আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৬+২৭

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২৬

“লেখক হিসেবে আপনার জীবন কাহিনি জানার খুব ইচ্ছে মিস শ্যামবর্ণা। আমার তো মনে হয় আপনার জীবন কাহিনি টা বেশ ইন্টারেস্টিং হবে এবং তা নিয়ে আমি সুন্দর এক উপন্যাস রচিত করতে পারব।”

পুরুষালি সাবলীল কন্ঠ শুনে মাথায় ওড়না টা ভালোভাবে টেনে নিল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা। তারপর সম্মুখে দূরত্ব রেখে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চাইল। ছেলেটার দিকে এক পলক চেয়ে বাহিরের পুকুরের পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,,

” আমি তুলি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসে আপনাদের সাথে দেখা হওয়া। আপনাদের এনজিও তে ছোট্ট একটা চাকরি পাওয়া দয়ার খাতিরে ব্যাস এতটুকুই আমার জীবন।”

মৃদু হাসল ছেলে টা। বাহিরে দৃষ্টি রেখে বিমূর্ত স্বরে বলল,

” আমি তো আপনার আঠারো বছরের জীবন কাহিনি জানতে চাইছি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসার কারণ,শুধু কি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে নাকি হবু বরও খারাপ ছিল?

হু হু করে কেঁদে উঠল তুলির মনটা। গলায় কঠোরতা রেখে তুলি জবাব দিল,

” উনার মতো ছেলে হয়তো আপনি লাখে একটাও খুঁজে পাবেন না। আর না কোনো মেয়ে আমার মতো ভালোবাসা পাবে।”

” তাহলে পালিয়ে কেন এলেন? যার এতোটা প্রশংসা করছেন এতোটা ভালোবাসেন তার কাছে কি একটা বার ও বলতে পারলেন না সবটা খুলে? তার কি জানার অধিকার ছিল না?”

” জানার চেয়ে ভালো থাকার অধিকার ছিল তার। তৎক্ষনাৎ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত তার মনটা। আমাকে কোনোক্রমেই ছাড়ত না তবে প্রতিটা মুহুর্তে মরণ যন্ত্রণা পেত। সময়ের স্রোতে একসময় তার জীবন টায় বরবাদ হয়ে যেত। যাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি তার এতো সুন্দর জীবনটা আমি কিভাবে নষ্ট করে দিতাম?”

“আপনার কি মনে হয় এখন আপনাকে ছাড়া ভালো আছে?”

দু’চোখ বুঁজে এল তুলির। প্রশ্ন টা হৃদয়পটে বিচরণ করতে লাগল। আঘাত করতে লাগল অনবরত। কে জানত তার আঠারো বছরের জীবনে এতকিছু ঘটে যাবে? যাকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও নিজেকে কল্পনা করতে পারত না, পাগলামি করত তাকে ছেড়ে চারটা মাস থাকতে হবে?

” ভালো নেই আমি ডাক্তার সাহেব। শরীরে বাসা বাধা অসুখের চেয়ে আমার মনের অসুখ টা প্রখর। প্রতিটা মুহুর্তে মরণ যন্ত্রণা অনুভব হয় আপনাকে ছাড়া। মাঝে মাঝে মনে হয় বিলীন হয়ে গেছে আমার ভিতরকার অস্তিত্ব। তবুও! তবুও আপনার দেওয়া ভালোবাসা নিয়ে বাধ্য হয়ে বেঁচে আছি আমি। জানিনা আর কতদিন অথবা কত মিনিট শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারব।”

মনের কথাগুলো মনে চেপে রেখেই তুলি দূর্বল গলায় বলে উঠল-

“ভালো নেই ওনি ও। তবে সময়ের ব্যবধানে এক সময় নতুন একটা জীবন তো শুরু করতে পারবেন। আচ্ছা রিম আপু আসবে না?”

ছেলেটা মুচকি হাসল। মাথা চুলকে বলল,

“আসবে। কিন্তু বুঝেনই তো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি তাই শশুড় আব্বা বড্ড ক্ষেপে আছে। আমার বউ টা কে বের হতেই দেয় না বাসা থেকে।”

তুলি আর কিছু বলল না। ছেলেটার নাম আরিয়ান। পেশায় একজন লেখক। ছোট্ট এই এনজিও টা সে ও তার গার্লফ্রেন্ড মিলে খুলেছে যে বর্তমানে তার জীবনসঙ্গিনী। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে কোনো দিকে যাওয়ার মতো নির্দিষ্ট স্থান ছিল না তুলির। উপায় না পেয়ে ট্রেন স্টেশন এসে যেই ট্রেন পায় তাতেই উঠে পড়ে। ট্রেনেই পরিচয় আরিয়ান ও রিম এর সাথে। জীবনের পুরোটা খুলে না বললেও রিম এর কাছে পালিয়ে আসার কারণ টা বলেছে। রিম অত্যাধিক মিশুক স্বভাবের একটা মেয়ে। নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তুলি কে কিন্তু তুলি যায় নি। তাই রিম তাদের এনজিও তেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এনজিও দেখার দায়িত্ব দিয়েছে সেই সাথে তুলির ভরনপোষণের দায়িত্ব ও নিয়েছে। আরিয়ান তুলি কে হাসানোর জন্য মাঝে মাঝে মিস. শ্যামবর্ণা নামে সম্বোধন করে।

“এই তুলি অসুস্থ শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মাথা ঘুরে পরে যাবি তো?”

