অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.
ভোর সকালে ফোনের এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙতেই ল্যায়লা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। হাই তুলতে তুলতে সে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়েই অবাক হয়ে যায়। তার যতদূর মনে পড়ছে সে তো বারান্দায় ঘুমিয়েছিল। তাহলে রুমে কিভাবে এসেছে সে? নাকি ঘুমের মাঝে হেঁটে একা রুমে এসে পড়েছে?
নিজের মনের খটকা ভাব মনে রেখে ল্যায়লা উঠে গিয়ে একটা শাওয়ার নেয় সবার আগে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হতে থাকে। ল্যাভেন্ডার রঙের একটা লং ফ্রোগ পড়ে নেয়। তার উপর কালো রঙের একটা লং কোট পড়ে চুলগুলোকে আঁচড়ে একপাশে এনে ছেড়ে রাখে।
__________
হোটেলের নিচে লনে অপেক্ষা করছে ফাতিহ এবং ইসাম। ল্যায়লা কিছুক্ষণ আগে কল করে জানিয়েছে সে রেডি হচ্ছে। ল্যায়লা এলেই তারা হোটেল থেকে নাস্তা করে রাবাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। এই হোটেলে তুলনামূলক মানুষের ভীড় কম। আর ফাতিহর এজেন্সি দ্বারা তাদের এখানে থাকার ব্যাপারটা কনফিডেনশিয়াল রাখার ফলে তারা মিডিয়ার ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারছে সহজে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়না তাদের। ল্যায়লা লিফট থেকে বের হয়ে লন ধরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতেই ফাতিহর দৃষ্টি ল্যায়লার দিকে স্থির হয়। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে গত রাতের দৃশ্য।
__________
নিজের রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবার ফিরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ফাতিহ। তার এবং ল্যায়লার বারান্দার মাঝে সামান্য ব্যবধান আছে। খোলা ঝুল বারান্দা হওয়ায় এক বারান্দা থেকে অন্য বারান্দায় যেতে তেমন একটা কসরত করতে হয় নি তার। ল্যায়লার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ফাতিহ কিছুটা দোটানায় ভুগে। সে চাইলেও কেন ল্যায়লার থেকে দূরত্ব বজায় চলতে পারছে না? পরিস্থিতি কেন তাদের একে অপরের দ্বারে এনে পৌঁছে দেয়? এসব কি নেহাৎ কাকতালীয় নাকি রবের কোনো ইশারা তা-ও জানে না ফাতিহ।
ফাতিহ সন্তর্পণে ল্যায়লাকে কোলে তুলে তার রুমের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। তার গায়ে ব্ল্যাংকেট টেনে দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে ফাতিহ এসির রিমোট নিয়ে এসির তাপমাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। মনে মনে বলে,
” এসির তাপমাত্রা এতো কমিয়ে রাখা কেন? এই মেয়ের কি শীত লাগে না নাকি? ”
কথাটুকু বলেই যেভাবে বারান্দা দিয়ে এসেছিলো সেই একইভাবে আবার নিজের রুমে ফিরে যায় ফাতিহ।
__________
মোহাম্মেদিয়া হতে রাবাত শহরের দূরত্ব প্রায় ৬৩ কি.মি। পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১ ঘন্টা। এল মানসৌরিয়া হাই ওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। আজকে গাড়ি ড্রাইভ করছে ইসাম। ল্যায়লা তার পাশে বসেছে। ল্যায়লা ইসামকে বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। ফাতিহ পিছনে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছে। তাকে অনেকটা নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে।
আচমকা ইসাম জোরে ব্রেক কষতেই ফাতিহর মাথা সামনের সিটে গিয়ে বাড়ি খায়। ফাতিহ বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে মুখে। ল্যায়লা সিট বেল্ট পড়ে থাকায় সে তেমন কোনো আঘাত পায়নি। ফাতিহ একহাতে তার কপালের একপাশ ঘষতে ঘষতে বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,
” ইসাম! এভাবে ব্রেক কষলি কেন? ”
ইসাম কোনো কথা না বলে গাড়ি কিছুটা রিভার্সে নেয়। তারপর গাড়ি থামিয়ে একপ্রকার লাফিয়েই নেমে পড়ে সে। ল্যায়লা এবং ফাতিহ ইসামকে অনুসরণ করে পিছনের দিকে তাকায়। তখনই তারা দেখতে পায় হাই ওয়ের পাশে একটা মেয়ে তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের কিছু একটা কাজ করছে। ইসাম তার কাছে এগিয়ে গিয়েই নিজের মহানত্ব প্রকাশের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফাতিহ তা দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” এই ছেলে জঙ্গলে গেলেও এর আশেপাশে মেয়ের অভাব হবে না। ”
কথাটা ল্যায়লার কর্ণগোচর হয় না। সে একই সুরে বলে উঠে,
” কারো সাহায্য করা খারাপ কাজের তালিকায় পড়ে না। ”
ফাতিহ এবার সামান্য বাকা হেসে বলে,
” আর এই কথা সে বলছে, যে কি-না সাহায্য করার অপরাধে যে কাউকে থাপ্পড় দিয়ে বসে। ”
ল্যায়লা এই কথার আর জবাব দেয় না। কেবল মুখ গোমড়া করে রয়৷
__________
ইসাম গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটির কাছাকাছি গিয়ে প্রশ্ন করে,
