আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৪+২৫

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২৪

রাতের আঁধার কাটিয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে এক স্নিগ্ধময় সকাল। সূর্যের আলোর পাশাপাশি রুমে ধেয়ে আসছে শীতল বাতাস। চার দেয়ালের প্রতিটি কোণায় কোণায় বাতাসের বিচরণ। হাওয়ার তালে কিছু টা নড়ছে আদ্রর কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো। লোক মুখের কথা ডাক্তারি পড়তে পড়তে মাথার অর্ধেক চুল খোয়াতে হয়। অথচ আদ্র নামক সুদর্শন যুবকের মাথায় চুলের ও কমতি নেই। মানুষ টা পারফেক্ট সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। এটা একটা ভুল! নিতান্তই ভুল বাক্য। পৃথিবীতে সবাই পারফেক্ট হয় না। কোনো না কোনো দিক দিয়ে ত্রুটি,শূণ্যতা থেকেই যায়। যেমন আদ্রর ও আছে। দেখতে সুদর্শন হলেও তার রয়েছে চরম দুর্বলতা। তার দুর্বলতা একটা মেয়েকেই কেন্দ্র করে । আটাশ বছরের এই সুদর্শন যুবকের দুর্বলতা আঠারো বছরের তুলি কে ঘিরে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় রুমের সাদা পর্দা গুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগল। নিমিষেই সূর্যের কিরণ বিলুপ্ত হয়ে রুম টা হিম ঠান্ডায় পরিণত হল। এক নজরে আদ্রর ঘুমন্ত চেহারায় দৃষ্টিপাত করে রেখেছিল তুলি। বাতাস এসে জ্বালাতন করায় না চেয়ে আদ্রর সামনে থেকে উঠতে হল তার। ধীর পায়ে হেটে বেলকনির কাছে এসে কাচের দরজা টা লাগাতে নিলে বাতাসের দাপটে উড়তে লাগল খোলা হালকা ভেজা চুল ও শাড়ির আঁচল টা। আকাশের দিকে তাকাল তুলি। আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা। হয়তো আজ বৃষ্টি হবে নয়তো আসবে কোনো প্রকান্ড ঝড়। তারই পূর্বাবাস দিয়ে যাচ্ছে কালো মেঘ ও এই দমকা হাওয়া। দরজার কাছে দাড়িয়ে চোখ বুঁজে নিল তুলি। বাতাস এসে চোখে মুখে দোলা দিয়ে যেতেই ঠোটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসির ঝলক। মনের কোণে ভেসে উঠল কিছু মুহুর্ত। আশ্চর্য! তুলির মন বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে না। কোনো তিক্ততা ও তাকে গ্রাস করতে পারছে না। বিষাক্ত অনুভূতি হৃদয়পটে জমাট হতে অক্ষম। তুলির কাছে সবকিছুই নিছক সত্য একটাই আদ্রর ভালোবাসা। তুলির ঠোঁট দুটো আলগা হয়ে এল। মিন মিন স্বরে উচ্চারিত হল,,

” একটা আহত মন,ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে কোনো এক বসন্তে আপনার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ!অথচ আপনি বদলে দিয়েছেন সময়।ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন আমায়। আমার হৃদপিন্ডের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে দিয়েছেন অনুরাগের অনল। ”

কাচ লাগিয়ে তুলি আদ্রর সামনে এসে বসল। আদ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। সারারাত নেশার ঘোরে থেকে এখন ঘুমানো টাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন ঘুম টা ভাঙবে তখন কি মনে পড়বে আদ্রর সবকিছু? স্মৃতির পাতায় কি সজীব থাকবে কিছু সময়? নিঃশব্দহীন একটা নিঃশ্বাস ফেলল তুলি। ঠোঁটে প্রস্ফুটিত হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে আদ্রর কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিল। একটু নিচু হয়ে কপালে নিজের অধর ছোঁয়াল গভীরভাবে। চোখে জড়ো হল জল। আর মাত্র কিছু সময় পর সারাজীবনের জন্য দু’জন বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে। ঘুচে যাবে সাময়িক দূরত্ব। মাথা উঠিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল তুলি। সাতটা বেজে গেছে। সবাই হয়তো ঘুম থেকে উঠে গেছে বিয়ে বাড়ি বলে কথা। অবশ্য তুলি ফজরের সময় নিজের ঘরে গিয়েছিল একবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। এখন না গেলে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে তাই উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়েও আরেকবার ফিরে তাকাল আদ্রর মুখের দিকে। অজানা কারণেই বুকটা হাহাকার করছে। তুলির ইচ্ছে করছে না তার ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে একটুও দূরে যেতে। তবে যেতে তো হবেই। “কিছু সময় পরই তো বিয়ে তারপর আমাদের জীবনের নতুন সূচনা ঘটবে।” কথাটা বিড়বিড় করে বলেই হালকা হেসে বেরিয়ে এল তুলি। চারদিকে নজর দিতেই দেখল দু তলায় কেউ নেই সবাই নিচে। হাফ ছেড়ে দরজা টা চাপিয়ে দ্রুত গতিতে পা ফেলে রুমে চলে আসল।
_______

ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠল আদ্র কিছু শোরগোলের আওয়াজে। কোনোদিকে না চেয়েই মাথা টা চেপে ধরে বসে পড়ল। প্রচন্ড ভার হয়ে আছে মাথা টা সেই সাথে তীব্র ব্যাথা। এমন তো কখনও হয় নি তার।কানে আবারও আওয়াজ এসে ভিড়তে মাথা তুলে চাইল চারপাশে। সাগর,অন্তু,নিবিড় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। চরম বিরক্তি নিয়ে আদ্র বলে উঠল-

-“সমস্যা কি তোদের? সকাল সকাল এভাবে পাগলের মতো চেয়ে আছিস কেন?”

–” বর সাহেব ঘড়িতে তাকালেই দেখতে পাবেন নয়টা বাজে। এখনও সক্কাল সক্কাল রয়ে যায় নি।” —কথাটা বলেই নিবিড়, সাগর,অন্তু হু হু করে হেসে উঠল। নিবিড় একটা বালিশ নিয়ে পাশে শুয়ে রসাত্মক কন্ঠে বলে উঠল-

–” তুই তো এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাস না। ব্যাপার কি! আজকের কাজ গতকাল শেষ? ”

নিবিড়ের মজার ছলে বলা রসাত্মক বাক্য টা শুনে বুক টা ধুক করে উঠল আদ্রর। বাকি সবাই আরেক দফা হাসতে শুরু করল। আদ্র কপাট রাগ দেখিয়ে বলল–

–‘ আমি তোর বউয়ের বড় ভাই হই ভুলে যাস না।”

–” তার আগে তুই আমার বন্ধু। আর বন্ধুর সাথে কথা বলতে সীমার প্রয়োজন নেই। ”

–” হু। এখন তোরা তিনটা বের হ আমার রুম থেকে। যার যে বউয়ের কাছে যা আর আমাকেও ফ্রেশ হয়ে আমার বউয়ের কাছে যেতে দে।”

আদ্রর কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে চাইল তিনজন।সাগর কপালে ভাজ ফেলে বলল–
” একটু পরেই তো বিয়ে ভাই। এখনই যেতে হবে তোর?”

–” যেতে হবে। যদি মাইর না খেতে চাস ফুট এখান থেকে।”

মাইর খাওয়ার কথা শুনেই উঠে দাঁড়াল অন্তু। যেতে যেতে বলল–” পায়েল বোধহয় আমাকে ডাকছে। বেবীর সেবা করতে হবে তো।” সাগর ও নিবিড় একসাথে বলে উঠল- “পায়েল বাঘিনী অথচ তার বর ভেজা বেড়াল। ” দুজনে না পেরে চলে গেল রুম থেকে। ওরা যেতেই আদ্র বিছানা থেকে উঠে দরজা টা ঠাস করে লাগিয়ে দিল। ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানি দিয়ে কাল রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল। আদ্রর স্পষ্ট মনে আছে জুস খেয়েছিল সে। খাওয়ার কিছু সময় বাদে তুলির সাথে দেখা করার জন্য বাড়ির ভিতরে এসেছিল। সামিরার উপস্থিতি ও ঝাপসা হয়ে স্মৃতির পাতায় বিচরণ করছে। মাথার চুল টেনে মনে করার চেষ্টায় লেগে পড়ল আদ্র। তার মন টানছে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেছে গত রাতে। বহু চেষ্টার পর মনের আরশিতে ভেসে উঠল তুলির চোখ বুজে থাকা শ্যামলা মুখশ্রী টা। থমকে গেল আদ্র। গলা শুকিয়ে এল তার। হৃদয় নিংড়ানো ভয় চেপে ধরল আষ্টেপৃষ্টে। আয়নায় চোখ যেতেই মনের আশঙ্কা টা পরিণত হল যন্ত্রণায়। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে এসে এক লাফে তুলির বারান্দায় উপস্থিত হল। পায়ের গতি বাড়িয়ে রুমে আসতেই চোখে পড়ল আয়নার সামনে কলা পাতা রঙের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তুলির দিকে। তড়িৎ বেগে তুলি কে ঘুরিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল আদ্র। কাতর স্বরে এক নিশ্বাসে বলল,,,

