#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
১০৫,
বরের সাজে দিগন্ত কে সাজিয়ে দিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে মাহাদ সহো আয়মান আর ইশফাক। শেরওয়ানির এক দোপাট্টা সেট করে দিতে গিয়ে তিনজনের বেশ বেগ পোহাতে হলো। যেভাবেই সেট করে দেয়, দিগন্ত বারবার বলে, পাজামা পাঞ্জাবিই ঠিক ছিলো। মেয়েদের ওরনার মতো! এটা পড়ানোর কি দরকার! এই কথা বলে বারবার সে খুলে ফেলছিলো। স্নেহা বিছানায় বোসে বোসে দিগন্তর কান্ড দেখছিলো। সবশেষে নিজে এক ধমক দেওয়ায় সে থেমে গেছে। এরপর মাহাদ পুরো রেডি করে দিয়ে পাগড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“স্নেহা, এটা তো বড়োদের পড়ানোর দায়িত্ব। কে পড়াবে?”
“চাচাকে ডাক দাও তো ইশা। উনি এসে পড়াবেন এটা। সাথে ফুফাকেও ডেকে আনো।”
বরপক্ষ আগেই বাস ভর্তি হয়ে চলে গেছে কনেপক্ষের উদ্দেশ্যে। বাসায় মানুষজনের বালাই তেমন নেই। শুধু দিগন্তের সাথে বরের গাড়িতে আর বরের সাথে যেতে ভাইবোন ক’জনই আছে। ইশা স্নেহার কথামতো চাচা আর ফুফাকে ডেকে আনার পর স্নেহা তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“চাচা, বাবা তো নেই। আপনারা-ই বাবার দায়িত্ব টা পালন করেন।”
দিগন্তের চাচা ভাইয়ের কথা মনে করতেই চোখের কোণে জল জমে। দিগন্তের নিজের বাবার কথা ভীষণ মনে পরছে। কিন্তু কিছু করার নেই। দিগন্তের হাত ধরে তার চাচা বিছানায় বসিয়ে দেয়। এরপর তার চাচা ফুফা মিলিয়ে মাথায় পাগড়ি টা পরিয়ে দিলেন। দিগন্তকে পুরোপুরো তৈরি করে নিয়ে বের হলো সবাই। উঠোনে এসে চাচী আর ফুফুকে বিদায় দিয়ে তারা গাড়িতে উঠে বসলো। উনারা বাড়িতে রয়ে গেলেন নতুন বউকে বরণ করার অপেক্ষায়। এক গাড়িতে ছেলেরা সব উঠলো। অন্য গাড়িতে মেয়েরা সব উঠে বসলো। সাথে চাচা আর ফুফা। গাড়িতে বসার পরপরই গাড়ি চলতে শুরু করে।
গেইট সাজানো শেষ প্রায়। ইফরাদ ফিনিশিং টাচ দিয়ে গেইটের পাশে পরে থাকা চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। শার্লিন সহো বাকি মেয়েরা ঘুরে ফিরে সব দেখছিলো। এরপর গালে হাত দিয়ে ভাবুক চিত্তে শার্লিন সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“আচ্ছা দুলাভাইকে কি কি শরবত খাওয়ানো হবে? সেগুলো কে ডিসাইড করবে!”
“কেনো আপু! তুমি থাকতে আমাদের আআার চিন্তা কিসের?”
শিখার উত্তরে সবাই হেসে উঠলো। ইফরাদ কপাল চুলকে মৃদু স্বরে বললো,
“ও আছে এটাই মূল চিন্তা। না জানি বেচারা দিগন্ত ভাইকে বিয়ের দিন কোন ডোবার পানি খাইয়ে ছাড়ে!”
ইফরাদের কথা শুনে শার্লিন গাল ফুলিয়ে তাকায়। রেখা কপাল চাপড়ে বলে,
“হয়ে গেলো। এখানে ৩য় বি”শ্বযু’দ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এদের কেউ সরিয়ে নিয়ে যাও।”
মেসবাহ একপাশে নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলো। আরফানের আঙুলে আঙুল পেচানো ছিলো তার। আরফান জানিনা কি বুঝলো রেখার কথার। সে এগিয়ে এসে ইফরাদের হাত ধরে বললো,
“ইফরাদ ভাই, এখান থেকে চলেন। আমি চকলেট খাবো।”
১০৬,
ইফরাদ ভীত সশস্ত্র চাহনীতে শার্লিনকে দেখে আরফানকে নিয়ে মানে মানে কে”টে পরলো। সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে কয়েক কদম যেতেই শার্লিন পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“আসিয়েন শুধু আমায় বিয়ে করতে! সিরিয়াসলি সেদিন আমি যদি কচুর শরবত না খাইয়েছি! আমিও শার্লিন নই, নাম পাল্টে দিগন্ত ভাইয়ের শালী নাম রাখবো। আফটার অল আজকেই আমি শালী হিসেবে তাকে ডোবার পানি খাওয়াবো তাইনা!”
শার্লিনের কথা ইফরাদের কানে পরতেই সে পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে কয়েকটা ফাঁকা ঢোল গিলে আরফানের হাত ধরে দ্রুত পদে চলে যায়। আর বাকিরা সবাই দাড়িয়ে তো হাসছে। শার্লিন সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,
“চলো চলো, অনেক কাজ বাকি। মিষ্টি সাজানো, শরবত বানানো। দিগন্ত ভাই আমাদের স্পেশাল দুলাভাই বলে কথা!”
“তোমায় মাথায় কি দুষ্টমি ঘুরছে শার্লিন?”
মাহিশার কণ্ঠ শুনে সেদিকে দৃষ্টি দেয় সকলে৷ মেয়েকে কোলে নিয়ে শার্লিনের থেকে একটু দূরেই দাড়িয়ে আছে। সবকিছু জানার পর মাহিশাকে একদমই পছন্দ না শার্লিনের। সে মাহিশাকে এড়িয়ে যাবে সবার মাঝে সেটারও উপায় নেই। সে একটু নিজেকে সামলে নিয়ে বিরক্তি চেপে উত্তর দেয়,
“না আপু, দুষ্টমি না। আমি গুড গার্ল। ভালো কিছুই মেইক করবো। ট্রাস্ট মি আমি উল্টাপাল্টা কিছু করবোনা।”
এরপর সবাইকে সাথে নিয়ে পা বাড়ায় শরবত বানানোর কাজে লাগতে। মিহাল নিহাল তো কথার ফাঁকে আগেই কেটে পরেছে। এই মেয়েরা কি শরবত বানিয়ে দিগন্তকে হাসায় না কাদায়! তার ঠিক নেই। দায়ভার টা নিজেদের ঘাড়ে আসার আগেই তারা সরে গেছে। ব্যস এটাই শান্তি।
মাহিশা সবার যাওয়ার পানে দাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জানে সে নিজের কৃতকর্মের জন্যই আজ এই পরিস্থিতিতে পরেছে। তাই আফসোস করা ব্যতিত আর কোনো কাজ নেই তার। সেই সময় সামিদ এসে মাহিশার কাঁধে হাত রাখে। মাহিশা তার দিকে তাকাতেই সে বলে,
“মেয়েকে রেডি করতে হবে, তোমার নিজেরও রেডি হতে হবে। সময়ের ব্যাপার। এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি করছো?”
