আগন্তুক🍁
ষষ্ঠ পর্ব
মিহি
আজমিরা বেগমের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ইরহাম সাহেবকে জানানো হয়েছে কিন্তু তিনি তার অফিসে নেই। ইরহাম সাহেব যেন নিরুদ্দেশ। অফিসের নাম করে কোথায় গেছেন তিনিই জানেন। এদিকে শুভ্র তো আগে থেকেই নিরুদ্দেশ। আজমিরা বেগমকে পড়ে থাকতে দেখে কাজের মেয়েটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে। আজমিরা বেগমের পরিবারে একমাত্র দুঃসম্পর্কের বোনের মেয়ে আছে,রজনী নাম। প্রথম স্বামী ফেলে যাওয়ার পর আর ঘর বাঁধেনি সে। বাবার কিছু টাকা ছিল আর এক বিরাট বাড়ি। সে বাড়ি ভাড়া দিয়ে যা টাকা আসে,তাতেই তার ভালোমতো খাওয়া হয়ে যায়। রজনী খালা আজমিরার অসুখে দেখতে এসেছে। সে-ই কল করল ইরহাম সাহেবের অফিসে। কল করে জানতে পারল ইরহাম সাহেব দুমাস আগেই রিটায়ার করে পেনশনের টাকা নিয়ে চলে গেছেন। কথাটা আজমিরা বেগমকে কিছুতেই বলার সাহস পাচ্ছে না রজনী। আজমিরা বেগম কাঁতরাচ্ছেন। বুকের ব্যথায় নাকি মনের দুঃখে উপলব্ধি করতে পারল না রজনী। চুপচাপ আজমিরা বেগমের মাথার কাছে বসে থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে। আজমিরার গলা থেকে কেবল শুভ্রর নামটাই উচ্চারিত হচ্ছে। রজনীর কৌতূহল সৃষ্টি হয় শুভ্র ছেলেটার প্রতি। “শুভ্র” হূমায়ন আহমেদের গল্প পড়ত রজনী। ষোলোর পরপরই বিয়ে হয়ে গেলে আর রজনীর গল্প পড়া হয়ে ওঠে না। এখন বয়স চলছে কুড়ি। মুখের সৌন্দর্য আর শরীরের যৌবন সবই আকর্ষণীয় আছে আগের মতোই তবে আগের স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারল না মেয়েটা। হয়তো স্বামীর মনের মতো উপভোগ্য হতে পারেনি রজনী। এই সমাজের তথাকথিত পুরুষগুলো মেয়েদের ভোগের বস্তু ব্যতীত কিছু মনে করে না। তাদের সাপেক্ষে মেয়ে মানেই চাহিদা পূরণের বস্তু। সে যদি যথাযথভাবে চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয় তবেই সে লক্ষী,গুণবতী,স্বামীকে ভালোবেসে বেঁধে রাখতে শিখেছে। এটা কি আদৌ ভালোবাসায় বেঁধে রাখা নাকি শরীর বিলিয়ে বেঁধে রাখা? রজনীও চেয়েছিল একটা সংসার,ভালোবাসার সংসার। যে সংসারে স্বামী তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে,স্বামীর ঘর্মাক্ত মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে দিবে রজনী। রাত হলে পূর্ণিমা চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করবে দুজন,কাঁধে মাথা রেখে,হাতে হাত রেখে অথচ সেটা অপূর্ণই রয়ে গেল চিরকালের জন্য। অপূর্ণ স্বপ্নগুলো বড্ড যন্ত্রণা দেয় রজনীকে। আগে প্রচোর কষ্ট হত যখন তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বাড়িতে রেখে যায়। রজনী বাপের বাড়ি চলে আসার পরদিনই দুঃখে-কষ্টে বুকের ব্যথায় বাবা পরপারে চলে যান। মাও ক’টা দিন রজনীকে সান্ত্বনা দিতে দিতে একটা সময় রজনীকে ফেলে পাড়ি জমালেন পরপারে। একা হয়ে গেল রজনী। উপরতলার ছোট্ট ঘরটা ভাড়া দিল। ভাড়াটের পিচ্চি মেয়েটার সাথে দিব্বি সময় কেটে যেত। বিষাদমাখা অতীতকে পেছনে ফেলে রেখে দিব্বি ভালো আছে রজনী। নার্স এসে বলে গেছে রোগীকে খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে আর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। রজনী পড়ল মহাবিপদে। খালা ঘুমাচ্ছে। বাড়ি ফিরে যদি খালা খালোর সাথে দেখা করতে চায়? কি বলবে রজনী? স্বামী পেনশনের টাকা নিয়ে কোথাও চলে গেছে,এটা কি সহ্য করতে পারবেন খালা?