–” আমার মনে হচ্ছে আমি অপরাধ করে ফেলেছি তুলা। সত্যিই কি তাই? ”

আদ্রর প্রশ্ন শুনে কেঁপে উঠল তুলির মনটা। হৃদয়ের উঠানামা হতে লাগল দ্রুত গতিতে। আদ্র অধীর আগ্রহ নিয়ে করুন চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে উত্তরের আশায়। পারবে না তুলি জবাব দিতে। আজ যেন তুলি কিছু বলার ভাষা ও হারিয়ে ফেলেছে। তুলি কে নিশ্চুপ দেখে আদ্র ধরা গলায় বলল,,

–” নীরবতা কি সত্যের প্রমাণ দিচ্ছে?”

–” আপনি কখনও অপরাধ করতে পারেন না আদ্র।”– কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল তুলি। আদ্রর ভয় হচ্ছে। তুলির ছোট্ট মনের ভাবনা সে আজ কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। বুকের অসহনীয় পীড়ন নিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে উঠল-

–” তুমি আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে নাতো তুলি? আমার মনে হচ্ছে আমাদের মাঝে,,,।”

আর কিছু বলতে পারছে না আদ্র। তুলির গালে হাত রেখে বলল–” জুস টা তুমি পাঠিয়েছিলে?”

আদ্রর এহেন প্রশ্নে কিছুটা বিস্মিত হল তুলি। সাবলীলভাবে জবাব দিল –” আমি সামিরা আপু কে বলেছিলাম ওনি পাঠিয়েছেন। ”

ব্যাস যা বুঝার বুঝে গেল আদ্র। সামিরার উদ্দেশ্য বেশ ঠাওর হয়েছে তার। ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকা তুলির দিকে তাকাতেই আদ্রর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। মেয়েটার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ নেই আজ যা আদ্র কে পোড়াচ্ছে ভীষণভাবে। তুলির ললাটে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে কপালে কপাল ঠেকাল আদ্র। করুন স্বরে বলে উঠল-

” যদি কিছু হয়েও থাকে তবে মুহুর্ত গুলো অবৈধ ছিল না তুলা। আমি অপেক্ষা করব। অপেক্ষা করব আরো একটা বার তোমাকে আপন করে নেওয়ার।”

তুলির মেহেদী রাঙা দু হাতে চুমু একে আস্তে আস্তে দু হাত ছেড়ে দিতে লাগল আদ্র। এক পলকে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল তুলি। মনটা আনচান করছে আজ।বড্ড কু ডাকছে। ইচ্ছে করছে আদ্রর হাত টা দু হাতে শক্ত করে আকড়ে ধরতে। ধীরে ধীরে চলে গেল আদ্র। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘোরের সমাপ্তি ঘটল তুলির। খুলে দিতেই আমরিন, ইনশিতা,পায়েল, রিমি, ঝুমু কে দেখে মৃদু হাসল। আমরিনের হাতে বিয়ের বেনারসি। ঝুমুর হাতে নাস্তার প্লেট। নিঃশব্দে খাটে এসে বসল তুলি। ঝুমু তুলির দিকে তাকিয়ে বলল —

“বাহ! গোসল করে নিয়েছ। বেশ ভালো হয়েছে। নাস্তা করতে তো নিচে যাও নি। এখন ঝটপট খেয়ে নাও। অলরেডি দশটা বেজে গেছে। সাজানো এখন থেকেই শুরু করে দিতে হবে। নামাজের পরেই তো বিয়ের কার্য সম্পন্ন করা হবে।”