“নাথিং, চলো মেয়েকে তৈরি করা যাক।”
আড়াই বছরের ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা কিছু বুঝেনা। কিন্তু মায়ের মলিন মুখটার দিকে শুধু টল-টলে চাহনীতে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সে-ও তার চঞ্চল মায়ের এই নিশ্চুপ রুপটার সাথে পরিচিত নয়। কিন্তু সে তো এই দুনিয়ার তিক্ততা বোঝে না। পরিচিত আপন মানুষ টাকে কাছে পেয়েও কাছে যাওয়ার অধিকার না পাওয়ার মতো যন্ত্র”ণা দুটো হয়না। অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার চাওয়ার মতো বিড়ম্বনা! আদৌও আর দুটোতে হয়? ভেবে পেলোনা মাহিশা। ধীর গতিতে তাদের জন্য ঠিক করে দেওয়া রুমটায় চলে গেলো।
এদিকে শার্লিন রা গেইট ধরার সব তৈরি করে সাজিয়ে ঢেকে রেখে সবাই চলে গেলো গোসল করে রেডি হতে। কলপাড়ে যে সিরিয়াল! তাতে গোসল দেওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলো সব। পরে আবার রাইমার প্রতিবেশী এক চাচাতো বোনের কথায় তাদের বাড়িতে নিরবিলি জায়গায় চলে গেছে সব নিজেদের ড্রেস আর সাজগোজের জিনিস নিয়ে। ওদের বাড়ির ভেতর উঠোন পেরিয়ে শান বাধানো ঘাটের পুকুরে নেমে পরেছে সব। শার্লিন তো ভীষণ খুশি। এতো আনন্দ এই জীবনে তার পাওয়া হয়নি। এতো এতো আনন্দের বিনিময়ে নিজের আত্মার বান্ধবী টাকে হারাতে হবে! এই কথা মনে আসলেই শার্লিনের চোখ জলে ভরে আসছে। তবুও সবার মাঝে কাদার বিষয়টা! ভীষণ অসস্তিকর। এজন্য পুকুরের পানিতে দাড়িয়ে মুখে বারংবার পানির ঝাপটা দেওয়ার বাহানায় কেঁদে নিচ্ছে। কি করবে! সবার সামনে কাঁদলে তো হাজার প্রশ্ন। এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো তার ধৈর্যশক্তি নেই।
১০৭,
বাইরে হইচই শোনা যাচ্ছে বর এসেছে আর এসেছে। রাইমার সাথে বোসে ছিলো সব মেয়েরা। ঘরে উপচে পরা ভীর ছিলো। মুহুর্তে ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেলো। শার্লিন রা তো ছুট লাগিয়েছে গেইট ধরবে বলে। বিয়ের সবথেকে মজার পার্ট তো এটাই মনে হয় তার কাছে। রাইমা ঘরটা ফাঁকা পেয়ে হাফ ছেড়ে জোড়ে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয়। এতো ভীড়ভাট্টা তার পছন্দ নয়। অল্প মানুষের মাঝে কমফোর্ট ফিল করা মানুষের জন্য বিয়ে মনে হয় একটা আতঙ্ক। বাবারে এতো মানুষকে সহ্য করা! এরথেকে আজীবন মানুষের কথা শুনে সিঙ্গেল থাকা ভালো মনে হলো রাইমার। বয়স ২৩এর কোঠায় ঠেকেছে বলে এতোদিন যারা বলতো, ‘বিয়ে কবে দিবে বাবা মা! পছন্দের কেউ আছে কিনা!’ আজকের পর তো আর বলবেনা বিয়ে কবে দিবে? উল্টে বর সহো দেখলে বলবে, ওমাহ! বিয়ে হয়ে গেলো! জামাই কি করে? কতো টাকা বেতন! কি করে বিয়ে হলো? কবে হলো? মনে হয় তারা বিয়েতে ভাঙচি দিতে না পেরে এক আকাশ হতাশায় ভুগতে শুরু করবে। এই বিষয়গুলো জঘন্য লাগে তার কাছে। রাইমার এই আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝে মাহিশা মেয়ের হাত ধরে রাইমার ঘরের দরজার কাছে দাড়িয়ে জিগাসা করে,
“ভেতরে আসতে পারি রাই?”
রাইমা নিজের চিন্তাভাবনা ফেলে মাহিশার গলা শুনে দরজার দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। হয়তো তাকে দেখার পর কষ্ট টা আরও প্রগাড় হয়েছে। পরনে ছাই রঙা শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে ওকে। আগে মাহিশা শাড়ি পরলেই রাইমা মুগ্ধতা নিয়ে দেখতো। মপয়েটা বেশ সুন্দরী। সে তার তুলনায় নগণ্য। তবুও সে তার নিজের সৌন্দর্যে অনন্য। যার যার জায়গায় সে সে সুন্দর। নির্ঘাত নিজের ভাইটা তার বড়ো হলে মাহিশাকে নিজের ভাইয়ের বউ করে ফেলতো রাইমা। সে আনমনে এসব চিন্তা করতে করতে বললো,
“আয়, আসতে আবার অনুমতি লাগে?”
“কিছুই তো আর আগের মতো নেই! তো কি করবো বল?”
ঘরে এসে বসতে বসতে মাহিশা জবাবে কথাটা বললো। রাইমা মাহিশার মেয়ের সামনে হাটুমুড়ে বোসে মাহিশার মেয়ের আঙুলে আঙুল ছুইয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলতো স্বরে বললো,
“মায়ের নামটা কি! এসে থেকে তোর সাথেই কথা হয়ে যাচ্ছে। আম্মগর নামটাই জানা হয়নি।”
“আদ্রিশা ওর নাম।”
রাইমা চকিতে মাহিশার দিকে তাকায়। নামটা তার বড্ড প্রিয়। মাহিশার সাথে আগে খুনশুটি করতে করতে সে নিজেই বলতো মাহিশার মেয়ে হলে নাম রাখবে আদ্রিশা। মাহিশা যে তার পছন্দের খেয়াল টা এতো বছর পরও রেখেছে এটাই বেশি। মাহিশাও রাইমার দিকেই তাকিয়ে ছিলল। সে মুচকি হাসি ফেরত দিলো রাইমার তাকানোর বদলে। রাইমা বললো,
“অনেক চঞ্চল ছিলি, এতো ভার কি করে হয়ে গেলি?”