আতঙ্কিত কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে রিম তাড়াহুড়ো করে তুলির কাছে এসে দাড়াল। হাত টা ধরে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে আরিয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চাইল। রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে উঠল-

” তুমি জানো না ও ভীষণ অসুস্থ? তবুও ওকে দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন হু? অসুস্থ একটা মেয়ের সাথেও নিজের কাব্যিক কথার ঝুলি খুলতে হবে তোমার?”

আরিয়ান কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুলি ধীর স্বরে বলল,

” কারো দোষ নেই আপু। আমার ভালো লাগছিল না তাই জানালার কাছে দাড়িয়েছিলাম। তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাদের কাছে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। আমানতও বলতে পারো।”

আরিয়ান ও রিম অবাক চোখে চেয়ে রইল। তুলি বালিশের নিচ থেকে খামে ভর্তি একটা চিঠি এগিয়ে দিল রিমের দিকে। হালকা হেসে বলল,

“চিঠি টা আমার ডাক্তার সাহেবের কাছে পৌঁছে দিও আপু। এখন না যখন সময় হবে।”

দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়ল রিম। চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠেছে তার। নিজের ফোনটা ও ব্যাগ থেকে একটা সিম বের করে ফোনে লাগিয়ে এগিয়ে দিল তুলির দিকে। আলতো হেসে বলল,

” তোর ডাক্তার সাহেব দু দিন আগে রাত দু’টোর দিকে এই নাম্বারে পাগলের মতো কল দিচ্ছিল। তাই উপায় না পেয়ে সিম টা খুলে ফেলি। এভাবে কতদিন ফোন দিয়ে কথা না বলে সেকেন্ডের জন্য ওনার বিষাদ মাখা কন্ঠ টা শুনবি? একটা বার কল দিয়ে কথা বল। এভাবে সবকিছু থেকে ওনাকে অজ্ঞাত রাখতে পারিস না তুলি। আমারই ওনার কন্ঠ শুনলে কষ্ট হয় তোর কি হৃদয় টা একটুও কেঁপে উঠে না?”

চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল তুলির দু চোখ থেকে। ক্ষত-বিক্ষত তো তার হৃদপিণ্ড চার মাস আগেই হয়ে গেছে এখন সেই ক্ষত যেন নতুন করে তাজা হয়েছে। নিজের মন কে বেঁধে রাখতে চেয়েও অক্ষম। এখনও ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে। আদ্র কে বুকে মাথা রেখে একটু শান্তি পেতে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

” আমার খুব কষ্ট হয় আপু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে কেউ যেন আমার আদ্র কে এনে দেয়। আমার নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় ওনাকে ছাড়া।”

” তুলা,,,,,!”

চেনা স্বর, অতি প্রিয় সেই ডাক কর্ণকুহর হতেই চমকে উঠল তুলি। প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল তার হৃদপিণ্ড। বিস্মিত চোখে একবার রিমের দিকে তাকিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে এল। ওই পাশ থেকে আদ্রর স্বর ভেসে আসছে কানে অনবরত। রিম কি তার সাথে বেইমানি করল? না সে তো ছোট বোনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এমন একটা পদক্ষেপ নিল। ভয়ে কল টা কেটে দিল তুলি। আদ্রর মুখে ফিরে পাওয়ার হাসি। নাম্বার টা থেকে গত পাঁচ দিনে তিনবার ফোন এসেছে। আদ্রর মনে কিছু টা সন্দেহ জেগেছিল এবং সে নাম্বার ট্রেস করে তার লোক দিয়ে খুঁজে বের করেছে রিম কে। আজই ফোনে রিমের সাথে কথা হয়েছে তার। রেডি হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরই হচ্ছিল তখনই ফোন টা বেজে উঠতেই নিজের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়ে গেল নিশ্চিতভাবে। অসুস্থ ছেলে কে তাড়াহুড়ায় বেড়িয়ে যেতে পিছু ডাকল সায়েরা বেগম কিন্তু আদ্র থামল না। গাড়িতে উঠতে উঠতে এতটুকু বলে গেল–“তোমার পুত্রবধূ নিয়েই ফিরব।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। রাদিফ সাহেব, নিবিড়, আমরিন কে ফোন দিতে লাগলেন।

আদ্র যতটা পারছে গাড়ি স্পিডে চালিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছাল। সন্দেহের ভিত্তিতেই সে টিকেট কনফার্ম করে রেখেছিল। তুলি চোখের জল ফেলতে ফেলতে রিমের দিকে চেয়ে বলল,

“এটা তুমি কি করলে আপু? তুমি ওনাকে চিন না এখনই ছুটে আসবে পাগলের মতো। কি করলে এটা? আমাকে এই অবস্থায় দেখলে সইতে পারবেন না ওনি।”

