনি আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো!’

ইফদিয়ার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তার পাশে অন্য কোনো মানব বলতে কেউ নেই। চেহারার গাম্ভীর্যতা প্রমাণ করে দিচ্ছে সে পরিপূর্ণভাবে এড়িয়ে চলছে যাবিয়াজকে।
যাবিয়াজ করুণ দৃষ্টিতে একবার গৌরীঘোনার প্রবেশদ্বারে পরখ করে। কারণ ইসমাইল সেখানে দাঁড়িয়ে বাদাম কিনছে। কেনা তার প্রায় শেষের পথে ছিল। কিন্তু মাঝপথে আঁটকে রেখেছে এরফান আর ফেরদৌস। তারা মন ভুলিয়ে কোনোভাবে যাবিয়াজ একে ইফদিয়ার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। যাবিয়াজ তার ইদুঁর কপালে সইয়ে যাচ্ছে ইফদিয়ার ঘৃণ্য দৃষ্টিকোণ।
সে আর না পেরে ইফদিয়ার হাত থেকে ছুঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল। এতে ইফদিয়ার চুপ করে দৃষ্টি পায়ের দিকে রাখে। যাবিয়াজ করুণ চোখে ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলে,

‘আ আমি জানি ইফদিমনি তোমাকে নিজের অজান্তে ভুলভ্রান্তে অপদস্থ করেছি। নানান বাজে-নোংরা চরিত্রের উপাধি তোমার শরীরের উপর ঠাহর করে দিয়েছি। এর যোগ্য শাস্তি প্রাপ্য আমার । কিন্তু প্লিজ আমাকে একটি বার সুযোগ দাও। আমি আর কখনো তোমায় অবিশ্বাস করব না। সবসময় তোমার প্রতি সুপ্ত আস্তানাময় ঘর বাঁধব যাতে বিশ্বাস ভরপুর থাকবে। ইফদিপরী শুনছো আমি কি বলেছি আ…।’

ঠাসস করে শক্ত দেহের অধিকারী পুরুষ এর আহত মনকে ক্ষতবিক্ষত করার ন্যায় চড় বসিয়ে দিল ইফদিয়ার। চড়টা এতটা জোরাল ছিল যে পুরু গৌরীঘোনার চৌপাশে শব্দ হলো। এখানকার পরিবেশ বেশ শান্তশিষ্ঠ থাকায় একটু শব্দ বিকট শব্দে পরিণত হতে সময় লাগে না। ইসমাইল শব্দের অনুকরণে পিছে তাকায়। এরফান ফেরদৌস হতবম্ভ চোখে তাকায়। তারা জানে এমন কিছু হওয়ার ছিল যাবিয়াজ এর সঙ্গে। কারণ সে কম কষ্ট দেয় নি মেয়েটিকে। একজন নারীর মূল্যবান সম্পদ তার সতিত্ব। যাবিয়াজ সেই সতিত্বকে কাটগড়ায় দাঁড়িয়ে মন্দ-অমন্দ যাচাই করেছে। ইফদিয়ার এর জায়গায় অন্য কেউ হলে যাবিয়াজ কে জেলের ভাত খাওয়ায়তো। তবে মেয়েটিকে দেখে বুঝা দায় সে আজও নিজেকে কেমনে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
যাবিয়াজ শক্ত হয়ে মূর্তির মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সকলে যে দৃশ্যটি দেখেছে তাতে তার কিছুই যায় আসে না। ইফদিয়ার কর্কশকণ্ঠে বলে উঠে।

‘হাউ ডেয়ার ইউ রাবিশ! আমার ফোন আমারি হাত থেকে নেওয়ার জন্যে স্পর্শ করার অধিকার কে দিয়েছে আপনায়! জানেন যে আমি আপনার বসের বোন। লজ্জা করে না মেয়ে দেখলে হ্যারাস করতে। আরে আমার ভাইয়া সাধু বলে আপনার চরিত্র বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি মেয়ে সবই বুঝি। একা মেয়ে পেলে নিজের সুখ মেটানোর কামনায় চলে আসেন। আপনাদের মত ছেলেকে একজম্মে কি দুই জম্মেও যেন চোখের সামনে না দেখি!’

ইসমাইল এসে ধমকে দিল ইফদিয়ার কে। রমণী তীক্ষ্ম চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে গটগট করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইসমাইল সকলকে চলে যেতে বলে। সে অসহায় পথিক এর মত যাবিয়াজ এর সামনে এসে দাঁড়ায়। মনে তার একরাশ প্রশ্নের সমাহার মুখে রয়েছে শান্ত ভঙ্গি। ইসমাইল যাবিয়াজ এর কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘বোনের সঙ্গে তোমার কিসের শত্রুতা আমি জানি না। তবে বলব সময় থাকতে নিজেকে শোধরাতে শিখো। যা নিজের তা নিজের করে রাখতে শিখো। পরবর্তীতে পোস্তাতে হবে।’

যাবিয়াজ সটান দাঁড়িয়ে রইল। ইসমাইল বোনের জন্যে এক মিনিট দেরি না করে পিছু নিল। বোনটাও বড্ড জেদি প্রকৃতির হয়ে গেছে। বাসার ভেতরে পা ফেলে সাবধানে নিজ রুমে চলে যায় ইফদিয়ার। বিছানায় শ্রেয়িতা ঘুমিয়ে আছে। তার চেহারায় ক্লান্তি ফুটে উঠেছে। তার শরীরটা উদ্দিন দেখাচ্ছে। ইফদিয়ার আনমনে ভাবে।

‘শরীর খারাপ তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে মনে হয়।’

ওয়াশরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে বেলকনির মধ্যে চলে এলো। সেখানের স্ফট সোফার উপর গা হেলিয়ে দিল। আনমনে আসমানের দিকে আহত চোখজোড়া রাখে। মনে প্রণয়ের দগ্ধ আরম্ভ হয়েছে। তলপেটের ব্যথা কমেছে অনেকটা। তবুও নামাজ এর দিন শুরু হয়নি। না হলে সে এখন বসে থাকতো না। জায়নামাজে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রুসিক্ত করতো। তথাপি মনের কোণায় পূর্বের স্মৃতি নিয়ে স্মরণ করে। নিজের হাতের দিকে তাকায় ইফদিয়ার। যে হাত দিয়ে যাবিয়াজ এর গালে চড় লাগিয়ে ছিল। সেই হাত রক্তিম আভায় পূর্ণ হয়েছে। বেশ জোরে মেরেছে যাবিয়াজ এর গালে। ডুকরে কেঁদে উঠে ইফদিয়ার। পারছে না আর আঁটকাতে।
ফুঁপিয়ে আহত কণ্ঠে বলে,