“আসলে আমি বদলাইনি। কিন্তু সময়টা অনেকটা পেরিয়ে গিয়ে অনেক জড়তা এসে গেছে সব সম্পর্কে । তাই চাইলেও আগের মতো হতে পারছিনা। তুই পছন্দ করবি কিনা কে জানে! কি বলতো ঐ বয়সটায় না ফ্যান্টাসি কাজ করতো! মনে হয়েছিলো এই তো পালিয়ে আসলাম, বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে। মা বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবো। তারা মেনে নিবে। তোর সামনে এসে কোলে মেয়েকে তুলে দিলে তুইও খুশি হয়ে আমায় বুঝবি! কিন্তু হলো কি বলতো! বাবা মায়ের অসম্মান, তোরও অসম্মান সাথে এতো অপমান মানুষের। সবাই এতোটা কষ্ট পেলো, আ’ঘাত পেলো। সবটাই আমার জন্য। আমি পজেটিভ দিকটা ভেবেছিলাম, এটার নেগেটিভিটি বলেও যে একটা ইফেক্ট থাকবে আমি কল্পনাও করিনি। ফ্যান্টাসিতে ভেসে বেরিয়েছি। সবকিছুরই লিমিট থাকে। আমি সেই লিমিট ক্রস করে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে নিজের সত্ত্বা খুইয়ে বসেছি। কিন্তু এই যে পিচ্চি পরি। এনার সামনে আমি কখনও গম্ভীর হইনা। কারণ সে ছোটো থেকে যা দেখবে তা দেখেই বড়ো হবে। আমি চাইনা আমার মেয়ে গম্ভীর হউক, ছোটো কিছু হলেই ওভার থিংকিং এ ডুবে যাক। চাই সে চটপটে হোক। প্রতিটা পরিস্থিতি পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ার ক্ষমতা রাখুক। এজন্য সত্যি বলতে নিজের চঞ্চল সত্ত্বা পুরো বিসর্জন দিতে পারিনি।’
মাহিশার দীর্ঘ কথা শুনে রাইমা একটু হাসলো। আদ্রিশার সাথে দুষ্টমিতে মেতে উঠলো। মাহিশা বুঝিয়ে দিলো রাইমা তার আরও একটা মায়ের মতো আন্টি। ডাকতে শিখিয়ে দিলো ছোটো মা বলে। আদো আদো বুলিতে তো সে সবই বলতে পারে। তাই রাইমাকে ডাকতে ডাকটাও চট করে রপ্ত করে ফেলে বাচ্চাটা।
১০৮,
মাহিশা আর রাইমার কথোপকথন একপাশে চলছে, অন্যপাশে চলছে গেইটে একপ্রকার তর্ক প্রতিযোগিতা। শার্লিন-রা দাবী করে তর্ক করে যাচ্ছে এক এমাউন্ট। দিগন্তের ভাইরা তার অর্ধেক দিবে বলে তর্ক করছে। এরমাঝে শার্লিন আর বাকি মেয়েদের বানানো স্পেশাল শরবত! যে মুখে দিয়েছে, সেই ছিটকে ফেলেছে। তা দেখে শার্লিনদের তো হাসি থামেনা। ছোটো ছোটো কাঁচা আম এনে তার শরবত সাথে একগাদা লবণ, মাল্টার শরবতের সাথে হলুদ মরিচের গুড়ো। সাদা পানির ভিতরও লবণ রাখতে ভুলেনি। মিষ্টি খাইয়ে দিগন্তের মুখে সাদা পানি দিতেও সে ছিটকে বের করে দিয়েছে। এরপর শার্লিনদের আর পায় কোথায়! উপস্থিত সকলে হেসেই খু'”ন। লটারিতে তিনটা এমাউন্ট লিখে টেবিলে ফেলে রেখেছিলো তারা। তারমাঝে মিডিয়াম এমাউন্ট টাই তুলেছে দিগন্ত। এতো তর্কাতর্কিতে দিগন্তের মাথা ধরে যাচ্ছিলো। ইফরাদ তো পাশে দাড়ানো মেসবাহকে বলেই বোসে,
“আপনার এটা বোন নাকি রেডিও এফএম ভাই! সারাক্ষণ বাজতেই থাকে! আমার যে কি অবস্থা হবে? আমি কল্পনা করতেও ভয় পাই রিতীমতো।”
“দেখেশুনে পঁচা শামুকে পা কেটেছো। সহ্য করো কি আর করবে!”
মেসবাহ ইফরাদের কথার জবাবে কথাটা বললো। ইফরাদ আলতো হেসে তর্ক রত শার্লিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ও পঁচা শামুক নয় ভাইয়া। ও রত্ন। ওকে যে বুঝবে, সে ওকে সব মানুষের মাঝেই খুজে বেড়াবে।”
মেসবাহ হাসলো ইফরাদের জবাবে। সে তো ইফরাদের শার্লিন সম্পর্কে ধারণা জানতে বোন সম্পর্কে ওভাবে বলেছিলো। যাক এদের ভালোবাসা ভুল নয়। মেসবাহ সস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। এদিকে দিগন্ত তর্কাতর্কির মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া দেখে সবাইকে থামানোর উদ্দেশ্যে পকেট থেকে শার্লিনদের কাঙ্খিত এমাউন্ট টা বের করে টেবিলে রেখে বললো,
“থেমে যাও শালীকা-রা আমার। এতো ছোট্ট একটা আবদার করেছো! দুলাভাই হয়ে অস্বীকার কি করে করি!, এবার ঝটপট গেইট ছাড়ো। বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। দীর্ঘপথ, মাথা ধরে গেছে আমার।।এতো টাকা দিলাম, বিনিময়ে এবার বসিয়ে একটু খাতিরদারি করো। নয়তো আমার বাড়ি নিয়ে একেকটাকে এই কাঁচা অপরিপক্ব আমের শরবতে চুবিয়ে রাখবো।”
শার্লিনরা টাকা পেয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠেছে। গেইট ছাড়িয়ে দিয়ে সরে যায় সবাই। মাহাদ দিগন্তের পাশে হাটতে হাটতে বলে,
“বিয়ের আগেই শালীদের কাছে হাড়লে! এবার তৈরি থাকো সারাজীবন হেরে হেরে হেরো ভূত হয়ে বোসে থাকবে।”
“টাকা দিয়ে উপরে থেকে গেলাম দুলাভাই। বলতে পারবেনা ওরা রাইকে যে, রাইয়ের স্বামী কিপ্টে।”
“বাপরে ভাই আমার, বউয়ের জন্য কতো চিন্তা!”