“এমনিতেই তো পাগল হয়ে যাচ্ছিল তোকে ছাড়া। আমি আর কোনো কথা শুনছি না তুলি। চার টা মাস দমিয়ে রেখেছিস আমাদের। এই চার মাসে আমরা তোর মায়ায় এভাবে জড়িয়ে গিয়েছি আর যেই মানুষ টা এতোগুলো বছর ধরে তোকে ভালোবাসে তার অবস্থা? চলেই তো যাবি তাকে এক পলক দেখে নাহয় বিদায় হ।”

কথাগুলো বলেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল রিম। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বুক ফেটে কান্না আসছে তার তুলির জন্য। তুলি মনে ভয় নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। তবে কি শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি হতেই হবে আদ্রর!
___________

সকাল পেরিয়ে বিকাল। বিকেল বললে ভুল হবে তাও শেষ হবার পথে। নীলচে আকাশে হালকা রক্তিম আভা ফুটে উঠছে। দুরুদুরু বুক নিয়ে তুলি বসে আছে। সত্যিই আদ্র আপনি আসবেন? আচ্ছা আমি কি জবাব দিব আপনাকে? কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি মনে তবুও কেন বার বার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে? আমি পারব তো আপনাকে সব বলতে? নাকি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার হয়ে এল তুলির। ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মাথার ঘোমটা টা ফেলে আয়নায় দৃষ্টি রাখল। নিজেকে দেখে নিজের কাছেই ভালো লাগছে না। সাথে সাথেই মাথা নত করে ফেলল। ঘাড়ে গরম নিশ্বাস পেতেই শরীরের প্রত্যেক টা রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জেগে উঠল। মনে আশঙ্কা নিয়ে আয়নায় চোখ রাখতেই বুক টা ধুক করে উঠল প্রচন্ড বেগে। দমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো সজীব হয়ে উঠল। চোখের পলকেই পিছু ঘুরে মানুষ টার বুকে আছড়ে পড়ল তুলি। আজ আর বাঁধা মানছে না কোনো অনুভূতি।চার মাসের দূরত্ব তিলে তিলে পুড়িয়েছে দু’টো হৃদপিণ্ড। আদ্রর বুকে খামচে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল তুলি। ভিজিয়ে দিতে লাগল আদ্রর ছাই রঙের শার্ট টা। নিজের শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তুলি কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র।একটুও বিলম্ব করলে এই বুঝি হারিয়ে যাবে তুলি। বুকের বা পাশের ব্যাথা টা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তবুও মন জুড়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। তার তুলা কে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু খেল। অস্থির স্বরে বলে উঠল-

” কেন চলে এলে তুলা? আমায় কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাচ্ছিলে? জানো আজ চেয়েও রাগ করতে পারছি না তোমার উপর। কিভাবে করব বলো? আজ যে আমি আমার অস্তিত্বের দেখা পেয়েছি। মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি। এই মেয়ে তুমি তো খুব ভালো করেই জানতা আমার জীবন টা তোমাকে কেন্দ্র করে তাহলে কিভাবে পারলে এতো নিষ্ঠুর হতে? সবসময় তো বলতা আদ্র আপনাকে আঁচলে বেধে রাখব,অন্য কারো হতে দিব না তাহলে তুমি কিভাবে নিশ্বাস নিতে পারলে আমাকে ছাড়া?”

তুলি নিশ্চুপ হয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে আদ্রর বুকে। আজও লেগে পড়েছে আদ্রর হৃৎস্পন্দন পরিমাপ করার চেষ্টায়। শান্তি অনুভব হচ্ছে তার। কতকাল এই বুকে মাথা রাখা হয় নি, এই শান্তি টুকুও পাওয়া হয় নি। গভীর ভাবে আদ্রর বুকের বা পাশে নিজের অধর ছোঁয়াল। আজও থমকে গেল আদ্র। হৃদপিণ্ডের উঠানামা হতে লাগল দ্রুত গতিতে। তুলির মুখটা বুক থেকে তুলতেই অন্তর টা নড়ে উঠল তার। তুলি তার ডাক্তার সাহেবের নীলাভ চোখের দিকে চেয়ে আলতো ঠোঁট প্রসারিত করল। গলা জরিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্রের পায়ের পাতায়। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আদ্র কোমর জরিয়ে উঁচু করে মুখ বরাবর তুলে ধরল। টুপ করে কপালে চুমু খেল তুলি।আদ্রর ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে কপালে কপাল ঠেকাল। শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল আদ্র। দু চোখ বন্ধ হয়ে আসল দু’জনের। অনুভব করতে লাগল সুখময় মুহুর্ত টা। চোখের পাতা ভিজিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জমে থাকা অশ্রু। দু’জনেই নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। নাকে নাক ঘষে আদ্র আবারও বলে উঠল,

“কাঁদছিস কেন? এতো মাস আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করিয়ে ক্ষান্ত হস নি তুই?এখন কেন আবার কেঁদে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিস? ”

” আপনি কেন কাঁদছেন আদ্র? নীল বর্ণের চোখে কান্না বেমানান। নিজের এমন হাল করেছেন কেন?সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে জাগছিল বুঝি?ডাক্তার রা কিন্তু সন্ন্যাসী হয় না।”–কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল তুলি।