‘কেনো বুঝলেন না আমার মনটা ! কি ক্ষতি করে ছিলাম আপনার। ভালোবেসেছি বলে যা নয় তা বলে ছিলেন। ভুল জেনে এখন সামনে এসে আদিক্ষ্যাতা দেখাচ্ছেন আর আমি রাজি হয়ে যাব। আমিও মানুষ। আজ আপনাকে যথার্থ শাস্তি দিয়েছি। যে শাস্তি আপনি আমায় নর্দমার পানিতে ফেলে দিয়ে ছিলেন। তার চেয়ে বড় শাস্তি প্রদান করেছি আপনার সম্মানের উপর। যেদিন ভালোবাসার মান্য করতে শিখবেন ঠিক তখনি আপনি আমার অস্তিত্বে নিজের ছোঁয়া আপীল করতে পারবেন।’

শ্রেয়িতা ইফদিয়ার ফুঁপানো শুনে সজাগ হয়ে গিয়ে ছিল। সে বেলকনির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইফদিয়ার আহত কথাগুলি শুনে ফেলে। তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ে দুমুঠো অশ্রুজল। ভালোবাসলে বুঝি এত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। জীবনটা জানি কুল কাঠের আগুনের ন্যায় ছাই হচ্ছে সবার। হাসিখুশি থাকতে এই একদিন তো পরের দিন দুঃখে শোকে মরতে হয়।
শ্রেয়িতা তার কাছে যেতে নিলে পরে কি ভেবে যেন থেমে যায়।
আনমনে ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘পরীর মত নিষ্পাপ মেয়েটি যাবিয়াজ এর কপালে হিরার ন্যায় উদয় হয়েছে। তাদের মান-অভিমান এর রেখাটা যেন সূক্ষ্ম হয়ে আসুক। অভিমানী পাহাড়টা যেন বরফ পিন্ডের ন্যায় গলে যাক। ইফদিয়ার যেন পূর্বের ন্যায় যাবিয়াজ কে ভালোবাসুক।’

শ্রেয়িতা ইফদিয়ারকে দেখে বুঝতে পারল সে ক্ষুধার্ত। শরীর বেশ শুকিয়ে গেছে। সে ভেবে পুনরায় বিছানায় গেল। কাঁথা বুক অব্দি টেনে ড্রয়ারে থাকা গ্লাস দিয়ে ঠুংঠাং শব্দ করে। ইফদিয়ার চমকে গেল। চোখ-মুখ উড়না দিয়ে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক শান্ত করল। পূর্বের ন্যায় শব্দটা আসায় ইফদিয়ার ধীরেসুস্থে বেলকনির দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। বিছানার দিকে নজর পড়ে। শ্রেয়িতা হামি দিয়ে উঠছে। সে যে আগে থেকেই সজাগ তা ইফদিয়ার অজানা। শ্রেয়িতা হামি দেওয়ার ভান করে আড়চোখে ইফদিয়ার কে দেখল। ইফদিয়ার গলা ঝেড়ে শ্রেয়িতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে।
শ্রেয়িতা যেন এই সুযোগটার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে ভ্রু কুঁচকে পিছে ফিরে দেখে ইফদিয়ার কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে সন্দেহপ্রবণ নিয়ে কড়া আদেশে বলে,

‘ইফুডল না খেয়ে কি শুকনো শেয়াল হতে চেয়েছো। পেট এতো ঢুকল কেনো! আসো খাবার খাবে।’

শ্রেয়িতা এক প্রকার জোড় করে ইফদিয়ার কে বিছানায় বসিয়ে দিল। নিজেকে গিয়ে খাবার বেড়ে খাওয়ে দিতে থাকে। রুমের বাহিরে ডাইনিং রুমের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ইসমাইল। শ্রেয়িতার প্রতি একদন্ত স্নেহ-অনুরাগ ঘিরে বসেছে তার মনে। কিন্তু সেই যে ‘ধর্মের দেয়াল’ এর কথা মনে পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলে,

‘নিষিদ্ধ জিনিসে বুঝি আগ্রহতা বহুত ! কিন্তু আমি যে পারব না সেই আগ্রহতাকে গ্রাহ্য করতে।’

ইসমাইল শ্রেয়িতার ভাবনার সঙ্গে নিশ্চিত হলো। তার কারণে ইফদিয়ার বোনটা পেটের মধ্যে দানা-পানি প্রবেশ করিয়েছে। না হলে ক্ষুধার্ত হলেও মুখ ফুটিয়ে বলবে না যে, খিদে লেগেছে। তবে পূর্বের ঘটনাটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। তার কোমলতা মনের বোনটির মধ্যে কখনো হিংসা-বিদ্বেষ এর প্রভাব দেখেনি। সবসময় মুগ্ধতর প্রাণচঞ্চলতা নিয়ে চলতে দেখেছে। হঠাৎ কয়েকমাসে বোনের মধ্যে ম্যাচিউরিটির মত পরিবর্তন দেখে তারও বেশ মন খারাপ হয়।
সে তো চঞ্চল বোনকেই চাই। এমন মনমরা বোনের মুখে হাসি ফুটাতে যতই হোক সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা বোনের পরিবর্তনশীলতার পিছনে রহস্য জানা।
ইসমাইল মনজুড়ে ইফদিয়ার রহস্য উদঘাটন করার জন্যে ভাবতে থাকে।
তখন গাড়ির হর্নের উচ্চ শব্দে খেয়াল করে দেখে
জগৎ শন্দ্রনাথ উনার দুইপুত্র বাসায় প্রবেশ করছে। ইসমাইল খাবারের টেবিলে অপেক্ষা করছিল তাদের। জগৎ শন্দ্রনাথ ছেলেদের পরিষ্কার হতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নিজেও রুমে গেলেন।

লক্ষ্মীনা বিছানায় বসে কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিলেন। দরজা খুলার শব্দে ভাবনাকে মাথা থেকে ঝেড়ে নিল আপাততঃ। জগৎ শন্দ্রনাথকে দেখে সযত্নে এসে কাবার্ড থেকে পোশাক বের করে ডাইনিং রুমে গেলেন। তিনিও খাবার খান নি। কেননা স্বামী ছাড়া খেতে পছন্দ করেন না। মিসেস হালিমা ইতিমধ্যে মিসেস জাবিয়ার ওষুধ সেবন করিয়ে দিয়েছেন। আজকাল তিনি অসুস্থতা সেরে উঠতে পারছেন। হাত-পা নড়চড় করছে ধীরস্থিরে। মিসেস হালিমার উক্ত কথায় পরিবারের নেমে আসে খুশির বর্ষণ। ইসমাইল যেন কেঁদেই দিবে মত অবস্থা। লক্ষ্মীনা খুশিতে পূর্জার দরবারে গিয়ে মিষ্টিমুখ করালো মূর্তির মত সাজিয়ে রাখা দেবীকে। ইসমাইল মনের গহীন থেকে আল্লাহর শোকরিয়া প্রার্থনা করে।
শ্রেয়িতা ঘুম পাড়িয়ে দিল ইফদিয়ার কে। নিজের কাঠকাঠুনি সাফল্য করতে পেরে দম নিয়ে শ্বাস ছাড়ল। ইফদিয়ার তো খাবার খাওয়ার সময়ই ফুঁপিয়ে উঠছিল। ফলে শ্রেয়িতা বারংবার জিজ্ঞাসা করে। শেষে তার সঙ্গে না পেরে ইফদিয়ার কান্না করার কারণ বলে দিল। শ্রেয়িতা জেনেও অবুঝ এর মত করে সব জেনেছে এমন ভান করল। সে নিজেও কান্নার মত মুখ করে বলে,