আয়মান পাশ থেকে দিগন্তের কথা শুনে কথাটা বলে। ওরা হাসতে হাসতেই স্টেজে গিয়ে বোসে। আজাদ সাহেব নিজে এসে দিগন্তকে নিয়ম মাফিক বসিয়ে দিয়ে যান। এদিকে বরপক্ষ সব আগেই চলে এসেছিলো যারা, সবাইকে খাওয়ানোর ধুম চলছে। স্নেহা সহো সব মেয়েরা লাগেজ নিয়ে সোজা চলে যায় রাইমার কাছে। হামিদা বেগম এসে ওদের নিয়ে যায়। এখন বউকে সাজিয়ে নিয়ে বিয়ে পরিয়ে সব নিয়ম শেষ করে বাড়িতে নিয়ে যেতে বাঁচে সব। এতো দূরের জার্নি করে সবার অবস্থা কাহিল।
চলবে? #আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_নীল
১০৯
লাগেজ থেকে রাইমার জন্য যা কিছু আনা হয়েছে সবই রাইমার পাশে বোসে একটা একটা করে দেখিয়ে দিচ্ছে স্নেহা। গ্রামের দাদী সম্পর্কীয়, ভাবী সম্পর্কীয় মহিলা-রা ভীড় জমিয়েছে দেখবে বলে। সব দেখানো শেষে স্নেহা শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলে,
“নাও শুরু করো তোমার বান্ধবীকে সাজানো। সময় কম, ঝটপট যেমন সাজানো যায়, সাজিয়ে ফেলো।”
স্নেহার কথা শুনে রেখা খাটের উপর বসা ছিলো, সে বলে উঠে,
“আপনাদের বাড়ির বউ, আপনারা কি সাজে সাজিয়ে নিয়ে যাবেন। এটা আপনাদের বিষয় বেয়ান সাহেবা। সাজানো শুরু করুন।”
স্নেহা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আসার পর থেকে এই পিচ্চি মেয়েগুলোর কলকাকলীতে চারপাশ মাতোয়ারা। বিয়ে বাড়ির আমেজটা যেনো ধরে রাখার দায়িত্ব তাদেরই। স্নেহাকে কিছু বলতে না দেখে ইশা পাশ থেকে বললো,
“আমাদের বাড়ির বউকে তো আমরা আছিই সারাজীবন সাজানোর জন্য। আপনাদের তো এটাই শেষ সুযোগ বলা চলে! এরপর কবে সুযোগ হবে ঠিক নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে সাজিয়ে ফেলুন।”
স্নেহা বললো,
“ওসব কথা বাদ, রাই তুমি নিজেই বলো কার হাতে সাজবে?”
রাইমা শাড়ির আঁচলে ঘোমটার নিচে সলজ্জ ভাবে বসেছিলো। রাইমা স্নেহার কথা শুনে ঘোমটা-টা একটু উচিয়ে চারপাশে তাকালো। তার নজর মাহিশাকে খুজে চলেছে। মাহিশার সাথে বন্ধুত্বের শুরু থেকেই মজার ছলে হলেও তাকে বিয়ের দিন সাজাবে বলে মাহিশা নিজের স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছিলো। নজর ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেয়েও গেলো রাইমা। দরজার একপাশে দাড়িয়ে একহাতের কনুইয়ে অন্য হাতে চাপিয়ে অশ্রুসজল চাহনীতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাইমা তাকাতেই মাহিশা চট করে চোখ সরিয়ে উল্টোদিকে হয়ে চোখ মুছে নিলো। হাসিমুখে ফের আবার রাইমার দিকে তাকালো। ঘরের মধ্যে এতো সরগম, তবুও যেনো এক শুনশান নিরবতা বিরাজ করে চলেছে রাইমা আর মাহিশার মাঝে। রাইমা মাহিশাকে হাতের ইশারায় তার কাছে এসে বসতে বললো। শার্লিন একবার রাইমা আর একবার মাহিশাকে দেখে আলতো হাসলো। সব আগের মতো ঠিক না হোক, কিন্তু মাঝের দূরত্ব টা ঘুচে যাক। এজন্য শার্লিন নিজের জায়গা টা ছেড়ে মাহিশাকে ইশারা করে এসে বসতে বললো। স্নেহা একবার রাইমা তো একবার মাহিশার দিকে তাকায়। শার্লিন রাইমার পিছনে দাড়িয়ে বললো,
“মাহিশা আপু, আমার ননদও হবে, আবার রাইয়ের একসময়ের আমার মতোই ফ্রেন্ড ছিলো। এখনও ফ্রেন্ড তবে সে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আপনাদের সাথে আলাপ করানোর মতো সিচুয়েশন ছিলো না।”
স্নেহা জবাবে আলতো হেসে মাহিশাকে লক্ষ্য করে বললো,
“শুরু করো ছোটো আপু। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে আবারও সূদুর জেলায় পারি দিতে হবে আমাদের।”
১১০
মাহিশার খুশিতে চোখে জলই এসে গেছে। রাইমার বিয়ে ঘিরে কতো আশা, কতো ইচ্ছে ছিলো তার। নিজের দোষেই অনেককিছুই করতে পারেনি। রাইমা যে তার ইচ্ছে মনে রেখে সাজানোর জন্য কাছে ডাকলো! এটাই তার জন্য অনেক। সে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে। রাইমার পাশে বসে টুকটুক করে সাজানো শুরু করলো। এরমাঝেই ইফরাদ এসেছে সব মেয়েদের খাওয়ার জন্য ডাকতে। এসে দরজায় দাড়িয়ে মাহিশার হাতে রাইমাকে সাজাতে দেখে থমকে দাড়ায়। বোনের জন্য রাইমাকে কম তো অপমান করেনি! সব ভুলে যখন সবকিছু একটু একটু করে ঠিক হয়ে যাচ্ছে! তারও কি উচিত বোনকে একটু একটু করেই আগের মতো ভালোবাসা! শত হোক সে তো বড়ো ভাই। বোনের জন্য ভালোবাসাগুলো বুকের মাঝে কব”র দেওয়ার মতোই আগলে রেখেছে। একবার যদি সবটুকু বিষয় বুঝিয়ে তাকে বলতো! তাহলে আজ এতো দূরত্ব আসতোই না। বিয়ের কথা তুলেছে মানেই যে বিয়ে দিয়ে দিতো, বিষয়টা তো এমন ছিলো না। থাক সেসব অতীতের চিন্তাভাবনা, হয়তো তারই খামতি ছিলো। ভাইয়ের মতো ভাই হতে পারেনি, যেমন ভাই হলে বোন এসে নির্দ্বিধায় সব বলে দেবে। ইফরাদ বোনের জন্য চোখের কোণে জমা জলটুকু বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে ছিটকে ফেলে নিজের ধাতস্থ করার চেষ্টায় মত্ত হয়ে বললো,
“এই যে ব্যান্ডপার্টি! সারাক্ষণ বাজতে থাকলেই হবে? চলো, চলো খাবে চলো!”
ইফরাদের কথা কানে যেতেই তিশা চট করে বলে উঠলো,
“আরে ছোটো দুলাভাই! এতো তাড়া কিসের? খেতে তো বসবো বড়ো দুলাভাইয়ের সাথে। নয়তো আদর যত্নটা করবো কিভাবে?”