“খুন করে যদি বলো মরে গেছি কেন তাহলে এ প্রশ্নের জবাব আমি কোনো কালেও দিতে পারব না তুলা।”

আদ্রর কথা শুনে তুলি আরো জোরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ ধরে গুছিয়ে নেওয়া সব কথা এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও কোনোমতে কান্নার মাত্রা কমিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠল-

” আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই আদ্র।”

আদ্র চোখ মেলে তুলির জলে টুইটুম্বুর ডাগরডাগর আঁখিদ্বয়ে দৃষ্টি রাখল। বজ্রপাতের ন্যায় ছলকে উঠল সারা দেহ। তুলির চোখ গুলো একদম ড্যাবে গেছে। কালো হয়ে গেছে চোখের নিচ। আগের চেয়েও অনেক শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। তার নিকট মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজায় ছুরি গাঁথছে।করুণ স্বরে বলল,

“বলো।”

” আদ্র আমি আপনাকে,,!”

এক পা পিছিয়ে গেল আদ্র। চোখের পলকেই থমকে গেল তার দুনিয়া। তুলি তার কথা সমাপ্ত করার আগেই ঢলে পড়ল প্রিয় মানুষ টার বুকে। চিৎকার করে আদ্র তুলি কে ডাকতে লাগল। পালস চেক করে কোলে তুলে নিল তাড়াতাড়ি করে। আরিয়ান,রিম দৌড়ে আসল রুমে। তুলির অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল দু’জন। আরিয়ানের হাত টা ধরে কাঁদতে লাগল রিম। আদ্র গাড়িতে উঠে ড্রাইভার কে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। তুলির মাথা বুকে চেপে ধরে চোখ মুখ খিঁচে রইল। বর্ষণ থেমে নেই। অশ্রু গুলো বর্ষণের ন্যায় অবাধে গড়িয়ে পড়ছে। হারানোর তিক্ত যন্ত্রণার ভয় আবারও মনে চেপে বসেছে। আদ্র বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

” এবার উদাও হলে আমার শ্বাস টুকু কেড়ে নিও তুলা।”
_________

“শরীরে এতবড় রোগের বাসা বাঁধিয়ে ওনি এতটা হেয়ালি পনা কিভাবে করলেন এটা ভেবে আমি সত্যিই প্রচন্ড অবাক হচ্ছি আদ্র। আমি জানি তোমার মানতে কষ্ট হবে তবুও বলতে হচ্ছে পেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল।”

থ মেরে দাড়িয়ে রইল আদ্র। চোখে কোনো জল নেই। পকেটে থাকা মোবাইল টা বেজে উঠছে বার বার। হয়তো আমরিন, পায়েল ওরা ফোন দিচ্ছে। চট্টগ্রাম এসে এনজিও তে পৌঁছার আগে ফোন করে বলেছিল তুলির খোঁজ পেয়েছে। কথাটা শুনা মাত্রই সবাই রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। হয়তো পথিমধ্যে আছে। ডাক্তারের সাথে কোনো কথা না বলে বারণ সত্বেও আদ্র দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল আইসিইউ রুমে। সাথে সাথেই তার শরীরের প্রত্যেক টা লোম খাঁড়া হয়ে গেল। আইসিইউ রুমে কতশত রোগীর চিকিৎসা করেছে সে কখনও তো এমন ভয় লাগে নি। কখনও তো কেঁপে উঠে নি অন্তর। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো তুলির ঘুমন্ত মুখ টা দেখে আজ কেন তার কোনো মুগ্ধতা কাজ করছে না? হাঁটতে পারছে না আদ্র। থেমে যাচ্ছে পা। বহু কষ্টে সামনের দিকে এগিয়ে নিল নিজের পা দুটো। কাঁপা কাঁপা হাতে টুল টা টেনে বসে তুলির এক হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিল। তিনঘন্টা ধরে ঘুমোচ্ছে মেয়ে টা। আদ্রর হার্টের ব্যাথা টা ক্রমশ বেড়েই চলছে। পেয়েও কেন হারিয়ে ফেলছে সে তার তুলা কে? প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর কেন হল তাদের প্রতি?এখনও যে দু’জনের অনেক কিছু বলা বাকি। অনেক স্বপ্ন পূরণ করা বাকি।তার মনটা যে অসীম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে তুলির মুখে অদ্ভুত, উদ্ভট কথাগুলো শুনার। এই বুঝি গায়ে নীল শাড়ি জড়িয়ে সামনে দাড়িয়ে বলবে-“আদ্র আপনি শুধু আমার।” মাথা নত করে কপাল ঠেকাল আদ্র তুলির আঁকড়ে ধরে রাখা হাতে। নড়ে উঠল তুলি। হাত টা ছাড়িয়ে নিল আদ্রর কাছ থেকে। অক্সিজেন মাস্ক টা খুলে নরম স্বরে বহু কষ্টে বলল,

“কাঁদছেন কেন আপনি? একটু হাসবেন প্লিজ?”

