#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৯,
রেস্টুরেন্টের একই টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে রাইমা এবং দিগন্ত। অবশ্য সাথে মাহাদ, শার্লিন আর স্নেহাও আছে। মাহাদের যার সাথে সম্পর্ক সে স্নেহা। আর স্নেহার ভাই হওয়ার সূত্রে এখানে উপস্থিত দিগন্ত। দিগন্তকে দেখে ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও মাহাদের জন্য নিজেকে শান্ত রেখেছে রাইমা। স্নেহার সাথে আগে বার কয়েক দেখা হলেও সে কখনও দিগন্তকে স্নেহার সাথে দেখেনি। দিগন্ত নিজ মনে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। শার্লিন পেটপুরে খেয়ে উসখুশ করছে উঠে চলে যাওয়ার জন্য। রেস্টুরেন্টেের একপাশে সুন্দর করে ডেকোরেট করা আছে। একুরিয়ামে গোল্ড ফিশগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে তার কাছে। রাইমা চামচ দিয়ে খাবার নাড়ছে, দেখছে, হুটহাট মুখেও দিচ্ছে। মূলত দিগন্তের সামনে তার খেতে অসস্তি বোধ হচ্ছে। এই ঝগরুটে লোকটার তার মুখোমুখিই বসতে হলো! আর জায়গা ছিলো না! তাছাড়া স্নেহার মতো একজন শান্ত, মিষ্টি মেয়ের ভাই এই এলোভেরার মতো তিতা আর পিছলে লোকটা! রাইমার এসব চিন্তাভাবনার মাঝেই শার্লিন রাইমার কানে ফিসফিস করে বলে,
“বইনে! আমি এখান থেকে উঠি? আমার বসে থাকতে থাকতে বিশ্বাস কর কোমড়ের অবস্থা কাহিল। তোর এভাবে মূর্তির মতো বসে থাকতে ভালো লাগলে বসে থাক। আমারে যাইতে দে।”
“থাম, আমিও যাবো তোর সাথে। ভাইয়া, ভাবীকে একা কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিতে হবে তো!”
রাইমাও শার্লিনের মতো ফিসফিস করেই উত্তর দিলো। স্নেহা বিষয়টা খেয়াল করলো। সে ওদের উদ্দেশ্যে বললো,
” দুই বান্ধবী মিলে কি ফিসফিস করছো?”
স্নেহা আসার পরপরই শার্লিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে মাহাদ। সেজন্য বান্ধবী কথাটা বলে স্নেহা। রাইমা কিছু বলতে মুখ খুলবে তার আগেই শার্লিন চট করে বলে,
“আপনি আর মাহাদ ভাই কাপল মানুষ। আমি আর রাই মিঙ্গেল মানুষের মাঝে হাড্ডির মতো বাঁধা হয়ে বসে আছি। বিষয়টা কেমন একটা না! আমরা বরং একটু হাঁটাহাঁটি করি। খেয়েদেয়ে পেটও ভারি হয়েছে আমাদের। তাছাড়া মিঙ্গেল মানুষদের দেখলে আমার জ্ব”লে।”
শার্লিনের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় স্নেহা। মাহাদ কপাল চাপড়ে বসে। এই মেয়েকে কোন দুঃখে নিয়ে এসেছিলো রাইমা! দিগন্ত ফোন থেকে মাথা উঠিয়ে শার্লিনকে একপলক দেখে নিলো। রাইমা তো পারছেনা শার্লিনকে এখানে মুখে সেলাই করে চুপ করায়। স্নেহা শার্লিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
“জ্ব”লে বলতে? কি বললে বুঝলাম না আমি।”
“ও কিছু না ভাবী। পাগলের প্রলাপ, কানে তুলতে নেই। চল এখান থেকে। কোথায় যাবি বললি, চল ওখানে।”
রাইমা উঠে কথাটা বলেই শার্লিনের হাত ধরে টেনে তোলে। এরপর হনহনিয়ে চলে যায় ওখান থেকে। ওদের উঠে যাওয়ার কারণ আন্দাজ করতে পারে দিগন্ত। সেও কাজের অযুহাত দেখিয়ে বোনকে বলে,
“তোরা কথা বল। আমার জরুরী একটা কল করার ছিলো। কথা বলে আসছি আমি।”
দিগন্ত উত্তরের অপেক্ষা করে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায়। মাহাদ ওরা উঠে চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। টেবিলের উপর হাত রেখে স্নেহার চোখে চোখ রেখে তাকায়। স্নেহা মাহাদের চাহনীতে একটু ইতস্তত বোধ করে চোখ নামিয়ে নেয়। মাহাদ মৃদু স্বরে বলে,
“আমার চোখে চোখ মিলাতেও তোমার ইতস্তত বোধ হচ্ছে আজকাল!”
