আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️ পর্ব ৩৮

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৮

আকাশ থমথমে।বৃষ্টি হওয়ার আগাম আভাসের আনাগোনা আকাশজুড়ে।বারকয়েক গুড়ুম গুড়ুম শব্দও কানে এসেছে।ঠান্ডা হাওয়া বইছে।হসপিটালের করিডোর ধরে মায়াকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।ঠান্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে।বাতাসে মায়ার ওড়নার আচঁল দিয়ে টানা ঘোমটা পরে গেছে।কপালের দিকে কিছু চুল বেরিয়ে পরেছে।ঠোঁটগুলো শুষ্ক।ঘন পাঁপড়িগুলো দিয়ে বারবার পলক ফেলছে সে।আরিয়ান একটু থেমে মায়ার ঘোমটা উঠিয়ে দেয়।তার আজকাল খুব ভয় লাগে।বাইরে আসলে মনে হয় সবার নজর লেগে যাবে মায়ার।যদিও এই বিষয়গুলো একেবারেই অযৌক্তিক,অহেতুক।আরিয়ান জানে,তারপরও অবচেতন মন মানতে চায়না।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে একবার আকাশের দিকে তাকায় আরিয়ান।মনে মনে ভাবে,যত দ্রুত সম্ভব বাসায় পৌছাতে হবে।বজ্রপাতের শব্দে বেশ ভয় পায় মেয়েটা।কয়েকদিন আগে বজ্রপাতের শব্দে সারারাত তাকে জাপটে ধরে বসেছিলো।একবিন্দু ঘুমোয়নি।এখন গাড়িতে থাকা অবস্থাতেই যদি বিদ্যুৎ চমকায় তবে মায়াকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।ভাবনার মাঝেই হঠাৎই থমকে দাড়ায় মায়া।হাপাতে হাঁপাতে বলে,
—“একটু দাঁড়ান।অস্থির লাগছে।”

আরিয়ান থামে।একটু দূরে বসার সিট আছে।মায়ার মাথাটা বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে সে বলে,
—“বসবে?”

—“নাহ্,বসলে আবার উঠতে কষ্ট হবে।”

আরিয়ানে স্বস্নেহে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মায়ার কষ্টটা সে নিতে পারেনা।একদমই পারেনা।
হসপিটালে কত মানুষ!যে যে যার যার ধ্যানে আছে।সবাই ব্যস্ত সবার আপনজন নিয়ে।হঠাৎই একটা কোলাহলে ছেঁয়ে যায় হসিপিটাল।একটু দূরেই গেট।তারা যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে।কয়েকজন ওয়ার্ডবয় মিলে দ্রুত স্ট্রেচার নিয়ে এগিয়ে আসছে পিছন থেকে।আরিয়ান মায়াকে নিয়ে একটু সরে দাড়ায়।
গেট দিয়ে একজন ভদ্রলোক ঢুকছেন।তার শার্টে হাল্কা রক্ত।কোলে সন্তানসম্ভবা বউ।মহিলা অচেতন।একটু খেয়াল করতেই আরিয়ান লক্ষ্য করলো মহিলার পেছন সাইডের জামা রক্তে ভিজে গেছে।সাথে সাথে মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আরিয়ান।রক্ত দেখলে আবার প্যানিক হয়ে যাবে মেয়েটা!
ভদ্রলোক তার বউকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো।তাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।নার্সরা বারবার রক্ত ম্যানেজ করার কথা বলছে।ভদ্রলোকের চেহারা উদ্ভ্রানতের মতো অবস্থা।কোনদিকে কি করবে বুঝতে পারছেনা সে।মহিলাকে নিয়ে গেলে মায়াকে ছেড়ে দেয় আরিয়ান।তার বুক থেকে মুখ তুলে মায়া।
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সরল মনে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনি রক্ত ম্যানেজ করে দিননা উনাকে।”

আরিয়ান একপলক মায়ার দিকে তাকায়।পরক্ষনেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“আচ্ছা,দেখছি।,,,,তোমার অস্থিরতা কমেছে?গাড়িতে নিয়ে বসাই।তারপর দেখি কি করা যায়।”