” আমি কি সাহায্য করতে পারি? ”
সাথে সাথে মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। ইসাম মেয়েটাকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। সরু চোখের মেয়েটার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি। সে দায়সারা ভাবে জবাব দেয়,
” ধন্যবাদ। প্রয়োজন নেই। ”
মেয়েটার জবাবে ইসাম আশাহত হয়। তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে আশা করছিলো মেয়েটা হয়তো তাকে দেখেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয় না। ইসাম মনে মনে বলে,
” এই মরক্কোর মেয়েগুলো কি ফুটবল খেলা দেখা ছেড়ে দিয়েছে নাকি? কি দিন আসলো! ইসাম শাহমীরকে দেখে কি-না মেয়েরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না? এটাও দেখার বাকি ছিলো আমার? ”
ইসামের মনের সাথে কথা বিনিময়ের মাঝেই মেয়েটা আবার সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুধায়,
” এইযে? এভাবে ষাঁড়ের মতন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ”
ষাঁড় সম্বোধন শুনে এবার ইসাম রাগ হয়। সে মুখ ফিরিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
” আমি কেবল মানবতার খাতিরে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোনো সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা। কারণ এই হাইওয়েতে নষ্ট গাড়ি নিয়ে একা একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কেবল ছিনতাইকারীই এগিয়ে আসবে। ”
মেয়েটাকে এবার কিছুটা চিন্তিত দেখালো। সে পিছন থেকে গলা ঝাড়ি দিয়ে ডেকে উঠে,
” দাঁড়ান। ”
ইসাম দাঁড়িয়ে পড়ে। মেয়েটা প্রশ্ন করে,
” কোথায় যাচ্ছেন? আর আপনার সাথে কে কে আছে? ”
ইসাম ঘুরে তাকায়। সামান্য ভেবে সে উত্তর দেয়,
” আমরা রাবাত যাচ্ছি। আমার সাথে আমার ভাই এবং ভাবী আছে। ”
ইসামের কথা শুনে যেন মেয়েটা কিছুটা নিশ্চিত হয়। সে কিছুটা ভেবে বলে,
” আমাকে আল মানাল কমপ্লেক্স পর্যন্ত লিফট দিলেই হবে। ”
ইসাম সামান্য হেসে বলে,
” শিওর। বাই দ্যা ওয়ে আপনার নাম? ”
” নাহাল ফিলালি। ”
” আমি ইসাম শাহমীর। ”
__________
ইসাম গাড়ির জানালায় এসে নক করতেই ফাতিহ উইন্ডো নামিয়ে ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ইসাম সামান্য মাথা চুলকে নিজের পাশে দাঁড়ানো নাহালকে দেখিয়ে বলে,
” ফাতিহ। শি ইজ নাহাল। ”
ইসামের কণ্ঠস্বর শুনে ল্যায়লাও জানালা নামিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ফাতিহ সামান্য হেসে হাই বলতেই ইসাম পরিচয় করানোর সুরে বলে উঠে,
” নাহাল, মিট ফাতিহ এন্ড ল্যায়লা। মাই ব্রাদার এন্ড সিস্টার ইন লো। ”
ইসামের কথা শুনে দুইজনের চোখই চড়াক গাছের ন্যায় হয়ে যায়। নাহাল ভদ্রতার সুরে তাদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” মারহাবান। ”
ইসাম ফাতিহকে চোখের ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বলে। ফাতিহ গাড়ি থেকে নেমেই হাসতে হাসতে ইসামের ঘাড় ধরে কিছুটা দূরে গিয়ে বিড়বিড়িয়ে প্রশ্ন করে,
” তুই ভুল পরিচয় দিলি কেন? ”
ইসাম সামনে তাকিয়ে দেখে নাহাল তার দিকেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইসাম হাসতে হাসতে ধীর স্বরে বলে উঠে,
” নাহালের রাবাত পর্যন্ত লিফট দরকার। আর তাছাড়া ও আমাকে দেখে চিনেও নি। হয়তো খেলা দেখে না কখনো। কিন্তু মেয়েটা লিফট চাইতে ভয় পাচ্ছিলো। তাই ওকে আশ্বস্ত করার জন্যই আমি আমাদের ফ্যামিলি হিসেবে পরিচয় দিয়েছি। ”
ফাতিহ একই সুরে বলে উঠে,
” মেয়ে মানুষ দেখলেই তোর মনে একটু বেশিই দয়া মায়া উথলে পড়ে না বন্ধু? এই মেয়ে যে আমাদের ক্ষতি করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? ”
ইসাম নাহালের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
” তুই মেয়েটার চেহারা দেখ। কি সুন্দর! মাশাল্লাহ। ওকে দেখে কোনো এংগেল থেকেই আমার ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। আর তাছাড়া তুই যখন ল্যায়লার সাহায্য করেছিলি আমি কি তোকে বাধা দিয়েছিলাম? ”
ফাতিহ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
” শি ইজ নট ল্যায়লা। একে তো আমরা সাথে কোনো গার্ড নেই নি। অলরেডি এজেন্সির কারণে অনেক ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারছি। তার উপর তুই নতুন ঝামেলা নিয়ে এসেছিস। যা ইচ্ছা কর। ”
কথাটা বলেই ফাতিহ গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। ইসাম তার হাত ধরে অনুরোধ করে বলে,
” তুই প্লিজ ড্রাইভ কর বাকি পথটা ব্রো। লেট মি সিট উইথ নাহাল। ”
ফাতিহ ইসামের দিকে চোখ পাকিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠে বসে। ইসাম মুখে বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে নাহালের দিকে এগিয়ে যায়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]