অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩১.
ছোট্ট জীর্ণ শীর্ণ শরীরটাকে সামান্য বাকিয়ে গলায় একটা সাপ ঝুলিয়ে সব দাঁত বের করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে আছে পোনা। তার গলায় ঝুলন্ত সাপটার নাম হলো ব্যান্ডেড ক্রেট। দুই ফুট উচ্চতার এই সাপটির গায়ের রঙ অনুভূমিক হলুদ ও কালো ব্যান্ডে আবৃত। মাথার নিচের অংশ হলুদ। পোনা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভাঙা বাংলায় বলে উঠে,
” কিবা ছবি উঠসে আপা? ”
ল্যায়লা ঠোঁটের কোণে হাসি এনে শেষ ক্লিকটা সম্পূর্ণ করে বলে,
” তোমার হাসি অনেক সুন্দর পোনা। ছবি কেমন এসেছে দেখতে চাও? ”
পোনা সাথে সাথে সম্মতির সুরে মাথা ঝাকায়। সে সাথে সাথে গলায় পেঁচিয়ে রাখা সাপটাকে একটা মুখবন্ধ ঝুড়ির ভেতর রেখে ল্যায়লার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ল্যায়লা নিজের ক্যামেরা থেকে ছবি বের করে দেখাতেই পোনা বলে উঠে,
” তুমি সাপরে ভয় পাও না? ”
” উহু। ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি যাদের প্যাশন তারা এসব প্রাণীকে ভয় পায় না। আর তাছাড়া সাপকে আমার তুলনামূলক কম ভয়ংকর মনে হয়। সাপের থেকে বেশি ভ’য়ংকর এবং বি’ষধ’র হলো মানুষ জাতি। ”
পোনা ল্যায়লার কথার সারমর্ম বুঝতে পারলো কিনা তা বুঝা গেলো না। কিন্তু সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লো। ল্যায়লা তা দেখে হেসে দেয়।
আট বছর বয়সী পাহাড়ী এই ছেলেটার সাথে আজ সকালে তার পরিচয়। কিন্তু ইতিমধ্যে কি সুন্দর তাকে আপন করে নিলো। পাহাড়ের মানুষরা প্রায়ই এরকমই হয়। এদের জন্ম এবং বেড়ে উঠা পাহাড়ের শুদ্ধতম পরিবেশে। তাইতো এদের মনও এতো শুদ্ধ হয়।
ল্যায়লা এই মুহুর্তে রাঙ্গামাটি সর্ব উত্তরে মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত সাজেকে অবস্থান করছে। তার উদ্দেশ্য কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো। কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। এই কংলাকে যাওয়ার পথেই পোনা নামক ছোট্ট আদিবাসীর সাথে পরিচয় তার। বেশ অনেকখানিক পথ পোনা তার সাথে এলেও এখন তাকে নিজ গৃহে ফিরতে হবে। ল্যায়লাও বাচ্চা ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ব্যাগপ্যাক থেকে একটা স্নিকারস বার বের করে দিয়ে তাকে বিদায় জানায়। অত:পর ফের রওনা হয় কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য।
__________
কংলাক পাহাড় বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। এই পাহাড়ের উপরেই অবস্থিত কংলাক পাড়া। কংলাক পাড়া ও রুইলুই পাড়ার সমন্বয়েই মূলত সাজেক ভ্যালি গঠিত। কংলাক পাহাড়ের চূড়া থেকে লুসাই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়।
সাজেকের হ্যালিপ্যাড হতে ৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাক পাড়ায় পৌঁছে যায় ল্যায়লা। এই পাড়াটি কমলাক পাড়া নামেও বেশ পরিচিত। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়, এই পাড়ার পাশে বড় বড় কমলা বাগান অবস্থিত হওয়ায়।
শীত শীত মরসুম। গত বছরের এমন সময়টাতেই ল্যায়লা অন্য দেশের মাটিতে অন্য এক পর্বত চূড়ায় অবস্থান করছিলো। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতেই ল্যায়লা মুগ্ধ চোখ মেলে চারিদিক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চারিদিকে পাহাড়, সবুজ এবং মেঘের অকৃত্রিম মিতালী যেনো জায়গাটার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দিলো।