সারাঘরে হাসির রোল পরলো। ইফরাদ কপাল চাপড়ে বললো,
“দিগন্ত ভাইয়ের অবস্থা দেখে আমার যা শিক্ষা হবার হয়ে গেলো। আমি আর এতো ধুমধাম করে বিয়ে করছিনা। শার্লিনকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে দৌড় মারবো। বাপরে বিয়ের এতো প্যারা জানলে আমি নিশ্চিত দিগন্ত ভাইও তাই করতেন।”
শার্লিন কোমড়ে হাত দিয়ে ইফরাদের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
“সবাইকে নিজের মতো ভাবেন কেন? এমন করে বিয়ের ইচ্ছে থাকলে আপনার সাথে এই মুহুর্তে ব্রেকআপ। অনেক সুন্দরী মেয়েরা এসেছে, একটা খুজে নেন নিজের জন্য। নয়তো বউ জুটবেনা কপালে।”
“তাতে আমার আপত্তি নেই তোমার অনুমতি থাকলে। তুমি সহো তোমার কথামতো আরও একটা বিয়ে করাই যায়। তুমি মা”রলে অন্তত সে বাঁচাবে। এমনিতেও বিয়ে বাড়িতে বিয়ে হয় তো দুজনের, আর বিয়ে ঠিক হয় ১৪জনের৷”
ইফরাদের উত্তরে হাসির দমক বাড়লো পুরো ঘরজুড়ে। মাহিশা সাজানোয় ব্যস্ত থাকায় রাইমাকে হাসতে হাসতে নড়াচড়া করতে দেখে তার হাতের পিঠে থাবা দিয়ে বলে,
“আরে চুপ করে বোস না। এতো নড়িস কেন? বিয়ের দিন পেত্নী সাজাই এমন কিছু চাইছিস!”
রাইমা স্টেচু হয়ে বসে যায় মাহিশার মৃদু ধমকে৷ এদিকে ইফরাদের কথায় তো শার্লিন চোখ পাকানো দৃঢ় করে যাচ্ছে। যার অর্থ এটাই বোঝায়, একবার একা পাই! দেখাবো মজা। তার দিকে তাকিয়ে ইফরাদ ফাঁকা ঢোক গিললো। ইফরাদের কথার প্রেক্ষিতে সাইরা বলে উঠে,
“ইফরাদ ভাই এই বিষয় খেয়াল করেননি! ফেসবুকে অনেক পোস্ট হয়, মানুষ স্বপ্নে দেখে দুটো বিয়ে করে। ভাবে এক বউ অত্যা”চার করলে অন্য জন বাঁচায় । কিন্তু সত্যি হয় কি! একজন বাঁধে, আরেকজন পি”টায়। শেষে না এমন হয়ে যায় আপনার কপালটা।”
“এই তো বোনের মতো কথা। লাবিউ বইনা।”
শার্লিন সাইরার উদ্দেশ্যে ফ্লাইং কিস ছুড়ে কথাটা বললো। ইফরাদ কপাল চুলকে বিরবির করে,
“যেমন বউ, তেমন জুটবে শালীগুলো। একেকটা একেকজনের এক কাঠি উপরে। সন্ন্যাস জীবন কেমন হবে! এদের ভয়ে বিয়েই করা যাবেনা মনে হয়।”
এরপর নিজেই আর কথা না বাড়িয়ে প্রস্থান করলো। মানুষ বেশি হওয়ায় ঘরের মাঝে সিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান ছাড়া থাকলেও গরম যেনো কমছেনা। এজন্য শার্লিন প্রতিবেশী সব মানুষকে নিয়ে তাড়া দেখিয়ে বললো,
“আপনারা তো খাওয়া দাওয়াই করেননি মনে হয়। চলেন চলেন, খাওয়া দাওয়া করা যাক। সাথে দুলাভাইয়ের একটু দর্শন করে আসি। বেচারা একা হয়তো বসে বসে বোর হচ্ছে। চলেন তো ভাবী-রা।”
শার্লিন সবাইকে নিয়ে বাইরে গিয়ে ঘর একদম ফাঁকাই করে দেয় প্রায়। শুধু ইশা, ঐশী, স্নেহা আর সাজাঁনোর জন্য মাহিশা থেকে যায়। সব বেরুতে মাহিশা হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে-ও সেই রাইমা আর শার্লিনের মতোই। বেশি মানুষজন সহ্য করতে পারেনা৷ ঘর ফাঁকা হতেই সে সাজানোয় আরও গভীর মনোযোগ দেয়।
১১১,
শার্লিন সহো বাকি মেয়েরা এসে দেখে আরফান দিগন্তের কোলে বসে স্টেজে বসে আছে। একপাশে মাহাদ অন্য পাশে রাইমার দাদা বসে আছেন। জুতা টা পায়েই পরা। হয়ে গেলো, তাদের সাধের জুতা চুরির প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেলো। যাকগে সেসব না পারলো একটু বিরক্ত তো করা যায়! সে সব মেয়েদের নিয়ে দিগন্তের সামনে গিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু করে দেয়। দিগন্তও বিষয়গুলো ইনজয় করছে। বিয়ে বলে কথা! এতো তো বিরক্ত হলে চলে না। এভাবে একঘন্টার মতো সময় চলে গেলে আজাদ সাহেব তাড়া দেন, এবার রেজিস্ট্রি, কবুল বলা হবে। কাজী সাহেব এসে পরেছেন। শার্লিন সব শুনে ছুটে রাইমার কাছে আসে সাজানোর কতোদূর এটা দেখতে। এসে দেখে সব শেষ। শুধু মাথায় দোপাট্টা-টা সেট করে বাকি। মাহিশা শার্লিনকে দেখেই বলে,
“তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। এসো, তুমি এই কাজটুকু করো।”
“তুমিই তো সব করে ফেলেছো আপু। আমি আর কি করবো! তুমিই করে ফেলো।”
“এই আমি তোমার এতোটাও বড়ো নই, আপু আপু শুরু করেছো। সেম এজই তো আমরা।”
মাহিশা শার্লিনের কথার জবাব দেয়। শার্লিন মুচকি হাসে। কথা না বাড়িয়ে রাইমার পিছনে দাড়িয়ে দোপাট্টা সেট করে দেয়। এরপর সামনে দাড়িয়ে চোখ থেকে কাজল নিয়ে কানের পিছনে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