মায়া মুচকি হেসে বলে,
—“চলুন”।

খুব সাবধানে মায়াকে গাড়িতে বসায় আরিয়ান।দায়িত্ব এখন আরো বেশি।আগে ছিলো দুইজন এখন তা বেড়ে হয়েছে তিনজন।একদিকে একসাথে দুটো বাচ্চা হওয়ার অগাধ খুশি আরেকদিকে মায়ার জন্য দুশ্চিন্তা।সব মিলিয়ে এক মিশ্রঅনুভূতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।
গাড়ির গেট লাগিয়ে আবারো ভেতরে যায় আরিয়ান।আধাঘন্টার মধ্য লোকটার বউয়ের জন্য রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে তার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ফিরে আসে।এর মধ্যে অবশ্য তিন-চারবার এসে মায়াকে দেখে গিয়েছে।

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পরছে।আরিয়ান দ্রুত যেয়ে গাড়িতে বসে।মায়া চোখ-বন্ধ করে আছে।ঘুমিয়ে পরেছে হয়তো।মাথাটা জানালার সাথে ঠেকানো।
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মেয়েটার সৌন্দর্য কি দিনদিন বেড়েই চলেছে?মায়া অতিরিক্ত রূপবতী।অন্তত তার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী,আদুরে,মায়াবী রমনী!!
গাড়ি স্টার্ট দিতেই নড়েচড়ে উঠে মায়া।ঘুমের মাঝে মাথা এ কাত করতেই আরিয়ান তা ঠি ক করে নিজের বাহুতে রাখে।একহাতে ধরে রেখে আরেকহাতে গাড়ি ড্রাইভ করে।
এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে আবার মাঝরাতে জেগে উঠে বলবে,”আমার ঘুম আসছেনা,চলেন গল্প করি।”
___________
বৃষ্টিতে ভিজে আছে বাগান।জ্যাক আর জেনিকে ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছে।আরিয়ান মায়ার পিছু পিছু ওরাও ঢুকেছে রুমে।আরিয়ান বারণ করেনি।মায়ার খুব আদুরে এরা দুজনই।সে অফিসে গেলে ঘুমব্যাতিত প্রায়শই তাদের সাথে খেলা করে মায়া।
মায়া ফিরতেই ইতি এসে পরেছে।আরিয়ান গেছে শাওয়ার নিতে।মায়ার সাথে ইতিই আছে।অনেকক্ষনের
জন্য মায়াকে একা রুমে রেখে সাধারণত কোথাও যায়না আরিয়ান।
ফ্লোরে কার্পেটের উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে জ্যাক আর জেনি।
ইতির মুখে চওড়া হাসি।টুইন্স বেবি হবে খবরটা শুনতেই খুশিতে মনটা লাফাচ্ছে তার।দুটো বাচ্চা একসাথে সারাবাড়িতেই দৌড়াবে।কি সুন্দরই না লাগবে দৃশ্যটা!
তিড়িংবিড়িং করা কন্ঠেই সে বলে,
—“আচ্ছা আপু,ওরা যদি দেখতে একদম একরকম হয় তবে ওদের আলাদা করবেন কি করে?”

মায়া শব্দ করে হাসে।খানিকটা চিন্তা করে বলে,
—“জানিনা ইতি।আগে আসুক তারপর ভেবে দেখবো।তন্ময় ভাইয়া কখন আসবেন?”

—“বললোতো ঘন্টাখানেক লাগবে।ওর তো কথাবার্তার ঠি ক নেই।দেখা যাবে তিনঘন্টা লেট করে বলবে,রাস্তায় জ্যাম ছিলো।তবে আজকে মনে হয়না দেরি হবে।টুইন্সদের কথা শুনেছেতো।দৌড়ে চলে আসবে”

মায়া আবারো খিলখিল করে হাসে।তন্ময়ও কম পাগলামি করেনা।মায়াকে এটা ওটা এনে দেয়।আরিয়ান আইসক্রিম,কোক এসব খেতে মানা করলেও মায়া খেতে চাইলে তন্ময় এনে দেয়।আরিয়ানের সাথে ঝগড়া করে হলেও এনে দেয়।
একবারতো মায়ার জেদে রাত দশটা বাজে মায়াকে নিয়ে আরিয়ানের অফিসে চলে গিয়েছিলো।আরিয়ান ফিরতে দেরি করছিলো বলে মায়া জেদ করছিলো তার অফিসে যাবে তখন তার সাথে না পেরে তখন ই মায়াকে নিয়ে বেরিয়েছিলো তন্ময়।