তুলি সায় জানিয়ে খেয়ে নিল। আমরিন তুলির চুল গুলো ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিল। একটু পর পার্লারের মেয়েরা চলে আসবে। পায়েল,রিমি সবার সাথে টুকটাক কথা বলতেই কেটে গেল কিছু সময়। সায়েরা বেগম পার্লারের মেয়ে গুলো কে রুমে নিয়ে এসে বাকি সবাই কে তাড়া দিল রেডি হওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে তুলির থুতুনিতে হাত রেখে মেয়ে দুটোর উদ্দেশ্যে বলে গেলেন –” আমার মা টা কে এতো সুন্দর করে সাজাবে যেন আমার ছেলে চোখের পলক ফেলতেই ভুলে যায়।” হবু শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে লজ্জায় কাটা দিয়ে উঠল তুলির সারা শরীর। মাথা নত রেখেই লাজুক হাসি হাসল। সবাই চলে গেল রুম থেকে। মেয়ে গুলো কে বসিয়ে ওয়াশরুমে এসে মুখ ধুয়ে নিল তুলি। আদ্র কে অনুশোচনায় ভুগতে দিবে না সে। বিয়ে টা হয়ে গেলেই বলে দিবে সব।

লাল বেনারসি টা পড়িয়ে তুলি কে সাজিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল মেয়ে দু’টো। নিজেকে আয়নায় দেখে অভিভূত তুলি। লাল বেনারসি তো আগেও গায়ে জড়িয়েছে এতটা মন তো কাড়ে নি তার তবে আজ কেন নিজেকে নিজের কাছেই ভালো লাগছে তুলির?বেনারসি টা আদ্রের পছন্দের বলেই কি এমন? শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তুলির। কখন আদ্র কে দেখাবে নিজের এই রূপ টা? আদ্র কে অপেক্ষা করাতে খুব খারাপ লাগছে তার। সে যে নিজেও ভীষণ অস্থির এক পলক তার ডাক্তার সাহেব কে সাদা শেরওয়ানিতে দেখার।আলতো হেসে চোখ বন্ধ করতেই কারো প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল মনের আঙিনায়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল তুলি। শাড়িটা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতেই যেন ধোঁয়াশায় হারিয়ে গেল মানুষ টা। আঁতকে উঠল তুলি। দু চোখ খুলে সামনে রাখা পানির গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। এটা ভ্রম ছিল! আদ্র কে নিয়ে অধিক ভাবার কারণেই হয়তো কোনো কল্পনায় হারিয়ে গিয়েছিল।
________

নামাজ শেষে সবাই একত্রিত হল বাগানের স্টেজ করা দিক টায়। খুব সুন্দর করে স্টেজ টা সাজানো হয়েছে। কনে ও বরের বাড়ি এক হলেও তুলির বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে ভাইয়ের কাছ থেকে পইপই করে গেইটের টাকা আদায় করেছে আমরিন। স্টেজের পাতলা পর্দা দেওয়া এক পাশে আদ্র বসল। নিজের হাতের কাগজ টা এগিয়ে দিল কাজী সাহেবের দিকে। কাজী সাহেব কাগজ টার দিকে চেয়ে হালকা হাসলেন। সাদা শেরওয়ানিতে আদ্র সবার নজর কাড়তে সক্ষম। কিন্তু সে যে অপেক্ষায় আছে তার তুলা কে লাল বেনারসি তে দেখার। ইচ্ছে তো হচ্ছে নিজে গিয়ে কোলে করে নিয়ে আসবে কিন্তু এতে তার তুলা লজ্জায় মরে যাবে। সেটা ভেবেই আদ্রর ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত মুগ্ধ হাসি ফুটল। কল্পনায় একে নিল তুলির লজ্জা রাঙা বধূ বেশী মুখটা। অবশেষে আজ দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। আরও একবার প্রাপ্তির খাতায় নাম লিখাতে যাচ্ছে। রাদিফ সাহেব আমরিন কে আদেশ করলেন তুলি কে নিয়ে আসার জন্য। খুশিতে গদগদ হয়ে বাড়ির ভিতরে পা বাড়াল আমরিন। একবার দেখে এসেছিল তুলি কে তারপর আর যাওয়া হয় নি। শাড়ির কুঁচি গুলো ধরে তুলির রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল,,,
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২৫