“মাশা আল্লাহ, আমার আত্মার মানুষ টার উপর, তার সুখের উপর কারোর বদ নজর না পরুক। আপনি সবটা সময় ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুখে থাকুন। প্রতিটা মোনাজাতে এটাই চাইবো। সংসার জীবনে পা দিচ্ছেন, এতোটা বুঝ আমার নেই। কিন্তু কিছু কথা বলি, আপনি ভীষণ নরম মনের মানুষ আমার আত্মার সাথী। হয়তো নিজেকে অনেকটা স্ট্রং হিসেবে সবার মাঝে প্রেজেন্ট করেন, আদৌও আপনি ততোটা স্ট্রং নন আমি জানি। নিজের বাবা-মাকে যেভাবে সংসার করতে দেখে বড়ো হয়েছেন। সেভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন। ছোট্টখাট্টো ঝামেলায় কষ্ট পাবেন না। মায়ের কথা মনে করবেন, লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে মিটানোর চেষ্টা করবেন। আমি জানি আপনি শান্ত মানুষ। সব শান্ত ভাবেই সামলে নিবেন। আপনার জীবনে ঝামেলাও কমই আসবে। আসবেনা, এই ভরসা তো দেওয়া যায় না। কারণ সংসার জীবন, ঠুকঠাক ঝামেলা সবারই হয়। ঘাবড়াবেন না। শান্ত ভাবে সামলে নিবেন। আপনার উপর আমার ভরসা আছে। দিগন্ত ভাই বাইরে থেকে রুক্ষ মেজাজের হলেও ভেতরটা বাচ্চাদের মতোই নরম। তাকে সামলে রাখবেন। মনে রাখবেন, আপনি একমাত্র বর্তমানে উনার জীবনে একটাই আপন মানুষ। স্নেহা ভাবী তো আপনার ভাইকেই সামলাচ্ছে। আপনিও তাকে সামলে সুস্থ, সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলবেন। আপনার কাছে আমার এটুকুই আর্জি কষ্ট পেলে সেটা চেপে রেখে অভিমান না বাড়িয়ে মিটিয়ে নিবেন। জানেনই তো ভালোবাসার থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারেনা। ভালোবাসা সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর। এটা একমাত্র আমার মতো ভালোবাসার কাঙাল-রাই বুঝতে পারি। হাতের জিনিস কখনও পায়ে ঠেলে দিয়ে সরে আসবেন না। আকড়ে ধরে সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে দিন। আপনি পারবেন আমি আশা রাখি। চলে তো চাইলেই যাওয়া যায়! আকড়ে ধরে বাঁচে ক’জন বলুন! দিগন্ত ভাই নিজের বাবা মায়ের যে তিক্ততা দেখে বড়ো হয়েছেন! সেই তিক্ততার ছাপ উনার উপর আবারও পরতে দিবেন না কখনও। তখন যে চাইলেই মানুষ টাকে সামলানো যাবেনা। স্নেহা ভাবী পারবেন না তো সামলাতে। আপনার জীবন, সংসার জীবন আল্লাহ রহমত ময় করে দিন, সেটাই চাইবো সবটা সময়। ভালো থাকবেন আমার সাথী, আপনি ভালো থাকবেন। আজ হতে আমরা কাছের মানুষ-রা আপনার দূরের মানুষ। আর দূরের মানুষগুলোই আপনার কাছের। এটা মনে রাখবেন।”
১১২,
শার্লিন একদমে কথাগুলো বলে নিজের কান্না লুকাতে চলে গেলো ঘর থেকে। উপস্থিত সকলে নির্বাক, শান্ত চাহনীতে শার্লিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রাইমা হতবিহ্বল হয়ে পরেছে শার্লিনের কথাগুলো শুনে। একটা চঞ্চল, দুষ্টু মেয়ে, যার কাজই সবটা সময় সবাইকে হাসিয়ে চলা! সে এতো ভারী কথাও বলতে জানে। রাইমার ভেতরে ভেতরে কান্নারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। উফ কি দারুণ য”ন্ত্রণা। কাছের মানুষগুলো দূরের, দূরের মানুষগুলো কাছে। ইশশশ! এমনটাও মেনে নিতে হয় জীবনে! হয়তো, হয় বলেই এর নাম সংসার জীবন। কাজী দরজায় এসে উপস্থিত হওয়ায় রাইমা নিজেকে সামলে নেয়। আজাদ সাহেব সহো বাকি মুরব্বিরা উপস্থিত হয়েছেন। স্নেহা সবাইকে নিয়ে সরে দাড়িয়ে উনাদের ভেতরে আসার জায়গা করে দেয়। হামিদা বেগম এসে নাতনীর পাশে বসেন। অন্যপাশে আজাদ সাহেব আরফানকে এনে বসিয়ে দেয়। রাইমা অনেকক্ষণ পর ভাইকে কাছে পেয়ে তার ছোট্ট হাত আকড়ে বসে। কাজী সাহেব তার কাজ সম্পূর্ণ করে রেজিস্ট্রি পেপার রাইমার দিকে এগিয়ে দিলে রাইমা বাবার মুখের দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রয়। আজাদ সাহেব মেয়েকে চোখের ইশারায় সাইন করতে বলেন। এই একটা তিন অক্ষরের সাইন অন্য একটা মানুষকে তার উপর অধিকার ফলানোর জন্য অধিকার দিয়ে বসবে! বাবার জোড় টা আগের মতো আদৌও রইবে! আজগুবি চিন্তা করতে করতে সাইন টা করেই দেয় রাইমা। এরপর আসে কবুল বলার পালা। কাজী সাহেব সব কথা বলে রাইমাকে কবুল বলতে বলায় আজাদ সাহেবের বুকের মাঝে হু হু করে উঠে। অবশেষে বাবার রাজকন্যা অন্য কারোর ঘরের ঘরণী হয়েই যাচ্ছে। রাইমা চারদিকে নজর বুলিয়ে মা-কে খুজে বেড়ায়। পেয়েও যায়৷ দরজার কাছে শাহনাজ বেগম সহো তার চাচী, ফুফু, খালা, মামীরা দাড়িয়ে আছে। মামাদের চাকরি থেকে ছুটি মিলছিলো না, এজন্য বিয়েতে আসতে পারতো কিনা ঠিকই ছিলো না। তবুও বিয়ের দিন বরপক্ষ আসার পরপরই উনারা আসতে পেরেছেন এটাই আনন্দের বিষয় রাইমার কাছে। উনারা তাদের আদরের মেয়েকে অন্য মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার কার্যক্রম উনারাও দেখছেন। চোখে জল, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে কবুল বলতে ইশারা করছেন। রাইমাও কেঁদে ফেলেছে। তবুও হাসি হাসি মুখ করে বলেই দেয়,
“কবুল।”
শাহনাজ বেগমদের পেছনেই দাড়িয়ে ছিলো শার্লিন। রাইমা কবুল বলতেই চোখের সামনে সাড়ে ৪টা বছরের বন্ধুত্বের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। চাইলেও আর আগের মতো সে রাইমাকে তার পাশে পাবেনা। শার্লিন নিজেকে সামলাতে পারলো না। বারান্দাতেই হাটু মুড়ে বসে চিৎকার করেই কান্না করে উঠলো। সবাই এদিকে শোকর আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলো। তার মাঝেই শার্লিনের চিৎকার শুনে শাহনাজ বেগম চট করে পিছন ফিরে তাকান। সবার দৃষ্টি চলে যায় শার্লিনের দিকে। রাইমা সবাইকে পাশ কাটিয়ে ছুটে এসে বান্ধবীকে আকড়ে ধরে। রাইমাদের বাড়িটা টিনশেড হওয়ায় মেঝে পাকা ছিলো বিধায় কাপড়চোপড় মাখার কথা নয়। কিন্তু সবাই জুতা পায়ে হাটছে। সেই ধুলোর মাঝে এমন করে বসে পরায় শাহনাজ বেগম আর সাহিরা বেগম দুই মেয়েকে টেনে তুললেন। তাদের কান্নায় যেনো আকাশ বাতাসও আজ গম্ভীর হয়ে গেছে। সবার চোখের কোণে জল জমে গেছে। বিদায়ের সময় না আসতেই দুজনের কান্না সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। শার্লিন কান্নার চোটে প্রলাপ বকছে। একনাগারে বলে যাচ্ছে,