_______________

আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে মায়া।সাতমাসের ভরা পেট তার।একটু মোটা হয়ে গিয়েছে।মা মা একটা ভাব শরীরে।শরীরটা খুব ভারি ভারি লাগে ইদানীং।পেটে আলতো করে হাত বুলায় সে।হঠাৎই ভাবনা আসে তাকে কি খুব বাজে দেখায়?
একবার আরিয়ানের দিকে তাকায় সে।পাশের সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আরিয়ান।আজকে অফিসে যেতে পারেনি।সকালবেলা তার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।এত মাসেও খাওয়ার রুচিতে কোন সমস্যা হয়নি মায়ার।কোনরকম গন্ধও লাগেনা।সবই খেতে পারে।বরং তুলনায় অনেক বেশি খাবার খায়।
দুজন বাচ্চা পেটে।ক্ষুধা তো বেশি লাগবেই।সকালে নাস্তার পর তিনবার বমি হয়েছিলো তার।যা খাচ্ছিলো তাই বমি করে দিচ্ছিল।ডক্টরকে বলে আরিয়ান ওষুধ খাওয়ানোর পর কিছুটা ভালো লাগছে এখন।

আয়নার সামনে মায়ার এমন ঘুরাফেরা আর হতাশ চোখের চাহনী দেখেই আরিয়ান মায়ার মনের কথাটা বুঝতে পারে।ড.মিতালী বলেছিলো,এসময় মেয়েটা নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে।মায়াও হয়তো সেরকম কিছুই ভাবছে।
আরিয়ান ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গিয়ে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে।গালে গাল ঘষে বলে,
—“মায়াবতী,তোমার কি মনে হচ্ছেনা তোমার একটু কম সুন্দর হওয়ার দরকার ছিলো?”

—“ফালতু কথা বলবেন না,,আমি জানি আপনি আমাকে খুশি করার জন্য বলছেন।”

—“এমনটা কেন মনে হলো?”

মায়া এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,
—“আমি খুব মোটা হয়ে গেছি তাইনা?”

আরিয়ান ছোট্ট করে তার গালে ছোট ছোঁয়ায়।বলে,
—“তুমি মোটা হওনি।গোলুমোলু হয়েছো।আমার গোলুমোলু মায়াবতী।আমি কি ভাবছি জানো?”
মায়া উৎসুক কন্ঠে বলে,
—“কি ভাবছেন?”

—“ভাবছি তোমাকে সবসময় প্রেগন্যান্ট বানিয়ে রাখব।যেন তুমি সবসময় এমন গোলুমোলু থাকো।কেমন আইডিয়াটা?”

মায়া ঝামটা মেরে তাকে সরায়।চোখমুখ কুঁচকে বলে,
—“ছিহ্,কিসব বলেন এগুলা!”
_______________
রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখে রাত বাজে দুইটা পঁয়ত্রিশ।তার একহাত মায়ার পেটের উপর রাখা।সোজা হয়ে ঘুমোচ্ছে মায়া।রোজ মাঝরাতে এসময় মায়ার ঘুম ভাঙে।ক্ষুধা লাগে অথবা ঘুম আসেনা কোন একটা কারণে হলেও ঘুম থেকে উঠে সে।তাই আরিয়ানেরও অভ্যাস হয়ে গেছে এসময় ঘুম থেকে উঠার।কিন্তু আজকে মায়া উঠলোনা কেন?আরিয়ান হাই তুলে উঠে বসে।পাশের ল্যাম্পলাইট জ্বালাতেই ঘর অনেকটা আলোকিত হয়ে যায়।ঝুঁকে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খায় সে।মায়া খুব ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।ভ্রু কুচকে আসে আরিয়ানের।বারদুয়েক গালে হাল্কা করে থাপ্পড় দেয়।মায়ার কোন হেলদোল নেই।বুকটা প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠে আরিয়ানের।কাঁপা গলায় সে দ্রুত ডাকে,
—“মায়া?মায়া উঠো?মায়াবতী?ক্ষুধা লাগেনি মায়া?শরীর খারাপ লাগছে?”

আর কথা বের হয়না গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।মায়া অচেতন।ঘুমের মাঝে মেয়েটা অচেতন হলো কিকরে?আরিয়ান দ্রুত নিজের গায়ের কম্বল সরায়।জোরে সরানোতে মায়ার গা থেকেও কম্বল সরে যায়।বিছানার দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে আরিয়ান।সাদা চাদরে লালরক্ত লেগে আছে।মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়।মায়ার গা থেকে সম্পূর্ণ কম্বল সরিয়ে তাকে একটু কাত করতেই নজরে আসে মায়ার পিছন সাইড রক্তে ভিজে গেছে খানিকটা….

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here