“বিষয়টা তা নয় মাহাদ। তোমায় নতুন করে আর কি বলার থাকতে পারে! এবার কি আমাদের সম্পর্কের ইতি টানা উচিত নয়?”
“জাস্ট শাট আপ স্নেহা। তোমায় কিছু বলি না তার মানে এটা নয় সম্পর্কের ইতি টানতে বলবে!”
“তুমি অযথা আমার জন্য সময় নষ্ট করছো। আংকেল আন্টি তোমার সুন্দর সুখী একটা সংসার দেখতে চান। তোমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার পরিবারের প্রতি। এবার তোমার বিয়েটা করা উচিত মাহাদ।”
“সেই ৮বছর আগে থেকে তোমায় ভালোবাসি। পড়াশোনা শেষ করলাম, চাকরিও নিলাম মোটামুটি মেনে নেওয়ার মতো। আমাদের সেইম এজ রিলেশনশিপ। না মানার কথা পরিবারের। আমার অপেক্ষায় থেকে দিনশেষে বয়স বেশি, এই কথার উপর দাড়িয়ে তোমায় ছাড়ার কথা আমার। তুমি আমাকেই ছেড়ে দিচ্ছো স্নেহা?”
১০,
স্নেহা মাথা নিচু করে বসে আছে। মাহাদের কথায় নিরুত্তর সে। মাহাদ করুণ চাহনীতে তাকায় স্নেহার দিকে। স্নেহার হাত দুটো আকড়ে ধরে বলে,
“এই হাত দুটো আকড়ে সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন আমি দেখেছি স্নেহা। আমি সেই পুরুষ হতে পারবোনা, যে একবার স্বপ্ন ভেঙে ২য় বার গড়তে পারে। আমার তোমাকেই লাগবে। অন্য কাউকে নয়। প্লিস বোঝার চেষ্টা করো।”
স্নেহার চোখ দিয়ে টপটপিয়ে জল গড়িয়ে পরে মাহাদের কথায়। ছেলেটা তাকে এতোটা ভালোবাসে। অথচ সে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে বিয়েতে অমত জানিয়ে বিয়েটা ভাঙতে চাচ্ছে। স্নেহা এবার মুখ খোলে, বলে,
“তুমি সব সমস্যা জানো মাহাদ। আমি পারছিনা আর এই টানাপোড়েনে থাকতে। রেহাই দরকার এবার। প্লিস তুমি আমায় আটকিও না।”
“কেনো আটকাবে না আপা! তোর যে চিন্তায় বিয়েতে অমত৷ সেই চিন্তার ভার আমি নিলাম। আর আজ আমি এখানে তোদের সম্পর্কের টানাপোড়েন মিটাতে এসেছি। তুই ভাঙতে চাইবি! আর আমি ভাঙতে দিবো? এটা দিগন্ত আহসান বেঁচে থাকতে সম্ভব হবে না।”
স্নেহার কথা শেষ হতেই দিগন্ত স্নেহার পিছনে দাড়িয়ে কথাটা বলে। মাহাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠে। দিগন্ত চেয়ারে বসতে বসতে ফের বলে,
“স্যরি, এখানে আসতেই আপুর কথা কানে আসলো। তাই কথাটা বললাম। মাহাদ ভাই, আপনি আগামী রবিবার আংকেল আন্টিকে নিয়ে দেখতে আসবেন। আমরা বাসাতেই কথাবার্তা ফাইনাল করবো।”
“দিগন্ত কি বলছিস এসব?”