তুলির কথা শুনে আদ্রর মাথায় রাগ চেপে বসল। আবার ঠোঁটে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। কিভাবে পারে এমন পরিস্থিতিতে এসেও একটা মেয়ে এমন উদ্ভট কথা বলতে? আদ্রর ঠোঁটের কোণে অজান্তে ফুটে উঠা হাসি দেখে এক রাশ মুগ্ধতা, এক রাশ শান্তি জড়ো হল তুলির মনে। হঠাৎই হুঁশ আসল আদ্রর। অক্সিজেন মাস্ক টা লাগিয়ে দিতে নিলে তুলি বাঁধা দিয়ে আদ্রর হাত টা শক্ত করে ধরল। মিনমিন স্বরে বলে উঠল-

” আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া আমার নিষেধ। আব্বু,আম্মু,আমরিন,ইনশিতা আপু, অন্তু ভাইয়া, আহান ভাইয়া সবাই কে বলবেন আমায় ক্ষমা করে দিতে। সবাই কে এক নজর দেখার খুব ইচ্ছে করছে আদ্র। ততটুকু সময় পাবো তো আমি?”

তুলির কপালে, গালে অজস্র চুমু খেল আদ্র। এ কেমন যন্ত্রণা? এ কেমন প্রহর? বাঁচবে না সে এক মুহুর্ত ও এই মেয়েটা কে ছাড়া। আদ্রর রক্তিম চোখের জল ভীষণ ভাবে পুড়াচ্ছে তুলির ছোট্ট মনটা কে। আদ্রর গালে হাত রেখে কান্নামিশ্রিত দূর্বল কন্ঠে বলে উঠল-

“আমি আপনার সাথে একটা সংসার গড়তে চাই আদ্র। বাঁচতে চাই আমি।”

গালে রাখা হাত টা টেনে তালুতে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল আদ্র। ধরা গলায় উচ্চারিত হল,

” তুই আমার সাথে বেইমানি করেছিস তুলা।”

তুলির চোখে জল,ঠোঁটে হেরে যাওয়ার হাসি। শিথিল হয়ে আসল হাতের ভাঁজে নিবদ্ধ,,,,
#আকাশে_তারার_মেলা ✨
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২৭

এই তুই হাত ছাড়ছিস কেন? চোখ বুঁজবি না একদম।দেখ চারটা মাস ধরে অনেক নাটক করেছিস। আমার কিন্তু এবার সহ্যশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। এক হাত লাগিয়ে দিব গালে।তুলি তুই ভালো করেই জানিস রাগ উঠলে কেউ তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। শক্ত কর নিজেকে। এখনও তোর আমার থেকে রেহাই পাওয়ার সময় আসে নি।

তুলির শিথিল হয়ে যাওয়া হাত টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো প্রলাপ করতে লাগল আদ্র। এই বুঝি তার নিশ্বাস আঁটকে যাবে। তুলির দু চোখ বুঁজে যাওয়া যেন তার মস্তিষ্কে হারানোর ভয় জাগিয়ে দিল পুনরায়। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ল। আদ্রর চিৎকার বাহির থেকে আরিয়ান ও রিম শুনতে পেয়ে দৌড়ে এল। আদ্র কে অস্থির অবস্থায় দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল দু’জন। তুলির শ্বাস চলছে কিন্তু রেসপন্স করতে পারছে না। রিম আরিয়ান কে ইশারা করল আদ্র কে সামলাতে। নিজে দৌড়ে চলে এল ডাক্তার ডাকতে। আরিয়ান আদ্র কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরে তুলির কাছ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ। আদ্রর সুঠাম দেহের শক্তির তুলনায় তার শক্তি নগন্য। ডাক্তার দৌড়ে আসলেন কেবিনে। আদ্র কে অনেক চেষ্টা করে ও সরাতে পারল না।ঠাই বসে রইল তুলির হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে। ডাক্তার তুলি কে চেকআপ করে আরেকটা টুল টেনে আদ্রর পাশে বসল। আদ্র তখনও তুলির মলিন, নির্জীব শ্যামলা চেহারার দিকে তাকিয়ে। ডাক্তার মিনহাজ আদ্রর বাহুতে হাত রাখতেই আদ্র ওনার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল।

“দেখুন না ডা. মিনহাজ আমার ওয়াইফ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করুন ওকে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছি। শুধু! শুধু তিন বার থাপ্পড় মেরেছি রাগের মাথায়। তাছাড়া চুল পরিমাণ ক্ষতিও আমি ওর হতে দেই নি। তবুও কেন ওর এতো বড় অসুখ হল? থাপ্পড় মারলে কি এত বড় অসুখ হয় ডক্টর?”

