অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১১.

0
320

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.

কাসাব্লাঙ্কা সমুদ্র তীরবর্তী শহর হওয়ায় এখানে বেশ কিছু সী বীচ রয়েছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে একটি নিরিবিলি বীচে যায় তিনজন। বীচে আসার আগে ইসাম আর ফাতিহ ফিশিং এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি কিনে নিয়েছিলো। ল্যায়লাও সাথে করে নিজের ক্যামেরা নিয়ে আসে।

সোনালী বালিতে আচ্ছাদিত সমুদ্র তীর যেন শীতের আভায় গা ঢেকেছে। ল্যায়লা বালির উপর নিজের জুতা খুলে রেখে তার পাশে বসে। ফাতিহ এবং ইসাম কিছুটা দূরে সমুদ্রের তীরে থাকা কিছু পাথর ডিঙিয়ে একটি জায়গায় গিয়ে বড়শি ফেলেছে। যদিও এই ঋতুতে বড়শিতে মাছ ধরা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবুও একবার চেষ্টা করে দেখছে তারা।

সমুদ্রের নীল জলরাশি এবং সারি সারি পাথরের মেলা দেখতে খুব উপভোগ করছে ল্যায়লা। যদিও তার নিজস্ব দেশেও পৃথিবীর সবথেকে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত রয়েছে। কিন্তু ল্যায়লার কখনো সমুদ্রের কাছে যাওয়া হয় নি। এই জন্যই সে চুপচাপ দূরে বসে আছে। কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।

আচমকা ল্যায়লা দেখে ফাতিহ এবং ইসাম লাফালাফি করছে। ভালো করে তাকাতেই সে দেখতে পায় ফাতিহর বড়শিতে একটি নাম না জানা ছোট মাছ উঠে এসেছে। ল্যায়লা সামান্য হেসে তার হাতের ক্যামেরাতে এই দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দী করে নেয়। হঠাৎ সে আরেকটু জুম করে ফাতিহর হাস্যজ্বল চেহারায় ক্যামেরা ফোকাস করে। ক্লিক করবে এমন মুহুর্তে ফাতিহ তার দিকে ফিরে তাকায়। সাথে সাথে সেই মুহুর্তের চিত্র ল্যায়লার ক্যামেরায় বন্দী হয়৷

ফাতিহকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ল্যায়লা ক্যামেরা হাত থেকে রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফাতিহ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

” তুমি এখানে বসে আছো কেন? ”

ল্যায়লা প্রতুত্তরে বলে,

” আমি এখানেই উপভোগ করছি। ”

” তোমাকে কি আমি সমুদ্রে নিয়ে এসেছি দূর থেকে বসে উপভোগ করতে? ”

ল্যায়লা একবার সমুদ্রের তীরের পাথর গুলোয় এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই আনমনে বলে উঠে,

” উহু। ঢেউর গতি প্রবল। ঢেউ এসে আমাকে টেনে নিয়ে গেলে? ”

ল্যায়লার কথা শুনে ফাতিহ অবাক হয়। পর মুহুর্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। মনে মনে ভাবে, ল্যায়লা কি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে? যদি সত্যিই তার মনে এই ভয় জেগে থাকে তবে এটা ইতিবাচক লক্ষণ। কারণ তারমানে ধীরে ধীরে তার মনের মৃত্যু আকাঙ্খা দূর হচ্ছে।

ফাতিহকে আনমনে হেসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ল্যায়লা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” কি ভাবছো? ”

ফাতিহর হাসি প্রশস্ত হয়। সে এক হাত বাড়িয়ে দেয় ল্যায়লার দিকে। শীতল স্বরে বলে উঠে,

” আমি আছি। ঢেউ তোমাকে টেনে নিতে পারবে না। আই’ল নট লেট দ্যাট হ্যাপেন। ট্রাস্ট মি। ”

ল্যায়লা একবার ফাতিহর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকায়। তারপর ফাতিহর চোখে চোখ রাখে। ফাতিহকে সে বিশ্বাস করতে পেরেছে কি-না তা সে নিশ্চিত নয় এখনো। কিন্তু কেন যেন এখন তাকে ভয়ও পাচ্ছে না সে। যেই ভয় তাকে কারো সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে সেই ভয় সে আর অনুভব করছে না। ল্যায়লা নিজের আনমনেই এক হাত বাড়িয়ে দেয়। ফাতিহ তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে হেসে সুধায়,

” সরি, কিন্তু এখন তোমাকে সমুদ্র বিলাসের সাথে পরিচয় করানোর জন্য আমি মোটেও দুঃখিত নই। ”

কথাটা বলেই ফাতিহ সামনের দিকে ফিরে ল্যায়লার হাত ধরে ছুটতে শুরু করে। আচমকা এমন কাণ্ডে ল্যায়লা অবাক হয়। প্রথমে তাল সামলাতে হিমশিম খায় সে। কিন্তু পর মুহুর্তেই সে-ও মুক্ত পাখির মতো ফাতিহর সাথে ছুটতে শুরু করে। দূর থেকে ইসাম এই দৃশ্য দেখে উল্লাসের সুরে চিৎকার করে উঠে।