১১৩,
“আপনাকে আর চাইলেই পাশে পাবো না প্রাণ, আপনি আমার সাড়ে চার বছরের অভ্যাস। আপনাকে সকাল হলেই আমি কারণে অকারণে দেখতাম, জ্বা’লাতাম। আজ থেকে আগামীকাল হতে কাকে জ্বা”লাবো! বলে দেন! আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে আত্মার সাথী। আপনি কাগজ-কলমে আজ একজনের হলেন। আপনাকে আটকে রাখার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু আপনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অভ্যাস আমি বদলাবো কি করে! জানেন তো আপনি আমার শান্তির জায়গা। আপনি ছাড়া এই মেয়েটা এককদম চলতেও হোচট খায় এখন। আমায় যে আপনার মতো শাসন করে কেউ আগলাতে পারবেনা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে প্রাণ।”
দিগন্ত স্টেজে বসেই সবার অবস্থা দেখে নিজেও ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করেই নেয়, এদের বন্ধুত্বে দেওয়াল হবেনা। ওদের ইচ্ছেমতোই ওরা আড্ডা, ঘোরাঘুরি বিয়ের আগে যেমন করতো, তেমনই থাকবে সব। ইফরাদ, মিহাল, নিহাল, মেসবাহ, মাহাদ দিগন্তকে ছেড়ে এসে বারান্দার কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে ওদের কান্না দেখে নিজেরাও ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। রাইমা শার্লিনের কথাগুলো শুনে থামানোর চেষ্টা করবে কি! নিজেই কান্না জুড়ে দিয়েছে। মাহিশা ঘরের দরজার কোণে দাড়িয়ে ছিলো। দুজনকে কাঁদতে দেখে সে পারেনি নিজেকে সামলাতে। রাইমার সাথে ছোটো থেকে বড়ো হওয়া! এতোদিনের দূরত্ব সব মিলিয়ে তার বুকের মাঝেও যন্ত্রণার ঝড়। সেও ছুটে এসে দুজনকে জড়িয়ে কান্না করে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টায় নামলো। বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ এদের বন্ধুত্বের বন্ধন দেখে কান্না করে দিয়েছে। এই স্বার্থ দেখার সময়ে এসেও এতো পাগলামি করার মতো বন্ধুত্বও হয়! শাহনাজ বেগম নিজেও যেনো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। শার্লিন, মাহিশা এবং মেয়েকে জড়িয়ে তিনজনকেই শান্ত করার জন্য বললেন,
“মাহিশা আর শার্লিনকে পাওয়ার পর কখনও ভাবিনি আমার এক মেয়ে। আমার তিনটা মেয়ে। বড়ো মেয়ে তো সংসার সাজিয়ে নিয়েছে, মেঝো জনকেও দিয়ে দিলাম অন্যের হাতে। ছোটো জনকেও দিয়ে দিতে হবে। তিনটা মেয়েকে হারিয়ে আমি এক মা পথের কাঙাল হবো। আমার ঘরের জান্নাতদের অন্যের ঘরে দিয়ে আমার ঘরে যে হাহাকার জমবে! সেগুলো কে দেখবে মায়েরা আমার! তোমরা নিজেরা এভাবে ভেঙে পরলে আমরা বাঁচবো কি করে? শান্ত হও, মায়ের কথা ভেবে হলেও শান্ত হও।”
শাহনাজ বেগমের কথা তাদের কর্ণ কুহরে আদৌও যাচ্ছে কিনা! কেউ বুঝতে পারলোনা। আজাদ সাহেব তো বাবা, চাইলেও সবার মতো কাঁদতে পারলেন না। মেয়েদের সামলাতে ইফরাদ আর সামিদকে ইশারায় তাদের প্রিয়তমাদের সামলে নিতে বললেন। ইফরাদ এসে শার্লিনে হাত ধরে সরিয়ে নেয়, সামিদ মাহিশাকে। তাদের মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। আদ্রিশা তার নানীর কোলে ছিলো। সামিদ সেখানেই নিয়ে যায় মাহিশাকে। এদিকে বিয়ের বাকি কার্যক্রমও সম্পন্ন করতে লেগে পরে সবাই। দিগন্তকে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করিয়ে কবুল বলতে বলা হয়। দিগন্ত একবার অদূরে দাড়ানো বোন, দুলাভাই, চাচা, ফুফার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়,
“কবুল।”
সবাই একত্রে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। এরপর মিষ্টি দেওয়া হয় সবার মাঝে। এরপর মিহাল-নিহাল মিলে রাইমা-দিগন্তকে পাশাপাশি চেয়ারে বসিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলে। আজাদ সাহেব হতে শুরু করে প্রতিটা মুরব্বি সহো পুরো পরিবার একসাথেই খেতে বসিয়ে দেয় তারা। ইফরাদ, মিহাল, নিহাল, মেসবাহ, রাহান সার্ভ করে দেয় নিজ হাতে। রাইমার কান্না থামছে না। তবুও সবার মুখ পানে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে খেতে বসে। আবার কবে, চাচা-চাচী, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু,, মামা-মামী-রা, দাদা-দাদী, সকল ভাইবোন সবার সাথে বসে একসাথে খাবে! তার তো ঠিক নেই। সবার জীবনে যে ব্যস্ততা। রাইমা নজর ঘুরিয়ে শার্লিনকে খুজছে। পেলো না, সে ইফরাদের দিকে তাকালো। ইফরাদ তখন সবার পাতে মুরগীর রোস্ট সার্ভ করছিলো। রাইমার পাতে দিতে আসতেই রাইমা ধীর স্বরে বলে,
“ইফরাদ ভাই! শালুকে দেখছিনা যে!”