ধরফর করে উঠল ডক্টর মিনহাজের বুকটা আদ্রর কাতর স্বরে পাগলাটে কথা শুনে। একজন ডাক্তার হয়ে আদ্র এতোটা জ্ঞান শূন্য কিভাবে হয়ে পড়ল? তিনি যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। কতবার এই ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। এই ছেলের প্রশংসা শুনেছে কত ডাক্তারদের কাছে। অথচ আজ যেন সম্পূর্ণ বিপরীত একটা মানুষ দেখছেন ওনি। আসলে পৃথিবীতে কিছু কঠোর মানুষ সর্বদাই ভালোবাসার কাঙাল হয়। কঠিন মন গলে তরলে পরিণত হয় ভালোবাসা নামক অসীম অনুভূতির নিকট। আদ্রই যেন ওনার কাছে জলজ্যান্ত প্রমাণ। নিস্তেজ হয়ে চোখ বুঁজে থাকা তুলির দিকে চেয়ে বুকটা হাহাকার করে উঠল ওনার। মনে পড়ে গেল নিজের স্ত্রীর কথা। আদ্রর মতো পাগল না হলেও ভিতরে ভিতরে পুড়েছেন ওনি স্ত্রীর মৃত্যুতে। বিয়ের একবছর পর এক্সিডেন্টে নিজ অর্ধাঙ্গিনী কে হারিয়ে তিনি একাই কাটিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবনের এতগুলো বছর। সাথে সজীব রেখেছেন ভালোবাসার স্মৃতি গুলো। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকে না। প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে সময়ের প্রবাহে কাটিয়ে দেয় মায়া। কিন্তু আদ্র? আদ্র কি পারবে হারিয়ে সময়ের স্রোতে নিজেকে সামলে নিতে? হঠাৎ ড. মিনহাজের মনে ধ্বনিত হলো পারবে না ছেলেটা। মরে যাবে। হতাশার একটা নিশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মনে আশার আলো জাগিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য। একটু আগেই জুনিয়র চিকিৎসকের ফোন পেয়ে ছুটে এসেছেন। কেবিন থেকে বের হতে হতে উচ্চারণ করলেন ” আকস্মিক মৃত্যু আসলে কিছুই করার থাকে না হাতে তবে মৃত্যুপথযাত্রী কে আল্লাহ চাইলে সুস্থ করে দিতে পারেন। শুধু প্রয়োজন আল্লাহর রহমত এবং ওনার উপর ভরসা রেখে সঠিক চিকিৎসা চালানো।”

আরিয়ান,রিমি আদ্রের দিকে চেয়ে আছে এক পলকে। অনুশোচনায় ভুগছে দু’জন। তুলির চেয়ে ও বেশি কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওদের আদ্রর জন্য। সব জেনেও ওরা কি একটা বার আদ্র কে খুঁজে বের করতে পারত না? চেষ্টা টা আগে করলে হয়তো চার টা মাস ধুঁকে ধুঁকে মরত না আদ্র ও তুলি। আজ রিমের মনে হচ্ছে তুলি ভুল ছিল। ভুল ছিল তার সিদ্ধান্ত। উপস্থিত বুদ্ধি টুকুও হয়তো তুলির নেই। নয়তো কি আদ্রর মতো মানুষ কে ছেড়ে আসতে পারে? ভালোবাসা কখনও ঘৃণায় পরিণত হয় না এটাও কি তুলি বুঝতে সক্ষম হয় নি? অথচ আজ সময় হারিয়ে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছে তার। আদ্রর ভিতরটা অগ্নি বলয়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। তুলির হাতের ভাজে অনবরত ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে চলেছে। তার তো এতটুকু ও হদিস নেই রুমে সে ছাড়াও আরো দু’জন মানুষের অস্তিত্ব আছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এল রিমের। আরিয়ানের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মনের সুপ্ত কোণে গেঁথে নিল কিছু বাক্য। “আমি কখনও তুলির মতো ভুল করব না আরিয়ান। যদি কখনও বিরাট অসুখে ভুগি তখনও প্রতিটি সেকেন্ড তোমার কাছেই থাকব। কখনও তোমার সান্নিধ্য ত্যাগ করব না শেষ নিঃশ্বাস অব্দি।

ডাক্তার মিনহাজ তুলির রিপোর্ট গুলো ভালো করে চেক করলেন। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে আদ্রর কাছে আসল। আদ্রর দৃষ্টি নিবদ্ধ তুলির চেহারায়। চোখের পলক ও ফেলছে না সে। মনে পড়ে গেল সেই ছোট্ট তুলির কথা। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ডাক্তার মিনহাজ আদ্রর পাশে বসে বলে উঠলেন,

” মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে হবে আদ্র। তুমি পাগলামি করলে বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটা ভেঙে পড়বে। আশা করি এজ অ্যা ডক্টর তুমি একজন রোগীর জন্য হলেও ভাববে নয়তো স্বামী হিসেবে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর জন্য। ”

চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত করে নিল আদ্র। অস্থির নয়নে ফুটে উঠল আশার প্রদীপ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া স্বরে বলল,

” ভবিষ্যতে কি হবে বা বর্তমানে কি ঘটবে আমি জানিনা ডাক্তার। তবে এতটুকুই জানি আমার নিশ্বাস মিশে গেছে এই মেয়েটার সাথে। এই মেয়েটার শ্বাস প্রশ্বাস চলা মানেই আমার অস্তিত্ব টিকে আছে। আমি একবার ও বলব না আমার তুলি কে বাঁচিয়ে দিন।শুধু এতটুকুই বলব আমার অস্তিত্ব টা বিলীন হতে রক্ষা করুন।”