স্নেহা অবাক নয়নে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। দিগন্ত বোনের দিকে তাকায়। শান্ত চাহনীতে বলে,
“ভালো ভাবে বলছি চুপচাপ মেনে নে। নয়তো তুই যার কথা ভেবে পিছিয়ে যাবার চিন্তা করছিস, সাথে আমার কথাও ভেবে বিয়েটা করবিনা বলে জিদ ধরে বসে আছিস। ভাবিস আমি ছোটো আছি, আমায় আগলে রাখবে কে? আপা তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি এখন যথেষ্ট বড়ো। তোর ভালোমন্দ দেখার মতোও উপযুক্ত আমি হয়েছি। হতে কারি তোর ছোটো। কিন্তু তোর বিষয়ে ভালোমন্দ দেখার মতো বড়ো আমি হয়েছি। আশা করি কথা ক্লিয়ার? আর কোনো কথা হবে না।”
দিগন্তের কথা বলার ভঙ্গিমায় স্নেহা বুঝে যায় দিগন্তকে আর কিছু বোঝানো যাবেনা। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে ভয়। দুটো মিলিয়েই স্নেহা ভেতরে ভেতরে চিন্তায় মুষরে পরে। দিগন্ত নিজের কথা শেষ করে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া! কথা এটাই রইলো? আগামী রবিবার আপনারা আসবেন ওকে?”
“ওকে লিটল ব্রো। ইনশা আল্লাহ আসবো। আমার পরিবার বা আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার সাথে তো আগে কখনও আমার সেভাবে কথাও হয়নি। আজ কি করে দেখা করার কথা ভাবলে?”
“বোন তো অনেক করলো আমার জন্য, তারও সুখ শান্তির কথা ভাবতে হয়। আজ যখন দেখলাম আপা বের হচ্ছে। জিগাসা করলাম, জানলাম এখানে আপনার সাথে দেখা করবে। তো আসতে হলো। আজ উঠি। রবিবারের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।”
মাহাদ সম্মতি জানায় দিগন্তের কথায়। স্নেহা উঠে দাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে বলে,
“রাই আর শার্লিনকে সাথে নিয়ে যেও যাওয়ার দিন। কোথায় গেলো ওরা! বিদায়ও বলতে পারলাম না।”
“পরে ওনাদের সাথে কথা বলিস। আপাতত চল। আমার দরকারি কাজ পরে গেছে।”
১১,
দিগন্ত তাড়া দেখিয়ে স্নেহাকে নিয়ে চলে যায় । মাহাদ ওয়েটার বিল নিয়ে আসলে মাহাদ ব্যস্ত হয়ে পরে বিল মিটাতে। বিল দিয়ে উঠে দাড়াতেই লক্ষ্য করে রাইমা শার্লিনের হাত ধরে টেনে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আর শার্লিন বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে হাত ছুটিয়ে নেওয়ার জন্য। রাইমা টেবিলের কাছে আসতেই শার্লিনের হাত ছেড়ে দেয়। শার্লিন মুখ গোমড়া করে দাড়িয়ে আছে। মাহাদ জিগাসা করে,
“হলো কি পাগলিটার? এভাবে টেনে আনছিলে যে!”