“পাগলি টার কথা ছাড়ো। তোমাকে দেখেই কান্না আটকাতে পারছেনা। বড়ই গাছের সাথে হেলান দিয়ে কাঁদছে। খাওয়া শুরু করো। আমি আনছি ওকে।”
রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই পাগলিটা যে কি! বুঝতে পারেনা সে। মাত্র কিছু বছরের পরিচয়ে এতো আপন কেউ হয়! এই মেয়েকে না দেখলে জানতেই পারতোনা। ইফরাদ নিজের হাতের কাজ শেষ করে জোড় করে শার্লিনের হাত ধরে টেনে এনে রাইমার পাশে চেয়ার এনে বসিয়ে দেয়। শার্লিন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাইমা খাওয়ার মাঝেই বা হাতে শার্লিনের হাত ধরে ওর মুখের দিকে তাকায়। শার্লিন তাকাতেই রাইমা স্মাইলি ফেইস করতেই শার্লিন হাসার চেষ্টা করে। এরপর রাইমা ইশারা করে খাওয়ার জন্য। ইফরাদ খাবার এনে দিতেই সবাই খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝেই দিগন্ত বলে উঠে,
“তোমার বান্ধবীকে বিয়ে করলাম শালু, নিয়ে জেলাখানায় আটকে রাখবো না তো। এতো কাঁদছো মনে হচ্ছে অন্যদেশে নিয়ে দৌড় দিবো। তোমরা একসাথে আছো, থাকবে। ইচ্ছে হলেই ছুটে যাবে। কোনো বাঁধা নেই।”
শার্লিন নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করলো। এরপর মনোনিবেশ করে খাওয়ার দিকে। আজাদ সাহেব শার্লিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“পাগোল মেয়ে আমার। কোথায় বোনের বিয়ে, কবজি ডুবিয়ে খাবে, আনন্দ করবে! তা নয় চোখের জল নাকের জল এক করে সাজগোজ নষ্ট করে একেবারে ভুতনী হয়ে বসে আছে।”
আজাদ সাহেব হাসানোর জন্য যে কথা-টা বললেন, এটা সবাই বুঝলো। এজন্য আনন্দের মাঝেই খাওয়া শেষ করতে চাইলো সবাই।
১১৪,
খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে আসলো। এরপর রাইমা দিগন্তকে পাশাপাশি বসিয়ে আয়নায় মুখ দেখা, মায়ের হাতে দুধভাত খাওয়ানোর পর্ব চুকিয়ে সময় আসলো জামাইয়ের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়ার নিয়ম। আজাদ সাহেব স্টেজে উঠে রাইমার হাত টা দিগন্তের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“আমার আদরের রাজকন্যা, বাবা-রা হয়তো রাজা হইনা আমরা। কিন্তু আমাদের কন্যাকে রাজকন্যার রুপেই মানুষ করি। আগলে রেখো বাবা। কষ্ট দিয়ো না। আমার মেয়ে মোমের মতো, ও গলে যায় অল্পতেই। তুমি শক্ত হাতে সামলে রেখো।”
আজাদ সাহেব কেদেই দিবেন এমন অবস্থা। দিগন্ত কিছু উত্তর দিতে পারলোনা শ্বশুর মশাইয়ের অবস্থা দেখে। শুধু উনার হাতের উপর অপর হাত দিয়ে চোখের ইশারায় আশস্ত করলেন। এরপর আসলো বিদায়ের পালা। এই সময়টা যে কি ভয়ানক! বর্ণনাতীত। স্নেহা একহাতে আকড়ে রাইমাকে গাড়ির কাছে আনলো। শাহনাজ বেগম সহ রাইমার খালা, ফুফু, চাচী, মামীরা নিজেদের হাতে আগলে বড়ো করা আদরের মেয়েটার বিদায় বেলায় আর সামলাতে পারলেন না। সাইরা, সাইফা, তিশা, রাহান, মিহাল, নিহাল, শিখা, রেখা নিজেদের আদরের বোনের থেকে দূরেই থেকেছে সবসময়। তবুও যেটুকু সময়ের জন্য কাছে পেয়েছে, আবার চাইলেই নিজেদের চাওয়া মতোই কাছে পাবেনা। দিগন্তের ব্যস্ততা থাকবে, রাইমার সংসার হবে। তাদের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠছে। বাবা-রা তো চাইলেই কাঁদতে পারেন না। উনারা সবাই দূরেই দাড়িয়ে মেয়ের বিদায় দেখছেন। হামিদা বেগম ও আরফানকে রাইমার সাথে দেওয়া হলো। শার্লিনকে আশে পাশে পাওয়া গেলো না। এখানে থাকলেই আবার তার পাগলামি শুরু করে। ইফরাদ তাকে নিয়ে সরে গিয়েছিলো। তবুও শেষ মুহুর্তে এসে সে রাইমাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এরপর বুকের মাঝে কষ্ট চেপেই রাইমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। সবাইকে বিদায় জানানো হয়ে গেলে গাড়ির দরজা আটকে দেয় দিগন্ত। রাইমা গাড়ির কাচ নামিয়ে এক পলক সবাইকে আবার দেখে নেয়। সবাই একসারি হয়ে দাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে তাকে বিদায় জানায় হাসিমুখে৷ রাইমা লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে সীটে গা এলিয়ে দেয়। নিজের মনকে শক্ত করে, মেয়েদের জীবন এটাই। দিগন্ত রাইমার একহাত নিজের হাতে আঁকড়ে ধরে বলে,
“ধরলাম হাত,, ইনশা আল্লাহ কখনও ছাড়বোনা পুষ্পবতী। আপনি আমার মানসিক শান্তি হয়ে রয়ে যান, আমি আপনাকে আমার কাছে যত্ন করে রেখে দিবো। ঝড়ঝাপটা আসবে, কখনও হাত টা ছাড়িয়েন না। আপনি ছাড়া আমার অস্তিত্ব এখন হতে কিছু টা ঠুনকোই। দিগন্ত আহসান যে ধীরে ধীরে রাইমা খন্দকারের মায়ায় ডুবছে। কি করে যে ঝগড়া করতে করতে আপনাকে বিয়েই করে নিলাম, বুঝে উঠতে পারলাম না৷ কিন্তু আপনার মায়ায় ডুবে যাচ্ছি। অদ্ভুত না?”
“আপনি পুরো মানুষ টাই অদ্ভুত মি: দিগন্ত আহসান।”
রাইমা আলতো হেসে উত্তর দেয়। তখনই স্নেহা আর মাহাদ গলা খাকাড়ি দেয়। মাহাদ বলে,
“বড়ো ভাই আমি, গাড়িতেও আছি। একটু লজ্জা রেখে বাসর ঘরে তোমরা নিজের মায়ায় ডুবিয়ো আমার শালাবাবু, আদরের বোন।”
দিগন্ত হাসলো মাহাদের কথায়। সে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে। স্নেহা দিগন্তের অন্য পাশে বসা। পরিচিত মানুষদের সাথে থাকলে হয়তো রাইমার খারাপ কম লাগবে। এজন্য একসাথেই বসেছে তারা। মাহাদ দিগন্তের দিকে ফিরে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,
“আরে শালাবাবু আপনারা যে আমি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেও পরিচিত ছিলেন, এটা তো বুঝতেই পেরেছি। এবার বলেন তো এই যে ঝগড়ার কথা বললেন! এতো ঝগড়া করলেন কবে!”
“এই এটা আমারও জানার আগ্রহ আছে।”
স্নেহা মাহাদের কথায় তাল মেলালো। দিগন্ত একবার রাইমার দিকে তাকিয়ে মাহাদ আর স্নেহার দিকে তাকালো। রাইমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের মাঝে পরিচয় হওয়া, ঝগড়া হওয়া সব চোখের পাতায় ভাসছে তাদের। দিগন্ত সীটে গা এলিয়ে রাইমার মাথাটা নিজের কাধে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সব খুলে বলে। সব শুনে স্নেহা আর মাহাদ হতবাক। স্নেহা ভাইয়ের বাহুতে কি”ল মে”রে বললো,
“যাকে ঝগড়ার সাথী বানিয়েছিলিস, তাকেই জীবন সাথী হিসেবে পেলি। দারুণ তো ভাই।”
দিগন্ত মুচকি হেসে বললো,
“সে আমার আকাশে অল্প নীল আপু। নীল মেঘের মতো জমে এসে বৃষ্টি ঝড়িয়ে ঝকঝকে আকাশের মতো সুন্দর করে দিতেই তার আগমন আমার জীবনে।”
“আগলে রেখো তোমার #আকাশেও_অল্প_নীল আনা এই মেয়েটিকে।”
মাহাদ মৃদু হেসে কথাটা বললো। দিগন্তও হেসে মাহাদকে ভরসা দিলো।
চলবে?