বিস্মিত না হয়ে পারল না রুমে উপস্থিত মানুষ গুলো। কি নাম দেওয়া যায় এমন ভালোবাসা কে? এতো আকুতি, এতো কাতরতা! রিমের কাছে তুলি কে অভাগিনী মনে হচ্ছে। যাদের জীবনে ভালোবাসা এলেও সেটা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না। সারাজীবনই প্রাপ্তির খাতা থাকে শূন্য। ডাক্তার মিনহাজ নিজের কাঠ পুড়া অধরযুগল ভিজিয়ে রিপোর্ট গুলো এগিয়ে দিল আদ্রর দিকে।

এম-৩ বা এপিএল নামক ব্ল্যাড ক্যান্সার সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে আশা করি। একিউট মায়েলোব্লাসটিক লিউকেমিয়া মূলত আট প্রকারের। যেমনঃ এম- ০,১,২,৩,৪,৫,৬,৭। এ এমএল এম -২ ও ৪ কে শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ৪ মাস চিকিৎসা করলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর এম-৩ বা এপিএল নামক ব্ল্যাড ক্যান্সার কে পর্যায় বুঝে শুধু ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ছয় মাস থেকে দুই বছর চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশের বেশি। তবে এটা পর্যায় বুঝে শুরু থেকেই ট্রিটমেন্ট চালালেই আর আল্লাহ চাইলেই সুস্থ হওয়া পসিবল। অবশ্যই বুঝতে পারছো তোমার ওয়াইফ কোন ধরনের ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। তবে,,

আদ্র তীর্থের কাকের মতো চেয়ে ডাক্তার মিনহাজের দিকে। কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছে যার ফলে শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। রুহু টা আর্তনাদ করে উঠছে বার বার। তুলি কে নিজের বুকে ঢুকিয়ে রাখতে পারলেই বুঝি তার হৃদপিণ্ড শীতল হতো। অথবা তুলির সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেই তার শান্তি মিলবে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু তছনছ করে দিল। এতোটা মাস কাছে থাকলে হয়তো আদ্র কিছু করতে পারত। সুস্থ করে তুলতে পারত। এখনও যে পারবে না এমন তো না। পারবে সে দিন রাত এক করে তুলি কে সুস্থ করে তুলবে। প্রতিবারের মতো তুলি কে ভিক্ষা চাইবে আল্লাহর কাছে। ব্লাড ক্যান্সার শব্দ টা শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠে। হাল ছেড়ে দেয়। ভয় গ্রাস করে দুর্বল করে দেয় মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা। চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দেয়। যেমনটা করেছে তুলি। অথচ ভয় না পেয়ে শুরু থেকেই নিজেকে শক্ত করে ট্রিটমেন্ট চালিয়ে গেলে সুস্থ হয়ে উঠা যায়। জীবন -মরণ সেটা তো আল্লাহর হাতে। ডাক্তার কয়েক মাস বাঁচবে বলে ধারণা করলেও দেখা যায় কিছু মানুষ বছরের পর বছর ক্যান্সার নিয়ে বেঁচে আছে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর রহমতে ও চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।

“তোমার ওয়াইফের শুরু থেকেই ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা চলছিল। আমাদের হাতে এখনও সুযোগ আছে আদ্র। আল্লাহর অশেষ কৃপায় ও সঠিক সময় চিকিৎসা শুরু করে দেওয়ায় এতোদিন টিকে আছে মেয়েটা নয়তো বুঝোই তো। এটা মিরাক্কেল ও বলতে পারো তবুও একটা সুযোগ আল্লাহ তোমায় দিয়েছেন। আর দেরি করা ঠিক হবে না। নেমে পড়ো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। ”

আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কৃতজ্ঞতার চোখে আরিয়ান ও রিমের দিকে চাইল। আরিয়ান আর রিম জানার পর থেমে থাকে নি। তুলির অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও চিকিৎসা চালাতে হয়েছে ওদের জোরে। ওরা জানে না এটা কতটুকু কাজে লাগবে তবে মন প্রাণে চাই তুলি বেঁচে থাকুক অনেকগুলো বছর তার ডাক্তার সাহেবের জন্য। এক মিনিট হোক আর এক সেকেন্ড তুলির সমাপ্তি যেন তার ডাক্তার সাহেব কে ঘিরেই হয়। আদ্র উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার মিনহাজের সাথে আলোচনা করে তুলি কে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগল। ওইখানে গিয়ে সাময়িক ট্রিটমেন্টের পর সব কাগজপত্র রেডি করে পাড়ি জমাবে বিদেশ। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে সে। ব্যর্থ হলে নিজেও হারিয়ে যাবে তুলির সাথে। তুলি বিহীন আর একটা মুহুর্ত ও সে চায় না । করিডোর দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের বাবা -মা, বোন, বন্ধুমহল কে এগিয়ে আসতে দেখল। কে বলবে এগুলো আদ্রর বন্ধুমহল? তুলি শুধু আদ্রর জীবনে নয় নিজের মায়া দিয়ে গেঁথে গেছে সবার হৃদয়ে। চক্ষুজোড়া লাল রঙে ছেয়ে আছে আদ্রর। ছেলের বিধস্ত অবস্থা দেখে সায়েরা বেগম ছেলে কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলেন। ছেলের অবস্থাই ওনাকে জানান দিচ্ছে তুলি ঠিক কেমন অবস্থায় আছে! এতো সুখময় মুহুর্তের কেন অবসান ঘটল? সব তো ঠিক থাকতে পারত। কেন এতো ছোট্ট বয়সে ক্যান্সার নামক ব্যাধির সাথে লড়তে হচ্ছে মেয়েটার? লড়াইয়ে জিতে যাবে নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে চিরতরে?
__________