মাঝ রাতে ঢিলা একটা টি শার্ট পড়ে খালি পায়ে হুড়মুড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আদ্র। ছেলে কে এভাবে বেড়িয়ে যেতে দেখে বুক টা কেঁপে উঠল রাদিফ সাহেবের। চোখে টলটল করতে লাগল জল। চশমা টা খুলে চোখের পানি মুছে মেয়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে ঘুম ছুটে গেল আমরিনের। কিছুক্ষণ আগেই চোখ লেগেছিল। আজকাল এ বাড়ির কারো চোখেই ঘুম সহজে ধরা দেয় না। এই বুঝি আবারও ঘটে গেল কোনো অঘটন। গলায় ওড়না টা জড়িয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে এসে দরজা টা খুলে দিল। দরজা খুলতেই বাবার অসহায় মুখ টা দেখে কেঁপে উঠল অন্তর আত্মা টা। রাদিফ সাহেব ভেজা কন্ঠে বলে উঠলেন,

–” আমি নিরুপায় রে মা। এতো রাতে তোদের জাগাতে খারাপ লাগলেও বাধ্য হলাম। আমার ছেলেটা আবারও বেড়িয়ে গেছে। নিবিড় কে বলবি একটু আমার সাথে ওর পিছু যাওয়ার জন্য? আমার একার পক্ষে যে ওকে আটকানো সম্ভব না।”

নিবিড় ঘুম ঘুম চোখে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে এল। চিন্তিত মুখে বলল–” তাড়াতাড়ি চলুন বাবা। দেরি করলে ওকে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।”

–” হুম চলো।”

রাদিফ সাহেব ও নিবিড় তাড়াতাড়ি করে হাতে টর্চ নিয়ে চলে গেলেন। আমরিন সেদিকে চেয়ে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। বিড়বিড় করে বলল–” কেন তুলি? কেন এমন করলি তুই? কেন আমার ভাই কে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে হারিয়ে গেলি? এতো ভালোবাসার এমন প্রতিদান দিতে পারলি তুই? কে জানত তোর ছোট্ট চঞ্চল মনের আড়ালে এতো নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে ছিল!”

নিবিড় ও রাদিফ সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু দূর আসতেই আদ্র কে দেখতে পেল। হাফিয়ে উঠেছেন তিনি। এ বয়সে ছেলের এতো কষ্ট তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত নিজের ছেলেকে চক্ষুদ্বয়ের সামনে ধুকে ধুকে মরতে দেখার মত কষ্ট ওনার মন টা কে বিষিয়ে দিচ্ছে। সুখের সময়গুলো বোধ হয় তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আদ্র অনবরত ফোন করে যাচ্ছে কাউকে। চোখে মুখে রাগের ছাপ। নিবিড় গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল। তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে বলে উঠল,

” মাঝ রাতেও শান্তি দিবি না তোরা? আবার চলে এলি? পাগল পেয়েছিস আমাকে? সবসময় পিছু কেন নিচ্ছিস? আমার শান্তি চাই। শান্তি!”

কেঁপে উঠল নিবিড়ের হৃদয় টা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আদ্রর বিরক্তমাখা চেহারা টা দেখে আজ ভীষণ কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার। একটা মানুষ কতটা অসুখী হলে একটু শান্তির জন্য আকুল আবেদন করে তা আজ ভালোই বুঝতে পারছে নিবিড়। মেডিকেল কলেজের দুর্দান্ত মেধাবী, সুদর্শন ছেলেটার বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে কে বলবে সে একজন বেস্ট হার্ট সার্জন, একজন সুখী মানুষ ছিল। যেই ছেলে নিজের হার্ট কেই সুস্থ রাখতে পারে নি সে আর অন্যের চিকিৎসা কিভাবে করবে। তাই তো ছেড়ে দিয়েছে ডাক্তারি পেশা।নিবিড়ের তো চোখ গুলো দেখলেই ভয় হয়। নির্ঘুম কাটানো নীল বর্ণের চোখ দুটো এখন সর্বদাই লাল রঙে ছেয়ে থাকে। কারণ নীলাভ চোখে মুগ্ধ হওয়া মেয়েটা আজ আর মুগ্ধ হওয়ার জন্য ছুটে আসে না। নিবিড় উত্তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,,

” বাসায় চল আদ্র। রাত দু’টো বাজে। এতো রাতে তুই তুলি ভাবী কে খুঁজে পাবি না।”

“খুঁজলে অবশ্যই পাবো। তোরাই তো আমার তুলা কে আমায় খুঁজতে বাধা দিচ্ছিস। আমি আমার তুলা কে ঠিকি খুজে বের করব।”

নিবিড়ের চোখের কোণে জমে থাকা জল টা গড়িয়ে পড়ল। শার্টের হাতা দিয়ে মুছে ধরা গলায় বলে উঠল-

