অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২৬.

0
211

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.

” কি বললে তুমি? ফুটবল টিম? ”

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে নাহাল। ইসাম আয়েশী ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

” হ্যাঁ। দাদাকে কথা দিয়েছি যে আজকে আমার টিম জিতলে আমি তাকে অনেকগুলো নাতি উপহার দিবো। ”

নাহালের মাথায় হাত। সে হতভম্ব স্বরে বলে উঠে,

” ইসাম, বাচ্চা না গাছে ধরে না যে যখন ইচ্ছা গাছ থেকে পেরে এনে দাদার কোলে দিয়ে দিবে। ”

ইসাম নাহালের একহাত ধরে টান দেয়। সাথে সাথে নাহাল বসা থেকে তার বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে। ইসামের আকস্মিক কান্ডে সে ভ্রু কুচকে তাকায়। ইসাম নিজের মতো বলতে থাকে,

” হ্যাঁ। জানিতো। সেজন্যই বিয়ের পর একমাস দাদাকে নাতি এনে দেওয়ার মিশনে নামবো। ”

নাহাল রাগে ইসামের বুকে ঘুষি মেরে বলে,

” নির্লজ্জ কোথাকার। আমার আসাটাই ভুল হয়েছে। ”

কথাটা বলেই নাহাল উঠে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। ইসাম দ্রুত উঠে গিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। ব্যস্ত স্বরে বলে,

” কোথায় যাচ্ছো? ”

” নিজের বাসায়। বিয়ের আগে তোমার সাথে আমার আর দেখা হচ্ছে না। ভিডিও কল দিয়েও লাভ নেই। রিসিভ করবো না। ”

ইসাম নাহালের কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুটা নিজের কাছে এনে বলে,

” বহু ঘুরিয়েছো আমাকে। এখনও একই কাজ করছো। সমস্যা নেই। বিয়েটা হতে দাও একবার। তখন সুদে আসলে সব ফেরত নিবো। ”

__________

শাহমীর ভবন সম্পূর্ণ আলোক সজ্জায় সজ্জিত। মানুষের আনাগোনায় রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ইসাম তৈরি হয়ে আয়নায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের আনুষ্ঠিকতা শুরু হবে। কিন্তু তার টিমের কেউ এখনো পৌঁছায় নি। সবাই নাকি একেবারে এয়ারপোর্টে থেকে এখানে এসে রেডি হবে। কবে আসবে এরা? ইসামের বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে গেলে?

ইসাম নিজের ফোন হাতে নিয়ে দু একটা সেলফি তুলে। পরপর ল্যায়লার ইনবক্সে একটা ছবি সেন্ড করে লিখে,

” ইসাম’স হাই বাজেট ওয়েডিং গেটাপ। ”

মেসেজের শেষে একটা চোখ মারার ইমোজিও দেয় সে।

ল্যায়লা সবে মাত্র ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। ফোনের নোটিফিকেশন বারের টুং শব্দে সে ফোন হাতে নেয়। ইসামের মেসেজ দেখে সামান্য হাসে। পরপরই সে ভিডিও কল দেয়। সাথে সাথে ইসাম রিসিভ করবো বলে উঠে,

” ডোন্ট টেল মি তুমি এখন বিয়েতে না এসে রিগ্রেট করছো। ”

ল্যায়লা মুচকি হেসে বলে,

” উহু। মোটেও না। আমি তো তোমার হাই বাজেট ভিজুয়ালের দর্শন পাওয়ার লোভে কল দিলাম। ”

ইসাম কিছুটা ভাব নিয়ে বলে,

” ওহ। তাই বুঝি! ”

ল্যায়লা প্রশ্ন করে,

” গিফট আনপ্যাক করে দেখেছো? ”

” হ্যাঁ। খুব সুন্দর ছিলো। নাহালও খুব পছন্দ করেছে। এতো দূর থেকে এতো চমৎকার উপহার পাঠানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ”

ল্যায়লা এবার কিছুটা বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলে উঠে,

” একটা সিক্রেট বলি। শুনো। প্রথম যেদিন নাহাল আর তোমাকে একসাথে দেখেছিলাম সেদিনই আমার মনে হয়েছিলো তোমাদের ভবিষ্যৎ একসাথে গাঁথা। হ্যাশট্যাগ সোলমেট ফরেভার। ”

ল্যায়লার কথার বিপরীতে ইসাম কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে একজন ব্যস্ত পায়ে তার রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,

” ফাইনালি আই রিচড টু ইউ। ”

সাথে সাথে সেই মানুষের পা জোড়া থমকে যায়। ইসামের হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে সেই পরিচিত মুখশ্রী দেখতে পেয়ে তার কাধে ঝুলানো ব্যাগপ্যাক হাত থেকে পড়ে যায়। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে স্ক্রিনে থাকা সেই হতবিহ্বল নারী মুখশ্রীকে।

ফোনের অপরপাশ থেকে ল্যায়লাও থমকে যায় ফাতিহকে দেখে। আজ কতমাস পর দেখার সুযোগ মিললো। ফাতিহর চেহারা অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। জয়ের খুশি নাকি ঠিক বুঝতে পারছে না।

ইসাম ল্যায়লা এবং ফাতিহর প্রতিক্রিয়া দেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

” হ্যাশট্যাগ ডেস্টাইনড টু মিট এগেইন এন্ড এগেইন। ”

ফাতিহ শান্ত কদম ফেলে সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু এতে ল্যায়লা অশান্ত হয়ে পড়ে। সে যেন শব্দের খৈ হারিয়ে ফেলেছে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সে ফট করে কল কেটে দেয়। ফোন বুকে চেপে ধরে বসে পড়ে। সে এখনো মানসিকভাবে নিজের এই অনুভূতিকে স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত নয়। তাই তো এতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে যদি আবার সে ভাগ্যের খেলায় ঠকে যায়? তার মা বাবা সবসময় তাকে যেই ভালোবাসার কাঙাল বানিয়ে রেখেছিলো, সেই ভালোবাসা যদি সে কখনো না পায়?