‘চিন্তে করো না। হয়ত ভুল সে বুঝছে। তবে দেরি হয়নি এখনো ইফুডল। যেহেতু মানুষ মাত্রই ভুল সেহেতু চোখে দেখা দৃশ্য সত্য ভাবা ছিল যাবিয়াজ এর বোকামি। কিন্তু এতে তার এক তরফা ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল। মানে বুঝছো?’

অবুঝ পিচ্চি মেয়ে ইফদিয়ার নাক ফুলিয়ে হিচকি তুলে মাথা এপাশ ওপাশ নেড়ে না বুঝায়। শ্রেয়িতা ঠোঁটটা হালকা প্রসারিত করে বলে,

‘মানে হলো যদি না সে তোমায় ভালোবাসতো তাহলে কেনো এতটা অভিমান হয়ে ছিল তার! কেনো করেছিল তোমার সঙ্গে সহস্র অত্যাচার! কারণ একটাই সে তোমায় মনপ্রান্তে জায়গা দিয়ে ছিল। কিন্তু একটা কথা আছে না! সুখ পাখি আসতে না আসতে উড়াল দেয়। তেমনটাই হলো তোমাদের মাঝে। যাবিয়াজ ভালোবেসে তোমায় আপন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু ওই যে বিপদ নামক শব্দটি এসে তোমাদের মধ্যকার অনুভূতি-এক তরফা দুজনের ভালোবাসা কে নিমিশেষে ছিন্ন করে দিল। তোমার সঙ্গে ভুলবশত ইসমাইল কে তোমার ভাই নয় বরং বয়ফ্রেন্ড ভেবে নিয়ে ছিল যাবিয়াজ। এখন যদি দৃশ্যটি তোমার ক্ষেত্রে অনুরুপে প্রসারিত হত। তাহলে যাবিয়াজ যা করেছে তুমিও তাই করতে। আইম রং অর রাইট!’

ইফদিয়ার হাল ছেড়ে দিল। এবার যেন তার গলা ফাটিয়ে কান্না করতে মন চাচ্ছে। আজ সে সীমানা লঙ্গন করে মনটাকে ভেঙ্গেই দিয়েছে যাবিয়াজ এর। কিন্তু দোষ কার এতে! দুজনেরই দোষ। একে তো সে কখনো তার পরিবার সম্পর্কে যাবিয়াজ কে অবহিত করে নি। তার উপর যাবিয়াজ এর কটুক্তি কথাগুলো বলার সুযোগ দিয়ে মিথ্যে দৃশ্যকে সত্য দৃশ্য কি না তা সামনে আনার চেষ্টা করেনি। তবুও শ্রেয়িতার শেষাক্ত কথায় সে ঘাবড়ে গেল। আসলেই যদি যাবিয়াজ এর জায়গায় সে হতো। আর যাবিয়াজ অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে গাড়ি নিয়ে ঘুরাঘুরি করতো! তখন না জানি তার মধ্যে কি চলতো মনে! বেহায়া মনে তখন বিচ্ছেদ এর মত দুর্ঘটনা রটিয়ে ছাড়তো। ভুল বুঝাবুঝি পাহাড় সমেত বাড়তো। শ্রেয়িতা ভাতের লোকমা ইফদিয়ার মুখে তুলে দিচ্ছে। সঙ্গে ইফদিয়ার ধ্যানমগ্ন চেহারা লক্ষ করছে। সে জানে ইফদিয়ার মনে যাবিয়াজ এর মত অনুশোচনা কাজ করছে। ইফদিয়ার খাওয়া শেষ হলে শ্রেয়িতা জোড়পূর্বক তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। না হলে মেয়েটা অযথা ভেবে মাথার কোষগুলোকে মেরে ফেলতো। হাত ধুয়ে সে নিজেও খাবারের পর্ব চুকিয়ে রুমে এলো। ঘুম আজ তার চোখে হানা দিবে না। কারণ অনেক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত ঘুমিয়েছে।

৩৭.

গভীর রাত যাবিয়াজ ছাদে গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে । খালি গলার সঙ্গে অদক্ষ গিটার নিয়ে আহ্লাদী শখ পূরণ করছে। উদ্দেশ্য একটি কোনোভাবে যদি মনের বেদনাকে সুর হিসেবে তুলতে পারে। ছোট থেকে গিটার বাজানোর শখ তার। কিন্তু কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ না থাকায় গিটারের তারে ঠুং ঠুং করে নেড়ে আওয়াজ করতো।
আজও ব্যতিক্রম নয়। তবে তখনকার দিন আর এখনকার দিনে তফাৎ রয়েছে। ছোট যাবিয়াজ আজ অনেক বড় হয়ে গেল। ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র। নিজের হাতে মুঠোয় অনেক কিছু করতে পারবে। গিটারের হ্যান্ডেলে মাথা দিয়ে যাবিয়াজ নিজ গালে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। গালটা খানিক ব্যথা করছে। কিন্তু সে ছেলে শক্ত দেহের গড়নে বেড়েছে। ইফদিয়ার চড় মারাটা ছিল ইদুঁরের মত নরম। না হলে তার গাল ফুলতো। তবে তার গাল ফুলে নি কিন্তু খানিক রক্তিম আভা বুঝা যায়। মেয়েদের মত হলে চড় খেয়ে তার গাল ফুলে যেতো। ইফদিয়ার পুচকির আচরণগুলো তার মনে কোণায় উঁকি মারছে। গিটারের উপর হাত দিয়ে সংকোচন করে নেড়ে নেড়ে শব্দ তুলল। শব্দের তালে গেয়ে উঠে।

‘বেখেয়ালি মেয়ে বিই তেরা
হিই খায়াল আয়ে~
কিউ বিসারনা হেয় জারুরি
ইয়ে সাওয়াল আয়ে~
তেরে নাসদিইকিউ কি খুশি
বেয়েহিসাব তিই
ইজচ্ছে মেয়ে ফাসলে বিই
তেরে বেয়েমিসাল আয়ে~