“আর বলবেন না ভাইয়া। রেস্টুরেন্টের ওদিকে একুরিয়াম দিয়ে সাজানো আছে। এই শালু আলু বলে একটা গোল্ড ফিশ তুলে নিবে। বাসায় গিয়ে ভেজে খেয়ে টেস্ট করবে যে গোল্ড ফিশ খেতে টেস্ট কেমন! বাচ্চাদের মতে জিদ ধরেছে মানুষের মাঝে। এতো বড়ো মেয়ে, টেনেও আনা যায়না৷”
মাহাদ অসহায় চোখে তাকায় শার্লিনের দিকে। এ কেমন মেয়েরে বাবা। রাইমা তো কি পাগলামি করে তার থেকে বড়ো পাগল। মাহাদ হন্তদন্ত হয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলো। এখানে আর এক মিনিট তো মান সম্মান দফারফা করে দিবে তোমার বান্ধবী। পেয়েছিলে কোথায় একে?”
“ভাইয়া আপনিও এভাবে আমায় অপমান করলেন?”
শার্লিন থমথমে গলায় প্রশ্ন করে। রাইমা ওর হাত টেনে ধরে বলে,
“চল এখান থেকে। বাকি কথা বাসায় গিয়ে।”
তিনজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। মাহাদের বাইকে এসেছিলো ওরা। বাইকে বসতে বসতে রাইমা জিগাসা করে,
“ভাবী তো চলে গেছে বুঝলাম। একবার আমায় জানিয়েও গেলো না!”
মাহাদ বাইক স্টার্ট দিয়ে উত্তর দেয়,
“তোমাদের খোজ করেছিলো। কিন্তু তোমাদের খবর ছিলো না। হারিয়ে গেলে তোমরা।”
“কি করবো, একজনের মন ভালো করতে সাথে আনলাম। আধপাগল করে ছেড়েছে আমায়। এর সাথে থাকলে আমি পুরো পাগল হবো।”
রাইমা কপাল চাপড়ে উত্তর দেয়। শার্লিন মুখটা ভার করে বলে,
“তোরে রেস্টুরেন্টে থাকতেই বলেছি আমি লে*সবিয়ান না। তোরে আমার সাথে রাখলে আমার অবলা জামাইয়ের কি হবে?”
“রাস্তায় যেতে যেতে আর একটা কথাও বলবিনা। মুখের একদম লাগাম নেই তোর।”
রাইমা ধম’কে কথাটা বলে। মাহাদ মনোযোগ দেয় বাইক চালানোয়। এদের কথার দিকে খেয়াল করলে নিশ্চিত এক্সি”ডেন্ট করে বসবে সে। বিয়ের আগে অন্তত সে নিজের জীবন হারাতে চায় না বা হাত পা-ও ভাঙতে চায়না। কি ভ’য়ংকর মেয়েরে বাপু। যার কপালে জুটবে তার জীবন তেজপাতা। মাহাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাগ্য করে স্নেহার মতো শান্ত বউ পাবে। স্নেহা যদি রাইমা বা শার্লিনের মতো হতো, তাহলে তার কি অবস্থা হতো? মাহাদ কল্পনাও করতে পারেনা। ঝাঁকি দিয়ে উঠে। সব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে রাস্তায় নজর দেয়। পিছনে তো চলছে রাইমা আর শার্লিনের বকবক। চলুক, তাতে তার কান দিয়ে লাভ নেই। স্নেহাকে পাচ্ছে এই আলহামদুলিল্লাহ।
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম।#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
১২,
পরেরদিন সকালবেলায়, নাস্তা খেয়ে রুমে বসে ফোন ঘাটছে রাইমা। তখনই শাহনাজ বেগম রুমে আসলেন। মা-কে দেখে ফোন রেখে রাইমা বললো,
“কিছু বলবে মা?”
শাহনাজ বেগম মেয়ের কাছে একপাশে বসলেন। মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“সেদিন একটু বেশিই বকাঝকা করে ফেলেছিলাম, তাইনা?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো কেনো?”
রাইমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। শাহনাজ বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“না হলে তুমি বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা কেনো করেছিলে?”
“ভুল বুঝছো মা। আমি বাসা ছেড়ে যাইনি সেদিন। এমনি মন খারাপ ছিলো, হাটতে বের হয়ে অনেকটা দূর চলে গিয়েছিলাম বেখেয়ালে।”
“কিন্তু তোমার চোখ তো মিথ্যা বলছে রাইমা। মায়ের কাছে কি লুকাচ্ছো? মায়েরা কিন্তু মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে।”
রাইমা ভেতর থেকে কেঁপে উঠে মায়ের কথায়। আসলেই তো সে কথা লুকাচ্ছে। থাক না কিছু কথা, অন্তরালে। রাইমা মা-কে আশস্ত করতে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“মাই মাদার বাংলাদেশ, আমি তোমার থেকে কিছু লুকাচ্ছি না। একটু বিশ্বাস করো আমায়।”
“আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তোমার খালামনি ফোন দিয়ে যে মাহাদের কার সাথে জানি সম্পর্ক আছে। সেই মেয়েকে দেখতে যাবে। তোমাকেও সাথে যেতে বলেছে নাকি সেই মেয়ে! আগামীকাল যাওয়ার সময় তোমার সাথে আমাকেও যেতে বললো তোমার খালামনি।”
মায়ের কথাতে স্নেহার পাশাপাশি যখনই মনে পরলো দিগন্ত স্নেহার ভাই, রাইমার মুখটা চুপসে গেলো। সে নিস্তেজ ভাবে বিছানায় আগের মতো হেলান দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,
“আমার বদলে তুমিই চলে যেও মা। আমি যাবোনা। আগামীকাল আমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।”
“কিন্তু তোমার খালামনি যে বললো! না গেলে বিষয়টা কেমন একটা দেখায় না রাইমা! মেয়েটাও যেখানে তোমায় বলেছে!”
“আগামীকালের বিষয় আগামীকাল দেখা যাবে মা। আপাতত এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি রান্না করবেনা দুপুরের? চলো তোমায় সাহায্য করি!”
রাইমা কথা কা’টাতে রান্নার কথা তোলে। শাহনাজ বেগম উত্তরে বলেন,
“হ্যাঁ রান্না একটু করতে হতো৷ কিন্তু তোমার সাহায্য করতে হবে না। রেস্ট করো। সারা সপ্তাহ ভার্সিটিতে ছোটাছুটি করো। গতকালও মাহাদের সাথে দৌড়ে বেড়ালে। রেস্ট করো।”
“বাবা আর আরফান কোথায়?”
রাইমা প্রশ্ন করে। শাহনাজ বেগম উত্তরে বলেন,
“বাজারে গেছে একটু। তোমার ভাইয়ের কখন কি বায়না তার ঠিক থাকেনা। তুমি রেস্ট করো।”
শাহনাজ বেগম মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। রাইমা মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ বন্ধ করে কপালের উপর এক হাত দিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। চোখের পাতায় আবছা কিছু স্মৃতি। মনের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে রাইমার। চোখের কার্ণিশে জলধারা বয়ে চলে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাইমা শার্লিনের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ধরফরিয়ে উঠে বসে রাইমা। এই মেয়ে এখন এসে চোখে জল দেখলে নির্ঘাত কানের পোকা ভর্তা করে ছেড়ে দেবে। সে উঠে চোখ ভালো করে চোখ মুছেই ওয়াশরুমে যায় দৌড় দিয়ে। চোখমুখে জল ছিটায় ভালো করে। শার্লিন এদিকে রাইমার রুমে এসে হাঁক ছেড়ে রাইমাকে ডাকছে। রাইমা তোয়ালে দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখে শার্লিন তার খাটে বসে আপেল খাচ্ছে। সে তোয়ালে ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসে বসলো শার্লিনের পাশে। শার্লিন রাইমাকে দেখে ওর দিকে আপেল এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আপেল খাবি?”