আদৃতের হাত আঁকড়ে ধরেছে আদিরা যেন বিশ্বস্ত একজন বন্ধুকে ছেড়ে যাওয়ার ভীতি কাজ করছে তার মনে। শুভ্রর চোখে জল। আদৃত আদিরার হাত ছেড়ে দেয়। আদিরা চলে যেতে উদ্যত হয়। শুভ্র আদিরাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় আদৃতের বাড়ি থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আদিরার চলে যাওয়া দেখতে ব্যস্ত আদৃত। যতক্ষণ আদিরার ছায়া অবধি দৃশ্যমান ছিল ততক্ষণ আদৃত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আদিরাকে পর্যবক্ষেণ করেছে। আদৃতের মনে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তো শুভ্রর মনে কাছে পেয়েও দূরে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা।
সময় ০৪ টা বেজে সাত মিনিট। ভোর বলা চলে। বাসের জানালার পাশের সীটটাতে হেলান দিয়ে বসা আদিরা। শুভ্রের জার্নিতে খুবই প্রবলেম হয় তা জানাই আছে আদিরার কিন্তু আজ শুভ্রর যেন কিছুই হলো না। রক্তিম চোখ নিয়ে চুপচাপ ট্রাভেল করছিল সে। এখন আদিরার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে শুভ্র। আদিরা চাইলেই পারে শুভ্রকে সরিয়ে দিতে কিন্তু আজ কেন যেন এইমুহূর্তে সেও দুর্বল হয়ে পড়েছে শুভ্রর প্রতি। শুভ্রর হাত আদিরার কোলের উপর রাখা। আদিরা শুভ্রর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়, বাচ্চাদের মতো করে শুভ্রর দুহাতে চুমু খায়। নড়ে ওঠে শুভ্র। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয় আদিরা। চোখ ভিজে ওঠে তার। আজও সে শুভ্রর প্রতি দুর্বল কিন্তু পারছে না শুভ্রর কাছে ফিরে যেতে। নিয়তির এমন দোটানায় তাকে না ফেললে কি এমন ক্ষতি হত?
–আবিদ কোথায় তুমি? গতকাল থেকে আমি হোটেলে একা। ডিভোর্স পেপার কোর্টে সাবমিট করতে হবে। কই তুমি?
–আমি কাজে ব্যস্ত।
–কি কাজে? আমি তোমার অফিসে কল দিয়েছিলাম,তুমি অফিসে যাওনি।
–অফিসের কাজেই বাইরে আসছি।
–আমাকে এতটা বোকা ভাবো তুমি? অফিসের কাজে বাইরে গেলে তোমার অফিসের বসও জানত না?
— তুমি সন্দেহ করছো আমায়?
–সন্দেহটা ভুল হলেই ভালো আবিদ। আমি আগামী একঘণ্টার মধ্যে তোমাকে বাড়িতে দেখতে চাই।
–অর্ডার করছো?
–ইনসিস্ট।
অপরপাশ থেকে কল কেটে ল্যান্ডলাইন ফোনটা রেখে দেয় তন্বী। আবিদ উঠে বসে।তানিয়া মেয়েটা এখনো বিছানায়,আবিদের ন’নম্বর গার্লফ্রেন্ড। ভেবেছিল তন্বীর পর অন্য কারো সাথে রিলেশনে যাবে কিন্তু তন্বী মেয়েটা তো বিয়ে অবধি পৌঁছে গেল। পরপুরুষের জন্য স্বামীকে ছেড়ে আসা মেয়ে! তাকে নাকি বিয়ের আগে ছোঁয়া বারণ! নষ্টামি করে আবার সতী সাজা! তন্বীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে তানিয়া মেয়েটার দিকে চোখ টিপ মেরে শার্টটা গায়ে জড়ায় আবিদ। চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে তন্বীর উদ্দেশ্যে বের হয়। তন্বী মেয়েটার প্রতি এখন আর রুচি আসে না আবিদের। এতদিন সাথে থাকার পরও ছুঁতে অবধি দেয় না। কথাগুলো ভাবতেই তন্বীর প্রতি রাগ মাথায় চড়ে বসে আবিদের। মুহূর্তেই তানিয়ার সাথে কাটানো রঙিন মুহূর্তগুলোও মলিন লাগে। তন্বীকে যেকোন ভাবে হাসিল করার কামনা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে মনের। তন্বীর প্রতি রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে আবিদের।
দরজার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তন্বী। আবিদ আসার প্রতীক্ষা করছে সে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আদৃত আর আদিরার কথা। কোন এক অজানা কারণে আদৃতের পাশে অন্য কাউকে মেনে নিতে পারছে না তন্বী।
আবিদ আসে। তন্বীর চিন্তিত মুখ দেখে শয়তানি হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। হোটেলের দরজা বন্ধ করে ক্রুর হাসি হেসে এগোতে থাকে তন্বীর দিকে। আবিদের পরিবর্তিত ভাব-ভঙ্গি তন্বীর মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। তন্বী পিছাতে গেলে আবিদ তার চুলের মুঠি ধরে কাছে নিয়ে আসে। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে তন্বী। আবিদের নোংরা দৃষ্টি তন্বীর সারা শরীরে বিচরণ করছে। ঘৃণায় গা রিঁ রিঁ করছে তন্বীর। তন্বীর মুখের দিকে আগাতে থাকে আবিদ।
আদৃত অফিসে যায়নি আজ। বাসাতেই বন্দি রেখেছে নিজেকে। বারান্দা থেকে সরতে মন চাচ্ছে না তার। ফোন বাজছে কারো,রিংটোনটা অচেনা। রুমে আসতেই আদৃতের চোখে পড়ে আলমারির এককোণে তন্বীর ফোনটা পড়ে আছে। তন্বী ফোন এখানেই ফেলে গেছে? তন্বীর ফোনের ওয়ালপেপারে আবিদের ছবি। দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে আদৃত। সে যাকেই ভালোবেসেছে,সে-ই তাকে ছেড়ে গেছে। এটা কি তার ভুল নাকি নিয়তির খেলা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশাময় লাগছে আদৃতের। সবকিছু যেন তার অনুপস্থিতিতে ঘটে যাচ্ছে। সে যে আদৌ বেঁচে আছে কিনা এ নিয়েই সন্দিহান সে। তন্বীর ফোনটা চেক করতে লাগল আদৃত। আচমকা এমন কিছু জিনিস ধরা দিল আদৃতের চোখে যার কারণে সবকিছু উল্টো পাল্টা লাগতে শুরু করল আদৃতের।
চলবে…