মেয়ে যো তুমছে দূর হোন
কিউ দূর মেয়ে রাহুন
তেরা গুরুন হুউন
আহ তুহ ফাসলা মিটা
তুহ খাওয়াব সা মিলা
কিউ খাওয়াব তোর ডুউন~
ও ও ও ও ও ও ও

হঠাৎ মুষলধারে নামে ঝুম করে বৃষ্টির এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। পানির টুপ টুপ শব্দ হওয়ায় যাবিয়াজ গান থামিয়ে দিল। বৃষ্টি বিলাসে সে আগ্রহী কিন্তু সে এখন আগ্রহহীন দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে। কারণ তার প্রাণভোমরা হিনা বৃষ্টির পানিও অচল।
মুষলধারে বৃষ্টির দিকে অপারগ হয়ে তাকিয়ে আছে যাবিয়াজ। ‘কাবির সিং’ এর ‘বেয়েখেয়ালি’ গানটি যেন তার চলমান জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্যময়।
দরজা খুলে পরক্ষণে ভেতরে প্রবেশ করলেন রবিউল। লাঠি ভর করে এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। তিনি বৃষ্টির পানি অনুভব করছেন শুধু দেখার সাধ্যতা নেই। সেই অন্ধ চোখে ছেলের আহত দৃষ্টি, বেদনাময় মুখশ্রী দেখতে পারছেন। তিনি ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

‘অনুভূতি বাসা বাঁধে ছোট থেকে। জানিস বাবা হূমায়ুন আহমেদ এর স্বীকারুক্তিগুলো তোর জম্মের পর থেকে শুনে এসেছি। তার সব স্বীকারুক্তির মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কোনটি!’

যাবিয়াজ ভাবক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়। রবিউল এর চোখযুগল একদৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে স্থীর হয়ে আছে। উনার এক হাত এখনো যাবিয়াজ এর কাঁধে স্পর্শ করা। তিনি মুচকি হেসে বলেন,

‘পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে । ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়। তোর মাকে ছাড়া যাবত জীবন কিভাবে পাড় করেছি মুখে ব্যক্ত করলেও হৃদয়ের ব্যক্ত করা শেষ হবে না। আজও মনে হয় তোর মা বুঝি আমার সঙ্গে অভিমান করে বসে আছে। আর আমি সাধ্যমত অভিমান ভাঙ্গতেও পারেনি। আমিও চাই তোর মায়ের অভিমান ভেঙ্গে তার সঙ্গে পরকাল জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু ওই যে তোর মা আমাদের ভীষণ ভালোবাসতো। ফলে তোর জন্যে আমায় দায়িত্ববান বানিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে।’

যাবিয়াজ বাবাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেলে। এত কষ্ট তারও সহ্য হচ্ছে না। রবিউল সাহেব নিজের চোখের পানি বাঁ হাত দিয়ে মুছে নিলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলা ছেলেটিকে এক হাতে আগলে নিলেন। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস রত কণ্ঠে তিনি যাবিয়াজকে বলেন,

‘প্রকৃত ভালোবাসাই কেবল তোর আত্মাকে জাগ্রত করতে সক্ষম।
এই ভালোবাসায় জয়ী হওয়া এতটা সহজতর নয়। তোর থেকে ভালোবাসার যুদ্ধে অপর ব্যক্তির মনে পুনরায় বিশ্বাস গড়তে হবে। তার প্রতি তোর বিশ্বাস।’

রবিউল সাহেব বলে ইঙ্গিত বুঝাতে নিজের তর্জনী আঙুল যাবিয়াজ এর হৃদপিন্ড বরাবর বসায়। রবিউল সাহেব বাকিটা ছেলের বুঝদার মস্তিষ্কের উপর সেরে রুম হতে প্রস্থান করলেন। রুমে গিয়ে পকেট থেকে ফোনটায় স্পর্শ করলেন। দু-তিন সেকেন্ড পর পকেটে ঢুকিয়ে বিছানা গা ছেড়ে শুয়ে পড়লেন।

________

পরেরদিন…

তিয়ানা নতুন কলেজে এডমিশন নিয়েছে। তার শারীরিক অসুস্থতা পরিপূর্ণ ভাবে সেরে গিয়েছে। চিকেন পক্স থেকে পরিত্রাণ পেয়ে কয়েকদিন বেড রেস্টে ছিল। কলেজ থেকে ফিরতি সময়ে বাইক এর বুঁ বুঁ বুঁ শব্দ শুনতে পেল। তিয়ানা রুহিয়ার সঙ্গে কলেজে এসেছিল। যেহেতু তাদের সঙ্গে মনিরামপুরে ইফদিয়ার নেই। সেহেতু তারা দুজন একই সঙ্গে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
এখন কাগজপত্র পূরণ করে রিসিটবুক হাতে নিয়ে রিক্সা খুঁজছে তিয়ানা। রুহিয়া তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ি করে চলে যায়। কিন্তু রুহিয়া উদাসীন ছিল তখন। কারণ সে কোনোভাবেও তিয়ানাকে একা ছাড়তে চাচ্ছিল না। তবে তিয়ানার নিজ মুখের জোড় লাগিয়ে রুহিয়াকে পাঠিয়ে দিল। অবশ্য রুহিয়া আর তার চাচাতো ভাই একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি কাবাবের হাড্ডি হতে গাড়িতে উঠে যাবে কেনো! ভেবেই রুহিয়াকে যেতে বলে।

‘ধুর ছাতা একটা রিক্সাও থামে না কেন!’

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো তিয়ানার। চোখজোড়া খালি রিক্সার জন্যে নরজদারি করছে। বাইকের তীব্র শব্দ পুনরায় তার কানে ভেসে আসায় সম্মতি ফিরল তিয়ানার। সে পিছে ঘুরে দেখে এক যুবক হেলমেট পরিহিত অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাও আবার রাইডার লুক দিয়ে বাইকে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তিয়ানা চোখ সরিয়ে নিল। যুবকটা মুচকি হেসে এসে কোলে উঠিয়ে নিল তিয়ানাকে। রাস্তার ফুটপাতে যুবকের এহেন কাজে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যায় তিয়ানা। চিৎকার কে মানুষ জোরো করতে আরম্ভ করে।
যুবকটি মানুষের সমাগম দেখে ঢোক গিলে হেলমেট খুলে। তিয়ানা যুবককে দেখে থ হয়ে যায়। যুবক এর চোখে স্পষ্ট রাগ দেখতে পেল তিয়ানা। যুবক চোখের ইশারায় চারপাশ তাকাতে বলে।
তিয়ানা চারপাশে তাকিয়ে দেখে মানুষ ঘিরে ধরেছে। অনেকে মোবাইল নিয়ে ভিডিও করতে প্রস্তুত হচ্ছে। সে সকলের হতবুদ্ধির কাজ দেখে মৃদু চিৎকার করে বলে,

‘মাফ করবেন আসলে স্বামীকে হেলমেট পড়া দেখে বুঝতে পারিনি।’