__________

ঢেউয়ের চাপ পাথরে এসে বাড়ি খেলেই সাগরের লোনা জলকে কয়েক ফুট উপরে উঠিয়ে দেয় এই পাথর সমূহ। পাথরে ধাক্কা খাওয়া ধবধবে সাদা সাগরের পানি গুলো উপরে উঠে ফের অনায়াসে নিচে নেমে যাচ্ছে সাগরে। তীরে আসা জলরাশি যেন ডাঙার সঙ্গে মিতালি সৃষ্টি করছে।

এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পরিবেশে এক অপার্থিব মূহুর্ত উপভোগ করছে ল্যায়লা। দৌড়াতে দৌড়াতে সে সমুদ্রে এসে নেমেছে। পানিতে নেমেই সে অনুভব করছে পায়ের নিচ থেকে ঢেউর স্রোতের সাথে বালি সরে যাওয়ার ব্যাপারটা। সাথে সাথে সে ভয়ে দু’হাতে ফাতিহর হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করে,

” পায়ের নিচে এমন অনুভব হচ্ছে কেন? ”

ফাতিহ হেসে আশ্বস্ত করে বলে,

” এটা স্বাভাবিক। ভয় পেও না। ”

ল্যায়লা প্রশ্ন করে,

” তুমি আগে বহুবার সমুদ্রে গিয়েছো? ”

” হ্যাঁ। ”

তাদের দেখাদেখি ইসামও এসে পড়ে সেখানে। ইসাম এসেই পানিতে নেমে আচমকা ফাতিহকে ডাকে,

” ফাতিহ দেখ তো এটা কি? ”

ফাতিহ ল্যায়লার হাত ছেড়ে ইসামের দিকে এগিয়ে যায় কৌতূহল নিয়ে। ল্যায়লা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কেবল হাঁটু সমান পানি। কিন্তু আরেকটু সামনে ইসাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কোমর সমান পানি। ফাতিহ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

” কি? ”

ইসাম হেসে সাথে সাথে তাকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেয়। আচমকা ইসামের এমন কাজে ল্যায়লা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু সে ভয় পেয়ে যায় যখন দেখে পানির ভেতর পড়ার পরে ফাতিহ আর উঠে দাঁড়াচ্ছে না। ল্যায়লা ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকে,

” ইসাম? ফাতিহ কোথায়? ”

ইসাম হেসে বলে,

” ডোন্ট ওয়ারি ল্যায়লা। চিল। ও সার্ফিং জানে। ”

ল্যায়লা তবুও ব্যাকুল চোখে ফাতিহকে খুঁজে। সে একা এগিয়ে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। তাই ভয়ার্ত কণ্ঠে আবার ডাকে,

” ফাতিহ? ফাতিহ? ”

ইসাম এবার হেসে ডাকে,

” এই? নাটক শেষ হলে উঠে আয়। বেচারি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছে। ”

তার কথা শেষ হতেই সে জোরে পায়ে টান অনুভব করে। আর সাথে সাথে পানিতে আছাড় খেয়ে পড়ে। ফাতিহ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” আর জীবনে পাঙ্গা নিতে আসলে সমুদ্রের মাঝে নিয়ে ফেলবো তোকে। ”

কথাটুকু বলেই সে ল্যায়লার দিকে এগিয়ে আসে। ফাতিহকে দেখে ল্যায়লা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ফাতিহ ল্যায়লার কাছাকাছি এসে তার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,

” ভয় পেয়েছিলে? ”

ল্যায়লা জবাব দেয় না। সে দৃষ্টি সরিয়ে ফাতিহর পিছনে তাকিয়ে সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে নিজেকে ফাতিহর বুকের দিকে আড়াল করে ফেলে। ফাতিহ একহাতে ল্যায়লাকে আড়াল করে পিছনে ফিরতেই দেখে ইসাম কিছুটা কাছাকাছি এসে তাদের দিকে পানি ছুড়ছে আর চিল্লিয়ে বলছে,

” আমি এখনো গিভ আপ করি নি ব্রো। ”

ফাতিহ ল্যায়লাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলে,

” ল্যায়লার গায়ে পানি ছুড়বি না। ”

” সমুদ্রে এসে গায়ে পানি না ছুড়লে সেই সমুদ্রযাত্রা বৃথা যায় ভাই। আর ল্যায়লা যদি আমার টিমে এসে পড়ে তবে ওর গায়ে এক বিন্দু পানিও আমি ছুড়বো না। ”

ল্যায়লা একহাতে ফাতিহর পিঠের দিকের কিছুটা শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিহ ফিসফিসিয়ে তার দিকে ফিরে বলে উঠে,

” এই মুহুর্তে ইসামের থেকে বাঁচতে আমাদের কি করা উচিত জানো? ”

ল্যায়লা ফাতিহর চোখের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই সে ফাতিহ কি বুঝাতে চাইছে বুঝতে পেরে হেসে উঠে। ফাতিহও হেসে ল্যায়লার একহাত ধরে এক পা দু পা করে পিছাতে পিছাতে দুজন একসাথে বলে উঠে,