তুলির ঠোঁটে লজ্জালু হাসি। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ। হৃদয়ের গহীনে শীতলতার বিস্তার। গলায় আদ্রর ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই একটা হার্ট বিট মিস করল। বুঁজে থাকা চোখ দুটো মেলে এক পলক চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র তুলির গলায় মুখ গুঁজে চোখ বুঁজে শুয়ে রইল। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। এই দশটা দিন একটুও থেমে থাকে নি। তুলির পাসপোর্ট, ভিসা রেডি করতে একটু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ঘুম ও হারাম হয়ে গেছে। নির্ঘুম কাটানো প্রতিটা রাত ও তাকে বড্ড শান্তি দেয়। কারণ রাত জেগে তো সে তার তুলার সেবা করতে পারে,ঘুমন্ত মুখটা অবলোকন করতে পারে। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া বুকে এতটুকুই যেন এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির ন্যায় ঝরে পড়ল। স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিল আদ্রর বিষাদে ছেয়ে থাকা মন। তুলি নড়ে উঠল। এতো মাস পর প্রিয় মানুষ টার এতো কাছে আসাটা তুলির হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক করে তুলছে। হসপিটালে থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল তুলি। কিছুটা সুস্থ হতেই আদ্র কে আকুতি মিনতি করে বাসায় চলে এল তিনদিন হয়েছে। আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। ” আমাকে ক্যান্সার নামক ব্যাধি এতোটা গ্রাস করতে পারে নি আদ্র যতটা আপনার অনুপস্থিতি গ্রাস করেছে আমায়। আমি প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় সিক্ত হতাম আপনাকে ছাড়া। আপনিই আমার ভালো থাকার উপশম। অথচ বিয়ের দিন কতটা বোকামি করেছি। আমাদের জীবনের চার টা মাস কে নরকে পরিণত করেছি। আসলেই আমি আহাম্মক!” কথাগুলো ভেবেই একটু হাসল তুলি। আদ্রর চুলে হাত দিতেই মাথা তুলে তুলির মুখ বরাবর চাহনি নিক্ষেপ করল। দু’জনের মাঝে কিঞ্চিত দূরত্ব। তুলির বলতে ইচ্ছে করছে ” আপনাকে ঠকানোর শাস্তি সরূপ সবটুকু দূরত্ব ঘুচিয়ে নেন আদ্র।”

তুলির গোলাপি মসৃণ ঠোঁটে ঠোঁট রাখল আদ্র। এক হাত দিয়ে আদ্রর ঘাড় খামচে ধরল। ডুবে গেল আদ্রর নীলাভ চোখের মাদকতায়। চোখের পলকেই ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্র। তুলি কে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর উপায় নেই। নিজের পায়ে হাঁটার মতো শক্তি আর তুলি পায় না। একটু তেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পা ফুলে গেছে। সারা শরীরে থেকে থেকে ব্যাথা। তবুও মেয়েটার মুখে ম্লান হাসির ঝিলিক। আদ্র কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে পা বাড়াতে নিলে তুলি হালকা হেসে দুর্বল স্বরে বলে উঠল-

” এখন কি আর সিগারেট খান না? অন্য সময় তো আপনার মুখ থেকে সিগারেটের সুবাস আসত।”

বাঁকা হাসল আদ্র। ঝটপট হাতের কাপড়গুলো সোফায় ফেলে কাছে এসে ঝুঁকে পড়ল তুলির মুখের দিকে। ঠোঁট প্রসারিত করে–” সিগারেট খাওয়ার নেশার চেয়ে আমার তুলার প্রতি মারাত্মক নেশা। এখন যখন তুলা-ই আমার বুকে তখন সিগারেটের নেশা ও ফিকে। তাই ছেড়ে দিয়েছি।”

আদ্রর এমন লাগামহীন বেহায়া কথা শুনে তুলি ঢোক গিলল। ঠোঁট কামড়ে মুখ টা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। চোখে মুখে ছুঁয়ে যাচ্ছে আদ্রর গরম নিশ্বাসের উত্তাপ। বুক টা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আদ্র সরে যেতে নিলে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল-

” আমরা তিন কবুল বলব না আদ্র?”

থ মেরে তুলির দিকে চেয়ে রইল আদ্র। তুলির সারা মুখ জুড়ে লজ্জার রেখা প্রতিফলিত যা আদ্র কে ঘোরে নিমজ্জিত করে ফেলল। নেশামিশ্রিত স্বরে জবাব দিল,

” তোমার ট্রিটমেন্ট শেষ হলেই আমরা নতুন ভাবে আবার সব সাজাব।”

” উঁহু! কালকেই কি লাল বেনারসি পড়ে আমি আপনার বধূ হতে পারি?”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। গল্পটা আজ শেষ করতে পারলাম না। তবে পরবর্তীতে সমাপ্তি পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করব।)
#চলবে,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here