মানুষজন আর ভীড় জমালো না। একে একে চলে যায় আর একাকিত্বে পড়ে তিয়ানা আর যুবকটি। যুবক এবার তিয়ানার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,

‘আজ হবুজামাই কে জেলে ভাত খাওয়ানোর জন্যে ভালোই ফাঁদ গড়ে ছিলে।’

তিয়ানা মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘সরি এরফান। আমি ভাবছি অন্য কোনো…।’

এরফান ক্যানভাসে অফ ডিউটি হিসেবে ইঞ্জয় করছিল। কিন্তু মনকে ঠাহর করতে পারছিল না বিধায় ঘুরতে গিয়ে ছিল। মনিরামপুরে নিজের বাসা এক পরখ দেখে। রওনার পথে তিয়ানাকে কলেজ থেকে বের হয়ে যেতে দেখল। তখনি কান্ড হয়ে যায়।
এরফান এর ভাবনামত তিয়ানাকে বলে। সে শুনে আফসোস এর কণ্ঠে বলে,

‘বোকামি করলাম সরি।’

‘উহুঁম চলো কফি খেতে।’

তিয়ানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এরফান তার মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিল। সময়টা যেহেতু সূর্য অস্তমিত হওয়ার। অতঃপর উপভোগ না করে দুজনের মনটাই মানছে না। তাই অহেতুক কথা না বাড়িয়ে এরফান বাইক স্টার্ট দিল।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২১

৩৮.
তিরিক্ষপূর্ণ মেজাজে শ্রেয়িতা কেঁপে উঠে। তিমির রাত্রিতে ছাদের মধ্যে এপাশ ওপাশ পায়চারী করছে সে। রাগটা যেন তার সাত আসমান চুম্বী। কেননা ‘ইসমাইল’ নামক আলগা পিরিত ওয়ালাকে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে হাসাহাসি করতে দেখেছে। শ্রেয়িতার গা-পিত্তি যেন সেখানেই জ্বলে পুড়ে ছাই হবার মত অবস্থা। কিন্তু অগণিত মানুষের সামনে ইজ্জতের বারোটা বাজালো না। চুরিচুপে চলে এলো বাসায়।
এখন যেন নিজের রাগ দমাতে না পেরে ছাদে এসেই মহামান্য বকাবকি শুরু করে হাঁটাহাঁটি করছে সে।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আজ বিকালে এনজিও ক্যানভাসে শিক্ষকদের মিলনমেলা উপলক্ষে অনুষ্ঠান ছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে শুধু আমন্ত্রিত ছিল শিক্ষকদের পরিবার। বাহিরের অন্য কোনো ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক আমন্ত্রিত ছিল না। জগৎ শন্দ্রনাথ হলেন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে ট্রেনিং নেওয়ার সম্পর্কে আলোচনা করতে চান। অনুষ্ঠান থাকায় বিষয়টা উনার মতে আরো সহজতর হলো। তিনিও পরিবারসহ যথাসময়ে রাত ১০টায় উপস্থিত হলেন। কিন্তু জগৎ শন্দ্রনাথ এর আসার আগে চলে এসেছিল সেন আর রৌশ। তারা অনুষ্ঠানে অন্যান্য কর্মচারীদের সহায়তা কর ছিল। তারা ছিল ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত। স্বয়ং পদটি জগৎ শন্দ্রনাথ দিয়েছেন।
তিনি এসেছেন সঙ্গে এসেছে মূখ্য খ্যাতনামা ডাক্তার সাহেব ইসমাইল বুহিয়ান। কিন্তু সঙ্গে আর কেউ আসে নি। আসেনি বলতে ভুল হবে তার বোনকে অর্থাৎ ইফদিয়ার কে আসার কথা বলে ছিল। কিন্তু তার বোন ভীষণ ক্লান্ত ছিল বিধায় জোর করেনি আনতে। ইসমাইল জগৎ শন্দ্রনাথ তার আঙ্কেলের পরিচিত বলে সঙ্গে এসেছে।
ইসমাইল এর সঙ্গে অনেক সৌন্দর্য মোহনীয় রমণী এসে পরিচিত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করল। সব রমণীদের দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষণ করেনি ইসমাইল। সে শুধু একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে ফোন কানে ধরে কথা বলার ভান আরম্ভ করে দিতো। অনুষ্ঠানে প্রতিটা
বয়স্ক প্রশিক্ষকদের মেয়ে এসেছে। সেই সব মেয়ে ইসমাইল কে দেখে তাদের লোভাতুর ইচ্ছে মিটাতে লেগে পড়ে। কোনো না কোনোভাবে গা ঘেঁষে ইসমাইল এর সান্নিধ্য পেতে চাই।
ইসমাইল নিজের আত্মায় দৃঢ়সংকল্পিত। কোনো রমণীকেও ‘হাই হ্যালো’ টুকু বলল না। শ্রেয়িতা অনুষ্ঠানে এসেছে কিন্তু বেহায়া মন তার ইসমাইল কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইসমাইল এসেছে তাদের সঙ্গেই। কিন্তু যুবকটা তার দিকে এটুকু লক্ষ করেনি। যাতে বেশ মন খারাপ হচ্ছে তার।
অনুষ্ঠানের জন্যে শ্রেয়িতা সাধারণ সাজে সেজেছে। উচ্চ ধনাঢ্য দেখানোর মত সাজ সাজেনি। অথচ অনুষ্ঠানে আসা কিছু রমণীর সাজ দেখে তার গলায় বমির পূর্বাভাস অনুভব করছে। শ্রেয়িতা সাদা আটামাখা মেয়েদের দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘অনুষ্ঠানে আসছে নাকি ছেলে পটাতে আসছে আল্লাহ জানেন! দেখে ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হলেও কু-ইঙ্গিত এর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। যতসব ন্যাকামো মার্কা ঢং।’