ল্যায়লা কাঁধ থেকে ভারী ব্যাগপ্যাক নামিয়ে সবুজ ঘাসের উপর রেখে দেয়। শীতের দিন হওয়ায় সবুজ ঘাসে শিশির কণা জমে তা ভিজে আছে। ল্যায়লার আচমকা ইচ্ছে হলো এই সবুজ ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটার। যেই ভাবনা, সেই কাজ। ল্যায়লা পায়ের শু আর সকস খুলে ব্যাগপ্যাকের পাশে রেখে ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ এভাবে পায়চারি করে সে পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে সাবধানে দাঁড়ায়। সাথে সাথে এক দমকা হাওয়া এসে ল্যায়লাকে ছুঁয়ে যায়। সাথে সাথে সে চোখ বুজে ফেলে। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠে দশ মাস আগের দৃশ্যচিত্র।
__________
সেদিন রাতে ফাতিহর কেবিন থেকে বের হয়ে ল্যায়লা সবার আড়ালে নিজের ব্যাগ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ে। পরদিন সকালেই সে ইয়াসিরের সাথে রাবাতে অবস্থিত নিজের নানুরবাসায় যায় মানুষগুলোর খোঁজ নেওয়ার জন্য। ল্যায়লা মনে বেশ শঙ্কা নিয়েই সেই বাড়ির দুয়ারে গিয়েছিলো৷ কিন্তু ভাগ্য মেহেরবান ছিলো। মানুষগুলো তাকে দেখে এবং তার পরিচয় জানতে পেরে তাকে আপন করে নিয়েছিলো। তাদের ভাষ্যমতে তাদের সকল রাগ আমাল ও রাদিফের সাথে কেবল।
এতো কিছুর মাঝেও ল্যায়লার মাথা থেকে ফাতিহর চিন্তা দূর হয় নি। সে মনে মনে ফাতিহর জন্য দোয়া করছিলো। বিকেলের দিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে জানতে পারে ফাতিহর অপারেশন ভালো মতোই হয়েছে। তবে প্রায় ছয়-সাত মাস তাকে ফিজিওথেরাপি চালিয়ে যেতে হবে এবং খেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ফাতিহ সুস্থ আছে জানতে পেরে ল্যায়লা খুশি হয়। ফিরে আসে নিজের দেশে। কিছুদিনের মধ্যে ইয়াসিরও পাড়ি জমায় অন্য দেশে। কিন্তু সবথেকে অবাক করার বিষয় হলো এই ঘটনার পর ইসাম আর তার সাথে যোগাযোগ করে নি। ল্যায়লা নিজেও আর যোগাযোগের চেষ্টা করে নি। সে ফাতিহকে যতই ভালোবাসুক না কেন তাদের পথ আলাদা। এই আলাদা পথে কোনো পিছুটান না রাখাই ভালো। যে যার অবস্থানে ভালো থাকুক কেবল এটাই তার চাওয়া। ফাতিহ যোহরাকে ভালোবেসে ভালো থাকুক, আর সে নাহয় ফাতিহকে ভালোবেসে ভালো থাকবে।
__________
“ আমি ভেবেছিলাম তোমার সুই’সাইড করার ভূত সম্পূর্ণভাবে দূর হয়েছে। “
পরিচিত কণ্ঠস্বর ল্যায়লার কানে ঝংকার তুলে। পাহাড়ের কিনারে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যায়লা নিজের বদ্ধ চোখ জোড়া খোলার সাহস করে না। সে সটান দাঁড়িয়ে রয়। যদি এটা কেবল তার ভ্রম হয়? কিছুক্ষণ সময় পাড় হয়। আর কোনো সাড়াশব্দ শুনতে না পেয়ে ল্যায়লা নিশ্চিত হয় এটা শুধুই তার ভ্রম ছিলো।
কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে ঠিক সেই মুহুর্তে তার কানের কাছে পরিচিত কণ্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ কল্পনা নয়, সত্যি ল্যায়লা। “
ল্যায়লার সম্পূর্ণ শরীরে তড়িৎ বয়ে যায়। সে চমকে পিছনে ফিরে তাকায়। অসাবধানবসত ঘুরে দাঁড়ানোর সময় তার পা পিছলে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটি তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে ল্যায়লার একহাত ধরে রাখে। বিস্ময়ে ল্যায়লার মুখ ফুটে আপনাআপনিই বের হয়,
“ ফাতিহ! “
ফাতিহ সাথে সাথে ল্যায়লাকে একটানে কিনারা থেকে কিছুটা ভিতরের দিকে নিয়ে আসে। একপল অপেক্ষা না করেই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দেয়,
“ আমি তোমাকে ভালোবাসি ল্যায়লা। “
বিস্ময়ে হতভম্ব ল্যায়লা কোনো জবাব দিতে পারে না। ফাতিহ আবার বলে উঠে,