“তুই খাচ্ছিস খা, আমায় বলিস কেন?”
“কাঁদছিলি কেনো?”
রাইমা থমকে যায় শার্লিনের প্রশ্নে। চোখেমুখে বিস্ময় প্রকাশ পায় তার। সে বিস্মিত কণ্ঠে জিগাসা করে,
“কোথায় কাঁদলাম আমি? কি বলছিস?”
শার্লিন আপেলে আরও কয়েকটা কামড় দিয়ে শেষ করে। রাইমার ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে,
“আমার থেকে কথা আড়াল করতে শিখে গেছিস? বিষয়টা তোর সাথে যাচ্ছে না ঠিক।”
“কি সব যা তা বলছিস শালু!”
“এই ডাকলি শালু! তোর এতোটা প্রিয় এমনি এমনি হইনি, যতোটা হলে কেউ ভালোবেসে আমায় একটা ডাকনাম দিবে। ডাকনাম দেওয়ার জন্যও অফুরন্ত ভালোবাসা লাগে রাই। আর ভালোবাসার কাছ থেকেই আজকাল কথা লুকাস? বিষয়টা মেনে নিতে পারলাম না।”
১৩,
শার্লিনকে জড়িয়ে কাঁদছে রাইমা। হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। শার্লিন কিছু সময় কাঁদার জন্য ছেড়ে দিয়ে যখন দেখলো কান্নার দমক বেড়ে যাচ্ছে, সে রাইমাকে ছাড়িয়ে সরিয়ে দিলো। চোখ মুছে দিয়ে বললো,
“আমি তোর বর নই যে জড়িয়ে কেঁদেই যাবি। আমার স্বপ্ন কিছু হলে আমার বরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবো। কিন্তু তুই বাই এনি চান্স আমায় তোর বর ভেবে সেই স্বপ্ন পূরণ করছিস? তোর কপালে তো প্রেম ভালোবাসা নাই, তাই এমনটা ভাবতেও পারিস! বলে রাখি আমি কিন্তু ছেলে নই। চাইলে আমায় টেস্ট করে দেখতে পারিস আমি মেয়ে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ থাকলে।”
রাইমার মুহুর্তে কান্না থেমে হেঁচকি উঠে যায়। শার্লিন বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রাইমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“খেয়ে নে। জানিনা আমি, আমার কথা শুনলেই তোর হেঁচকি কেনো উঠে?”
“তোর সাথে আমার বড্ড মিল বুঝলি শালু। এমনি এমনি তোকে আমার আত্মার সাথি বলি না। সবার জীবনে একটা ব্যক্তিগত মানুষ থাকা দরকার। সেই মানুষ যে শুধু ভালোবাসার মানুষই হবে, এমনটা নয়। এই তোর মতো আত্মার সাথী থাকলেই হবে। যে চট করে মন খারাপ ধরে ফেলব, অধিকার দেখিয়ে জানতে চাইবে কি হয়েছে, সময় দেবে। কানৃনা করার জন্য একটা ভরসার কাঁধ হবে। আর মুহুর্তে হাঁসাবে। সবার জীবনে এমন একটা মানুষ থাকে না। আমার ভাগ্য আমি তোকে পেয়েছি।”
রাইমা এক দমে কথাগুলো শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলে। রাইমার ঠোঁটের কোণে হাসি। শার্লিন মুচকি হাসে, রাইমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমারও ভাগ্য আমি তোকে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর তোকে আমার জীবনে আঁটকে রাখার বা তোর জীবনে আঁটকে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। আমরা দুজন দুজনের প্রতি আঁটকে থাকলে আমাদের বেচারা বরের কপাল পুড়”বে। ওদের কপালে বউ জুটবে না।”
রাইমা শার্লিনকে জড়িয়েই ওর পিঠে দুমদাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয়। শার্লিন আরও শক্ত করে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। রাইমা হেসে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুই আর ভালো হলি না?”