ভীষণ বিরক্ত শ্রেয়িতা তাদের সাজগুজে। কারণ সে এতো সাদা মুখে মাখতে পছন্দ করে না। সে প্রাকৃতিকভাবে আহামরি সুন্দর না হলেও তার হালকা সাজই তাকে ভীষণ মায়াবী করে তুলে।
শ্রেয়িতা ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে মোবাইল বের করে নিজের মুখের উপর ধরে। দেখে তার ডান গালে একটি ছোট তিল, গোলাপী ঠোঁটের উপর লাল রঙের লিপস্টিক, চোখের কাজলে কাজল টানা, ডাগর চোখের পাপড়ির উপরের অংশে কালো-নীল রঙের আইস্যাডো দেওয়া, আইলানার দিয়ে চোখের পাতা টান টান করা, মুখে নেই কোনো প্রকার ফাউন্ডেশন এর ছাপ। হালকা এটুকু সাজায় অসাধারণ তাকে আবৃত করেছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে লক্ষ্মীনা মায়ের উপদেশ মতে শাড়ি পরেছে। শাড়ির রঙটা হচ্ছে ঘন নীল রঙের। দেখতে কালো রঙের দাগকাটা ছাপ ফুটে উঠে। ফুলহাতা ব্লাউজ পরায় তার শরীরের অংশ পুরুপুরি ঢেকে আছে। একদম মার্জিত পরিমাণদর্শী নারী হয়ে এসেছে শ্রেয়িতা।
লক্ষ্মীনা দ্বিমত পোষণ করেনি মেয়ের সাধারণ সাজে।
তিনি সেজেছেন ঠিকিই।
শ্রেয়িতা ফোন ব্যাগে রেখে চৌপাশে নজর বুলিয়ে দেখতে থাকে। তখনি ক্যাফের বাঁ পাশের দুটো চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিদের উপর তার নজর পড়ে। সে সরু চোখযুগল তীক্ষ্ম করে তাদের দেখতে থাকে। হাতজোড়া মুঠোবদ্ধ করে লুচির মত ফুঁসতে আরম্ভ করে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘ইসমাইল আপনার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। এখানে আমাকে ইগনোর মেরে অন্য মেয়ের সঙ্গে মাতামাতি করেন।’

ক্রোধটা কে যথেষ্ঠ পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে আড়চোখে ইসমাইল আর অপরিচিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রেয়িতা। কিন্তু হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখায় সে চেয়ার থেকে উঠে। বাসায় চলে যায়। আসলে দৃশ্যটি ছিল ইসমাইল এর শার্টে অপরিচিত মেয়েটি নিজের হাতের স্পর্শ দিয়ে কি যেন করছিল। যা দূরে বসায় শ্রেয়িতা স্পষ্ট দেখতে পায়নি। শ্রেয়িতার স্বচ্ছ নরম মনটা উতলা হয়ে পড়ে। চলে যায় সেখান থেকে। বেশিক্ষণ থাকলে বুঝি হাত-পা ছড়িয়ে মারামারি করে ফেলবে।

ছাদে এসে শ্রেয়িতা হিসাব মিলাতে আরম্ভ করে। তার সঙ্গে ইসমাইল এর এড়ানো ভাব করে চলা। তার এহেন ঘাড়ত্যাড়া ভাব সহ্য হচ্ছিল না শ্রেয়িতার। যখনি শ্রেয়িতার সামনে অকস্মাৎ ইসমাইল উদয় হতো। তখনি যুবকটা চোখ ঘুরিয়ে গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে টোটালি এড়িয়ে যেতো। শ্রেয়িতা দিনকে দিন যুবকের এড়ানোর দিকটা মানতে পারছিল না। তার মন চাইতো এখনি গিয়ে যুবকটার ভাব চুটিয়ে দিতে। কিন্তু না পারছে চুটাতে, না পারছে মানতে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে শ্রেয়িতা বলে,

‘আজ তুই বড় গলদ কাম করলি ইসমাইল। তোকে জান দিয়া লাবিউ করি বলি অন্য মাইয়ার সঙ্গে রং মারোস। আরে গলইদা একবার কি আমার প্রতি তোর মন পুড়ে না। কানকাটা গন্ডাল না বুঝে মন , না বুঝে পরান। এ আল্লাহ বিচার দিলাম তোমায়!’

‘আল্লাহ কে কেনো বিচার দিবে, তোমার তো তোমাদের রাম পালকে বিচার দেওয়ার কথা।’

কোনো পুরুষেলী কণ্ঠে পূর্ণবাক্যের সমাচার শুনে প্রচন্ড বেগে ঘাবড়ে গেল শ্রেয়িতা। ঢোক গিলে পিছু ফিরবার মত সাহস যেন একনিমিষে উড়াল দিল। যুবকটি ভ্রুযুগল খানিক নেড়ে কপালে তর্জনী আঙুল দিয়ে চুলকানোর ভান করে হেঁটে এলো। শ্রেয়িতার পাশে ডান কাঁধ বরাবর দাঁড়িয়ে স্থীর দৃষ্টি রাখল। সামনে থাকা নির্জন গাছ-গাছালির দিকে। শ্রেয়িতা নজর লুকিয়ে বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। ইসমাইল একই চাহনি নিয়ে শ্রেয়িতার মুখোমুখি হলো। এবার যেন রমণীর হৃদপিন্ডে বড়জোড় ধুমকা হাওয়া বয়ে গেল। ধুকপুক করার শব্দটা ঘনিষ্টতায় রুপান্তর হতে লাগল। শ্রেয়িতা আমতা আমতা করে বলে,

‘দেখুন আপনি যা ভাবছেন ওমন কিছুই নয়।’

‘আমি কি ভাবছি সেটা যদি বুঝতে! তা হলে আমার বাচ্চার চেহারা দেখা হয়ে যেতো।’

শ্রেয়িতা ইসমাইল এর কথায় পাল্টা জবাবের বাক্য হারিয়ে ফেলল। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে ইসমাইল কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগে রমণী। কেমন যেন যুবকের চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখতে পেল শ্রেয়িতা। ঢোক গিলে ঠোঁটযুগল আলগা করে চেপে প্রসারিত করে বলে,

‘দেখুন।’

‘এত যখন দেখাতে চাও। না দেখিয়ে অপেক্ষা কেনো করাছো পরী!’

শ্রেয়িতা ‘পরী’ ডাকটি আজ অনেকদিন পর বোধ হয় শুনতে পেল। প্রকৃতির বাতাসের সঙ্গে মনে হচ্ছে তার মনেও ধুমচে ঘন বাতাসের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি নত করে নিল রমণী। ইসমাইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে দৃষ্টপাত করে। শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে শ্রেয়িতাকে।

‘আদৌ কি তুমি সনাতন ধর্মালম্বী! শুদ্ধ জবাব চাই। হ্যাঁ হলে তড়ঘড় অনুষ্ঠানে পরিচিত হওয়া রমণীকে বিয়ে করার ব্যবস্থা করব।’

কথাটি শ্রেয়িতার কর্ণপাত হতেই হাতযুগল আনমনে খামচি ধরে নিল শাড়ির আঁচলে। চোখযুগলে অশ্রুের লুকোচুরি উম্মাদনা এসে জোড়ো হলো। আনমনে ভাবতে লাগল শ্রেয়িতা।

‘যেখানে আপনাকে পরনারীর সঙ্গে কথা বলতে মনটা ব্যথিত হয়। সেখানে পুরুপুরি আপনি যদি পরনারীর স্বামী হয়ে যান। তাহলে এই যে শ্রেয়িতা নামক মানুষটির অস্তিত্ব থাকবে! আল্লাহ কোন দুটানায় ফেলেছো আমায়। মুখ ফুলিয়ে বলতে চায় তোমায় প্রিয়! যে চাই আমি আপনার সঙ্গে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে। সুন্দর নৈমিত্তিক দ্বীনি জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে। আদৌ কি তা সম্ভব!’