” থ্রি, টু, ওয়ান এন্ড গো। ”

বলেই তারা উল্টো ফিরে ভোঁ দৌড় দেয়। ইসামও তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে এরাবিক ভাষায় বলে উঠে,

” ফাতিহ! শেষমেশ বন্ধু ফেলে ল্যায়লার হাত ধরে মজনুর মতো পালালি? তোকে আমি বন্ধু পদ থেকে বহিস্কৃত করছি। ”

ফাতিহ দৌড়াতে দৌড়াতে এরাবিক ভাষায় বলে উঠে,

” তোর তালাক গ্রহণ করলাম আমি। ভাগ এখন। ”

__________

সমুদ্রের তীরে বালুর উপর শুয়ে আছে ইসাম। এতক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে সে ক্লান্ত। আড়চোখে সামনে একবার ফাতিহ এবং ল্যায়লার দিকে তাকায় সে। দু’জন পাথরের উপর দাঁড়িয়ে দুই বড়শি ফেলে মাছের আশায় অপেক্ষা করছে। ইসাম ভেবে পায় না এই দুজন ক্লান্ত হয় না কিভাবে? সে তার ফোন বের করে। বহু খুঁজে নিজের এক পুরনো বান্ধুবীর নাম্বার খুঁজে পায়। কল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অপর পাশ থেকে কল রিসিভ হয়। ইসাম হেসে এক হাতের উপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে বলে উঠে,

” হেই মোনা ডার্লিং। ইউ রিমেম্বার মি? ইট’জ ইসাম শাহমীর। ইউর চাইল্ডহুড ক্রাশ। ”

__________

বড়শিতে টান অনুভব করতেই ল্যায়লা লাফিয়ে উঠে,

” মাছ পেয়েছি আমি। ”

ফাতিহ সাথে সাথে নিজের বড়শি রেখে ল্যায়লার দিকে এগিয়ে এসে বলে,

” স্পিন উল্টো দিকে ঘুরাও। তাহলে বড়শি উপরে উঠবে। ”

ল্যায়লা স্পিন ধরে ঘোরাতে গিয়ে বড়শিতে ভার অনুভব করে। সে ব্যর্থ স্বরে বলে,

” পারছি না। ”

ফাতিহ ল্যায়লার পিছনে এসে দাঁড়ায়। অত:পর নিজের দু হাত ল্যায়লার দু পাশ দিয়ে নিয়ে বড়শি ধরে ল্যায়লার হাত ধরে স্পিন ঘোরাতে সাহায্য করে। কিন্তু ল্যায়লার মনযোগ আপাতত আর বড়শি কিংবা স্পিনের দিকে নেই। সে ঘাড় কাথ করে ফাতিহর দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র তীরের অবাধ্য বাতাসে তার চুল অশান্ত ভঙ্গিতে উড়ছে। কিছু চুল উড়ে ফাতিহর মুখের উপর গিয়ে পড়ছে। ফাতিহর মনযোগ ভঙ্গ হয়। তার দৃষ্টি ল্যায়লার দিকে নিবদ্ধ হয়। ল্যায়লাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার হাত থেমে যায়। স্পিনের থেকে হাত সড়িয়ে এনে সে শান্ত ভঙ্গিতে ল্যায়লার মুখের উপর এসে পড়া চুল সড়িয়ে কানের পিছনে গুজে দেয়। সাথে সাথে ল্যায়লা চোখ বুজে নেয়৷ ঠিক সেই মুহুর্তে ফাতিহ অনুভব করে সমুদ্রের একটি ঢেউ এসে এবার তার হৃদয় কোণে আছড়ে পড়েছে।

দূর থেকে এই দৃশ্য ল্যায়লার ক্যামেরায় বন্দী করে ইসাম। কথা বলতে বলতে আচমকা সামনের দিকে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখতেই সে ফোন রেখে উঠে বসে। পাশে ল্যায়লার ক্যামেরা দেখতে পেয়েই ভাবে এই দৃশ্য সংরক্ষণ করে রাখলে মন্দ হয় না। যদিও সে জানে ল্যায়লার অনুমতি ব্যতীত তার ক্যামেরা ধরা ঠিক না। কিন্তু মাঝে মাঝে সুন্দর স্মৃতি তুলে রাখতে গেলে অনুমতি সেখানে মুখ্য নয়।

ক্যামেরায় একবার ছবিটা দেখে আবার সামনে তাকায় ইসাম। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে ল্যায়লা এবং ফাতিহর মধ্যের সম্পর্ক কোনো একটা নাম পেলেও মন্দ হয় না। হয়তো এই দুজনের দেখা হওয়াটা কাকতালীয় ছিলো না। হয়তো বিধাতার তরফ থেকে পূর্বলিখিত ছিলো তাদের সাক্ষাৎ। হয়তো একে অপরকে অন্ধকার থেকে টেনে তুলতে গিয়েই কোনো এক নতুন কাব্য রচিত হবে তাদের।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here