__________

ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে দেখা করতে আসে ল্যায়লা। দেশে ফেরার পর থেকে সে কাউনসিলিং এর জন্য এখানে আসা যাওয়া করছে। এতে বেশ ভালো সুফলও পেয়েছে সে। সাইকিয়াট্রিস্টের কেবিন থেকে বের হওয়ার পরপরই তার ফোনে একটা কল আসে। ল্যায়লা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে আননোন নাম্বারটা কয়েকবার মুখে আওড়ায়। এই নাম্বার তার পরিচিত নয়। কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে কাটিয়ে সে অবশেষে ফোন রিসিভ করে কানে দেয়।

__________

আজ বেশ অনেক মাস পরে এই বাড়িতে আবার পা মাড়িয়েছে ল্যায়লা। বাড়ির ভিতরে প্রচুর মানুষের আনাগোনা। লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই ল্যায়লা দেখে একটি খাটিয়াতে ফারদিনের নিষ্প্রাণ দেহ শুয়ে আছে। সেই খাটিয়ার একপাশে বসে তার মা আমাল কাঁদছে। বেশ কিছু মহিলা তাকে শান্তনা দিতে ব্যস্ত। ভীড় ঠেলে মিথিলা আন্টি ল্যায়লার দিকে এগিয়ে আসে। করুণ সুরে বলে,

” আম্মু কতদিন পর আসলা। ”

ল্যায়লা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

” ভালো আছেন আন্টি? ”

” আমরা ভালো আছি আম্মু। তুমি এই আজাব থেকে মুক্তি পাইসো দেখে এখন আরো খুশি আমরা। ”

ল্যায়লা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করে,

” ইয়াসির ভাইয়া দেশে নেই? ”

” আছে তো। আব্বা উপরে নিজের রুমে আছে। ”

ল্যায়লা শান্ত পা ফেলে উপরে যায়। দোতলার শেষের দিকের রুমটাই ইয়াসিরের। এই রুমে ল্যায়লার কখনোই আসা হয়নি আগে। দরজার কাছে গিয়ে নব ঘোরাতেই দরজা খুলে যায়। ল্যায়লা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করে,

” আসবো? ”

ইয়াসির বিছানায় বসে ছিলো। ল্যায়লার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সে বিস্ময় নিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। মাথা নেড়ে আসার অনুমতি দেয়। ল্যায়লা রুমে প্রবেশ করে ইয়াসিরের মুখোমুখি একটা কাউচে এসে বসে। সে শান্তনা দেওয়াতে খুব কাচা। তাই বুঝে উঠতে পারছে না কি বলা উচিত।

ইয়াসির নিজ থেকেই হেসে বলে উঠে,

” আমি কিন্তু তোমার শাস্তি মেনে নিয়েছিলাম। তোমার সামনে আর কখনো না যাওয়ার ওয়াদা করেছি। অথচ এখন তুমিই আমার সামনে এলে। ”

ল্যায়লা শান্ত ভঙ্গিতে ইয়াসিরকে দেখে। এই লোক হাসছে কিভাবে এই মুহুর্তে? শোকে কি মাথাটা গেলো নাকি? তাকে অবাক করে দিয়ে ইয়াসির আবার বলে উঠে,

” আমার শান্তনার প্রয়োজন নেই। তোমার আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ”

” আপনার খারাপ লাগছে না মোটেও? ”

ইয়াসির জবাব না দিয়ে ফিকে হাসে। ল্যায়লা চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছাকাছি যেতেই সে ইয়াসিরের ভরাট কিন্তু অসহায় স্বর শুনতে পায়,

” আমি এতিম হয়ে গিয়েছি ল্যায়লা। ”

কথাটা বলতেই তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ল্যায়লা অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ইয়াসিরকে কাঁদতে দেখে তার মায়া হয়। মা থাকা সত্ত্বেও তো সে-ও এতো বছর এতিমের মতোই জীবন পার করেছে। তাই ইয়াসিরের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সে আন্দাজ করতে পারছে। ল্যায়লা গুটিগুটি পায়ে ইয়াসিরের সামনে গিয়ে বসে। নিজের একহাত ইয়াসিরের হাতের উপর রাখে। ইয়াসির চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই ল্যায়লা বলে উঠে,

” আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। আপনিও নিজেকে মাফ করে দেন। ”

ল্যায়লার কথা শুনে ইয়াসিরের কান্নার গতি আরো বাড়ে। সে মাথা নত করে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। আজ অবশেষে তার মনে হচ্ছে সে ক্ষমা পেয়ে গিয়েছে। রুহের উপর থেকে অনুশোচনার বোঝা হালকা হয়ে আসে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here