শ্রেয়িতার নিরবতা ইসমাইল এর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। সে রমণীর মুখ থেকে নেতিবাচক শব্দটি শুনতে চাই। ইতিবাচক নিরবতা নয়। পারলে যেন সে শ্রেয়িতাকে বুকমাঝাড়ে বেঁধে হলেও নিজের করে নিতো। কিন্তু হায় সুখ পাখি উড়ে যাওয়ার প্রবর্তনা করেছে !
ইসমাইল শক্ত মুখ করে কাঠকাঠ গলায় বলে,

‘নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। ভালো থাকবেন শ্রেয়িতা।’

আর একদন্ত অপেক্ষা না করে চলে গেল ইসমাইল। যেতে গিয়ে দেখতে পেল না হতশ্রী রমণীর বেদনাময় মুখখানা। শ্রেয়িতা ধপ করে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ে। চোখের কার্নিশে আটকে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে অস্পষ্টসুরে বেরিয়ে আসে।

‘ভালোবাসি আপনাকে অস্তিত্বের নিবিড়ে অন্তরজুড়ে।’

৩৯.
ইফদিয়ার নাকের ডগায় রাগ এনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার সম্মুখে হ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছে ইসমাইল। বোনকে উদাসীন দেখায় ভুলভ্রান্তে বলে ফেলেছে যে,

‘ওই দিয়াশলাই শোন তো।’

ইফদিয়ার নাক-মুখ কুঁচকে সরু দৃষ্টিতে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

‘কি বললি আমি দিয়াশলাই তো তুই মগের মুল্লক।’

‘সেটাই তোকে দেখে মগের মুল্লকই লাগে।’

‘ভাই সহি করছো না বলে দিলাম।’

‘আয় আগুন জ্বালাবো তোরে দিয়া। তোর নাম ইফদিয়ার না রেখে দিয়াশলাই রাখা উচিৎ ছিল।’

ব্যস শুরু হলো রাগের দ্বন্দ। ইফদিয়ার রাগ ভাঙ্গাতে ইসমাইল হে হে করে হাসি দিয়ে বলে,

‘তোর নাকের ডগায় আগুন লাগছে যা নিভিয়ে আয়।’

‘ভাইইইই!’

খানিক চেঁচিয়ে ফেলায় ইসমাইল থতমত খেয়ে গেল। হাত জোড় করে ইশারায় চুপ করতে বলে সে। ইফদিয়ার শান্ত হয়ে ‘হু’ পিছিল শব্দ করে মুখ
ঘুরিয়ে রাখে। ইসমাইল বাধ্য হয়ে বলে,

‘শোন তোর বাসায় মন ঠিকচ্ছে না। একটা কাজ কর কয়েকদিনের জন্যে তিয়ানার বাসায় চলে যা।’

এক ঝটকে খুশিতে গদগদিয়ে উঠল ইফদিয়ার। তার তিয়ানা দোস্তের সঙ্গে থাকার কথা নিজ মুখে বলেছে ইসমাইল। শুনে যেন সে আকাশে উড়াল দিয়ে তিয়ানার বাসায় চলে যাবে। বোনের খুশি দেখে ইসমাইল খুশিটাকে তীব্রতর করতে গলা খাঁকড়ি দিয়ে উঠে। দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইফদিয়ারকে বলে,

‘তোর এডমিশন তিয়ানার কলেজে করে দিয়েছি। তোদের রেজাল্ট বের হতে আরো দুমাস আছে। তাই কোচিং করবি বান্ধবীদের সঙ্গে।’

ইফদিয়ার অবাক তার ভাই কিনা সব জোগাড় করে বসে আছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

‘ভাইয়া তুমি জানলে কেমনে তিয়ানা কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে আর সে যে চিকেনপক্স এর মত ছোঁয়াচে রোগ সেরে উঠল!’

ইসমাইল খানিক ভাবুক ভঙ্গিতে চুপ রইল। পরক্ষণে হেসে বলে,

‘সে কি শুধু তোর বান্ধবী! সে আমার একান্ত পেশেন্ট ছিল। তাকে চিকিৎসা করতে বাসায় খুব কম যেতাম। তবে নিয়মিত মেডিসিন আর মলম এর প্রেসক্রিপশন আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দিতাম। আমি এখানে মেডিক্যাল সামলাতে ব্যস্ত সেখানে কেমনে তিয়ানার চিকিৎসা করতাম! ভেবেচিন্তে সাবধানে চিকিৎসা করেছি। এরই মাঝে তার অসুস্থতা পরিত্রাণ পাওয়ার পর নতুন কলেজ এর ভর্তি হওয়ার কথা জানলাম। তোকেও সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলাম। এবার তুই বল কবে যাবি তিয়ানার বাসায়!’

ইফদিয়ার খুশিতে ‘আজ’ বলতে গিয়ে থেমে যায়। মনের অন্তরালে শোক নেমে এলো। চুপচে যাওয়া মুখ করে বসে পড়ে। ‘যাবিয়াজ’ নামক মানুষটিকে ঘটনার পর থেকে তার চৌপাশে পা ফেলতেও দেখেনি। এতে ইফদিয়ার ভীষণ ব্যথিত হচ্ছিল সকলের চুক্ষগোচরে।
ইসমাইল ইফদিয়ার কে চুপটি মেরে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আজ কি যাবি!’

‘আব না মানে দুদিন পর।’

বোনের কথায় দ্বিমত পোষণ করল না ইসমাইল। ক্যানভাসে যাওয়ার আগে মিসেস জাবিয়াকে পরখ করে গেল। তিনি এখন শুয়া থেকে বসতে পারেন, হাত-পা মোটামুটি নড়বড় করতে পারেন। আগের মত গুটিয়ে থাকেন না। অবশ্য এখন তিনি নিজেকে বুঝিয়েছেন। স্বামী অপরাধী, দোষকর হলে এর শাস্তি কেন বাচ্চাদের দিবে!
উনার অসুস্থতা ঘিরে থাকায় কষ্ট কে পেল উনার স্বামী নাকি বাচ্চাগুলো। তিনি আয়নার দিকে নিজেকে দৃষ্টপাত করে কথাগুলো ভাবছেন।
তখন উত্তর হিসেবে একটি শব্দই উচ্চারিত হলো।
‘বাচ্চারা’ উনার অসুস্থতায় ইসমাইল সেবাযত্ন করেছে। ইফদিয়ার রাত-বিরাতে মায়ের জন্যে দোয়া মোনাজাত পাঠ করেছে। শ্রেয়িতা নামক মেয়েটি উনাকে ওষুধ আর খাবার সময়মত নিতে সহায়তা করেছে। এই বাচ্চারাই তো উনার সব!
মিসেস জাবিয়া নিজ উদ্যোগ সুস্থ হওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করছেন।
মিসেস হালিমা নিজের মালকিনকে বসা দেখে চট জলদি ইফদিয়ার রুমে গেল। ততক্ষণে ইফদিয়ার গোসল সেরে বের হলো। মাথা মুছছিল তখন মিসেস হালিমা ধড়ফড়িয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন।
ইফদিয়ার আকস্মিক কেঁপে পিছে ঘুরে তাকায়। মিসেস হালিমাকে উত্তেজিত দশায় দেখে চিন্তিত কণ্ঠে ইফদিয়ার বলে,

‘কাকীমা তুমি হাঁপিয়ে গেছো। কি হয়েছে!’