” আর কত খুঁজবি আদ্র? চার মাস ধরেই তো পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিস। কখনও কুমিল্লা যাচ্ছিস আবার ঢাকা ফিরে আসছিস তো কখনও ঢাকার অলি গলিতে হেঁটে বেড়াচ্ছিস। কত’শ লোক লাগিয়ে রেখেছিস ভাবী কে খোঁজার জন্য তবুও কেন এতো অস্থির হয়ে পড়ছিস? রাত-বিরেতে কেন খোঁজার জন্য পাগলামি করছিস? ফিরে চল ভাই। একবার তাকিয়ে দেখ তোর বৃদ্ধ বাবার দিকে। লোকটা তোর জন্য ছুটে এসেছে। তোর কষ্ট আমাদের ঘুমোতে দেয় না। আমাদের বুক টা ফেটে যায় আদ্র। আমরা সবাই মিলে তো খুজছি। যেই মানুষ টা ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় পৃথিবীতে তাকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন আদ্র। খুবই কঠিন।”

নিবিড়ের দিকে এক পলক চেয়ে রাদিফ সাহেবের ছলছল চোখে দৃষ্টি রাখল আদ্র। আচমকাই ওনার পা জড়িয়ে বসে পড়ল রাস্তায়। চমকে উঠলেন রাদিফ সাহেব। নিমিষেই হার্টের ব্যাথা টা বেড়ে গেল। আদ্র কন্ঠে আকুলতা নিয়ে বলে উঠল-

” বাবা জীবনে একবার আপনার সামনে কেঁদেছিলাম তুলি কে পাওয়ার জন্য। আজ আপনার পা জড়িয়ে আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বায়না করতে ইচ্ছে করছে একটু সুখ একটু শান্তি এনে দিবেন বাবা? আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চাই। আমার দম টা বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিটা মুহুর্তে বুকের বা পাশ টায় অসহনীয় পীড়ন হয়। আমি ঘুমোতে পারি না। তুলি কে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি,,। আমি সুস্থ হয়ে যাব। আমার কিছু চাই না শুধু একটুখানি স্বস্তি চাই। আমার তুলি কে চাই।”

স্যান্ডেল পড়া পায়ে তরল কিছুর স্পর্শ অনুভব করতেই রাদিফ সাহেব হু হু করে কেঁদে দিলেন। নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেন না তিনি। পারলেন না ছেলের চোখের জল দেখে আজ কঠোর থাকতে। একটা সময় ছেলের চোখের জল দেখেও কঠোর থেকেছিলেন। আজ শত চেষ্টা করেও, চেয়েও ছেলের জন্য মেয়েটা কে এনে দিতে পারছেন না তিনি। তিনি হাঁটু মুড়ে বসতেই নিবিড় এগিয়ে এল। আদ্রর কোনো হেলদোল নেই। একদম নির্জীব হয়ে আছে। আঁতকে উঠল নিবিড়। রাদিফ সাহেবের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠল-

“বাবা এক্ষুনি আদ্র কে হসপিটালে নিতে হবে৷ ওকে স্বাভাবিক লাগছে না। আমি আমরিন কে ফোন দিচ্ছি গাড়ি নিয়ে আসার জন্য। ”

রাদিফ সাহেব আদ্রর বাহু ঝাঁকাল। চোখ মুখ খিঁচে মূর্তির ন্যায় বসে আছে আদ্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল রাদিফ সাহেবের মনের ভিতর। ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
_____

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে সবাই। সায়েরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাগরের হাত টা ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে রিমি। মাঝ রাতে ও ঘুম নেই কারো চোখে। আদ্রর জন্য ছুটে এসেছে সবাই।পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পায়েল শাশুড়ির শত বাঁধার পরও ছুটে এসেছে অন্তু কে নিয়ে প্রাণের বন্ধুর জন্য। অন্তর হাত টা ধরে বুকে মাথা রেখে নীরবে কাঁদছে সে। কেন তুলি চলে গেল?কোথায় হারিয়ে গেল আদ্র কে এতো ভালোবেসে? থাকলে হয়তো আজ পরিস্থিতি টা অন্যরকম হতো। আমরিন দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুঁজে ফেলল। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল প্রকান্ড ঝড় উঠা সেই দিনটার কথা।