“ আমি তোমাকে ভালোবাসি ল্যায়লা। “
ল্যায়লা খুঁটে খুঁটে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখতে ব্যস্ত। ফাতিহকে দেখতে এখনো সেই প্রথমদিনের মতোই লাগছে। ফাতিহ শেষবারের মতো আবার বলে,
“ আমি তোমাকে ভালোবাসি ল্যায়লা। “
কথাটা শেষ হতেই সে ল্যায়লাকে জড়িয়ে ধরে। ল্যায়লার শরীর জুড়ে বয়ে যায় এক হীম শীতল হাওয়া। খোলসে আবৃত হৃদয়ের অনুভূতি চোখের বিন্দু অশ্রুকণা হয়ে নির্মোচন হয়। স্তব্ধ চিত্ত আর বাকরুদ্ধ মুখ নিয়ে সে ফাতিহর বুকে পড়ে রইলো। সময় গড়ালো। ল্যায়লার তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ফাতিহ কোমল সুরে সুধায়,
“ সে সামথিং প্লিজ। “
ল্যায়লা অস্ফুটে প্রশ্ন করে,
“ যোহরা? ”
ফাতিহ সোজা হয়ে ল্যায়লাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। তার গভীর চোখে চোখ রাখে। পরপর বলে উঠে,
“ এতো অধৈর্য্য কেন তুমি? আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে এলে! একবারও জানতে ইচ্ছে করে নি আমি কি চাই? ”
ল্যায়লা জবাব দিতে পারে না। চেনা মুখের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শনে তার নিঃশ্বাস হয় রুদ্ধ। সেদিন অবচেতন ফাতিহর সামনে নিজের মনের কথা যতটা সহজে স্বীকার করতে পেরেছিলো আজ আর সেই সাহস তার মাঝে কাজ করছে না। ফাতিহ বেশ মোলায়েম স্বরে বলে,
“ যোহরা আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসা। কিন্তু তুমি আমার অকপটে প্রকাশ্য ভালোবাসা। “
ফাতিহর স্বীকারোক্তিতে যেন ল্যায়লার কোমল হৃদয়ে এক গুচ্ছ তুলোর ন্যায় মেঘ এসে বাড়ি খায়। ফাতিহ অধৈর্য্য হয়ে বলে,
“ দশটা মাস অপেক্ষা করিয়েছো। আমার অবচেতন অবস্থায় আমার কাছে এসেও ফিরে গিয়েছো তুমি। এবার আমি আসলাম তোমার কাছে। তোমার উত্তর এবং তুমি দুটোর একটাও না নিয়ে ফিরবো না আমি। ”
ফাতিহর ধৈর্য্যের অবসান ঘটিয়ে ল্যায়লা বলে উঠে,
“ আমিও। “
“ তুমিও কি? “
এই মুহুর্তে সরাসরি ফাতিহর দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও লজ্জা লাগছে ল্যায়লার। তবুও সে বলে উঠে,
“ আই অলসো ডু। ”
ফাতিহ এবার হেসে ল্যায়লাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে বলে উঠে,
“ আমাকে থাপ্পড় মারতে কখনো লজ্জা পাও নি, কিন্তু এখন ভালোবাসি বলতে এতো লজ্জা পাচ্ছো? “
ল্যায়লা লজ্জা পায় এহেন কথায়। নিজের করা সকল কর্মকান্ড তার মনে পড়ে যায়। তবে সেসব চিন্তা দূরে ঠেলে সে প্রশ্ন করে,
“ তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে? ”
“ পিঁছু নিয়েছিলাম তোমার। বহু কষ্টে আত্মগোপন করে এই পর্যন্ত এসেছি। আর এই পর্যন্ত এসে এখন নিজেকে স্বার্থক মনে হচ্ছে। “
কথাটুকু বলেই ফাতিহ লজ্জা চিত্তে আড়ষ্ট ল্যায়লার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। পকেট হাতড়ে একটা রিং বক্স বের করে সেখানে থাকা আংটিটা হাতে নিয়ে নেয় সে। পরপরই সেই দীঘল চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,
“ কংলাক পর্বত থেকে আমার অ্যাটলাস শৃঙ্গের দেশে ফিরে যাবে ল্যায়লা? যেই ভূমিতে সূচনা হয়েছিলো সেই ভূমিতে ফিরে এক নতুন উপাখ্যান লিখবে আমার সাথে? আমাকে বিয়ে করবে? ”
ল্যায়লার প্রফুল্লবদন, নয়নযুগল সবকিছু যেন এক সঙ্গে সম্মতির ঘোষণা দিচ্ছে। তবুও ফাতিহ অপেক্ষা করলো ল্যায়লার মুখে উত্তর শোনার জন্য। ল্যায়লা লজ্জা কাটিয়ে দু’হাতে পিঠের পিছনে নিয়ে ভাজ করে দুষ্টমির ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ ফেসে যাবে। “
ফাতিহ হেসে বলে,
“ ফেসে গেছি। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]