‘মামুনি আপা ঠিক হইয়া গেছো। আহো রুমে দেহো আপা নিজের থেইকা উঠে বইছে।’

ইফদিয়ার ঠোঁটে হাসির উজ্জ্বলতা বেড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ মায়ের রুমে গিয়ে দৃশ্যটি সত্য দেখে জড়িয়ে ধরে। মিসেস জাবিয়া আগলে নিতে না পারলেও ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি টেনে নিলেন। যা দেখে ইফদিয়ার নিশ্চিত তার মা সুস্থতার পথে চলতে আরম্ভ করেছে। আর কোনো ‘আহসান’ নামক পাপ তাদের দ্বারপ্রান্তে আসবে না।

দুপুর পেড়িয়ে বিকাল হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো শ্রেয়িপ্পিকে না দেখে ইফদিয়ার ভাবতে লাগে। কোথায় বেড়িয়েছে সকাল থেকে! একটা ফোন অব্দি করল না মেয়েটি! ভাইকে জিজ্ঞাসা করি। ভেবেই সে ফোন বের করে ইসমাইল কে কল দিল। ইসমাইল ক্যানভাসে ক্লাস করা ছিল। বায়োজেনেটিক প্রোগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে যুবক-যুবতীদের অবহিত কর ছিল সে। ফোনের টিংটু শব্দে ইসমাইল ক্লাস চলাকালীন ধরল না। ক্লাস শেষে দরজা পেড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে। কল লিস্টে ইফুপাখি নামটি দেখে চিন্তিত হয়ে কল ব্যাক দিল।
ইফদিয়ার পায়চারী করছে শ্রেয়িতার কোনো খবর নেই। কিছুক্ষণ আগে লক্ষ্মীনা আন্টি নিজ পায়ে হেঁটে এসে মেয়ের খোঁজ লাগাতে বললেন! তিনিও সকাল থেকে মেয়েকে না দেখে উদগ্রীব হয়ে আছেন।
ফোনের তীব্র শব্দে ইফদিয়ার হুঁশ ফিরে। সে ফোন কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে ইসমাইল বলে,

‘ইফুপাখি এত কল কি মায়ের কোনো সমস্যা হয়েছে!’

‘না ভাই কিন্তু শ্রেয়িপ্পিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বেড়িয়ে ছিল এখন অব্দি বাসায় ফিরেনি। ইনফ্যাক্ট আন্টি কল দিলেও বলে ফোন সুইচড অফ। ভাই একটু খুঁজে দেখো না। আমার খুব ভয় লাগছে।’

‘শোন বাসায় সবার খেয়াল রাখ। শ্রেয়িতার কোনো আপডেট পেলে জানাইস।’

‘ওকে।’

ফোন কেটে ইসমাইল ক্যানভাস হতে বেড়িয়ে গেল। গাড়িতে বসে ইঞ্চিন চালু করতে করতে শ্রেয়িতা কোথায় যেতে পারে তা ভেবে চলছে। তার হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ কি তার কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করে উঠে সে।

‘কোনো ভাবে আমার কথায় কষ্ট পেয়ে স্টেপ নিলো কি! ওহ শীট পরী তোমাকে শুধু কথাটা শুনিয়েছে আসলে কি পারতাম তোমাকে হিনা অন্যের সঙ্গে জীবনের পথযাত্রায় আগাতে। প্লিজ পরী পিক আপ দ্যা কল!’

ইসমাইল বারংবার কল করছে শ্রেয়িতাকে। কিন্তু সেই একই কথা ‘কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির ফোন বন্ধ।’
যুবক চিন্তায় উম্মাদের মত ফোন করেই চলেছে। একই কথা শুনার পরও কল করে যাচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে ডানে-বামে-সামনে-পিছনে লক্ষ করছে। এই বুঝি শ্রেয়িতার দেখা পাবে সেই আশায়! কিন্তু রমণীর চিহ্নটুকু পাওয়া যাচ্ছে না।

‘কই তুমি পরী তোমার অস্তিত্ব জানান দাও প্লিজ। হে আল্লাহ সহায় হোন!’

ইসমাইল গাড়ি ঘুরিয়ে মনিরামপুরের রাস্তায় ঢুকে। সেখানে অগণিত গাড়ির চলাচল। চৌপাশে রয়েছে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি। ফোনেও লাগাতার কল করে চলেছে। মনিরামপুরের ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামায়। পুরু ভার্সিটি বন্ধ। ভেতরে কেউ নেই কিন্তু কেনো যেন ইসমাইল এর মনে বিপদ সংকেত এর ধারণা হচ্ছে। এই বুঝি শ্রেয়িতা বিপদে আঁটকা পড়েছে। সে এখানেই হয়ত তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভার্সিটির প্রবেশদ্বারে কোনো দারোয়ান দাঁড়িয়ে নেই। যতদিন ক্যানভাসে কাজ শেষ হয়নি ততদিন ভার্সিটি বন্ধ থাকবে। ইসমাইল এর হৃদয়ে কেউ যেন ছুড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সে যতই পিছে ফিরার চিন্তা করছে ততই মন তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে আহ্বান জানাচ্ছে।
ইসমাইল নিজের মনের ভ্রম ভেবে বলে,

‘উঁহুম শ্রেয়িতা একা বন্ধ ভার্সিটিতে কেনো আসবে! তাও আবার সকাল থেকে। তারা তো কেশবপুরে আছে। মনিরামপুরে আসার কোনো কারণ থাকতে পারে। তবে এমনি কাউকে না জানিয়ে আসার মত মেয়ে সে নয়। তাও মনটা কেনো ভেতরে পরখ করতে আদেশ করছে।’

ইসমাইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমরে হাত রেখে কপাল চুলকানি দিল। চোখযুগল ভার্সিটির প্রতিটা রুমের দিকে বুলিয়ে নিল। সূক্ষ্ম কোনো প্রমাণ না পেয়ে হতাশ হয়ে গাড়ি উঠে বসে সে। মনজুড়ে তার চলছে একটিই কথা।

‘কোথায় তুমি পরী!’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here