আমরিন কে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল আদ্র। শাড়ি বেজিয়ে পড়ে যেতে নিলে সামলে নিল নিবিড়। আমরিন হাপাঁতে হাপাঁতে আদ্রর হাতে একটা কাগজ দিল। সবাই আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আমরিনের দিকে। আদ্র কাগজ টা মেলে পড়তে শুরু করল।

❝ ক্ষমা করে দিবেন আদ্র। আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করাটা কোনোভাবেই সম্ভব না তাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। নতুন একটা জীবন শুরু করার অনুরোধ রইল নতুন কাউকে নিয়ে। ❞

লিখাগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল আদ্র। নিমিষেই মনে হল তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পুরো দুনিয়াটা হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে শীতল স্রোতের বদলে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কাগজ টা হাতের মুঠোয় নিয়ে পাগলের মত তুলির রুমে ছুটে আসল। ওয়াশরুম, বেলকনি পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে খুজেও তুলির কোনো অস্তিত্ব পেল না। হাঁটু গেড়ে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল আদ্র। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ধূলিসাৎ হয়ে গেল এতো বছরের জমানো সব স্বপ্ন। তুলি পালিয়ে গেছে এটা কোনোক্রমেই কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাই কে চিৎকার করতে দেখে কেঁদে দিল ইনশিতা, আমরিন। রিমি তো আজ আনন্দের অশ্রু দেখতে চেয়েছিল তবে আদ্রর চোখে কেন বিষাদের জল। হাসি-খুশি বিয়ে বাড়ি টা নীরবতায় ছেয়ে গেল। আহান-ঝুমু ও স্তম্ভিত। আচমকা আদ্র উঠে এসে সামিরার গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। মাটিতে ছিটকে পড়ল সামিরা। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল সে। রনক,ইনশিতা সহ সবাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ইনশিতা সামিরা কে তুলতেই আদ্র ইনশিতা কে সরিয়ে সামিরা কে টেনে সবার সামনে ছুড়ে ফেলল। রনক এগিয়ে আসতেই রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দমে গেল রনক। আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করল,

“সামিরা কি করেছে ভাই?”

আদ্রর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। সামিরার দিকে তাকিয়ে চিৎকার বলে উঠল-

” তুই কি ভেবেছিস তুলি কে সরিয়ে দিলে আমি তোকে বিয়ে করে নিব? কান খুলে শুনে রাখ। তুলি আমার বউ। কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে অনেক আগেই ওকে আমি নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে নিয়েছি। তোর সব চেষ্টা বৃথা। নাকি ম্যারিড ছেলে কে ও বিয়ে করতে চাস তুই? ”

আদ্রর কথা শুনে সবাই অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল এটা জেনে আদ্র আগেই বিয়ে করে নিয়েছে। রাদিফ সাহেব একটুও চমকালেন না। তিনি বিষয়টা জানতেন। সামিরা ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

” আমি তুলি কে কিছু করি নি আদ্র।”

রাগটা দ্বিগুণে পরিণত হল। হাটু গেঁড়ে হাতের ছুরি টা দিয়ে সামিরার হাতে আঁচড় কাটতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল সামিরা। রনক এগিয়ে এসে বোন কে আগলে নিল। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,

“পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি আদ্র ভাই? কি করছেন এসব?”

” হে,, হয়ে গিয়েছি আমি পাগল। তোর বোন কে বল আমার বউ কে বের করে দিতে নয়তো আজ ওর লাশ ফেলব এখানে। তুই জানিস তোর বোন কাল আমার শরবতে অ্যালকোহল মিশিয়ে আমার সাথে অবৈধ ভাবে মিলিত হওয়ার ফন্দি এঁটেছিল? আমাকে ও তুলি কে আলাদা করতে চেয়েছিল? কিন্তু সফল হয় নি। আমার তুলি ঠিক সামলে নিয়েছে। ও কখনও আমায় ছেড়ে যেতে পারে না। আমি ওর অস্তিত্বে মিশে আছি। আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। তোর বোন কে বল আমার তুলি কে ফিরিয়ে দিতে।”

বিষিয়ে উঠল রনকের মন টা। সেই সাথে বিমূর্ত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। রনক সামিরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“আদ্র ভাই যা বলছে সব সত্যি? ”

” হুম তবে আমি তুলি কে কিডন্যাপ করি নাই ভাইয়া। তুলি কোথায় আমি কিছুই জানি না।”