“ভালো হলে তোকে কে হাসাবে রাই?”
“তোর ভালো হওয়ার দরকার নেই, এমনই থাকিস।”
“আচ্ছা এসব বাদ, কাঁদছিলি কেনো?”
“তুই বুঝলি কি করে আমি কাঁদছিলাম?”
“তোর চোখ মুখ বলে দেয়। তাছাড়া বাসায় এসে আগে তোর রুমেই উঁকি দিয়ে দেখলাম কাঁদছিস। এরপর আন্টির সামনে হইচই করে জানান দিয়ে দেখলাম, আমি এসেছি দেখে তুই কি করিস! কান্না প্রকাশ করিস, নাকি আড়াল করিস।”
রাইমা শার্লিনকে ছেড়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে। মৃদু স্বরে বলে,
“বিকেলে চল ফুচকা খেতে যাই। সাথে একটু ঘুরাঘুরি করবো। এরপর বলবো।”
“ওকে ডান। বিকেলে রেডি থাকিস, আমি আসবো ডাকতে। এখন যাই।”
শার্লিন চলে যায় কথাটা বলেই। রাইমা ফোনে তাকিয়ে সময় দেখে নেয়। এরপর চলে যায় গোসল দিতে।
১৪,
দুপুরের খাবার পর একটু ঘুমিয়েছিলো স্নেহা। বিকেল চারটের সময় ঘুমটা ভেঙে যেতেই দেখে বাসার চেহারায় পাল্টে বসে আছে। পুরো ড্রইং রুম জুড়ে নতুন ফার্ণিচার আর সেগুলো সেট করছে কিছু লোকজন। দিগন্ত তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে কোথায় কি সাজাবে। আর পুরাতন গুলো বাসার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। স্নেহা দিগন্তের এহেন কর্মে পুরোপুরি হতবাক। দিগন্ত বোনকে রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বোনের পাশে দাড়িয়ে জিগাসা করে,
“আপা দেখ তো, সব পছন্দ হয় কিনা!”
“কিন্তু হঠাৎ সবকিছু এমন পাল্টে দিচ্ছিস কেনো?”
“আগামীকাল থেকে তোরও নতুন জীবনের সূচনা, আর আমারও। পুরোনো কোনো স্মৃতি আমাদের জীবনে না থাকুক।”
“সব পাল্টে দিলেই কি সব স্মৃতি মুছে যাবে দিগন্ত!”
দিগন্ত বোনের প্রশ্নে বোনের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্নেহা অবাক হয়ে ভাইয়ের হাসি দেখে। প্রশ্ন করে,
“তুই হাসছিস?”
“হাসবো না তো কি করবো বলতো আপা! বাদ দে, তুই যে কেনো সব জেনেও মেনে নিয়ে মনে আঁটকে রাখিস! আমি জানিনা।”
“দিনশেষে এটাই মনে হয় উনি আমাদের জন্মদাত্রী মা।”
“মা শব্দ টার সম্মান উনি রেখেছেন?”
“বাদ দে তুই তোর কাজ কর।”
স্নেহা রুমে ঢুকে যায়। ফ্রেশ হওয়া জরুরী। দিগন্ত বোনের লুকোচুরি দেখে মৃদু হাসে। হাসতে হাসতেই গম্ভীর হয়ে যায়। হাত মুঠোবন্দি করে মনে মনে ভাবে,
‘জীবনেও উনাকে ক্ষমা করবোনা আমি, কখনও না৷’
“স্যার এই ল্যাম্পটা কোথায় রাখবো?”
যারা সবকিছু জায়গা মতো সেট করে দিচ্ছিলো, তাদেরই একজনের প্রশ্নে দিগন্ত সব ভাবনা চিন্তা ছেড়ে ওদের সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। অন্তত কাজের মাঝে থাকলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।