সাথে সাথেই সামিরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল রনক। একটা মেরে ক্ষান্ত হয় নি সে। পর পর আরো দু’টো থাপ্পড় বসিয়ে আদ্রর হাত ধরে বলল,

” আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাই। সামিরা হয়ত সত্যি বলছে। তুলি ভাবী কোথায় ও হয়ত জানে না।”

সামিরা নত মস্তকে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল-

” কাল আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল কিন্তু আমি সত্যি বলছি আমি তুলি কে কিছু করি নি। তুমি যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিব। কিন্তু তুলি কে এনে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ও কোথায় আমার জানা নেই। ”

কথা না বাড়িয়ে আদ্র বেড়িয়ে পড়ল তুলির খোঁজে। আহান,রনক,অন্তু, সাগর,নিবিড় সবাই মিলেও খোঁজে পেল না তুলি কে। আদ্র সোর্স ব্যবহার করে ও তুলির কোনো হদিস পেল না। তুলি বিহীন ধুধুর মরুভূমি পৃথিবী টা আদ্রর কাছে।পৃথিবীর সব রং যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে ধূসর কিংবা সাদাকালো তে। মেঘে ছেয়ে গেছে তারার মেলায় মুখরিত হয়ে থাকা আকাশ টা। ঘুম হারাম করে প্রতি টা দিন,প্রতিটি মুহুর্ত শান্তির খুঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। যেখানে প্রিয় মানুষ টা হারিয়ে গেলে ছেলেরা সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে সেখানে আদ্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মোনাজাতে তার তুলা কেই চেয়ে যাচ্ছে। সবার ভালোবাসার ধরন আলাদা। কেউ কেউ হারিয়ে অতি শোকে পাথর হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ পাহাড়সম যন্ত্রণা নিয়েও ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যায়। আদ্রর দুর্বলতা আদ্র কে গ্রাস করেই নিল। তুলি শুধু নিজে যায় নি নিয়ে গেছে আদ্রর বেঁচে থাকার অবলম্বন টুকু।
_______

ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই নিবিড় এগিয়ে গেল। ডাক্তার ইশতিয়াক চিন্তিত মুখে বললেন,

” কতবার বলেছি ড. আদ্র আহনাফ যেন কোনো স্ট্রেস না নেয়। ওনি আমার কথা একদমই শুনছেন না। ওনি একজন হার্ট সার্জন ওনার হার্ট সম্পর্কে বেটার ধারণা আছে তবুও কেন ওনি এমন করছে বুঝতে পারছি না। ওনি নিজেও জানেন এমন চলতে থাকলে এক সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা যেতে পারেন। ”

কথাটা বলেই সূক্ষ্ম একটা নিশ্বাস ছাড়লেন ড.ইশতিয়াক। সায়েরা বেগম সবটুকু শুনতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ওনার খুব অভিমান জমেছে তুলির প্রতি। এতো করে বলেও কিভাবে পারল মেয়েটা তার ছেলে কে ছেড়ে যেতে! নিবিড় করুন স্বরে বলল,

“আমরা ভিতরে যেতে পারি?”

“হুম আসুন।”

সায়েরা বেগমও রাদিফ সাহেব কে নিয়ে আমরিন ও নিবিড় কেবিনে গেল। সবাই কে দেখে মৃদু হাসল আদ্র। সায়েরা বেগমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

” সামান্য একটু বুকের বা পাশ টা ব্যাথা করছিল। তোমার পুত্রবধূ ফিরে আসলে ঠিক এটার উপশম হয়ে যাবে।”

আদ্রর হাত টা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন সায়েরা বেগম। ড.ইশতিয়াক কিছুটা সাহস জুগিয়ে বলে উঠলেন,

” আমার মনে হয় কি ওনি বেঁচে নেই। নয়তো এতো খোঁজার পরও কি আপনারা পেতেন না?”

ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল আদ্রর মস্তিষ্কে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে লাগল হৃদপিণ্ড। চোখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। আঁতকে উঠল নিবিড় ও আমরিন। আদ্র দাঁতে দাঁত চেপে আওয়াজ করে বলে উঠল-

” আমার বউ বেঁচে আছে। অভিমান করেছে হয়ত আমার উপর তাই লুকিয়ে থাকছে। আমি জানি আমি ওকে খুঁজে বের করে যখন অভিমান ভাঙাব তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠবে। আমার বুকে মাথা এলিয়ে বলবে –আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম ডাক্তার সাহেব।

#চলবে,,,,,,,,,,!

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here